প্রশ্নোত্তর :  অধ্যক্ষ মুফ্তী সৈয়দ মুহাম্মদ অছিয়র রহমান 

প্রশ্নোত্তর :  অধ্যক্ষ মুফ্তী সৈয়দ মুহাম্মদ অছিয়র রহমান 

 মুহাম্মদ আহসান উল্লাহ 
মুরাদনগর, সীতাকুন্ড, চট্টগ্রাম।
মুহাম্মদ আলমগীর
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
মুহাম্মদ ইহসানুদ্দিন
ছাত্র, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: সম্প্রতি রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামার সাহাবী হযরত আমিরে মু‘আবিয়াহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সহ জলীলুল কদর তিন প্রধান (হযরত সিদ্দিকে আকবর, হযরত ওমর ফারূক ও হযরত ওসমান গণি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) খলিফাদের নিয়ে কটূক্তি করেছে জনৈক মহিলা? তাঁদের খেলাফতকে অস্বীকার করে তাঁদের শানে মুনাফিক্ব বলা থেকে শুরু করে অনেক বেয়াদবী করেছে। ইদানিং আহলে বায়তে রসূল ও মাওলা আলীর প্রতি সম্মান ও ভালবাসা প্রদর্শন করতে গিয়ে ১ম, ২য় ও ৩য় খলিফাসহ সাহাবায়ে রাসূলের শানে পেইজবুক-অনলাইনসহ মিডিয়ায় চরম বেয়াদবী ও কটুক্তি পরিলক্ষিত হচ্ছে। সাহাবীদের সাথে বেয়াদবী করার শাস্তি কী? এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানিয়ে কৃতজ্ঞ করবেন।
উত্তর: প্রিয়নবী রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামার সাহাবী হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু একজন জলীলুল কদর কাতেবে ওহী ও মুজতাহিদ সাহাবী ছিলেন। তাঁকে কাফের, ফাসিক ছিলেন ইত্যাদি বলা বা মনে করা হারাম, নিন্দনীয় ও গুনাহের কারণ এবং গুমরাহীর নামান্তর, কারণ, সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা শান- মান, সাধারণ মুসলমান ও ওলী আবদালের চেয়ে অনেক অনেক ঊর্ধ্বে এবং তাঁদের শান-মানে নিন্দা বা গালমন্দ করা থেকে অথবা কু-ধারণা হতে বিরত থাকার জন্য প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বারবার সতর্ক করেছেন এবং কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছেন । যেমন- সহীহ বুখারী শরীফে বর্ণিত- عن ابي سعيد ن الخدرى رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لا تسبوا اصحابی فلوان احدكم انفق مثل احد ذهبا ما بلغ من مدهم ولا نصيفه  অর্থাৎ প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা আমার সাহাবীদেরকে গালমন্দ করো না। তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় সমান স্বর্ণ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় কর তবে তাঁদের এক মুদ বা অর্ধমুদ এর সম-পরিমাণ সাওয়াবও হবে না। [সহীহ্ বুখারী শরীফ, পারা-১৪] 
অপর হাদিসে উল্লেখ রয়েছে- প্রিয়নবী রাউফুর রহীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-عن ابن عمر قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا رايتم الذين يسبون اصحابي فقولوا لعنة [مشكواة اورجامع ترمذى، الله على شركم ৫৫৪] অর্থাৎ বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, তোমরা যখন ঔ সমস্ত লোকদেরকে দেখবে, যারা আমার সাহাবীদেরকে গালি দেয়, তখন বলবে তোমাদের এ ঘৃণ্য কাজের উপর আল্লাহর অভিশাপ। [জামে তিরমিযীর সূত্রে মিশকাত শরীফ, মানাকিব অধ্যায়, পৃ. ৫৫৪] 
সাহাবীদের মন্দ বলা, গালি দেয়া ও সমালোচনা করা প্রসঙ্গে প্রিয়নবী রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
والناس اجمعين  فمن سبهم فعليه لعنة الله والملائكة
অর্থাৎ যারা আমার সাহাবায়ে কেরামকে গালি দেয় তাদের উপর আল্লাহর, ফেরেস্তাগণের এবং সমস্ত মানুষের অভিশাপ।
[নুযহাতুল মাজালিস, কৃত, ইমাম আব্দুর রহমান সফূরী রহমাতুল্লাহি আলায়হি, ২য় খন্ড, ৫২০ পৃ.] 
সাহাবীদের সম্মান করা প্রসঙ্গে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-اكرموا اصحابي فانهم خياركم অর্থাৎ তোমরা আমার সাহাবায়ে কেরামকে সম্মান করো, কেননা তাঁরা তোমাদের চেয়ে অনেক উত্তম।  [মেশকাত শরীফ, পৃ. ৫৫৪ ]
আর আমীরে মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু একজন প্রখ্যাত সাহাবী ছিলেন। তাঁর ফজীলত বা মর্যাদা প্রসঙ্গে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। স্বয়ং হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁর জন্য দোয়াও করেছেন। হাফেজুল হাদিস হারেস ইবনে ওসামা একটি বড় হাদীস শরীফ রেওয়ায়ত করেছেন। যার মধ্যে খোলাফায়ে রাশেদীন ও অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামের ফজীলতসমূহ বর্ণিত রয়েছে। উক্ত হাদীসে হযরত আমীরে মুয়াবিয়া সম্পর্কে বর্ণিত আছে- প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-ومعاوية ابن ابي سفيان اعلم امتى واجودها অর্থাৎ হযরত আমিরে মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু আমার উম্মতের বড় জ্ঞানী, ও বড় দানবীর।  [তাতহীরুল জিন্নাহ্ ও হযরত আমীরে মুয়াবিয়া পর এক নজর কৃত. হাকিমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী রহ.] 
উল্লেখ্য যে, সমস্ত ওলামা-মাশায়েখ, মুহাদ্দেসীন, তাবেয়ীন ও তবে তাবেয়ীন ও সাহাবায়ে কেরাম হযরত আমীরে মুয়াবিয়ার প্রশংসা করেছেন। যেমন ইমাম কস্তালানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর শরহে সহীহ বোখারীতে উল্লেখ করেছেন যে, হযরত আমির মুয়াবিয়া একান্ত প্রশংসার পাত্র ও অনেক মহৎ গুণাবলীর অধিকারী। তিনি ন্যায়পরায়ণ, জ্ঞানী, ভদ্র, দয়ালু, বুদ্ধিমান, ওহী লেখক সাহাবী ছিলেন। শুধু তাই নয়, হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হতে ১৬৩টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। সহীহ বুখারী শরীফে ৪টি, সহীহ মুসলিম শরীফে ৫টি হাদীস এককভাবে স্থান পেয়েছে। তাছাড়া বাকী হাদিস শরীফসমূহ হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে উল্লেখ রয়েছে। আর সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের আক্বীদা বা দৃঢ় বিশ্বাস হলো- جماعة الصحابة رضي الله عنهم كلهم عدول  অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরামের সকলেই ন্যায়পরায়ণ ও নির্ভরযোগ্য। কিয়ামত পর্যন্ত এ উম্মতে মুসলিমার জন্য তারা অতুলনীয় আদর্শ।  [শরহে আকায়েদে নাসাফী, কৃত, আল্লামা ইমাম সাদ উদ্দীন তাফতাযানী (রহ.) ]
উক্ত কিতাবে আরো উল্লেখ রয়েছে, সাহাবায়ে কেরামের একজনকে বেশি মুহাব্বত করে অন্যজনের সাথে শত্রুতা পোষণ করার কোন সুযোগ নেই। এ কারণে সাহাবায়ে কেরামের ভালো দিকগুলো আলোচনার কেবল বৈধতা রয়েছে। উল্লেখ্য, যেভাবে আহলে বায়তের প্রতি অতি ভক্তি-ভালবাসা প্রদর্শন করতে গিয়ে যে কোন সাহাবির শানে বেয়াদবী ও কটুক্তি করা হারাম ও বেঈমানী। তদ্রুপ সাহাবায়ে কেরামের প্রতি অতি মহব্বত প্রদর্শন করতে গিয়ে আহলে বায়তের প্রতি বেয়াদবী ও কটুক্তি করা হারাম ও বেঈমানী। আহলে বায়ত ও সাহাবায়ে কেরামের সবাইকে ভালবাসা ও সম্মান প্রদর্শন করা ঈমানের দাবি ও জরুরি। [শরহে আকায়েদে নসফী কৃত. ইমাম তাফতাজানী রহ.।]   
 لا يجوز ذكر هم الا بالخير حبهم من علامات الايمان من ابغضهم فقد كفر ونافق وطغى অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরামের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র তাদেরকে ভালো দিক নিয়েই আলোচনার বৈধতা আছে। তাদেরকে ভালোবাসা ঈমানের আলামত। যারা তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে তারা নাফরমানী, মুনাফেকী এবং সীমালঙ্ঘন করে। 
[শরহে আকায়েদে নসফী] 
প্রিয়নবী রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বেসাল বা ওফাত শরীফের পর হযরত সিদ্দিকে আকবার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ইসলামের প্রথম খলিফা। এর উপর সকল সাহাবা, আনসার, মুহাজেরীন ঐক্যমত হয়ে সিদ্দিকে আকবারের খেলাফত ও আনুগত্যের উপর সবাই এমনকি হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুসহ বায়আত গ্রহণ করেছেন। এভাবে পরবর্তীতে দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর ফারূক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাতের পর তৃতীয় খলীফা হযরত ওসমান জিন্নুরাঈন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফত ও আনুগত্যের উপর সকল সাহাবী ও হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুসহ সবাই বায়আত কবুল করেছেন। তারপর চতুর্থ খলীফা হযরত মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতের উপর সাহাবিয়ে রাসূল ও তাবেঈনগণ আনুগত্য প্রদর্শন করে বায়আত গ্রহণ করেছেন। সুতরাং এ তিনজনকে মুনাফিক্ব বলা বেঈমানী।
 
উপরোক্ত আলোচনা হতে প্রতীয়মান হয় যে, সাহাবাযে কেরামের প্রতি ভালবাসা পোষণ করা, সম্মান করা, শ্রদ্ধা করা ওয়াজিব এবং রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সম্মান করার নামান্তর। তাছাড়া সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে ভাল ধারনা পোষণ করা, সাথে সাথে (আহলে বায়তে রসূলের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান ও ভক্তি-প্রদর্শন ঈমানের পরিচয় এবং তাঁদের আহলে বায়ত ও সাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারে মন্দ ধারনা করা মুনাফেকির আলামত)। যেকোন সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে কু-ধারণা হতে বেঁচে থাকা অপরিহার্য। স্বয়ং হযরত সিদ্দিকে আকবর, হযরত ওমর ফারূকে আযম,  হযরত ওসমান গণি, হযরত মাওলা আলী মুশকিল কোশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমসহ কোন সাহাবী, সম্মানিত তাবেঈন, তবে তাবেঈন, মাযহাবের ইমামগণ এবং  তরিকতের শাইখগণ সকলেই হযরত আমির মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে বে-ঈমান, মুনাফেক ও ফাসেক বলেননি। বরং প্রশংসা করেছেন। এমনকি হযরত আমির মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে হযরত ওমর ফারূকে আজম ও হযরত ওসমান জিন্নুরাঈন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা উভয়ে তাদের খেলাফতের সময় সিরিয়াসহ বিভিন্ন বড় বড় শহর ও প্রদেশে আমীর, গভর্ণর নিযুক্ত করেছেন। এমনকি হযরত মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতের সময় হযরত আমির মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর মধ্যে যুদ্ধ-বিদ্রোহ ও উভয়ের সৈন্যবাহিনীর মধ্যে খুনাখুনি যা হয়েছে তারপরও হযরত মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও মাওলা আলীর অনুসারী সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনে ঈযাম হযরত আমির মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ও তাঁর পক্ষের যারা ছিলেন সাহাবায়ে কেরাম ও সম্মানিত তাবেঈনে ঈযামকে ফাসিক, মুনাফিক ও ইসলাম হতে খারিজ হয়েছে বলেন নাই। বরং উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ-বিদ্রোহ, যা সংঘটিত হয়েছে, তা ছিল হযরত আমির মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর ইজতিহাদগত ভুল। এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ইমাম, মুহাদ্দিস, ফকিহ্, মুফাস্সিরিনে কেরামের চূড়ান্ত ফয়সালা। আর ইজতিহাদগত ভুল ক্ষমাযোগ্য। বরং মুজতাহিদের ভুল ইজতিহাদেও একটি সাওয়াব তথা পুরস্কার রয়েছে। এ কারণে তাঁদের সমালোচনা করা বা মন্দ বলা হারাম। তদ্রুপ হযরত সিদ্দিকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত ওসমান গণি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু একের পর এক প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের ইনত্কোল শরীফের পর খলীফা ছিলেন না- একমাত্র মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু খলীফায়ে বরহক, তাকে খলীফা নিযুক্ত করেছেন স্বয়ং রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম স্বীয় হায়াতে জাহেরায় তথা ওফাত শরীফের পূর্বে কিন্তু হযরত আবু বকর, হযরত ওমর ফারূক ষড়যন্ত্র করে হযরত আলী থেকে খেলাফত ছিনিয়ে নিয়েছেন বলা আর হযরত আবূ বকর, হযরত ওমর ও হযরত ওসমানকে মুনাফিক বলা তাদের খেলাফতকে অস্বীকার করা, তাদের শানে কাফির, মুনাফিক ও ফাসিক এ জাতীয় শব্দ প্রয়োগ করা শিয়া রাফেজী, ভন্ড ও মুনাফিকের চরিত্র। কোন প্রকৃত ঈমানদারের চরিত্র হতে পারে না। এদেরকে যারা মুনাফিক বলে তারাই প্রকৃত ও আসল মুনাফিক। এদেরকে গুনিয়াতুত্ তালেবীনে হুযুর সায়্যিদুনা পীরানে পীর গাউসুল আজম দস্তগীর শেখ সুলতান সৈয়দ আবদুল কাদের জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু (كلاب النار) কেলাবুন নার তথা জাহান্নামের কুকুর বলেছেন এবং ইমামে আহলে সুন্নাত মুহাদ্দিসে আজম ও ফকিহে আজম আলা হযরত শাহ্ আহমদ রেযা ফাযেলে বেরলভী (রহ.) তার রচিত ইলমে ফিক্বহের বিশাল ভা-ার ফতোয়ায়ে রজভীয়া শরীফের নবম খ-ে এ ধরনের শিয়া, রাফেজীদেরকে ফোকাহায়ে কেরামের নির্ভরযোগ্য উদ্ধৃতি ও রেফান্সের আলোকে কাফির, বেঈমান, ফতোয়া দিয়েছেন। আরো বলেছেন, ومن شك فى كفرهم فهو ايضًا كافر যারা এসব বেয়াদব, গোস্তাখ, শিয়া ও রাফেজীদের কুফরির বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করবে তারাও কাফির, বেঈমান হয়ে যাবে। সাবধান, এ ধরনের বেয়াদব শিয়া, রাফেজীদের খপ্পরে ঈমানহারা হয়ে যাবেন না। আল্লাহর দরবারে পানাহ্ চাই। 
[ফতোয়ায়ে রজভীয়া, নবম খন্ড,  শরহে আকায়েদে নসফী ও শরহুল মাওকিফ ইত্যাদি]   
 
 মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল কাদের 
পটিয়া, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: আহলে বায়ত কারা। ক্বোরআন ও হাদীসের আলোকে তাঁদের পরিচয় জানালে উপকৃত হব। 
উত্তর: প্রিয় নবী আক্বা ও মাওলা হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র বংশধর ও পরিবারের সদস্যগণকে আহলে বায়তে রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলা হয়। এটা অধিকাংশ ইমামগণের অভিমত। আহলে বায়ত বলতে প্রিয়নবী হুযূর পুরনুর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রিয়ভাজন ও ¯েœহের পাত্র তথা নিকটাত্মীয়গণকে বুঝানো হয়। নবীয়ে দোজাহাঁ রাহমাতুল্লিল আলামীনের নিকটাত্মীয় প্রসঙ্গে পবিত্র ক্বোরআনুল হাকীমে মহান আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন- قل لا اسئلكم عليه اجرًا الا المودة فى القربى অর্থাৎ (হে নবী) আপনি বলে দিন যে, আমি (রসূল) তোমাদের নিকট কোন বিনিময় চাইনা, আমার বংশধরগণের ও নিকটাত্মীয়দের ভালোবাসা ব্যতীত।  [আল ক্বোরআন: সূরা শুআরা, আয়াত-২৩] 
প্রিয়নবী ইমামুল মুরসালিন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটাত্মীয় প্রসঙ্গে এ আয়াতে পাক নাযিল হলে সাহাবীদের অন্তরে এ প্রসঙ্গে জানতে প্রবল ইচ্ছা জাগে। ফলে সাহাবায়ে কেরাম হুযুর পুরনূর রাহমাতুল্লিল আলামীনের দরবারে আরয করে জানতে চাইলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার নিকটত্মীয় কারা? এর জবাবে প্রিয়নবী সরওয়ারে কায়েনাত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন (আহলে বায়ত হলেন) হযরত আলী, হযরত ফাতিমা, হযরত ইমাম হাসান ও হোসাঈন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম এবং তাদের উভয়ের বংশধর তথা আওলাদ। আহলে বায়তের পরিচয় প্রদানে বহু হাদিস, শরীফ রয়েছে। যেমন- عن ام سلمة رضى الله عنها ان رسول الله صلى الله عليه وسلم جمع عليًا وفاطمة وحسنا وحسينا رضى الله تعالى عنهم ثم ادخلهم تحب ثوبه ثم قال اللهم هؤلاء اهل بيتى [طبرانى] অর্থাৎ হযরত উম্মে সালমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা হতে বর্ণিত, একদিন নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত মাওলা আলী, হযরত ফাতিমা, হযরত ইমাম হাসান-হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমকে একত্রিত করেছেন এবং তাদেরকে একটি কাপড়ে আবৃত করে নিলেন। অতঃপর বললেন, হে আল্লাহ, এরা আমার আহলে বায়ত। [তাবরানী: আল মুজামুল কবির, হাদীস-২৬৬৩]
অপর হাদীসে উল্লেখ আছে- عن سعد بن ابى وقاص رضى الله عنه قال لما انزل الله هذه الاية تعالوا ندع ابناءنا وابناءكم ونساءنا ونسائكم الاية ـ دعا رسول الله صلى الله عليه وسلم عليا وفاطمة وحسنا وحسينا فقال اللهم هؤلاء اهلى [رواه مسلم) অর্থাৎ হযরত সা’দ বিন আবূ ওয়াক্কাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, যখন ‘মুবাহালা (একে অপরকে অভিসম্পাৎ করা) এর আয়াত ‘‘আপনি বলে দিন, এসো! আমরা আমাদের সন্তানদের ডাকছি, আর তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে ডাক।’’ তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী, হযরত ফাতিমা, ইমাম হাসান-হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমকে ডাকলেন। অতঃপর বললেন, হে আল্লাহ্ এরা আমার পরিবারবর্গ তথা আহলে বায়ত। [সহি মুসলিম]
এভাবে অসংখ্য হাদীসে পাক আহলে বায়তে রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পরিচয় বর্ণিত রয়েছে। যাদের পবিত্রতার ব্যাপারে ক্বোরআনে পাকে বর্ণিত রয়েছে এবং এ প্রসঙ্গে আর একটি হাদীস পাকেও বর্ণনা পাওযা যায়। عن ابى سعيد الخدرى رضى الله عنه فى قوله انما يريد الله ليذهب عنكم الرجس اهل البيت ويطهركم تطهيرًا قال نزلت فى خمسة فى رسول الله صلى الله عليه وسلم وعلى وفاطمة والحسن والحسين [ طبرانى] অর্থাৎ হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু আল্লাহর বাণী ‘হে নবী পরিবার। নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা চান তোমাদের অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পাক-পবিত্র করতে। [সূরা আহযাব] এ আয়াত সম্পর্কে বলেন যে, এ আয়াত এ পাঁচ মনীষী সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। [তাবরানী আল মু’জামুস্ সগীর, হাদীস নং-৩২৫] 
প্রতীয়মান হলো যে, আহলে বায়ত হলেন, শেরে খোদা হযরত আলী, হযরত ফাতিমা জাহরা, হযরত ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম ও তাঁদের সন্তানগণ। তাই আহলে বায়ত তথা নবী বংশধরদের ভালবাসা, তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা, অন্তরে ভক্তি শ্রদ্ধা রাখা প্রতিটি মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব। তাফসীর ও হাদীস বিশারদগণ প্রিয়নবীর বিবিগণকেও আহলে বায়তের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। 
 
 মুহাম্মদ ইনজামামুল হক রাকিব
বাহারচড়া, বাশঁখালী, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: যারা আল্লাহর রাসূলের বংশধর তথা আহলে বায়তের সাথে বেয়াদবী করে তাদের বিষয়ে কী হুকুম? কুরআন ও হাদীসের প্রমাণসহ জানানোর আবেদন রইল।
উত্তর: মহান আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর প্রিয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সকল সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। সৃষ্টির সকল কিছু তাঁর নূর হতেই সৃজিত। নবীয়ে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম- এর মর্যাদা যেমন তুলনা করা যায় না তেমনি তাঁর প্রকৃত ঈমানদার বংশধরের মর্যাদাও পৃথিবীতে অতুলনীয়। আহলে বায়ত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)কে ভালোবাসা আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশ। ক্বোরআন পাকে মহান রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন-  قل لا اسئلكم عليه اجرا الا المؤدة في القربي অর্থাৎ হে আমার প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম! আপনি বলুন (হে উম্মত) আমি তোমাদের নিকট ইসলাম, ঈমান, ক্বোরআন ইত্যাদি প্রদানের কারণে কোন বিনিময় চাই না, নিকট আত্মীয়দের (আমার বংশধরের) ভালোবাসা ছাড়া। (সূরা শুরাঃ আয়াত- ২৩) 
পবিত্র কোরআনেই আল্লাহ্ তা’আলা নবী বংশের প্রতি মহব্বত বা ভালোবাসাকে অপরিহার্য করে দিয়েছেন। বিদায় হজ্জের সময় রাসূল পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-يا ايها الناس انى تركت فيكم ما أن اخذتم به لن تضلوا كتاب الله وعترتى اهل بيتي
অর্থাৎ হে মানব জাতি! আমি তোমাদের মাঝে যা রেখে যাচ্ছি, যদি তোমরা তা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর তাহলে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। তাহলো আল্লাহর কিতাব এবং আমার আহলে বায়ত। [তিরমিজি শরীফ] 
মূলত নবী বংশের প্রতি ভালোবাসা মানে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ভালোবাসা। আর তাদের প্রতি বিদ্বেষ মানে আল্লাহ্ জাল্লাশানুহু ও প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি বিদ্বেষ রাখার নামান্তর। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলে আকরম সরকারে দু’আলম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘শপথ সেই সত্তার যার নিয়ন্ত্রণে আমার প্রাণ! যে কেউই আমার আহলে বায়তের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে আল্লাহ্ তা’আলা তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। [সহীহ ইবনে হিব্বান]
সুতরাং যারা নবী বংশের সাথে শত্রুতা পোষণ করবে, কিয়ামত দিবসে আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে রহমত হতে বঞ্চিত করবেন। এবং সে কাফের অবস্থায় মৃত্যু বরণ করবে। সাবধান! হুযূর পুরনূর নবীয়ে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বংশধরের সাথে শত্রুতা পোষণকারী জান্নাতের সুঘ্রাণ ও পাবে না। বরং তারা লা’নতের যোগ্য হয়ে যায় । 
উল্লেখ্য যে, আহলে বায়তে রাসূল ও নবী বংশের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন ঈমানের দলিল। এবং তাঁদের শানে বেয়াদবী ও কটূক্তি ঈমানকে ধ্বংস করে দেয়। তাদেরকে কষ্ট দেয়া মূলত প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে কষ্ট দেয়া- যা অসংখ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। উল্লেখ্য যে, প্রিয় নবীর আওলাদে পাক ও আহলে বায়তের প্রতি মহব্বত ও সম্মান প্রদর্শন ঈমানদারের জন্য ফরয তথা অপরিহার্য বিষয় তদ্রুপ সাহাবায়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি মহব্বত ও ভালোবাসা এবং সম্মান প্রদর্শন করাও জরুরী এবং অপিরিহার্য। প্রিয় রাসূলের আওলাদ ও আহলে বায়তের প্রতি ভালোবাসার দাবীদার হয়ে সাহাবায়ে কেরামের কারো শান-মানে বেয়াদবী করা অবশ্যই হারাম ও মুনাফেকী। তাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জমাতের অনুসারীগণ নবীজীর আওলাদ পাক ও আহলে বায়তে রাসূলকে যেভাবে ভক্তি-শ্রদ্ধা ও ভালোবাসেন তা সাহাবীয়ে রাসূলের সকলের খেদমতেও শ্রদ্ধা সম্মান ও ভালোবাসা প্রদর্শন করেন। নেজাত প্রাপ্ত জান্নাতী দলের এটা অন্যতম আদর্শ।
[তাফসীরে কবির কৃত: ইমাম রাযী রহ., মেরকাত শরহে মেশকাত কৃত: শেখ মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী রহ., খোতবাত কৃত: ফকিহে মিল্লাত মুফতি জালাল উদ্দীন আমজাদী, আশ্ শারফুল মুয়াব্বদ লে আলে মুহাম্মদ (দ.) কৃত: আল্লামা ইউসুফ নিবহানী রহ. ও তরজুমানে আহলে সুন্নাত মহররম সংখ্যা সমূহ ইত্যাদি]
 
 সৈয়দ মুহাম্মদ মেহেদী হাসান
ছাত্র, সোবহানিয়া আহমদিয়া হাফেজিয়া মাদরাসা,
শাহপুর দরগাহ্ শরীফ, কুমিল্লা।
প্রশ্ন: টিভিতে নামধারী এক আলেমের মুখে শুনেছি, ওলীদের মাজারে জিয়ারত করা যাবে না, যিয়ারত করা কবর পূজা করার নামন্তর। যারা যিয়ারতের পক্ষে কথা বলে তাদেরকে মাযার পূজারি বলে আখ্যায়িত করে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। ইসলামি শরীয়ত মোতাবেক কবর বা মাযার যিয়ারত কতটুকু শরিয়ত সম্মত? আর যারা যিয়ারতকে বিধর্মীদের পূজা অর্চনার সাথে তুলনা করে থাকে ইসলামী রীতি অনুযায়ী তাদের বিধান কি? তাদের পিছনে নামায পড়া যাবে কিনা? বিস্তারিত জানালে কৃতজ্ঞ হব।
উত্তর: মুসলমানের কবর যিয়ারত একটি অতীব বরকতমন্ডিত সুন্নাত ও পূণ্যময় আমলের নাম। যা মুসলিম বিশ্বে যুগযুগ ধরে প্রচলিত। যিয়ারত করার সময় কবর বা মাযারের সম্মুখে গিয়ে কবরবাসীকে সালাম আরজ করে নিষ্ঠার সাথে ও আল্লাহর কালাম পবিত্র কুরআনুল করীমের সূরা-কেরাত ও দরুদ শরীফ তিলাওয়াত করা হয়। পরিশেষে, জিন্দা- মুর্দা সকলের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া-মুনাজাত করা হয়। আল্লাহর প্রিয়তম হাবিব হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লামার অগণিত হাদিস শরিফ দ্বারা যিয়ারতের বৈধতা প্রমাণিত। তাই সর্ব সম্মতিক্রমে  যিয়ারত ইসলামি শরিয়ত সম্মত ও প্রিয়তম রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামার বরকতময় সুন্নাত। হাদিস পাকে অসংখ্য বর্ণনা আছে, প্রিয় নবী হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজে যিয়ারত করেছেন, এমন কি যিয়ারত করার জন্য তিনি উদ্বুদ্ধও করেছেন। যেমন- রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-كنت نهيتكم عن زيارة القبور فزورها فانها تزهد فى الدنيا وتذكر الاخره وفى رواية فان فى زيارتها تذكرة وفى رواية فانها تذكركم الموت وفى رواية فان لكم فيها عبرةً  অর্থাৎ – আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করা থেকে নিষেধ করতাম, এখন তোমরা কবর যিয়ারত করো। কেননা যিয়ারত দুনিয়ার প্রতি অনিহা সৃষ্টি করে এবং পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অন্য বর্ণনায় এসেছে নিশ্চয় কবর যিয়ারতে মৃত্যুর/কবরবাসীর স্মরণ হয়। অন্য বর্ণনায় রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন তোমরা কবর যিয়ারত কর, নিশ্চয় কবর যিয়ারতে তোমাদের জন্য উপদেশ নিহিত আছে। 
(সুনানে ইবনে মাযাহ, ৪/৫০১প ৃ, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, ৩/৫৬৯ পৃ, সুনানে কুবরা ৪/১২৮ পৃ. ও সুনানে আবি দাউদ ইত্যাদি)
হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজেও যিয়ারত করেছেন মর্মে হাদিস পাকে অগণিত বর্ণনা রয়েছে। যেমন-ان رسول  الله صلى الله عليه وسلم كان ياتى قبور الشهداء باحد على راس كل حول فيقول : سلام عليكم بما صبرتم فنعم عقبى الدار قال وجاءها ابو بكر ثم عمر ثم عثمان رضى الله عنهم অর্থাৎ- প্রত্যেক বছরের মাথায় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম উহুদের যুদ্ধে শাহাদত প্রাপ্ত সম্মানিত শহীদগণের কবরে যেতেন এবং তাঁদের জন্য দোয়া করতেন। আর বলতেন, তোমাদের উপর শান্তির ফোয়ারা বর্ষিত হোক অনর্গল। তোমরা যে ধৈর্য প্রদর্শন করেছ কতই উত্তম সমাপনি তথা আখিরাতের আবাসস্থল। এভাবে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু উহুদের কবরস্থানে যিয়ারতে আসতেন। 
[ক. ওমর ইবনে শুব্বাহ, তারিখে মাদিনা লি ইবনে  শুব্বাহ ১/১৩২ পৃঃ, জিদ্দা থেকে প্রকাশিত খ. আব্দুর রাজ্জাক,  আল মুসান্নাফ, ৩/৫৭৩. মাকতাবাতুল ইসলামিয়া, বৈরুত] 
সুতরাং ইসলামি শরিয়তের ফায়সালা অনুযায়ী যিয়ারত এক অনুপম ইবাদত। প্রত্যেক ইবাদত দ্বীন বা ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একজন মুসলমান হয়ে দ্বীনের কোন বিষয়কে বিধর্মীদের পূজা অর্চনার সাথে তুলনা করে তিরস্কার বা হেয় প্রতিপন্ন করা সম্পূর্ণ কুফরি। যেমন- সৌদি আরবের সাবেক গ্রান্ড মুফতি ওহাবী নযদীদের অন্যতম গুরু আবদুল আযিয বিন আবদুল্লাহ্ বিন বাযের কিতাবে রয়েছে-الاستهزاء بالاسلام او بشئ منه كفر اكبر অর্থাৎ- যে কেউ ইসলাম বা ধর্মের কোন বিষয় নিয়ে ঠাট্টা করে সে জঘন্যতম কুফরি করল।  (আব্দুল্লাহ্ ইবনি বায; মাযমুয়ায়ে ফাতোয়া, পষ্ঠা-১০/২৬১)। 
যেমন-আযান ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আযানের মুক্তাঝরা ধ্বনির মাধ্যমে বান্দাগণকে নামাযের প্রতি আহ্বানে সচেতনতা সৃষ্টি করা হয়। কেউ যদি সেই আযানকে বিদ্রুপ করে, শরিয়তের ফায়সালা অনুযায়ী সে কাফের হয়ে যাবে। হানাফি মাযহাবের বিশ্ববিখ্যাত ফিকহের কিতাব আল আশবাহ্ ওয়ান নাজায়েরে আল্লামা শায়খ ইবনে নুজাইম মিসরি হানাফী রহমাতুল্লাহি আলায়হি উল্লেখ করেন- الاستهزاء بالاذان كفر    ‘আযানকে হেয় প্রতিপন্ন করা কুফরি। 
(আল্লামা ইবনে নুজাইম মিসরি; কিতাবুল আশবাহ ওয়ান  নাজায়ের ১৬০পৃ, দারুল কুতুবে ইলমিয়া বৈরুত, লেবনান) 
হাদীসের পবিত্র ভাষ্যনুযায়ী যিয়ারত যেহেতু সুন্নাত হিসেবে বিবেচিত, যিয়ারতকে অবজ্ঞা বা হেয় প্রতিপন্ন করা মানে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র মহিমান্বিত সুন্নাতকে হেয় করা, যা জঘন্য কুফরি। ওহাবী মুফতি মুহাম্মদ বিন ইবরাহিম বিন আব্দুল লতিফ লিখেছেন-الاستزاء  بسنة رسول الله صلى الله عليه وسلم الصريحة كفر بلا ريب অর্থাৎ- হযরত রাসূলে মাকবুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামার পবিত্র সুন্নাতকে হেয় প্রতিপন্ন করা সুস্পষ্ট কুফরি এতে কোন সন্দেহ নেই।  [মুহাম্মদ বিন ইবরাহিম বিন আবদুল লতিফ;  রসায়েল সমাহার ১/১৭৪পৃ.] 
কবর যিয়ারতকে কবর পূজা বলে কটুক্তিকারীদের গুরুদের রচিত পুস্তক থেকে রেফারেন্স দেয়া হল, যাতে অন্তরে শুভবুদ্ধির উদয় হয় এবং এ ধরনের বেয়াদবী থেকে খালিস নিয়তে তাওবা করে। আল্লাহ্ তা‘আলা হেদায়ত দান করুক। আমিন। 
উল্লিখিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহর পূণ্যবান বান্দাগণের মাযার বা সাধারণ মুসলমানদের কবর যিয়ারত অত্যন্ত ফজিলত পূর্ণ আমল। সুতরাং একজন মুসলমান হয়ে শরিয়ত সমর্থিত কোন ইবাদত আমলকে এভাবে বিধর্মীদের পূজা অর্চনার সাথে তুলনা করা উপহাসের নামান্তর; যা সম্পূর্ণ কুফরি। মসজিদের খতিব বা টিভির পর্দায় যারা যিয়ারতের মতো ধর্মীয় একটি বিষয়কে পূজার সাথে তুলনা করে তাদের প্রত্যেকের উপর তাওবা এবং নতুনভাবে কলমা পড়া ওয়াজিব। কলমা পড়া ও খালিচ অন্তরে তওবা করার আগ পর্যন্ত সেসব খতিব বা ইমামের পেছনে নামাযে ইকতিদা করা যাবে না।
 
প্রশ্ন: মসজিদের ইমাম সাহেব যখন ফরয নামায পড়ান, তখন মাইক্রোফোন ইমাম সাহেবের পাঞ্জাবীর সাথে লাগানো থাকে। ইমাম সাহেব সিজদায় যাওয়ার সময় মাইক্রোফোনের তার এক হাতে সরিয়ে দেন। যাতে সিজদা দেওয়ার সময় পায়ের সাথে লেগে না যায়। এভাবে নামাযাবস্থায় মাইক্রোফোনের তার নিজ হাতে সরিয়ে দিলে নামায হবে কিনা? জানিয়ে কৃতজ্ঞ করবেন।  
উত্তর: নামাযের ফরজ-ওয়াজিব বাদ পড়লে যেমন নামায নষ্ট/ফাসেদ হয়ে যায় তেমনি ‘মাকরূহে তাহরীমীর কারণেও উক্ত নামায পুনরায় আদায় করতে হয়। আর ‘মাকরূহে তানযীহী’র কারণে উক্ত নামায পুনরায় আদায় করতে হয় না। মাকরূহে তাহরীমীর মধ্যে রয়েছে, নামাযরত অবস্থায় কাপড়, দাড়ি বা শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে খেল-তামাশা করা, নামায অবস্থতায়, অযথা ও অনর্থক বেশী নড়াচড়া করা, উভয় হাতে কাপড় টেনে ধরা, যেমন- সিজদায় যাওয়ার সময় সামনে এবং পেছন থেকে জামার আস্তিন বা অন্য কোন কাপড় অথবা পায়জামা দু’হাতে টেনে ধরা এবং নামাযে আস্তিন উপরের দিকে এমনভাবে কুড়িয়ে নেয়া, যাতে হাতের কুনুইগুলো প্রকাশ পায়, তখন নামায ‘মাকরূহে তাহরীমী’ হবে। তদ্রুপ নামাযরত অবস্থায় টুপি, পাগড়ী অথবা মাইক্রোফোন পড়ে গেলে উভয় হাতে উঠানো অথবা একই নামাযে মাইক্রো ফোনের তার বারবার সরানো ‘আমলে কসীর’ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় এবং এতে নামাজের খুশু-খুযু এবং একাগ্রতায় ব্যাঘাত ঘটে। সুতরাং ইমাম সাহেব নামাযরত অবস্থায় বারবার এভাবে উভয় হাতে মাইক্রোফোনের তার সরিয়ে নামায পড়া মাকরূহে তাহরীমী। এক্ষেত্রে অবশ্যই গুনাহগার হবে। তবে মাইক্রোফোনের কারণে রুকু -সিজদা করতে যেন অসুবিধা না হয় সেভাবে জামার সাথে মাইক্রোফোন ভালভাবে লাগালে (যেন পড়ে না যায়) অসুবিধা নেই । আর টুপি ও মাইক্রোফোন নামাযরত অবস্থায় হঠাৎ পড়ে গেলে তখন উভয় হাত ব্যবহার না করে শুধু এক হাতে টুপি মাথায় ও মাইক্রোফোন জামা বা পাঞ্জাবীতে লাগালে মাকরূহে তাহরীমার অন্তর্ভুক্ত হবে না। তবে ইমাম/মোক্তাদীসহ সকল মুসল্লী অবশ্যই সজাগ ও সতর্ক থাকবে যেন এ রকম বারবার না হয়। [ফতোয়া-এ রজভীয়া, ৩য় খন্ড ও আহকামে শরিয়ত কৃত, ইমাম আলা হযরত শাহ আহমদ রেযা রহ., ফতহুল কদির শরহে হেদায়া, কৃত ইমাম ইবনে হুম্মাম হানাফী রহ., আল বাহরুর রায়েক- কৃত ইমাম ইবনে নুজাইম মিসরী হানাফী রহঃ ও আদ্ দুরুল মোখতার কৃত, ইমাম আলাউদ্দিন খাচকপি হানাফী রহ.]
 
 মুহাম্মদ নুর আহমেদ আল ওমর
রাঙ্গুনীয়া, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: আমরা জানি, পঞ্জেগানা নামায ও রমজানের ফরয রোযা এমন ইবাদত যা প্রত্যেক বালেগ-বালেগা নারী-পুরুষের আদায় করা অপরিহার্য বিষয়। অনেক মুসলিম নর-নারী ফরয নামায-রোযা আদায় না করে মারা যায়। সুতরাং মুসলিম মৃত ব্যক্তির কাযা/ অনাদায়ী ফরয নামাযের ও ফরয রোযার বিধান কি? জানালে উপকৃত হব ।
উত্তর: পঞ্জেগানা নামায ও রমজানের ফরয রোযা এমন ইবাদত যা প্রাপ্ত বয়স্ক সকল হুশ-বুদ্ধিসম্পন্ন মুসলিম নর-নারীর উপর ফরয। যদি কারো জিম্মায় ফরয নামায ও ফরয রোযা অনাদায়ী থাকে এবং এমতাবস্থায় সে মৃত্যু বরণ করে, অসিয়ত করে থাকলে এবং সম্পদ রেখে গেলে পরিত্যক্ত সম্পদের এক তৃতীয়াংশ দ্বারা গরীব- মিসকিন, অসহায় ব্যক্তিকে (যারা যাকাত-ফিতরার হকদার) বিতিরের নামায সহ দৈনিক ছয় ওয়াক্ত নামায হিসাব করে প্রতি ওয়াক্তের জন্য অর্ধ ‘সা’ তথা ২ কেজি ৫০ গ্রাম পরিমাণ গম বা তার মূল্য নামাযের ফিদয়া বা কাফ্ফারাসহ আদায় করতে হবে। দৈনিক প্রত্যেক ফরয রোযার ফিদয়া বা কাফফারাও প্রতি ওয়াক্ত নামাযের ন্যায়। মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদের এক তৃতীয়াংশ যদি নামায রোযার ফিদয়ার জন্য যথেষ্ট না হয় বা ওয়ারিশগণের পক্ষে ও ফিদয়া আদায় করা অসম্ভব হয় তবে কমপক্ষে এক ওয়াক্ত নামায বা একটি ফরয রোযার ফিদয়া অথবা যতটুকু সম্ভব তা নির্ধারণ ও হিসেব করে ফকির-মিসকিনকে মৃত ব্যক্তির পক্ষে প্রদান করবে এবং ফকির-মিসকিন তা গ্রহণ করে উক্ত ফিদয়া/ কাফ্ফারা উক্ত দাতাকে হেবা করবে, তারপর দাতা মিসকিনকে পুনরায় দিবে- ফকির/মিসকিন তা গ্রহণ পূর্বক পুনরায় উক্ত ফিদয়া/কাফ্ফারা দাতাকে হেবা করবে। এভাবে একে অপরের মধ্যে আদান-প্রদান করতে থাকবে যতক্ষণ না সব কাফ্ফারা বা ফিদয়া আদায় হয়। যেমন হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত ফিকহের কিতাব ‘আদ্দুররুল মুখতারে’ উল্লেখ রয়েছে- لومات وعليه صلواة فائتة وأوصى بالكفارة يعطى لكل صلواة نصف صاع من بر كالفطرة كذا حكم الوترو الصوم وانما يعطي من ثلث ماله ولو لم يترك مالا يستفرض وارثه نصف صاع مثلا ويدفعه للفقير ثم يدفعه الفقير للوارث অর্থাৎ আর মৃত ব্যক্তি যদি ধন-সম্পদ রেখে যায় এবং নামায ও রোযার কাফ্ফারা/ফিদয়া আদায়ের জন্য অসিয়ত করে তখন অলি ও ওয়ারিশের উপর একান্ত কর্তব্য মৃত ব্যক্তির সম্পদের এক তৃতীয়াংশ হতে তার অনাদায়ী ফরয নামায ও রোযা সমূহের হিসাব করে বিতরসহ প্রতি ওয়াক্ত নামায ও ফরয রোযার জন্য এক ফিতরা সমতুল্য গম বা গমের মূল্য ফিদয়া মিসকিনকে সদকা করবে। আর যদি মৃত ব্যক্তি কোন সম্পদ রেখে না যায় এবং অলি ওয়ারেছের সামর্থও না থাকে তখন এক ওয়াক্ত বা একটি রোযার ফিদয়া কর্জ নিয়ে ফকিরকে উপরে বর্ণিত নিয়ম অনুসারে আদান-প্রদান করবে যেন অনাদায়ী সব ফরয নামায ও রোযার ফিদয়া/কাফ্ফারা আদায় হয়ে যায়। এবং পরওয়ার দিগার আল্লাহ্ তা’আলার দরবারে ঐ ব্যক্তির মাগফিরাত-এর জন্য দু’আ-ফরিয়াদ করবে। এটা ইসলামী শরীয়তের বিধান মৃত ব্যক্তির অনাদায়ী ফরয নামায ও রোযার কাফ্ফারা আদায়ের। এভাবে আদায় করলে এবং মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে মৃত ব্যক্তির জন্য দু’আ-ফরিয়াদ করলে আশা করা যায় তার গুনাহ আল্লাহ্ তা’আলা মাফ করে দেবেন। যেহেতু আল্লাহ্ পরম দয়াবান, ক্ষমাশীল এবং অতিব মেহেরবান । (এটাই বিশুদ্ধ নিয়ম।) [আদ্ দুররুল মুখতার ইমাম আলাউদ্দীন খাসকাপি  হানাফী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ইত্যাদি]
 
 মুহাম্মদ মুহাম্মদ আরফাত হোসেন 
প্রচার সম্পাদক-চন্দনাইশ উপজেলা 
প্রেস ক্লাব, চট্টগ্রাম ও আবদুর রহমান, পটিয়া, চট্টগ্রাম।
 
প্রশ্ন: মাগরিবের জামাআতে ইমাম সাহেব প্রথম দুই রাকাআত শেষ করেন। আমি তৃতীয় রাকআতে গিয়ে নিয়্যত করলাম। ইমাম সাহেব সালাম ফেরানোর পর বাকি দুই রাকাত নামায আদায় করার সঠিক পদ্ধতি কি? শেষের দুই রাকাআত কি এক বৈঠকে শেষ করব নাকি দুই বৈঠকে? দয়া করে জানালে ধন্য হব।
উত্তর: যে মুকতাদি মাগরিবের জামাআতের তৃতীয় রাকাআতে শামিল হবে, সে (মাসবুক মুকতাদি) তার ছুটে যাওয়া দু’রাকাআত আদায় করার সময় প্রথম রাকাআতের পর বৈঠক অবশ্যই করবে। এবং তাতে শুধু ‘আত্তাহিয়্যাতু’ পড়ে দাঁড়িয়ে যাবে। অতঃপর দ্বিতীয় রাকাআত পড়বে এবং শেষ বৈঠক করে নামায শেষ করবে। অর্থাৎ ইমাম নামায শেষ করার পর তার বাকী (ছুটে যাওয়া রাকাআত) নামায শুরু করবে, তখন তার প্রথম রাকাআতে দোয়া সানাসহ সূরা ফাতেহা ও কিরআত পাঠ করার পর রুকু-সাজদা আদায় করে বসবে ও আত্তাহিয়্যাতু পড়ে উঠে যাবে, তারপরের রাকাআতে সূরা কেরাত পাঠ করার পর রুকু সাজদা আদায় করে বসবে এবং আত্তাহিয়্যাতু, দরূদ শরীফ ও দোয়া পড়ে সালাম ফিরাবে। তবে মাসবুক তার ছুটে যাওয়া নামায আদায় করার সময় কিরআত উচ্চস্বরে পড়বে না। [আদ্ দুরুল মুখতার, রাদ্দুল মুহতার, গুনিয়া, খোলাসা ও বাহারে শরীয়ত- ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা ১৩৬, ফতওয়া-এ রফভীয়্যাহ্- ৩য় খন্ড, ৩৯২পৃষ্ঠা ইত্যাদি]
 
 মুহাম্মদ  মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান 
সৈয়দপুর, রাজশাহী ও আবদুল গফুর, গবীগন্ড।
প্রশ্ন: শুনেছি পায়ের গোড়ালির নিচে প্যান্ট/পায়জামা ঝুলিয়ে নামায পড়লে মাকরূহে তাহরিমী হবে। এ ব্যাপারে প্রমাণসহ আলোকপাত করার অনুরোধ রইল।
উত্তর: হ্যাঁ। নামাযের ভেতরে বা বাইরে উভয় অবস্থাতেই অহংকার বশতঃ লুঙ্গি-পায়জামা ও প্যান্ট ইত্যাদি টাখনুর নিচে অর্থাৎ চুল গিরার নিচে পরিধান করা অথবা ঝুলিয়ে দেয়া পুরুষের জন্য মাকরূহে তাহরীমী। যা অত্যন্ত নিন্দনীয়, নিষেধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সহীহ্ বুখারী শরীফে হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত হুজুর করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- لاينظر الله يوم القيامة من جر ثوبه خيلاء অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার কাপড়কে অহংকার বশতঃ ঝুলিয়ে রাখে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তায়ালা তার দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না। (সহীহ বুখারী শরীফ) তাই নামাযের ভিতরে ও বাইরে অহংকার বশতঃ টাখনুর নিচে কাপড় তথা প্যান্ট/পায়জামা ও লুঙ্গি ইত্যাদি ঝুলিয়ে রাখা মাকরূহে তাহরিমা। যদি ঝুলিয়ে রাখা অহংকার বশতঃ না হয় তবে মাকরূহে তানযীহি। অনেক লোককে দেখা যায়, ‘নামায পড়ার সময় পায়জামা বা প্যান্ট উপরের দিকে ভাঁজ করে দেয়, নামাযে এভাবে ভাজ করে দেয়াও মাকরূহে তাহরীমি। পায়জামা বা প্যান্ট যদি লম্বা হয় এবং পায়ের টাখনু ঢেকে যায় তখন কাপড়কে টাখনুর উপর করার জন্য নীচের দিকে ভাজ করবে না বরং সম্ভব হলে কোমরের দিকে টেনে দিবে, এভাবে টানার দরুণও যদি কাপড় টাখনুর উপরে না উঠে তখন ওই অবস্থায় নামায পড়ে নেবে। নামায এভাবে আদায় করাও মাকরূহ তবে তা হবে মাকরূহে তানযীহী, তাহরীমি নয়। কিন্তু কাপড় টাখনুর উপরে তোলার জন্য নীচের দিকে ভাজ করাটা মাকরূহে তাহরিমী বিধায় ওই নামায পুনরায় আদায় করতে হবে। মাকরূহে তানযীহীর দরুণ সওয়াব কম হবে কিন্তু নামায় পুনরায় আদায় করতে হবে না। বিস্ময়ের কথা এই যে, অনেক লোক ও মুসল্লিরা মাকরূহে তানযীহি থেকে বাঁচার জন্য মাকরূহে তাহরীমি করে বসে আর এটাকে সুন্নাত মনে করে। অনেক মসজিদের ইমাম/মোয়াজ্জিন/খতিব ও ওলামায়ে কেরাম এ মাসআলা সম্পর্কে উদাসীন। না জানলে জেনে নেয়ার চেষ্টা করে না। তবে পায়জামা, প্যান্ট ও লুঙ্গী ইত্যাদি পরিধানের সময় যেন টাখনুর (চুল গিরার) নীচে না যায় বরং টাখনু (চুল গিরা) খোলা থাকে, এটাই সুন্নাত নিয়ম। উক্ত মাসআলা দলিলসহ মাসিক তরজুমান প্রশ্নোত্তর বিভাগে একাধিকবার আলোচনা করা হয়েছে । [আল্লামা আবদুস সাত্তার হামদানী কর্তৃক রচিত মুমিন কি নামায’ পৃ. ১৮০-১৮১ এবং ইমাম আলা হযরত শাহ্ আহমদ রেযা মুহাদ্দিসে বেরলভী (রহ.) কর্তৃক রচিত ফতোয়ায়ে রেজভিয়া, ৯ম খন্ড, পৃ. ৮৪ ইত্যাদি)
 
প্রশ্ন: হাদীস শরীফে সন্তানকে তিনটি বিষয় শিক্ষা দেয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে, তা কোন তিনটি বিষয়ের কথা নবীজি বলেছেন? হাদীসের উদ্ধৃত সহকারে জানালে কৃতজ্ঞ হব।
উত্তর: প্রায় হাদিসের কিতাবে কিতাবুল আদব তথা শিষ্ঠাচারের একটি অধ্যায় বিদ্যমান। প্রিয়নবী রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম স্বীয় উম্মতের জীবন- যাপন, আখলাক ও চলা-ফেরা ইত্যাদি যাতে সুন্দর হয় সে লক্ষ্যে অসংখ্য শিষ্ঠাচার ও আদব কায়দা শিক্ষা দিয়েছেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম স্বীয় উম্মতদেরকে নিজ নিজ সন্তানদের ব্যাপারে তালিম তথা শিক্ষা/শিষ্ঠাচার সংক্রান্ত হাদিসে পাকে তিনটি বিষয়ে শিক্ষাদানের কথা উল্লেখ করেছেন। বিখ্যাত হাদিস গ্রন্থ দায়লামী শরীফে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-قال رسول الله صلى الله عليه وسلم أدبوا اولادكم على ثلاث خصال حب نبيكم وحب اهل بيته وعلى قراة القران او كما قال عليه الصلوة والسلام অর্থাৎ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে তিনটি বিষয়ে আদব শিক্ষা দাও তোমাদের প্রিয় নবীর প্রতি ভালোবাসা, তাঁর (নবীজির) আহলে বায়ত তথা পরিবার ও বংশধরের প্রতি ভালোবাসা এবং কোরআন মজীদ তেলাওয়াত শিক্ষা দাও।  [দায়লামী শরীফ] 
উপরোক্ত হাদিস প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ ইমাম জালাল উদ্দীন সূয়ুতী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর রচিত ‘আল জামেউস সগীরে’ও বর্ণনা করেছেন।
 
 মুহাম্মদ রেজিয়া বেগম  
উত্তর গোবিন্দরখীল, পটিয়া,
চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: কিছু টাকা রাস্তায় পেয়েছি। টাকাগুলো কি এখন কোন মাদরাসার এতিম ফান্ডে দিব, নাকি ভিক্ষুকদের দিব, নাকি আমার বাড়ীর মসজিদে নির্মাণ বা সংস্কার হচ্ছে তাতে দিব? 
উত্তর: পতিত অবস্থায় বা রাস্তায় পাওয়া টাকা-পয়সা, মূল্যবান বস্তু যে তুলে নেবে তার কাছে তা আমানত স্বরূপ। তাই প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে দেয়ার নিয়তে রাস্তায় পাওয়া মূল্যবান বস্তু, টাকা-পয়সা তুলে নেয়া উত্তম। বরং কোন মূল্যবান বস্তু ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তুলে নেয়া জরুরী। যদি পাওয়া বস্তুটা দশ দিরহাম মূল্যের কম হয় তবে কিছু দিন তা প্রচার করবে বা মালিককে খোঁজ করবে। আর যদি দশ দিরহাম বা দশ দিরহামের বেশি মূল্যের হয়, তবে পূর্ণ এক বছর তার প্রকৃত মালিকের খোঁজ প্রচার করতে হবে। যদি ওই সময়ের মধ্যে প্রকৃত মালিক এসে যায় তবে তা ভালই। অন্যথায় এক বছর পর প্রকৃত মালিকের পক্ষ থেকে গরীব-মিককিন ও অসহায়দের নিকট বা মিসকিন, ফকিরকে সাদকা করে দেবে। মসজিদ, মাদরাসা বা স্কুল-কলেজ ও রাস্তাঘাটের নির্মাণ কাজে উক্ত কুড়ে পাওয়া টাকা প্রদান করবে না। 
উল্লেখ্য যে, ১০ (দশ) দিরহাম পরিমাণ বর্তমান বাংলাদেশের টাকার হিসেবে প্রায় ২৭০০/- (দুই হাজার সাতশত) টাকা প্রতি ভরি/তোলা চাঁদি রুপার দাম এক হাজার টাকা হিসেবে। [কুদুরি, কিতাবুল লুকতা ও ফতোয়া-ই মিরাজিয়্যাহ্ ইত্যাদি]
 
প্রশ্ন: পুরুষগণ মসজিদে ইতিকাফ থাকেন। মেয়েরা কি মসজিদের পরিবর্তে নিজগৃহে ইতিকাফ থাকতে পারেন? এ সম্পর্কে বিধিবিধান কি জানালে উপকৃত হব। 
উত্তর: পুরুষ মান্নতকৃত ইতেকাফ অথবা মাহে রমজানের শেষ দশকের সুন্নাত ইতেকাফ মসজিদে পালন করবে। আর মহিলারা ঘরের মধ্যে খাস বা বিশেষ কামরায় ইতিকাফ পালন করবে। মহিলারা ঘরের এমন স্থানে ইতিকাফ করবে, যা নামায পড়ার জন্য নির্ধারিত আছে। মহিলার জন্য এটাও মুস্তাহাব যে, ঘরে নামাযের জন্য কোন একস্থান নির্ধারণ করবে এবং সে স্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবে। [রদ্দুল মুহতার, ইতিকাফ অধ্যায় ও বাহারে শরীয়ত ৫ম খন্ড]
 
 
দু’টির বেশি প্রশ্ন গৃহীত হবেনা  একটি কাগজের পূর্ণপৃষ্ঠায় প্রশ্ন লিখে নিচে প্রশ্নকারীর নাম, ঠিকানা লিখতে হবে
 প্রশ্নের উত্তর প্রকাশের জন্য উত্তরদাতার সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ বাঞ্ছনীয় নয়।  প্রশ্ন পাঠানোর ঠিকানা:
প্রশ্নোত্তর বিভাগ, মাসিক তরজুমান, ৩২১, দিদার মার্কেট (৩য় তলা), দেওয়ান বাজার, চট্টগ্রাম-৪০০০।