বহুমুখী প্রতিভা ও গুণের ধারক আলহাজ্ব নূর মুহাম্মদ আলকাদেরী

বহুমুখী প্রতিভা ও গুণের ধারক আলহাজ্ব নূর মুহাম্মদ আলকাদেরী

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান>

আল্লাহ তা’আলা ইচ্ছা করলে কোন সাধারণ ব্যক্তিকে অগাধ সম্পদের অধিকারী করে দ্বীন, মাযহাব ও দুঃস্থ-মানবতার সেবায় অকাতরে দান করিয়ে ‘আস্সাখিয়ু হাবীবুল্লাহ্’ (দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর বন্ধু)’র আসনে বসিয়ে দিতে পারেন এবং তাঁর ইচ্ছায়, কেউ তার এ ক্ষণস্থায়ী জীবনে অগণিত সাদক্বাহ্-ই জারিয়া ও বহুমুখী অবদান রাখার সুযোগ পেয়ে মৃত্যুর পরও অমর এবং স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে যেতে পারে। বার আউলিয়ার পূণ্যভূমি চট্টগ্রামের বাকলিয়ায় জন্মগ্রহণকারী আলহাজ নূর মুহাম্মদ আলকাদেরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি হলেন আল্লাহর এমনই বিশেষ নি’মাতপ্রাপ্ত ক্ষণজন্মাদের একজন।

তিনি বিংশ শতাব্দির গোড়ার দিকে ১৯২২ ইংরেজি বাকলিয়ার এক মধ্যবিত্ত সম্ভ্রান্ত ও ধার্মিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি পৈত্রিক ক্ষুদ্র ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রয়াসী হন। অল্প সময়ে তিনি পুরো চট্টগ্রামে এক সফল ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি বক্সিরহাট মার্চেন্ট ডিফেন্স কমিটির সভাপতি, চট্টগ্রাম শিল্প ও বণিক সমিতির সম্মানিত সদস্য, চট্টগ্রামের ভোজ্য তৈল ও তুলা আমদানিকারক সমিতির সভাপতি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ট্রাস্ট সদস্য হিসেবে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবসায়ী পরিমন্ডলে খ্যাত হন। এমনকি তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট থেকে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের দাবী-দাওয়া আদায়ে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, রাজনীতির অঙ্গনেও তিনি এক বিশেষ পদমর্যাদায় আসীন হন। তিনি ছিলেন জন দরদী, প্রসিদ্ধ সমাজ সেবকও। তিনি জমিয়তুল ফালাহ্ জাতীয় মসজিদের বোর্ড অফ গভর্নরস্ এর সদস্য ও হজ্জ্ব কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

আলহাজ নূর মুহাম্মদ আলকাদেরী নিজে যেমন জ্ঞানপিপাসু ছিলেন, তেমনি সমাজে জ্ঞান ও শিক্ষার প্রসারের গুরুত্বকে যথাযথভাবে অনুভব করেছেন। সুতরাং তিনি চট্টগ্রাম শহর এলাকায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উদ্যোগী হন। তিনি লামাবাজার, চরচাক্তাই বালক উচ্চ বিদ্যালয়, গুলজার বেগম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং বাকলিয়ায় প্রসিদ্ধ ফোরক্বানিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মূল ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। সর্বোপরি এশিয়া বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া (চট্টগ্রাম), জামেয়া ক্বাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলিয়া (ঢাকা) এবং হালিশহর ও চন্দ্রঘোনা মাদ্রাসাসহ বহু দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কায়েমের ক্ষেত্রে সর্বাধিক অবদান রাখেন এবং এগুলোর আজীবন অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি স্ব-উদ্যোগে যে জ্ঞান-ভান্ডার আয়ত্ব করেছিলেন তা সত্যি বিস্ময়কর। তাঁর কথাবার্তা, বক্তব্য ও যে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে এ সত্য প্রমাণিত হয়েছে।

তিনি উপমহাদেশের সুপ্রসিদ্ধ মুর্শিদে বরহক্ব আওলাদ-ই রসূল হযরতুল আল্লামা হাফেয ক্বারী সৈয়দ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি (ওরফে হযরত পেশোয়ারী সাহেব) আলায়হির রাহমাহ্র হাতে বায়’আত গ্রহণ করেন এবং তাঁর সান্নিধ্যে অতি অল্প সময়ে ‘ফানাফিশ্ শায়খের’ মর্যাদায় উন্নীত হন। ইতোমধ্যে তিনি শরীয়ত, ত্বরীকত, বিশেষত আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের নিষ্ঠাপূর্ণ খিদমতে আত্মনিয়োগ করেন। সিলসিলাহ্-ই আলিয়া ক্বাদেরিয়া সিরিকোটিয়ার জন্য তিনি যে অসাধারণ অবদান রাখেন, তা চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাই তাঁর মহান মুর্শিদের উত্তরসূরি আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলাইহি) তাঁকে প্রধান খলিফার মহা মর্যাদায় আসীন করেছিলেন। তাছাড়া তাঁর নামের সাথে ‘সওদাগর’ -এর স্থলে ‘আলক্বাদেরী’ও শোভা পেতে থাকে। আলহাজ নূর মুহাম্মদ আলকাদেরী আপন মুর্শিদে বরহক্বের আনুগত্য তথা ত্বরীকত জগতের এক অনন্য উদাহরণ। হযরত সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি আলাইহির সুদূরপ্রসারী ও যুগান্তকারী দ্বীনী মিশন বাস্তবায়নের জন্য আন্জুমান-এ শুরা-ই রহমানিয়া (পরবর্তীতে আন্জুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট) প্রতিষ্ঠা করেন। আন্জুমানের তিনি সর্বপ্রথম সহ-সভাপতি নিযুক্ত হন। আজীবন নিষ্ঠার সাথে এ দায়িত্ব পালন করে যান। তিনি বলুয়ারদীঘি পাড়স্থ নিজ বাসভবনের পূর্ণ এক তলা খানক্বাহ্ শরীফের জন্য ওয়াক্বফ করে দেন ও নিজ খরচে পরিচালনা করেন। জামেয়া প্রতিষ্ঠার সময়ও তিনি আপন মহান মুর্শিদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর ক্ষেত্রে বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। জামেয়া প্রতিষ্ঠার এমন পরামর্শ সভায় বাঁশ-বেড়া ও টিনের ছাউনী কিংবা সেমি পাকা ঘর তৈরীর প্রস্তাবাবলী উপস্থাপিত হলে হুযূর ক্বেবলা তাতে রাজি হননি। হুযূর ক্বেবলার ইচ্ছা যে প্রথম থেকেই জামেয়া একটি মনোরম পাকা দালানেই প্রতিষ্ঠিত হোক সেটা আলহাজ নূর মুহাম্মদ আলকাদেরী সহজেই অনুমান করতে পেরেছিলেন এবং তিনি সাথে সাথে প্রস্তাব দিয়েছিলেন জামেয়ার জন্য পাকা দালানই হবে আর যাবতীয় রড-সিমেন্ট তিনিই প্রদান করবেন। এতে হুযুর কেবলা অত্যন্ত খুশী হন এবং বিশেষভাবে দো’আ করেন।

মোটকথা হযূর কেবলার শরীয়ত ও ত্বরীকত সমন্বিত অনন্য সুন্দর এ মিশনকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যান এ নিষ্ঠাবান ব্যক্তিত্ব। তাছাড়া হুযুর ক্বেবলা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ (রহ.) প্রতিষ্ঠিত মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তর জশনে জুলুসের প্রবর্তনের গোড়ায়ও আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরীর ভূমিকা চির ভাস্বর হয়ে থাকবে। ১৯৭৪ সাল থেকে প্রর্বতিত বিশাল জশনে জুলুসের প্রথম দু’ বছর তিনিই নেতৃত্ব দেন।
তিনি হুযুর ক্বেবলাগণের সান্নিধ্যে ছায়ার মতোই থাকতেন। হজব্রত পালনসহ দেশ-বিদেশ সফরে হুযুর ক্বেবলার সাথে থাকতেন। কল্যাণমুখী রাজনীতি সমাজসেবা ও দেশপ্রেমই তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় সুষ্পষ্টরূপে প্রকাশ পেয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাঁর পরিচালনাধীন আন্জুমানের অধীনে জামেয়া সহ যত প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছিলো কোন প্রতিষ্ঠানের কোন ছাত্র-শিক্ষক স্বাধীনতাবিরোধী কোন কর্মকান্ডে জড়িত হয়নি; বরং জামেয়ায় তখন কঠোরভাবে নোটিশ জারী করা হয়েছিলো যেন কেউ তদানীন্তন তথাকথিত শান্তি কমিটির আহ্বানে সাড়া দিয়ে কিংবা অন্য কোনভাবে স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠনে ও কর্মকান্ডে জড়িত না হয়। এর ব্যত্যয় ঘটলে মাদ্রাসা থেকে বহিস্কার করার নির্দেশ ও দেয়া হয়েছিলো। উল্লেখ্য, স্বাধীনতাত্তোরকালে জামেয়া পরিদর্শনে এসে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জহুর আহমদ চৌধুরী ও আওয়ামী ওলামা পরিষদের সভাপতি মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগিশ প্রমুখ এসব রের্কড দেখে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। জামেয়া ও আন্জুমানের ভূয়সী প্রশংসা করে পরিদর্শন বইতে স্বাক্ষর করেন। [সূত্র : বাঙ্গাল কেন যুদ্ধে গেল: কৃত সিরু বাঙ্গালী ও জামেয়ার রেকর্ডপত্র]
ত্বরীকতের ক্ষেত্রে আলহাজ নূর মুহাম্মদ আলকাদেরী সমস্ত পীর ভাইদের নয়নমণি ছিলেন। তিনি সকলের হৃদয়ে অকৃত্রিম ভালবাসার স্থান করে নিয়েছিলেন, যা তাঁর ইন্তিকালের সময় প্রকাশ পেয়েছিলো। তিনি ১৯৭৯ ইং সাল ১০ ডিসেম্বর মোতাবেক ১৪০০ হিজরির ১৯ মহররম ইহজগতের মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমান। তাঁর ইন্তেকালের সাথে সাথে অগণিত পীরভাই-বোন, সর্বস্তরের জন সাধারণ ও জামেয়ার ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। ঐতিহাসিক লালদিঘি ময়দানে ও জামেয়া মাঠে অনুষ্ঠিত বিশাল জানাযা নামাযের পর তাঁকে জামেয়ার পাশেই সমাধিস্থ করা হয়।

তিনি আজীবন আন্জুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়ার সহ-সভাপতি ছিলেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর সুযোগ্য সন্তান আলহাজ মুহাম্মদ মহসিন সাহেবকে হুযূর ক্বেবলা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি আলহাজ নূর মুহাম্মদ আলকাদেরীরই পদে সিনিয়র সহ-সভাপতি হিসেবে নিয়োগ দান করেন। নিয়োগপ্রাপ্তি থেকে আজ অবধি আলহাজ্ মুহাম্মদ মহসিন সাহেব ওই পদে সসম্মানে আসীন রয়ে জামেয়া, আন্জুমান, আলমগীর খানকাহ শরীফ্, বলুয়ার দীঘিস্থ খানক্বাহ্ শরীফ ও সিল্সিলাহ্ আলিয়া ক্বাদেরিয়া সিরিকোটির ব্যাপক কর্মকান্ড সুচারুরূপে পরিচালনা করে আসছেন।
আগামী ১৯ মর্হরম ৭ আগস্ট তাঁর ৪৫ তম ওফাত বার্ষিকীতে তাঁকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। আল্লাহ্
তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন। আমীন।

লেখক: বিশিষ্ট লেখক, গবেষক, অনুবাদক ও মহাপরিচালক- আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।