ঘনবসতি এলাকায় সামাজিক এবাদতখানায় জুমার নামায চালু করা যাবে কিনা?

ঘনবসতি এলাকায় সামাজিক এবাদতখানায় জুমার নামায চালু করা যাবে কিনা?

 মুহাম্মদ রমজান আলী, মুহাম্মদ ফারুক মিয়া 
ও মুহাম্মদ জানে আলেম। 
১ নং ওয়ার্ড, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন,
চট্টগ্রাম। >
প্রশ্ন: আমরা এলাকাবাসী দীর্ঘ ১৫/২০ বছর যাবৎ এবাদতখানারূপে একটি সেমি পাকা ঘরে নিয়মিত জামাতের মাধ্যমে পঞ্জেগানা নামায আদায় করে আসছি। প্রথম দিকে পরিকল্পনা না থাকলেও পরবর্তীতে উক্ত এবাদতখানার ভূমির মালিক ০.৩ শতাংশ জায়গা জুমা আদায়সহ ধর্মীয় কর্মকাণ্ড আনজাম দেয়ার লক্ষ্যে রেজিষ্ট্রি মূলে ওয়াক্ফ করে দেন। এ এবাদতখানা বা মসজিদটি একান্ত বাড়ি-ঘরের ভিতর হওয়ায় আশ-পাশের লোকজন ব্যতীত সর্বসাধারণ অবাধে জামায়াতে অংশ গ্রহণ করতে পারে না। মসজিদের পাশে পারিবারিক ব্যবহারের পুকুর থাকাতে মা-বোনদেরও গৃহস্থলী ধোয়া-পালা করতে অসুবিধা হয়। ভবিষ্যতে এ মসজিদের পরিসর বড় করা ও রাস্তা ঘাট হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এতসব অসুবিধার কারণে আমরা এখনো জুমার নামাজ চালু করতে পারি নাই। অপরদিকে এই ইবাদতখানা মসজিদ থেকে কয়েকশত গজ দূরে সিটি কর্পোরেশনের রাস্তার সাথে সংযুক্ত ০.৬ শতাংশের অধিক জায়গা কতিপয় ব্যক্তিগণ জুমা মসজিদ স্থাপনের জন্য রেজিষ্ট্রি মূলে ওয়াকফ করে দিয়েছেন। বৃহত্তর এলাকার লোকজন আশ-পাশের নিত্য নতুন বিল্ডিং ও এ্যাপার্টমেন্ট বাড়ী-ঘর হওয়াতে জামে মসজিদের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। যাতায়াত ও অবাধে চলাচলের সুবিধা বিবেচনায় সাধারণ মুসল্লিসহ এলাকার লোকজন এই জায়গায় নতুন জামে মসজিদ নির্মাণে আগ্রহী। সাধারণ মুসল্লিদের মনোনীত কমিটি উভয় জায়গা পরিচালিত করেন। বর্তমানে এ কমিটির উদ্যোগে নতুন জামে মসজিদ নির্মাণের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অতএব এ মুহূর্তে আমাদের প্রশ্ন ১. প্রস্তাবিত নতুন জায়গায় নিয়মিত জামায়াতসহ নতুন জামে মসজিদ নির্মাণে ইসলামী শরীয়তের কোন বাধা আছে কিনা? ২. যদি না থাকে তাহলে আমরা পুরাতন এবাদতখানাটি কি কি কাজে ব্যবহার করতে পারব। আশা করি ইসলামী শরীয়তের আলোকে আপনাদের মূল্যবান ফতোয়ার মাধ্যমে আমাদেরকে উপকৃত করবেন। 
উত্তর: উপরোক্ত আবেদন যাচাই বাচাই করে এ মর্মে ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক ফতোয়া/ফায়সালা প্রদান করা হচ্ছে যে, এবাদতখানাটিতে যেহেতু দীর্ঘদিন যাবৎ নামায-কালাম ও পঞ্জেগানা নামাযের জামাত হয়ে আসছে বিধায় উক্ত পুরাতন এবাদতখানার বারান্দাসহ চিহ্ণিত জায়গাটি কেয়ামত পর্যন্ত মসজিদ হিসেবে সাব্যস্ত থাকবে। যেমন আদদুররুল মোখতার কৃত. ইমাম আলাউদ্দিন হাসকাফী হানাফী রহ.সহ ইসলামী ফিকহের নির্ভরযোগ্য ফতোয়াগ্রন্থ সমূহে উল্লেখ করা হয়েছে- ان المسجد الى عنان السماء অর্থাৎ নিশ্চয় মসজিদ আসমান পর্যন্ত। আর রদ্দুল মোহতার এ আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী হানাফী (রহ.) বলেন كذا الى تحت الثرى অর্থাৎ তদ্রুপ মসজিদ সর্বনিম্ন তাহতুছ ছারা পর্যন্ত মসজিদ হিসেবে নির্ধারিত। উক্ত পঞ্জেগানা এবাদতখানাও শরিয়তের দৃষ্টিতে মসজিদ যেহেতু উক্ত জায়গাটি মালিক কর্তৃক রেজিষ্ট্রি মূলে মসজিদ/এবাদতখানার জন্য ওয়াকফ করা হয়েছে।
 
বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া পূর্ব নির্ধারিত মসজিদ/এবাদতখানা শহীদ করা বা ভেঙ্গে আগের চেয়ে ছোট করা বা মসজিদ/এবাদতখানার বারান্দাসহ চিহ্ণিত জায়গায় দুনিয়াবী কোন প্রতিষ্ঠান স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত বা কোন দোকান করা এমনকি মসজিদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে সেখানে ধর্মীয় কোন প্রতিষ্ঠান-মাদরাসা, খানকাহ্ ইত্যাদি করা হারাম। তবে বিশেষ প্রয়োজনে খারাপ উদ্দেশ্য ও কু-মতলব ছাড়া আল্লাহর ওয়াস্তে মুসল্লি সংকুলান না হলে পুরাতন মসজিদ/এবাদতখানা ভেঙ্গে উক্ত জায়গায় নতুন করে বড় আকারে মসজিদ/এবাদতখানা সম্প্রসারণ করা ইসলামী শরিয়ত কর্তৃক অনুমোদিত। আর যদি পুরাতন মসজিদ/এবাদতখানা আয়তনে ছোট হয়, সামনে ও পার্শ্বে পারিবারিক ব্যবহারের পুকুর থাকায় এবং সাধারণের বাড়ী-ঘরের ভিতরে হওয়ায় উক্ত পুরাতন মসজিদ/এবাদতখানাকে সম্প্রসারণ করা সম্ভব না হয় এবং উক্ত পুরাতন মসজিদ/এবাদতখানার পার্শ্বে বা কয়েক শত গজ দূরে বড় আকারে জুমা মসজিদের জন্য ওয়াক্বফকৃত জায়গায় একান্ত বিশেষ প্রয়োজনে অধিকাংশ এলাকাবাসী ও মসজিদ পরিচালনা কমিটির যৌথ উদ্যোগে/পরামর্শক্রমে পুরাতন মসজিদ/এবাদতখানার একই নামে বা ভিন্ন নামে নতুন মসজিদ নির্মাণ করা জায়েয ও বৈধ। সেখানে জুমা-জামাত পড়লে শরিয়ত মোতাবেক কোন অসুবিধা নেই। তবে প্রথম ও পুরাতন মসজিদ/এবাদতখানাকে মসজিদ হিসেবে সংরক্ষণ ও হেফাযত করতে হবে। পূর্বের ন্যায় আদব-সম্মান বজায় রাখতে হবে। সবসময় নফল ইবাদত-বন্দেগী, নফল নামায, ওয়াজ-নসীহত, কুরআন তেলাওয়াত, মাসিক বা সাপ্তাহিক খতমে গাউসিয়া শরীফ, জিকির-আজকার, মিলাদ-কিয়াম, সালাত-সালাম ও দোয়া-মুনাজাতের মাধ্যমে উক্ত পুরাতন মসজিদ/এবাদতখানাকেও আবাদ রাখতে হবে।
 
উক্ত পুরাতন মসজিদ/এবাদতখানা ক্বিয়ামত পর্যন্ত অবহেলা ও বেইজ্জত করা যাবে না। নতুন-পুরাতন উভয় মসজিদ/এবাদতখানার আদব, সম্মান, হেফাজত ও সংরক্ষণের প্রতি লক্ষ্য রাখা মসজিদ পরিচালনা কমিটি ও এলাকাবাসী সকল মুসলমানের উপর একান্ত অপরিহার্য। অবহেলা ও অসম্মানজনক আচরণ করা হারাম ও মারাত্মক অপরাধ। যেমন- الفقه الواضع তে ড. আল্লামা বকর ইসমাইল (১ম খ-, ৩৬৬পৃ.) বলেন-قال منصور بن ادريس فى كتاب كشاف القناع يحرم ان يبنى مسجد الى جانب مسجد الا لحاجة كضيق الاول او خوف فتنة باجتماعهم فى مسجد واحد – অর্থাৎ হযরত মনসুর বিন ইদ্রিস ফকিহ কাশশাফুল কানা কিতাবে বলেন- এক মসজিদের পার্শ্বে/নিকটে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া আর এক মসজিদ নির্মাণ করা হারাম। তবে উক্ত মসজিদ যদি সংকীর্ণ হয়ে যায় (সম্প্রসারণ করার সুযোগ নাই) অথবা উক্ত পুরাতন মসজিদে এলাকার সবাই একত্রিত হলে ঝগড়া তথা ফিতনা-ফ্যাসাদের আশঙ্কা দেখা যায় তখন উক্ত মসজিদ হতে কিছু দূরত্বে নতুন মসজিদ নির্মাণ করা জায়েয। এ বিষয়ে ইমামে আহলে সুন্নাত মুজাদ্দিদে দীন ও মিল্লাত শাহ্ আহমদ রেযা আ’লা হযরত রহমাতুল্লাহি আলায়হি ফতোয়ায়ে রজভীয়া, ৩য় খন্ড, ৫৯০পৃষ্ঠায় বলেন- جبكه اس مسجد كو بھى مسلمانوں نے مسجد كرليا يه بھى مسجد هوگے مسجد اول كي اور اسكى دونوں كي حفاظت اور ابادى فرض هيں مسجد اول منهدم كركے تعمير دهنوى نهں تعمير دينى هي ميں شامل كر دينا حرام حرام سخت حرام الخـ … ج ـ ৩و صفحه ـ ৫৯০
অর্থাৎ এই নতুন মসজিদটিও এলাকার মুসলমানগণ মসজিদ হিসেবে নির্মাণ করেছেন। সুতরাং এটাও মসজিদে পরিণত হয়েছে। প্রথম মসজিদ (পুরাতন মসজিদ) এবং এ (নতুন) মসজিদ উভয়টাকে সংরক্ষণ ও ইবাদতের মাধ্যমে আবাদ রাখা ফরজ। প্রথম মসজিদকে শহীদ করে সেখানে দুনিয়াবী কোন ইমারত (অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি) নির্মাণ করা জায়েজ নেই; এবং প্রথম মসজিদকে বিলুপ্ত করে সেখানে দ্বীনি বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান করাও হারাম, হারাম ও শক্ত হারাম। 
 
তদ্রুপ রদ্দুল মোহতার, ফতোয়ায়ে আলমগীরী (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া), ফতোয়ায়ে শরয়ীয়া ৪র্থ খন্ডে এবং বাহারে শরীয়ত ১০ম খন্ডে এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং বর্তমানে পুরাতন এবাদতখানাকে বড় আকারে নির্মাণ করা সম্ভব না হওয়ায় বিশেষ প্রয়োজনে কিছু দূরে জুমা মসজিদের জন্য ওয়াকফকৃত জায়গায় একই নামে বা ভিন্ন নামে বড় আকারে নতুন জুমা মসজিদ নির্মাণ করে সেখানে জুমা-জামাত, ইবাদত-বন্দেগী পালন করতে ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক কোন অসুবিধা নেই বরং জায়েয। তবে প্রথম ও পুরাতন মসজিদ/এবাদতখানাকে পূর্বের ন্যায় হেফাজত, সংরক্ষণ করবে ও আদব-সম্মান বজায় রাখবে এবং পুরাতন এবাদতখানাকেও ইবাদত-বন্দেগী, নফল নামাজ, জিকির-আযকার, খতমে গাউসিয়া, মিলাদ-ক্বিয়াম, কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া-মুনাজাতের মাধ্যমে আবাদ রাখবে। এটাই ইসলামী শরিয়তের ফতোয়া/ফায়সালা।    

Share:

Leave Your Comment