বাইতুল্লাহর হজ : মুমিন জীবনে বরকতময় অভিযাত্রা

বাইতুল্লাহর হজ : মুমিন জীবনে বরকতময় অভিযাত্রা

মাওলানা মুহাম্মদ মুনিরুল হাছান>

আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের নামই হল ইসলাম। ইসলামের অবশ্য করণীয় বিধানসমূহের একটি হলো হজ। হজের প্রতিটি বিধি-বিধান ও কর্মকান্ডের মধ্যে সেই আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের চিত্র ফুটে উঠে। এটি আল্লাহর প্রেমে নিজেকে উৎসর্গ করার অন্যতম একটি উপায়। মানুষের প্রতি মহান আল্লাহর অসীম দয়া ও করুণার অন্যতম নিদর্শন হলো বান্দাহকে হজ তথা আল্লাহর ঘর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে পবিত্র কাবা ঘরের আঙ্গিনায় ডেকে নিয়ে যাওয়া। আল্লাহর অনুগত বান্দাগণ তার পিতা-মাতা, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, সহায় সম্পত্তি সব কিছু পেছনে ফেলে ইহরাম পরিধান করে মহান প্রতিপালকের আহবানে সাড়া দিয়ে হজের উদ্দেশ্যে সমবেত হয়। পবিত্র নগরী মক্কায় পৌঁছে বান্দাহ তার প্রভুর সামনে নিজের দাসত্বের প্রমাণ দেয়। মুমিন নামাজ আদায় করলে আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশিত হয়, যাকাত দিলে দারিদ্রতা দূরীভূত হয়, রোজা পালন করলে কুবপ্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয় হজ করলে কি হয়? এর জবাব হলো, পুরো হজই আল্লাহ ও তার প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশনাবলীর অনুসরণ এবং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশ। হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লাম বলেছেন, لبيك حقاً حقاً، لبيك تعبداً ورقاً হে আল্লাহ! আমি উপস্থিত আপনার কাছে যথার্থ হজ, নিষ্ঠাপূর্ণ এবাদত ও পরিপূর্ণ আনুগত্য প্রার্থনা করছি।

হজের ইতিহাস অতি প্রাচীন এবং এর প্রতিটি কাজ ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত ও তাৎপর্যপূর্ণ। হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম দুনিয়াতে এসে এই উপমহাদেশ (বর্তমান দক্ষিণ এশিয়া) থেকেই গিয়েই সর্বপ্রথম হজ পালন করেন। হযরত জিবরাইল আলায়হিস্ সালাম হযরত আদম আলাইহিস সালামকে বললেন, আপনার আগমনের সাত হাজার বছর পূর্ব থেকে ফেরেশতারা দলে দলে বাইতুল্লাহ শরীফের তাওয়াফ করে আসছে।

হজের বিধানগুলোর মধ্যে বিবেক বুদ্ধি খাটিয়ে যৌক্তিকতা তালাশের কোন অবকাশ নাই। কেননা আল্লাহর প্রেমিকরা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য বাইতুল্লাহ শরীফের দিকে পতঙ্গের মতো ছুটে এসেছে। হাজার বছর পূর্বে আল্লাহর প্রেমের নিদর্শন স্বরূপ আল্লাহর বিশেষ বান্দাহগণ এই কাজগুলো করেছিলেন।
হজের প্রতিটি কাজের মধ্যে আল্লাহর প্রিয় বন্ধু হযরত ইব্রাহিম আলায়হিস্ সালাম ও তার সন্তান হযরত ইসমাইল আলায়হিস্ সালাম এর সঙ্গে মুসলিম উম্মাহর সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
তারা উভয়ই আল্লাহ তাআলার প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ করেছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, اِذۡ قَالَ لَهٗ رَبُّهٗۤ اَسۡلِمۡ ۙ قَالَ اَسۡلَمۡتُ لِرَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ স্মরণ করুন, যখন তার রব তাকে বলেছিলেন, ‘আত্মসমর্পণ করুন’, তিনি বলেছিলেন, আমি সৃষ্টিকুলের রব-এর কাছে আত্মসমর্পণ করলাম। (সূরা বাকারা-১৩১)

পবিত্র কাবাগৃহ, সাফা মারওয়া পাহাড়, জমজম কূপ, আরাফাহ,মিনা ইত্যাদি প্রতিটি স্থানের সঙ্গে আল্লাহর প্রতি হযরত ইব্রাহিম আলায়হিস্ সালাম, তার স্ত্রী হাজেরা আলায়হিস্ সালাম, শিশু পুত্র ইসমাইল আলায়হিস্ সালাম এর আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের ঘটনা জড়িত। আল্লাহ তায়ালার কুদরতি ইচ্ছা হলো বান্দাহ যাতে হযরত ইব্রাহিম আলায়হিস্ সালাম ও আখেরি যমানার পয়গাম্বর হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুসরণ করে হজের কার্যক্রম সম্পাদনের মাধ্যমে আল্লাহর দিকে আত্মসমর্পণ করে। সাথে সাথে আল্লাহ তাআলার নিদর্শনাবলীর প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করে।
হজ শুধু একটি ইবাদতই নয় বরং আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জনের অনন্য একটি মাধ্যম। হজে বাইতুল্লাহ বান্দাহকে ঈমানি চেতনা ও আত্মশুদ্ধির অনুভূতি উপহার দিয়ে থাকে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
من أراد الحج فليتعجل، فإنه قد يمرض المريض
وتضل الضالة وتعرض الحاجة.
যে ব্যক্তি হজ করার ইচ্ছে করে, সে যেন তাড়াতাড়ি তা আদায় করে নেয়। কারণ যে কোনো সময় সে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে বা বাহনের ব্যবস্থাও না থাকতে পারে অথবা অন্য কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। (সুনানে ইবনে মাজাহ-২৮৮৩, সুনানে আবু দাউদ-১৭৩২)
অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
تعجلوا إلى الحج، يعني الفريضة،
فإن أحدكم لا يدري ما يعرض له.
ফরয হজ আদায়ে তোমরা বিলম্ব করো না। কারণ তোমাদের কারো জানা নেই তোমাদের পরবর্তী জীবনে কী ঘটবে। (মুসনাদে আহমদ- ২৮৬৭; ইমাম বায়হাকি,সুনানে কুবরা- ৪/৩৪০)
হজ করার শক্তি-সামর্থ্য ও অর্থ-বিত্ত থাকার পরও যে ব্যক্তি হজ করে না তার সম্পর্কে হাদীস শরীফে কঠোর হুমকি প্রদান করা হয়েছে। হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন,
من أطاق الحج فلم يحج فسواء
عليه مات يهوديا أو نصرانيا.
যে ব্যক্তি হজ করার সামর্থ্য রাখে, তবুও হজ করে না সে ইহুদী হয়ে মৃত্যুবরণ করল কি খৃস্টান হয়ে তার কোনো পরোয়া আল্লাহর নেই। (তাফসীরে ইবনে কাসীর, ১/৫৭৮)
হজের অফুরন্ত ফযিলত রয়েছে। হজ পালনের মাধ্যমে বান্দাহর জীবনের সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, আমি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, مَنْ حَجَّ لِلّهِ فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশে হজ করল এবং অশালীন কথাবার্তা ও গুনাহ থেকে বিরত রইল, সে যেন নবজাতক শিশু, যাকে তার মা এ মুহূর্তেই প্রসব করেছে, তার মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরবে। (সহীহ বুখারি-১৪৩১)
আরবীতে মাবরুর শব্দটি বির শব্দ থেকে উৎসারিত। এই ‘বির’ শব্দটি দুটো অর্থে ব্যবহৃত হয়ঃ
এক: মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার ও সুসম্পর্ক। যার বিরপরীত হল দুর্ব্যবহার। হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, البر حسن الخلق উত্তম চরিত্রই হলো সকল নেক কাজের মূলকথা। (সহীহ মুসলিম)।
দুই: অধিক হারে ইবাদত বন্দেগী,তাকওয়ার গুনাবলী অর্জন ও সৎকর্ম করা। যার বিপরীত হল গুনাহ বা নাফরমানী। হযরত হাসান বসরী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, যে হজের পর দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি জন্মে এবং আখেরাতের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয় সেটাই হল মাবরুর হজ।
মাবরুর হজের মূল অর্থ হলো পুণ্যময় হজ, যেখানে সমুদয় কল্যাণের পূর্ণ সমাহার ঘটে। যাতে হজের ফরজ,ওয়াজিব ও সুন্নতগুলো যথাযথভাবে আদায় করা হয়। সাথে সাথে সব ধরনের গুনাহ ও পাপাচার থেকে বিরত থাকা হয়। এককথায় যে হজ পালনে কোনো ত্রুটি থাকবে না, কারও সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ হবে না, অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ কাজ হবে না, গুনাহ হবে না, সেটাই হচ্ছে মাবরুর হজ। উলামায়ে কেরাম মাবরুর হজের জন্য কয়েকটি শর্ত লিপিবদ্ধ করেছেন। তন্মধ্যে অন্যতম হলো বৈধ উপার্জনের মাধ্যমে হজ করা। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
وإذا خرج بالنفقة الخبيثة فوضع رجله في الغرز، فنادى: لبيك، ناداه مناد من السماء، لا لبيكَ ولا سعديك، زادك حرام، ونفقتك حرام، وحجك مأزور غير مأجور.
আর অবৈধ উপার্জন নিয়ে কোন ব্যক্তি যখন হজের উদ্দেশ্যে বের হয় এবং বাহনের পা-দানিতে পা রেখে ঘোষণা দেয়, লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। তখন আসমান থেকে একজন ঘোষক তার ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, তোমার জন্য কোন লাব্বাইক নাই, তোমার জন্য কোন সৌভাগ্যবার্তা নাই। কেননা তোমার পাথেয় হলো হারাম উপার্জনের, তোমার খরচ হারাম, তোমার হজ কবুল করা হয়নি। (মুয়াত্তা ইমাম মালেক-১/৩০৭)
মাবরুর হজের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, একনিষ্ঠ হয়ে এক আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে হজ করা এবং লোক দেখানোর মানসিকতা বর্জন করা। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ حَجَّ النَّبِيُّ ـ صلى الله عليه وسلم ـ عَلَى رَحْلٍ رَثٍّ وَقَطِيفَةٍ تُسَاوِي أَرْبَعَةَ دَرَاهِمَ أَوْ لاَ تُسَاوِي ثُمَّ قَالَ ‏ “‏ اللَّهُمَّ حِجَّةٌ لاَ رِيَاءَ فِيهَا وَلاَ سُمْعَةَ ‏”‏ ‏
হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলে আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (উটের পিঠে) একটি পুরাতন জিন ও পালানে উপবিষ্ট অবস্থায় হজ করেন। তাঁর পরিধানে ছিল একটি চাদর যার মূল্য চার দিরহাম বা তারও কম। অতঃপর তিনি বলেনঃ হে আল্লাহ! এ এমন হজ, যাতে কোন প্রদর্শনেচ্ছা বা প্রচারেচ্ছা নেই। (ইবনে মাজাহ-২৮৯০)।
এইজন্য হাজীদের সংখ্যা দেখে বিবেচনা না করে পূর্বসূরীরা তাদের একনিষ্ঠতাকেই মূল্যায়ন করতেন। একদা হযরত মুজাহিদ (রহঃ) বলেছিলেন কত বিপুল সংখ্যক হাজীর সমাগম! তখন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন ‘বাস্তবে হাজীর সংখ্যা খুবই সীমিত বরং তুমি বলতে পারো কাফেলার সংখ্যা কতইনা বেশি।’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক-৮৮৩৬)
তালবিয়া হলো হজের স্লোগান। এটি আল্লাহর একত্ববাদ ও মাহাত্ম্য প্রকাশের শ্লোগানও বটে। জাহেলিয়াতের যুগে আরবের বিভিন্ন গোত্রের জন্য স্বতন্ত্র তালবিয়ার প্রচলন ছিল। বিদায় হজের মাধ্যমে প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণের জন্য এই তালবিয়ার প্রচলন করেন। হানাফী মাযহাব মতে ইহরাম বাধার সময় একবার তালবিয়া পাঠ করা ফরজ। একাধিকবার পাঠ করা সুন্নাত। ইহরাম বাধার পরে, আরাফাতের ময়দানে, মিনায়, মুজদালিফায় উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ করতে হয়। এক কথায় হজের সফরে সার্বক্ষণিক ওঠা-বসা, ঘুমাতে যাওয়া, ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর কিংবা স্বাভাবিক চলাফেরাসহ প্রত্যেক ফরজ ও নফল নামাজের পর বেশি বেশি তালবিয়া পড়তে হয়।

হজের তালবিয়া রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়েত স্বরূপ। হজের সফরে যিনি বেশি বেশি তালবিয়া পাঠ করতে পারবেন তিনি তত বেশি সাওয়াব ও কল্যাণের অধিকারী হবেন। হাদিসে এসেছে, হযরত সাহল ইবনে সাদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলে আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, مَا مِنْ مُسْلِمٍ يُلَبِّى إِلاَّ لَبَّى مَنْ عَنْ يَمِينِهِ أَوْ عَنْ شِمَالِهِ مِنْ حَجَرٍ أَوْ شَجَرٍ أَوْ مَدَرٍ حَتَّى تَنْقَطِعَ الأَرْضُ مِنْ هَا هُنَا وَهَا هُنَا ‘কোনো মুসলিম যখন তালবিয়া পাঠ করে, তখন তার (তালবিয়া পাঠকারীর) ডান-বামে যত পাথর, গাছ ও মাটি আছে (এ সবই) তার সঙ্গে তালবিয়া পড়তে থাকে। এমনিভাবে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত গিয়ে তা (পড়া) শেষ হয়। (তিরমিযি-৮২৭) অপর হাদীসে রয়েছে,
عَنْ أَبِي بَكْرٍ الصِّدِّيقِ، أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم سُئِلَ أَىُّ الْحَجِّ أَفْضَلُ قَالَ ‏ “‏ الْعَجُّ وَالثَّجُّ ‏”‏ ‏.‏
হজরত আবু বকর ছিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলে আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কোন ধরণের হজ সর্বোত্তম? তিনি বললেন, ‘আলআজ্জু ওয়াছছাজ্জু’। অর্থাৎ, উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ এবং কুরবানি করা। (তিরমিজী-৮২৮)

পবিত্র কাবাঘর একমাত্র ঘর যেখানে তাওয়াফ করা হয়। তাওয়াফের পর হাজী সাহেবগণ তৃপ্তি সহকারে জমজমের পানি পান করে থাকেন। আল্লাহর মেহমানদের জন্য আল্লাহ তাআলা পবিত্র কাবাঘরের পার্শ্বে অলৌকিক কূপে যে পানি প্রবাহমান রেখেছেন তার নাম জমজম। এর পানি অত্যন্ত বরকতপূর্ণ, ক্ষুধা নিরোধক ও রোগের প্রতিষেধক। হজরত আবু যর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন, প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, إِنَّهَا مُبَارَكَةٌ إِنَّهَا طَعَامُ طُعْمٍ এ পানি অতিশয় বরকতময় ও প্রাচুর্যময় এবং তা অন্যান্য খাবারের মতো তা পেট পূর্ণ করে দেয়। (সহিহ মুসলিম-২৪৭৩) 

প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জমজমের পানি বহন করে নিয়ে যেতেন।
হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের সঙ্গে পাত্রে ও মশকে করে জমজমের পানি বহন করতেন। তা অসুস্থদের ওপর ছিটিয়ে দিতেন এবং তাদের পান করাতেন। (সুনানে তিরমিজি)
জমজমের পানি যে উদ্দেশ্যে পান করা হয় তা পূরণ হয়। হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَاءُ زَمْزَمَ لِمَا شُرِبَ لَهُ ‏ জমজমের পানি যে উদ্দেশ্য নিয়ে পান করবে তা পূরণ হবে। (সুনানে ইবনে মাজাহ-৩০৬২)

ইতিহাস থেকে জানা যায় পূর্বসূরি মনীষীগণ জমজমের পানি পান করার সময় বিভিন্ন দোয়া করতেন। তাদের দোয়া কবুলও হয়েছিল। হাদিসশাস্ত্রের প্রসিদ্ধ ইমাম ইবনে খুজায়মা (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি এতো ইলম কীভাবে অর্জন করলেন? প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘জমজমের পানি যে নিয়তে পান করা হয় তা-ই কবুল হয়।’ আর আমি যখন জমজমের পানি পান করেছিলাম, তখন আল্লাহর কাছে উপকারী ইলম প্রার্থনা করেছিলাম। (সিয়ারু আলামিন নুবালা – ১৪/৩৭০)
হযরত ইয়াহইয়া ইবনে আহমাদ আল আনসারি রহমাতুল্লাহি আলায়হি কোরআন হিফজের নিয়তে জমজমের পানি পান করেন। ফলে তিনি খুবই স্বল্প মেয়াদে কোরআন হিফজ করতে সক্ষম হন।

পবিত্র কাবা ঘরে তাওয়াফকারী ব্যক্তি আল্লাহর অনুগ্রহের মধ্যে প্রবেশ করে। সেখানে প্রতিনিয়তই ১২০ টি রহমত নাযিল হয়। হজ পালনকারী ব্যক্তি বাইতুল্লাহ থেকে ফেরার সময় ক্ষমা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রাপ্ত হয়ে বের হয়। কাবা ঘরে পৌঁছানো হলো মুমিন জীবনে স্বপ্নের কাংখিত অভিযাত্রার ন্যায়। একজন মুমিন সারা জীবন স্বপ্ন লালন করে থাকেন একবার আল্লাহর ঘরে পৌছার জন্য। যেই সফরের প্রতিটি পরতে পরতে অফুরন্ত সাওয়াব পাওয়া যায়। যিনি হজ করতে যাবেন তিনি আল্লাহর মেহমান হয়েই সেখানে গমন করেন। আল্লাহর মেহমানকে সন্তুষ্ট করার জন্য আল্লাহ তাআলাই যথেষ্ট।

লেখক: সিনিয়র শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা), চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল এন্ড কলেজ।

Share:

Leave Your Comment