পৈত্রিক সম্পদে কন্যা সন্তানের অংশ : ইসলামি নীতি ও বর্তমান সমাজ

পৈত্রিক সম্পদে কন্যা সন্তানের অংশ : ইসলামি নীতি ও বর্তমান সমাজ

মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ্ আল-মাসুম>

মহান আল্লাহর সৃষ্টি নারী জাতি পরম শ্রদ্ধেয় মা, আদরের বোন, প্রেমময় স্ত্রী কিংবা স্নেহভাজন কন্যা হিসেবে পুরুষের অর্ন্তজগতকে নিয়ন্ত্রণ করে অঘোষিতভাবে। তাই ইসলাম নারীকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছে । তাকে বসিয়েছে মর্যাদার সুমহান আসনে এবং নিশ্চিত করেছে তার সামগ্রিক অধিকার। সন্তানকে মায়ের সাথে সর্বোচ্চ সদাচরণ ও সেবার আদেশ দেওয়া হয়েছে। স্বামীকে দেওয়া হয়েছে স্ত্রীর ভরণ-পোষণসহ সার্বিক অধিকার আদায়ের আদেশ। কন্যা সন্তানের সঠিক লালন পালন ও সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে প্রবলভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে তার পিতাকে। আলোচ্য নিবন্ধে নারীর অর্থনৈতিক বিশদ অধিকার সম্পর্কে আলোকপাত করার প্রয়াস পেলাম। ইরশাদ হচ্ছে-لِّلرِّجَالِ نَصِيبٌ مِّمَّا تَرَكَ الْوٰلِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ وَلِلنِّسَآءِ نَصِيبٌ مِّمَّا تَرَكَ الْوٰلِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ مِمَّا قَلَّ مِنْهُ أَوْ كَثُرَ ۚ نَصِيبًا مَّفْرُوضًا۝ অর্থাৎ পিতা-মাতা এবং নিকটতর আত্মীয়দের পরিত্যাক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের অংশ আছে এবং পিতামাতা ও নিকটতর আত্মীয়দের পরিত্যাক্ত সম্পত্তিতে নারীরও অংশ আছে। তা অল্পই হোক বা বেশি, এক নির্ধারিত অংশ। ক্বোরআনুল করিমে শরীয়তের বিভিন্ন আহকাম ও বিধানের বিবরণ উসূল ও মূলনীতি রয়েছে। আর সেগুলোর বিশদ ব্যাখ্যা ও বিবরণ রয়েছে হাদীস শরীফে। কিন্তু উত্তরাধিকারের বিষয়টি এর ব্যতিক্রম। প্রত্যেক ওয়ারিসের অংশ এক এক করে কুরআনুল করিমে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর কারণ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন- آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ لَا تَدْرُونَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ لَكُمْ نَفْعًا ۚ فَرِيضَةً مِّنَ اللهِ ۗ إِنَّ اللهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيْمًا۝ অর্থাৎ তোমাদের পিতা ও সন্তানদের মধ্যে কে তোমাদের জন্য অধিক উপকারী তোমরা তা জান না। নিশ্চয় এটা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত অংশ। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। আর তাই মীরাছের নির্ধারিত অংশের উপর আপত্তি করা, জুলুম কিংবা বৈষম্যের অভিযোগ তোলার অর্থ সরাসরি রব্বে করিম আল্লাহ তায়ালার উপর অভিযোগ তোলা। ইরশাদ হচ্ছে, تِلْكَ حُدُودُ اللهِ وَمَنْ يُطِعِ اللهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِى مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ ۝ وَمَنْ يَعْصِ اللهَ وَرَسُولَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُهِينٌ۝ অর্থাৎ এইসব আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসরণ করবে আল্লাহ তাকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। সেখানে তারা স্থায়ী হবে এবং এটা মহাসাফল্য। পক্ষান্তরে যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হবে এবং তাঁর নির্ধারিত সীমাকে লঙ্ঘন করবে তিনি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং তার জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর শাস্তি।

কেউ পুত্র সন্তানকে বেশি পছন্দ করেন, কেউ কন্যা সন্তানকে। তবে মানবীয় দুর্বলতার কারণে অধিকাংশ মানুষই পুত্র সন্তান বেশি পছন্দ করে। মমতা ও মনের টান যেহেতু মানুষের ইচ্ছাধীন নয় তাই কারো প্রতি মনের টান বেশি হলে বা কম হলে মানুষ অপরাধী হয় না, কিন্তু এর প্রকাশটি যেহেতু মানুষের ইচ্ছা ও ইখতিয়ারের অধীন তাই এ বিষয়ে সমতা বজায় রাখা অপরিহার্য। অনেকে এই সমতা রক্ষা করেন না। পুত্র-কন্যার মাঝে অসম আচরণ করেন। পুত্রকে বেশি আদর করেন, উপহার বেশি দেন, বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যান। পক্ষান্তরে কন্যার খোঁজখবরও নিতে চান না। বস্তুত আচার-আচরণে পিতা-মাতা থেকে এমন কিছু প্রকাশ পাওয়া উচিত নয়। সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার এমন অসম আচরণ অন্যায়। কিয়ামতের দিন এ জন্য তাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে। এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে এসেছে, একদা জনৈক আনসারী সাহাবীকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ডাকলেন। ইতিমধ্যে ঐ সাহাবীর এক পুত্র সন্তান তার কাছে এল। তিনি তাকে চুমু খেয়ে বুকে জড়িয়ে নিলেন এবং কোলে বসালেন। কিছুক্ষণ পর তার এক কন্যাও সেখানে উপস্থিত হল। তিনি তার হাত ধরে নিজের কাছে বসালেন। এটি অবলোকন করে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন- ولو عدلت كان خيرا لك، قاربوا بين أبنائكم ولو في القبل. অর্থাৎ উভয় সন্তানের প্রতি তোমার আচরণ অভিন্ন হওয়া উচিত ছিল। তোমরা নিজেদের সন্তানদের মাঝে সমতা রক্ষা করো। এমনকি চুমু খাওয়ার ক্ষেত্রেও।

সুতরাং পিতা-মাতা যখন সন্তানদেরকে ভরণ পোষণ টাকা-পয়সা, কাপড়-চোপড় কিংবা কোনো খাদ্যদ্রব্য কিংবা হাদিয়া দেবে তখন সকলকে সমান হারে দিতে হবে। কন্যাকে ঠিক ততটুকুই দেবে যতটুকু পুত্রকে দেওয়া হয়েছে। ছেলেকে বেশি আর মেয়েকে কম কিংবা এর বিপরীত করা যাবে না। বিশেষ করে আনন্দের উপলক্ষগুলোতে যখন সন্তানদেরকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু দেওয়া হয় তখনও সমতা রক্ষা করা অপরিহার্য। একদা হযরত বশীর ইবনে সাদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু একবার নিজপুত্র নুমান ইবনে বশীরকে কিছু জিনিস হাদিয়া দিলেন এবং নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামাকে স্বাক্ষী বানানোর জন্য নুমানকে তাঁর নিকট নিয়ে এলেন। হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি তোমার সকল সন্তানকে এরূপ উপহার দিয়েছ? তিনি বললেন, জ্বী না। অতঃপর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন- فاتقوا الله واعدلوا في أولادكم. وفي رواية : قاربوا بين أولادكم. অর্থাৎ আল্লাহকে ভয় কর এবং সন্তানদের মাঝে সমতা রক্ষা কর। (আর এতটুকু চেষ্টা অবশ্যই কর যে, উপহার-সদাচার ইত্যাদির ক্ষেত্রে প্রত্যেকের অংশ যেন কাছাকাছি হয়।) তবে পিতামাতা যদি কোন সন্তানের প্রয়োজনের খাতিরে অন্যদের চেয়ে তার পেছনে তুলনামূলক বেশি ব্যয় করে, যেমন কারো অসুস্থতার সময় কিংবা পড়াশোনার জন্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাদেরকে প্রয়োজন অনুপাতে কম-বেশি প্রদান করেন তাহলে অসুবিধা নেই।

নারীর ইনসাফপূর্ণ অর্থনৈতিক হক
ইসলামি অর্থনীতির মীরাছ-ব্যবস্থায় নারীর অধিকার সুসংরক্ষিত। নারীর জন্য নির্ধারিত একাধিক অংশ সমষ্টি করলে প্রতীয়মান হয় যে, নারীর প্রাপ্য সম্পদ পুরুষের চেয়েও কোন অংশে কম নয়, বরং সর্বোপরি পুরুষের চেয়েও বেশি। ইসলামি মীরাছ ব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে নারীর তিনটি অবস্থা দেখা যায়। যথা-

প্রথমত-নারীর অংশ পুরুষের সমান
ক. দাদা-দাদী দুজনের অংশ ছয় ভাগের এক ভাগ; যদি মৃতের পুত্র বা পৌত্র থাকে। অর্থাৎ পুত্র ৪৫.১৬৬%, দাদী ১৬.৬৬%, দাদা ১৬.৬৬%, স্ত্রী ১২.৫%।
খ. পিতা-মাতা দুজনেরই অংশ ছয় ভাগের এক ভাগ, যদি মৃতের পুত্র বা পৌত্র থাকে। অর্থাৎ পিতা ১৬.৬৬%, মাতা ১৬.৬৬%, স্ত্রী ১২.৫%, ও পুত্র ৫৪.১৬৬%। এটা ক্বোরআনুল করিমেরই বিধান। ইরশাদ হচ্ছে- وَلِأَبَوَيْهِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَكَ إِنْ كَانَ لَهُ وَلَدٌ فَإِنْ لَمْ يَكُنْ لَهُ وَلَدٌ۝ অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে পিতা-মাতার উভয়ে প্রত্যেকের জন্য এক ষষ্ঠাংশ পাবে যদি তার পুত্র সন্তান থাকে।
গ. বৈপিত্রেয় ভাই-বোন একত্রে থাকলে তিন ভাগের এক ভাগ সম্পত্তি উভয়ে সমান ভাগে ভাগ করে নেবে। অর্থাৎ বৈপিত্রেয় একভাই ও এক বোন প্রত্যেকে ৩৩.৩৩%, সহোদর দুই ভাই-বোন ৬৬.৬৬% পাবে। ইরশাদ হচ্ছে- وَإِنْ كَانَ رَجُل یُورَثُ كَلَالَةً أَوِ ٱمۡرَأَة وَلَهُۥۤ أَخٌ أَوۡ أُخۡت فَلِكُلِّ وَاحِد مِّنۡهُمَا السُّدُسُۚ فَإِنْ كَانُوا أَكۡثَرَ مِن ذ ٰلِكَ فَهُمۡ شُرَكَاۤءُ فِی الثُّلُثِۚ۝ অর্থাৎ যদি পিতা ও সন্তানহীন কোনো পুরুষ অথবা নারীর উত্তরাধিকারী থাকে, তার এক বৈপিত্রেয় ভাই বা ভগ্নী তাহলে প্রত্যেকের জন্য এক ষষ্ঠাংশ। তারা একাধিক হলে সকলে সম অংশীদার হবে এক তৃতীয়াংশে। উপর্যুক্ত উদাহরণে দেখা যাচ্ছে, একই মৃত ব্যক্তির মীরাছে বিশেষ কিছু নারী ও পুরুষকে সমান অংশ দেওয়া হয়েছে।

দ্বিতীয়ত-নারীর অংশ পুরুষের চেয়ে বেশি
মীরাছে পুত্র ও ভাইয়ের অংশ যেহেতু নির্ধারিত নয় তাই ভাই ও পুত্র কখনো বোন ও কন্যা থেকে কম পেয়ে থাকে। যেমন মৃত ব্যক্তির পিতা, মাতা এবং স্বামী বা স্ত্রীর সাথে শুধু দুই কন্যা থাকলে কন্যা যতটুকু পায় শুধু দুই পুত্র থাকলে তারা তার চেয়ে কম পেয়ে থাকে। প্রথম ক্ষেত্রে মীরাছের অংশ হবে নিম্নরূপ: স্ত্রী ১১.১১%, পিতা ১৪.৮১%, মাতা ১৪.৮১% এবং প্রত্যেক কন্যা ২৯.৬২৯% করে। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে মীরাছের অংশ হবে নিম্নরূপ : স্ত্রী ১২.৫%, পিতা ১৬.৬৬%, মাতা ১৬.৬৬% এবং প্রত্যেক পুত্র ২৭.০৮% করে পাবে। তাহলে ১ম ক্ষেত্রে প্রত্যেক কন্যা ২৯.৬২৯% পাচ্ছে, অথচ ঐ আত্মীয়দের সাথে পুত্র পাচ্ছে ২৭.০৮%। উপর্যুক্ত উদাহরণে একই ধরনের আত্মীয় রেখে দু’জন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছে, কিন্তু আত্মীয়তার ক্ষেত্রে ভিন্ন হয়েও এক মৃত ব্যক্তির নারী ওয়ারিসরা অপর মৃত ব্যক্তির পুরুষ ওয়ারিসদের চেয়ে সম্পদ বেশি পেয়েছে। অথচ সমপর্যায়ের পুরুষ মীরাছ পায় না কিন্তু নারী পায়। যেমন-১. নানী ছয় ভাগের এক ভাগ পায়, কিন্তু নানা কিছুই পায় না। ২. মৃতের স্বামী এবং সহোদরা বোনের সাথে বৈমাত্রেয় বোন থাকলে বৈমাত্রেয় বোন অংশ পায়। কিন্তু এক্ষেত্রে বৈমাত্রেয় ভাই থাকলে সে পায় না।

তৃতীয়ত-এক পুরুষ পায় দুই নারীর অংশ
কোন কোন ক্ষেত্রে একজন পুরুষ দুইজন নারীর সমান অংশ পেয়ে থাকে। ইরশাদ হচ্ছে- يُوصِيكُمُ اللهُ فِىٓ أَوْلٰدِكُمْ ۖ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنثَيَيْنِ۝ অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির পুত্র-কন্যা দুটোই যদি থাকে তাহলে পুত্র পাবে কন্যার দ্বিগুণ। তেমনি পৌত্র ও পৌত্রী থাকলে পৌত্র পাবে পৌত্রীর দ্বিগুণ।
অন্যত্র বর্ণিত রয়েছে- وَإِنْ كَانُوا إِخْوَةً رِجَالًا وَنِسَاءً فَلِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ۝
অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির সহোদর ভাই-বোন দুজনই যদি থাকে তাহলে ভাই পাবে বোনের দ্বিগুণ। উপর্যুক্ত বিধানে এক্ষেত্রে এক পুরুষ দুই নারীর সমান অংশ পাওয়ার কারণ, কম-বেশি শুধু নারী বা পুরুষ হওয়ার কারণে নয়; বরং দায়িত্ব, খরচ ও মৃতের সাথে সম্পর্কের মতো গভীর ও মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পুরুষকে সর্বক্ষেত্রে অধিক অংশ দেয়া হয়নি। কোন ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অংশ সমান, কোন ক্ষেত্রে বেশি। সুতরাং ইসলামে পুরুষের অংশ নারীর দ্বিগুণ-এটি ইসলামী মীরাছ-ব্যবস্থার খন্ডিত উপস্থাপনা। ইসলামি মীরাছ-ব্যবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞতার ফলে ইসলাম বিদ্বেষিরা অপপ্রচার করে যে, ‘‘ইসলামে পুরুষকে নারীর দ্বিগুণ সম্পদ দেওয়া হয়েছে। এটা মূলত নারী-পুরুষের মাঝে বৈষম্যমূলক চেতনারই প্রতিফলন।’’ অথচ সর্বস্বীকৃত নীতি হল, ‘‘দায় অনুযায়ী প্রাপ্তি’’ যাকে শরীয়তের ভাষায় الغنم بالغرم বলা হয়েছে। অর্থাৎ যার দায় বেশি তার প্রাপ্তি বেশি, যার দায় কম তার প্রাপ্তি কম। পরিবার, সন্তান-সন্ততি ও ধন-সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব পুরুষের উপর। শত্রুর মোকাবেলা করার দায়িত্ব পুরুষেরই। পরিবার ও সন্তান-সন্ততির ভরণপোষণ, তাদের চিকিৎসা ও বাসস্থানের দায়িত্বও পুরুষের উপর । নারীর উপর এমন কোন দায়িত্ব অর্পণ করা হয়নি। বরং নারীর সকল খরচ পুরুষকে বহন করতে হয়। এমনকি যদি কোন কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে তাহলেও ইদ্দত চলাকালীন স্ত্রীর ভরণ- পোষণ ও থাকার ব্যবস্থা পুরুষের দায়িত্বে। ইরশাদ হচ্ছে, তোমরা তোমাদের সামর্থ অনুযায়ী যেরূপ গৃহে বাস কর তাদেরকেও (তালাকপ্রাপ্তাদেরকে) বসবাসের জন্য সেরূপ গৃহ দাও। তাদেরকে কষ্ট দিয়ে সংকটাপন্ন করো না। যদি তারা গর্ভবতী হয় তবে সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত তাদের ব্যয়ভার বহন করবে। যদি তারা তোমাদের সন্তানদেরকে স্তন্য দান করে তবে তাদেরকে প্রাপ্য পারিশ্রমিক দিবে। … সামর্থ্যবান তার সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যয় করবে। আর যার সামর্থ্য কম সে সেই অনুযায়ী ব্যয় করবে। সন্তান এবং সন্তানের মাতার খরচের দায়িত্ব পিতার উপর। ইরশাদ হচ্ছে, সন্তানের পিতার উপর দায়িত্ব নিয়ম অনুযায়ী মাতার খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করা। মোহর আদায়ের দায়িত্ব পুরুষের উপর। ইরশাদ হচ্ছে, আর তোমরা স্ত্রীদেরকে খুশিমনে তাদের মোহর দিয়ে দাও। বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে গেলে প্রদেয় মোহর ও অন্যান্য সম্পদ স্ত্রী থেকে ফেরত নেওয়া নিষেধ। ইরশাদ হচ্ছে, যদি তোমরা এক স্ত্রীর স্থলে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করতে চাও (সঙ্গত কারণে শরীয়তসম্মত পন্থায় তালাক ও নিকাহর মাধ্যমে) এবং তাদের একজনকে প্রচুর ধনসম্পদ প্রদান করে থাক তবে তা থেকে কিছুই ফেরত নিও না। আর এই স্ত্রী অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে আবারও মোহর পাবে। কিন্তু পুরুষ দ্বিতীয় বিবাহ করলে সেখানেও তাকে দিতে হবে।
মেয়েকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করার পরিণাম

মেয়েকে তার প্রাপ্য অংশ থেকে কম দেওয়া বা একেবারেই না দেওয়া শরীয়তের দৃষ্টিতে জুলুম ও নাজায়েয। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হচ্ছে, যে ব্যক্তি তার ওয়ারিশকে মীরাছ থেকে বঞ্চিত করে আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতের অংশ থেকে বঞ্চিত করবেন। নারীর প্রতি এই অবিচার মূলত জাহেলি যুগ থেকে চলে আসা ভ্রান্ত চিন্তারই কুফল। জাহেলি যুগে আরবের কাফিররা কন্যা সন্তানকে কোন কিছুই মনে করত না। এমনকি তাদেরকে বাঁচার অধিকারটুকু দিতেও প্রস্ত্তত ছিল না। আর এখন মুসলমানরাও মেয়েদেরকে মীরাছ থেকে বঞ্চিত করে। বিয়ে-শাদিতে প্রথাগত সামান্য কিছু ব্যয় করেই মনে করে যে, তাদের হক আদায় হয়ে গেছে। এখন অবশিষ্ট সম্পদে তাদের কোন অধিকার নেই, এতে শুধু পুত্রদের অধিকার। মুলত এ চিন্তা ও রীতি সম্পূর্ণ ভুল; বরং পিতার সম্পদে পুত্র-কন্যা উভয়ের অধিকার রয়েছে। সুতরাং তাদের সাথে ন্যায়সঙ্গত আচরণ করা জরুরি।

জীবদ্দশায় সম্পত্তি বণ্টন আবশ্যক কিনা?
অনেকে জীবদ্দশাতেই স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পদ সন্তানদের মাঝে বণ্টন করতে চায়। প্রথমত, এটা কোন অপরিহার্য বিষয় নয়। দ্বিতীয়ত, পিতা-মাতার জীবদ্দশায় তাদের সম্পদে সন্তানদের কোন অধিকার সাব্যস্ত হয় না; বরং মাতা-পিতাই নিজ সম্পদের মালিক। তারা ইচ্ছা করলে সন্তানদের মাঝে তা বণ্টন করতেও পারেন, ইচ্ছা করলে নাও করতে পারেন। সন্তানরা পিতা-মাতার কাছে এই দাবি করতে পারে না যে, আপনারা যা কিছু উপার্জন করেছেন তা আমাদের মাঝে বণ্টন করে দিন। অনেক সন্তান এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি করে এবং এই বলে পিতা-মাতাকে বাধ্য করে যে, “আপনার তো এখন আর এই সম্পদের প্রয়োজন নেই, এগুলো তো এখন আমাদের অধিকার। তাই জীবিত অবস্থায়ই সবকিছু বণ্টন করে ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে যান। ক্ষেত্রবিশেষে এ নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ হতে পারে। সুতরাং এখনই জমিজমা বণ্টন করুন।” মনে রাখতে হবে যে, পিতা-মাতাই তাদের সম্পদের মালিক। সুতরাং বণ্টন করা, না করার বিষয়ে তারা স্বাধীন। অবশ্য মাতা-পিতা যদি মনে করেন যে, তাদের জীবদ্দশাতেই সম্পদ বণ্টন করে দেওয়া সমীচীন হবে তাহলে তারা তা করতে পারেন। যদি পিতা-মাতা জীবদ্দশাতেই সন্তানদের মাঝে নিজেদের সম্পদ বণ্টন করতে চান তবে এক্ষেত্রেও উত্তম হল শরীয়তের মীরাছ-ব্যবস্থার নীতিমালা অনুযায়ী তা বণ্টন করা এবং প্রত্যেককে তার প্রাপ্য অংশ হস্তান্তর করে দেওয়া। তবে এই অগ্রিম বণ্টন যেহেতু প্রকৃত মীরাছ বণ্টন নয় তাই এক্ষেত্রে ছেলে-মেয়েকে সমান হারে দেওয়ারও সুযোগ রয়েছে।
মনে রাখা উচিত যে, মৃত্যু-পূর্ব সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে কোনো ছেলে বা মেয়েকে বঞ্চিত করা কিংবা মীরাছের প্রাপ্য অংশ থেকে কম দেওয়া জায়েয নেই। সুতরাং তা থেকে বেঁচে থাকা জরুরি।

কোন কোন মাতা-পিতা তাদের জীবদ্দশায়ই তাদের সম্পদ শুধু মৌখিক বা লিখিত আকারে বণ্টন করে দেন। যেমন ঐ জমি এই ছেলের নামে, অমুক দোকান ঐ ছেলের নামে, অমুক ফ্ল্যাট এই মেয়ের নামে, অমুক প্লটটি অমুক মেয়ের নামে ইত্যাদি। কিন্তু প্রত্যেকের অংশ পৃথক পৃথক করে তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপর্যুক্ত মৌখিক বা লিখিত ঘোষণার পরও সম্পদ পিতা-মাতার কব্জাতেই থাকে। প্রত্যেকের অংশ তার কাছে হস্তান্তর করা হয় না। বস্তুত হস্তান্তর করা ছাড়া শুধু মৌখিক বা লিখিত বণ্টনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা শরীয়তে নেই এবং এভাবে তাদের মালিকানাও প্রতিষ্ঠিত হয় না; বরং তা যথারীতি পিতার সম্পদ বলেই গণ্য হয়। ফলে পিতার মৃত্যুর পর মীরাছ বণ্টনের নিয়ম অনুযায়ী পুনরায় তা বণ্টন করতে হবে। তাই জীবদ্দশায় সম্পদ বণ্টন করতে চাইলে সঠিক পদ্ধতি হল, প্রথমে বণ্টনযোগ্য সকল সম্পদ পৃথক পৃথক করে ভাগ করবে। এরপর সন্তানদের হাতে তা হস্তান্তর করবে। আর সম্পদ বিভিন্ন ধরনের হলে কমপক্ষে এসবের চাবি, ডকুমেন্ট বা মালিকানা সার্টিফিকেট ইত্যাদি হস্তান্তর করতে হবে। আরো সহজ ও উত্তম পন্থা হলো যিনি জীবদ্দশায় তার সকল সম্পদ বণ্টন করতে চান তিনি প্রথমে মুফতীর কাছ থেকে তার করণীয় বুঝে নিবেন। এরপর সে নিয়মে বণ্টন করবেন। যেন তার এই বণ্টনটি শরীয়তের দৃষ্টিতেও গ্রহণযোগ্য হয়।

বিবাহের কারণে কন্যার অধিকার রহিত হয় কি?
আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় দেখা যায়, পিতা তার জীবদ্দশায় সম্পদ বন্টন করার ক্ষেত্রে আপন মেয়েদেরকে সম্পদ দেয় না। অথবা এমনও দেখা যায়, পিতার মৃত্যুর পর আপন ভাইয়েরা বোনকে বিয়ে দেয়ার সময় কৃত খরচের অজুহাত দেখিয়ে পৈত্রিক সম্পদ দিতে চাই না। মেয়েরা যদি পিতা অথবা ভাই থেকে প্রাপ্য সম্পদ দাবি করে তখন জবাবে বলে, “আমি তো মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। বিবাহের সময় তাকে যা কিছু দিয়েছি তাতেই তার পাওনা আদায় হয়ে গেছে।” অথচ বিয়ের সময় মেয়েকে আসবাবপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী দেওয়ার কারণে তার মীরাছের হক শেষ হয়ে যায় না। কেননা, এটি ছিল ঐচ্ছিক বিষয়। এ কারণে তাকে পিতার সম্পদ থেকেও বঞ্চিত করা যাবে না। বরং এ ক্ষেত্রেও সমতা রক্ষা করা উচিত। যার সহজ উপায় হল, নিজের আর্থিক সঙ্গতি অনুসারে আগে ভাগেই নির্দিষ্ট করে নেয়া যে, প্রত্যেক পুত্র-কন্যার বিয়েতে এই পরিমাণ অর্থ ব্যয় করব। এরপর সে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ থেকে ছেলে-মেয়ের বিয়ের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করবে। যদি কারো ক্ষেত্রে কিছু বেঁচে যায় তাহলে নগদ আকারে তা প্রদান করবে। মোটকথা মেয়ের বিয়েতে সবকিছু দিয়ে দিয়েছি, এখন আর তার কোনো অধিকার নেই, জীবদ্দশাতেও সে আর কিছু পাবে না, মৃত্যুর পরও মীরাছের সম্পদে তার কোনো অধিকার থাকবে না-এমনটি বলা এবং বাস্তবায়ন করা স্পষ্ট জুলুম এবং শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম। তাই আসুন, মুসলিম সমাজের প্রতিটি পুরুষ শপথ করি, আমি ব্যক্তি জীবনে নারীর সকল প্রাপ্য যথাযথভাবে পরিশোধ করব, তেমনি সমাজ-জীবনেও তাঁর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় সর্বশক্তি নিয়োজিত করব।
লেখক: আরবী প্রভাষক, তাজুশ শরীআহ মাদ্রাসা, বিবিরহাট, পাঁচলাইশ, চট্টগ্রাম।

 

Share:

Leave Your Comment