শেরে মিল্লাত আল্লামা নঈমী ’র স্মরণে আজও অনুরণিত যে সুর

শেরে মিল্লাত আল্লামা নঈমী ’র স্মরণে আজও অনুরণিত যে সুর

আল্লামা হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান

আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন কুল মাখলুকাতের স্রষ্টা ও পালনকর্তা। অতএব ইনসানেরও স্রষ্টা ও পালনকর্তা। তবে, ইনসানের স্রষ্টা-এ ঘোষণার সাথে যে বৈশিষ্ট্য তিনি ব্যক্ত করেন, তা আর কোন সৃষ্টির প্রসঙ্গে নেই। তা হল, ‘রহমান স্রষ্টা’ পরিচয়ের পর তিনি বলেছেন, খালাকাল ইনসান, আল্লামাহুল বায়ান।’ এ বর্ণনা শৈলী যদিও পূর্ণাঙ্গভাবে ‘মুহসিনে ইনসা-নিয়ত হুযূরে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তাঁর না-য়েব হিসেবে এক শ্রেণীর ইনসানের ক্ষেত্রে এর প্রযোজ্যতা সব সৃষ্টিকে ছাড়িয়ে। যা আদম সৃষ্টির পরে ফেরেশতাদের ডেকে আল্লাহ্ তা‘আলা পরীক্ষা গ্রহণ পূর্বক তা প্রমাণ করত: হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম-এর খেলাফত অনুষ্ঠানিকভাবে ফেরেশতাদের সামনে অভিষেক করেন।

আমার প্রতিপাদ্য হুযূর শেরে মিল্লাত আল্লামা নঈমী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র বহুগুণের মধ্যে যে গুণটি আপামর সুন্নী জনগোষ্ঠির মাঝে তাঁকে মধ্যমণি হওয়ার বিরল প্রতিষ্ঠা দিয়েছে তা হলো তাঁর বাগ্মিতা। তাঁর প্রখর মেধা, তাঁর অসাধারণ স্মৃতিশক্তি, তাঁর অদম্য সৎ সাহস, তাঁর উপস্থিত তীক্ষè বুদ্ধি, অজেয় মনোবল- কীভাবে তাঁর গুণপনা বর্ণনা করবো? পর্যাপ্ত শব্দমালা যে আমার নেই। এক কথায় তিনি একের ভেতর অনেক। তিনি দরস দানেও সাবলীল, তাঁর বর্ণনা শৈলী সুস্পষ্ট, আত্মবিশ্বাস তাঁকে অজেয় ইমেজ দিয়েছে। ছাত্রদের তিনি কটমট চাহনী আর ধমক দিতেন না; কিন্তু শ্রেণী কক্ষে প্রবেশ করার সাথে সাথে শ্রেণী কক্ষের অনুুকুল পরিবেশে আপনিই ফিরে আসত। এ ছিল তাঁর একান্ত ব্যক্তিত্বের প্রভাব। অসংখ্য সুন্নী আলিমের প্রাণ-প্রিয় শিক্ষাগুরু হিসাবে তিনি ঈর্ষণীয় ইমেজের ধারক-বাহক, সর্বোপরি যে কোন স্থানে, যে কোন পরিস্থিতিতে মধ্যমণি হিসাবে সর্বত্রই বরেণ্য হয়ে যেতেন।

যুগশ্রেষ্ঠ বিশ্ববরেণ্য ওলামায়ে কেরামের সাথে তাঁর যোগাযোগ, তাঁর মেলা-মেশা, সুন্নীয়তের দিকপালগণের সাথে তাঁর সখ্য, নেটওয়ার্ক তাঁকে দিয়েছে এক বিশ্বজনীন পরিচিতি ও অনস্বীকার্য ইমেজ। ইমাম শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র সাথে দিগ-দিগন্তে ছুটে যাওয়ার অদম্য নেশা তাঁর মাঝে সঞ্চার করেছে ঈমান-আক্বীদা, মাযহাব-মিল্লাতের সুরক্ষার অনন্য তাগিদ। বিশেষ করে ঈমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা শাইখ নুরুল ইসলাম হাশেমী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর হাতে গড়া মুনাযির, শিল্পশৈলীবৎ মুনাযারায় তিনি সময়ের কিংবদন্তী রূপে নিজস্ব ইমেজ দাঁড় করিয়েছেন। এ জুটি বরাবরই ছিল বাতিলের আতঙ্ক, তাঁর শৈল্পিক উপস্থাপন প্রতিপক্ষকে নিমেষেই হতভম্ব করে রণেভঙ্গ দিতে বাধ্য করত। হাশেমী-নঈমী জুটির কথা শুনতেই পৃষ্ঠ প্রদর্শন করতে দেখা যেত যে কোন বাতিল ফির্কাকে। ফকিটছড়ির কোন এক অঞ্চল হতে শেরে মিল্লাত হুযূরের কাছে ফোন করে কোন এক ব্যক্তি তাঁকে আকস্মিকভাবে সেখানে যেতে কাকুতি মিনতি করছিল। সেখানের সুন্নী ভাইয়েরা একটা মাহফিল আয়োজনের প্রস্তুতি নিতে দেখে পার্শ্ববর্তী কওমী মাদ্রাসার দু’জন মৌলভী এসে বললো, ‘ওয়াজ নয়, আমাদের সাথে মুনাযারাই আগে হবে।’ তখন লোকটির জবাবে হুযূর বললেন, ‘আমি দূরে এক মাহফিলে যাবো, এক কাজ করো, সেটা তাদের বলার দরকার নেই; আমি এবং হাশেমী সাহেব হুযূর’র নাম মাইকে প্রচার করে দাও এবং বলে দাও যে, আমরা আসছি। দেখা গেল, এটুকুতে কেল্লাফতে তারা সন্ধ্যার পরে আর বাইরেও আসেনি। যাঁর নাম বাতিলের বুকে এমন ভীতি সঞ্চার করে তিনি তো যর্থার্থ বাতিলের জন্য মিল্লাত’র শের বা সিংহশার্দুল। প্রায় বক্তৃতা-বাগীশ আত্মপক্ষের যশঃ গীতি গেয়েই ‘বাহবা’ কুড়ান; কিন্তু বাতিলের ভিত কাঁপানোর মত দুরূহ ও ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় কথা বলতে হাতে গোনা বজ্রকন্ঠ শোনা যায়। তাঁর দুঃসাহসী এ ইমেজ অতিক্রম করার মত অকুতোভয় কর্ণধার, নিঃস্বার্থ, নির্লোভ সিপাহ্ সালার আহলে সুন্নতের অনুসারী এদেশের এ প্রজন্মের বড়ই দুর্লভ বৈকি।

উপস্থিত সমাবেশকে সমানভাবে কাঁদাতে আর হাসাতে সমান পারঙ্গম ছিলেন তিনি। বলুয়ার দীঘির পাড়স্থ খানকাহ্-এ কাদেরিয়া শরীফে আয়োজিত ১০ দিন ব্যাপী ‘সুলতানে কারবালা’ মাহফিলে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা সবাই স্বাক্ষ্য দেবেন, তাঁর হৃদয়গ্রাহী, মর্মস্পর্শী শাহাদাতের বয়ান শুনে শুধু শ্রোতাবৃন্দই নয়, মনে হচ্ছিল পুরো দালানের দেওয়াল পর্যন্ত শোকে ক্রন্দনরত ছিল। এরূপ বহু ঘটনার স্বাক্ষী খুঁজলে এন্তার পাওয়া যাবে। কে জানত একদিন সবাইকে কাঁদিয়ে হাসি মুখ নিয়ে তিনি নিজে এত সহসা স্মৃতি হয়ে যাবেন, তাঁর স্মৃতি গাঁথা লিখতে এত দ্রুত কলম ধরতে হবে।
পৌরুষদীপ্ত তাঁর ভরাট কন্ঠটিতে এত সুরের বৈচিত্র শোনা যেত, আর এত উচুঁ কন্ঠে তিনি গযল না’ত সহকারে ওয়াজের ইন্দ্রজাল রচনায় পারঙ্গম আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু! উঠোনে উঠোনে ওয়ায করে যারা প্রায় সারা রাত কাটান, তাঁরা সচরাচর দিবা-নিদ্রায় বেঘোর থাকার দরুন জনসমক্ষে অন্ততঃ এ বেলা আসেন না, নিশাচরদের রুটিন ভিন্ন হওয়াই সঙ্গত। আর শাইখুল হাদীস হুযূর নঈমী সাহেব রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ভোর বেলা তাখাস্সুস (বিশেষ দরসে হাদীস)’র ক্লাসে নিয়মিত পাঠ দানে হাযির। বিকেল অব্দি ক্লাস, বিকেল বেলায় শিডিউল মাহফিলের উদ্দেশ্যে দূর দুরান্তের গন্তব্যে রওয়ানা। আরো আশ্চর্যের বিষয় যে, অনিদ্রা, অবিশ্রাম সত্ত্বেও তাঁকে কখনো হাই তুলতে আমি অন্ততঃ দেখিনি।

মানুষটির চেহারাও কত কমনীয়, মায়াবী অথচ আত্মবিশ্বাস ও পৌরুষ দীপ্ত এ মর্দ্দে মুজাহিদ’র গম্ভীর ব্যক্তিত্বে তাঁর প্রতি সমীহ জাগত সবার। সুরেলা সে কন্ঠের যাদু অবিস্মরণীয়। প্রত্যক্ষদর্শী অনেকে এখনো বেঁচে আছেন, কুলগাঁও বটতলী শাহী মসজিদে প্রায় মাহফিলে হুযূর শেরে মিল্লাতের তাকরীর অবধারিত থাকত। ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা হাশেমী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এতে সভাপতিত্ব করতেন। এক মাহফিলে সেই সুরেলা যাদু কন্ঠে নঈমী সাহেব হুযূর রাহমাতুল্লাহি আলায়হি উচ্চকিত কন্ঠের সর্বোচ্চ ভল্যুমে শে’র এর একটি টান দিতে এক যুবক আবেগাপ্লুত কন্ঠে চিৎকার দিয়ে বেহুশ হয়ে যান। ঘটনা এখানে শেষ নয়, সে আর সংজ্ঞা ফিরে পায়নি। কারণ অজ্ঞাত, সম্ভবত: সে প্রিয়নবীর অনিন্দ্য মায়াবী রূপ প্রত্যক্ষ করেছিল, বিচিত্র কী, হযরত ইউসুফ আলায়হিস্ সালাম-এর রূপ দর্শনে মিশরের রমণীরা লেবুর স্থলে নিজ হাত কেন কাটল?

কাঁদানোতে পারঙ্গম এ মহাপুরুষ সহস্র জনতাকে মুহুর্তেই হাসাতেও পারঙ্গম ছিলেন। বোয়ালখালীর এক মাহফিল। উনি দরুদের সরস পরিবেশনায় রত বহুল পঠিত, এ অঞ্চলে ব্যাপক প্রচলিত ‘সালাতুন্ ইয়া . . . . . . . .’’ দরূদ সমবেত কন্ঠে জনতাও আবেগে পরিবেশন রত ‘ইয়া হাবীবাল্লাহ্ আলাইকুম,’ সামনের সারির এক যুবক শ্রোতা দরাজ কন্ঠে দরূদের শেষ ‘আলাইকুম’ বার বার অধিকক্ষণ দীর্ঘায়িত করছিল। এতে পরবর্তী শে’র সূচনায় হুযূরের ব্যঘাত হচ্ছিল, তখন তিনি হঠাৎ থেমে যুবকটাকে বললেন আঞ্চলিক ভাষায় ‘‘ওয়া এয়া, তোঁয়ার কুম ইবা বাইট্যা গরো।’’ অর্থাৎ কুম শব্দটি কম দীর্ঘ করো। এরূপ সরস পরিবেশনা, একক পান্ডিত্যে নিজের তুলনা তিনি নিজে।

সাধারণ মানুষ তো বটেই, তাঁর এমন মজার পরিবেশনায় মুর্শিদে করীম আল্লামা সাইয়্যিদ তাহের শাহ্ (মু.জি.আ.) যিনি হাস্যরস তো দূরে, আলাপও করেন অতি অল্প, তিনিই নঈমী সাহেব হুযূর’র পরিবেশনায় না হেসে পারেননি অনেক বার। জশনে জুলুসে জামেয়ার সালানা জলসায় ভাইদের তাহসীল, সিলসিলার কাজ পরিচালনার মুহুর্তগুলোতে তাঁর শুণ্যতা অতি তীব্র হয়ে অনুভূত হয়। তবুও মনে হয়, হুযূর চিরকাল আশে-পাশে কোথাও তিনি আছেন, এক্ষণেই হেসে দাঁড়াবেন। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর মকাম বুলন্দ করুন, ‘‘থা-ম্ লে মুর্শিদ কা দা-মন, এ্যয় নঈমী তা আবাদ . . . . . . .’’ আমীন।

১৪ জিলক্বদ হুযূর শেরে মিল্লাত শাইখুল হাদীস আল্লামা নঈমী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির ওফাত বার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। তাঁর রফ্্ঈ দরজাত কামনা করছি।

লেখক: আরবী প্রভাষক- জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাস, চট্টগ্রাম।

Share:

Leave Your Comment