রোযা ও তাওবাহ্

রোযা ও তাওবাহ্

মাওলানা মুহাম্মদ আবুল হাশেম
রোযা (Fasting) ও তাওবাহ্ (Penitence)-এর মধ্যে কীরূপ গভীর সম্পর্ক রয়েছে এবং মানুষকে বাস্তবিক পক্ষে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সেটা অনুধাবন করার পূর্বে অতীব জরুরী হচ্ছে, তাওবাহ্’র শাব্দিক অর্থ ও দর্শন বুঝে নেয়া।

তাওবাহর আভিধানিক অর্থ
‘তাওবাহ্’ শব্দটি আরবী ভাষায় تَابَ يَتُوْبُ -এর মাসদার, যার অর্থ- প্রত্যাবর্তন করা, ফিরে যাওয়া। এ কারণে ওই বান্দা, যে স্বীয় পাপরাশি ত্যাগ করে রবের আনুগত্যের প্রতি ফিরে যায়, তাকে তা-য়িব (تائب) বলা হয়; আর যখন বিশ্বকুল স্রষ্টা স্বীয় ক্রোধ ছেড়ে দিয়ে আপন রহমতের প্রতি প্রত্যাবর্তন করেন এবং বান্দার পাপরাশি ক্ষমা করে দেন, তখন তাকে ‘তাওয়াব’ (توّاب) বলা হয়।

তাওবাহ্ দর্শন
সৃষ্টিকুলে প্রতিটি বস্তু, যা চির অনাদি রব সৃষ্টি করেছেন, অস্তিত্ব দান করেছেন, সাথে সাথে ওই বস্তুর জন্য একটি রাস্তাও নির্ধারণ করেছেন, একটি পথও নির্বাচন করে দিয়েছেন এবং ওই বস্তুকে এটা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, যদি তুমি ওই নির্ধারিত রাস্তা থেকে এক ইঞ্চিও আগে-পিছে সরে যাও কিংবা এদিক-ওদিক ঘুরপাক খাও, তবে ধ্বংস ও বরবাদ হয়ে যাবে। যেমনিভাবে বিশ্বকুল ¯্রষ্টা আপন কিতাবে ইরশাদ করেন: وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَهَا “এবং সূর্য ভ্রমণ করে আপন এক অবস্থানের দিকে।”وَالْقَمَرَ قَدَّرْنَاهُ مَنَازِلَ “এবং চাঁদের জন্য আমি মানযিলসমূহ (তিথি) নির্ধারণ করেছি।” وَكُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ “এবং প্রত্যেকটি একেক বৃত্তের মধ্যে সন্তরণ করছে।” কিন্তু পরম বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, রবের কালাম যে কথা ১৪০০ বছর পূর্বে বর্ণনা করেছে, আধুনিক গবেষণা ও বিজ্ঞানীরা আজ এ কথা বলছে যে, যে নক্ষত্ররাজি, তারকারাজি, ছায়াপথ নিজ নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমণ করছে, কিংবা Orbit এ ঘুরছে, যদি সেগুলো এক ইঞ্চি পরিমাণ এদিক-ওদিক সরে পড়ে, তাহলে সৃষ্টিকুলে ক্বিয়ামত সংঘটিত হয়ে যাবে। এ কথা অনুমান তাদের তখনই হয়েছে, যখন তারা নিজস্ব শক্তিশালী মহাকাশ যন্ত্র কিংবা দূরবীণ দ্বারা সৃষ্টিজগতে অবস্থিত দূর-দূরান্তের ছায়াপথ এবং নক্ষত্ররাজি অবলোকন করেছেন। আর এটা দেখে বিস্মিত হন যে, এ বিভীষিকাময় কিয়ামত প্রতিদিন বহুসংখ্যক নক্ষত্র, তারকাকে ধ্বংস করে বিলীন করে দিচ্ছে, কিন্তু তদপেক্ষা আশ্চর্যের কথা যে, আমাদের যমীন, সূর্যের উদয়-অস্ত, অঅমাদের ছায়াপথ ওইসব কিয়ামতের প্রভাব থেকে সুরক্ষিতও; আর এ ব্যাপারে আমরা বেখবরও। তবে যেদিন আমাদের যমীন, সূর্য কিংবা সৌরজগতের চতুর্পার্শ্বে প্রদক্ষিণকারী নক্ষত্ররাজি এক ইঞ্চি পরিমাণ নিজস্ব কক্ষপথ থেকে সরে যাবে, তখন ওই দিন না এ সূর্য টিকে থাকবে, না এ যমীন থাকবে, সবকিছুই বরবাদ, ধ্বংস হয়ে যাবে। আর ওই দিনই কিয়ামত হবে।

মানুষ ও সৃষ্টি নীতি
প্রিয় পাঠক, লক্ষ করুন, উপর্যুক্ত সৃষ্টিনীতি মোতাবেক এরূপ হওয়া উচিত যে, মানুষও যদি তার জন্য নির্ধারিত রাস্তা ও পথ থেকে সরে যায়, তাহলে সেও ধ্বংস হয়ে যাবে, অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। আপনার মস্তিষ্ক অবশ্যই এ প্রশ্ন করবে যে, সেটা কোন রাস্তা, কোন পথ, যা মানুষের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে? জবাব হচ্ছে, এটি ওই রাস্তা, যা অন্বেষণ করার নির্দেশ স্বয়ং বিশ্বকুল ¯্রষ্টা দৈনিক পাঁচবার দিচ্ছেন। অর্থাৎ- اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ (হে আল্লাহ্! আমাদেরকে হিদায়ত দাও সরল-সোজা পথের) صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ (তাদের পথে, যাদের প্রতি তুমি অনুগ্রহ করেছো) ওইসব লোক কারা, যাদের প্রতি বিশ্বকুল ¯্রষ্টা অনুগ্রহ করেছেন? ক্বোরআনের অপর স্থানে সেটার জবাবে ইরশাদ হয়েছে, فَأُولَئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ.
“অনুগ্রহপ্রাপ্ত হলেন- নবীগণ, সিদ্দীক্বগণ, শহীদগণ এবং নেককার বান্দাগণ।” অর্থাৎ হে আল্লাহ্! আমাদেরকে নবীগণের রাস্তায় পরিচালিত করো, সিদ্দীক্ব, শহীদ এবং নেককার লোকদের পথ দান করো। সারকথা হলো: এখন যদি কোন ব্যক্তি আপন নবীর রাস্তা থেকে সরে যায় (যা তার জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে) তাহলে তার ধ্বংস হয়ে যাওয়া অনিবার্য। উদাহরণস্বরূপ: হত্যা, নৈরাজ্য সৃষ্টি করে, যিনা করে, চুরি করে, মদ সেবন করে, জুয়া খেলে, সুদ খায়, নামায পড়ে না, রোযা রাখে না, যাকাত, হজ্জ আদায় করে না, এককথায় ওইসব বিধান, যা তার নবী নির্দেশ দিয়েছেন, সেগুলোর উপর আমল করে না, তাহলে সৃষ্টি নীতি মোতাবেক তারও অস্তিত্ব বিলীন হওয়া উচিত। কিন্তু উৎসর্গ হোন দয়াময় রবের করুণার উপর। ওই মহান সত্ত্বার রহমত যে, মানুষ একবার নয়, দু’বার, তিনবার নয়, বরং সত্তর বার নিজের নির্ধারিত পথ থেকে সরে যায় এবং তিনি তাকে সত্তর বার ক্ষমা করে দেন। সুবহানাল্লাহ্! এটি ওই একক, অদ্বিতীয়ের স্বীয় বান্দাদের প্রতি পূর্ণ মুহাব্বতের বহিঃপ্রকাশ, এমনকি নিজের বানানো সৃষ্টিনীতি পর্যন্ত ভঙ্গ করে দিয়েছেন।

রবের রহমত
হাদীসে এসেছে,
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ العَبْدَ إِذَا اعْتَرَفَ ثُمَّ تَابَ، تَابَ اللَّهُ عَلَيْهِ.
বিশ্বকুল সরদার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: নিশ্চয় বান্দা যখন স্বীয় পাপরাশি স্বীকার করে নেয় এবং অতঃপর তাওবাহ্ করে; অর্থাৎ স্বীয় পাপরাশি ত্যাগ করে, তার আনুগত্যের প্রতি অগ্রসর হয়, তখন বিশ্বকুল ¯্রষ্টাও স্বীয় ক্রোধ ত্যাগ করে, আপন রহমতের প্রতি প্রত্যাবর্তন করেন এবং ওই বান্দার তাওবাহ কবূল করে নেন।
[সহীহ বোখারী: ৪১৪১; সহীহ মুসলিম: ২৭৭০]
বরং এক হাদীসে তো এভাবে এসেছে, বিশ্বকুল ¯্রষ্টা ইরশাদ করেন: لاَ أُبَالِي، يَا ابْنَ آدَمَ لَوْ بَلَغَتْ ذُنُوبُكَ عَنَانَ السَّمَاءِ ثُمَّ اسْتَغْفَرْتَنِي غَفَرْتُ لَكَ
“হে আদম সন্তান! আমার এ বিষয়ে পরোয়া নেই যে, যদি তোমার গুনাহ আসমানের উঁচুতায় পৌঁছে যায়, অতঃপর তুমি আমাকে রব বলে ক্ষমা প্রার্থনা করবে তোমার সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিব।” [তিরমিযী: ৩৪৫০]
এটাই তাওবাহর মর্তবা, মর্যাদা এবং শান।

রোযার মর্যাদা
কিন্তু উৎসর্গ হোন রমযানের মহত্বের উপর। তাওবাহর ক্ষেত্রে বান্দা হাত উঠিয়ে, চাদর প্রসারিত করে পাপরাশির ক্ষমা প্রার্থনা করে; কিন্তু রমযান মাসে বান্দা আপন রবের জন্য রোযা রাখে এবং চাদর বিছানো ছাড়াই তিনি তার পাপরাশি ক্ষমা করে দেন। এটি কেবল আমি বলছি না, বরং বোখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীস এটার সাক্ষী:
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ، إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের আশায় রমযান মাসের রোযা পালন করবে, তার ইতিপূর্বের সকল পাপ ক্ষমা করে দেয়া হবে।” [সহীহ বোখারী: ৩৮; সহীহ মুসলিম: ৭৬০]
সুতরাং বান্দাকে বাস্তবে তাওবাহকারী বানানো এবং পাপরাশি ক্ষমা হাসিলে রোযা যে ভূমিকা পালন করে, সত্যিই তা অতুলনীয়।

লেখক: পরিচালক, আনজুমান রিসার্চ সেন্টার ও খতীব, নওয়াব ওয়ালী বেগ খাঁ জামে মসজিদ, চকবাজার, চট্টগ্রাম।

 

Share:

Leave Your Comment