আল্লাহ্‌র যাত বা সত্তা

আল্লাহ্‌র যাত বা সত্তা

আল্লাহ্‌র যাত বা সত্তা

সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ইস্‌মে যাত বা সত্তাবাচক নাম

বিশুদ্ধতম মতানুসারে ‘আল্লাহ’ (الله) শব্দটি ওই চিরন্তন সত্তার নাম, যাঁর অস্তিত্ব একান্ত অপরিহার্য, যিনি সমস্ত উত্তম গুণাবলীর অধিকারী।             [আক্বাইদে নসফী]

বিভিন্ন আক্বাঈদ গ্রন্থে আল্লাহ তা’আলার সত্তার পরিচয় এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘‘এ মহা বিশ্বের অবশ্যই একজন সৃষ্টিকর্তা রয়েছেন। তিনি ‘ক্বাদীম’ অর্থাৎ অনাদি ও অনন্ত। তিনি সব সময় ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। তিনি সমস্ত উত্তম গুণের অধিকারী ও সমস্ত দোষ-ত্রুটি হতে পূত-পবিত্র। সব কিছুই তাঁর জ্ঞানের আওতাভুক্ত। তিনি সকল বিষয়ের উপর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সকল সৃষ্টি তাঁরই ইচ্ছাধীন।’’     [আক্বাআদে নসফী]

আল্লাহর সিফাত বা গুণাবলী

আল্লাহ তা’আলার অসংখ্য অগণিত সিফাত বা গুণাবলী রয়েছে। আল্লাহর গুণাবলী আমাদের গুণাবলীর মত নয়। এ ঈমান রাখা সকলের উপর ফরয। [শরহে ফিক্বহে আকবর]

ইমাম আবুল মনসুর মাতুরীদীর মতে, আল্লাহ তা’আলার সত্তাগত গুণ হল আটটি-

১. হায়াত               

এটি আল্লাহ তা’আলার একটি বিশেষ গুণ, যা অনাদি ও অনন্ত। তিনি চিরঞ্জীব। তিনি সব সময় ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। তিনি নিজেই এরশাদ করেছেন-

اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ
তরজমাঃ আল্লাহ হন, যিনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই। তিনি নিজে জীবিত এবং অন্যান্যদের অধিষ্ঠিত রাখেন। তাঁকে না তন্দ্রা স্পর্শ করে, না নিদ্রা। [সূরা বাক্বারা, আয়াতঃ ২৫৫, তরজমা- কান্‌যুল ঈমান]

২. ইল্‌ম বা জ্ঞান

আল্লাহ তা’আলা সর্ব বিষয়ে জ্ঞাতা। তাঁর মহান সত্তা যেমন অনাদি-অনন্ত, তেমনি তাঁর জ্ঞানও অনাদি, অনন্ত ও চিরন্তন। মরুভূমির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালু কণা হতে আরম্ভ করে সাগর- মহাসাগরের জলরাশির প্রতিটি বিন্দুও তাঁর জ্ঞানের বাইরে নয়। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন-

وَأَسِرُّوا قَوْلَكُمْ أَوِ اجْهَرُوا بِهِ ۖ إِنَّهُ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ ( 13 أَلَا يَعْلَمُ مَنْ خَلَقَ وَهُوَ اللَّطِيفُ الْخَبِيرُ (14)

তরজমাঃ এবং তোমরা নিজেদের কথা নীরবে বলো কিংবা সরবে, তিনি তো অন্তর্যামী। তিনি  কি জানেন না, যিনি সৃষ্টি করেছেন? এবং তিনিই হন প্রত্যেক সুক্ষ্ম বিষয়ের জ্ঞাতা।

 [সূরা মুল্ক,  আয়াত-১৩, তরজমাঃ কান্‌যুল ঈমান]

৩.ইরাদা বা  ইচ্ছা

আল্লাহ তা’আলাই বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন। তিনি নিজের ইচ্ছায় তা করেছেন। তিনি যেভাবে ইচ্ছা, সেভাবে সৃষ্টি করেছেন। তিনি কারো বাধ্য নন। পবিত্র ক্বোরআনে ইরশাদ করেন-

وَرَبُّكَ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ وَيَخْتَارُ ۗ তরজমাঃ আপনার রব সৃষ্টি করেন, যা চান এবং পছন্দ করেন।

[সূরা ক্বাসাস, আয়াত-৬৮, তরজমা-কান্‌যুল ঈমান]

৪. ক্বুদরত বা শক্তি

আল্লাহ তা’আলা সর্বশক্তিমান। এ বিশ্ব, এর গতি এবং স্থিতি, সবই তাঁর অসীম ক্বুদ্‌রত এবং শক্তিমত্তার বহিঃপ্রকাশ। প্রতিটি জিনিসের মধ্যে যে উদ্যম ও শক্তি নিহিত রয়েছে, ওই শক্তির উৎস সেটা নিজে নয়, বরং এর উৎস হচ্ছে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন-

وَمَا كَانَ اللَّهُلِيُعْجِزَهُ مِنْ شَيْءٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ ۚ إِنَّهُ كَانَ عَلِيمًا قَدِيرًا ﴿٤٤﴾

তরজমাঃ এবং আল্লাহ এমন নন যে, তাঁর আয়ত্ব থেকে কোন কিছু বের হতে পারে-আসমান সমূহ ও যমীনের মধ্যে। নিশ্চয় তিনি জ্ঞানময় শক্তিমান। [সূরা ফাতির, আয়াত-৪৪, তরজমা- কান্‌যুল ঈমান]

৫. শ্রবণশক্তি

মহান আল্লাহর গুণাবলীর মধ্যে শ্রবণ শক্তি তাঁর একটি অন্যতম গুণ। মহাবিশ্বের সব কিছু তিনি শুনতে পান। কি জোরে, কি আস্তে- সব আওয়াজই তিনি শুনতে পান। মাটির নিচে পিপীলিকার পায়ের আওয়াজ হোক, সমুদ্রের পানির নিচের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটের সঞ্চালন-ধ্বনি হোক; সব আওয়াজই আল্লাহ তা’আলা শুনতে পান। যেমন ইরশাদ হয়েছে-

وَمَا يَعْزُبُ عَنْ رَبِّكَ مِنْ مِثْقَالِ ذَرَّةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ وَلَا أَصْغَرَ مِنْ ذَٰلِكَ وَلَا أَكْبَرَ إِلَّا فِيكِتَابٍ مُبِينٍ ﴿٦١﴾

তরজমাঃ আর আপনার রবের নিকট থেকে কোন অণু পরিমাণ বস্তুও অগোচর নয়-পৃথিবীতে, না আসমানে এবং না তদপেক্ষা ক্ষুদ্রতর, আর না তদপেক্ষা বৃহত্তর, কোন বস্তুই নেই, যা এক সুস্পষ্ট কিতাবে নেই। [সূরা ইয়ূনুস, আয়াত-৬১, তরজমা- কান্‌যুল ঈমান]

৬. দর্শন

যেমনিভাবে আল্লাহ তা’আলা সর্বশ্রোতা তেমনি তিনি সম্যক দ্রষ্টা। সৃষ্টির সব কিছুই তিনি দেখেন। সব কিছুই তাঁর গোচরীভূত। আলো-আধাঁর, ছোট-বড় সব কিছুই তিনি সমানভাবে দেখেন, জানেন। যেমন ইরশাদ হয়েছে-

لَهُ غَيْبُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۖ أَبْصِرْ بِهِ وَأَسْمِعْ ۚ

তরজমাঃ তাঁরই জন্য আসমানসমূহ ও যমীনের সমস্ত অদৃশ্য বিষয়; তিনি কতোই উত্তম দেখেন ও কতোই উত্তম শুনেন।‌  [সূরা কাহ্‌ফ, আয়াত-২৬, তরজমা-কান্‌যুল ঈমান]

আসমান যমীনের সব গোপন অবস্থা তাঁর জানা আছে। তিনি কত সুন্দর দ্রষ্টা ও কত সুন্দর শ্রোতা!

৭. কালাম (বাণী)

নিঃসন্দেহে ‘কালাম’ গুণটি আল্লাহ তা’আলার মধ্যে পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান। হুকুম-আহকাম আদেশ-নিষেধ সবকিছুই তিনি তার বাণীর মাধ্যমেই জারি করেছেন। তিনি যেমন অসীম ও অতুলনীয়, তাঁর এ গুণও অসীম ঐ অতুলনীয়। সুতরাং আল্লাহর বাণী বর্ণমালা ও ধ্বনি হতে মুক্ত। সমস্ত আসমানী গ্রন্থ তাঁর কালাম বা বাণীরই বহিঃপ্রকাশ। ক্বোরআন আল্লাহ্‌র কালাম (বাণী)। তা সৃষ্ট নয়; বরং চিরন্তন।  ইরশাদ হয়েছে-

لَوْ أَنَّمَا فِي الْأَرْضِ مِنْ شَجَرَةٍ أَقْلَامٌ وَالْبَحْرُ يَمُدُّهُ مِنْ بَعْدِهِ سَبْعَةُ أَبْحُرٍ مَا نَفِدَتْ كَلِمَاتُ اللَّهِ ۗ إِنَّ اللَّهَعَزِيزٌ حَكِيمٌ ﴿٢٧﴾

তরজমাঃ এবং যদি পৃথিবীতে যত বৃক্ষ আছে সবই কলম হয়ে যায়, আর সমুদ্র তার কালি হয়, এরপর আরো সাতটি সমুদ্র শহ, তবুও আল্লাহর বাণীসমূহ শেষ হবে না। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ সম্মান ও প্রজ্ঞাময়।  [সূরা লোক্বমান, আয়াত-২৭, তরজমা- কান্‌যুল ঈমান]

৮. তাকভীন (সৃষ্টিকর্ম)

আসমান-যমীন, লাওহ-কলম, গাছপালা, জীব-জন্তু -এ সব কিছুই আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টি করেছেন। আমাদের এবং আমাদের কর্মের স্রষ্টাও তিনি। পবিত্র ক্বোরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে-

وَاللهُ خَلَقَكُمْ وَمَا تَعْلَمُوْنَ

তরজমাঃ অথচ আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের কর্মগুলোকেও।

[সূরা সাফ্‌ফাত, আয়াত-৯৬, তরজমা-কান্‌যুল ঈমান]

সৃষ্টি করার এ গুণটিও তাঁর অনাদি-অনন্ত। যখন ইচ্ছা, যেভাবে ইচ্ছা, তিনি সৃষ্টি করতে পারেন। সৃষ্টি করার জন্য তাঁর কোন নমুনার প্রয়োজন হয় না। এ মহা বিশ্বকে ধ্বংস করে তিনি পুনরায় তা সৃষ্টি করতে সক্ষম। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-

أَوَلَيْسَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِقَادِرٍ عَلَىٰ أَنْ يَخْلُقَ مِثْلَهُمْ ۚ بَلَىٰ وَهُوَ الْخَلَّاقُ الْعَلِيمُ ﴿٨١﴾

তরজমাঃ এবং যিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি সেগুলোর মতো আরো সৃষ্টি করতে পারেন না? কেন নয়? নিশ্চয় পারেন। আর তিনিই হন মহান স্রষ্টা, সর্বজ্ঞ।

 [সূরা ইয়াসীন, আয়াত-৮১, তরজমা- কান্‌যুল ঈমান]

সত্তাগত গুণ ব্যতীত আল্লাহ তা’আলার যত গুণাবলী আছে, সবই তাঁর কর্মগুণ। কর্মগত গুণ ওই সিফাত বা গুণাবলীকে বলা হয়, যেগুলোর মধ্যে সৃষ্টির সাথে তাঁর সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ রয়েছে। আল্লাহ তাজ্ঞআলার কর্মগত গুণ অসংখ্য ও অগণিত। [শরহে ফিক্বহে আকবর]

এ দিকে ইশারা করে ক্বোরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে-

يَسْأَلُهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ كُلَّ يَوْمٍ هُوَ فِي شَأْنٍ ﴿٢٩﴾

তরজমাঃ তাঁরই নিকট প্রার্থনা করছে যতকিছু আসমানসমূহ ও যমীনে রয়েছে। প্রত্যহ তাঁর একেকটি (গুরুত্বপূর্ণ) কাজ রয়েছে। [সূরা আর্‌রাহমান, আয়াত-২৯,তরজমা-কান্‌যুল ঈমান]

[গাউসিয়া তরবিয়াতী নেসাব, পৃ. ৬-১০]