আল্লামা গাজী শেরে বাংলা বিরচিত ‘দীওয়ান-ই আযীয’ কাব্যগ্রন্থে প্রিয়নবীর প্রশংসাস্তুতি

আল্লামা গাজী শেরে বাংলা বিরচিত ‘দীওয়ান-ই আযীয’ কাব্যগ্রন্থে প্রিয়নবীর প্রশংসাস্তুতি

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল নোমান
পূর্ব প্রকাশিতের পর

পংক্তি-৭
بہ بیداری بچشم سر بدیدہ -بہ معراجش خدا را خوب دیدہ
উচ্চারণ: ব বে-দা-রী ব চশমে সর ব দী-দাহ,
ব মে’রা-জশ্ খোদা- রা- খূ-ব দী-দাহ।
কাব্যানুবাদঃ জাগ্রত আঁখে পেলেন দর্শন আপন প্রভুরে, আরো উত্তম করেন সাক্ষাৎ মি’রাজ সফরে।
[জাগ্রত অবস্থায়, কপাল মুবারকের চোখে তিনি (আল্লাহকে) দেখেছেন- তাঁর মি’রাজে, আল্লাহকে তিনি খুব উত্তমরূপে দেখেছেন।]
ব্যাখ্যাঃ মি’রাজ প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)’র একটি বিস্ময়কর অতুলনীয় মু’জিযা। আর মি’রাজের একটি বিশেষত্ব হলো, এতে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)’র সাথে মহান আল্লাহর প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ। মহান আল্লাহ বলেন,
ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى – فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى
অতঃপর আল্লাহর নিকটবর্তী হলেন, এমন কি তাঁর ও আল্লাহর মধ্যে দুই ধনুক পরিমাণ বা কম ব্যবধান রইল। [আল-ক্বোরআন,সূরা আন- নজম, ৫৩: ৮-৯]
এভাবে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)’মকামে দানা’ অতিক্রম করে ‘মকামে ফাতাদাল্লাহ’তে পৌঁছলেন। সেটা পার হয়ে ‘আদনা’ তে পৌঁছলেন। আদনা ‘ইসমে তাফদ্বীল’ -এর সিগাহ। অর্থাৎ, অত্যন্ত সন্নিকটে। এ মকামে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) মহান আল্লাহকে তিনি খুব উত্তমরূপে দেখেছেন। মিশকাত শরীফের ৬৮ পৃষ্ঠায় রয়েছে,
عن عبد الرحمن بن عائش يقول سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم، يقول : رأيت ربي في أحسن صورة ، قال : فيم يختصم الملأ الأعلى؟ فقلت : انت أعلم يا رب. قال: فوضع كفه بين كتفي فوجدت بردها بين ثديي فعلمت ما في السماوات والأرض.
[হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আয়িশ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, আমি আমার প্রভুকে উত্তমরূপে দেখেছে। তখন তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন শীর্ষস্থানীয় ফেরেশতাগণ কী বিষয়ে তর্কে লিপ্ত হয়েছেন? তখন আমি বললাম, আপনিই তা অধিক অবগত। অতঃপর তিনি, আমার দু’কাঁধের মাঝে কুদরতের হাত রাখলেন, যা দ্বারা আমার বুকে শীতলতা অনুভব হলো এবং নভোম-ল-ভূম-লের সকল জ্ঞান জেনে নিলাম। [খতীবে তাররিযী, মিশকাতুল মাসাবীহ, باب المساجد و مواضع الصلاة، كتاب الصلاة হাদিস নং – ৭৭১] পবিত্র মি’রাজে জাগ্রত অবস্থায়, স্বীয় কপাল মুবারকের চোখে তিনি আল্লাহকে উত্তমরূপে দেখেছেন, সেটা এমনই ছিল। মহান আল্লাহর ভাষায়, مَا زَاغَ الْبَصَرُ وَمَا طَغَى -চক্ষু না কোন দিকে ফিরেছে, না সীমাতিক্রম করেছে। [আল-ক্বোরআন,সূরা আন- নজম, ৫৩: ১৭]
আ’লা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর বিখ্যাত কসিদায়ে সালামের একটি পংক্তিতে আলোচ্য বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেন,
کس کو دیکھا یہ موسیٰ سے پوچھے کوئی
آنکھوں والوں کی ہمت پہ لاکھوں سلام
উচ্চারণ: কিস্ কো দেখা ইয়ে মূসা সে পুছে কোঈ, আখোঁ ওয়ালোঁ কি হিম্মত পে লাখোঁ সালাম।
[আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (র.), হাদায়েকে বখশিশ, পৃষ্ঠা-৪৭, খ–২, প্রকাশনায়: ইমাম আহমদ রেযা একাডেমী,দিল্লী, ভারত]
হযরত মূসা আলায়হিস সালাম থেকে জেনে নাও, ‘হে আল্লাহ! আমাকে আপনার দিদার দিন’ বলে প্রার্থণা করে তিনি কি দেখেছেন? বরং তিনি বেহুশ হয়ে যান। আর হুযূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম অপলক নেত্রে মহান আল্লাহর দিদার লাভে ধন্য হন। এমন চোখওয়ালার বিশেষত্বকে লক্ষ সালাম। উপরোক্ত বিশদ আলোচনাকে ইমামে আহলে সুন্নাত ইমাম শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ফার্সি ভাষায় এভাবেই একটি পংক্তিতে রূপায়ণ করেন।

পংক্তি-৮
ہمہ قرآن بتوصیف محمد برو -نازل چہ گویم وصف احمد
উচ্চারণ: হামাহ্ ক্বোরআঁ- ব তাওসী-ফে মুহাম্মদ,
বরো- না-যিল ছেহ্ গোয়ম ওয়াসফে আহমদ।
কাব্যানুবাদঃ স্তুতিতে তাঁর কুরআন ভরপুর অক্ষরে অক্ষরে, তাঁর প্রশংসা করার ভাষা নাহি মোর ভাণ্ডারে।
[সমগ্র ক্বোরআন হুযূর হুযূর মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রশংসায় ভরপুর, তাঁরই উপর এ ক্বোরআন অবতীর্ণ হয়েছে; সুতরাং তাঁর প্রশংসা করার ভাষা আমার নেই।]
ব্যাখ্যাঃ পবিত্র ক্বোরাআনে পাককে যদি ঈমান ও প্রিয় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর ভালবাসার দৃষ্টিতে গবেষণা করা হয়। তবে দেখা যাবে ক্বোরআন আদ্যো-পান্ত প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) -এর তা’রিফ এবং গুণাবলীকেই ধারণ করেছে। সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম একসময় মু’মিন জননী হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র নিকট রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) -এর জীবনচরিত সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন, পবিত্র ক্বোরআনই তাঁর জীবন চরিত। নিম্নোক্ত হাদিস পাকে তাই বর্ণিত হয়েছে,
سُئِلَتْ عائِشةُ عن خُلُقِ رسولِ اللهِ صلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ، فقالَتْ: كان خُلُقُه القُرآنَ
উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র নিকট রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) -এর জীবনচরিত সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পবিত্র ক্বোরআনই তাঁর জীবন চরিত।
আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (রহ.) বিরচিত না’তিয়া এই পংক্তিতেও একই সুর অনুরণিত হয়। তিনি যথার্থই বলেছেন,
اے رضاؔ خود صاحبِ قرآں ہے مَدَّاحِ حضور تجھ سے کب ممکن ہے پھر مِدحت رسول اللہ کی
উচ্চারণ: এ্যয় রেযা,খোদ্ সাহেবে ক্বোরআঁ হ্যায় মাদ্দাহে হযূর, তুঝ্ সে কাব মুমকিন হ্যায় ফির মিদহাত রাসূলুল্লাহ কী। – হে রেযা! ক্বোরআন মাজীদ অবতরণকারী স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা হুযূর আকরম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম -এর প্রভূত প্রশংসাকারী, তোমার পক্ষে আল্লাহর রাসূলের গুণগাণ করা আবার কখন সম্ভব হবে?
[আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (র.), হাদায়েকে বখশিশ,পৃষ্ঠা-৯৬, খ–১]

পংক্তি-৯
ہمہ تعظیم روا بہر محمد -بجز گفتن خدا آں ذات احمد
উচ্চারণ: হামাহ্ তা’যী-ম রাওয়া বাহরে মুহাম্মদ,
ব জুয্ গুফতন খোদা- আঁ- যা-তে আহমদ।
কাব্যানুবাদঃ মন যা চায় তাঁর মর্যাদায় নির্দ্বিধায় বলো তাঁরে, মনে রেখো শুধু কভু ‘আল্লাহ্’ বলো না তাঁরে।
[‘আল্লাহ’ বলা ব্যতীত হুযূর মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি যাবতীয় সম্মান প্রদর্শন করা জায়েয।]
ব্যাখ্যাঃ প্রিয়নবী রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) কে মহান আল্লাহ অতুলনীয় মর্যাদা প্রদান করেছেন। তিনি বলেন, وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ -এবং আমি আপনার জন্য আপনার স্মরণকে সমুন্নত করেছি। [আল-ক্বোরআন, সূরা ইনশিরাহ,৯৪:৪]
যেখানে মহান আল্লাহ তাঁর পেয়ারা মাহবুবের স্বরণকে নিজেই সমুন্নত করে তাঁর মর্যাদাকে বৃদ্ধি করেছেন, সেখানে আমাদের দ্বারা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) -এর প্রতি যথাযত সম্মান প্রদর্শন ও গুনাগুণ বর্ণনা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এদতসত্তেও আল্লাহ বলেন,
لِّتُؤْمِنُوا بِاللهِ وَرَسُولِهِ وَتُعَزِّرُوهُ وَتُوَقِّرُوهُ وَتُسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا
যাতে হে লোকেরা! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনো এবং রাসূলের মহত্ত্ব বর্ণনা ও (তাঁর প্রতি) সম্মান প্রদর্শন করো ; আর সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহ এর পবিত্রতা ঘোষণা করো। [আল-ক্বোরআন,আল-ফাত্হ,৪৮:৯]
আলোচ্য আয়াতে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) -এর মহত্ত্ব বর্ণনা ও তাঁকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের জন্য। কিন্তু হুযূর (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) -এর গুণাবলি ও মর্যাদা যথাযথভাবে বর্ণনা করা অসম্ভব।

পংক্তি-১০
حقیقت ذات احمد کس نداند- بجز ذات خدا دیگر نداند
উচ্চারণ: হাক্বী-ক্বাতে যা-তে আহমদ কস নদা-নদ,
ব জুয্ যা-তে খোদা- দী- গর নদা-নদ।
কাব্যানুবাদঃ নবীজীর কী হাকিকত এই জগত সংসারে, মহান রব ব্যতীত কেহ তা না জানিতে পারে।
[হুযূর আহমদ মুজতাবার ‘বাস্তবিক অবস্থা’ সম্পর্কে একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ জানে না।]
ব্যাখ্যাঃ আমরা নবীজিকে চেনার জন্য,জানার জন্য কতইনা গবেষণা করি! নবী নূর না মাটির তৈরি সেটা নিয়ে আমাদের গবেষণার অন্ত নেই। অনেকে তো এমনও আছেন যে, নবীজিকে মাটির তৈরি প্রমাণ করার জন্য রাতের পর রাত, সময়ের পর সময় কাঠিয়ে দেন। অথচ নবীজির হাকিকত বা প্রকৃত অবস্থা আমাদের অগোচরেই রয়ে গেছে। সূরা তাওবার ১২৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবু হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত,তিনি বলেন,
سأل النبيّ صلى الله عليه وسلم جبريل عليه السلام فقال: يا جبريل كم عمّرتَ من السنين؟ فقال: يا رسول الله لست أعلم ، غير أن في الحجاب الرابع نجمًا يطلع في كل سبعين ألف سنة مرة ، رأيته اثنتين وسبعين ألف مرة ، فقال النبيّ صلى الله عليه وسلم : وعزة ربي أنا ذلك الكوكب
একদা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কথা প্রসঙ্গে হযরত জিবরাঈল (আলায়হিস সালাম)কে তাঁর বয়স সম্পর্কে এভাবে জিজ্ঞেস করলেন- হে জিবরাঈল! তোমার বয়স কত? তদুত্ত্যরে হযরত জিবরাঈল আলায়হিস সালাম বললেন- আমি কেবল এতটুকু জানি যে, নূরের চতুর্থ হেজাবে একটি উজ্জ্বল তারকা ৭০ হাজার বছর পর পর একবার উদিত হতো। (অর্থাৎ, ৭০ হাজার বছর উদিতাবস্থায়, ৭০ হাজার বছর অস্তমিতবস্থায় ওই তারকাটি বিরাজমান ছিল।) আমি ওই তারকাটিকে ৭২ হাজার বার উদিতাবস্থায় দেখেছি। তখন নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন- ” খোদার শপথ, আমিই ছিলাম ওই তারকা।” [তাফসীরে রুহুল বয়ান, খ–৩, পৃষ্ঠা-৫৪৩, সূরা তাওবার তাফসীর]
নবীজীর এই অবস্থানের সময় ছিলো ঐ জগতের হিসাবে ১০০৮ কোটি বছর। ৫০৪ কোটি বছর উদীয়মান অবস্থায় এবং ৫০৪ কোটি বছর গায়েবী অবস্থায়। দুনিয়ার হিসাবে কত হাজার কোটি বছর হবে – তা আল্লাহ-ই ভাল জানেন। হযরত জিবরাঈল আলায়হিস সালাম নবীজির কেবল বাহ্যিক রূপই দেখেছিলেন। প্রকৃত অবস্থা ছিল তাঁর অজানা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের সৃষ্টি রহস্য এমন সুগভীর যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউই তাঁর প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবগত নন। তাইতো তিনি তাঁর সর্বাধিক সহচার্য লাভে ধন্য হওয়া ‘ইয়ারে গারে রাসূল’ খ্যাত হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে তিনি বলেছিলেন,
يا أبا بكر لم يعرفني حقيقتي الا ربي
হে আবূ বকর! আমার রব ছাড়া আমার প্রকৃত স্বরূপ কেউ জানেনা।
[ইমাম আহমদ রেযা (র.) কৃত তাজাল্লিউল ইয়াক্বিন’র বঙ্গানুবাদ-দৃঢ় বিশ্বাসের চেতনায় নবীকূল সম্রাট,বঙ্গানুবাদক: মাওলানা মুহাম্মদ জসিম উদ্দীন রেযভী (র.),পৃষ্ঠা-১০৬]
আলোচ্য বিষয়ে শাহজাদায়ে আ’লা হযরত,হুযূর মুফতিয়ে আ’যম হিন্দ মাওলানা শাহ মুস্তফা রেযা খান রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বিরচিত এই পংক্তিটি এখানে প্রণিধানযোগ্য। যথা-
حقیقت سے تمہاری جز خدا اور کون واقف ہے کہے
-تو کیا کہے کوئی چنیں تم ہو چناں تم ہو
উচ্চারণ: হাকীকত সে তুমহারী জুয খোদা আওর কওন ওয়াকিফ হে, কাহে তো কিয়া কাহে কুয়ী, চুনী তুম হো চুনা তুম হো। – হে প্রিয় রাসূল! আমাদের কেউ আপনাকে এটা-ওটা বিভিন্নভাবে নানা গুণাবলিতে আহবান করলেও আপনার প্রকৃতরূপ একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত কেউই অবগত নয়।
[মুস্তফা রেযা খান (র.), সামানে বখশিশ, পৃষ্ঠা-১৫৭, প্রকাশনায়: মজলিসুল মাদানিয়্যাতুল ইলমিয়্যাহ।]

পংক্তি-১১
عزیز الحق چہ گوئی نعت احمد -تأدب یا قلم در شان احمد
উচ্চারণ: ‘আযী-যুল হক্ব ছেহ্ গো-ঈ- না’তে আহমাদ, তাআদ্দাব ইয়া কলম দর শা-নে আহমাদ।
কাব্যানুবাদঃ হে আযীযুল হক! তুমি কী আর বলবে তাঁরে, হে কলম! আদব বজায় রেখো লেখার তরে।
[হে আযীযুল হক্ব! তুমি হযরত আহমদ মুজতাবার কী প্রশংসা করবে? হে কলম! তুমি হুযূর আহমদ মুজতাবার কী প্রশংসা লিখতে গিয়ে শিষ্টাচারিতা বজায় রাখ।]
ব্যাখ্যাঃ ইমাম শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি নিজেকে সম্বোধন করে বলেন, হে আযীযুল হক! তুমি নবীজীর কি আর প্রশংসা করবে? অর্থাৎ,প্রিয়নবীর যথার্থ প্রশংসাস্তুতি বর্ণনা করতে তুমি অক্ষম। বিখ্যাত ফার্সি কবি আল্লামা শেখ সা’দী (রাহমাতুল্লাহি আলায়হি)’র ‘বোস্তা’ গ্রন্থের একটি পংক্তিতেও আলোচ্য পংক্তির একই সুর অনুরণিত হয়। দরবারে রিসালতে অক্ষমতা প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেন,
چہ وصفت کند سعدی ناتمام! علیک الصلوة ای نبی السلام
উচ্চারণ: চে ওয়াছফত কুনদ সা’দীয়ে না তামাম, আলায়কাস সালাত আয় নবী আস-সালাম। -ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! আমি অপূর্ণাঙ্গ শেখ সা’দী আপনি মহান নবীর কি গুণগান বর্ণনা করব? হে নবী! আপনার উপর দুরূদ ও সালাম।
[আল্লামা শেখ সা’দী, বোস্তা, ফি না’তি সায়্যিদিল মুরসালিন আলায়হিস-সালাত ওয়াস-সালাম।]
কাব্যমালায় না’তচর্চা খুবই কঠিন একটি বিষয়। কেননা, এতে একদিকে প্রিয়নবীর প্রতি মুহাব্বত। আর অন্য দিকে শরীয়ত। কবিতায় যদি কেবল শরীয়তকে ধারণ করা হয়, তাহলে সেই কবিতা আর শুধু কবিতাই থাকে না, বরং তা ওয়াজ ও তাকরীর হয়ে যায়। আর যদি শুধুমাত্র মুহাব্বতের দাবীকে পূরণ করা হয়, তাহলে কবিতার প্রতিটি শব্দ দ্বারাই শরীয়তের মূলে কুঠারাঘাতকারীও সাব্যস্থ হতে পারে। ওরফী সিরাজী এ নাযুক অবস্থাকে তাঁর এক কবিতায় এভাবে বর্ণনা করেন,
عرفی مشتاب ای راہ نعت است نہ صحرا، آہستہ کہ راہ بردم تیغ است قدم را
উচ্চারণ: ওরফী মুশতাব আয় রাহে না’ত আস্ত না চাহরা, আহিস্তা কে রাহ বরদম তে-গ আস্ত কদম রা।
হে ওরফী তাড়াতাড়ি পা বাড়িও না। কারণ, এটা না’তের ময়দান, মরুপ্রান্তর নয়। ধীরে ধীরে অগ্রসর হও। কারণ, তুমি তরবারির তীক্ষ্ণ ধারের উপর পা রাখছ।

পংক্তি-১২
سلام شیر بنگالہ در جنابش -رسد ہر دم ہزاراں زاں گلامش
উচ্চারণ: সালা-মে শেরে বাংলা দর জনা-বশ,
রসদ র্হাদম হাযা-রাঁ- যাঁ- গোলামশ।
কাব্যানুবাদঃ শেরে বাংলার বিনম্র সালাম সদা তাঁর দরবারে, এ গোলামের অযুত সালাম তাঁর শাহী দরবারে।
[শেরে বাংলার সালাম তাঁর মহান দরবারে সর্বদা পৌঁছতে থাকুক; বরং তাঁর এ গোলামের পক্ষ থেকে হাজার হাজার সালাম পৌঁছতে থাকুক।]
ব্যাখ্যাঃ মাক্ তাহ বা শেষোক্ত পংক্তিতে ইমাম শেরে বাংলা প্রিয়নবীর দরবারে সালাম পেশ করেছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মুসলিম নামাধারী একটি মহল দুরূদ-সালামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আছে, রীতিমতো তারা দুরূদ-সালামকে বিতাড়িত করার গভীর ষড়যন্ত্রেও লিপ্ত। যদিও তা মহাপ্রলয়বধি অসম্ভব। ইমাম শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি আপন জীবদ্দশায় তাদেরকে সফলভাবে মোকাবেলা করতে সমর্থ হন। তাই তিনি প্রিয়নবীর প্রতি অধিকহারে দুরূদ-সালাম পাঠ করতেন। কেননা, দুরূদ-সালামের ফযিলত তো স্বয়ং মহান আল্লাহই বর্ণনা করেছেন। পবিত্র ক্বোরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে,
اِنَّ اللّٰهَ وَمَلٰٓئِكَتَهٗ يُصَلُّوۡنَ عَلَى النَّبِىِّ ؕ يٰۤـاَيُّهَا الَّذِيۡنَ اٰمَنُوۡا صَلُّوۡا عَلَيۡهِ وَسَلِّمُوۡا تَسۡلِيۡمًا‏
নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা তাঁর (অগণিত) ফেরশতাসহ স্বীয় অদৃশ্যের সংবাদদাতা নবীর উপর দুরূদ প্রেরণ করেন। হে ঈমানদ্বারগণ! তোমরা তাঁর উপর দুরূদ পাঠ কর এবং উত্তমরূপে সালাম প্রেরণ কর। [আল-ক্বোরআন, সূরা আহযাব, ৩৩:৫৬]
হাদিসে পাকে আছে, প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত উবাই ইবনে কা’ব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আল্লাহর রাসূলের মহান দরবারে যখন আরয করলেন, ‘আমি আপনার প্রতি দুরূদ প্রেরণে আমার সমস্ত সময় ব্যয় করবো।’ তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, ‘যদি তুমি তা করতে পারো, তবে সার্বিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর করতে এ দুরূদ শরীফই যথেষ্ট হবে এবং তোমার সমস্ত গুনাহের কাফ্ফারা হবে।’ [তিরমিযী: আস-সুনান, কিতাবু সিফাতিল ক্বিয়ামাতি
ওয়ার রাকায়িক, হাদিস নং- ২৪৫৭]
বুঝা যায়, প্রিয়নবীর প্রতি সর্বদা দুরূদ-সালাম প্রেরণের মাধ্যমে সামগ্রিক কল্যাণ লাভ করা যায়। তাইতো তিনি দরবারে রিসালতে সর্বদা সালামী পেশ করার আর্জি জানান। আর আল্লাহ তা’আলা কুদরতী ব্যবস্থাপনায় এক দল ফেরেশতাকে কেবলমাত্র প্রিয়নবীর প্রতি উম্মতের সালামী পৌঁছিয়ে দেওয়ার দায়িত্বেই নিয়োজিত রেখেছেন। নিম্নোক্ত বর্ণনায় সেটিই বিদ্যমান,
عن عبد الله قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : إنَّ لله ملائكةً سيَّاحين يُبلغوني عن أمتي الصلاة والسلام
হযরত আব্দুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, নিশ্চয় আল্লাহর যমীনে এমন অনেক বিচরণকারী ফেরেশতা রয়েছে, যারা আমার নিকট আমার উম্মতের দুরূদ সালাম পৌঁছান। এ হাদিস নাসায়ী ও দারেমী বর্ণনা করেছেন।
[নাসায়ী: আস-সুনান, বাবুস সালাম আলান নাবিয়্যি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম, হাদিস নং-১২৮২, দারেমী: আস-সুনান, হাদিস নং-২৭৭৪।]
প্রিয়নবীর মহান দরবারে ইমাম শেরে বাংলার সালামী সর্বদা পৌঁছানোর আর্জি তাঁর পক্ষ থেকে হাজার হাজার সালাম পেশ করে তিনি সত্যিকার অর্থে তিনি নবীজীর গোলামীর পরিচয় দিয়েছেন। পরিশেষে কোনো এক কবির একটি না’তিয়া কালামের অংশবিশেষ উল্লেখ করে যবনিকা টানছি। কবি বলেন, ان کے جو غلام ہو گئے، وقت کے امام ہو گئے
উচ্চারণ: উনকে জু গোলাম হো গ্যায়ে, ওয়াক্ত কে ইমাম হো গ্যায়ে।
তাঁর গোলাম হয়েছেন যিনি, যুগের ইমাম হলেন তিনি। সত্যিই প্রিয়নবীর গোলামীর বদৌলতে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ইমামই ছিলেন ইমাম আল্লামা গাজী শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি আলায়হি।

লেখক: বিশিষ্ট না’তখাঁ ও প্রচার সম্পাদক আ’লা হযরত ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।

 

Share:

Leave Your Comment