ঈমান বিনষ্টকারী বিষয় সমূহ

ঈমান বিনষ্টকারী বিষয় সমূহ

মাওলানা মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম ক্বাদিরী

 ভূমিকা:
ঈমান অমূল্য সম্পদ। ঈমান হলো- প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান আল্লাহর পক্ষ হতে যা নিয়ে এসেছেন সেসব কিছুর উপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা এবং সত্যায়ন করা। ইহকালীন কল্যাণ আর পরকালীন মুক্তি ঈমান নির্ভর। যাঁর ঈমান আছে তিনি সফল। ঈমানহীন ব্যক্তি বিফল। যাঁর ঈমানী শক্তি যতো বেশী তিনি আল্লাহর ততোবেশী প্রিয়ভাজন। ঈমান পরিশুদ্ধ ও সুদৃঢ় হলে কম আমলও মুক্তির জন্য যথেষ্ট হয়। ঈমানের বিষয়াদি সুস্পষ্ট। পবিত্র কুরআন-সুন্নাহর সেই বিষয়াদির বিবরণ সুবিদিত। আহলে সুন্নাহ’র সম্মানিত ইমাম-মুজতাহিদগণ সেসবই তাঁদের লেখনীর মধ্যে সুস্পষ্ট ভাষায় লিপিবদ্ধ করে গেছেন। আল্লাহর মা‘রিফাত অর্জনকারী ইমামগণ তাঁদের জাহিরী-বাতিনী ইলমের মাধ্যমে ঈমান সম্পর্কিত সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম বিষয়ের বিবরণ দিয়ে গেছেন। কোন্ বিষয়ে আলোচনা-ব্যাখ্যা চলবে আর কোন বিষয়ে চুপ থেকে শুধুমাত্র আস্থা স্থাপন করে যেতে হবে তার নির্দেশনাও দিয়ে গেছেন। মু’মিন ব্যক্তিকে সদা চকিত-সতর্ক থাকতে হবে। কথায়-কাজে-বিশ্বাসে দৃঢ়তা পোষণ করতে হবে। ঈমানী বিষয়ে সন্দেহমুক্ত থাকতে হবে। কখনো কখনো চেতনে-অবচেতনে মু’মিন ব্যক্তি আল্লাহ, নাবী, রাসূল, আসমানী কিতাব, ইসলাম ইত্যাদি বিষয়ে এমন সব মন্তব্য করে থাকে, যার ফলে সে ঈমান হারা হয়ে যায়। আক্বাঈদের পরিভাষায় এগুলোকে نَوَاقِضُ الإيْمَانِ (নাওয়াক্বিদ্বুল ঈমান) তথা ঈমান বিনষ্টকারী বিষয় বলা হয়। অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়ে ধারাবাহিক আলোচনা করার প্রয়াস পাচ্ছি

 নাওয়াকিদুল ঈমান-এর পরিচয় ও প্রকার
نواقض (নাওয়াক্বিদ্ব) এটি শব্দগতভাবে কর্তৃপদ ناقض ‘নাকিদ্ব’-এর বহুবচন। এর অর্থ সুদৃঢ় কোন বন্ধন বা ভিত্তিকে নষ্ট বা ধ্বংস করা। ঈমান (إيْمَانٌ) অর্থ: আন্তরিক বিশ্বাস। পরিভাষায়- ‘প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর পক্ষ হতে যা নিয়ে এসেছেন তার প্রতি আন্তরিক বিশ্বাস রাখাই হলো ঈমান।’
সুতরাং نَوَاقِضُ الْإيْمَانِ-এর যৌগিক অর্থ দাঁড়ায়- اَلْأشْيِاءُ الَّتِيْ تُفْسِدُ إيْمَانَ الْمَرْءِ
অর্থাৎ- ব্যক্তির আন্তরিক বিশ্বাসকে বিনষ্ট ও ধ্বংসকারী বিষয়সমূহ। নাওয়াক্বিদ্বুল ঈমানকে نَوَاقِضُ التَّوْحِيْدِ (নাওয়াক্বিদুত-তাওহীদ) এবং نَوَاقِضُ الْإسْلَامِ (নাওয়াক্বিদুল ইসলাম) নামেও আখ্যায়িত করা হয়। পরিভাষায়- ঈমান বিনষ্টকারী বিষয় (نَوَاقِضُ الْإيْمَانِ) বলা হয়-
.نَوَاقِضُ الْإيَمَانِ هِيَ: اَلْأقْوَالُ أوِ الْأفْعَالُ أوِ الْمُعْتَقِدَاتُ الَّتِيْ تُنْقِضُ وَتُبِطَلُ الْإيْمَانُ فِي الْقُلُوْبِ وَالنُّفُوْسِ.
অর্থাৎ-‘ঈমান বিনষ্টকারী বিষয় বলা হয় এমন সব কথা, কাজ এবং বিশ্বাসমালা পোষণ করাকে, যা মনস্থিত আন্তরিক সুদৃঢ় বিশ্বাসকে নষ্ট বা ধ্বংস করে দেয়।’ যেমন, ¯্রষ্টা তথা আল্লাহ পাক এবং তাঁর রাসূলগণ আলাইহিমুস সালামকে মন্দ বলা বা গালাগালি করা ইত্যাদি। (নাঊযূবিল্লাহ!) এর তিনটি শাখা রয়েছে। শাখা তিনটি হলো-
০১. নাওয়াক্বিদ্বুল কাউলিয়্যাহ তথা ভাষাগত বা কথার মাধ্যমে ঈমান বিনষ্টকারী বিষয়।
০২. নাওয়াক্বিদ্বুল ‘আমলিয়্যাহ তথা কর্মগত বা কাজের মাধ্যমে ঈমান বিনষ্টকারী বিষয়।
০৩. নাওয়াক্বিদ্বুল ‘ইতিক্বাদিয়াহ তথা আকীদাগত বা আন্তরিক বিশ্বাসগত ঈমান বিনষ্টকারী বিষয়।

আলোচ্য প্রবন্ধে শুধুমাত্র এর প্রথম শাখা তথা ভাষাগত বা কথার মাধ্যমে ঈমান বিনষ্টকারী বিষয়সমূহ আলোচনা করা হবে। ভাষার মাধ্যমে ঈমান বিনষ্টকারী বিষয় বলা হয়-
هُوَ كُلُّ قَوْلٍ فِيْهِ إعْتِرَافٌ بِعَقِيْدَةٍ مُكَفِّرَةٍ، أوْ فِيْهِ جُحُوْدٌ لِعَقِيْدَةٍ مِنْ عَقَائِدِ الْإسْلَامِ الْمَعْلُوْمَةِ مِنَ الدِّيْنِ بِالضَّرُوْرَةِ، أوْ فِيْهِ إسْتِهْزَاءٌ بِالدِّيْنِ فِيْ عَقَائِدِهِ أوْ أحْكَامِهِ كَالسِّبَابِ لِلْخَالِقِ عَزَّ وَجَلَّ وَالرُّسُلُ عَلَيْهِمُ السَّلَامِ وَغَيْرِهَا.
অর্থাৎ- এটি এমন সব উক্তি যেগুলোর মধ্যে কুফুরী বিশ্বাসের স্বীকৃতি থাকে বা দ্বীনের জরুরী সুপ্রসিদ্ধ ইসলামী বিশ্বাসমালার কোন একটি বিশ্বাসকে অস্বীকার করা হয় অথবা দ্বীনের বিশ্বাসমালা-বিধিবিধানকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাসা করা হয়। যেমন, ¯্রষ্টা তথা আল্লাহপাককে এবং তাঁর রাসূলগণ আলাইহিমুস সালামকে মন্দ বলা বা গালাগালি করা ইত্যাদি। (নাঊযূবিল্লাহ!) অত্র পরিভাষাতে তিনটি দিক স্পষ্ট হয়েছে। যথা-
১. কুফরী বিশ্বাসের স্বীকৃতিমূলক উক্তি। যেমন, কোন মুসলমান যদি বলে- আমি আল্লাহকে ¯্রষ্টা হিসেবে মানি না। ¯্রষ্টা বলতে কিছু নেই। প্রকৃতিই জগতের ¯্রষ্টা। (নাঊযূবিল্লাহ!)
২. ধর্মীয় সুপ্রসিদ্ধ জরুরী বিশ্বাসমালার যে কোন একটির অস্বীকৃতি। যেমন, কোন মুসলমান যদি বলে- আমি ফেরেশতা মানি না। কুরআন মাজীদ কিংবা আসমানী অন্য কোন ঐশী গ্রন্থে বিশ্বাস রাখি না। জান্নাত-জাহান্নাম বলতে কিছুই নেই। (নাঊযূবিল্লাহ!)
৩. ধর্মীয় বিশ্বাসমালা বা বিধি-বিধানের যে কোন একটি নিয়ে ঠাট্টা-তামাসা করা। যেমন, কোন মুসলমান যদি বলে- হজ্জ্ব করা মানে টাকার অপচয়! কুরবানী করা মানে অহেতুক টাকা ব্যয়। (নাঊযূবিল্লাহ!)
সুতরাং কারো কথায় বা উক্তির ভেতরে এই তিনটির যে কোন একটিও পাওয়া গেলে সে নিশ্চিত কাফির।

 ভাষাগত ঈমান বিনষ্টকারী বিষয় সম্পর্কে আরো কিছু বর্ণনা
ক) আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির বর্ণনা
০১. ক্ষমতা-সম্পদ ও প্রতিপত্তির দম্ভে কেউ নিজেকে রব ঘোষণা করলে ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে। যেমন, ফিরআউনের উক্তি- فَقَالَ أَنَاْ رَبُّكُمُ الاْعْلَى অর্থাৎ- “আর সে (ফিরআউন) বলেছে আমিই তোমাদের সবচেয়ে বড় রব (প্রতিপালক)।” (নাঊযূবিল্লাহ!) অথচ, আল্লাহ ছাড়া আসমান-যমীনে অন্য কোন লালন-পালন কর্তা তথা রব নেই। যেমন ইরশাদ হচ্ছে-
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اذْكُرُوا نِعْمَةَ اللهِ عَلَيْكُمْ هَلْ مِنْ خَالِقٍ غَيْرُ اللهِ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ فَأَنَّى تؤفكون.
অর্থাৎ- “ওহে লোকেরা! তোমাদের প্রতি আল্লাহর দয়া-অনুগ্রহকে স্মরণ করো! আল্লাহ ছাড়া কি কোন ¯্রষ্টা (প্রতিপালক) আছে, যে তোমাদেরকে আসমানসমূহ ও যমীন হতে রিযিক প্রদান করে? তিনি ছাড়া অন্য কোন ইলাহ্ নেই। সুতরাং কোন বিপথে তোমরা চালিত হচ্ছো?”
তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। তিনি বলেন,
رَّبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا فَاعْبُدْهُ وَاصْطَبِرْ لِعِبَادَتِهِ ۚ هَلْ تَعْلَمُ لَهُ سَمِيًّا.
অর্থাৎ- “আল্লাহ পাক হলেন আসমানসমূহ-যমীন এবং এই দু’য়ের মধ্যবর্তী সব কিছুরই রব। সুতরাং তুমি তাঁরই ইবাদত করো! আর তাঁর ইবাদতে ধৈর্যশীল থাকো! তুমি কি তাঁর সমগুণ সম্পন্ন কাউকে জানো?” একমাত্র রব আল্লাহ। তারই ইবাদত করতে হবে।
شَهِدَ اللهُ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ وَالْمَلَائِكَةُ وَأُولُو الْعِلْمِ
০২. কথার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে সৃষ্টির মধ্য হতে কাউকে অংশীদার (শির্ক) সাব্যস্ত করলে কাফির হয়ে যাবে। যেমন, কুরআন মাজীদে বিবৃত হচ্ছে-
لَّقَدْ كَفَرَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللهَ ثَالِثُ ثَلَاثَةٍ.
অর্থাৎ-“অবশ্যই তারা কাফির হয়ে গেছে যারা বলেছে- নিশ্চয়ই তিনজনের একজন হলো আল্লাহ।” (নাঊযূবিল্লাহ!) এরূপ বলার সাথে সাথে ওই ব্যক্তি কাফির হয়ে যাবে। বর্ণিত আয়াতের শুরুতে এ জতীয় বিশ্বাস ধারণ কারীকে আল্লাহ পাক কাফির বলে ঘোষণা দিয়েছেন। বর্তমানে এরূপ ধারণা খৃষ্টান সমাজ পোষণ করে থাকে। ইয়াহুদী-নাসারাদের কুফুরী ধারণার একত্রে বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ পাক বলেন,
وَقَالَتِ الْيَهُودُ عُزَيْرٌ ابْنُ اللهِ وَقَالَتْ النَّصَارَى الْمَسِيحُ ابْنُ اللهِ ذَلِكَ قَوْلُهُم بِأَفْوَاهِهِمْ.
অর্থাৎ- “আর ইয়াহুদীরা বলে- উযাইর আলাইহিস সালাম আল্লাহর ছেলে এবং খৃষ্টানরা বলে- ঈসা মাসীহ আলাইহিস-সালাম আল্লাহর ছেলে; এটা তাদের মনগড়া কথা বৈ কিছুই নয়।” এভাবে কোন মুসলমান যদি অন্য কোন মানুষকে তুচ্ছ করতে বা অসম্মান করতে বলে- অমুক খোদার ছেলে ঈসা হয়েছে না কি? তৎক্ষণাৎ এ উক্তিকারী কাফির হয়ে যাবে। একমাত্র সত্য বা পরম সত্য হলেন আল্লাহ্। বাকী সব মিথ্য-ধোঁকা। আল্লাহপাক বলেন,
ذَلِكَ بِأَنَّ اللهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ هُوَ الْبَاطِلُ وَأَنَّ اللهَ هُوَ الْعَلِيُّ الْكَبِيرُ.
অর্থাৎ- “(আর আল্লাহ পাক) এটা এজন্য করেন যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তিনিই পরম সত্য। আর নিশ্চয়ই তারা তিনি ব্যতিত যাদের ডাকে তা অসার। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ তিনি সমুচ্চ, সুমহান।” সৃষ্টি-সাহায্য করার ক্ষমতা যার নেই তাকেই ¯্রষ্টা-সাহায্যকারী হিসাবে আহ্বান কতই নিকৃষ্ট কাজ! আল্লাহ পাক বলেন,
أَيُشْرِكُونَ مَا لَا يَخْلُقُ شَيْئًا وَهُمْ يُخْلَقُونَ وَلَا يَسْتَطِيعُونَ لَهُمْ نَصْرًا وَلَا أَنْفُسَهُمْ يَنْصُرُونَ.
অর্থাৎ- “তারা (মুশরিকরা) কি (আল্লাহর সাথে এমন কাউকে) শরীক করে, যারা কোন কিছুই সৃষ্টি করেনা (করার ক্ষমতা রাখে না)! কারণ, তারাতো নিজেরাই (আল্লাহর দ্বারা) সৃষ্ট। এরা যেমনি তাদের কোন সাহায্য করতে পারে না, তেমনি নিজেরাও কোন সাহায্য করতে পারে না।”
০৩. কথার মাধ্যমে আল্লাহর একক প্রভূত্ব-ক্ষমতা-মালিকানাকে অস্বীকার করলে ঈমান বিনষ্ট হয়ে যায়। অথচ আল্লাহ পাক বলেন,
وَإِلٰهُكُمْ إِلَٰهٌ وَاحِدٌ ۖ لَّا إِلٰهَ إِلَّا هُوَ الرَّحْمٰنُ الرَّحِيمُ.
অর্থাৎ- “আর তোমাদের উপাস্য একক উপাস্য। তিনি ছাড়া অন্য কোনো (সত্য) উপাস্য নেই। তিনি দয়াময় পরম দয়ালু।” তিনি আরো ইরশাদ করেন,
أَلا لَهُ الْخَلْقُ وَالأمْرُ تَبَارَكَ اللهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ.
অর্থাৎ- “সাবধান! (জেনে রেখো!) সকল সৃষ্টির মালিক তিনিই, আর হুকুমের একমাত্র মালিকও তিনিই। জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহপাকই হলেন বরকতময়।” অন্যত্র এসেছে-
ثُمَّ رُدُّوٓاْ إِلَى اللهِ مَوْلَىٰهُمُ ٱلْحَقِّ ۚ أَلَا لَهُ ٱلْحُكْمُ وَهُوَ أَسْرَعُ ٱلْحَٰسِبِينَ.
অর্থাৎ- “অতঃপর তাদেরকে তাদের প্রকৃত মালিক আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তিত করানো হয়। নিঃসন্দেহে সর্বময় ক্ষমতা তাঁরই এবং তিনি দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী।” সুতরাং কেউ যদি বলে- ‘‘অমুক আমার পালনকর্তা-লালনকর্তা। অমুক মহান ক্ষমতার মালিক। তিনি মহান শক্তিশালী, সবকিছু তার হাতে। এ জাতীয় কথা বলার সাথে সাথে ব্যক্তি কাফির হয়ে যাবে। কারণ, সর্বময় ক্ষমতার উৎস-মালিক, লালন-পালনকর্তা, বিচার কর্তা সবকিছুই একমাত্র মহান আল্লাহ। আর এজন্য আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন-
تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ.
অর্থাৎ- “বরকতময় তিনি (আল্লাহ্) যাঁর কুদরতের হাতে রাজত্ব এবং তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।” তাঁর সৃষ্টিজগতের মালিকানায়-কর্তৃত্বে কাউকেও তিনি শরীক করেন না। যেমন, ইরশাদ হচ্ছে- .وَلَا يُشْرِكُ فِي حُكْمِهِ أَحَدًا অর্থাৎ- “আর তিনি নিজ কর্তৃত্বে কাউকেই শরীক করেন না।” আল্লাহ পাক চাইলে তাঁর মুত্তাক্বী-সৎকর্মশীল বান্দাদের তাঁর সৃষ্টিজগতের কর্তৃত্ব-নেতৃত্ব দিতে পারেন। এটা কেউ দাবী করে নিতে পারে না। আল্লাহ পাক নিজ অনুগ্রহ-দয়ায় বিশেষ কিছু বান্দাদের দিয়ে থাকেন। যেমন, আল্লাহ পাক বলেন, إِنَّ الأَرْضَ لِلَّهِ يُورِثُهَا مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ. অর্থাৎ- “নিশ্চয়ই যমীনের মালিক আল্লাহ। তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাদের থেকে যাকে ইচ্ছা এর মালিক বানাতে পারেন। আর শুভপরিণাম তো খোদাভীরুদের জন্যেই।”
০৪. আল্লাহর যাত বা সিফাতের ধারক হিসেব মৌলিকভাবে সৃষ্টির কাউকে আহ্বান করা। যেমন, কেউ কাউকে খোদা বলে বিশ্বাস করলো অথবা কাউকে সত্তাগতভাবে রিযিকদাতা, সন্তানদাতা, জীবনদাতা, জ্ঞান দাতা এবং সম্পদদাতা বলে বিশ্বাস করলো ও ঘোষণা দিলো। যদি কেউ বলে- অমুক আমার হাকীকী রিযিকদাতা, জ্ঞানদাতা এবং সম্পদ দাতা তবে এরূপ বলার সাথে সাথে ওই ব্যক্তি শির্ক করার কারণে কাফির হয়ে যাবে। এ জাতীয় শির্কী বিশ্বাস আমাদের দেশীয় হিন্দুসমাজ পোষণ করে থাকে। আল্লাহপাক বলেন,
فَلَا تَدْعُ مَعَ اللهِ إِلَٰهًا ءَاخَرَ فَتَكُونَ مِنَ ٱلْمُعَذَّبِينَ.
অর্থাৎ- “আর আল্লাহর সাথে অন্য প্রভূকে আহ্বান করো না। করলে- তুমি শাস্তি প্রাপ্তদের অন্তর্ভূক্ত হবে।”
وَأَنَّ الْمَسَاجِدَ لِلّهِ فَلَا تَدْعُوا مَعَ اللهِ أَحَدًا
অর্থাৎ- “আর মাসজিদ সমূহ আল্লাহর (ইবাদতের) জন্যেই। সুতরাং আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে ডেকো না (ইবাদত করো না)।” যারা শির্ক করবে তাদের বিষয়ে আল্লাহর ফায়সালা হলো- ومَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ. অর্থাৎ- “আর যে আল্লাহর সাথে শির্ক করবে অবশ্যই তার জন্য আল্লাহ পাক জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন। আর তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম।”
০৫. এ বিষয়ে ফাতওয়া আলমগীরীতে বলা হয়েছে-
ومنها: ما يتعلق بذات الله تعالى وصفاته وغير ذلك) يكفر إذا وصف الله تعالى بما لايليق به، أو سخر باسم من أسمائه، أو بأمر من أوامره، أو نكر وعده ووعيده، أو جعل له شريكاً، أو ولداً، أو زوجةً، أو نسبه إلى الجهل، أو العجز، أو النقص ويكفر بقوله: يجوز أن يفعل الله تعالى فعلاً لا حكمة فيه، ويكفر إن اعتقد أن الله تعالى يرضى بالكفر.
০৬. অর্থাৎ- ‘(আর তার (কুফুরীর) মধ্যে হতে একটি বিষয় হলো- যা আল্লাহর সত্তা এবং গুণাবলীর সাথে সম্পর্কিত) কেউ যদি আল্লাহকে তাঁর জন্য প্রযোজ্য নয় এমন গুণে গুণান্বিত করে, বা তাঁর নামগুলির যে কোন একটি নামকে উপহাস করে অথবা তাঁর আদেশের কোন একটি আদেশকে নিয়ে ঠাট্টা করে, বা তার পরকালীন (পুরস্কারের) অঙ্গীকার ও (শাস্তির) হুমকিকে অস্বীকার করে, বা তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে, বা কাউকে পুত্র-স্ত্রী বানায়, বা অজ্ঞতা, অক্ষমতা বা অপূর্ণতার জন্য দায়ী করে; তবে সে কাফির হয়ে যাবে। এছাড়া সেই ব্যক্তিও কাফির হয়ে যাবে যে বলে- হিকমতহীন কাজ করা আল্লাহর জন্য জায়িয। সে ব্যক্তিও কাফির হয়ে যাবে যে বিশ্বাস করে যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা অবিশ্বাসের (কুফুরীর) উপর সন্তুষ্ট।’
০৭. আল্লাহপাককে মন্দ বললে, গালাগালি করলে বা দোষ বর্ণনা করলে ওই ব্যক্তির ঈমান বিনষ্ট হয়ে যাবে। যেমন, কোন মুসলমান দুঃখের সময় যদি বলে- খোদা অন্ধ হয়ে গেছে মনে হয়! আমার দুঃখ-কষ্ট তিনি দেখেন না। এরূপ বলার সাথে সাথে ওই ব্যক্তি কাফির হয়ে যাবে। অনুরূপভাবে কোন ব্যক্তি রাগবশতঃ যদি বলে- তোর মাকে—! এ সময় কেউ খোদার ভয় প্রদর্শন করলে- খোদার মাকেও—! নাঊযূবিল্লাহ! সাথে সাথে ঈমান হারা হয়ে যাবে। ইবনু কুদামা আল-মাক্বদাসী বলেন, من سبَّ اللهَ تعالى كَفَر، سواءٌ كان مازحًا أو جادًّا. অর্থাৎ- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলাকে গালি দিয়েছে, হোক তা হাসি-ঠাট্টাচ্ছলে বা সুস্থির মন নিয়ে; সে কুফরী করেছে।’ ইমাম ইসহাক ইবনু রাহওয়াই বলেন, ‘মুসলিম উম্মাহ এই বিষয়ে একমত যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ পাককে গালি দেবে নিঃসন্দেহে সে কাফির।’ ইমাম নাজমুদ্দিন আহমাদ আল-হাম্বালী বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহপাক বা তাঁর রাসূলকে গালি দেবে সে কাফির হয়ে গেছে।’

টিকা:
– আল-কুরআন, সূরা: আল ইনশিরাহ্, ৯৪:০৩। 
– মুসত্বালাহাতুল-ফিক্বহিয়্যাহ, পৃ.নং-৯৯।
[1]- https://www.almaany.com/ar/dict/ar-نواقض-الإيمان/

– আল-কুরআন, সূরা: আন-নাজি‘আত-৭৯:২৪।
– আল-কুরআন, সূরা: আল-ফাতির-০৫:০৩।
– আল-কুরআন, সূরা: আল-মারইয়াম-১৯:৬৫।
– আল-কুরআন, সূরা: আল-মায়িদাহ্-০৫:৭৩।
– আল-কুরআন, সূরা: আত্-তাওবাহ্-০৯:৩০।
– আল-কুরআন, সূরা: আল-হাজ্জ্ব-২২:৬২।
– আল-কুরআন, সূরা: আল-আরাফ-০৭:১৯১ ও ১৯২।
– আল-কুরআন, সূরা: আল-বাক্বারাহ্-০২:১৬৩।
– আল-কুরআন, সূরা: আল-আরাফ-০৭:৫৪।
– আল-কুরআন, সূরা: আল-আন‘আম-০৬:৬২।
– আল-কুরআন, সূরা: আল-মুল্ক-৬৭:০১।
– আল-কুরআন, সূরা: আল-কাহাফ-১৮:২৬।
– আল-কুরআন, সূরা: আল-আরাফ-০৭:১২৮।
– আল-কুরআন, সূরা: আশ-শু‘আরা-২৬:২১৩।
– আল-কুরআন, সূরা: আল-জিন-৭২:১৮।
– আল-কুরআন, সূরা: আল-মায়িদাহ্-০৫:৭২।
– মুল্লা নিজামুদ্দিন, ফাতওয়া আলমগীরী, খন্ড-০২, পৃ.নং-২৫৮।
– ইমাম আব্দুল্লাহ বিন কুদামা আল-মাকদাসী, আল-মুগনী, খন্ড-১২, পৃ.নং-২৯৮।

লেখক: প্রভাষক (আরবী), হাশিমপুর ইসলামিয়া মকবুলিয়া কামিল মাদরাসা।

Share:

Leave Your Comment