সারা বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ প্রসঙ্গ

সারা বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ প্রসঙ্গ

চাঁদ দেখার বিবরণ

রমযানের রোযা, ঈদ, হজ্ব, কোরবানী, শবে বরাত, শবে ক্বদর, আশুরা ও শবে মি’রাজ শরীফের মত অতীব ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানসমূহ চাঁদের তারিখের উপর নির্ভরশীল। তাই অধিকাংশ ওলামা-ই কেরামের মতে বার চাঁদের মধ্যে পাঁচটি মাসের চাঁদ দেখা ওয়াজিব আলাল কেফায়া। অর্থাৎ প্রত্যেক এলাকাবাসীর মধ্যে কম পক্ষে একজন চাঁদ দেখলে সবাই গুনাহ্‌ থেকে দায়মুক্ত হবে। পাঁচটি চাঁদের মধ্যে শা’বান, রমযান, শাওয়াল, জিলক্বদ ও জিলহজ্ব। বাকি মাসসমূহের চাঁদ দেখা মুস্তাহাব ও অনেক সাওয়াব। [ফাতাওয়ায়ে রযভিয়া ইত্যাদি]

প্রিয় নবী সরকারে দো’আলম হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা চাঁদ দেখে রোযা শুরু কর এবং চাঁদ দেখে ইফতার (ঈদ) কর, আর যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে যায় তবে শাঞ্চবান মাসকে ত্রিশ দিনে পূর্ণ করে নাও। [বুখারী ও মুসলিম শরীফ]

জরুরী মাসআলাঃ যেহেতু চৎন্দ্র মাস ২৯ ও ৩০ দিনে পরিপূর্ণ হয়, কোন চৎন্দ্র মাস ২৯ দিনের কম হয় না, তদ্রূপ ৩০ দিনের অধিকও হয় না,  সেহেতু শা’বানের ২৯ তারিখ সন্ধ্যা বেলায় মাহে রমযানের নতুন হেলাল (চাঁদ) দেখবে, শা’বানের ২৯ তারিখ রমযানের চাঁদ দেখা গেলে পরদিন থেকে রমযানের রোযা শুরু করবে। যদি শা’বানের ২৯ তারিখ সন্ধ্যায় রমযানের চাঁদ দেখা না যায়, তবে শা’বানের ত্রিশদিন পূর্ণ করে রমযানের রোযা শুরু করবে। শা’বানের ৩০ তারিখ রমযানের চাঁদ দেখা না গেলেও পরদিন থেকে রমযানের রোযা শুরু করতে হবে। [আলমগীরী]

জরুরী মাসআলাঃ চন্দ্রের উদয়স্থল পরিস্কার না থাকা অবস্থায় বা কুয়াশা ও মেঘাচ্ছন্ন থাকাবস্থায় রমযানের রোযা ফরয হওয়ার জন্য শুধু একজন মুসলমান বালেগ (প্রাপ্ত বয়স্ক) আক্বেল (বিবেকবান) আদেল (যে কবীরা গুনাহ হতে বিরত থাকে এবং বার বার সগীরাহ্‌ গুনাহ করে না) ও মসতুর (যার বাহ্যিক অবস্থা শরীয়ত সম্মত, কিন্তু অভ্যন্তরীণ অবস্থা জানা নেই)-এর সাক্ষ্য যথেষ্ট, সে পুরুষ হোক বা মহিলা, অবশ্য রমযান ব্যতীত ঈদ বা অন্যান্য মাসের চন্দ্র উদয়ের ব্যাপারে আকাশ পরিস্কার না থাকাবস্থায় কমপক্ষে দুঞ্চজন উপরোক্ত গুণাবলী সম্পন্ন পুরুষ বা একজন পুরুষ ও দু’জন মহিলার সাক্ষূ অবশ্যই জরুরী। হাঁ আকাশ বা চন্দ্রের উদয়স্থল পরিস্কার থাকা অবস্থায় চন্দ্র উদয়ের ব্যাপারে অনেক লোকের সাক্ষ্য অপরিহার্য, চাই রমযানের ব্যাপারে হোক বা ঈদের ব্যাপারে হোক বা অন্য মাসের ব্যাপারে হোক। অনেক লোক বলতে শরীয়তের ক্বাযী বা রাষ্ট্রের পক্ষ হতে নিযুক্ত স্থানীয় প্রশাসন যতজন সাক্ষীর প্রয়োজন মনে করেন, ততজন সাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়ে ক্বাযী বা সরকার কর্তৃক নিযুক্ত স্থানীয় প্রশাসন চাঁদ দেখার ঘোষণা দেবেন।[হেদায়া ও রদ্দুল মুহতার ইত্যাদি]

জরুরী মাসআলাঃ শুধু রেডিও, টিভির খবর এবং জ্যোতিষের ধারণা চন্দ্র উদয়ের ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য নয়। রমযান বা ঈদের চন্দ্র উদয়ের ব্যাপারে ক্বাযী বা সরকার কর্তৃক নিযুক্ত স্থানীয় প্রশাসনের নিকট উপরোক্ত গুণাবলী সম্পন্ন সাক্ষীর প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য অপরিহার্য, সাক্ষ্য দেওয়ার সময় বলবে, ‘‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, অমুক স্থানে বা অমুক এলাকায় আমি রমযান বা ঈদের নতুন চাঁদ দেখেছি।’’ অন্য শব্দ দ্বারা সাক্ষ্য প্রদান করলে তা গৃহীত হবে না। যেমনঃ ক্বাযী বা সরকার কর্তৃক নিযুক্ত প্রশাসনের নিকট কয়েকজন বলল- অমূক স্থানে চাঁদ দেখা গেছে অথবা অমুক অমুক ব্যক্তি চাঁদ দেখেছে- এ জাতীয় শব্দে সাক্ষ্য দান যথেষ্ট নয়। তদ্রূপ টেলিগ্রাম বা টেলিফোন বা যান্ত্রিক উপায়ে ক্বাযী বা স্থানীয় প্রশাসনের নিকট চন্দ্র উদয়ের সাক্ষ্য প্রদান করলে তাও গৃহীত হবে না, যেভাবে মামলা-মোক্বদ্দমায় হাকিমের নিকট সাক্ষীগণ প্রত্যক্ষভাবে সাক্ষ্য প্রদান করতে হয়, তদ্রূপ চন্দ্র উদয়ের বেলায়ও ক্বাযী বা স্থানীয় প্রশাসনের নিকট প্রত্যক্ষভাবে সাক্ষ্য প্রদান করতে হবে। অনুরূপ চন্দ্র না দেখে গুজব, পঞ্জিকা, সংবাদ পত্রের ভিত্তিহীন ও সন্দেহমূলক খবর, ক্বাযী বা সরকার কর্তৃক নিয়োজিত স্থানীয় প্রশাসনের নিকট চন্দ্র উদয়ের সাক্ষ্যদান ছাড়া শুধু রেডিও, টিভির খবরের উপর ভিত্তি করে, অনুরূপ জ্যোতিষী বা গণকের গণনার উপর নির্ভর করে শরীয়ত মোতাবেক চাঁদ দেখা প্রমাণিত হয় না। [শরহুল আশবাহ, হুমুভী ও কানূনে শরীয়ত ইত্যাদি]

 জরুরী মাসআলাঃ গ্রাম বা শহরের অনেক লোক রমযানের নূতন চাঁদ দেখলে সকলের উপর রমযানের রোযা পালন করা অপরিহার্য হয়ে যায়। অবশ্য যদি কোন গ্রামের মাত্র ২/১ জন লোক শাঞ্চবানের ২৯ তারিখ সন্ধ্যাবেলায় রমযানের চাঁদ দেখল, কিন্তু সেখানে কোন ক্বাযী বা সরকার কর্তৃক নিযুক্ত প্রশাসন নেই, তবে গ্রামের লোকদেরকে একত্রিত করে চাঁদ দেখার সাক্ষ্য দেবে। সাক্ষ্যদাতা যদি আদিল বা সত্যবাদী হয় তবে সকলের উপর পরদিন হতে রমযানের রোযা পালন করতে হবে। নতুবা শাঞ্চবান মাস ৩০ দিন পূর্ণ করার পর থেকে রমযানের রোযা শুরু করবে।  [কানূনে শরীয়ত ইত্যাদি]

সারা বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ প্রসঙ্গ

যদি কোন এক শহরে বা রাষ্ট্রে রমযান বা শাওয়ালের নূতন চাঁদ দেখা যায়, তবে অন্য শহর বা রাষ্ট্রে (যেখানে চাঁদ দেখা যায় নাই) রোযা ও ঈদ পালন করতে হবে কি না? এ ব্যাপারে ইমামগণের মধ্যে মতবিরোধ আছে। বিশেষতঃ হানাফী মাযহাবের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ওলামা-ই কেরামের মতে বিশ্বের কোন এক স্থানে চাঁদ দেখা গেলে সারা বিশ্বে একই সময়ে রোযা ও ঈদ পালন করবে। তবে শর্ত হল নির্দিষ্ট তারিখেই চাঁদ দেখা সংক্রান্ত সাক্ষ্য চাঁদ দেখা না যাওয়া স্থানে কাযী বা সরকার কর্তৃক নিযুক্ত প্রশাসনের নিকট প্রদান করতে হবে অথবা বিভিন্ন কাফেলা বা দল-উপদল চাঁদ দেখা না যাওয়ার স্থানে ক্বাযী বা সরকার কর্তৃক নিযুক্ত প্রশাসনের নিকট সাক্ষ্য প্রদান করতে হবে। শুধু রেডিও, টেলিভিশন, বেতারযন্ত্র অথবা যান্ত্রিক উপায়ে বিশ্বের কোন এক প্রান্তে চাঁদ দেখার খবর প্রচার করলে হানাফী মাযহাবের পূর্ববর্তী ফক্বীহগণের মতেও অন্য দেশে (যেখানে চাঁদ দেখা যায় ংন) রোযা ও ঈদ পালন করা শুদ্ধ হবে না। যেহেতু রোযা ও ঈদ পালন করা চাঁদ দেখার সাক্ষ্যের উপর নির্ভরশীল, খবরের উপর নয়। [বাহারে শরীয়ত ইত্যাদি]

তবে হানাফী মাযহাবের পরবর্তী ওলামা-ই কেরাম ও শাফে‘ঈ মাযহাবের অধিকাংশ ইমামগণ সারা বিশ্বে চন্দ্র উদয়ের ভিন্নতার কারণে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, সারা বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ পালন করা যাবে না। যেহেতু নামায যেমনিভাবে সূর্যের গতি ও সময়ের উপর নির্ভরশীল, তেমনি রোযা ও ঈদ চন্দ্র উদয়ের সময়সীমার উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ সারা বিশ্বে সূর্য উদয়ের ভিন্নতা যে রকম গ্রহণীয়, তদ্রূপ অধিকাংশ ইমামগণের মতে চন্দ্র উদয়াস্তের ভিন্নতাও গ্রহণীয়। সুতরাং হানাফী মাযহাবের পরবর্তী ওলামা-ই কেরামের মতে নিকটতম শহর বা রাষ্ট্রের (যেখানে চন্দ্র উদয়ের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়) কোন এক প্রান্তের চন্দ্র দেখা অপর দূরবর্তী প্রান্তের জন্য যথেষ্ট নয়। উল্লেখ্য যে, যে দেশ বা শহর পায়ে হেঁটে বা স্বাভাবিক নিয়মে অতিক্রম করতে কমপক্ষে এক মাসের অধিক সময় লাগে সে শহর বা দেশে রোযা বা ঈদ পালন করা অন্য শহর বা দেশের চাঁদ উদয়ের উপর নির্ভরশীল নয়। কোন কোন ইমাম বলেন- যতদুর এলাকাকে এক দেশ মনে করে সে এলাকার যে কোন স্থানে চন্দ্র উদয়ের সাক্ষী পাওয়া গেলে উক্ত সমগ্র এলাকায় রোযা ও ঈদ পালন করতে হবে। আর তা না হলে বরং ভিন্ন সময়ে চন্দ্র উদয় হতে দেখা গেলো, যেমন বাংলাদেশে তার বিপরীত তারিখে চন্দ্র উদয় হলো, উভয় দেশ হানাফী পরবর্তী ওলামা-ই কেরামের মতে এক হুকুমের আওতায় আসতে পারে না। হাফেযুল হাদীস ওসমান বিন আলী যায়ল‘ঈ হানাফী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ‘শরহুল কানয’ কিতাবে ‘মুতাআখ্‌খেরীনে আহনাফ’ বা পরবর্তী হানাফীগণের মতকে অধিকতর উত্তম বলে গ্রহণ করেছেন। [সিরাজিয়া,বাদা-ই’উস্‌ সানা-ই’]