রিয়া বা লৌকিকতা নেক আমল বিনষ্ট করে দেয়

রিয়া বা লৌকিকতা নেক আমল বিনষ্ট করে দেয়

মাওলানা মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম ক্বাদিরী

মু’মিনের জীবনে সব থেকে ক্ষতিকর বিষয় হলো লৌকিকতা-ভনিতা। ইমাম নবভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন, লৌকিকতা আমল নষ্টকারী। আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য এবং মু’মিন ব্যক্তির মাঝে লৌকিকতা দূরত্বের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি লৌকিকতাকে শির্কতুল্য গণ্য করা হয়। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বিষয়ে স্বীয় উম্মতকে সাবধান করে গেছেন। তিনি ইরশাদ করেন, ‘সৈয়্যদুনা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, একবার তিনি মসজিদে নবভী শরীফের দিকে যাচ্ছিলেন; এমন সময় তিনি হযরত মু‘আয ইবনু জাবাল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রাওযা মুবারকের কাছে কান্নারত দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কাঁদছেন কেন? তিনি বললেন, এ কারণে কাঁদছি যে, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, “সামান্যতম লৌকিকতা (রিয়া)ও শির্ক।’
হযরত কাযী ফুদাইল ইবনু আয়ায রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, ‘মানুষের কথা ভেবে আমল পরিত্যাগ করা রিয়া বা লৌকিকতা আর মানুষের কথা ভেবে আমল করা শির্ক। আর এতদুভয় থেকে আল্লাহ পাক দয়া করে তোমাকে মুক্ত রেখে যে আমলের তাওফীক দেন তাই খাঁটি আমল।’
মাওলা আলী শের-এ খোদা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, লৌকিকতার চিহ্ন তিনটি। যথা- ১. একাকী থাকলে অলস পড়ে থাকে। কিন্তু লোকসমাজের সামনে আসলে কর্মবীর হয়ে যায়। ২. তাঁর কাজের প্রশংসা করলে কাজ বাড়িয়ে দেয়। ৩. তার কাজের সমালোচনা করলে কাজ কমিয়ে দেয়।’
আল্লাহপাক বলেন, لَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَفْرَحُونَ بِمَا أَتَوْا وَيُحِبُّونَ أَنْ يُحْمَدُوا بِمَا لَمْ يَفْعَلُوا فَلَا تَحْسَبَنَّهُمْ بِمَفَازَةٍ مِنَ الْعَذَابِ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
অর্থাৎ- যারা আপন কর্মে সন্তুষ্ট এবং তারা যা করেনি তার জন্যে প্রশংসা চায়; এ জাতীয় লোকদের বিষয়ে এরূপ ধারণাও করো না যে, তারা শাস্তি হতে বিমুক্ত হবে। বরঞ্চ তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।”
লৌকিকতা ইসলামে বর্জনীয়-নিন্দনীয় স্বভাব। মু’মিন কখনো কপট বা ভণিতাকারী হন না। মু’মিন কখনো লোকপ্রিয়তার জন্য আমল করেন না। এটা মুনাফিকের স্বভাব। রিয়াকারের অশুভ পরিণতির বর্ণনায় হাদীসে পাকে ইরশাদ হচ্ছে-
.مَنْ سمَّعَ الناسَ بعملِهِ سمَّعَ اللهُ بهِ سامِعَ خلقِهِ وصغرَهُ وحقرَهُ
অর্থাৎ- ‘যে লোক অন্যদেরকে তার আমলের কথা বলে বেড়াবে (লৌকিতা করবে)- তা সৃষ্টির সবকিছু শ্রবণকারী আল্লাহপাক শুনে নেন। আর (এর শাস্তিস্বরূপ) তাকে (উভয় জগতে) ছোট করবেন এবং অপমাণিত করবেন।’
সুতরাং কোন মু’মিন আলিম দাবিদার হলে তিনি রিয়াকার হবেন না। দুনিয়া অর্জনের জন্য কপট হবেন না। মানুষের বাহবা কুঁড়ানোর জন্য ওয়াজ করবেন না। ইলমী ভণিতা করে উদরপূর্তি করবেন না। আল্লাহ প্রদত্ত অমূল্য ইলমকে তুচ্ছ-মূল্যহীন দুনিয়ার যশ-খ্যাতি-সম্পদ লাভের হাতিয়ার বানাবেন না।

 দুনিয়া লাভের নিয়্যতে ইলম অর্জন-বিতরণ ন্যাক্কারজনক কাজ
আলিমগণ দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মানুষ। তাঁদের মর্যাদার স্তর আল্লাহ পাক অনেকগুণ বৃদ্ধি করেছেন। আলিম ও জাহিল কখনো এক হতে পারেনা বলেও ফয়সালা দিয়েছেন। নবী-রাসূল আলাইহিমুস-সালাম-এর পর তাঁদের স্থান দিয়েছেন। আলিমগণ আল্লাহকে বেশী ভয় করেন। এই হিসেবে তাঁরা বড়ই খোদাভীরু। পার্থিব সম্মান-খ্যাতি, প্রতিপত্তির লোভ এবং ক্ষমতার লালসা ত্যাগ করাই হলো পরহিযগারী।
সুতরাং দুনিয়ার ধন-সম্পদ, যশ-খ্যাতি লাভের আশায় দ্বীনী ইলম অর্জন করা খুবই ন্যাক্কারজনক কাজ। হাদীস শরীফে ইরশাদ হচ্ছে-
من تعلَّم علمًا مما يبتغى به وجهَ اللهِ تعالى، لا يتعلَّمُه إلا ليُصيبَ به عرضًا من الدنيا لم يجِدْ عَرْفَ الجنةِ يومَ القيامةِ.
অর্থাৎ- ‘আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যেই জ্ঞান অর্জন করা চাই। আর যে ব্যক্তি পার্থিব লাভের আশায় ইলম অর্জন করবে সে কিয়ামতের দিন জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না।’
হাদীস শরীফে আরো ইরশাদ হচ্ছে- ‘যে ব্যক্তি (পৃথিবীতে) ইলম শিখেছে, শিক্ষা দিয়েছে এবং পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করেছে; তাকে (কিয়ামতের দিন) আল্লাহর সামনে পেশ করা হবে। আল্লাহ তা‘আলা তাকে তাঁর প্রদত্ত নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। তারপর সেই ব্যক্তি সেগুলো স্বীকার করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন- তুমি এই নিয়ামতের শুকরিয়া স্বরূপ কি করেছো? বান্দা বলবে- আমি ইলম শিখেছি আর শিখিয়েছি এবং আপনার সন্তুষ্টির জন্য কুরআন তিলাওয়াত করেছি। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন- তুমি মিথ্যা বলছো। তুমি জ্ঞান অর্জন করেছিলে যাতে তোমাকে আলিম বলা হয় এবং কুরআন তিলাওয়াত করেছিলে যাতে তোমাকে তিলাওয়াতকারী (সুকন্ঠী ক্বারী) বলা হয়। সুতরাং (জগতে তোমাকে) তাই বলা হয়েছে (অর্থাৎ- তোমার বিনিময় তুমি জগতে পেয়ে গেছো)। অতঃপর তাকে মুখ উপুড় করে টেনে নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার আদেশ দেয়া হবে।’ আর এ জাতীয় আলিম সর্বপ্রথম জাহান্নামে প্রবেশকারী তিন জনের একজন হবে। নাঊযূবিল্লাহ!
হাদীসে পাকে আরো এসেছে-
مَنْ تعلَّمَ العلْمَ ليُباهِيَ بِهِ العلماءَ، أوْ يُمارِيَ بِهِ السفهاءَ، أوْ يصرِفَ بِهِ وجوهَ الناسِ إليه، أدخَلَهُ اللهُ جهنَّمَ.
অর্থাৎ- ‘যে ব্যক্তি এই উদ্দেশ্যে ইলম শিখে যে, সে এর মাধ্যমে (হক্কানী) আলিমগণের উপর নিজ ইলমের গর্ব-অহংকার প্রকাশ করবে, অথবা এর মাধ্যমে মূর্খদের সাথে তর্কে লিপ্ত হবে, অথবা লোকজন তার প্রশংসায় মুখরিত থাকবে; সেই ব্যক্তিকে আল্লাহপাক জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন।’
প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,
مَنْ تَعَلَّمَ صَرْفَ الْکَلَامِ لِيَسْبِيَ بِهِ قُلُوْبَ الرِّجَالِ أَوِ النَّاسِ لَمْ يَقْبَلِ ﷲُ مِنْهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ صَرْفًا وَلَا عَدْلًا..
অর্থাৎ- ‘যে বক্তা ব্যক্তি বিশেষের বা আম লোকজনদের হৃদয় নিজের করতলগত করার উদ্দেশ্যে সুন্দর বর্ণনাভঙ্গি-বক্তব্য শিখে কিয়ামতের দিন আল্লাহপাক তার ফরয-নফল কোন ইবাদত কবুল করবেন না।’
মু’মিন আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনার্থে ইলম শিখবে। অন্যথায় জাহান্নামই তার নিবাস হবে। ইরশাদ হচ্ছে-
مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا لِغَيْرِ ﷲِ أَوْ أَرَادَ بِهِ غَيْرَ اﷲِ، فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ
অর্থাৎ- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর (সন্তুষ্টি কামনা) ছাড়া অন্য কারো (সন্তুষ্টির) জন্য জ্ঞান অর্জন করে, সে তার স্থান জাহান্নামে করে নিলো।’ সুতরাং বুঝা গেলো- পার্থিব লাভের আশায় ইলম অর্জন করা হারাম। এটা জাহান্নামীদের অন্যতম আমল।

 দুনিয়াপ্রীতি জান্নাতীদের নিশানা নয়
দুনিয়া মু’মিনের জন্য জেলখানা আর কাফিরের জন্য জান্নাত। দ্বীনদার মু’মিনগণ দুনিয়াদারী করবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও পরকালীন নাজাতের আশায়। মাছ যেভাবে পানিতে বাস করেও তার গায়ে পানি লাগে না তেমনি মু’মিনগণ দুনিয়াতে থাকবে কিন্তু দুনিয়ার নোংরা স্বভাব তাঁদের স্পর্শ করবে না। দুনিয়ার স্্েরাতে গা ভাসিয়ে দেয়া লোকের পরকালীন মন্দ পরিণতির কথা বর্ণনা করে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيهَا وَهُمْ فِيهَا لا يُبْخَسُونَ، أُولَٰئِكَ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْآخِرَةِ إِلَّا النَّارُ ۖ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوا فِيهَا وَبَاطِلٌ مَّا كَانُوا يَعْمَلُونَ.
অর্থাৎ- “যে ব্যক্তি পার্থিব জীবন ও তার শোভা কামনা করে, আমি তাদেরকে সেখানে (পৃথিবীতে) তাদের আমলের পূর্ণ প্রতিদান দেবো। আর তাদের এই প্রতিদানে কমতি করা হবে না। তারাই ঐ সকল লোক যাদের জন্য পরকালে আগুন ছাড়া আর কিছুই নেই। আর তারা তাতে (দুনিয়াতে) যা আমল করেছিল তা ধ্বংস হয়েছে এবং তারা যা (দুনিয়াতে আমল) করতো তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।” দুনিয়াবিমুখ এবং দুনিয়াদার উভয়ের প্রতিদান বিষয়ে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন,
مَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الْآخِرَةِ نَزِدْ لَهُ فِي حَرْثِهِ وَمَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ نَصِيبٍ.
অর্থাৎ- “যে ব্যক্তি (সৎ আমলের দ্বারা) পরকালীন কল্যাণের আশা করবে আমি তার ফসল (বিনিময়/প্রতিদান) বৃদ্ধি করে দিই। আর যে দুনিয়াবী ফল/প্রতিদান কামনা করে, আমি তাদেরকে সেখানে (পৃথিবীতে) তাদের আমলের কিছু প্রতিদান দিই। আর পরকালে তার জন্য কোন (প্রতিদানের) অংশ থাকবে না।” পরকালে দুনিয়দার আলিমের পরিণতি কী হবে একটু ভাবলেই গা শিউরে উঠছে! ইমাম সুফিয়ান ছাউরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, ‘যখন আলিমগণই ভ্রষ্ট হয়ে যাবে, তখন সাধারণ মানুষদের পরিশুদ্ধ কে করবে? আলিমগণের দুনিয়াপ্রীতিই হলো তাদের ভ্রষ্টামী। যখন ডাক্তার নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়বে , তখন রোগীর চিকিৎসা সে কিভাবে করবে?’ আলিমগণ হলেন উম্মতের রুহানী ডাক্তার। একমাত্র খোদাভীরু-হক্কানী আলিমগণই উম্মতের ঈমানী-আমলী রোগ সারাতে সক্ষম।

 বর্তমান আলিম নামধারী ওয়ায়িজদের বিধান
বর্তমান সময়ে এমন কিছু ওয়ায়িজ দেখা যায় যারা কুরআন-হাদীস, ফিক্বহ্, এর জ্ঞানে একেবারেই অপরিপক্ক। এরা বিশাল পাগড়ী-আলখেল্লা, আবা-কাবা বা মিনার স্টাইলের উঁচু টুপি পরিধান করে বড় আলেম হিসেবে জাহির করে। এদের উদ্ধৃতি-অনুবাদে এবং কথা-আমলে মিল খুঁজে পাওয়া দুঃষ্কর। কিতাবি ইলম অর্জন না করেও এরা শাইখ-মুফতী-আন্তর্জাতিক স্কলার। এদের কারো কারো কুরআন তিলাওয়াত একেবারেই অশুদ্ধ, ব্যক্তি, সংস্থা ও দরবারী লেজুড়বৃত্তির ফাঁদে আটক ওয়ায়িজরা তো আরো লাগামহীন। কখন মুখ দিয়ে কী বলে ফেলে সেও জানে না। এদের বিষয়ে আমাদের প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ফয়সালা হলো- ‘যে বক্তা শুধু মানুষের বাহবা কুঁড়ানো বা লৌকিকতার নিমিত্তে বক্তব্য দেয়, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঐ বক্তাকে কিয়ামতের দিন লৌকিকতা ও সুনামপ্রিয় ব্যক্তিদের (শাস্তি দেওয়ার) জন্য নির্ধারিত স্থানে দাঁড় করিয়ে রাখবেন।’

ইবনুল ক্বায়্যিম আল-জাওযী বলেন, নবীগণ আলাইহিমুস-সালামের পর শ্রেষ্ঠ লোক হলেন- আলিমগণ, শহীদগণ এবং মুখলিস দানশীলগণ। আর নিকৃষ্টলোক হলো- ঐসকল লোক, যারা নিজেদেরকে তাঁদের দলভূক্ত মনে করে অথচ তারা তা নয়। সুতরাং আলিম না হয়েও নিজেকে আলিমগণের দলভূক্ত মনে করা আল্লাহর জগতে নিকৃষ্ট লোকের পরিচায়ক। হযরত ইমাম যুন্নুন মিসরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তৎকালীন আলিম সমাজকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমরা পূর্বেকার আলিমদের ইলম অর্জনের জন্য মাল খরচ করতে দেখেছি। আর তোমরা মাল অর্জনের জন্য ইলম ব্যয় কর!’
দ্বীনের উপর দুনিয়া, পরকালের উপর ইহকাল এবং ইলমের উপর মাল কখনোই প্রাধান্য পেতে পারে না। এদিকে সতর্ক করে আল্লাহপাক বলেন, بل تؤثرون الحياة الدنيا والآخرةُ خيرٌ وأبقى. অর্থাৎ- “বরং তোমরা পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দিয়ে থাকো; অথচ, পরকাল উত্তম ও স্থায়ী (নিবাস)।”

অতএব, ইলমহীন হয়ে আলিমের ভণিতা করা বা আমলহীন আলিম হয়ে দ্বীনদারী-পরহিযগারিতা প্রদর্শন করা হরাম, কবীরা গুণাহ। এর নিশ্চিত পরিণতি জাহান্নাম। লৌকিকতা এমন মন্দগুণ, যা সহজ-সরল মু’মিনকে ধোঁকা দেয়ার নিমিত্তে কপট লোকেরা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। বর্তমান ওয়ায়িজদের মধ্যে কতিপয় ওয়ায়িজ ইলমী ভণিতা ও লৌকিকতার চোরাবালিতে নিমজ্জিত। ধর্ম বিক্রি করে উদরপূর্তি করা ইয়াহুদী আলিমদের কাজ। তারা অর্থের লোভে আসমানী কিতাবের বিধান পাল্টিয়ে দিতো। আল্লাহ পাক এদের শাস্তির কথা বর্ণনা করে বলেন, “নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ কর্তৃক নাযিলকৃত কিতাবের অংশ বিশেষ গোপন করে এবং তার বিনিময়ে তুচ্ছমূল্য গ্রহণ করে। ঐ লোকেরা নিজেদের পেটে আগুণই ভক্ষণ করে থাকে। আল্লাহপাক কিয়ামত দিবসে তাদের সাথে কথা বলবেন না, তাদের পবিত্রও করবেন না। তাদের জন্য লাঞ্চনাদায়ক শাস্তি রয়েছে।”

আজকাল কিছু তথাকথিত ওয়ায়িজ মনগড়া কথার ফুলঝুরি ছড়াচ্ছে। মনগড়া আলোচনার ফলে মানুষ গোমরাহ-ফাসিকে পরিণত হচ্ছে। কুরআন-সুন্নাহ-ফিক্বাহ-ফতোয়ার জ্ঞান ও উদ্বৃতিবিহীন গলাবাজির মাধ্যমে ওয়াজকারী ও শ্রবণকারী পথভ্রষ্ট হচ্ছে। কেননা, হাদীসের বাণী হলো- ‘সর্বোত্তম কথা হলো- আল্লাহর কিতাব (কুরআনুল কারীম) এবং সর্বশ্রেষ্ঠ পথনির্দেশনা হলো- প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পথনির্দেশনা (সুন্নাহ মুবারাকাহ)।’
ইসলামের মর্মবাণী বিশ্বের রন্দ্রে রন্দ্রে পৌঁছিয়ে ইসলামী সমাজ বিনির্মাণে আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূল-এর সন্তুষ্টি অর্জনই হোক আলিম সমাজের মূল উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন-সুন্নাহই হোক তাঁদের গাইডবুক এবং খোদভীরু, ইলমদার ও বা-আমল আলিমই হোক মুসলিম জাতির পথনির্দেশক।
দ্বীনের পথে আহ্বানকারী আলিম-দাঈ নাবী-রাসূল আলাইহিমুস সালাম-এর উত্তরসূরী। এ কাজ সুযোগ্য-সুদক্ষ ব্যক্তির কাজ। ইসলাম সহজ-সরল ধর্ম। এর পথে আহ্বান ও সহজ – সরল – হিকতমপূর্ণ -লৌকিকতাহীন হওয়া চাই। ধর্ম সরল বিধায় দাঈ তথা আলিমও সরল হওয়া চাই। সরল মানেই সাদাসিধে। ভণিতা কপটতা জাগতিক কৃত্রিম চাকচিক্যের মোহময়তা ও লৌকিকতার এতে স্থান নেই। প্রসিদ্ধি অর্জন ও লোকপ্রিয়তার বালাইও নেই। নেই ইহকালীন ফায়দার লিপ্সা। আছে একাগ্রতা, নিষ্ঠা, ভালোবাসা। আছে হৃদ্যতা, আত্মনিবেদন, খোদাভীরুতা। আছে প্রেমময় আল্লাহ-রাসূল-এর সন্তুষ্টি অর্জন ও পরকালীন সফলতার ঐকান্তিক কামনা। নির্ভেজাল ঐশী জ্ঞানের প্রভায় ইসলাম-মুসলমান আলোকিত। আলিমগণ কর্তৃক সেই নিরেট নূরানী জ্ঞানের নিষ্ঠাপূর্ণ বিতরণই পথহারা জাতিকে দিশা দিতে সক্ষম হবে। আল্লাহর অন্যতম গুণবাচক নাম ‘আলিম’। [আল-কুরআন, সূরা: হাশর-৫৯:২২]

জগতে তাঁর প্রতিনিধি নবী-রাসূল আলাইহিমুস-সালামের উত্তরসূরী মর্দেমু’মিনকে তিনি রূপকার্থে তাঁর এই সুমহান নাম ব্যবহারের সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে অনন্য উচ্চতায় সমাসীন করেছেন। সুবহানাল্লাহ্! ‘আলিম’ আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের ধনে ধনী প্রকৃত মু’মিন। সেই মহান জ্ঞান ইসলামের প্রাণ। সেই জ্ঞানের জ্ঞানী নবীর উত্তরসূরী। ইসলাম কিয়ামত পর্যন্ত এই নির্ভুল ইলম ও মুখলিস আলিমের মাধ্যমেই জগত মাঝে তার সুমহান মর্যাদার সুভাস বিলিয়ে যাবে।

টিকা:

– ইমাম নবভী, শারহুল আরবাঈন, পৃ.নং-০৯।
– ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদীছ নং-২৩৬২৬; ইমাম বাইহাক্বী, শুয়াবুল ঈমান, হাদীছ নং-৬৮৩০।
– ইমাম ইবনু ক্বুদামা আল-মাকদাসী, মুখতাসারু মিনহাজিল কাসিদীন, পৃ.নং-২২৪।
– প্রাগুক্ত, পৃ.নং-২২৩-২২৪।
– আল-কুরআন, সূরা: আলু ইমরান-০৩:১৮৮।
– ইমাম বুখারী, আস-সাহীহ, হাদীছ নং-৬১৩৪; ইমাম মুসলিম, আস-সাহীহ, হাদীছ নং-২৯৮৭; ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদীছ নং-৬৫০৯; ইমাম তাবারানী, মু’জামুল কাবীর, খন্ড-১৩, পৃ.নং-৩৭০, হাদীছ নং-১৪১৮৭; ইমাম আবু নুয়াইম, হিলিয়াতুল আউলিয়া, খন্ড-০২, পৃ.নং নং-১২৪।
– ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, হাদীছ নং-৩৬৬৩; ইমাম ইবনু মাযাহ, আস-সুনান, হাদীছ নং-২৫২; ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদীছ নং-৮৪৫৭; ইমাম মুনযিরী, আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব, হাদীছ নং-১০৫।
– ইমাম মুসলিম, আস-সাহীহ, হাদীছ নং-১৫১৩ ও ১৯০৫; ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদীছ নং-৮২৬০; ইমাম নাসায়ী, আস-সুনান, খন্ড-০৬, পৃ.নং-২৩, হাদীছ নং-৩১৩৭; ইমাম হাকিম নিশাপুরী, আল-মুসতাদরাক, হাদীছ নং-৩৬৪; ইমাম বাইহাক্বী, আস-সুনান, হাদীছ নং-১৮৩৩০; ইমাম খতীব তিরিযী, মিশকাত শরীফ, হাদীছ নং-২০৫।
– ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, হাদীছ নং-৩৬৬৪; ইমাম ইবনু মাযাহ, আস-সুনান, হাদীছ নং-২৬০; ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদীছ নং-৮৪৫৭।
– ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, হাদীছ নং-৫০০৬; ইমাম বাইহাক্বী, শুয়াবুল ঈমান, হাদীছ নং-৪৯৭৪।
– ইমাম নাস্য়াী, আস-সুনানুল কুবরাহ, হাদীছ নং-৫৯১০; ইমাম তিরমিযী, আস-সুনান, হাদীছ নং-২৬৫৫; ইমাম ইবনু মাযাহ, আস-সুনান, হাদীছ নং-২৮।
– আল-কুরআন, সূরা: হুদ-১১:১৫।
– আল-কুরআন, সূরা: শুরা-৪২:২০।
– ইমাম শা‘রানী, আত-তাবাক্বাতুল কুবরাহ, পৃ.নং-৭৩।
– ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদীছ নং-১৫৭৪০; ইমাম মুহাম্মদ ইবনু সা‘দ, তাবাকাতুল কুবরাহ, হাদীছ নং-৯৪২৯।
– ইমাম ইবনুল ক্বায়্যিম আল-জাউযী, আল-জাওয়াবুল কাফী লি-মান সা’লা আনিদ-দাওয়াইশ-শাফী, পৃ,নং-৩৪।
– ইমাম শা‘রানী, আত-তাবাক্বাতুল কুবরাহ, পৃ.নং-১০৬।
– আল-কুরআন, সূরা: আল-‘আলা-৮৭:১৬ ও ১৭।
– আল-কুরআন, সূরা: বাকারা-০২:১৭৪।
– ইমাম মুসলিম, আস-সাহীহ, হাদীছ নং-৮৮৭; ইমাম নাসায়ী, আস-সুনান, হাদীছ নং-১৮৮; ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদীছ নং-৩১০।

লেখক: দাওয়াত-এ খায়র সম্পাদক, গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ, চন্দনাইশ উপজেলা।

Share:

Leave Your Comment