আরশের মেহমানের রাজসিক মর্যাদা মি’রাজের প্রতিটি লহমায়

আরশের মেহমানের রাজসিক মর্যাদা মি’রাজের প্রতিটি লহমায়

মুফতি মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান আল কাদেরী

মানব ইতিহাসে মি’রাজুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন এক অবিস্মণীয়, বিষ্ময়কর ও অভূতপূর্ব ঘটনা যা পরিপূর্ণ জ্ঞাত হওয়া কিংবা উপলদ্ধি করা আদৌ জ্ঞান-গরিমা ও বিবেক বুদ্ধির বহির্ভূত। এটা সবিস্তার জানা ও বুঝা সম্ভব না কারও পক্ষে। যুক্তির নিরিখে অনুধাবন করা ব্যর্থ চেষ্টা ছাড়া অন্য কিছুই নয়। যদিও কেউ কেউ তা করে থাকে। বুঝতে হবে দয়াল রবের তরফ থেকে দয়াল নবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুজিযা এটা। যেখানে অন্যান্য মুজিযা বুঝা ও পরিমাপ করা অসম্ভব সেক্ষেত্রে এমন অসাধারণ মুজিযা যা আকল দিয়ে হৃদয়ঙ্গম করার দাবি যেন জলের মাছের ডাঙ্গায় জীবন। সব যুক্তিতে মুক্তি মেলা আসলে ভার। বিশেষ করে শরিয়ত ও অলৌকিক বিষয়ে যুক্তি অনেক ক্ষেত্রে পথভ্রষ্টতার কারণ হয়ে থাকে। কাজেই পথভ্রষ্টতা থেকে মুক্তির প্রত্যয়ে যুক্তি এড়িয়ে পবিত্র মি’রাজকে মানতে ও দেখতে হবে পরিপূর্ণ ঈমান-বিশ্বাস ও প্রেম ভালবাসার দর্পণে। বিশ্বাস ও হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত পবিত্র মি’রাজ ইসলামের অনেক কিছুকে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রেখেছে। যেমন আত্তাহিয়্যাহ সহ নামাযের অন্যান্য বিষয়, মহানবীর প্রকৃতরূপ, উসিলা গ্রহণ, নবীগণ জীবিত, অসাধারণ অভিবাদন জ্ঞাপন, উম্মতের মাগফেরাত, শাফায়াতের গুরুত্বসহ আক্বিদা ও আমলগত অনেক মাসআলার সুস্পষ্ট সমান। বিশেষ করে শ্রেষ্ঠ নবীর অনন্য সাধারণ সম্মান-মর্যাদা হিরন্ময় দ্যুতিতে ভাস্বর এ মি’রাজ। পবিত্র মি’রাজ দয়াল নবীর সর্বোচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন বর্ণনার আলোকে। মর্যাদাভরা ফুল বাগানের অগণিত ফুল থেকে দু’একটির আলোকপাত করার প্রয়াস চালাব মাত্র এ প্রবন্ধে।

মি’রাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি পরতে পরতে দেখা যায়। দয়াল নবীর শান ও মর্যাদা, অপরিসীম ও অসাধারণ। বিচ্ছিন্নভাবে শুরু করলেও দেখা যায় হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম মহানবীর দরবারে এসে জাগ্রত করলেন অমিয় কথায়। সাথে ছিল সত্তর হাজার ফেরেশতার বিশাল বহর। এমন সম্মানের নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বাহন হিসেবে নিয়ে আসলেন বোরাক নামের জান্নাতি পশু, যা এমন দ্রুতগতি সম্পন্ন যে, বর্তমান প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগেও এত দ্রুতগামী যান আবিষ্কার হয়নি এবং হবেওনা কখনো। যা ছিল সুসজ্জিত তাও প্রিয় নবীর সম্মানের লক্ষ্যে। এমন শোভিত ও অলংকৃত জান্নাতী বোরাক নবীর কদমে পেশ করা হলে ঘটে ভিন্ন চিত্র। বোরাক নাচতে থাকে নবীজির সম্মুখে। তুমি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে এমন করছ? হযরত জিবরাঈল বললেন বোরাককে সম্বোধন করে। আল্লাহ তা‘আলার নিকট সর্বাধিক সম্মানিত ও মহিমান্বিত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এমন নবীর মতো তোমার উপর আরোহণ কেউ করেননি। কি বিষ্ময়কর! বোরাক মুখ দিয়ে কথা বলতে গিয়ে ব্যক্ত তাঁর উনার সম্মানের কথা আমিও জানি। আরও জানি তিনিই একমাত্র শাফায়াতে কুবরার মালিক, কাজেই আমি প্রত্যাশা করি তিনি যেন আমাকে শাফায়াতের অন্তর্ভুক্ত করেন। তার মনোরথ গ্রহণ পূর্বক দয়াল নবী ঘোষণা করেন, তুমি আমার শাফায়াতের শামিল। বর্ণনায় এসেছে, প্রিয় নবীর সম্মুখে এহেন আচরণের কারণে লজ্জায় এর ঘাম নিঃসৃত হচ্ছিল তখন। শিফা শরিফ ও শরহে শিফাসহ অন্যান্য নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে বিদ্যমান এ বর্ণনাটি। আসলে প্রিয় নবীকে পেয়ে বোরাক খুশীর আতিশয্যে এমন কান্ড করেছিল। কারণ বোরাক কেন যে কারও জন্য নবীজির সাক্ষাৎ ও দয়া জীবনের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি।

হাদিসের বর্ণনা মতে মহানবীর শাফায়াতের মতো অনন্য নিয়ামত কামনা করেছে বোরাক এবং তা লাভে ধন্যও হয়েছে। আর বর্তমানে নবীর উম্মত দাবীদার এমন উম্মত রয়েছে যারা শাফায়াতকে অস্বীকার করে, শাফায়াতের যারা আলোচনা ও চর্চা করে তাদেরকেও অপছন্দ ও ক্ষেত্র বিশেষে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকায়। তারা কেবল শাফায়াত অস্বীকর করে না মূলত তারা কুরআন-সুন্নাহর বাণীকে অমান্য করে। অথচ বোরাক একটি জন্তু হয়েও শ্রেষ্ঠ নবীর মর্যাদাকে মাথা পেতে চেয়ে নিল শাফায়াত। বলা বাহুল্য, এ টেকনোলজির যুগেও কেউ কেউ মহানবির স্বশরীরে মি’রাজ হয়নি, ঘুমে বা রূহ তথা আত্মার মি’রাজ হয়েছে বলে থাকে। মি’রাজ যদি স্বপ্নে হয়ে থাকে তাদের কথায়, তাহলে বোরাকের প্রয়োজন কেন? স্বপ্নযোগে মি’রাজের জন্য কোন বাহনের দরকার হয়না, বাহন ছাড়াই রূহ সরাসরি উর্ধ্বজগতে যাওয়া অবশ্যই সম্ভব। যেহেতু বোরাকের বিষয়টা নির্ভরযোগ্য হাদিসে উল্লেখ আছে, সেহেতু এটাকে না মানার সুযোগ নেই। কাজেই বোরাক ও রফরফের মাধ্যমে মিরাজ সংগঠিত হয়েছে বিধায় স্বপ্নযোগে মি’রাজ হয়েছে এই কথা বলার সুযোগ নেই। এ ছাড়া মি’রাজের বর্ণনার সূচনায় মহানবীর ক্ষেত্রে ‘আবদুন’ শব্দ উল্লেখ করেছেন মহান রব সূরা বনী ইসরাঈলে। সকলের জানা আছে ‘আবদুন’ শব্দের অর্থ দেহ ও আত্মা বিশিষ্ট ব্যক্তি। কাজেই ‘আবদুন’ শব্দ উল্লেখের মাধ্যমে স্বশরীরে মি’রাজ নিয়ে প্রশ্ন তোলা মানে কুরআন-হাদিসের সরাসরি অস্বীকার। বোরাক বা বাহন ব্যতিত প্রিয় নবীকে আরশে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রয়েছে মহান রবের। এরপরও এ কুদরতি ব্যবস্থা মূলত দয়াল নবীর প্রতি যথাযথ সম্মান জ্ঞাপনের নিমিত্তে। মহানবীর উচ্চ সম্মান-মর্যাদার ব্যবস্থা করে ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা, তারপরও নবীর সম্মান-ইজ্জতের প্রসঙ্গ সামনে এলে উন্নাসিকতা প্রকাশ ও উটকো মন্তব্য করে থাকে কিছু লোক। তাদের এহেন আচরণকে একটি অশনি সংকেত বলা যায়।

আকাশপথে বোরাকে করে বায়তুল মোকাদ্দাসে পৌছে গেলেন নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আগে থেকে সেখানে অপেক্ষমান ছিলেন হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম থেকে হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম পর্যন্ত নবী-রাসুলগণ। প্রিয় নবীর আগমনে সকল নবী-রাসুল অপেক্ষায় থাকার উদ্দেশ্য তাঁকে অভিনন্দন-মোবারকবাদ জ্ঞাপন এবং সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো। আমাদের প্রিয় নবীজি নিজেই ঘোষণা করেন, সৃষ্টির সূচনা থেকে অন্ত পর্যন্ত আমি সর্বাধিক সম্মানিত। এই হাসিদটি ইমাম বুখারি রহমাতুল্লাহি আলায়হি সহীহ বুখারীতেও বর্ণনা করেছেন।
সকল নবীর উপস্থিতিতে নামাযের ইকামত দিলেন হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম। কিন্তু ইমামতির খালি জায়গায় সামনে গিয়ে তা পূরণ করে কার ইমামতিতে নামায পরিচালিত হবে। যেখানে উপস্থিত আদম ছাফিউল্লাহ, নূহ নাজিহুল্লাহ, ইব্রাহিম খলিলউল্লাহ, মুসা কলিমউল্লাহ ঈসা রুহুল্লাহ আলাইহিমুস সালাম ও উলুল আযম নবী সহ অন্যান্যরা। সামনে গিয়ে নামায পরিচালনার মাধ্যমে অনবদ্য সৌভাগ্যের মুকুট কার মাথায় শোভা পাবে। এরইমধ্যে নীরবতার প্রাচীর ভেঙ্গে সসম্মানে দয়াল নবীর হাত ধরে জায়নামাযে নিয়ে গেলেন হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম। যার বর্ণনা সুনানে নাসায়ীসহ অন্যান্য হাদিসগ্রন্থে বিদ্যমান। সেই বিলক্ষণ সময়ে প্রতিভাত হলো আজকে জায়নামাযে অবস্থান করে কমান্ড করবেন না সকল নবীদের মাঝে কেউ, এমনকি ছফিউল্লাহ, কলিমউল্লাহ, খলিলউল্লাহ সহ অন্যান্যরা। সবার ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করে সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে আসীন হয়ে নামায পরিচালনা করবেন একমাত্র হাবিবউল্লাহ। বায়তুল মোকাদ্দাসে বাস্তবে সেটাই ঘটেছে, তাইতো তিনি সকল নবীরও নবী। সকল সৃষ্টির মাঝে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুটের অধিকারী দয়াল নবী মোস্তফা।

ইমাম ক্বাসতালানী ও অন্যান্য ইমামদের বর্ণনানুসারে ওই সময় বায়তুল মোকাদ্দাসে সকল নবী নিজের প্রাপ্ত নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে মহান রবের মহিমা প্রকাশের মাধ্যমে ভাষণ প্রদান করেন। গোনাহগার উম্মতের কান্ডারী প্রিয় নবী আল্লাহ তা‘আলার তরফ থেকে প্রাপ্ত নিয়ামতের কথা উল্লেখপূর্বক রবের গুণাগুণ বর্ণনা করেন। পাশাপাশি আপন উম্মতের মর্যাদা তুলে ধরেন নবীগণের এ মহাসমাবেশে। অন্যান্য নবীর বক্তব্যে স্ব স্ব উম্মতের প্রসঙ্গ ওঠে আসেনি, একমাত্র ভিন্নতা ঘটেছে প্রিয় নবীর ক্ষেত্রে। প্রিয় নবী উম্মতের জন্য কত বড় দয়াবান ও দয়াপরবশ এটা বুঝতে বোধ হয় বোদ্ধার প্রয়োজন হয়না। কিন্তু এরপরও এ মহাসত্যকে অস্বীকার করে কেউ কেউ উদ্গত মানসিকতায়। সকল নবীর বক্তব্যের শেষে হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম দাড়িয়ে ঘোষণা করেন- এই জন্যই আপনাদের সকলের ওপর মহান রব এ নবীকে শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা দান করেছেন। ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের এ অমোঘ বক্তব্য সকল নবী সাদরে গ্রহণ ও মেনে নিলেও বর্তমানে অনেকের মানতে কষ্ট হয় যা আসলে বিদঘুটে প্রবণতা বৈকি।

বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে একটি একটি করে সপ্তম আসমান অতিক্রম করেন বোরাকে ভর করে। প্রত্যেক আসমানে বিশেষ বিশেষ নবীগণ মি’রাজের মহান মেহমানকে সাদর অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেছেন। মহানবীকে কত সম্মান ও মর্যাদা দান করেছেন তা লেখে ও বলে শেষ করা যাবে না কখনো। যার কিছুটা ঝলক ও চমক প্রতিভাত হয় পবিত্র মি’রাজে। আজকের লেখা শেষ করব বিশ্বজোড়া ইমাম আরিফ বিল্লাহ আল্লামা আবদুল ওহাব শারানী রহমাতুল্লাহি আলায়হির একটি বক্তব্য কোড করে। তদ্বীয় কিতাব ‘আল ইওয়াকিত ওয়াল জাওয়াহির’ এ তিনি উল্লেখ করেন, সিদরাতুল মুনতাহা থেকে আরশ পর্যন্ত অগণিত নূরানী পর্দার প্রত্যেকটি আল্লাহ তাআলার গুণবাচক নামে বিশেষিত। প্রত্যেকটি পর্দা অতিক্রমকালে মহান রবের গুণবাচক নামে গুনান্বিত হয়েছেন এবং এগুলোর বরকতের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে প্রিয় নবীজির পবিত্র সত্তার মাঝে। ইমাম শারানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি আরও উল্লেখ করেন- কোনটি পর্দা ‘রাহিম’ নামে, কোনটা ‘গাফুর’ কোনটা ‘হালিম’ কোনটা ‘কারিম’ কোনটা ‘শাকুর’ ইত্যাদি নামের পর্দাসমূহ গমনকালে প্রত্যেকটি নামের বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয়েছেন আল্লাহর প্রিয় হাবিব। মোদ্দাকথা নবীজির সর্বাধিক মান-মর্যাদার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে দিয়েছেন মহান রব মি’রাজের মাধ্যমে। অধুনাকালে সেই মি’রাজের চর্চা ও প্রতীতি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে মুসলিম সমাজে। পবিত্র মি’রাজের চেতনার মহিরুহটি অঙ্কুরিত হোক পুনরায় মুসলিমের ঘরে ঘরে। সেটিই প্রত্যাশা করছি।

লেখক: প্রধান ফকিহ, কাদেরিয়া তৈয়্যেবিয়া আলিয়া কামিল মাদরাসা, ঢাকা।

Share:

Leave Your Comment