রসূলুল্লাহর প্রতি আগুনও সম্মান প্রদর্শন করতো

রসূলুল্লাহর প্রতি আগুনও সম্মান প্রদর্শন করতো

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান

আগুনের কাজ জ্বালানো। সেটার সৃষ্টিও এ কাজের জন্য। কিন্তু মহান স্রষ্টা আল্লাহ্ তা‘আলা সেটাকে পরম সম্মানিত নবী ও রসূলগণ আলায়হিমুস্ সালাম-এর প্রতি আদব দেখানোর শিক্ষা দিয়েছেন। পবিত্র ক্বোরআনে হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম-এর ঘটনা থেকে এর অকাট্য প্রমাণ পাওয়ায় যায়। যখন হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম নমরূদের অগ্নিকুণ্ডে পৌঁছলেন, তখন আল্লাহ্ তা‘আলা তাৎক্ষণিকভাবে আগুনকে নির্দেশ দিলেন-يَا نَارُ كُوْنِىْ بَرْدًا وَّ سَلاَمًا عَلى اِبْرَاهِيْمَ তরজমা: হে আগুন! হয়ে যা শীতল ও নিরাপদ ইব্রাহীমের উপর। [সূরা আম্বিয়া: আয়াত-৬০: কানযুল ঈমান]
এ কারণেই আজ পর্যন্ত আগুন নবী-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাচ্চা ওয়ারিস আউলিয়া-ই কেরাম বরং ইসলামের প্রত্যেক মুক্বাদ্দাস জিনিষের প্রতিও আদব বা সম্মান বজায় রাখে। নিম্নে কয়েকটা উদাহরণ পেশ করা হলো-

এক. হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর দস্তরখানা
হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে- সাইয়্যেদুনা আনাস ইবনে মালিক সাহাব-ই রসূল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ঘরে কয়েকজন মেহমান আসলেন। তিনি তাঁদেরকে খানা খাওয়ালেন। যখন তাঁরা আহার গ্রহণ করলেন, তখন ব্যঞ্জনের শুরবাহ্ ইত্যাদি লেগে যাওয়ার কারণে দস্তরখানাটা হলদে ও ময়লাযুক্ত হয়ে গেলো। তিনি সেবিকাকে বললেন, ‘‘দস্তরখানাটাকে আগুনে ফেলে দাও। নির্দেশ অনুসারে খাদিমাহ্ দস্তরখানাটা চুলোর জ্বলন্ত আগুনে ফেলে দিলো? কিন্তু খোদা তা‘আলার ক্বুদরতে দস্তরখানাটাকে আগুন জ্বালালো না; বরং কিছুক্ষণ পর যখন সেটাকে চুলোর আগুন থেকে বের করে আনা হলো, তখন দেখা গেলো, দস্তরখানা অক্ষত রইলো এবং ময়লা-আবর্জ্জনাগুলো জ্বলে সেটা একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেলো। মেহমানগণ এমন অস্বাভাবিক ঘটনা দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন! তাঁরা আরয করলেন, ‘‘এ দস্তরখানায় এমন কি বৈশিষ্ট্য আছে, যার কারণে সেটাকে আগুন জ্বালালো না?’’ হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বললেন-
گفت زانكه مصطفى دست ودهاں
بس بماليد اندريں دستر خوان
অর্থ: (তিনি বললেন) হুযূর মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ দস্তরখানা দ্বারা আপন হাত ও মুখ মুবারক মুছেছেন। এর বরকতে আগুন সেটার উপর প্রভাব ফেলতে পারে না। [মসনবী শরীফ]

দুই. সাইয়্যেদাহ্ ফাত্বিমা যাহরাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার রুটি
হুযূর সরওয়ার-ই আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম একদা সাইয়্যেদাতুন্নিসা ফাতিমা যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আন্হার ঘরে তাশরীফ নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন হযরত ফাত্বিমা খাতুনে জান্নাত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা চুলোয় রুটি লাগাচ্ছিলেন। নবী-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ফরমালেন, ‘‘কন্যা! তুমি একটু বিশ্রাম নাও! চুলোয় বাকী রুটিগুলো আমি লাগাচ্ছি।’’ সাইয়্যেদা খাতুনে জান্নাতও রহমত ও স্নেহ ভরা নির্দেশ সাদরে পালন করলেন। হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজ হাত মুবারক দ্বারা কিছু সংখ্যক রুটি তান্দুরে লাগালেন। আল্লাহরই কুদরত! অবশিষ্ট সব রুটি পেকে তৈরী হয়ে গেলো; কিন্তু রসূল-ই আক্বদাস সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজ হাত মুবারকে যে রুটিগুলো লাগিয়েছিলেন, সেগুলো যেমন ছিলো তেমনি কাঁচা রয়ে গেলো। সাইয়্যেদাহ্ যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা হতভম্ব হয়ে আরয করলেন, ‘‘আব্বা হুযূর! আপনার লাগানো রুটিগুলো তো পাকছেনা। কাঁচা রয়ে গেলো কেন?’’ জবাবে হুযূর-ই আক্রাম এরশাদ ফরমালেন, ‘‘হে ফাত্বিমা! আশ্চর্যবোধ করোনা! রুটিগুলো আমার হাতের স্পর্শধন্য হয়েছে। যে জিনিষকে আমার হাত মুবারক স্পর্শ করে, সেটার উপর আগুনের প্রভাব পড়তে পারেনা।’’
শায়খুল মুহাদ্দিসীন ‘আলাল ইত্বলাক্ব হযরত শায়খ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এ ঘটনা উল্লেখ করে একথা প্রমাণ করেছেন যে, ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের সময় কা’বা-ই মু‘আয্যামার উঁচু জায়গায় বসানো বোত্গুলোকে সরকার-ই রেসালত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজের হাত মুবারক দ্বারা এজন্য নিচে ফেলেননি যে, বোতগুলো তো পবিত্র ক্বোরআনের ঘোষণানুযায়ী জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে, যদি হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজের পবিত্রতম হাতে সেগুলোকে নিচে ফেলে দিতেন, তবে তো সেগুলোকে জাহান্নামের আগুন জ্বালাতে পারতো না, এ কারণেই তিনি হযরত শেরে খোদা আলী মুশকিল কোশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে বলেছিলেন, ‘‘আমার কাঁধের উপর ওঠে তুমি ওই বোতগুলোকে নিচে ফেলে দাও।’’ [মাদারিজুন্নবূয়ত: ২য় খন্ড: পৃ. ৪৮৬-৪৮৭]

আগুন রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর চুল মুবারকের প্রতি আদব প্রদর্শন করেছে
কাশ্মীরের ইতিহাস সম্পর্কিত এক কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে যে, কাশ্মীরের ‘হযরত-বাল দরগাহ্ শরীফ’ থেকে নবী-ই পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর যেই চুল শরীফ হারিয়ে গিয়েছিলো, সেটাকে আগুন জ্বালাতে পারতোনা। কিতাবটা একজন নামকরা কাশ্মীরী ইতিহাসবিদ গোলামে গোলাম মুহিউদ্দীন সূফী মরহুম লিখেছেন। তিনি তাতে লিখেছেন, কাশ্মীরের এক শাসক একবার চুল মুবারককে পরীক্ষা স্বরূপ জ্বলন্ত আগুনে ফেলে দিয়েছিলেন।
দেখা গেছে আগুন তাতে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারেনি। তা অবিকল রয়ে গিয়েছিলো। ইতিহাসবিদ আরো লিখেছেন, চুল মুবারকটি ১৬৯৯ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ১১১১ হিজরীতে মদীনা মুনাওয়ারা থেকে নিশাপুরে আনা হয়েছিলো, যখন শাহানশাহ্ আওরঙ্গজেব আলমগীর ভারত শাসন করছিলেন।
[নাওয়া-ই ওয়াক্বত: লাহোর: ১ জানুয়ারী, ১৯৬৪ইং সংখ্যা]
এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে, চুল মুবারক তো হুযূর-ই আক্রাম নূরে মুজাস্সাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শরীর মুবারকের একটি অংশ। সেটাকে আগুন কিভাবে জ্বালাতে পারে; এ বেচারী আগুন তো ওই জিনিসকেও জ্বালাতে অক্ষম, যাকে নবী-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আপন হাত মুবারক দ্বারা শুধু স্পর্শ করেছিলেন; পূর্বে উল্লেখিত ঘটনা থেকে একথা প্রতীয়তমান হয়।

হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর চুল মুবারকের অনন্য সম্মান
হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর চুল মুবারকের মহা সম্মান ও মহা মর্যাদার কারণে আমরা আহলে সুন্নাতও আদব বজায় রাখি। হুযূর-ই পাক আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর চুল মুবারকের খোদ্ আল্লাহ্ তা‘আলা শপথ করেছেন- وَالضُّحَى وَالَّيْلِ اِذَا سَجى (তরজমা: চাশ্তের শপথ এবং রাতের শপথ যখন তা পর্দা আবৃত করে। (সূরা দ্বোহা: আয়াত-১ ও ২, কানযুল ঈমান) কোন কোন তাফসীরকারকের মতে, আয়াতে চাশ্ত (পূর্বাহ্ন মানে হুযুর-ই আক্রাম-এর সৌন্দর্যের আলো এবং ‘রাত’ মানে তাঁরই সুবাসিত যুলফী। (রূহুল বয়ানের বরাতে তাফসীর-ই খাযাইনুল ইরফান।) কবি বলেন-
بوصف رخش والضحى گشت نازل
چو والليل شد زلف وخال محمد صلى الله عليه وسلم
অর্থ: হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর চেহারা-ই আন্ওয়ারের বর্ণনায় ‘সূরা ওয়াদ্ব্ দ্বোহা’ নাযিল হয়েছে, যেভাবে وَالَّيْلِ শব্দটি হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কালো বর্ণের যুল্ফী ও কালো বর্ণের তিল শরীফের দিকে ইঙ্গিত করছে।

চুল মুবারক সম্পর্কে নবী-ই আকরামের ইরশাদ
হযরত আলী শেরে খোদা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, আমি নবী-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি, তিনি নিজের চুল মুবারককে হাতে নিয়ে এরশাদ ফরমাচ্ছিলেন, যে ব্যক্তি আমার একটি চুলকেও কষ্ট দিয়েছে অর্থাৎ সেটার প্রতি বে-আদবী বা অশালীনতা প্রদর্শন করেছে, তাঁর উপর আল্লাহ্ তা‘আলা জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। [কান্যুল ওম্মাল: ৬ষ্ঠ খন্ড: পৃ. ২৭]
হুযূর-ই আকরাম আরো এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আমার চুলকে কষ্ট দিয়েছে, সে আমাকে কষ্ট দিয়েছে, যে আমাকে কষ্ট দিয়েছে, সে আল্লাহ্ তা‘আলাকে কষ্ট দিয়েছে। তার উপর আল্লাহ্ তা‘আলা যমীন ও আসমানের সম পরিমাণ লা’নত করেন। তার কোন ফরয ও নফল ইবাদত কবুল হবে না।

অনন্য মু’জিযা
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব, সিদ্দীক্বে আকবর হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দাড়ি মুবারকের চুল নিয়ে ঘরে আসলেন এবং সেগুলোকে অত্যন্ত যত্ন ও সম্মানের সাথে ঘরের ভিতর রাখলেন। কিছুক্ষণ পর ক্বোরআন মজীদ তিলাওয়াতের শব্দ শোনা গেলো। সিদ্দীক্ব-ই আকবার ওই কামরায় আসলেন। তখনো দস্তুর মতো ক্বোরআন পাকের তিলাওয়াত জারি ছিলো; কিন্তু তিলাওয়াতকারী নজরে আসলো না। আশ্চর্যান্বিত হয়ে সিদ্দীক্ব-ই আক্বার হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র দরবারে এসে ঘটনা বর্ণনা করলেন। হুযূর-ই আক্রাম তা শুনে মুচকি হাসলেন আর বললেন, ‘‘ফেরেশতাগণ আমার চুল মুবারকের নিকট এসে ক্বোরআন তিলাওয়াত করেন।
[জামে‘উল মু’জিযা, শরহে হাদাইক্বে বখশিশ, আল্লামা ফয়য আহমদ ওয়াইসী]
—০—

মহাপরিচালক-আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।

Share:

Leave Your Comment