শীতের আগমন ও মুমিনের ইবাদত

শীতের আগমন ও মুমিনের ইবাদত

গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির

শীতকাল আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত। শীতের সময় নফল রোজা রাখার দারুণ সময়। কাজা রোজা বাকি থাকলে তা আদায় করার জন্যও শীতের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য আল্লাহর দান। হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেছেন, ‘শীতকাল হলো ইবাদতকারীদের জন্য গনিমতস্বরূপ।’ শীত তো এমন গনিমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ), যা কোনো রক্তপাত কিংবা চেষ্টা ও কষ্ট ছাড়াই অর্জিত হয়। সবাই কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই এ গনিমত স্বতঃস্ফূর্তভাবে লাভ করে এবং কোনো প্রচেষ্টা বা পরিশ্রম ব্যতিরেকে তা ভোগ করে। হযরত আবু সাঈদ খুদরি রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘শীতকাল হচ্ছে মোমিনের বসন্তকাল।’ (মুসনাদে আহমাদ)

বায়হাকির বর্ণনায় রয়েছে, ‘শীতের রাত দীর্ঘ হওয়ায় মোমিন রাত্রিকালীন নফল নামাজ আদায় করতে পারে এবং দিন ছোট হওয়ায় রোজা রাখতে পারে।’ শীতকাল এলে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলতেন, ‘হে শীতকাল! তোমাকে স্বাগতম! শীতকালে বরকত নাজিল হয়; শীতকালে রাত দীর্ঘ হওয়ায় নামাজ আদায় করা যায় এবং দিন ছোট হওয়ায় রোজা রাখা যায়।’
হযরত মুআজ ইবনে জাবাল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর মৃত্যুর সময় তাঁকে তাঁর কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি মৃত্যুর ভয়ে কাঁদছি না; বরং (রোজার কারণে) গ্রীষ্মের দুপুরের তৃষ্ণা, শীতের রাতের নফল নামাজ এবং ইলমের আসরগুলোতে হাজির হয়ে আলেমদের সোহবত হারানোর জন্য কাঁদছি।’
আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত আছে, ‘নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যদি কোনো তীব্র ঠান্ডার দিন আল্লাহর কোনো বান্দা বলে, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু (আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই), আজকের দিনটি কতই না শীতল! হে আল্লাহ! জাহান্নামের জামহারি (ভয়াবহ শাস্তি) থেকে আমাকে মুক্তি দিন।” তখন আল্লাহ জাহান্নামকে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমার এক বান্দা আমার কাছে তোমার জামহারি থেকে আশ্রয় চেয়েছে। আমি তোমাকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি তাকে আশ্রয় দিলাম।’
সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন, জামহারি কী? নবীজি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘জামহারি এমন একটি ঘর যাতে অবিশ্বাসী, অকৃতজ্ঞদের নিক্ষেপ করা হবে এবং এর ভেতরে তীব্র ঠান্ডার কারণে তারা বিবর্ণ হয়ে যাবে।’ (আমালুল ইয়াওম ওয়াল লাইল: ৩০৬)।
শীতকালে সঠিকভাবে অজু করা, অজুর অঙ্গ ধোয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা; প্রতিটি অঙ্গের যতটুকু স্থানে পানি পৌঁছানো দরকার ততটুকু স্থানে পানি পৌঁছানো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ আমল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তিনটি আমল পাপ মোচন করে সংকটকালীন দান, গ্রীষ্মের রোজা ও শীতের অজু।’ (আদ দোয়া লিত তাবরানি: ১৪১৪)
রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের জানাব না? কিসে তোমাদের পাপ মোচন হবে! এবং মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে!’ সাহাবায়ে কিরাম বললেন, ‘অবশ্যই! হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম!’ তিনি বললেন, ‘শীতের কষ্ট সত্ত্বেও ঠিকভাবে অজু করা।’(মুসলিম: ২৫১; তাফসিরে কুরতুবি)

তীব্র শীতে কষ্ট হলে গরম পানি দিয়ে অজু করাতে কোনো বাধা নেই। অজুর পর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মুছে ফেলাতেও সমস্যা নেই। শীতের তীব্রতা যদি কারও সহ্যের বাইরে চলে যায়, পানি গরম করে ব্যবহার করার সুযোগ না থাকে এবং ঠান্ডা পানি ব্যবহারে শারীরিকভাবে ক্ষতি হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে, তাহলে তিনি অজুর পরিবর্তে তায়াম্মুম করতে পারেন। (বায়হাকি, খ-: ১, হাদিস: ২২৬)
হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁর ছেলের উদ্দেশে বলেন, ‘শীতের দিনে ভালোভাবে অজু করা বড় গুরুত্বপূর্ণ ও সওয়াবের কাজ।’ আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি কি তোমাদের এমন কাজের কথা বলব না! যা দ্বারা গুনাহ মাফ হয় এবং মর্যাদা বৃদ্ধি হয়?’ সাহাবিরা বললেন, ‘অবশ্যই হে আল্লাহর রাসুল!’ তিনি বললেন, ‘মন না চাইলেও অজু করা, অধিক পদক্ষেপে মসজিদে যাওয়া এবং এক নামাজের পর আরেক নামাজের জন্য অপেক্ষা করা।’( মুসলিম শরীফ)
শীতকালে সঠিকভাবে অজু করা, অজুর অঙ্গ ধোয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা; প্রতিটি অঙ্গের যতটুকু স্থানে পানি পৌঁছানো দরকার ততটুকু স্থানে পানি পৌঁছানো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ আমল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তিনটি আমল পাপ মোচন করে সংকটকালীন দান, গ্রীষ্মের রোজা ও শীতের অজু।’ (আদ দোয়া লিত তাবরানি: ১৪১৪)।

নেককার পুণ্যাত্মা ব্যক্তিরা শীতের রাতগুলোয় সালাত ও জিকিরে রত হন। শীতকাল আগমন করলে উবাঈদ বিন উমাঈর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলতেন, ‘হে কোরআনের ধারক! তোমাদের রাতগুলো তিলাওয়াতের জন্য প্রলম্বিত করা হয়েছে, অতএব তা পড়তে থাকো। আর রোজা রাখার জন্য তোমাদের দিনগুলো সংক্ষেপিত করা হয়েছে, তাই বেশি বেশি রোজা রাখো।’ কোরআনের ভাষায়, ‘তারা রাতের সামান্য অংশই এরা ঘুমিয়ে কাটায়, আর রাতের শেষ প্রহরে এরা ক্ষমা চাওয়ায় রত থাকে।’ (সুরা-৫১ জারিয়াত, আয়াত: ১৭-১৮)

লেখক: প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক, উপস্থাপক ও সিনিয়র সহ-সভাপতি বুড়িচং প্রেসক্লাব, কুমিল্লা।

Share:

Leave Your Comment