মানসিক প্রশান্তির খোঁজে

মানসিক প্রশান্তির খোঁজে

মাওলানা মুহাম্মদ আবুল হাশেম

এ দুনিয়ায় সকলেই শান্তি খোঁজে। শান্তি মানে মানুষের মন-মগজ পরিপূর্ণ প্রশান্ত হওয়া। তার কোন প্রকারের কষ্ট, ভয় এবং শঙ্কা না থাকা। বর্তমানে মানুষ অস্থিরতা ও ডিপ্রেশনের শিকার। কিছু ক্ষেত্রে মানুষের স্বীয় অস্থিরতার কারণসমূহের ব্যাপারে অবগতি অর্জিত হয়, কিন্তু যখন মানুষের জীবনে ওই পরিস্থিতি আসে যে, মানুষ স্বীয় ডিপ্রেশনের কারণসমূহ থেকে অনবহিত হয়, তখন ওই ডিপ্রেশনের ভয়াবহ রূপ কল্পনা করা যায়। এ কারণে ওই দেশসমূহে, যেগুলোকে ‘উন্নত দেশ’ বলে ধারণা করা হয়, যারা শিক্ষা, সংস্কৃতি, কালচারের দিক থেকে অনেক অগ্রসর, যেখানে আমদানি-রপ্তানি সর্বাধিক হয়ে থাকে, সেখানেও মানুষ অস্থিরতা, অধৈর্য এবং অশান্তিতে রয়েছে, তাহলে কারণ কী?

লোকেরা প্রশান্তির খোঁজে নানা উপায় অবলম্বন করে থাকে। কিছু লোক সহায়-সম্পদ বেশি থেকে বেশি জমা করার চেষ্টা করে, যাতে তাদের শান্তি মিলে যায়; কিছু লোক ভ্রমণ ও আনন্দ-মজাকে প্রাধান্য দেয়, এটা ভেবে যে, তাতে তাদের প্রশান্তি অর্জিত হবে। এ কারণে তারা বহু সংখ্যক দেশের মাটিতে পাড়ি জমান, কিন্তু প্রশান্তি তাদের মিলে না। কিছু লোক পার্কসমূহ, উদ্যান, বিনোদন কেন্দ্রসমূহকে নির্বাচন করে, এ আশায় যে, হয়ত সেখানে অন্তরের প্রশান্তির পরশ মানিক কাক্সিক্ষত অর্থে পেতে পারে, কিন্তু সেখানেও তাদের কিছুই হাতে আসে না। আর কিছু দূর্ভাগা তো এমনও রয়েছে, যারা মদ, যিনা, ব্যভিচার, আমোদ-ফুর্তি, গান-বাজনার মধ্যে শান্তি খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করে এবং হতে পারে গান-বাজনার মধ্যে তাদের কিছু ঐচ্ছিক শান্তি হাসিল হয়, কিন্তু যখন ওই ঐচ্ছিক আনন্দের প্রভাব শেষ হয়ে যায়, তখন ওই ব্যক্তিই আরো বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে দেখা যায়।
؎ مرض بڑھتا گیا جوں جوں دوا کی  রোগ বৃদ্ধি পেতেই থাকল, যা যা চিকিৎসা করলাম

 প্রশান্তি আছে কোথায়?
রব তাবারকা ওয়া তা‘আলা ক্বোরআন মাজীদে ইরশাদ করেন: اَلَا بِذِكْرِ اللّٰهِ تَطْمَىٕنُّ الْقُلُوْبُ.
“শুনে নাও, আল্লাহর ‘যিকর’ (স্মরণ)-এ অন্তরের প্রশান্তি রয়েছে।” (তরজমা-ই কানযুল ঈমান)

অন্তরের প্রশান্তি শুধু আল্লাহ্ তা‘আলার যিকর-এর মধ্যে রয়েছে। ক্বোরআন ঘোষণা করছে, শান্তি ও প্রশান্তি তো কেবল আল্লাহর যিকরে আছে। আমাদের মধ্যে এমন বহু সংখ্যক ব্যক্তি আছেন, যারা ক্বোরআন কারীমের এ আয়াতকে পূর্বে অনেকবার পড়েছেন, কিন্তু আমাদের মধ্যে এমন ক’জন রয়েছেন, যাদের নিকট এ কথার পরিপূর্ণ দৃঢ়বিশ্বাস রয়েছে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা মানবজাতির অন্তরের শান্তি ও প্রশান্তি শুধু স্বীয় যিকরের মধ্যে রেখেছেন। হায়! ওই সব লোক, যারা প্রশান্তির খোঁজে দিকবিদিক ছুটে বেড়াচ্ছে, তারা এ কথা বুঝে নিত যে, তাদের দুশ্চিন্তার চিকিৎসা এবং তাদের অন্তরের প্রশান্তি আল্লাহ্ তা‘আলা স্বীয় যিকরের মধ্যে বিদ্যমান রেখেছেন।

অন্তরের প্রশান্তির জন্য এ কথা জরুরী ও আবশ্যক যে, মানুষের সম্পর্ক আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে গভীর হওয়া, নিজের সর্বপ্রকারের পেরেশানির সমাধান সেটার মাধ্যমেই অর্জন করবে। যার জন্য পরিপূর্ণ ঈমান ও দৃঢ়বিশ্বাস জরুরী। এতে কোন সন্দেহ নেই, যে অন্তর খোদার ভয়ে আবাদ থাকে, যে অন্তর আল্লাহর স্মরণের ভাণ্ডার হয়, যা প্রতি মুহুর্তে তাঁরই ভয়ে কম্পমান থাকে এবং তাঁরই রহমতে প্রশান্ত থাকে, যার সকাল-সন্ধা রবের তাসবীহ ও পবিত্রতা বর্ণনা করার মধ্যে অতিবাহিত হয়, এমন ব্যক্তির জন্য কঠিন থেকে কঠিনতর অবস্থাদিও একেবারে সাধারণ ও নিম্ন পর্যায়ের হয়ে থাকে। সে তার সাধারণ পেরেশানি দেখে আহাজারি, শোরগোল পাকায় না আর না খোদার রহমত থেকে নিরাশ হয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায়, বরং নিজের পূর্ণাঙ্গ ঈমান, দৃঢ় বিশ্বাস এবং অটল আত্মবিশ্বাসের কারণে সর্বাবস্থায় প্রশান্ত ও স্থির থাকে। ক্বোরআন পাকের নানা স্থানে আল্লাহ্ রাব্বুল ইয্যত ঈমানদারদেরকে স্বীয় যিক্র ও স্মরণের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইরশাদ করেন: فَاذْكُرُوْنِیْۤ اَذْكُرْكُمْ وَ اشْكُرُوْا لِیْ وَ لَا تَكْفُرُوْنِ.
“সুতরাং আমার স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ করবো আর আমার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো এবং আমার অকৃতজ্ঞ হয়ো না।” (তরজমা-ই কানযুল ঈমান)

ক্বোরআন ও হাদীসে আল্লাহ তা‘আলাকে স্মরণ করার অসংখ্য ফাযাইল ও মানাক্বিব এসেছে। সর্বোপরি একটি ফযীলত কোন অংশে কম নয় যে, যখন বান্দা খোদাকে স্মরণ করে, তখন আল্লাহ্ তা‘আলাও ওই বান্দাকে স্মরণ করে। যেমন: হুযূর-ই আক্বদাস সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
أَنَا عِنْدَ ‌ظَنِّ ‌عَبْدِيْ بِيْ، وَأَنَا مَعَهُ إِذَا ذَكَرَنِيْ، فَإِنْ ذَكَرَنِيْ فِي ْ نَفْسِهِ ذَكَرْتُهُ فِي نَفْسِيْ، وَإِنْ ذَكَرَنِيْ فِي مَلَإٍ ذَكَرْتُهُ فِي مَلَإٍ خَيْرٍ مِنْهُمْ، وَإِنْ تَقَرَّبَ إِلَيَّ بِشِبْرٍ تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ ذِرَاعًا، وَإِنْ تَقَرَّبَ إِلَيَّ ذِرَاعًا تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ بَاعًا، وَإِنْ أَتَانِيْ يَمْشِي أَتَيْتُهُ هَرْوَلَةً.

“আমি সেরূপই আচরণ করি, যেরূপ বান্দা আমার প্রতি ধারণা রাখে। আমি বান্দার সাথে থাকি যখন সে আমাকে স্মরণ করে। যদি সে মনে মনে আমাকে স্মরণ করে; আমিও তাকে (নিজের শান মোতাবেক) স্মরণ করি। আর যদি সে জনসমাবেশে আমাকে স্মরণ করে, তবে আমিও তাদের চেয়ে উত্তম সমাবেশে (তথা ফিরিশতাদের সমাবেশ) তাকে স্মরণ করি। যদি সে আমার দিকে এক বিঘত এগিয়ে আসে, তবে আমি তার দিকে এক হাত এগিয়ে যাই, যদি সে আমার দিকে এক হাত অগ্রসর হয়; আমি তার দিকে দু’ হাত এগিয়ে যাই। আর সে যদি আমার দিকে হেঁটে আসে, আমি তার দিকে দৌঁড়ে যাই।”

আল্লাহর যিকর মু’মিনদের অন্তরসমূহের খোরাক। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ আল্লাহর যিকরে রত থাকবে, ততক্ষণ তার অন্তর স্থির ও প্রশান্ত থাকবে। যেমন: মাছ পানির মধ্যে, পক্ষীকুল বাতাসে এবং পশু জঙ্গলে সুখী প্রফুল্ল থাকে; অর্থাৎ প্রত্যেকেরই নিজ নিজ স্থান ও পর্যায় রয়েছে, যখনই সে সেখানে পৌঁছে, তার স্থিরতা ও প্রশান্তি অর্জিত হয়, অনুরূপ যখনই পরিবেশ-পরিস্থিতির শিকার, দুঃখ ভ্রারাক্রান্ত, নির্যাতিত, অস্থির, অশান্ত ব্যক্তি আপন রবকে স্মরণ করে, তখন তার সকল দুঃখ-দুর্দশা হালকা হয়ে যায়, তার অস্থিরতা ও অশান্তি স্থিরতা ও প্রশান্তিতে রূপ নেয়। কিন্তু যখনই মানুষের হৃদয়ে আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীনতার পর্দা আচ্ছাদিত হয় কিংবা ব্যক্তি উদাসীনদের সোহবতের শিকার হয়, তখন তাৎক্ষনিক অন্তরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়া শুরু হয়ে যায়। যেমন: মাছকে পানির বাহিরে রাখা হলে কিংবা পক্ষীকে পানিতে ডুবিয়ে দিলে এবং পশুকে খাঁচায় বন্দি করা হলে হয়ে থাকে।
হুযূর নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: مَثَلُ الَّذِيْ ‌يَذْكُرُ ‌رَبَّهُ وَالَّذِيْ لَا يَذْكُرُ مَثَلُ الْحَيِّ وَالْمَيِّتِ.
“যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা‘আলার ‘যিকর’ (স্মরণ) করে, আর যে করে না, উভয়ের দৃষ্টান্ত হচ্ছে- জীবিত ও মৃত। অর্থাৎ রবকে স্মরণকারী জীবিত, আর যে রবকে স্মরণ করে না, সে যেন জীবিত থেকেও মৃত।”

 অন্তরের প্রশান্তি অর্জনের উপায়
এখানে একটা প্রশ্ন তৈরী হয় যে, আল্লাহ্ তা‘আলার যিকর দ্বারা অন্তরসমূহের প্রশান্তি কীভাবে লাভ হয়? সেটার জবাব হচ্ছে, হাদীসে পাকে হযরত আবূ হোরায়রা এবং হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলাপ আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: “যেসব লোক আল্লাহ্ তা‘আলাকে স্মরণ করে এবং তাঁর যিকরের মাহফিল সাজায়, ফিরিশতারা তাদেরকে বেষ্টন করে নেয়, আল্লাহর রহমত তাদেরকে ডেকে নেয়, তাদের উপর প্রশান্তি অবতীর্ণ হয় এবং আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর নিষ্পাপ ফিরিশতাদের মধ্যে তাদের আলোচনা করেন।” (মুসলিম শরীফ, ২য় খ-, কিতাবুয্ যিকর ওয়াদ্ দো‘আ, পৃ. ৩৪৫)

অপর স্থানে রয়েছে, আমার বান্দা আমার যিকর করে এবং তার ঠোঁট নড়াচড়া করে, তখন আমি তার সাথে থাকি। অর্থাৎ বান্দা আল্লাহর স্মরণে মশগুল হয়ে যায়, তার স্মরণের মাহফিল সাজায়, তখন তার উপর নূররাশি, তাজাল্লিরাশি এবং রহমতের অবতরণ হয়, ফিরিশতাকুল সেখানে উপস্থিত হয় আর বান্দার জন্য এ সম্মাননা হয় যে, তার রব, স্রষ্টা, মালিক তাকে স্মরণ করে এবং যিকরের সময় তিনি স্বীয় বান্দার নিকটে হন। সুতরাং যেখানে স্বয়ং রব হন, স্রষ্টা ও মালিক হন, সেখানে ভয়-ভীতি কীভাবে আসতে পারে? সেখানে অস্থিরতা কীভাবে আসবে? সেখানে তো শান্তি আর শান্তি থাকে।

 যিকর দ্বারা উদ্দেশ্য কী?
যিকর কী এটাই যে, শুধু মুখে আল্লাহ্ তা‘আলার তাসবীহ পড়বে এবং তার অন্তর আল্লাহর স্মরণ এবং তাঁর ভয় থেকে মুক্ত হবে, এটা কখনো নয়, বরং নামায, রোযা, দো‘আ-মুনাজাত, সকাল-সন্ধার যিকরসমূহ, ক্বোরআন তিলাওয়াত ইত্যাদি হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার যিক্রের নানা পদ্ধতি। যেগুলোর শিক্ষা আল্লাহ্ তা‘আলা স্বীয় বান্দাদেরকে দিয়েছেন। কিন্তু ওইসব ইবাদত ও মুনাজাত-এর উদ্দেশ্য শুধু একটিই যে, মানুষের অন্তরে এ অনুভূতি সৃষ্টি হবে যে, আমার রব সবসময় আমার সাথে রয়েছেন এবং জীবনের পরিস্থিতি যেরূপই হোক না কেন, তিনি আল্লাহ্ প্রতি মুহুর্তে সবসময়ে আমার সাথে রয়েছেন। আমার রব কখনো নিজ বান্দাকে সহায়হীন, সাহায্যকারী বিহিন ছেড়ে দিবেন না, আমার আল্লাহ্ই প্রকৃত কর্মবিধায়ক। আর তিনিই সত্য মা’বূদ এবং তার জীবন  আয়াতের নিম্নোক্ত কার্যত দৃশ্য হবে- قُلْ اِنَّ صَلَاتِیْ وَ نُسُكِیْ وَ مَحْیَایَ وَ مَمَاتِیْ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ.
“আপনি বলুন, নিঃসন্দেহে আমার নামায, আমার ক্বোরবানীগুলো, আমার জীবন এবং আমার মরণ-সবই আল্লাহর জন্য, যিনি প্রতিপালক সমগ্র জাহানের।”

অতএব, যখন মানুষ এ অবস্থায় জীবন অতিবাহিত করবে যে, তার অন্তরে সবসময় আল্লাহ্ তা‘আলার স্মরণ থাকবে, তার নামায, রোযা, ক্বোরবানী, জীবন-মরণ, তার সকল মেহনত, প্রচেষ্টা, জীবনের সকল অগ্রাধিকার ও উদ্দেশ্যাবলি শুধু আল্লাহ্ রাব্বুল ইয্যত-এর সন্তুষ্টি ও খুশির খাতিরে হবে, তাহলে দেখবেন পরিস্থিতি যেমনই হোক, তার জীবন প্রশান্তিতে কাটে।

আপনারা জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে দেখুন, তাহলে বুঝবেন খোদা তা‘আলাকে স্মরণকারী কত আরাম ও শান্তির জীবন পেয়ে থাকে। তাদের কোন প্রকারের কোন পেরেশানী হয় না, কোন কিছুর ভয় ও শংকা থাকে না, সে সদাসর্বদা অপন রবের যিক্র ও ইবাদতে রত থাকে। আরাম ও প্রশান্তি সেখানেই হয়, যেখানে আল্লাহর স্মরণ হয়; যেখানে তাঁর প্রিয় মাহবূব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কথা বলা হবে। আজকের এ পুজিবাদী সমাজে যেখানে সবদিকে অন্ধকাররাশি ছেঁয়ে আছে, যুলম ও অন্যায় ক্রমবর্ধমান, অবাধ্যতা, নাফরমানির জয়জয়কার, ব্যক্তিত্ব ও আত্মসংযমের বিলীনতা, চরিত্রের অধ:পতন, নানা প্রকারের রোগ-ব্যাধির জন্ম হচ্ছে, নফসী নফসী পরিস্থিতি, সেটার কারণ হচ্ছে, শুধু যিকর-ফিকরের হ্রাস পাওয়া। আসুন, অন্তরে যিকরের প্রদীপ প্রজ্বলিত করার সংকল্প করি, কেননা আল্লাহরই স্মরণে অন্তরের প্রশান্তি রয়েছে।

 যিকর ত্যাগ করার অশুভ পরিণতি
মানুষ থেকে সংঘটিত সকল মন্দের সর্বাধিক বড় ও গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে, মানুষ আপন রবকে স্মরণ না করা। এ কারণেই যে সকল ব্যক্তি আপন রব থেকে যত বেশি গাফিল হয়, সে ততবেশি মন্দের সাথে মিশ্রিত হয়। তার রাত-দিন পাপাচারে অতিবাহিত হয়। তার জীবন উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়ে, আর এ মানুষ যখন গাফিলতীর শেষ সীমায় পৌঁছে যায়, তখন তার নিজে বান্দা হওয়াও স্মরণে থাকে না, পরিশেষে নিজেকে ‘খোদা’ বলে ঘোষণা করে বসে এবং দৃষ্টান্তমূলক পরিণতির শিকার হয়। অপরদিকে মানুষের আপন রবকে স্মরণ করা, কল্যাণের ওসীলাহ্ হয়; সুতরাং যে ব্যক্তি যত বেশি আপন রবকে স্মরণ করে, সে তত বেশি নেকী সম্পাদনকারী হিসেবে নজরে আসে। এক সময় এমন আসে যে, সে উন্নতি ও খোদার নৈকট্যের ওই স্তরে উপনীত হয় যে, স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলা ওই বান্দার ব্যাপারে ইরশাদ করেন: كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِيْ يَسْمَعُ بِهِ، وَبَصَرَهُ الَّذِيْ يُبْصِرُ بِهِ، وَيَدَهُ الَّتِيْ يَبْطِشُ بِهَا، وَرِجْلَهُ الَّتِي يَمْشِيْ بِهَا.

“আমি তার কান হয়ে যাই, যা দ্বারা সে শুনে; তার চোখ হয়ে যাই, যা দ্বারা সে দেখে; তার হাত হয়ে যাই, যা দ্বারা সে ধরে; তার পা হয়ে যাই, যা দ্বারা সে পদচারণা করে।”

এ জন্য আল্লাহ্ তা‘আলা ক্বোরআন হাকীমে বিভিন্ন স্থানে নানাভাবে স্বীয় বান্দাদেরকে নিজের স্মরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং ভুলে যাওয়া থেকে ভীতি প্রদর্শন করেন। যেমন: আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন: یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تُلْهِكُمْ اَمْوَالُكُمْ وَ لَاۤ اَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللّٰهِۚ -وَ مَنْ یَّفْعَلْ ذٰلِكَ فَاُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْخٰسِرُوْنَ.
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ, না তোমাদের সন্তান-সন্ততি কোন কিছুই যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন না করে; এবং যে কেউ তেমন করে, তবে ওই সমস্ত লোক ক্ষতির মধ্যে রয়েছে।” (কানযুল ঈমান)

 ইরশাদ হচ্ছে,
وَ مَنْ اَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِیْ فَاِنَّ لَهٗ مَعِیْشَةً ضَنْكًا وَّ نَحْشُرُهٗ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ اَعْمٰى.
“আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তবে তাঁর জন্য রয়েছে সংকুচিত জীবন যাপন এবং আমি তাকে ক্বিয়ামতে অন্ধ অবস্থায় উঠাবো।”

মুনাফিকদের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন যে, তাদের অন্যসব দোষ-ত্রুটির সাথে সাথে একটি দোষ এও রয়েছে যে, তারা আল্লাহ্র যিক্র খুবই কম করে।
اِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ یُخٰدِعُوْنَ اللّٰهَ وَ هُوَ خَادِعُهُمْۚ- وَ اِذَا قَامُوْۤا اِلَى الصَّلٰوةِ قَامُوْا كُسَالٰىۙ- یُرَآءُوْنَ النَّاسَ وَ لَا یَذْكُرُوْنَ اللّٰهَ اِلَّا قَلِیْلًا.
“নিশ্চয় মুনাফিক লোকেরা নিজের ধারনায়, আল্লাহকে প্রতারিত করতে চায়; বস্তুত তিনিই তাদেরকে অন্যমনষ্ক করে মারবেন; আর যখন নামাযে দাঁড়ায়, তখন মনভোলা অবস্থায়, মানুষকে দেখায় (মাত্র) এবং আল্লাহকে স্মরণ করে না কিন্তু কম সংখ্যক লোক।”

তারা তো স্পষ্ট গোমরাহীতে রয়েছে, যাদেরকে আল্লাহ্ তা‘আলার যিকর শোনানো হয়, কিন্তু তবুও তাদের অন্তর আল্লাহ্ তা‘আলার যিকরের প্রতি ধাবিত হয় না, সুতরাং এমন লোকদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে ধ্বংস, লাঞ্ছনা, অপমান রয়েছে; এসব লোক আল্লাহ্ তা‘আলার যিকর থেকে উদাসীন হয়ে দুনিয়ার রংতামাশা, আরাম-আয়েশে মগ্ন রয়েছে, আল্লাহকে স্মরণ করার সুযোগই নেই। এ লোকদেরকে যখন কেউ আল্লাহর যিকরের প্রতি আগ্রহী করে কিংবা আহ্বান করে, তখন তারা ওই দা‘ঈ (আহ্বানকারী)’র দা’ওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে। আর বাস্তবতা হচ্ছে, যিকর থেকে উদাসীনতার কারণে তাদের অন্তর মৃত হয়ে গেছে, তাদের গৃহ কবরস্থানে পরিণত হয়েছে, সে স্বয়ং নানা ধরনের বিপদাপদগ্রস্ত হয়ে থাকে, অস্থিরতা, অশান্তি, পেরেশানী অবস্থায় থাকে। এ আয়াত দ্বারা আশ্রয় প্রার্থনা করুন এবং খেয়াল করুন- আল্লাহর বাণী: وَ مَنْ یَّعْشُ عَنْ ذِكْرِ الرَّحْمٰنِ نُقَیِّضْ لَهٗ شَیْطٰنًا فَهُوَ لَهٗ قَرِیْنٌ.
“এবং যে রহমানের স্মরণ থেকে বিমুখ হয়, আমি তার জন্য একটা শয়তান নিয়োগ করি, যাতে সে তার সাথী হয়ে থাকে।”
আজকাল মুসলমান সহজেই গুনাহের প্রতি ধাবিত হচ্ছে, যুলম-এর প্রতি অগ্রসর হচ্ছে, আমোদ-ফুর্তিতে মত্ত হচ্ছে, মাদক সেবনে আসক্ত হচ্ছে,-এ সব মন্দকর্মের মূল বিষয় ও কারণ হচ্ছে, রবের যিক্র থেকে উদাসীনতা। যখনই বান্দা রবের যিকর থেকে গাফিল হয়, তখন সে শয়তানের খেলনা হয়ে যায়, শয়তাক তাকে যেদিকে ইচ্ছা, সহজেই নিয়ে যেতে পারে।
 রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন: اِسْتَحْوَذَ عَلَیْهِمُ الشَّیْطٰنُ فَاَنْسٰىهُمْ ذِكْرَ اللّٰهِؕ- اُولٰٓىٕكَ حِزْبُ الشَّیْطٰنِؕ -اَلَاۤ اِنَّ حِزْبَ الشَّیْطٰنِ هُمُ الْخٰسِرُوْنَ. “তাদের উপর শয়তান বিজয়ী হয়ে গেছে, সুতরাং সে তাদেরকে ভুলিয়ে দিয়েছে আল্লাহর স্মরণ। তারা শয়তানের দল। শুনছো! নিশ্চয় শয়তানেরই দল ক্ষতির মধ্যে রয়েছে।”
আল্লাহ্ তা‘আলা আমরা সকল মুসলমানকে স্বীয় যিকরের তাওফীক্ব দান করুন এবং উদাসীনতা থেকে রক্ষা করুন। আমীন, বিহুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালীন।

টিকা:

আল্ ক্বোরআন, সূরা (১৩) রা’দ, আয়াত: ২৮
আল্ ক্বোরআন, সূরা (২) বাক্বারা, আয়াত: ১৫২
বোখারী, আস্ সহীহ, কিতাবুদ দা’ওয়াত, হা/ ৭৪০৫
পূর্বোক্ত, হা/ ৬৪০৭
আল্ ক্বোরআন, সূরা (৬) আন‘আম, আয়াত: ১৬২
বোখারী, আস্ সহীহ, কিতাবুর রিক্বাক্ব, বাবুত তাওয়াদ্বা‘উ, হা/ ৬৫০২
আল্ ক্বোরআন, সূরা (৬৩) মুনাফিক্বূন, আয়াত: ০৯
আল্ ক্বোরআন, সূরা (২০) ত্বোয়াহা, আয়াত: ১২৪
আল্ ক্বোরআন, সূরা (৪) নিসা, আয়াত: ১৪২
আল্ ক্বোরআন, সূরা (৪৩) যুখরুফ, আয়াত: ৩৬
আল্ ক্বোরআন, সূরা (৫৮) মুজাদালাহ্, আয়াত: ১৯

লেখক: পরিচালক, আনজুমান রিসার্চ সেন্টার ও খতীব, নওয়াব ওয়ালী বেগ খাঁ জামে মসজিদ, চকবাজার, চট্টগ্রাম।

Share:

Leave Your Comment