রাসূলুল্লাহর হালফুল ফুযূল বর্তমানেও আদর্শ সমাজ গঠনে সহায়ক

রাসূলুল্লাহর হালফুল ফুযূল বর্তমানেও আদর্শ সমাজ গঠনে সহায়ক

মুহাম্মদ আরিফুর রহমান রাশেদ

মহানবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীতে তাশরিফ এনেছেন মানব জীবনে শান্তি ও সামগ্রিক কল্যাণ বয়ে আনার জন্য। তিনি যেমন ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ, তেমনি ছিলেন সর্বগুণে গুণান্বিত। তিনি অন্যায়, অবিচার, পাপাচার, যুলুম ও শোষণ থেকে মানব জীবনকে মুক্ত করে একটি আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন, যা কিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির মুক্তি ও আলোকবর্তিকার ভূমিকা পালন করবে। আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে তিনি জন্মগ্রহণ করেন আরবের মক্কা নগরীতে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর উপর পবিত্র কুরআন নাযিল হয়। যে পবিত্র কুরআন মানবজাতির জন্য হিদায়তের পথ প্রদর্শনকারী। কুরআন মাজীদের ভাষ্য অনুযায়ী তাঁর গোটা জীবন মানব জাতির জন্য আদর্শ। বিশেষ করে তাঁর যৌবন কালের শুরুতে গঠিত সেবা সংঘ ‘হালফুল ফুযূল’ আজকের দিনেও মানব গোষ্ঠীকে পথ দেখাতে পারে আদর্শ সমাজ গঠনে।

হালফুল ফুযূল প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট
হালফুল ফুযূল প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে হারবুল ফিজারের ভূমিকা। আরব জাহানে জাহেলি যুগে পরিচালিত যুদ্ধসমূহের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও প্রসিদ্ধ যুদ্ধ ছিল এই হারবুল ফিজার যুদ্ধ। একদা আরব দেশে ওকায মেলায় জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে কুরাইশ ও কায়েশ বংশের মধ্যে এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। ইসলামের ইতিহাসে এটি হারবুল ফিজার বা অন্যায় যুদ্ধ বা পাপাচারীদের যুদ্ধ নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক ইবনে হিশামের বর্ণনামতে ১৪ বছর বয়সে এবং ঐতিহাসিক ইসহাকের মতে ২০ বছর বয়সে হুযূর পুরনুর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজে তার চাচা জুবাইয়েরর সাথে হারবুল ফিজার যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। এ যুদ্ধ দীর্ঘ পাঁচ বছর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। ৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে শুরু হওয়া মক্কার রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধে রসূল করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম দারুণভাবে ব্যতিত হন। কারণ এ যুদ্ধে অনেক নারী বিধবা হয় এবং অনেক শিশু এতিম হয়ে পড়ে, অনেক লোক মৃত্যুবরণ করেন, অনেক লোক হতাহত হয়। এ ভয়াবহ যুদ্ধের দৃশ্য দেখে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র প্রাণ কেঁদে উঠে। মক্কার আরবদের বিভৎসতা পাপাচার, শিশু হত্যা ও কুসংস্কার নির্মূলের চিন্তা হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র অন্তরকে ব্যথিত করে। কিভাবে দেশে শৃংখলা রক্ষা করা যায়, শান্তি ফিরানো যায়। এ প্রত্যাশা কিভাবে পূরণ হবে? অবশেষে আরবের ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ বন্ধ, সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষা ও অসভ্য সমাজকে সুসভ্য ও সুশৃংখল সমাজে রূপান্তর করার নিমিত্তে মক্কার প্রতিটি উদারপন্থী ও উৎসাহী কিশোরদের নিয়ে হালফুল ফুযূল বা ফজলদের চুক্তি বা সংঘ নামে একটি সংগঠনের গোড়া পত্তন করেন।

হালফুল ফুযূলেল প্রতিজ্ঞাসমূহ
আরবে পূর্ব নিয়ম ছিল নিজেদের আত্মীয়-স্বজন, স্বগোত্রস্থ বা স্ববংশস্থ কোন ব্যক্তি কোন লোক শত অন্যায়-অত্যাচার করলেও সকলকে তার সমর্থন করতে হত। অন্যায় অত্যাচারের বিচার করাই অন্যায় বলে বিবেচিত হত। আলোচ্য পরামর্শ সভার সদস্যবর্গ স্থির করলেন আরবের এ ব্যবস্থা নিতান্ত অন্যায় এবং সর্বনাশের প্রধান কারণ। অতএব এ অন্যায় ও অধর্মের মূলোৎপাটন করতে হবে। তারা প্রতিজ্ঞা করলেন।
১. আমরা দেশের অশান্তি দূর করার যথাসাধ্য চেষ্টা করব।
২. দরিদ্র অসহায় লোকদের সহায়তায় আমরা এগিয়ে আসব।
৩. বিদেশি লোকদের জান-মাল রক্ষায় যথাসাধ্য চেষ্টা করব।
৪. বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনের চেষ্টা করব।
৫. অত্যাচারীকে প্রাণপণে বাধা প্রদান করব ও মাযলুমের সার্বিক সাহায্যে এগিয়ে আসব। প্রতি কাজে হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে মান্য করব।

হালফুল ফুযূলের সুফল
তখনকার দিনে হালফুল ফুযূল সেবা সংঘের প্রচেষ্টায় সমাজে অত্যাচার অবিচার অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছিল। মানুষের বসবাস যাতায়াত বহুগুণে নিরাপদ হয়েছিল। ইতিহাসের সর্বপ্রথম এটাই অন্যায় বিশৃংখলা দমনের জন্য গঠিত কল্যাণময়ী সেবা সংঘ। এ সংঘের মাধ্যমে হুজুর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সেবার এক মহৎ আদর্শ স্থাপন করেন। যুদ্ধের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের বিধবা, শিশু ও নিরাশ্রয়ের পুনর্বাসনে হালফুল ফুযূল জনগণের খেদমতে এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। মানব সেবায় অল্পদিনের মধ্যে এ সংগঠন গোটা আরবে খ্যাতি অর্জন করে। নবীজি এ সাংগঠনিক কার্যক্রমের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে অতি প্রিয় হয়ে উঠেন। এভাবে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র অসাধারণ অনুপম চরিত্র সত্য নিষ্ঠায় ও সততার নীতি সমগ্র আরবে ছড়িয়ে পড়ে এবং তিনি আল-আমীন উপাধিতে ভূষিত হন।

হালফুল ফুযূলের অনুসরণে এলাকা ভিত্তিক সংঘগুলো যে সব ভূমিকা রাখতে পারে
যৌবনের প্রারম্ভে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হালফুল ফুযূল গঠনে যে ভূমিকা রেখেছেন তার মধ্যে উত্তম আদর্শ খুজে পেতে পারে আমাদের তরুণ সমাজ। বর্তমানে এলাকায় এলাকায় নানা নামে, ক্লাব, সংঘ বা সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্থা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে ও করে চলছে। হালফুল ফুযূলের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য অভিন্ন রেখে বিভিন্ন সমিতি, ক্লাব- সংঘ বা সামাজিক সংগঠনের উদ্দ্যোগে অসহায় দুর্বল মানুষের সাহায্য করতে পারে। গরীব ঘরের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ায় সহযোগিতা ও উৎসাহ্ যোগাতে পারে। এলাকা ভিত্তিক সামাজিক সংগঠনগুলোতে এলাকায় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, বসবাসকারি বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোকজনের সম্মিলন ঘটে বলে এ সংগঠনগুলো চেষ্টা করলে এলাকার বহু সমস্যার সহজে সমাধানসহ এলাকার শান্তি ও আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। এলাকায় অবাধে মাদক বেচাকেনা বর্তমানে আরেকটি বড় সমস্যা। হাতের কাছে মুড়ি-মুড়িকর মতো মাদক সহজলভ্য হওয়ায় এলাকার উঠতি বয়সী ছেলেদের একটা বড় অংশ মাদকাসক্ত হচ্ছে। এলাকার আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। এ ক্ষেত্রে সংগঠনগুলো এলাকাবাসির সহযোগিতায় মাদক মুক্ত রাখতে পারে। এলাকা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, পরিবেশ দূষণ করে এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে না দেয়া, এলাকায় অসামাজিক কর্মকা- থেকে মুক্ত রাখার ক্ষেত্রে এ ধরনের সংগঠন প্রহরীর ভূমিকা পালনের সুযোগ আছে। তাছাড়া সংগঠনগুলো এলাকায় পাঠাগারের ব্যবস্থা করতে পারে। এতে এলাকার উঠতি বয়সী ছেলে মেয়েদের পাঠ অভ্যাস হবে। যা তাদের সৎ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়ক হবে। এ সব সংগঠনের উদ্যোগে বিভিন্ন দিবস উদযাপন করা যায়। সমাজে সংঘঠিত ছোট-খাট সামাজিক অপরাধের বিচার, এলাকাবাসির মধ্যে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বিরোধ থাকলে সে সব বিরোধ নিরসনে সংগঠন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসার ব্যবস্থা করে এলাকায় শান্তির আবহ বজায় রাখতে পারে। সকল প্রকার অনাচার, দূরাচার, অপরাধ প্রবণতা মুক্ত রেখে এলাকাকে আদর্শ এলাকায় রূপ দিতে এ ধরনের সংগঠনের ব্যাপক অবদান রাখার সুযোগ আছে।

লেখক: মুদাররিস, বেতাগী রহমানিয়া জামেউল উলুম দাখিল মাদরাসা, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।

Share:

Leave Your Comment