রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এক মুহূর্তও উম্মতকে ভুলেন না

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এক মুহূর্তও উম্মতকে ভুলেন না

মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস আলকাদেরী

আল্লাহi প্রিয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এক মুহূর্তও আপন উম্মতকে ভুলেন না। তিনি দুনিয়াতে শুভাগমনের পর সাজদায় পড়ে উম্মতকে তালাশ করেছেন। দুনিয়াবী হায়াত থেকে বিদায়ের প্রাক্কালেও উম্মতকে ভুলেননি। হাশরের ময়দানে ভয়াবহ মুহূর্তেও উম্মতকে ভুলবেন না। সকল মু’মিন উম্মতকে জাহান্নাম হতে উদ্ধার করে জান্নাতে নিয়ে আসবেন। একজন ঈমানদার উম্মতও জাহান্নামে থাকলে তিনি ক্ষান্ত হবেন না। বরং তখনই তিনি খুশি হবেন, যখন একজন মু’মিন উম্মতও দোযখে থাকবে না। আর সেদিন আল্লাহ্র উদ্দেশ্য হবে তাঁর হাবীবকে খুশী করা। এ বিষয়ে সম্যক আলোকপাত করবো ইন্শা-আল্লাহ্।

মোল্লা মুঈন ওয়ায়েজ রচিত প্রসিদ্ধ কিতাব মায়ারেজুন নুবূয়ত-এর ২য় খণ্ডে লিখেছেন, সাফিয়া বিনতে আবদুল মোত্তালিব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা বলেন, হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শুভাগমনের রাতে আমি তাঁর ধাত্রী ছিলাম।

সে রাতে আমি ছয়টি আলামত দেখলাম:

১. যখন তিনি ভূমিষ্ট হলেন, তখন সাজদারত ছিলেন।

২. মাথা মোবারক তুলে স্পষ্ট ভাষায় বললেন, لااله الّا الله اِنِّىْ رسول الله ।

৩. ঘরকে আমি নূরে পূরিপূর্ণ দেখলাম।

৪. যখন আমি তাঁকে গোসল করাতে চাইলাম, তখন আওয়াজ শুনলাম, হে সাফিয়া, তুমি কষ্ট করিও না। আমি তাঁকে গোসল করিয়ে প্রেরণ করেছি।

৫. তিনি খত্নাকৃত ছিলেন এবং নাভীও কর্তিত ছিল।

৬. যখন আমি তাঁকে শুয়াতে চাইলাম, তখন পৃষ্ঠ দেশে দু’কাধের মাঝখানে নুবূয়তের মোহর দেখলাম। যাতে লেখা لااله الله محمد رسول الله ।
হযরত সাফিয়া আরো বলেন, হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাজদায় পড়ে কি যেন বলছেন, আমি আমার কানকে তাঁর মুখের নিকট নিয়ে শুনলাম, তিনি বলছেন, উম্মতী উম্মতী (আমার উম্মত, আমার উম্মত) দেখুন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম দুনিয়াতে এসেই উম্মতকে স্মরণ করেছেন।
উম্মতের দরদী দুনিয়াতে এসে নবুয়ত প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে যে চল্লিশ বছর অতিবাহিত হয়েছে- তাতেও প্রতিটা মুহূর্তে উম্মতের মুক্তির চিন্তা করতেন।
সর্বদা উম্মতের সার্বিক কল্যাণে রত থাকতেন। নুবূয়ত প্রকাশিত হওয়ার পর ঈমান ও ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসার জন্য সচেষ্ট থাকতেন এবং নজিরবিহীন ত্যাগ স্বীকার করেন।
মহান আল্লাহ্ ইরশাদ করেন, وَكُنْتُمْ عَلَى شَفَا حُفْرَةٍ مِنَ النَّارِ অর্থাৎ তোমরা জাহান্নামের গর্তের কিনারায় উপনীত হয়েছিলে। অতঃপর তিনি (নবীজি) তোমাদেরকে তা হতে উদ্ধার করেন। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১০৩, মেরকাত]

ওফাতের সময়ও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে ভুলেননি। হযরত আযরাঈল আলায়হিস্ সালাম রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর রূহ মোবারক কব্জ করার জন্য এসে সালাম নিবেদন করে আরয করেন- আমি এসেছি সাক্ষাৎকারী ও রূহ কব্জকারী হিসেবে, আমাকে আমার রব এবং আপনার রব নির্দেশ দিয়েছেন, আপনার অনুমতি ব্যতীত আপনার রূহ কব্জ না করার জন্য। তখন তিনি বলেন, তুমি আমার ভাই জিবরাঈল আলায়হিস্ সালাম না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। তাঁরা কথোপকথনে আছেন, ইত্যবসরে ৬হযরত জিবরাঈল আলায়হিস্ সালাম এসে বললেন, হে আল্লাহ্ রাসূল! আপনাকে সালাম। আল্ বিদা, আল্ বিদা, সফর সফর। মহান অধিপতির সান্নিধ্যে গমনের সময় নিকটবর্তী হয়েছে।

তখন নবীজী বলেন, হে ভাই জিবরাঈল! ইনি মালাকুল মওত। তিনি আমার নিকট অনুমতি চান আমার রূহ কব্জ করার। তখন হযরত জিবরাঈল আলায়হিস্ সালাম বললেন, নিশ্চয় আপনি ইন্তিকাল করবেন, তারাও মৃত্যু বরণ করবে। প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আল্লাহ্ জাল্লা জালালুহু আপনাকে সালাম বলেছেন। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, হে ভাই জিবরাঈল! আমার পর আমার উম্মতের জিম্মাদার কে হবেন? হযরত জিবরাঈল আলায়হিস্ সালাম উত্তর দিলেন, হে ইয়া রাসূলাল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়কা ওয়াসাল্লাম! আপনার রব আপনাকে সালাম দিয়েছেন এবং বলছেন আপনার ইজ্জত ও মহত্বের শপথ আমি তাঁর দু’চোখ তাঁর উম্মতের ব্যাপারে ঠান্ডা করব। পবিত্র ক্বোরআনে ইরশাদ হয়েছে- অচিরেই আপনার রব আপনাকে দান করবেন, এতে আপনি খুশি হয়ে যাবেন। তখন নবীজী বললেন, এখন আমার আশা পূর্ণ হয়েছে। এবং আমার অন্তর ইন্তিকালের জন্য সন্তুষ্ট হয়েছে। আর আমি নিশ্চয় সে পর্যন্ত খুশি হব না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমার একজন উম্মতও জাহান্নামে থাকবে। এবং তিনি শোকরানা সাজদা আদায় করলেন। দেখুন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম দুনিয়া হতে চলে যাওয়ার সময়েও উম্মতকে ভুলেননি। বরং উম্মতকে আল্লাহ্ তা‘আলার কুদরতের হাতে তুলে দেন।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কিয়ামত দিবসের ভয়াবহ্ অবস্থায়ও উম্মতকে ভুলবেন না। বরং তিনি সাজদায় পড়ে বলবেন, হে আমার রব! আমার উম্মত, আমার উম্মত। অর্থাৎ হে আমার রব! আমার উম্মতকে দয়া করুন, আমার উম্মতকে ক্ষমা করুন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- এবং আমি আল্লাহ্র সমীপে সাজদাকারী হবো অতঃপর আমাকে বলা হবে, হে মুহাম্মদ! আপনি আপনার মাথা তুলুন এবং আপনি বলুন, আপনার ফরিয়াদ শুনা হবে। এবং আপনি যা চান, আপনাকে দেওয়া হবে। এবং আপনি সুপারিশ করুন, আপনার সুপারিশ কবুল করা হবে। তখন আমি বলব, হে আমার রব! আমার উম্মত, আমার উম্মত। (আমার উম্মতকে করুনা করুন এবং মার্জনা করুন।) তখন (আমার রবের পক্ষ হতে আমাকে বলা হবে আপনি জাহান্নামের দিকে চলুন এবং যার ক্বলবে এক যবের দানা পরিমাণ ঈমান আছে, তাকে জাহান্নাম হতে বের করুন। অতঃপর আমি জাহান্নামের দিকে যাব এবং তা করব। অর্থাৎ যার অন্তরে যবের দানা পরিমাণ ঈমান আছে, তাকে জাহান্নাম হতে মুক্ত করব। উক্ত রেওয়ায়াতে এসেছে, এভাবে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম চারবার সাজদায় নত হয়ে উম্মতি-উম্মতি বলবেন, এবং গুনাহগার উম্মতকে জাহান্নাম হতে উদ্ধার করে জান্নাতে নিয়ে আসবেন।
[মেরকাত, মেশকাতের পাদ টীকা]

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উম্মতের প্রতি বড় দয়ালু। উম্মত যখন কষ্ট পায়, তখন তিনিও কষ্ট পান। তিনি সর্বদা উম্মতের কল্যাণ কামনা করেন। যেমন আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, ‘‘নিশ্চয় তোমাদের নিকট তশরিফ আনায়ন করেছেন, তোমাদের মধ্য হতে ঐ রাসূল, যার নিকট তোমাদের কষ্টে পড়া কষ্টদায়ক। তোমাদের কল্যাণ অতিমাত্রায় কামনাকারী। মুমিনদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু, করুণাময়। [সূরা তাওবা, আয়াত নং ১২৮]

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের নিকট উম্মতের আমল পেশ হয়। হাদীসে পাকে এসেছে-
عن عبد الله بن مسعود رضى الله عنه عن النبى صلى الله عليه وسلم قال ان لله ملائكة سياحين يبلغون عن امتى السلام قال وقال رسول الله صلى الله عليه وسلم حياتى خير لكم تحدثون واحدث لكم ووفاتى خيرلكم تعرض علىّ عمالكم فَلَمَّا رأيت من خير حمدت الله عليه وما رأيت من شرّ تغفرت الله لكم-
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হতে, তিনি (নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) বলেন, আল্লাহ্র অনেক ভ্রমনকারী ফেরেশতা আছেন। তারা আমার নিকট আমার উম্মতের সালাম পৌঁছান। রাভী বলেন, এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার পার্থিব জীবন তোমাদের জন্য কল্যাণ। (এ পার্থিব জীবনে) তোমরা আমার সাথে কথা বল এবং আমি তোমাদের সাথে কথা বলি। এবং আমার পরকালীন জীবন তোমাদের জন্য কল্যাণময়। (কেননা আমার পরকালীন জীবনে) তোমাদের আমলসমূহ আমার নিকট পেশ করা হয়। সুতরাং আমি যখন তোমাদের নেক আমল দেখি, তখন সেটার উপর আল্লাহ্র প্রশংসা করি। আর যখন আমি তোমাদের বদ আমল দেখি, তখন আল্লাহ্র কাছে তোমাদের গুনাহ্ মাফ চাই। [খাছায়েছুল কুবরা: ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৮১]

দেখুন উপরিউক্ত হাদীসের বর্ণনা মতে, প্রতিনিয়ত উম্মতের আমল নবীজীর দরবারে পেশ হয়। তাই নবীর প্রতিটা নিমিষে উম্মতকে নিয়ে ব্যস্ত। উম্মতের নেক আমল দেখে খুশি হয়ে আল্লাহ্র প্রশংসা করেন ওই উম্মতের জন্য দো‘আ করেন এবং উম্মতের পাপ দেখে দুঃখিত হয়ে ওই উম্মতের পাপ মোচনের প্রার্থনায় আল্লাহর দরবারে সর্বদা ব্যস্ত থাকেন।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উম্মতের সাথে আছেন, আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
النَّبِىُّ أَوْلَىٰ بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنفُسِهِمْ- (নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ঈমানদারগণের প্রাণ থেকেও অতি নিকটে।) সুতরাং যিনি ঈমানদার উম্মতের প্রাণের চেয়ে অধিকতর নিকটে থাকেন ওই নবী কিভাবে আপন উম্মতকে ভুলতে পারেন? উম্মতদের দুঃখ, দুর্দশা, পিবদ-আপদগুলো নবীজী দেখেন। [সূরা আহযাব: আয়াত-০৬]

উম্মত গুনাহ্ করে নবীজীর দরবারে গিয়ে কিংবা যেখানে আছে সেখানে নবীজীকে উসিলা হিসেবে পেশ করে গুনাহ্ মাফ চাইলে তখন নবীজী সে উম্মতের জন্য আল্লাহ্র দরবারে ইস্তিগফার বা সুপারিশ করেন। ফলে আল্লাহ্ তা‘আলা সে উম্মতকে ক্ষমা করে দেন। যেমন মহান আল্লাহ্ পাক বলেন, যদি তারা (উম্মত) গুনাহ্ করে, আপনার কাছে যায়, অতঃপর আল্লাহ্র কাছে (আপনাকে উসিলা হিসেবে পেশ করে) ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর (আপনি রাসূল) তাদের জন্য আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা চান, তখন তারা আল্লাহকে তাওবা কবুলকারী, দয়ালু হিসেবে পাবে।

দেখুন, সর্বদা অসংখ্য উম্মত গুনাহ্ করে আল্লাহ্র দরবারে এ বলে ক্ষমা চায়, হে আল্লাহ্ আপনার নবীর উসিলায় আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, তখন নবীজী আল্লাহ্র কাছে সে উম্মতের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং বলেন, আল্লাহ্ আপনি আমার উম্মতকে মাফ করে দিন। এভাবে নূর নবীজী সর্বদা উম্মতের গুনাহ্ মাফ করানোর জন্য সদয় প্রস্তুত আছেন। ফলে এক মুহূর্তও তিনি উম্মতকে ভুলেন না।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া, চট্টগ্রাম।

Share:

Leave Your Comment