কালেমা-ই তাইয়্যিবার অসাধারণ মহত্ত্ব ও তাৎপর্য

কালেমা-ই তাইয়্যিবার অসাধারণ মহত্ত্ব ও তাৎপর্য

মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ্ আল-মাসুম

বিশ্বজুড়ে সকল মুসলমানের অন্তরে, মুখে মুখে বিরাজমান কালেমার ধ্বনি। ইসলামের মৌলিক পঞ্চভিত্তির প্রথমটিই এই ‘কালেমা’র সাক্ষ্য প্রদান। ‘কালেমা’র প্রতি বিশ্বাস ছাড়া কোন মানুষ মুমিন হতে পারেনা। তার কোন ইবাদতও আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য ও প্রতিদানযোগ্য হতে পারেনা। নেকির পাল্লায় এই ‘কালোমা’র ওজন সমস্ত আমল অপেক্ষা বেশি হবে। এমনকি সাত আসমান সাত জমিনের সবকিছু থেকেও ‘কালেমা’র ওজন বেশি হবে।’ আকাশের দৃশ্যমান কোন খুঁটি বা পিলার নেই। একথা কোরআন থেকে আমরা জানতে পারি। [সুরা রা’দ : ২।

কিন্তু অদৃশ্য খুঁটির কথা আমরা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামার হাদীস শরীফ থেকে জানতে পারি। তিনি ঘোষণা করেছেন- ‘যতদিন পৃথিবীতে আল্লাহ আল্লাহ বলা হবে ততদিন পৃথিবী ধ্বংস হবে না।’ কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, সাম্প্রতিককালে ইসলামী লেবাসধারী কিছু লোক মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য মাঠে নেমেছে। মুসলিম জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে বিজাতীয় হানাদারদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে মরিয়া হয়ে উঠেছে কিছু নামধারী মুসলমানও। তারা বিভিন্ন এনজিও সংস্থার ছত্রচ্ছায়ায় অর্থবলে, সেবার নামে অবান্তর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে (‘‘এই কালেমা নাকি কোনো হাদীসে নেই, এই কালেমা পড়া শিরক, যারা পড়বে তারা মুশরিক’’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ) বই পুস্তক বিতরণ করে জনমনে ধূম্রজাল সৃষ্টির ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে সরলমনা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করছে। তাই কালেমা সম্পর্কে এ নিবন্ধে আলোচনা করার প্রয়াস পেলাম। মহান আল্লাহ এই বসুন্ধরায় কালেমা প্রতিষ্ঠা করার জন্যই যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ আলায়হিমুস্ সালাম এর নিকট শরী‘আত প্রদান ও কিতাব নাযিল করেছেন।

মানুষ মুমিন ও কাফির, নেককার ও বদকার দু’ভাগে বিভক্ত এ কালেমার কারণে। এটি সে সত্য বাণী, যার ওপর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত ও কিবলা নির্ধারিত। ইরশাদ হচ্ছে –
إِذْ جَعَلَ الَّذِينَ كَفَرُوا فِي قُلُوبِهِمُ الْحَمِيَّةَ حَمِيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ فَأَنْزَلَ اللَّهُ سَكِينَتَهُ عَلَى رَسُولِهِ وَعَلَى الْمُؤْمِنِينَ وَأَلْزَمَهُمْ كَلِمَةَ التَّقْوَى وَكَانُوا أَحَقَّ بِهَا وَأَهْلَهَا
অর্থাৎ কাফিররা মুসলমানদের সাথে সেই অজ্ঞ যুগের বাড়াবাড়িতে লিপ্ত ছিল। এমতাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ও মুমিনদের ওপর স্বীয় প্রশান্তি অবতরণ করেন। আর তাদের জন্য তাকওয়ার কালেমা আবশ্যক করে দেন। যার সত্যিকার ধারক তারাই। এ আয়াতের তাফসীরে হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, এই তাকওয়ার কালেমাটি হলো “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ”। অনুরূপ তাফসীরের প্রায় পঞ্চাশের অধিক কিতাবে কালেমায়ে তাক্বওয়ার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ”।

অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে – وَ کَانَ تَحۡتَهٗ کَنۡزٌ لَّهُمَا অর্থাৎ “এবং তার নিচে ছিল তাদের গুপ্তধন।” উক্ত গুপ্তধনের ব্যাখ্যায় আমিরুল মুমিনীন হযরত উসমান ইবনে আফফান ও হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামা থেকে বর্ণনা করেন, সেটি ছিল স্বর্ণের একটি ফলক। তাতে নিম্নলিখিত উপদেশ বাক্যসমূহ লিখিত ছিল।

যথা- ১. বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। ২. সে ব্যক্তির ব্যাপারটি আশ্চর্যজনক, যে তকদীরে বিশ্বাস করে অথচ চিন্তাযুক্ত হয়। ৩. যে আল্লাহ্ তা‘আলাকে রিযিকদাতারূপে বিশ্বাস করে; এরপর প্রয়োজনাতিরিক্ত পরিশ্রম ও অনর্থক চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করে; ৪. সে ব্যক্তির ব্যাপারটি আশ্চর্যজনক, যে মৃত্যুতে বিশ্বাস রাখে; অথচ আনন্দিত ও প্রফুল্ল থাকে। ৫. সে ব্যক্তির ব্যাপারটি আশ্চর্যজনক, যে পরকালের হিসাব-নিকাশে বিশ্বাস রাখে, অথচ সৎ কাজে উদাসীন থাকে। ৬. সে ব্যক্তির ব্যাপারটি আশ্চর্যজনক যে দুনিয়ার নিত্যনৈমিত্তিক পরিবর্তন জেনেও নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকে। ৭. লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্। এ প্রসঙ্গে হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন,
عَنْ أنَسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ دَخَلْتُ الجَنَّةَ فَرَأيْتُ في عارِضَتِي الجَنَّةِ مَكْتُوباً ثَلاَثَةَ أسْطُرٍ بالذَّهَبِ السَّطْرُ الأوَّل لاَإلهَ إلا الله محمَّدٌ رَسوُلُ الله والسَّطرُ الثَّانِي ماقَدَّمْنا وَجَدْنا وما أكَلْنا رَبِحْنا وما خَلَّفْنا خَسِرْنا والسَّطْرُ الثَّالِثُ أُمَّةٌ مُذْنِبَةٌ وَرَبٌّ غَفُورٌ.
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি (মিরাজ রজনীতে) জান্নাতে প্রবেশ করে জান্নাতের উভয় পাশে স্বর্ণাক্ষরে ৩টি লাইন লেখা দেখলাম। ১ম লাইন : لَا إلهَ إلَّا اللهُ مُحَمَّدُ رَّسُوْلُ اللهِ অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত কোন মা’বুদ নেই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। ২য় লাইন : যা আমরা আগে পাঠিয়েছি তার প্রতিদান পেয়েছি, যা দুনিয়াতে পানাহার করেছি তা দ্বারা লাভবান হয়েছি। আর যা দুনিয়াতে ছেড়ে এসেছি তাতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। ৩য় লাইন : উম্মত গুনাহগার এবং প্রতিপালক ক্ষমাকারী।

কালেমা-ই তৈয়্যবা প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে বুরাইদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন,
عن يوسف بن صهيب، عن عبد اللَّه بن بريدة، عن أبيه، قال: انطلق أبو ذر ونعيم ابن عم أبي ذر، وأنا معهم يطلب رسول اللَّه صلّى اللَّه عليه وآله وسلّم وهو مستتر بالجبل، فقال له أبو ذر: يا محمد، أتيناك لنسمع ما تقول، قال: أقول لا إله إلا اللَّه محمد رسول اللَّه، فآمن به أبو ذر وصاحبه.
অর্থাৎ হযরত আবু যার ও নু‘আইম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামার খুঁজে বের হন। আমি তাঁদের সাথে ছিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তখন এক পাহাড়ের আড়ালে ছিলেন। তখন আবু যার গিফারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে বললেন, হে মুহাম্মদ! আপনি কি বলেন আমরা তা শুনতে এসেছি। তখন হুযুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” এর দাওয়াত দেই। অতঃপর তারা সকলে রাসূলুল্লাহর হাতে কালেমা পড়ে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন।
একদা হযরত দাহিয়াতুল কালবী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাওবা করার জন্য আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামার দরবারে গমন করে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি ৭০ জন জীবিত শিশুকন্যাকে নিজ হাতে দাফন করেছি। এ গুনাহ কি আল্লাহ তা‘আলা মাফ করবেন? রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, এ গুনাহ মাফ করবেন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে দাহিয়াতুল কালবী! তোমার কোন ভয় নাই, তোমার এ গুনাহ মহান রাব্বুল আলামীন মাফ করে দেবেন। তুমি পড় لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ. -(‘‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ”)।

এ প্রসঙ্গে হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা আরো বলেন,
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: كَانَتْ رَايَةُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سَوْدَاءَ وَلِوَاؤُهُ أَبْيَضُ، مَكْتُوبٌ عَلَيْهِ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ.
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামার ঝান্ডাটি ছিল কালো এবং পতাকাটি ছিল সাদা রঙের। এই পতাকায় লেখা ছিল “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ”। আর এ কালেমা তৈয়বা-(‘‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ”) প্রায় ২৫ থেকে ৩০টি নির্ভরযোগ্য হাদীসের বর্ণনায় এসেছে। মুহাদ্দিসগণের ভাষ্য মতে, যে সকল হাদীসের বর্ণনায় কালেমার পূর্ণ অংশ নেই, শুধুমাত্র لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ আছে, তা বালাগাত শাস্ত্রের কায়দাذكر الجزء ويراد به الكل (কোন বাক্যের অংশ উল্লেখ করে পুরো বাক্য বুঝানো) এর আলোকে হাদীসের মর্মার্থ পূর্ণ কালেমা তথা لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ। যেমন মহান আল্লাহর বাণী- فَكُّ رَقَبَةٍ অর্থাৎ গর্দানকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করা। আয়াতটি দাসমুক্তির ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে। গর্দান ক্রীতদাসের একটি অংশ কিন্তু উক্ত আয়াতে গর্দান মুক্তকরণ দ্বারা দাসমুক্তি বুঝানো হয়েছে, শুধু তার ঘাড় নয়।

কিয়ামত দিবসে সকল মানুষকে উক্ত কালেমা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। দু’টি মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হওয়া ব্যতিরেকে কোন বান্দার পা আল্লাহর সম্মুখ থেকে হটবে না: ১. তোমরা কার ইবাদাত করেছ? ও ২. রাসূলদের কী উত্তর দিয়েছ? প্রথম প্রশ্নের উত্তর: লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহর অর্থ জানা, একত্ববাদের স্বীকৃতি দেয়া ও তার ওপর আমল করে কালেমার বিধান বাস্তবায়ন করা। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর: মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর অর্থ জানা, নবীজিকে আল্লাহর রাসূল হিসেবে স্বীকার করা, তাঁর বশ্যতা মেনে নেওয়া ও তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে তার রিসালাহ বাস্তবায়ন করা। এই কালেমার মধ্যে মহান আল্লাহ তা‘আলার যে পরিচয় দেয়া হয়েছে তাই আল্লাহর সঠিক পরিচয়। আর হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কেবল একজন মানুষই নন, বরং তিনি আল্লাহর রাসূলও, আর এটা তাঁর আসল পরিচয়। বস্তুত: আল্লাহকে ভালবাসতে হলে প্রথমেই তাঁর বন্ধু মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামাকে ভালবাসতে হবে।

ইরশাদ হচ্ছে-
قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ ٱللَّهَ فَٱتَّبِعُونِى يُحْبِبْكُمُ ٱللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ۗ وَٱللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
অর্থাৎ ‘হে রাসূল! আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসতে চাও তবে প্রথমেই রাসূলের অনুসরণ করো তবেই আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং আল্লাহ তোমাদের মাফ করে দিবেন এবং তোমাদের গুনাহ সমূহ ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল করুণাময়।” উক্ত কালেমা পাঠের সুফল প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল ‘আস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
্রيُصَاحُ بِرَجُلٍ مِنْ أُمَّتِي عَلَى رُءُوسِ الْخَلائِقِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، فَيُنْشَرُ لَهُ تِسْعَةٌ وَتِسْعُونَ سِجِلا، كُلُّ سِجِلٍّ مِنْهَا مَدُّ الْبَصَرِ، ثُمَّ يَقُولُ اللَّهُ عز وجل لَهُ: ” أَتُنْكِرُ مِنْ هَذَا شَيْئًا؟ ” فَيَقُولُ: لا يَا رَبِّ، فَيَقُولُ عز وجل: أَلَكَ عُذْرٌ أَوْ حَسَنَةٌ؟ ” فَيَهَابُ الرَّجُلُ، فَيَقُولُ: لا يَا رَبِّ، فَيَقُولُ عز وجل: بَلَى إِنَّ لَكَ عِنْدَنَا حَسَنَاتٍ، وَإِنَّهُ لا ظُلْمَ عَلَيْكَ “، فَتُخْرَجُ لَهُ بِطَاقَةٌ فِيهَا: أَشْهَدُ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، فَيَقُولُ: يَا رَبِّ مَا هَذِهِ الْبِطَاقَةُ مَعَ هَذِهِ السِّجِلاتِ؟ فَيَقُولُ: إِنَّكَ لا تُظْلَمُ “.قَالَ: فَتُوضَعُ السِّجِلاتُ فِي كِفَّةٍ وَالْبِطَاقَةُ فِي كِفَّةٍ، فَطَاشَتِ السِّجِلاتُ وَثَقُلَتِ الْبِطَاقَةُ.
অর্থাৎ কিয়ামতের দিন সকল মানুষের সামনে আমার উম্মত থেকে এক ব্যক্তিকে উচ্চস্বরে ডাকা হবে, অতঃপর তার নিরানব্বইটি দফতর পেশ করা হবে, প্রত্যেক দফতরের দৈর্ঘ্য হবে চোখের দৃষ্টির সমপরিমাণ, অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: এসব থেকে কোনও একটি কি তুমি অস্বীকার কর? সে বলবে: না, হে আমার প্রতিপালক। আল্লাহ বলবেন: তোমার কোনো অজুহাত অথবা কোনো নেকী আছে কি? লোকটি ভয় পেয়ে যাবে এবং বলবে, হে আমার প্রতিপালক, না কোন নেকী নেই। আল্লাহ বলবেন: অবশ্যই, আমার কাছে তোমার একটি নেকী আছে, আর নিশ্চিত থাক তোমার ওপর যুলুম করা হবে না, এরপর একটি কার্ড পেশ করা হবে, যেখানে থাকবে:
اَشْهَدُ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ.
লোকটি বলবে: হে আমার রব, এসব দফতরের বিপরীতে এ কার্ডের মূল্য কী? আল্লাহ বলবেন: তুমি যুলমের শিকার হবে না। তিনি বলেন, অতঃপর সকল দফতর এক পাল্লায় আর কার্ডটি রাখা হবে অপর পাল্লায়, তখন দফতরগুলো উপরে উঠে যাবে আর কালেমার কার্ড ভারী হয়ে নুয়ে পড়বে”। উপরোক্ত ক্বোরআন-সুন্নাহর বিশুদ্ধ বর্ণনা দ্বারা প্রতিয়মান হয় যে, শুধু লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু কালেমা নয়, বরং কালেমার পূর্ণরূপ হলো- লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।

সাম্প্রতিক কালে গুটি কয়েকজন চিহ্নিত ব্যক্তিবর্গ জনমনে নানান সন্দেহের বীজ বপন করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের উপস্থাপিত অন্যতম দুটি সংশয় নিম্নরূপ :

এক. “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” কালেমাটি এভাবে কোনো হাদীসে নেই। এসব মিথ্যা কাহিনী। সুহৃদ পাঠকগণ! আশা করি উপরোল্লিখিত বিশুদ্ধ হাদীসগুলোর আলোকে আপনারা সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছেন যে, তাদের এই দাবি সম্পূর্ণ অবাস্তব ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

দুই. “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” এই কালেমাটিতে দুটি বাক্য আছে। লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ- একটি বাক্য। আর মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ দ্বিতীয় বাক্য। সব ভাষাতেই দুটি বাক্যের মাঝে পৃথক করার কোনো না কোনো বিভাজন শব্দ ব্যবহার করতে হয়। আরবীতে حرف عطف বা বিভাজন শব্দের ব্যবহার আছে। তাই এই দুটি বাক্যের মধ্যে বিভাজন শব্দ থাকার প্রয়োজন ছিল। অন্যথায় দুটি বাক্য এক হয়ে এতে শিরকের অর্থ সৃষ্টি হবে। বিষয়টি বুঝার জন্য মনে করেন যায়িদ ও চোর বললে দুজনকে বুঝায়। আর ‘ও’ ব্যতীত যায়িদ চোর বললে একই ব্যক্তি বা যে যায়িদ সেই চোর এবং যে চোর সেই যায়িদ বুঝাবে। অনুরূপভাবে ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’-এর মধ্যে কোনো বিভাজন শব্দ না থাকায় দুটি বাক্য একই অর্থে রূপান্তরিত হবে, যা শিরক ব্যতীত আর কিছুই না। তাই যারা এই কালেমা পড়বে ও এ অনুযায়ী আমল করবে তারাও মুশরিক। বরং তাদের ভাষ্যে যারা এই কালেমা পড়ে তারা আল্লাহ ও রাসূলকে দু’ভাইয়ে পরিণত করে থাকে। (নাউজু বিল্লাহ)
নিরসন : সুহৃদ পাঠক! আরবী ভাষা, বাংলা ভাষাসহ সব ভাষাতেই বিভাজন শব্দ আছে ঠিক। কিন্তু যেকোনো দুটি শব্দের মধ্যে অথবা যে কোনো দুটি বাক্যের মধ্যে বিভাজন শব্দ ব্যবহার করতেই হবে এমন দাবি সম্পূর্ণরূপে ভুল। এর কোনো ভিত্তি নেই। বরং তা فصاحت ও بلاغت তথা আরবী ভাষার সৌন্দর্য এবং মাধুর্যপূর্ণ ধারাবাহিকতা ও বর্ণনা বিন্যাসের সম্পূর্ণ বিপরীত। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করলে জানা যায়, পাঁচটি স্থান আছে, যেখানে বিভাজন শব্দ ব্যবহার না করাই সৌন্দর্য ও মাধুর্যতা। অব্যয় ব্যবহার করা ব্যতিরেকে দুটি শব্দ বা দুটি বাক্য ভিন্ন ভিন্ন অর্থে গণ্য হবে। এমন স্থানগুলোর অন্যতম হলো-
ان يكون بين الجملتين تباين تامৃ. بأن لا يكون بينهما مناسبة فى المعنى كقولك على كاتب الحمام طائر
অর্থাৎ দুটি শব্দ বা বাক্য যদি অর্থগতভাবে সম্পূর্ণ বিপরীত বা ভিন্ন ভিন্ন হয় তাহলে এর মধ্যে বিভাজন শব্দ ছাড়াই স্পষ্ট বিভাজন বোঝা যায়। যেমন- আলী লেখক, পাখিটি উড়ন্ত। এইভাবে আগুন পানি, আকাশ-পাতাল, আসমান- জমীন, ইত্যাদি বহুল প্রচলিত বিপরীতমুখী শব্দ বা বাক্যের মাঝে বিভাজন শব্দ না হওয়াই ভাষার মাধুর্যতা। এগুলোতে বিভাজন শব্দ না থাকা সত্ত্বেও দুটিকে কেউ এক গণ্য করবে না। তেমনিভাবে আল্লাহ্ রাসূল দুটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়। আল্লাহ হলেন ¯্রষ্টা রাসূল হলেন সৃষ্টি। লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু এই বাক্যে আল্লাহর একত্মবাদের আলোচনা আর মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ এই বাক্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামার রিসালাত বা রাসূল হওয়ার আলোচনা রয়েছে। তাই স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে যেমন ব্যবধান ও বৈপরীত্ব, ঠিক তেমনি বাক্য দুটিতে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। এ জন্য দুটি বাক্যের মধ্যে কোনো বিভাজন শব্দ حرف عطف না থাকা সত্ত্বেও পরিপূর্ণ বিভাজন বুঝায়। তাই এই দুই বাক্যের মধ্যে বিভাজনমূলক শব্দ ব্যবহার না করাই ভাষার সৌন্দর্য ও মাধুর্যতা বৃদ্ধি করে।
যুগ যুগ ধরে মুসলিম বিশ্বের সকলে এই কালেমায় (লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ) বিশ্বাসী। এতে কারো কোনো মতভেদ নেই। দ্বিধা নেই। নেই কোনো ভুল বুঝাবুঝি ও সংশয়ের লেশমাত্র। আজ থেকে প্রায় একশত বছর পূর্বে বাদশা সাউদ সৌদি আরবে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। সে দিন তাঁর ধর্মবিষয়ক প্রাইম উপদেষ্টা ছিলেন কট্টর সালাফী নেতা মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব নজদী। সে সময়েও আরবের জাতীয় পতাকায় খচিত ছিল “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ”। আজো তা বহাল আছে। আরব বিশ্বের আহলে হাদীস মতবাদের ইমাম ইবনে তাইমিয়া লিখেন-
دين الاسلام مبنى على اصلين، من خرج عن واحد منها فلا عمل له ولا دين: ان نعبد الله وحده ولا نشرك به شيئا وعلى ان نعبد بما شرع، لا بالحوادث والبدع هو حقيقة قول: “لا اله إلا الله محمد رسول الله.
অর্থাৎ ইসলামের মূল ভিত্তি দু’টি। যে এর কোনো একটি পরিত্যাগ করবে তার যাবতীয় আমল বৃথা। তার কোনো দ্বীন ধর্ম নেই। আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করে তাঁর ইবাদত করা এবং বিদআত ও কুসংষ্কার পরিহার করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার আনীত দ্বীন গ্রহণ করা। যা এক বাক্যে : “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ”। তাই যারা ইবনে তাইমিয়া ও মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহাব নজদীর অনুসারী বলে দাবি করে তাদের আরো ভেবে দেখা প্রয়োজন। মুসলমানদের কিবলা কা’বা ঘরের গিলাফে অঙ্কিত আছে এই কালিমা। আফগানিস্তানের পতাকায়ও শোভা পায় এই কালিমা। তাই বলা যায় এই কালেমা বিশুদ্ধতার ব্যাপারে সমগ্র উম্মতের ঐক্যমত বা ইজমা রয়েছে। আর ইজমা হলো ইসলামি শরীয়তে একটি প্রামাণ্য দলিল।

কালেমার রহস্য: অক্ষরগত দিক থেকে কালেমায় রয়েছে অনন্য চমক। আল্লাহ শব্দটিতে আরবি মূলবর্ণ রয়েছে তিনটি। আলিফ, লাম ও গোল হা। প্রত্যেকটি বর্ণ নুকতা ছাড়া। নুকতা আরবি বর্ণের একটি দুর্বলতা। এদিক থেকে শব্দটি শক্তিশালী বা দুর্বলতামুক্ত। অপর দিকে বৈশিষ্ট্যের বিবেচনায় প্রত্যেকটি বর্ণ উচ্চারণে সহজ। তাই শব্দটির তালাফফুজ সহজ ও শ্রুতিমধুর। আবার ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বাক্যটি আল্লাহ শব্দে বর্ণিত তিনটি বর্ণ দ্বারাই গঠিত যা বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। পৃথিবীতে এমন সত্তা কে আছেন? যে তার নাম এবং পরিচয় একই বর্ণযোগে দিতে পারেন! সুবহানাল্লাহ! ‘আল্লাহ’ শব্দটির গাঁথুনিতে মোট ৪টি বর্ণ আছে। আবার ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বাক্যটিতে ৪টি শব্দ রয়েছে। কী চমৎকার মিল! বাক্যটিতে বর্ণগুলো ব্যবহার হয়েছে মোট ১২ বার, যা ৩ ও ৪ সংখ্যা দ্বার নিঃশেষে বিভাজ্য। তার মানে বুঝা যায় বিষয়গুলি কাকতালীয় নয়। তার পেছনে অবশ্যই কোন রহস্য লুকিয়ে আছে। হ্যাঁ, অবশ্যই আছে। ‘কালেমা’র অপর অংশ- ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ বাক্যটির দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় এখানেও পূর্বের বাক্যটির মতো মিরাকেল। ‘মুহাম্মাদ’ শব্দটিতে আল্লাহ শব্দের মতো মূলবর্ণ তিনটি ব্যবহার করা হয়েছে। যথা- হা, মীম ও দাল। এই বর্ণগুলিও নুকতামুক্ত। আবার ‘মুহাম্মাদ’ শব্দটির গঠনে মোট ৪টি বর্ণ রয়েছে। আর বাক্যটিতে আছে ১২টি বর্ণ। তাহলে দুটি বাক্যের মধ্যেই আমরা ৩,৪,ও ১২ সংখ্যার মধ্যে মিল দেখতে পাচ্ছি। আবার বাক্য দুটিতে মোট বর্ণের সংখ্যা ২৪টি। ২৪ সংখ্যাটি পূর্বের প্রত্যেকটি সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্য। তার মানে প্রত্যেকটি সংখ্যাই একে অপরের সঙ্গে মিল রাখছে। এবার রহস্য উদঘাটন করা যাক। ৩ সংখ্যাটি আল্লাহ তা‘আলার ১. অনাদি ২. অনন্ত ও ৩. বিরাজমান হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে। তাঁর প্রতি এভাবেই বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানের দাবি। প্রশ্ন তোলা নির্বুদ্ধিতা। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল ও প্রিয়বন্ধু সর্বযুগে, সর্বজগতে তথা ১. বিশ্ব সৃষ্টির আগে ২. পরে এবং ৩. পরজগতে। আর এ বিশ্বাস বুদ্ধিমান তিনটি প্রাণী তথা মানুষ, জিন এবং ফেরেশতা সবার মধ্যে থাকা আবশ্যক। তারপরেও যদি কেউ কালেমায় আল্লাহ ও রাসূলের নাম পাশাপাশি পড়া যাবেনা, লিখা যাবেনা বলে ফতোয়া দেয় তাদের উচিত মহান আল্লাহর দেয়া সতর্কবাণী থেকে সবক গ্রহণ করা। ইরশাদ হচ্ছে
اِنَّ الَّذِیۡنَ یَکۡفُرُوۡنَ بِاللّٰہِ وَ رُسُلِہٖ وَ یُرِیۡدُوۡنَ اَنۡ یُّفَرِّقُوۡا بَیۡنَ اللّٰہِ وَ رُسُلِہٖ وَ یَقُوۡلُوۡنَ نُؤۡمِنُ بِبَعۡضٍ وَّ نَکۡفُرُ بِبَعۡضٍ ۙ وَّ یُرِیۡدُوۡنَ اَنۡ یَّتَّخِذُوۡا بَیۡنَ ذٰلِکَ سَبِیۡلًا – اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡکٰفِرُوۡنَ حَقًّا ۚ وَ اَعۡتَدۡنَا لِلۡکٰفِرِیۡنَ عَذَابًا مُّہِیۡنًا-
অর্থাৎ     (নিশ্চয়)       যারা      আল্লাহ্      ও      তাঁর রসূলগণপকে    অমান্য    করে    এবং    চায়    যে,    আল্লাহ্  থেকে    তার   রসূলগণকে    পৃথক    করে    নেবে,   এবং বলে,    ‘আমরা   কতেকের   উপর   ঈমান    আনি   এবং কতেককে অস্বীকার করি’, আর এটা চায় যে, ঈমান ও  কুফরের  মাঝখানে  অন্য   একটা  পথ    বের   করে নেবে;  এরাই    হচ্ছে    সত্যি    সত্যি    কাফির;    এবং  আমি   কাফিরদের  জন্য  লাঞ্ছনার   শাস্তি  প্রস্তুত  করে রেখেছি। [সূরা নিসা: আয়াত-৫০, ৫১]
মহান আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে কালেমার প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করার তাওফিক দান করুন। আমীন বিজাহিন নবিয়্যিল আমীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

লেখক: আরবি প্রভাষক, রাণীরহাট আল-আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদরাসা, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম

Share:

Leave Your Comment