বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ‘জশনে জুলুস’

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ‘জশনে জুলুস’

মুফতি আবুল কাশেম মোহাম্মদ ফজলুল হক

ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উদযাপনের বিশেষায়িত ও আকর্ষণীয় একটি রূপ ‘জশনে জুলুস’। ইসলামী শরীয়তের পুণ্যময় অনেকগুলো আমলের ‘নান্দনিক সমষ্টি’। ‘নান্দনিক’ বলা এজন্য যে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীতে শুভাগমন পবিত্র কুরআনের সূরাহ্ ইউনুসের ৫৮ নম্বর আয়াতের ভাষ্যমতে পরম আনন্দের। সে আনন্দ আল্লাহর মহান নেয়ামতপ্রাপ্তির আনন্দ। প্রভূর দয়ারূপ মহান রহমতের নবীকে পাওয়ার আনন্দ। সে আনন্দকে আয়াতের শেষাংশে আমাদের সমূদয় অর্জন থেকেও ‘উত্তম বিষয়’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। ‘জশনে জুলুসে’-এ মাধ্যমে এ আনন্দ যতটা ফুটে উঠে এবং অনুভূত হয়, তা ঈদে মিলাদুন্নবীর অন্যরূপ উদযাপনে এতটা পাওয়া যায় না। সে কারণে জশনে জুলুসে সাধারণ মুসলমানের অংশগ্রহণ অন্য অনুষ্ঠান থেকে বেশি হয়। মানুষের অংশগ্রহণের এই আধিক্য ইসলামের সামগ্রিক স্বার্থরক্ষার জন্য খুবই সহায়ক। বিশেষকরে বিশ্বের আন্তঃধর্মীয় প্রেক্ষাপটে ইসলামকে শ্রেষ্ঠ ধর্মের মুকুট পরিয়ে দেয়ার মত একটি বিশেষ অনুষ্ঠান ‘জশনে জুলুস’।

যৌক্তিক-অযৌক্তিক বিভিন্ন কারণেই বিশ্বে বিভিন্ন ধর্মের সহাবস্থান এবং ধর্মাচারে ‘ইসলাম’ বিগত শতাব্দীকাল ধরেই ইমেজ সংকটে আছে। ‘ইসলামোফোবিয়া’র নীলনকশায় ইসলামের গায়ে জঙ্গিবাদ-উগ্রবাদ-সন্ত্রাসবাদের তকমা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। ইসলামবিদ্বেষ ও ষড়যন্ত্র শান্তির ধর্ম ইসলামকে উগ্রবাদের প্রায় সমর্থক করে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করেছে। একাজে সফল হওয়ার জন্য তারা সর্বশ্রেণীর মিডিয়াকে কাজে লাগিয়েছে সার্থকভাবে। যা মুসলমানদের ধর্মীয় ও আর্থ-সামাজিক কাজের স্বাভাবিকতাকে চরমভাবে বিঘ্নিত করেছে। মুসলমানদেরকে আন্তঃধর্মীয় গ্রাউন্ডে সামাজিক, নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে। ফলে ছোটখাট সংঘবদ্ধতাকেও দেহের চোখে দেখা হয়। মুসলমানদের ধর্মাচারের নিবিড়তা, অনড়তা ও আপোষহীন মনোভাবকে কখনো ‘মৌলবাদ’ হিসেবে, কখনো বা ‘উগ্রবাদ’ বলে, কখনো কখনো ‘গোঁড়াবাদ’ আখ্যা দেয়া হয়।

এমনই একটা পরিস্থিতিতে দৃশ্যমান এমন একটা নান্দনিক বড়মাপের সংঘবদ্ধতা ও আনুষ্ঠানিকতার তীব্র প্রয়োজন দেখা দিয়েছে যার মধ্যে ভালবাসা তীব্র থাকবে ঠিকই কিন্তু তা উগ্রতা থেকে যোজন যোজন দূরে থাকবে। উপস্থিতির বিশালতা থাকবে, পাশাপাশি থাকবে পরিপূর্ণ শান্তিময়তার চাদরে ঢাকা। উদ্যাপনের উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনা নিশ্চয়ই থাকবে। তবে তা মনস্তাত্ত্বিক উগ্রতা তৈরি করবে না। পৃথিবীর মানুষের কাছে শান্তির ধর্ম ইসলামের শান্তির উত্তম একটা উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপিত হবে। পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এই বিশেষরূপ ‘জশনে জুলুস’ বিশ্বের আন্তঃধর্মীয় পরিবেশে উপরোক্ত দাবিগুলো পূরণ করতে সমর্থ হয়েছে। এই অনুষ্ঠানের ভেতরে চরিত্র, চেতনা ও ফলাফলও প্রায় অভিন্ন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি অনিঃশেষ ভালবাসার দাবি পূরণে আবেগ ও আনন্দঘন পরিবেশে শান্তিপূর্ণ স্থির কিংবা চলমান সমাবেশে যিকির, আলোচনা, নাত, দুরূদ, মিলাদ, তেলাওয়াত ও দান সদকাহ। পৃথিবীর মানুষ দেখছে, মুসলমানদের নবীর প্রতি তাদের বাঁধভাঙা ভালবাসার নান্দনিক এমন উচ্ছ্বাস ভিন্নধর্মের কারো উপর আঘাত বা আক্রমণ করার সাধারণ মানসিকতাটুকু ও তৈরি করে না। ঈদে মিলাদুন্নবীর জশনে জুলুস অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মনে করি, বিশ্ব দরবারে ইসলামের শান্তিময় সৌন্দর্য কিছুটা হলেও ইতোমধ্যে তুলে ধরে সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি ইসলামের প্রতি মুসলমানদের শর্তহীন আত্মদানের একটা নমুনা চিত্রও সবার কাছে ফুটে উঠেছে। কারণ প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকালের ১৪০০ বছর পরেও মুসলিম হৃদয়ে তাঁরই ভালবাসার দুর্নিবার জোয়ার মূলতঃ বিশ্বমানবতার কাছে ইসলামের চিরবিজয়ের ‘সোনালী শিরোনাম’। দার্শনিক ও কবি ইকবাল নবীর প্রতি তরঙ্গায়িত এই ভালবাসাকে ইসলামের বিজয়ের মূলমন্ত্র বলে মনে করতেন। যার সার্থক বহিঃপ্রকাশ ঘটে জশনে জুলুছের মাধ্যমে। এ অর্থে জশনে জুলুস বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ইসলামের হৃত গৌরব ও ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। নবীপ্রেমের ইস্যুকে বিশ্বমুসলিম ঐক্যের বৃহত্তর প্লাটফর্মে আনতে কার্যকর এবং মুসলমানদের শান্তিপূর্ণ ইসলামী চেতনা তৈরিতে খুবই ফলপ্রসূ একটি বরকতময় অনুষ্ঠান।

লেখক : উপাধ্যক্ষ, কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদ্রাসা, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।