যুগে যুগে মীলাদুন্নবী
যুগে যুগে মীলাদুন্নবী
=====
প্রত্যেক নবী নিজ নিজ যুগে আমাদের প্রিয়নবী ও আল্লাহর প্রিয় হাবীবের আবির্ভাবের সুসংবাদ দিয়ে গেছেন।
এক. হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম তাঁর প্রিয় পুত্র ও প্রতিনিধি হযরত শীস আলায়হিস্ সালামকে নূরে মুহাম্মদীর তা’যীম করার জন্য নিন্মোক্ত ওসীয়ত করে গেছেনঃ
اَقْبَلَ اٰدَمُ عَلٰی اِبْنِہٖ شِیْثَ فَقَالَ اَیْ بُنَیَّ اَنْتَ خَلِیْفَتِیْ مِنْ بَعْدِیْ فَخُذْہَا بِعِمَارَۃِ التَّقْوٰی وَالْعُرْوَۃِ الْوُثْقٰی فَکُلَّمَا ذَکَرْتَ اللّٰہَ فَاذْکُرْ اِلٰی جَنْبِہٖ اِسْمَ مُحَمَّدٍ فَاِنِّیْ رَأَیْتُ اِسْمَہٗ مَکْتُوْبًا عَلٰی سَاقِ الْعَرْشِ وَاَنَا بَیْنَ الرُّوْحِ وَالطِّیْنِ ثُمَّ اِنِّیْ طُفْتُ السَّمٰوَاتِ فَلَمْ اَرَ فِی السَّمٰوَاتِ مَوْضَعًا اِلاَّ رَأَیْتُ اِسْمَ مُحَمَّدٍ مَکْتُوْبًا عَلَیْہِ وَاِنَّ رَبِّیْ اَسْکَنَنِیَ الْجَنَّۃَ فَلَمْ اَرَ فِی الْجَنَّۃِ قَصْرًا وَلاَ غُرْفَۃً اِلاَّ وَجَدْتُ اِسْمَ مُحَمَّدٍ مَکْتُوْبًا عَلَیْہِ وَلَقَدْ رَأَیْتُ اِسْمَ مُحَمَّدٍ مَکْتُوْبًا عَلٰی نُحُوْرِ الْحُوْرِ الْعِیْنِ وَعَلٰی وَرَقِ قَصَبِ لِجَامِ الْجَنَّۃِ وَعَلٰی وَرَقِ شَجَرَۃِ طُوْبٰی وَعَلٰی وَرَقِ سِدْرَۃِ الْمُنْتَہٰی وَعَلٰی اَطْرَافِ الْحُجُبِ وَبَیْنَ اَعْیُنِ الْمَلاآءِکَۃِ فَاَکْثِرْ ذِکْرَہٗ فَاِنَّ الْمَلآَءِکَۃَ مِنْ قَبْلُ تَذْکُرُہٗ فِیْ کُلِّ سَاعَاتِہَا (زَرْقَانِیْ عَلَی الْمَوَاہِبِ)
অর্থাৎ হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম আপন পুত্র হযরত শীস আলায়হিস্ সালাম-এর উদ্দেশে বললেন, ‘‘হে আমার প্রিয় বৎস! আমার পরে তুমি আমার খলীফা। সুতরাং এ খিলাফতকে তাক্বওয়ার তাজ ও দৃঢ় ইয়াক্বীন দ্বারা আঁকড়ে ধরো। আর যখনই আল্লাহ্র নাম নেবে, তখন তাঁর সাথে হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নামও উল্লেখ করবে। কারণ, আমি রূহ ও মাটির মধ্যবর্তী থাকা অবস্থায়ই তাঁর পবিত্র নাম আরশের পায়ায় (আল্লাহ্র নামের সাথে) লিখিত দেখেছি। এরপর আমি সমস্ত আসমান ভ্রমণ করেছি। আসমানগুলোতে এমন কোন স্থান ছিল না, যেখানে হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নাম অঙ্কিত পাইনি। আমার রব আমাকে জান্নাতে বসবাস করতে দিলেন। জান্নাতের এমন কোন প্রাসাদ ও কামরা পাইনি, যেখানে হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নাম লেখা ছিলোনা। আমি হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নাম আরও লিখিত দেখেছি সমস্ত হুরের স্কন্ধদেশে, বেহেশ্তের সমস্ত বৃক্ষের পাতায় পাতায়, বিশেষ করে তূবা বৃক্ষের পাতায় পাতায় ও সিদ্রাতুল মোন্তাহার পাতায় পাতায়, পর্দার কিনারায়। ফেরেশতাগণের চোখের মণিতে ওই নাম অঙ্কিত দেখেছি। সুতরাং হে শীস! তুমি এ নাম বেশী পরিমাণে জপতে থাকো। কেননা, ফেরেশতাগণ পূর্ব হতেই এ নাম জপনায় মশগুল রয়েছেন। [যারক্বানী শরীফ]
উল্লেখ্য যে, সর্বপ্রথম দুনিয়াতে এটাই ছিলো যিক্রে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম।
দুই. হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম মীলাদ শরীফ পাঠ ও ক্বিয়াম করেছেন
হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম এবং হযরত ইসমাঈল আলায়হিস্ সালাম যখন আল্লাহর ঘর তৈরী করছিলেন, তখন হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম উক্ত ঘরের নির্মাণ কাজ কবূল করার জন্য এবং নিজের ভবিষ্যৎ সন্তানদের মুসলিম হয়ে থাকার জন্য আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করার পর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তথা ক্বিয়াম করে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আবির্ভাব আরবে ও হযরত ইসমাঈলের বংশে হওয়ার জন্য এভাবে দোয়া করেছিলেনঃ
رَبَّنَا وَابْعَثْ فِیْہِمْ رَسُوْلاً مِّنْہُمْ یَتْلُوْا عَلَیْہِمْ اٰیٰتِکَ وَیُعَلِّمُہُمُ الْکِتَابَ وَالْحِکْمَۃَ وَیُزَکِّیْہِمْ
তরজমা: হে আমাদের রব! তুমি এ আরব ভূমিতে আমার ইসমাঈলের বংশের মধ্যে তাদের মধ্য হতেই ওই মহান রাসূলকে প্রেরণ করো, যিনি তোমার আয়াতসমূহ তাদের কাছে পাঠ করে শুনাবেন, তাদেরকে ক্বোরআন-সুন্নাহর বিশুদ্ধ জ্ঞান শিক্ষা দেবেন এবং বাহ্যিক ও আত্মিক অপবিত্রতা থেকে তাদেরকে পবিত্র করবেন।’’ [সূরা বাক্বারা: আয়াত ১২৯]
এখানেও দেখা যায়- হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম রসূলুল্লাহ্র আবির্ভাবের চার হাজার বছর পূর্বেই মুনাজাত আকারে তাঁর আবির্ভাব ইত্যাদির জন্য দণ্ডায়মান অবস্থায় আরয করেছেন, যা পূর্বে উল্লিখিত দু’টি আয়াতের মর্মার্থ থেকে বুঝা যায়। ইবনে কাসীর তাঁর ‘আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া’ গ্রন্থের ২য় খণ্ড: ২৬১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- دَعَا اِبْرَاہِیْمُ عَلَیْہِ السَّلاَمُ وَہُوَ قَآءِمٌ অর্থাৎ উক্ত দো‘আ করার সময় হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম দণ্ডায়মান অবস্থায় ছিলেন।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম -এর এ মহান বাণীতে এ দো‘আর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে- اَنَا دَعْوَۃُ اِبْرَاہِیْمَ অর্থাৎ ‘‘আমি হলাম হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম-এর দো‘আ।’’
হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম আল্লাহ্র নিকট থেকে চেয়ে আমাদের প্রিয় নবীকে আরবে হযরত ইসমাঈল আলায়হিস্ সালাম-এর বংশে নিয়ে এসেছেন। এটা উপলব্ধির বিষয়। বর্তমানে মীলাদ শরীফে রসূলে পাকের আবির্ভাবের যে বর্ণনা আমরা দিয়ে থাকি, তা হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম-এর দো‘আর তুলনায় অতি নগণ্য। সুতরাং আমাদের মীলাদ শরীফ পাঠ ও ক্বিয়াম হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালামেরও সুন্নাত হলো। [সূত্র. আল বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া: ২য় খণ্ড পৃ. ২৬]
তিন. হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর মীলাদ শরীফ পাঠ ও ক্বিয়াম
নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আবির্ভাব সম্পর্কে হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম তাঁর উম্মত ও হাওয়ারীকে নিয়ে আলোচনা করেছেন। নিজের উম্মতের কাছে তিনি আখেরী যমানার পয়গাম্বরের নাম, গুণাবলী এবং তাঁর আগমন বার্তা এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ
وَاِذْ قَالَ عِیْسٰی بْنُ مَرْیَمَ یٰبَنِیْ اِسْرَآءِیْلَ اِنِّیْ رَسُوْلُ اللّٰہِ اِلَیْکُمْ مّصَدِّقًا لِّمَا بَیْنَ یَدَیَّ مِنَ التَّوْرَاۃِ وَمُبَشِّرًا بِرَسُوْلٍ یَّأْتِیْ مِنْمبَعْدِی اسْمُہٗ اَحْمَدُ
তরজমা: হে আমার প্রিয় রাসূল! আপনি স্মরণ করুন, যখন মরিয়ম-তনয় ঈসা বলেছিলেন, হে বনী ইসরাইল! আমি তোমাদের কাছে নবী হয়ে প্রেরিত হয়েছি। আমি আমার পূর্ববর্তী তাওরীত কিতাবের সত্যতার সাক্ষ্য দিচ্ছি এবং এমন এক মহান রাসূলের সুসংবাদ দিচ্ছি, যিনি আমার পরেই আগমন করবেন এবং তাঁর নাম হবে ‘আহমদ’। [সূরা আস্সফ: আয়াত-৬]
হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর ভাষণ সাধারণতঃ দণ্ডায়মান অবস্থায় হতো। আর এটা ভাষণের সাধারণ রীতিও বটে। ইবনে কাসীর ‘আল-বেদায়া ওয়ান্ নেয়াহা’ গ্রন্থের ২য় খণ্ড: ২৬১ পৃষ্ঠায় উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ وَخَاطَبَ عِیْسٰی عَلَیْہِ السَّلاَمُ اُمَّتَہٗ الْحَوَارِیّیْنَ قَٓاءِمًا
অর্থাৎ হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম দণ্ডায়মান (ক্বিয়ামরত) অবস্থায় তাঁর উম্মত হাওয়ারীকে আমাদের নবী করীমের আগমনের সুসংবাদ দিয়ে বক্তৃতা করেছিলেন। সুতরাং মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়াম হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর সুন্নাত হলো এবং তা নবী করীমের এ পৃথিবীতে শুভাগমনের ৫৭০ বছর পূর্বে সম্পন্ন হয়েছে। [আল-বেদায়া ও ওয়ান্ নেহায়া]
চার. নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজের মীলাদ শরীফ নিজেই পাঠ করেছেন
একদিন নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মিম্বরে দাঁড়িয়ে সমবেত সাহাবীগণের উদ্দেশে বললেনঃ مَنْ اَنَا قَالُوْا رَسُوْلُ اللّٰہِ قَالَ اَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللّٰہِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ بْنِ ہَاشِمِ بْنِ عَبْدِ مَنَافٍ
অর্থাৎ তোমরা বলো, ‘‘আমি কে?’’ সাহাবা-ই কেরাম আরয করলেন, ‘‘আপনি আল্লাহর রাসূল।’’ হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘আমি আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ, আব্দুল মোত্তালিবের নাতি, হাশেমের প্রপৌত্র এবং আবদে মানাফের পুত্রের প্রপৌত্র।’’
এ হাদীস শরীফ থেকে হুযূর-ই আক্রামের চার পূর্বপুরুষের বর্ণনার সূত্র পাওয়া যায়।
হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আরো এরশাদ করেনঃ
وَمِنْ کَرَامَتِیْ عَلٰی رَبِّیْ اَنِّیْ وُلِدْتُّ مَخْتُوْنًا وَلَمْ یَرَ اَحَدٌ سَوْأَتِیْ [طبرانی ٗ زَرقانی]
অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ হতে আমার একটি বিশেষ মর্যাদা এ যে, আমি খতনাকৃত অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয়েছি এবং আমার গোপনাঙ্গ কেউই দেখেনি। [ত্বাবরানী, যারক্বানী]
অন্যান্য রেওয়ায়তে পাক-পবিত্র, নাভি-কর্তিত, সুরমা সজ্জিত ও বেহেশতী লেবাস পরিহিত অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হওয়ার বর্ণনাও এসেছে। [মাদারিজুন্নুবূয়ত]
এছাড়াও ঐতিহাসিক হোনায়নের যুদ্ধে যখন হাওয়াযিনের প্রচূর পরিমাণে তীর নিক্ষেপের ফলে মুসলিম সৈন্যগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন, তখনও নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম একা যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে বলেছিলেনঃ اَنَا النَّبِیُّ لاَ کَذِب ۔ اَنَا اِبْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِب
অর্থাৎ আমি আল্লাহর নবী। আমি মিথ্যাবাদী নই। আমি আব্দুল মুত্তালিবের পৌত্র।
প্রসঙ্গত উপরোক্ত প্রথম ঘটনাটি দাঁড়িয়ে বলা এবং বর্ণনা করা থেকে মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়ামের প্রমাণ মিলে। সুতরাং মীলাদুন্নবী ও ক্বিয়াম স্বয়ং রাসূলে পাকেরই সুন্নাত বলে প্রমাণিত হলো। দ্বিতীয় বর্ণনায়وُلِدْتُ শব্দ এসেছে। এর অর্থ হলো আমি জন্মগ্রহণ করেছি, ভূমিষ্ঠ হয়েছি, আবির্ভূত হয়েছি। এ সব বর্ণনাই ক্বিয়ামরত অবস্থায় করেছিলেন। তিনি যে নিজেই ক্বিয়াম করেছেন তাতে সন্দেহ কিসের? সুতরাং বেলাদতের বর্ণনাকালে ক্বিয়াম করা নবী করীমেরই সুন্নাত হলো।
পাঁচ. সাহাবা-ই কেরামের যুগে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মাহফিল
হুযূর-ই পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপস্থিতিতে সাহাবা-ই কেরাম মীলাদ মাহফিলের অনুষ্ঠান করেছেন। নিন্মোক্ত এর কয়েকটি প্রমাণ দেখুন-
১. হযরত আবুদ্ দারদা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত হাদীস শরীফ-
عَنْ اَبِی الدَّارْدَآءِ رَضِیَ اللّٰہُ عَنْہُ قَالَ مَرَرْتُ مَعَ النَّبِیَّ ﷺ اِلٰی بَیْتِ عَامِرِ ن الْاَنْصَارِیِّ یُعَلِّمُ وَقَاءِعَ وِلاَدَتِہٖ ﷺ لِاَبْنَاۂٖ وَعَشِیْرَتِہٖ وَیَقُوْلُ ہٰذَا الْیَوْمُ فَقَالَ النَّبِیُّ ﷺ اِنَّ اللّٰہَ فَتَحَ عَلَیْکَ اَبْوَابَ الرَّحْمَۃِ وَمَلاآءِکَتُہٗ یَسْتَغْفِرُوْنَ لَکُمْ (اَلدُّرُّ الْمُنَظَّمُ) وَفِیْ رِوَایَۃٍ وَمَنْ فَعَلَ فِعْلَکَ نَجَا نَجَاتَکَ
অর্থাৎ হযরত আবুদ্ দারদা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে আবূ ‘আমের আনসারীর ঘরে গিয়ে দেখি- তিনি তাঁর সন্তানদের এবং আত্মীয়-স্বজনকে নবী করীমের জন্ম বৃত্তান্ত শিক্ষা দিচ্ছেন এবং বলছেন, ‘আজই সে দিন।’’ এটা দেখে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, ‘‘নি:সন্দেহে আল্লাহ্ তা‘আলা তোমার উপর রহমতের দরজা খুলে দিয়েছেন এবং আল্লাহর ফেরেশতাগণ তোমাদের সকলের জন্য মাগফিরাত কামনা করছে।’’ [র্দুরে মুনায্যাম, কৃত. আব্দুল হক এলাহাবাদী]
অন্য বর্ণনায় আছে হুযূর-ই আক্রাম আরো এরশাদ করেছেন, ‘‘যে তোমার এ কাজ করেছে সে তোমার মতো নাজাত (মুক্তি) পেয়েছে।’’
২. হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে বর্ণিত হাদীস-
عَنْ اِبْنِ عَبَّاسٍ رَضِیَ اللّٰہُ عَنْہُمَا کَانَ یُحَدِّثُ ذَاتَ یَوْمٍ فِیْ بَیْتِہٖ وَقَاءِعَ وِلاَدَتِہٖ بِقَوْمٍ فَیَبْشِرُوْنَ وَیَحْمَدُوْنَ اِذْ جَآءَ النَّبِیُّ ﷺ وَقَالَ حَلَّتْ لَکُمْ شَفَاعَتِیْ (اَلتَّنْوِیْرُ فِیْ مَوْلِدِ الْبَشِیْرِ النَّذِیْرِ لِاِبْنِ دَحْیَۃَ)
অর্থাৎ ‘‘একদিন তিনি (হযরত ইবনে আব্বাস) কিছু লোক নিয়ে নিজ ঘরে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর জন্ম-বৃত্তান্ত আলোচনা করে আনন্দ উৎসব করছিলেন এবং তাঁর প্রশংসাবলী আলোচনাসহ দুরূদ শরীফ পাঠ ও সালাম পেশ করছিলেন। এমন সময় নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সেখানে উপস্থিত হয়ে এটা দেখে বললেন, ‘‘তোমাদের সকলের জন্য আমার শাফা‘আত অবধারিত হয়ে গেলো।’’ [ইবনে দাহ্ইয়া কৃত আত্-তানভীর ফী মওলেদিন বশীরিন নাযীর ৬০৪ হিজরী]
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, নবী করীমের মিলাদ শরীফ পাঠ করলে তাঁর সুপারিশ নসীব হয়।
৩. হযরত হাস্সান ইবনে সাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু মিম্বরে দাঁড়িয়ে কবিতার মাধ্যমে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পাঠ করেছেন। দীর্ঘ কবিতার একাংশ নিন্মরূপ-
وَاَجْمَلَ مِنْکَ لَمْ تَرَقَطُّ عَیْنِیْ وَاَکْمَلَ مِنْکَ لَمْ تَلِدِ النِّسَآءُ
قَدْ وُلِدْتَ مُبَرَّأً مِّنْ کُلِّ عَیْبٍ قَدْ کَاَنَّکَ خُلِقْتَ کَمَا تَشَآءُ
وَضَمَّ الْاِلٰہُ اِسْمَ النَّبِیِّ بِاِسْمِہٖ اِذَا قَالَ فِی الْخَمْسِ الْمُؤَذِّنُ اَشْہَدُ
وَشَقَّ لَہٗ مِنْ اِسْمِہٖ لِیُجِلَّہٗ فَذُوْ الْعَرْشِ مَحْمُوْدٌ وَّہٰذَا مُحَمَّدُ
অর্থাৎ ক. ‘‘ইয়া রাসূলুল্লাহ্! আপনার চেয়ে সুন্দর আমার চোখ আর কাউকে দেখেনি। আপনার চেয়ে পরিপূর্ণ কোন সন্তান মহিলারা জন্ম দেয়নি।
খ. আপনি সব দোষত্রুটি হতে মুক্ত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছেন। আপনার এ সূরত যেন আপনার ইচ্ছা অনুযায়ীই সৃষ্টি করা হয়েছে।
গ. আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় নবীর নাম আযানে নিজের নামের সাথে সংযুক্ত করেছেন। (এর প্রমাণ হলো) যখন মুআয্যিন পাঞ্জেগানা নামাযের জন্য ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ্’ বলে আযান দেয়। আল্লাহ্ তা‘আলা আবার আপন নাম থেকে তাঁর নাম পৃথক রেখেছেন- তাঁকে অধিক মর্যাদাশীল করার লক্ষ্যে। যেমন- আরশের অধিপতির নাম হলো ‘মাহমূদ’ এবং তাঁর নাম হলো ‘মুহাম্মদ’। [দিওয়ান-ই হাস্সান]
লক্ষণীয় যে, উভয় নামের মূলাক্ষরগুলো হলো- ‘হামদ’ বা প্রশংসা। দ্বিতীয়তঃ আরবীতে ‘মাহমূদ’ শব্দে রয়েছে পাঁচ হরফঃ م ح م و د আর ‘মুহাম্মদ’ শব্দেও পাঁচ হরফ; যেমন- م ح م و د
আরো লক্ষণীয় যে, হযরত হাস্সানের উক্ত ক্বাসীদায় এ কয়েকটি বিষয় প্রকাশ পায়-
১. নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপস্থিতিতে এ প্রশংসাসূচক ক্বসীদা পাঠ করা হয়েছে। ২. মিম্বরে দাঁড়ানো (ক্বিয়াম) অবস্থায় হুযূরে করীমের জন্ম-বৃত্তান্ত ও গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। ৩. নবী করীমের যে কোন ধরনের ঘোষণা ত্রুটি হতে মুক্ত। ৪. হুযূর-ই আক্রামের বর্তমান সূরত শরীফ অবর্ণনীয় সুন্দর। ৫. আযানের মত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতে আল্লাহর নামের পাশে নবী করীমের নাম আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে সংযোজিত হয়েছে। ৬. নবী করীমের ‘মুহাম্মদ’ নামের উৎস মূলও হামদ্ বা প্রশংসা।
হযরত হাস্সান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর এ মীলাদ শরীফ পাঠ শুনে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ বলে দো‘আ করতেন- اَللّٰہُمَّ اَیِّدْہُ بِرُوْحِ الْقُدْسِ
অর্থাৎ হে আল্লাহ্! তুমি তাঁকে জিব্রাইল মারফত সাহায্য করো। ‘কান্যুল ঈমান ও তাফসীরে খাযাইনুল ইরফান-এ উল্লেখ করা হয়েছে- যারা নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রশংসা করে, তাদের জন্য হযরত জিব্রাইলের গায়েবী মদদ থাকে। [সূরা মুজাদালাহ্] মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়ামের পক্ষে এটি একটি অকাট্য ও উৎকৃষ্ট দলীল।
ছয়. আল্লামা ইবনে হাজর হায়তামী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির নির্ভরযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। তিনি তাঁর ‘আন্ নি’মাতুল কুবরা আলাল আলম’-এ মীল্লাদুন্নবী পালনের ফযীলত সম্পর্কে হযরত হাসান বসরী, হযরত মা’রূফ কারখী, হযরত সারিউস্ সাক্বতী, হযরত জুনায়দ বাগদাদী, ইমাম শাফে‘ঈ, ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী এবং ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিম প্রমুখ ইমাম ও সল্ফে সালেহীনের রেওয়ায়াত বর্ণনা করেছেন। [সূত্র. প্রাগুক্ত, পৃ. ৭-১১]
তাছাড়া, প্যালেস্টাইনের আল্লামা ইউসুফ নাবহানী আলায়হির রাহমাহ্-এর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘জাওয়াহিরুল বিহার: ৩য় খণ্ড’-এও মিলাদুন্নবী সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। আমাদের বাংলাদেশ ও ভারতে কিছু পথভ্রষ্ট লোক মীলাদুন্নবী বিষয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে লেখা পড়া না করেই মীলাদ ও ক্বিয়াম সম্পর্কে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। পূর্ববর্তীগণের কিতাব না দেখেই তারা এ পথ অবলম্বন করছে। বিজ্ঞ পাঠকগণ নিরপেক্ষভাবে ওই দলীলগুলো মনযোগ সহকারে পাঠ করলেই আশা করি তাদের দ্বিধা দূর হয়ে যাবে। সত্যপথ অনুসন্ধান করাই সকলের কাম্য হওয়া উচিত।
সাত. মীলাদ ও ক্বিয়াম ফেরেশতাদের সুন্নাত
আমরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মত। তাঁকে সম্মান করা ওয়াজিব। তিনি হায়াতুন্নবী। রওযা মোবারকে সশরীরেই তিনি আছেন। হযরত আবুদ্ দারদা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
اِنَّ اللّٰہَ حَرَّمَ عَلَی الْاَرْضِ اَنْ تَأْکُلَ اَجْسَادَ الْاَنْبِیَاءِ (طبرانی)
অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলা সম্মানিত নবীগণের দেহ মুবারককে গ্রাস করা মাটির জন্য হারাম করে দিয়েছেন।
মাটি তাঁদের দেহ মুবারক ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বিনষ্ট করতে পারে না। সুতরাং রওযা মুবারকে আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার দেহ মুবারক নিয়েই অক্ষত অবস্থায় অবস্থান করছেন। বোখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফয়যুল বারী’তে উল্লেখ করা হয়েছে-
وَاتَّفَقَ الْعُلَآَاءُ عَلٰی حَیَاۃِ الْاَنْبِیَاءِ অর্থাৎ সমস্ত আলিম এ ব্যাপারে একমত যে, সম্মানিত নবীগণ নিজ নিজ রওযা মুবারকে সশরীরে জীবিত আছেন। তাই নবীগণের হায়াত ও ওফাতের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সুতরাং সর্বদা তাঁদের তা’যীম করা ওয়াজিব।
আট: ফেরেশতাগণের ক্বিয়াম
আল্লাহ তা‘আলার ৭০ হাজার ফেরেশতা সর্বদা হুযূর-ই আন্ওয়ারের রওযা মুবারকের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নূরের পাখা রওযা মুবারকে সামিয়ানার মত বিস্তার করে দুরূদ ও সালাম পেশ করে থাকেন। সুতরাং আমরাও ফেরেশতাদের অনুকরণে ৫/১০ মিনিট দাঁড়িয়ে দুরূদ ও সালাম পেশ করলে তা বিদ‘আত হবে কেন? ফিরিশতারা কি তাহলে বিদ‘আতে লিপ্ত? মোটেই না। হাদীস শরীফ খানা নিন্মরূপ-
عَنْ نُبَیْہَۃَ بْنِ وَہْبٍ اَنَّ کَعْبًَا دَخَلَ عَلٰی عَآءِشَۃَ فَذَکَرُوْا رَسُوْلَ اللّٰہِ ﷺ فَقَالَ کَعْبٌ مَا مِنْ یَّوْمٍ یَّطْلَعُ اِلاَّ نَزَلَ سَبْعُوْنَ اَلْفًا مِّنَ الْمَلآَءِکَۃِ حَتّٰی یَحُفُّوْا بِقَبْرِ رَسُوْلِ اللّٰہِ ﷺ یَضْرِبُوْنَ بِأَجْنِحَتِہِمْ وَیُصَلُّوْنَ عَلٰی رَسُوْلِ اللّٰہِ ﷺ حَتّٰی اِذَا اَمْسَوْا عَرَجُوْا وَہَبَطَ مِثْلُہُمْ فَصَنَعُوْا مِثْلَ ذٰلِکَ حَتّٰی اِذَا اِنْشَقَّتْ عَنْہُ الْاَرْضُ خَرَجَ فِیْ سَبْعِیْنَ اَلْفًا مِّنَ الْمَلاآءِکَۃِ یَزُفُّوْنَہٗ ۔ [رَوَاہُ الدَّارِمِیُّ وَمِشْکَواۃُ الْمَصَابِیْحِ بَابُ الْکَرَامَات]
অর্থাৎ হযরত নুবায়হাহ্ ইবনে ওহাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাবে‘ঈ হতে বর্ণিত, একদিন হযরত কা’ব-ই আহ্বার (তাবে‘ঈ) হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা-এর নিকট উপস্থিত হলেন। অতঃপর সাহাবা-ই কেরাম সেখানে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শান-মানের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে লাগলেন। হযরত কা’ব বললেন, ‘‘এমন কোন দিন উদয় হয় না, যে দিন ৭০ হাজার ফেরেশতা নাযিল হয়ে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর রওযা মোবারক বেষ্টন করে তাঁদের নূরের পাখা বিস্তার করে সন্ধ্যা পর্যন্ত নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দুরূদ ও সালাম পাঠ করেন না। অতঃপর যখন সন্ধ্যা হয়ে আসে, তখন তাঁরা আসমানে আরোহণ করেন এবং তাঁদের অনুরূপ সংখ্যার (৭০ হাজার) ফেরেশতা অবতরণ করে তাঁদের মতই দুরূদ ও সালাম পাঠ করতে থাকেন। আবার ক্বিয়ামতের দিন যখন যমীন (রওযা মোবারক) বিদীর্ণ হবে, তখন তিনি ৭০ হাজার ফোরেশতা দ্বারা বেষ্টিত হয়ে প্রেমাষ্পদের রূপে আসল প্রেমিকের সাথে শীঘ্র মিলিত হবেন।’’ [দারেমী ও মিশকাত-বাবুল কারামত]
উল্লেখিত হাদীস শরীফের নিন্মোক্ত বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রণিধানযোগ্যঃ
১. হযরত কা’ব-ই আহবার রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর রওযা মুবারকে ৭০ হাজার ফেরেশতা নাযিল হতে নিজে প্রত্যক্ষ করেছেন। এটি তাঁর কারামত ছিলো।[লুম‘আত]
২. হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার উপস্থিতিতে হযরত কা’ব এ সাক্ষ্য দিয়েছেন।
৩. রওযা মুবারকে দিনে ৭০ হাজার এবং রাতে ৭০ হাজার ফেরেশতা নাযিল হন এবং তাঁদের ডিউটি হলো- রওযা মোবারক বেষ্টন করে নূরের পাখাগুলো রওযা মোবারকের উপর সামিয়ানা স্বরূপ বিছিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুরূদ ও সালাম পাঠ করা।
সুতরাং মুসলমানগণ ফিরিশতাদেরই অনুকরণে ক্বিয়াম সহকারে দুরূদ ও সালাম পড়ে থাকেন। [আন্ওয়ার-ই আফতাব-ই সাদাক্বাত]
৪. হাদীসে উল্লেখিত مِثْلُهُمْ শব্দ দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, সবসময় ফেরেশতাদের নিত্য নতুন দল আসে। জীবনে একবারই তাঁরা এ সুযোগ পেয়ে থাকেন। ৫. উক্ত ফেরেশতারা বিশেষ করে ক্বিয়াম সহকারে দুরূদ শরীফ পড়েন। ৬. রওযা মোবারকে পালাক্রমে দিন-রাত ২৪ ঘন্টা মীলাদ শরীফ পাঠ ও ক্বিয়াম করা হয়। ৭. মীলাদ মাহফিলে উত্তমরূপে আলোক সজ্জিত করা ও সামিয়ানা টাঙ্গানো বৈধ। ৮. নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে দাঁড়ানোর জন্যে তিনি চোখের সামনে উপস্থিত থাকা পূর্বশর্ত নয়। কেননা, ফেরেশতাদের চোখের সামনে হয়তো শুধু রওযা মোবারক পরিদৃষ্ট ছিলো। ৯. ক্বিয়ামত-দিবস পর্যন্ত ক্বিয়ামসহকারে দুরূদ ও সালামের এ ধারা অব্যাহত থাকবে। দুশমনরা তা বন্ধ করতে পারবে না। ইমামে আহলে সুন্নাত আ’লা হযরত আহমদ রেযা খান বেরলভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি লিখেছেন-
ذکر میلادالنَّبی کرتا رہونگاعمر بھر ۔جلتے رہو نجدیو جلنا تمہارا کام ہے
অর্থাৎ ‘‘আমরা মীলাদুন্নবীর মাহফিল জীবনভর করে যাবো। হে নজদীগণ! তোমরা জ্বলতে থাকো। জ্বলে মরাই তোমাদের কাজ।’’ [আ’লা হযরত]
১০. ক্বিয়ামত পর্যন্ত রওযা মুবারক অক্ষত থাকবে। ১১. রোজ হাশরে ৭০ হাজার ফেরেশতা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে পরিবেষ্টন করে ও জুলূস সহকারে আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে নিয়ে যাবেন। নবী করীমের মীলাদ-ই পাক উপলক্ষে আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে প্রিয় মাহবূবের সাক্ষাৎ হবে। [লুম‘আত]
নয়. ইজমা’ দ্বারা মীলাদুন্নবী উদ্যাপন প্রমাণিত
তাফসীরে রুহুল বয়ানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘‘পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসে ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অনুষ্ঠান বর্তমানকার প্রচলিত নিয়মে আনুষ্ঠানিকভাবে আরম্ভ হয় ৬০৪ হিজরীতে। হযরত ইমাম তক্বিউদ্দীন সুবকী মিশরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ছিলেন ওই যুগের শ্রেষ্ঠ মুজতাহিদ ও ইমাম। একদিন তাঁর দরবারে ওই যুগের বিখ্যাত ওলামা-ই কেরামের সমাবেশ ঘটেছিলো। ইমাম তক্বিউদ্দীন রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁদের উপস্থিতিতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রশংসায় ইমাম সরসরী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি কর্তৃক রচিত দু’ লাইন কবিতা পাঠ করেন। চরণ দু’টি ছিল নিন্মরূপঃ
قَلِیْلٌ لِمَدْحِ الْمُصْطَفٰی اَلْخَطُّ بِالذَہَبٖ ۔عَلٰی وَرَقٍ مِّنْ خَطٍّ اَحْسَنُ مِنْ کُتُبٖ
وَاَنْ تَنْہَضَ الْاَشْرَافُ عِنْدَ سَمَاعِہٖ ۔قِیَامًا صُفُوْفًا اَوْجِثِیًّا عَلَی الرُّکَبِ
অর্থাৎ ‘‘সুন্দরতম কিতাবের পাতায় স্বর্ণাক্ষরেও যদি নবী মোস্তফার নাম অঙ্কন করা হয়, তবুও তাঁর বিশাল মর্যাদার তুলনায় তা অতি নগণ্য। অনুরূপ, শুধু তাঁর নাম শুনেও যদি উচ্চ পর্যায়ের লোকেরা সারিবদ্ধভাবে ক্বিয়াম করে (দাঁড়িয়ে যায়) অথবা আরোহী অবস্থায়ও নতজানু হয়ে যায়, তবুও তা তাঁর মহান মর্যাদার তুলনায় অতি নগণ্যই হবে।’’
সরসরীর কবিতার উক্ত চরণ দু’টি পাঠ করার সময়ে ইমাম তক্বিউদ্দীন সুবকী ও উপস্থিত ওলামায়ে কেরাম নবী করীমের সম্মানে দাঁড়িয়ে গেলেন। মজলিসে নবী-প্রেমের ঢেউ খেলে গেলো। সকলেই ভাবের আবেগে আপ্লুত হলেন। মীলাদ শরীফে ক্বিয়ামের বৈধতার ক্ষেত্রে ইমাম তক্বিউদ্দীন সুবকী ও উপস্থিত ওলামায়ে কেরামের উক্ত ক্বিয়ামের অনুসরণ করাই যথেষ্ট। কেননা, এ ক্বিয়াম হলো নবী করীমের পবিত্র জন্মের শুভ সংবাদ উপলক্ষে তা’যীমী ক্বিয়াম। নবী করীমের উপস্থিতি এখানে পূর্বশর্ত নয়- যদিও তিনি উপস্থিত হতে পারেন। [তাফসীরে রুহুল বয়ান ৯ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫৬]
দশ. উম্মত ও ওলামা-ই কেরামের ইজমা’
প্রথা ও অনুষ্ঠান হিসাবে নতুন হলেও মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়ামের মূল ভিত্তি হচ্ছে ক্বোরআন ও সুন্নাহ্। কেননা রোযে আযলে আল্লাহ্ তা‘আলা মীলাদ শরীফের বর্ণনাকালে সম্মানিত নবীগণের মাহফিলের আয়োজন করেছিলেন এবং নিজে ছিলেন মজলিসের প্রধান। অনুরূপ, সম্মানিত নবীগণ আপন আপন উম্মতের মাহফিলে মীলাদুন্নবীর আলোচনা করেছেন বলে ক্বোরআনেই সূরা-ই সাফ্ (২৮ পারায়) উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তীকালে (৬০৪হিজরী) শুধু আনুষ্ঠানিকতার বিষয়টি নূতন হওয়ার কারণে বিদ্‘আতে হাসানাহ্ ও মুস্তাহাব-এর পর্যায়ভুক্ত হয়েছে বলে সকল আলিমের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ কারণে মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়াম সকল ওলামা-ই কেরামের ইজমা’ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও সর্বত্র তা অনুসৃত। মুসলমানদের সর্বোৎকৃষ্ট শ্রেণীর আলিমদের ইজমা’র গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে ক্বোরআন মজিদে এরশাদ হয়েছেঃ
وَمَنْ یُّشَاقِقِ الرَّسُوْلَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَیَّنَ لَہُ الْہُدٰی وَیَتَّبِعْ غَیْرَ سَبِیْلِ الْمُؤْمِنِیْنَ نُوَلِّہٖ مَا تَوَلّٰی وَنُصْلِہٖ جَہَنَّمَ وَسَآ ءَ تْ مَصِیْرًا [سورۃ نساء آیت ۱۱۵]
অর্থাৎ রাসূলের কাছে হিদায়ত প্রকাশিত হওয়ার পর যে কেউ তাঁর বিরুদ্ধাচারণ করে এবং মুসলমানদের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে যে কেউ চলে, আমি তাকে ওই পথেই চালাবো, যে পথ সে অবলম্বন করেছে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো। আর জাহান্নাম হচ্ছে নিকৃষ্টতম স্থান।’’ [সূরা নিসা: আয়াত-১১৫]
উক্ত আয়াত অনুসারে, রাসূল-ই করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বিরোধিতা এবং মুসলমানদের অনুসৃত ঐকমত্যের বিরোধিতা উভয়টির পরিণামই জাহান্নাম। মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়াম সকল মুসলমানের অনুসৃত পথ। সুতরাং এর বিরোধিতার পরিণামও ভয়াবহ। সকলের অনুসৃত পথকে ‘ইজমা-ই উম্মত’ বলা হয়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
لاَ تَجْتَمِعُ اُمَّتِیْ عَلَی الضَّلاَلَۃِ
অর্থাৎ ‘‘আমার সকল উম্মত গোমরাহীর কাজে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না।’’ সুতরাং মীলাদ ও ক্বিয়াম যে মন্দ কিছু নয়, তা সমগ্র উম্মত দ্বারা অনুসৃত ও গৃহীত হওয়া-ই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ‘নুরুল আনওয়ার’ গ্রন্থে ইজমা’ অধ্যায়ে উপরের আয়াতকে ইজমা’-ই উম্মতের একটি অকাট্য দলীল হিসেবে পেশ করা হয়েছে। একবার কোন বিষয়ে ইজমা’ হয়ে গেলে পরবর্তী যুগে কেউ-এর বিরোধিতা করলে বা ইখ্তিলাফ করলেও তা গ্রহণযোগ্য হবে না বলে উক্ত কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যদিও বিরোধীদলের সংখ্যা পরবর্তীকালে বেশী হয়ে যায়।
পরবর্তীকালে মীলাদ ও ক্বিয়ামের বিরুদ্ধে মালেকী মাযহাবের শেষ যুগের একজন আলিম তাজুদ্দীন ফাকেহানী মালেকী বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে সেটাকে তথাকথিত নিকৃষ্টতম বিদ্‘আত বলে উল্লেখ করেছেন; যেমন- কোথাও গান-বাজনার সংযোজন, মেয়েলোকদের বেপর্দাভাবে উপস্থিতি, উচ্চস্বরে তাদের না’ত পাঠ করা ও ক্বসীদা পাঠ করা ইত্যাদি। এগুলো তার যুগে হয়তো মীলাদ ও ক্বিয়ামের অনুষ্ঠানে অনুপ্রবেশ করেছিলো কারণেই হয়তো তিনি ওই যুগের প্রচলিত মীলাদ-ক্বিয়ামকে নাজায়েয বলেছেন। (যেমনটি ‘মীলাদে সূয়ূত্বী’তে সেটার খণ্ডনসহকারে উল্লেখ করা হয়েছে।) মালেকী মাযহাবের অন্যান্য ওলামা-ই কেরামসহ চার মাযহাবের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম তাজুদ্দীন ফাকেহানীর উক্ত ফাত্ওয়ার খণ্ডন করে মীলাদ-ক্বিয়ামের পক্ষে বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। ইবনে হাজর আসক্বালানী ও জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী আলায়হিমার রাহমাহ্ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সুতরাং উল্লিখিত কারণগুলোর ভিত্তিতে তাজুদ্দীন ফাকেহানীর বিরোধিতা ইজমা’র সিদ্ধান্তকে বাতিল করতে পারে না।
মোটকথা, ঈদে মীলাদুন্নবীর পক্ষে বিস্তারিত দলীলসহ আলোচনা করা হলো। আরো আরয করা হলো যে, ক্বোরআন ও হাদীসে মীলাদ এবং ক্বিয়ামের মূল সূত্র বর্ণিত হয়েছে। পরবর্তীকালে যুগের চাহিদা অনুযায়ী স্বতন্ত্রভাবে মিলাদ ও ক্বিয়ামের পৃথক পৃথক মাহফিলের প্রচলন শুরু হয়েছে। যেমন প্রচলন হয়েছে জামা‘আতের সাথে বিশ ‘রাক্‘আত তারাবীহ্, ক্বোরআন একত্রীকরণ, ক্বোরআন সংকলন, জুমু‘আহ্র প্রথম আযান, আরবী ব্যাকরণ, ক্বোরআনের নোক্বতাহ্ ও হরকত সংযোজন, রুকু’, পারা মনযিল ইত্যাদির সংযোজন, যা নবী করীমের যুগে ছিলো না। নবী করীমের যুগের পরে সংযোজিত হওয়ার কারণে এগুলো বিদ্‘আত-ই হাসানার অন্তর্ভুক্ত হয়ে কোনটি ওয়াজিব, কোনটি সুন্নাত, কোনটি মুস্তাহাব হয়েছে। তারাবীহ্ নামায জামা‘আতের সাথে প্রচলন হয়েছে হযরত ওমর ফারূক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর আমলে। এটা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ্। জুমু‘আর প্রথম আযান প্রচলন করেছেন হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু। এটি সুন্নাত। আরবী ব্যাকরণ প্রচলন করেছেন হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এবং এটি শিক্ষা করা ওয়াজিব। ক্বোরআনের নোক্বতাহ্ ও হরকত সংযোজন করেছেন হাজ্জাজ ইবনে ইয়ূসুফ, উমাইয়া শাসক ৮৬ হিজরীতে। এটা মুস্তাহাব। সব মিলিয়ে এগুলোকে বিদ‘আতে হাসানাহ্ (উত্তম বিদ্‘আত) বলা হয়। তাই এগুলো পরিত্যাজ্য হয় কীভাবে? মীলাদ এবং ক্বিয়ামের প্রচলনও অনুরূপ মুস্তাহাব পর্যায়ের বিদ্‘আত। তা ৬০৪ হিজরীতে সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। ইমাম ইবনে হাজর হায়তামী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন-
اِنَّ الْبِدْعَۃَ الْحَسَنَۃَ مُتَّفَقٌ عَلٰی نُدْبِہَا وَعَملُ الْمَوْلِدِ وَاِجْتِمَاعُ النَّاسِ لَہٗ کَذَالِکَ اَیْ بِدْعَۃٌ حَسَنَۃٌ ۔ (تَفْسِیْرِ رُوْحُ الْبَیَانِ جلد ۹ صفحہ ۵۷)
অর্থাৎ বিদ‘আতে হাসানার কাজ মোস্তাহাব হওয়ার উপর সকল বিজ্ঞ আলিমদের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং মীলাদ শরীফের আমল ও সেটার উদ্দেশ্যে লোকদের মাহফিল করা অনুরূপ মুস্তাহাব। [তাফসীর রুহুল বয়ান, ৯ম খণ্ড, পৃ.৫৬]