বিদ’আত, মীলাদ ও শরীয়ত প্রসঙ্গ – হাফেজ মুহাম্মদ আশরাফুজ্জামান আলকাদেরী

বিদ’আত, মীলাদ ও শরীয়ত প্রসঙ্গ – হাফেজ মুহাম্মদ আশরাফুজ্জামান আলকাদেরী

বিদ’আত, মীলাদ ও শরীয়ত প্রসঙ্গ

হাফেজ মুহাম্মদ আশরাফুজ্জামান আলকাদেরী

মুহাদ্দিস: জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া, চট্টগ্রাম।

 ==========

নদভি সাহেব, তার “বিশ্ব বিদআত” নামের হাস্যকর ও চটি পুস্তিকাটিতে ‘বিদআত’ শব্দ সম্বলিত দু’তিনটি হাদীস উল্লেখ করে পবিত্র মীলাদুন্নবী উদ্যাপনকে বিদআত বলে আখ্যায়িত করার অপপ্রয়াস চালিয়েছেন। কিন্তু আদ্যোপান্ত পুস্তিকাটির কোথাও বিদআতের সংজ্ঞা মানে শরীয়তের দৃষ্টিতে‘বিদআত’ কাকে বলে লিখেন নি। কারণ কথায় বলে, ‘মাজনূন বকারে খোদ হুশিয়ার আস্ত’। তখন তো ‘শখের হাঁড়িটা মাঠে নয় ঘাটেই চুরমার হয়ে যাবে।’

সম্মানিত পাঠক সমাজ! এবার মহান শরীয়তের আলোকে সর্বপ্রথম সরলমনা সাদাসিধে মুসলমানদের ঈমান হরণকারী, ‘মান্নাউল লিল খায়র’ অর্থাৎ যেকোন পূণ্যময় কাজে বিদ’আতের ধুয়োঁ তুলে বাধা দানকারী ‘বিশ্ব বিদআতী’দের স্বরূপ উন্মোচনে ‘বিদআত’ কথাটি বিশ্লেষণ করে দেখি।

বিদ’আতের আভিধানিক অর্থ:

যুগশ্রেষ্ঠ আলেমেদ্বীন আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ইমাম নববী রহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রণীত ‘চল্লিশ হাদীস’ এর ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘ফাতহুল মুবীন’ কিতাবে লিখেছেন- البدعۃ لغۃ ما کان مخترعا علی غیر مثال سابق ومنہ بدیع السموات والارض ای موجد ہما علی غیر مثال سابق অর্থাৎ কোন প্রকার পূর্ব দৃষ্টান্ত ছাড়া নব উদ্ভাবিত কাজকে বিদআত বলা হয়। আর এ অর্থেই মহান আল্লাহর সেফাতী নাম ‘বাদীঊস্ সামা-ওয়া-তি ওয়াল র্আদ্ব’ মানে কোন পূর্ব নমুনা ব্যতীত স্বর্গ-মর্ত্যরে সৃষ্টিকারী।

শরীয়তের পরিভাষায় বিদ’আত: 

আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রহমাতুল্লাহি আলাইহি রদ্দুল মুহতার প্রথম খন্ড ৩৯৩ পৃষ্ঠায় বিদ’আতের সংজ্ঞা শরীয়তের পরিভাষায় এভাবে পেশ করেছেন-

بانہا ماحدث علی خلاف الحق المتلقی عن رسول اللہ ﷺ من علم او عمل او حال بنوع شبہۃ واستحسان وجعل دینا قویما وصراطا مستقیما

অর্থাৎ আকীদা-বিশ্বাস ও আমল কিম্বা প্রচলিত কর্মকান্ডে শরীয়ত সম্মত বা সর্ব সাধারণের জন্য কল্যাণকর মনে করে এমন কোন নতুন বিষয় উদ্ভাবন করে ধর্ম এবং ধর্মীয় কাজ হিসেবে বানিয়ে নেয়া প্রকৃত অর্থে যা রসূলে আকরম নূরে মুজাস্সাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রাপ্ত শরীয়ত‘র বিপরীত হয়।

প্রতীয়মান হল, বর্জনীয় বিদ’আত নিরূপন করতে হলে এর দু‘টো প্রধান বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

এক. তা শরীয়তে ইসলামিয়া অর্থাৎ কোরআন, সুন্নাহ্, ইজমা ও কিয়াসের বিপরীত হবে।

দুই. ইখেলাফে শরা’ কাজটাকে দ্বীন ও ধর্মের অংশ বানিয়ে নেবে।

‘এতদ্ভিন্ন শরীয়তে ইসলামিয়ার একটি সুপ্রসিদ্ধ ও সর্বজন স্বীকৃত বিধান হচ্ছে- الاصل فی الاشیاء اباحۃ  অর্থাৎ প্রকৃত ও মৌলিক দৃষ্টিকোণে প্রতিটি বস্তুই মুবাহ্ মানে জায়েয। যতক্ষণ কোরআন, সুন্নাহ্, ইজমা ও কিয়াসের ভিত্তিতে তাতে কোন মন্দ বা নাজায়েয প্রমাণিত হবেনা ততক্ষণ তাকে মন্দ বা নাজায়েয বলে আখ্যায়িত করা যাবেনা।

সৃষ্টি তথা মানব কল্যাণে ইসলামের উদারতা সত্যিই লক্ষ্যণীয়। মহান আল্লাহ্ তায়ালা বলেন-  ہو الذی خلق لکم ما فی الارض جمیعا  অর্থাৎ আল্লাহ্, সে মহান সত্ত্বা যিনি পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। [সূরা বাক্বারা, আয়াত-২৯

الم تروا ان اللہ سخرلکم ما فی السموت وما فی الارض واسبغ علیکم نعمہ ظاہرۃ وباطنۃ

অর্থাৎ তোমরা কি এ সত্যটি চিন্তা করে দেখনি? যে মহান আল্লাহ্ পাকই জমিনে আসমানে সকল জাহের-বাতেন নেয়ামত ও সকল বস্তু তোমাদের কল্যাণে তোমাদেরই আয়ত্ব করে দিয়েছেন। [সূরা লোকমান, আয়াত-২০]

বিশেষ কোন কারণে আল্লাহ্ রসূলের পক্ষ থেকে যেসব বস্তু কিম্বা কর্মের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে তা খুবই সীমিত এবং সুনির্দিষ্টও নিশ্চয়ই। মহান আল্লাহ্ এরশাদ ফরমান- وقد فصل لکم ما حرّم علیکم (الانعام)

 অর্থাৎ- আল্লাহ্ তায়ালা তোমাদের নিষিদ্ধ বস্তুগুলো বিস্তারিতভাবেই বলে দিয়েছেন।

হুজূর রসূলে মাকবূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান-

الحلال ما احل اللہ فی کتابہ والحرام ما حرم اللہ فی کتابہ وماسکت عنہ فہو مما عفالکم ترمذی وابن ماجہ

অর্থাৎ “হালাল আর হারাম সেগুলোই যেগুলোর ব্যাপারে মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে হালাল কিম্বা হারাম বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেসকল ব্যাপারে নীরব রয়েছেন তোমাদের জন্য তা ক্ষমাযোগ্য।”

ইসলাম নিতান্তই সহজ ধর্ম:

আল্লাহ্ তায়ালা বলেন-  لایکلف اللہ نفسا الا وستعہا অর্থাৎ মহান আল্লাহ্ কাউকে সামর্থের বাইরে কষ্ট দেন না। এরশাদ یرید اللہ بکم الیسر ولا یرید بکم العسر  মানে- আল্লাহ্ পাক তোমাদের জন্য সহজতর ব্যবস্থাই চান, কোন কঠিন কিম্বা সঙ্কীর্ণ ব্যবস্থা নয়। অন্যত্র ফরমান- فانما یسرنہ بلسانک لعلہم یتذکرون (الدخان) অর্থাৎ হে রসূল মহাগ্রন্থ কোরআনুল হাকীমকে আমি আপনার জবান পাকে অতীব আসান করে দিয়েছি যাতে তারা সহজেই এর উপদেশগুলো গ্রহণ করতে পারে। প্রিয় নবীজি এরশাদ ফরমান- بعثت الحنفیۃ السمحۃ হে মানব জাতি! আমি সত্য-মিথ্যা তথা হক্ব ও বাতিলের মাঝে পার্থক্য নিরুপণকারী একটি সহজতম জীবন ব্যবস্থাসহ প্রেরিত হয়েছি।

যারপর নাই অনুতাপ:

আশ্চর্যই লাগে, ইসলাম প্রদানকারী ও ইসলামের প্রবর্তনকারী আল্লাহ্-রসূল বলেন ইসলাম বড়ই সহজ।  لا اکراہ فی الدین বলে যে ধর্ম নিজেকে সকল সঙ্কর্ণীতার উর্ধ্বে বলে ঘোষণা দেয় তারই অনুসারী হওয়ার দাবীদার হয়ে কথায় কাজে আচার অনুষ্ঠানে এমন সঙ্কীর্ণতা প্রদর্শন করে যা স্বয়ং দ্বীনদার মুসলমানকেও ভাবিয়ে তোলে।

পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ প্রদত্ত দর্শনের ভিত্তিতে হালাল ও হারামের যে ধারণা পাওয়া যায় তা হচ্ছে-

এক. পবিত্র কোরআন যেটা না জায়েয বলেনি।

দুই. সুন্নাতে নববীর আলোকে যা নাজায়েয বলে সাব্যস্ত হয়নি।

তিন. সাহাবায়ে কেরামের কথা ও কাজে যা নাজায়েয বলে গণ্য হয়নি এবং

চার. ইজমা-এ উম্মত যে কাজের হারাম হওয়ার ব্যাপারে একমত নয়।

নিঃসন্দেহে তা  الاصل فی الاشیآء اباحۃ  (প্রত্যেক বস্তুই মৌলিক দৃষ্টিকোণে মুবাহ মানে জায়েয) এই মূল নীতির ভিত্তিতে জায়েয বলে পরিগণিত হবে।

নদভী সাহেব! অসংখ্য পরিতাপ আপনাদের জন্য। কাফির-মুশরিকদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হওয়া পবিত্র কোরআনের বাণীগুলো যুগে যুগে খাঁটি দ্বীনদার সুন্নী মুসলমানদের জন্য ব্যবহার করার দারুন্ নাদ্ওয়া থেকে প্রাপ্ত যে পুরোনো অভ্যাস নদভী -নজদীরা ছাড়তে পারবেনা এটাই স্বাভাবিক। তাইতো এমন ধরণের কিছু আয়াত নদভী সাহেব তার বিশ্ববিদআত পুস্তিকায় উল্লেখ করেছেন। বুকে হাত দিয়ে বলুন তো নদভী সাহেব আপনাদের হামখেয়াল কিছু পুরোনো মুরব্বী যেমন, ফাকেহানী, বাগদাদী গংদের দু’একটি মনগড়া মন্তব্য সম্বলিত বক্তব্য ছাড়া পবিত্র কোরআন ও হাদীসের যে বাণীগুলো পেশ করে মূর্খ পন্ডিত বাহাদুর সেজে ‘মীলাদ’কে বিদআত প্রমাণ  করার অর্থহীন ও ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন তার সাথে মীলাদুন্নবী উদ্যাপন সংক্রান্ত কোন বিষয়ের দূরবর্তী সম্পর্কও আছে কি?

অথচ পূন্যময় অনুষ্ঠান মীলাদুন্নবী’র বিরোধিতা করতে গিয়ে আপনাদের মৌলিক আক্বীদা আমলের বিরুদ্ধে হলেও মুসিলম মিল্লাতের কাছে গ্রহণীয় কিছু বিষয়ের প্রশংসনীয় অবতারণা করেছেন। যেমন- প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম‘র বিভিন্ন অবস্থানের জায়গা এমনকি তিনি পেশাব মোবারক করেছেন এমন স্থানসমূহ খোঁজ নিয়ে নিয়ে সাহাবীগণ যিয়ারত করতেন। সম্ভব হলে মসজিদ নির্মাণ করে ঐ স্থানকে স্মরণীয় করে রাখার চেষ্টা করতেন। পবিত্র কোরআন সুন্নাহয় এর নির্দেশনা মূলক কোন বর্ণনাই আসেনি।

পক্ষান্তরে, ধরাধামে প্রিয় নবীর শুভাগমন মানে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম‘র ঐতিহাসিক, বাস্তবে মহান স্রষ্টার সৃজন শীল্পে সময়ে গতিধারায় সর্বশ্রেষ্ঠ দিনক্ষণ মুহূর্ত সমৃদ্ধ বারই রবিউল আউয়াল ও সোমবার দিবসটির স্মরণ, পালন ও উদ্যাপনের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নির্দেশ বর্ণনা থাকা সত্ত্বেও পবিত্র কোরআন-সুন্নাহয় ‘মীলাদ’খুঁজে পাচ্ছেন না, ‘আলেম’ নামটির সাথে এসব কিছু মোটেও মানায়না।