শাহানশাহ্ এ সিরিকোট শীর্ষক সেমিনারের প্রবন্ধ : মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার

শাহানশাহ্ এ সিরিকোট শীর্ষক সেমিনারের প্রবন্ধ : মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার

শাহানশাহ্ এ সিরিকোট (র): বিশ্বব্যাপি সুন্নিয়তের জাগরণে তাঁর অবদান,
শীর্ষক সেমিনারের মূল প্রবন্ধ 

 মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার 

 

১৬ জিলক্বদ ১৪৩৯ হিজরি, ৩০ জুলাই, ২০১৮, সোমবার,
স্থান: জমিয়তুল ফালাহ্ জাতীয় মসজিদ চট্টগ্রাম।
আয়োজনে: গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ, কেন্দ্রীয় পরিষদ

গাউসে জামান, সৈয়্যদুল আউলিয়া,পেশওয়ায়ে আহলে সুন্নাত, আল্লামা হাফেজ সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি, পেশোয়ারী (র),কালে কালে কখনো ‘আফ্রিকাওয়ালা পীর’, কখনো ‘সীমান্ত পীর’, কখনো ‘পেশওয়ারী সাহেব’, শেষের দিকে ‘সিরিকোটি হুজুর’, এমনকি চট্টগ্রামে শুভ আগমনের শুরুতে ‘ইন্জিনিয়ার সাহেবের পীর’ হিসেবেও অভিহিত হতেন। এই ক্ষণজন্মা মহান সংস্কারক অলীই এই নিবন্ধে ‘শাহানশাহ্ এ সিরিকোট’ উপাধিতে আলোচিতব্য। আজ বাংলাদেশ’র সুন্নি অঙ্গনে এই ‘শাহানশাহ্ এ সিরিকোট’ একটি প্রাতঃস্মরণীয় নাম, একটি জাগরণী শ্লোগান। শাহানশাহ্ এ সিরিকোট’র জন্ম পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের বর্তমান খাইবার পাখতুন প্রদেশের বিখ্যাত মাশওয়ানি, ‘সৈয়্যদ’ অধ্যুষিত ‘সিরিকোট’ পার্বত্য অঞ্চলের শেতালু শরিফে ১৮৫৬-৫৭ খ্রিষ্টাব্দে বা তারও কয়েকবছর আগে। তিনি বংশ পরম্পরায় হযরত ইমাম হোসাইন (রা)’র মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ৩৮তম অধস্তন বংশধর।
[শাজরা শরীফ, প্রকাশনায়, আনজুমান -এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট] ইমাম হোসাইন (রা)’র পঞ্চম অধস্তন বংশধর সৈয়্যদ জালাল আর রিজাল (রা) মদিনা পাক ছেড়ে ইরাকের ‘আউস’ এ চলে আসেন। পরবর্তিতে তাঁর ৫ম অধস্তন বংশধর মীর সৈয়্যদ মুহম্মদ গেসুদারাজ সুলতান মাহমুদ গজনবী (র)’র সময়ে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে আফগানিস্তান হিজরত করেন, এবং তাঁর সাথে ভারত অভিযানেও শরীক হন। আফগান-বেলুচিস্তানের সীমান্তের ‘কোহে সোলাইমানি’তে তিনি শায়িত আছেন, যে জায়গাটি সুলতান গজনবীর উপহার হিসেবেই তিনি লাভ করেন, এবং এখানে বসেই তিনি মুলতান পর্যন্ত ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে দিয়ে ৪২১ হিজরিতে ওফাত বরণ করেন, আর এই সময়টা ছিল খাজা গরীব নওয়াজ মঈনুদ্দিন চিশতি(র)র ভারত আগমনের দুইশ বছর আগে। এ গেসুদারাজ (আউয়াল)’রই ১২ তম অধস্তন পুুরুষ হলেন সিরিকোট বিজয়ী, ফাতেহ্ সিরিকোট সৈয়্যদ গফুর শাহ্ ওরফে কাপুর শাহ্ (র)। [Local govt. Act: (Ref-15) Hazara 1871] তিনি আফগানের কোহে সোলাইমানি হতে হিজরত করে উত্তর- পশ্চিম সীমান্তের কোহে গঙ্গরে আসেন এবং অত্যাচারী শিখ রাজাদের প্রতিহত করে যে এলাকাটি ইসলামের জন্য আবাদ করেন এর বর্তমান কেন্দ্রস্থল ‘সিরিকোট’। ‘সের’ মানে মাথা, আর কোহ্ ‘হল পাহাড়। ‘সেরকোহ’ মানে ‘পাহাড়ের চূঁড়া’ বা পাহাড় শীর্ষ। এই ইসলাম বিজয়ী বীর হযরত সৈয়্যদ গফুর শাহ্ ওরফে কাপুর শাহ্ (র) গঙ্গর পাহাড়ের একদম মাথায় বসবাস করতেন বিধায় তাঁর আবাস বুঝাতে ‘সেরকোহ্ শব্দটি ব্যবহার হয়, এবং কালের বিবর্তনে মানুষের মুখে শব্দ পরিবর্তনের স্বাভাবিক ধারায় বর্তমানে এ এলাকা ‘সিরিকোট’ হিসেবে পরিচিত হয়েছে। ফাতেহ্ সিরিকোট সৈয়্যদ গফুর শাহ্ (র)’র ১৩ তম অধস্তন পুুরুষ হযরত সৈয়্যদ সদর শাহ্ (র)’র ই শাহজাদা হলেন এই প্রবন্ধে আলোচিত শাহানশাহ্ এ সিরিকোট, আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি, পেশোয়ারী (র)। [শাজরা শরীফ, প্রকাশনায়, আনজুমান -এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট] সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়ার এই মহান দিকপাল শুধু কাদেরিয়া ত্বরিকাকে নয়,এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে ভ্রমন করে সুন্নিয়ত কেও পূনর্জাগরিত করেছিলেন তাঁর শতাধিক দীর্ঘ হায়াতে তাইয়্যেবাকে কাজে লাগিয়ে। তাই আজ বাংলাদেশ-বার্মা, আফ্রিকা-পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য সহ পৃথিবীর বহুদেশ-জনপদে একটি আদর্শ, একটি প্রেরণার নাম হলেন শাহানশাহে সিরিকোট (রহ.)।

ক. শিক্ষা-দীক্ষা
ঐতিহ্যগত উন্নত পারিবারিক শিক্ষা, তালিম, তারবিয়তের পাশাপাশি তিনি ছিলেন পরিত্র কোরানে করিমের হাফেজ। কোরান, হাদিস, উসুল-ফেকাহ্ ইত্যাদি দ্বীনিয়াত বিষয়ে শিক্ষা তিনি স্থানীয় আটক জেলা সহ ভারত-পাকিস্তানের বিভিন্ন মাদ্রাসার উপযুক্ত ওস্তাদগন থেকে আয়ত্ব করেন। লিখিত সনদ অনুসারে, ১২৯৭ হিজরির শা’বান মাসে তাঁকে ‘মমতাজুল মুহাদ্দেসীন’ সনদ প্রদান করে দস্তারে ফজিলত অর্পন করা হয়।
যা ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের কোন এক তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ প্রদান করেন। তাঁর ত্বরিকত জীবনের দীক্ষা গুরু ছিলেন হরিপুরের বিখ্যাত কামেল অলী, গাউসে দাঁওরা, খলিফায়ে শাহে জীলাঁ, খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী আল আলাভী (র)।
[শাজরা শরীফ, প্রকাশনায়, আনজুমান -এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট] ১৯১২ তে, আফ্রিকা হতে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তিনি শত শত বছরের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার এমন কামেল মুর্শিদের হাতে বয়াত গ্রহন করে ত্বরিকত জীবনের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেন। তাঁর পীর খাজা চৌহরভী (র)’র আধ্যাত্মিক মর্যাদার অনুমান সাধারনের জন্য সাধ্যাতীত। যিনি প্রাতিষ্ঠানিক-আনুষ্ঠানিক কোন প্রকারের শিক্ষার্জনের সুযোগ লাভ করতে পারেননি, অথচ তাঁর অদৃশ্য আধ্যাত্মিক ‘ইলমে আতায়ি’ দিয়ে রচনা করে গেছেন ১৮ টি কিতাব। এর একটি কিতাব হল ৩০ পারা বিশিষ্ট দরুদ গ্রন্থ ‘মজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’, যা বড় বড় আল্লামাদের পর্যন্ত আক্বল হয়রান হবার মত একটি কিতাব। দুনিয়ার বুকে কোরান শরিফ, বোখারি শরিফের পর এটিই তৃতীয় ৩০ পারা কিতাব যা মাকসাদ হাসিল ও বরকতের জন্য খতম দেওয়ার রেওয়াজ চালু আছে। বিশুদ্ধ আরবীতে রচিত এ অনবদ্য দরুদ গ্রন্থের একটি কপি মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের এক আরব পাঠকের নজরে আসবার পর, তিনি কিতাবটির মলাটে আরবিতে একটি মন্তব্য লিখে যান যে, ‘‘এটা কখনো কোন অনারবের রচনা হতে পারেনা’’। উল্লেখ্য, যেহেতু এ বিরল দরুদ গ্রন্থের লেখক খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী (র)’র পরিচয় হল তিনি পাকিস্তানের হরিপুর জেলার বাসিন্দা, একজন অনারব। অর্থাৎ অনারবের পক্ষে এত উচ্ছাঙ্গের আরবী ভাষার কিতাব রচনা কখনও সম্ভব হবার কথা না।

খ. ইসলামের মূলধারা ‘সুন্নিয়ত’
কোরান-সুন্নাহ্, এজমা-কেয়াস এবং মাজহাব ও সূফিবাদের সুসামন্জস্যপূর্ণ বিশ্বাস ও আমলই মূলত সুন্নিয়ত। এটাই ইসলামের মূলধারা। এ আক্বিদা-আমলের মুসলমানরাই সুন্নি মুসলমান। সুন্নি মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে, শুধু শরিয়তের অনুসরণ সফলতার জন্য যথেষ্ট নয়, দরকার তাসাওফের পথ ত্বরিকতও। আবার শরিয়ত বাদ রেখে শুধু ত্বরিকত-মারেফাত চর্চা সুন্নিয়তে গ্রহণযোগ্য নয়। উল্লেখ্য, এমন সুসামঞ্জস্যপূর্ণ অবিতর্কিত আদর্শের অনুসারী সফল পুরুষগনের মধ্যে হযরত গাউসুল আযম জিলানী, খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি, শেহাবুদ্দিন ওমর সোহরাওয়ার্দী, বাহাউদ্দিন নক্সবন্দী, মুজাদ্দিদ আল ফেসানি (র)’র পথ ও মত কাদেরিয়া, চিশতিয়া, সোহরাওয়ার্দীয়া, নক্সবন্দীয়া ইত্যাদি নামে পরিচিত। উক্ত মূল ত্বরিকত দর্শনের অনুসরণে এবং সিলসিলাহ্ পরম্পরায় পরবর্তিতে আরো কিছু ত্বরিকত দর্শন আত্মপ্রকাশ করলেও প্রথমোক্ত চারটিই বিশ্বব্যাপি বহুলভাবে সমাদৃত ও পরিচিত। উল্লেখ্য, ত্বরিকত সমূহের উক্ত মূলধারার অপর নামও কিন্তু সুন্নিয়ত। যদিও এসব ধারার অনুসারী দাবিদারদের মধ্যে ইদানিং কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিয়া ও ওহাবী মতবাদের আক্বিদা -আমল ও আচরণ লক্ষ্যণীয়। এরপরও, সহজভাবে আমরা সুন্নি বলতে বুঝব কোরান -সুন্নাহ্ -এজমা, কেয়াস -মাজহাব -ত্বরিকতে বিশ্বাসী ও অনুসারী বৃহত্তর ইসলামি জনগোষ্ঠীকে। এরাই, হাদিস শরীফে নির্দেশিত একমাত্র নাজাতপ্রাপ্ত দল ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত’। যাদের পরিচয় হল ‘‘মা আনা আ’লাইহি ওয়া আসহা-বি।’’ [আল হাদিস]

গ.বিশ্বব্যাপি সুন্নিয়ত প্রচারে শাহানশাহ্ এ সিরিকোটের কর্মযজ্ঞ
হযরত সিরিকোটি (র) ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আনুষ্ঠানিকতার ইতি টানবার পর থেকেই নিজেকে দ্বীনের কাজে নিয়োজিত করে দ্বীনি শিক্ষাকে কাজে লাগাতে শুরু করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি অবদান এ প্রবন্ধের শিরোনামের প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় সংক্ষেপে তুলে ধরলামঃ

দক্ষিণ আফ্রিকায় ইসলাম প্রচার
১৮৮০-১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে, তিনি প্রথমে আপন মাশওয়ানি সৈয়্যদ ‘বংশের এক তাপসী নারীর সাথে পারিবারিক ঐতিহ্যানুযায়ী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, এরপরই কোন এক সময়ে ইসলাম প্রচারের ব্রত নিয়ে পূর্বপুরুষ আহলে বাইত (রা) গনের পথ ধরে দক্ষিণ আফ্রিকায় ছুটে যান ইসলাম প্রচারের কাজে। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্যাপটাউন, মোম্বাসা ও জাঞ্জিবারের বিভিন্ন জনপদে তাঁর হাতে অসংখ্য স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে। Dr Ibrahim M Mahdi মাহাদি লিখিত A short history of Islam in South Africa গ্রন্থের স্বীকৃতি অনুযায়ী এ সব অঞ্চলের ইসলাম প্রচারকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সফলকাম প্রচারক হলেন সৈয়্যদ আহমদ পেশওয়ারী ‘নামক একজন ভারতীয় ব্যবসায়ী। উল্লেখ্য, পাকিস্তান অর্জনের আগেকার ঐ সময়ে সিরিকোটি হুজুর ভারতীয় হিসেবেই পরিচিত হবার কথা। আর তিনি ইসলাম প্রচারের পাশাপাশি সুন্নতি পেশা ব্যবসায় -বানিজ্যের মাধ্যমে আফ্রিকার একজন শীর্ষ ব্যবসায়ী হিসেবেও গন্য হতেন। পরবর্তিতে, ১৯১১ সনে, তাঁর নিজের অর্জিত অর্থে আফ্রিকার প্রথম জামে মসজিদটি তাঁর হাতেই নির্মিত হয়। [Dr.Ibrahim M Mahdi, প্রাগুক্ত] পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রামাণ্য গ্রন্থেও সিরিকোটি হুজুরের আফ্রিকায় ইসলাম প্রচারের তথ্য পাওয়া যায়।
[প্রফেসর ড. মাসউদ আহমদের ইফতিতাহিয়্যা, মুফতী আবদুল কাইয়্যুম হাযরাভী, আল্লামা আবদুল হাকীম শরফ কাদেরী, আল্লামা সৈয়দ আমির শাহ্ গীলানী, ড. মমতাজ আহমদ ছদিদীসহ বিভিন্ন স্কলারদের কিতাব] বিশেষত, তাঁর বড় নাতি, দরবারে আলিয়া কাদেরিয়া সিরিকোট শরিফের বর্তমান সাজ্জাদানশীন হযরত, আল্লামা সৈয়্যদ মুহম্মদ তাহের শাহ্ মাদ্দাজিল্লুহুল আলিও একবার অধম প্রবন্ধকারের জিজ্ঞেসে বলেছিলেন যে, দক্ষিণ আফ্রিকার ঐ জামে মসজিদের দেখভাল করার দায়িত্ব অদ্যাবধি তাঁর নানার বংশের আত্মীয়দের হাতে রয়েছে। সিরিকোটি হুজুরের সহদোর ভাই সৈয়্যদ মুহাম্মদ ইউসুফ শাহ্ ১৯১১ সালে স্বপরিবারে উক্ত মসজিদসহ দ্বীনী মিশনের দায়িত্ব পালনের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকায় হিজরত করেন। [অধ্যাপক কাজী সামশুর রহমান, সুন্নিয়তের নবদিগন্ত উন্মোচনকারী পথিকৃত,
হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রহ. তরজুমান যিলক্বদ সংখ্যা ১৪৩৯ হিজরী] উল্লেখ্য, হুজুর কেবলা তাহের শাহ্ ‘র দাদা সিরিকোটি শাহ্ এবং নানাজি সৈয়দ ইউসুফ শাহ্ সম্পর্কে আপন ভাই হন। সৈয়্যদ বংশের পবিত্র রক্তধারার বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে তাঁদের সব আত্মীয়তা নিজেদের মধ্যেই এ পর্যন্ত হয়ে আসছে।

পীরের দরবারে নজিরবিহীন খেদমতে
আফ্রিকা থেকে ফিরে তিনি তাঁর পীর খাজা চৌহরভী (র)’র দরবারেই কাটিয়ে দেন প্রায় ৭-৮ বছর। সেখানেও তিনি বিরল স্বাক্ষর রেখেছেন দরবারের সেবায়। পীরের সাথে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের ঘটনাটিও বড়ই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। তাঁর মহীয়সী বিবির উপুর্যপরি পরামর্শ এবং পীড়াপীড়িতেই তিনি খাজা চৌহরভীর সাথে সাক্ষাতে কোনমতে রাজি হন, এবং সেই এলাকার হরিপুর বাজারে কাপড়ের দোকান খুলেছিলেন। হরিপুর থেকে সিরিকোটের দুরত্ব অন্তত ১৮ মাইল। দোকান খোলার কয়েকদিন পর, আসা-যাওয়ার পথেই একদিন হয়ে গেল সেই তাৎপর্যপূর্ণ মিলনপর্ব। এ সময় সিরিকোটি হুজুরের এক লোকের নুরানি সূরতের দিকে দৃষ্টি গেল, যাঁকে খুব কর্ম ব্যস্ত মনে হচ্ছিল। ভাবছিলেন, বোধহয় উনিই হবেন, তাঁর বিবির পছন্দের সেই পীর। সামনাসামনি হতেই তাঁকে সালাম দিলেন, আর পীর সাহেবের পক্ষ থেকে প্রত্যুত্তর এল অনেক লম্বা এবং বিশেষ স্বরভঙ্গিতে, যেন তাঁর সেই স্বরভঙ্গি জানান দিচ্ছিল ‘‘ও তুমিই তাহলে,এসেছ শেষতক -ঠিক আছে, আমারও যে দরকার তোমাকে’’। পীরজি সালামের তাৎপর্যপূর্ণ উত্তর শুধু দিলেন না, এবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘চান্দে কেত্তে আয়ে’’, হে চাঁদপুরুষ আপনি কোত্থেকে আসছেন? সিরিকোটি হুজুর উত্তর দিলেন, গঙ্গর সে’-গঙ্গর উপত্যকা হতে। আবার জিজ্ঞেস, এখানে কেন? উত্তর দিলেন, ‘‘আমি হরিপুর বাজারের নতুন দোকানদার’’। পীরজি বল্লেন, ও তাই নাকি, বেশ ভাল কথা, আমার কাছে যারা আসে আমি তাদের বলব যে, হরিপুরে আমার একটা দোকান আছে, যেন তারা আপনার কাছ থেকে কিনে ‘‘কী আশ্চর্য, প্রথম দেখাতেই যেন শত বছরের আপনজন, পর বলে মনে হচ্ছিলনা চৌহরভী হুজুরকে। এবার সিরিকোটি হুজুর জানতে চাইলেন, হযরত আপনাকে খুব তৎপর দেখাচ্ছে, কী করছিলেন? বললেন, একটা মসজিদ নির্মানের কাজে ব্যস্ত আছি’’। সিরিকোটি সাহেব বললেন, তাই নাকি? তাহলে মেহেরবানি করে আমাকেও এমন মোবারক কাজে শরিক করুন, এই বলে, হযরত চৌহরভী’র হাতে তিনি তুলে দেন একশত টাকা, সুবহানআল্লাহ! ঘটনাটি আনুমানিক ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের কোন এক সময়ে, আর সে সময়ে একশত টাকা তাৎক্ষনিক দানের ঘটনা কল্পনাতীত। শুধু চৌহর শরিফের উক্ত মসজিদ নয়, সিরিকোটি হুজুর নিজের টাকায় আরো বহু মসজিদ তৈরী করেন, এর মধ্যে একটি হরিপুর বাজারে রয়েছে,। তাছাড়া নিজ বাড়ি সিরিকোট দরবারের জামে মসজিদটিও তাঁর টাকায় নির্মিত হয় ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে। বিশেষ করে, ১৯০২ সনে চৌহরভী (র) হরিপুর বাজারে যে “দারুল উলুম ইসলামিয়া রহমানিয়া প্রতিষ্ঠার যাত্রা শুরু করেছিলেন, তা মূলত সিরিকোটি সাহেবের হাতেই বিশাল মারকাজ হিসেবে পূর্ণতা পায়। তিনি এই মাদ্রাসার আর্থিক পৃষ্টপোষকতায় শুধু প্রধান ছিলেননা, বরং খাজা চৌহরভী (র) ‘র পর এর পরিচালনাটা পরিপূর্ণভাবে তাঁর উপরই নির্ভরশীল হয়। মাদ্রাসার বিশাল দ্বিতল ভবন(১৯২৭ খ্রি ) সহ পরবর্তী সকল উন্নয়ন ও প্রশংসনীয় অবস্থান ছিল তাঁর অবদান।
উল্লেখ্য, ৩১ডিসেম্বর ১৯৪৮ তৎকালিন অবিভক্ত পাকিস্তানের মন্ত্রী এবং গভর্নর সর্দার আবদুর রব নিশতার এ মাদ্রাসার অবস্থান সম্পর্কে বলেছিলেন। ‘‘এই দারুল উলুমের মাধ্যমে এমন কামেল ব্যক্তি তৈরী হয়েছে যে যাঁদের পদচুম্বনে রয়েছে পরকালের মুক্তি’’ (আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আ’লা হযরত গবেষক, প্রফেসর ড: মাসউদ আহমদ লিখিত ইফতিতাহিয়্যা ) ২২ মার্চ ১৯৪৯ পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খাঁনও এ মাদ্রাসার অবদান স্বীকার করে গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, দরবারের লঙ্গরখানা এবং এই রহমানিয়া মাদ্রাসার হোস্টেলের রান্নাবান্নার জন্য লাকড়ির অভাব ছিল বলে, তিনি নিজ বাড়ি সিরিকোটের পাহাড় হতে সারাদিন লাকড়ি যোগাড় করতেন এবং দিন শেষে ১৮ মাইল দুরের চৌহর শরিফে নিয়ে যেতেন নিজের কাঁধে করে। এভাবে বহুবছর তিনি এমন কঠোর শারীরিক পরিশ্রম পর্যন্ত করেছিলেন দরবার ও মাদ্রাসার সেবায়। এর ফলে তাঁর হাতে -ঘাঁরে যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল এর যন্ত্রনা এবং চিকিৎসা জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত চলেছিল। এই ক্ষত সম্পর্কে তিনি বলতেন-ইয়ে মেরে বাবাজিকা মোহর হ্যায়’’। দ্বীনি খেদমতে কঠিন পরিশ্রমী এই জবরদস্ত আলেম-হাফেজ সিরিকোটি হুজুরের মধ্যেও এক সময়ে লোকালয় ছেড়ে বনে জঙ্গলে একান্তে রেয়াজত করবার ইচ্ছা জেগেছিল এবং এ জন্য পীরের এজাজতও চেয়েছিলেন, কিন্তু পীর খাজা চৌহরভী (র) তাঁকে সাফ জানিয়ে দিলেন যে, বন জঙ্গলের কঠিন রেয়াজাত -মোশাহেদা -মোজাহেদার চেয়েও উত্তম হল মানুষের মধ্যে থেকে দ্বীনের খেদমত করা’’। সুতরাং সংসার -লোকালয় বর্জনে তিনি ব্যর্থ হবার পর, এবার তিনি চেয়েছিলেন লাহোর বাদশাহী জামে মসজিদের ইমাম -খতিবের দায়িত্ব পেতে। দরখাস্তও করেছিলেন কিন্তু এবারও পীর সাহেব একমত হলেন না। কারণ, ঐ মর্যাদাপূর্ণ পদে ইতোপূর্বে যিনি ছিলেন তাঁর এক শাহজাদা এ পদের জন্য আবেদন করেছেন, খাজা চৌহরভী চেয়েছিলেন যে, দায়িত্বটা মরহুম ইমামের সন্তানের হাতে থাকুক। তাই, হযরত সিরিকোটি, তাঁর পীরের এক তাৎপর্যপূর্ণ নির্দেশে প্রেরিত হলেন রেঙ্গুনে। তাঁর কামেল পীর ছিলেন গাউসে দাঁওরান, খলিফায়ে শাহে জীলান তিনি তাঁর রুহানি দৃষ্টিতে দেখেছিলেন হযরত সিরিকোটি হুজুরের হাতে রেঙ্গুন আর চট্টগ্রামের এক যুগান্তকারী দ্বীনি খেদমত সুন্নিয়তের মহাজাগরণের সুসংবাদ। ১৯২০ সালে, তিনি পীরের নির্দেশে স্বদেশের মায়া ছেড়ে দ্বীনের মায়ায় আবারো হিজরত করলেন রেঙ্গুনে।

রঙ্গিলা রেঙ্গুনের আঁধার তাড়াতে, সিরিকোটি এলেন মশাল হাতে
বার্মার রঙ্গিলা শহর রেঙ্গুনে হুজুরের আগমন ১৯২০ খ্রি। তখন তাঁর বয়স ছিল কমপক্ষে তেষট্টি। পীরের নির্দেশ আর ইসলাম প্রচারের নেশা তাঁকে এই বয়সেও বিদেশ সফরে বাধ্য করল। এখানে তিনি ছিলেন ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর পর্যন্ত। মোট ২১-২২ বছরের নিরলস প্রচেষ্টায় তিনি তৎকালিন বার্মার হাজার হাজার অমুসলিমকে যেমন মুসলমান বানিয়েছেন, তেমনি অসংখ্য বিপদগামি মুসলমানদের বানান সাচ্চা আক্বিদার পরহেজগার বান্দা।
[১৯৩৫ সালে রেঙ্গুনে অনুষ্ঠিত বিদায়ী সংবর্ধনার মানপত্র,রচনায়- তফজ্জল হক, সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট, আনজুমানে শুরা-ই রহমানিয়া রেঙ্গুন ১৬ অক্টোবর ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে] অনেক ভাগ্যবান বান্দা তাঁর তা’লিম তারবিয়তের ফলে হয়েছিলেন ইনসানে কামেল অলি-আউলিয়া। জানা যায়, শুরুতে তিনি ক্যাম্পবেলপুরে মৌলানা সুলতানের মাদ্রাসায় এবং পরবর্তিতে রেঙ্গুনের বিখ্যাত বাঙ্গালি সুন্নি জামে মসজিদের খতিব ও ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই বিখ্যাত মসজিদই ছিল তাঁর সুন্নিয়ত প্রচারকেন্দ্র- যা তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ১৯৪১ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। বিখ্যাত আ’লা হযরত গবেষক প্রফেসর ড: মাসউদ আহমদ, আনজুমানে শুরায়ে রহমানিয়ার ১৯৩৫ সনের রিপোর্টের তথ্যানুসারে জানান যে, পীরের নির্দেশকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে গিয়ে হযরত সিরিকোটি (র) ১৯২০-৩৫ পর্যন্ত ১৬ বছর একাধারে রেঙ্গুনে থেকে যান, একটি বারের জন্যও স্বদেশে আপনজনদের কাছে যাননি। যদিও এই সময়ের মধ্যে ১৯২৪ সনের ৫ জুলাই তাঁর মহান পীর খাজা চৌহরভী (র) এবং ৩ শাবান ১৯২৮ তারিখ বুধবারে তাঁর বড় শাহজাদা মৌলানা সৈয়্যদ মুহম্মদ সালেহ্ শাহ্ ওফাত প্রাপ্ত হন (ইফতিতাহিয়্যা)। অবশ্য, এ সংক্রান্ত একটি কারামতের কথা জানা যায় হুজুর কেবলার প্রবীণ মুরীদদের কাছ থেকে, যা ড: মাওলানা সাইফুল ইসলামের একটি রচনায়ও স্থান পেয়েছে। সে অলৌকিক ঘটনানুসারে, হুজুর কেবলা সিরিকোটি, ঐদিন ৩ শা’বান, বুধবার আসরের নামাজের সময়ে, বা নামাজের পরে হঠাৎ করে নিজের হুজরার দরজা বন্ধ করে দীর্ঘক্ষণ বের হননি। তখন তিনি তাঁর অসুখ বলে বলেছিলেন। কিন্তু ঐ দিকে সিরিকোট শরিফে একই সময়ে অনুষ্ঠিত তাঁর বড় শাহজাদার নামাজে জানাজায় তাঁকে দেখা যায়, সুবহানআল্লাহ। [সূত্র, তরজুমান] উল্লেখ্য, খাজা চৌহরভী তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেন ৩০ পারা দরুদ গ্রন্থ ছাপানোর কাজ এবং দারুল উলুম রহমানিয়ার কোন বিহীত না করে রেঙ্গুন না ছাড়েন। আর, এ জন্যই তিনি ১৬ বছর পরই স্বদেশে যান। আর, এরি মধ্যে তিনি ১৯৩৩ সনে এতবড় বিশাল ৩০ পারা কিতাব রেঙ্গুনে থেকেই প্রথম প্রকাশ সম্পন্ন করেন, এবং রহমানিয়া মাদ্রাসার দ্বিতল ভবন তৈরী করেন। এমনকি মাদ্রাসার ছাত্র -শিক্ষকদের আবাসনের এবং শিক্ষকদের নিয়মিত বেতনের ব্যবস্থাটাও তিনি রেঙ্গুন থেকে করেন, আর এমন বিরল খেদমতে সে সময়েও অংশগ্রহণের সুযোগটা হয়েছিল রেঙ্গুন প্রবাসী চট্টগ্রামের মুসলমানদের।

রেঙ্গুন থেকে চট্টগ্রামে, আনজুমান-জামেয়ার মিশন শুরু
১৯২০ থেকে ১৯৪১ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ বাইশ বছরে রেঙ্গুনের হাজার হাজার স্থানীয় বার্মিজ নাগরিক এবং বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এসে কর্মরত প্রবাসীদের মধ্যে অসংখ্য অমুসলিম-মুসলিম নির্বিশেষে তাঁর আধ্যাত্মিক ও অলৌকিক আকর্ষণে উপকৃত হয়েছিলেন। এদের কেউ ভিন্ন ধর্ম থেকে ইসলামে আবার কেউ অন্ধকার জীবন থেকে আলোর দিকে ফিরে এসেছিলেন। রেঙ্গুনের বিখ্যাত বাঙালী মসজিদের ইমামত ও খেতাবতের পাশাপাশি রেঙ্গুনসহ সমগ্র ব্রহ্মদেশে সত্যিকারের দ্বীন ও তরীক্বতের প্রসার ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন যা এখনো পর্যন্ত সেখানে বিদ্যমান। এ সময় সমগ্র রেঙ্গুনে তাঁর অসংখ্য কারামাতের কথা ছড়িয়ে পড়ে এবং দলে দলে লোকজন তাঁর কাছে এসে দুনিয়া-আখিরাতের অমূল্য নিয়ামত লাভে ধন্য হয়। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের অপ্রতিদ্বন্ধি মুজাহিদ আলেমে দ্বীন, ইমামে আহলে সুন্নাত, মুজাদ্দিদে মিল্লাত হযরতুল আল্লামা সৈয়্যদ আযীযুল হক শেরে বাঙালা রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর রেঙ্গুন সফরের সময় কুতুবুল আউলিয়া, গাউসে যামান আল্লামা শাহ্ সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কে লোকজনের কাছে জানতে পেরে বাঙালি মসজিদে গিয়ে তাঁর সাথে মুলাক্বাত করেন এবং দীর্ঘক্ষণ আলাপ-আলোচনা ও পর্যবেক্ষণের পর তাঁর মধ্যে বিশাল বেলায়তী ক্ষমতা অবলোকন করে তিনি তাঁকে চট্টগ্রামে তাশরীফ আনার জন্য অনুরোধ জানান। পরবর্তীতে চট্টগ্রামের সংবাদ পত্র শিল্পের পুরোধা দৈনিক আজাদী’র প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ্ব আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার, মাস্টার আবদুল জলিলসহ চট্টগ্রাম নিবাসী তাঁর অসংখ্য মুরীদের আবেদন-নিবেদন উপেক্ষা করতে না পেরে ১৯৩৫-৩৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে তিনি রেঙ্গুন থেকে পাকিস্তান যাওয়ার পথে চট্টগ্রামে কিছু দিনের জন্য যাত্রা বিরতি করতেন। এ কয়েক দিনের যাত্রা বিরতিতে তাঁর আদর্শ, আখলাক ও অলৌকিক শক্তির আকর্ষণে এখানকার মানুষ আকৃষ্ট হতে থাকে এবং এখানে তাঁর মুরীদ’র সংখ্যা বাড়তে থাকে দিন দিন।
এভাবে, ১৯৪১ এর শেষ দিকে এসে তিনি রেঙ্গুন থেকে স্থায়ীভাবে এই মিশন নিয়ে চট্টগ্রামে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল এবং বার্মা ছিল তখনো অক্ষত। কিন্তু আল্লাহর এ মহান অলী হযরত সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর অলৌকিক অদৃশ্য শক্তিতে দেখলেন যে, শিগগিরই রেঙ্গুন শহর বোমা হামলায় তছনছ হয়ে যাবে এবং অসংখ্য লোকের প্রাণহানি ও সম্পদহানি ঘটবে। তিনি তাঁর মুরীদ এবং পরিচিত সকলকে দ্রুত রেঙ্গুন ত্যাগের নির্দেশ দেন এবং নিজেও রেঙ্গুন ছেড়ে চলে আসেন।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বর্তমানে রেঙ্গুনে বিদ্যমান গাউসে জমান আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর খলিফা হাজি ইসমাঈল বাগিয়া সাহেব জানান যে, তাঁর আব্বা হাফেজ মুহাম্মদ দাঊদ জী বাগিয়া উক্ত নির্দেশ পেয়ে ৮ ডিসেম্বর ১৯৪১ তারিখে তাদের পুরো পরিবার নিয়ে রেঙ্গুন ছেড়ে লক্ষনৌতে নিজ দেশে ফিরে আসেন। অন্যান্যরাও চলে যান যার যার দেশে। আর ২৩ ডিসেম্বর ১৯৪১ তারিখে রেঙ্গুন শহরে বোমা বর্ষণ শুরু হয়। [মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার, সিরিকোট থেকে রেঙ্গুন দ্রষ্টব্য] অপর একটি বিশ্বস্থ সূত্রে জানা যায় যে, শেষের দিকে হুজূর কেবলা সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি রেঙ্গুন ছাড়বার সময় তাঁর খাদেম ফটিকছড়ি নিবাসী মরহুম ফজলুর রহমান সরকারকে রেখে আসেন হুজূর কেবলার বিছানায়। তাঁকে হুজুর কেবলা আরো তিন দিন থাকার পর রেঙ্গুন ছাড়ার পরামর্শ দেন। ফজলুর রহমান সরকার নির্দেশমত তিন দিন থেকে চলে আসেন এবং এর পরপরই বোমা বর্ষণ শুরু হয়। যারা হুজূর কেবলার নির্দেশ মেনে এবং বিশ্বাস করে রেঙ্গুন ছেড়েছিল তাদের সকলের প্রাণ বেঁচে যায় এবং সম্পদও রক্ষা পায় অনেকাংশ। আর অন্যদের অবস্থা হয় বিপরীত ধরণের। শেষ পর্যন্ত সকলকেই রেঙ্গুন ছাড়তে হয়েছিল যুদ্ধের ভয়াবহতা শুরু হবার পর, কিন্তু তাদের কেউ আর স্বাভাবিক এবং সুস্থভাবে দেশে ফিরতে পারেনি। হেটে হেটে আসবার সময় অনেকে পথিমধ্যেই ক্ষুধায় এবং শক্তিহীন হয়ে মারা যান।
যা হোক, তাঁর রেঙ্গুন জীবনের শুরুতে ১৯২৪ সালের দিকে তাঁর পীর খাজা চৌর্হভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁকে স্থলাভিষিক্ত করে শরীয়ত-তরীক্বতের বিশাল দায়িত্ব এবং আধ্যাত্মিক ক্ষমতা প্রদান করে দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নেন। পীরের ইন্তিকালের পরপরই তিনি উক্ত অর্পিত দায়িত্বাবলী যথাযথভাবে আঞ্জাম দেয়ার লক্ষে তাঁর পীরের নামেই একটি সংগঠন গড়ে তোলেন।
১৯২৫ সনের ১৫ ফেব্রুয়ারী ‘আন্জুমান-এ-শুরায়ে রহমানিয়া’ নামক এই সংস্থা স্থাপিত হলে খাজা চৌহরভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রতিষ্ঠিত হরিপুরস্থ রহমানিয়া মাদরাসা পরিচালনা, তাঁর রচিত ৩০ পারা বিশিষ্ট দরূদ শরীফের অদ্বিতীয় কালজয়ী গ্রন্থ ‘মাজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ প্রকাশনা সহ যাবতীয় দায়িত্ব এ সংস্থা কর্তৃক সুচারুরূপে পরিচালিত হতে থাকে। ‘আন্জুমান-এ-শুরায়ে রহমানিয়া’রেঙ্গুন’র চট্টগ্রাম শাখা স্থাপিত হয় ১৯৩৭ সনের ২৯ আগস্ট একই উদ্দেশ্য আঞ্জাম দেয়ার প্রয়োজনে। শুরুতে এ সংস্থা রেঙ্গুনের শাখা হিসেবে কাজ শুরু করলেও ১৯৪২ থেকে চট্টগ্রামের এই সংস্থাই হয়ে ওঠে হুজূর কেবলা রহমাতুল্লাহি আলাইহি’র মিশনের প্রধান অবলম্বন। ১৯৪২-১৯৫৪ পর্যন্ত অন্তত: ১২ বছর পর্যন্ত এই সংস্থার মাধ্যমেই চট্টগ্রাম থেকে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হতো হরিপুরের রহমানিয়া মাদরাসার জন্য। সুন্নিয়ত ও তরিক্বতের অন্যান্য কাজও এ সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হতো। পঞ্চাশের দশকে এসে বাঁশখালির শেখেরখীলের এক মাহফিলে দরূদ শরীফ বিরোধীদের বেআদবীপূর্ণ আচরণের প্রতিক্রিয়ায় সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি চট্টগ্রামে এদের মোকাবেলার জন্য একটি শক্তিশালী মাদরাসা কায়েম করার ঘোষণা দেন। ১৯৫৪ সনের ২২জানুয়ারী এই নয়া মাদরাসা বাস্তবায়নের জন্য গঠিত হয় ‘আন্জুমান-এ আহমদিয়া সুন্নিয়া’ নামক অপর এক সংস্থা। সিরিকোটী হুজূরের উপস্থিতিতে এই নয়া আন্জুমানের ১৭ ফেব্রুয়ারী ১৯৫৪ তারিখের এক ঐতিহাসিক সভায় প্রস্তাবিত মাদরাসার নাম রাখা হয় ‘মাদরাসা-এ-আহমদিয়া সুন্নিয়া’ ২৫ জানুয়ারী ১৯৫৬ তারিখের এক সভায় এ মাদরাসাকে পর্যায়ক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার লক্ষে মাদরাসার নামের সাথে “জামেয়া” (বিশ্ববিদ্যালয়) শব্দটি যুক্ত করে এ মাদরাসার নাম রাখা হয় ‘জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া’। [মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার, গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ ইতিবৃত্ত ও কর্মসূচি, ২১/১১/২০১২] চট্টগ্রামের ষোলশহরে স্থাপিত এই মাদরাসা আজ অর্ধশতাব্দিকাল ধরে দেশে সুন্নিয়তের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে। ১৮ মার্চ ১৯৫৬ তারিখে ইতিপূর্বে গঠিত আন্জুমান দ্বয়ের পরিবর্তে ‘আন্জুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া’ নামক নতুন একক আন্জুমান প্রতিষ্ঠা করা হয়। [প্রাগুক্ত] বর্তমানে এই আন্জুমান দেশের প্রধান বেসরকারী দ্বীনী সংস্থা হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত। আন্জুমান পরিচালিত এই ‘জামেয়া’কে এশিয়ার অন্যতম খ্যাতনামা সুন্নি মারকাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জামেয়ার এতটুকু সফলতার কারণ হলো এই প্রতিষ্ঠানটি আল্লাহর দরবারে কবূল হয়েছে।
জামেয়া প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দেখা যায়-বাঁশখালীর এক মাহফিলে হুজূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র দরূদ-সালামকে ইনকার করার তীব্র প্রতিক্রিয়া হিসেবে এদের বিরুদ্ধে আদর্শিক মেধাভিত্তিক লড়াইয়ের চূড়ান্ত প্রস্তুতি হিসেবেই তৎকালীন ‘নয়া মাদরাসা’ এই জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জায়গা নির্ধারণ, ভিত্তি স্থাপন থেকে শুরু করে এর যাবতীয় পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে হযরত সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি যেন অদৃশ্য কারো ইঙ্গিতের অনুসরণ করছিলেন। তাঁর ঘোষণা অনুসারে “শহর ভি নাহো, গাঁও ভি নাহো, মসজিদ ভি হ্যায়, তালাব ভি হ্যায়” এমন ধরণের জায়গাটি যখন অনেক যাঁচাই-বাছাই শেষে চট্টগ্রাম ষোলশহরস্থ বর্তমানের মাদরাসা এলাকাটি নির্ধারণ করা হয়। তখন এর মাটি থেকে ইলমে দ্বীন’র সুগন্ধি পাওয়া যাচ্ছে বলে উঠেন সুফী মোনাফ খলিফা নামক নাজিরপাড়া নিবাসী সিরিকোটি হুজুরের জনৈক মুরীদ।
এই মাদরাসার পৃষ্ঠপোষকতা কে কোত্থেকে করবেন সে সম্পর্কে তিনি অনেক রহস্যময় মন্তব্য করেছিলেন। কেয়ামত পর্যন্ত এই মাদরাসা পরিচালনার ভার স্বয়ং আল্লাহর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গ্রহণ করেছেন বলে তিনি তাঁর মুরীদদের অভয় দেন। তিনি বলেন- “মেরে কান মে ইয়ে আওয়াজ আতেহে, ইয়ে নয়া মাদরাসা হাম খোদ চালাওঙ্গা’’ অর্থাৎ এই নতুন মাদরাসা আমি নিজেই চালাবো। সত্যিকার অর্থেই এই মাদরাসা চলছে যেন অদৃশ্য শক্তির ব্যবস্থাপনায়। টাকা-পয়সা যখন যা প্রয়োজন তা ভাবনা-চিন্তা করতে না করতেই চলে আসছে। শুধুমাত্র মাদরাসার টাকা নেয়ার জন্যই আজ আলাদা অফিস খুলে বসতে হয়েছে। কত চেনা-অচেনা লোক এসে হাদিয়া, সদক্বা, মান্নত, নিয়্যতের টাকা, যাকাত-ফিতরা ইত্যাদির টাকা দিয়ে যাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। মান্নতকারীদের আশাভঙ্গ করেনা এই জামেয়া -তাই, আজ জামেয়া মান্নত পূর্ণ হওয়ার কথা মানুষের মুখে মুখে। শাহ্ সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছিলেন-“মুঝেহ দেখনা হ্যায় তো, জামেয়া কো দেখো, মুঝসে মুহাব্বত হ্যায় তো, জামেয়া কো মুহাব্বত করো।” ভ্রান্ত মতবাদীদের বিরুদ্ধে ইসলামের মূলধারা সুন্নিয়তকে বিজয়ী করতে ইশ্ক্বে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র ভিত্তিতে এই মাদরাসা তৈরি করেছিলেন। ফলে, আজ ভেজাল থেকে আসল ইসলামকে রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী ‘সাচ্চা আলেম’ বের হচ্ছে এই মাদরাসা থেকে।
আল্লামা সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি জামেয়ার কারিকুলাম সম্পর্কে বলেন, এই মাদরাসায় প্রয়োজনীয় সকল ভাষাজ্ঞানসহ বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়গুলোর উপরও শিক্ষা দিতে হবে। তিনি ভবিষ্যতে ইউরোপ-আমেরিকায় ইসলাম প্রচারে সক্ষম হয় এমন ইংরেজী ও জ্ঞান বিজ্ঞানে দক্ষ সুন্নী আলেম তৈরির জন্য এই জামেয়া প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল জামেয়ার সাচ্চা আলেমরা শুধু মোল্লা না হয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখা-প্রশাখায় পারদর্শী হয়ে বহির্বিশ্ব পর্যন্ত যেন ইসলামের সঠিক আক্বীদা ও মূল্যবোধের বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হন। সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এই মাদরাসা প্রতিষ্ঠার সময় বলেছিলেন, তোমরা ত্রিশ বছর পর্যন্ত হরিপুর রহমানিয়া মাদরাসার খিদমত করেছো। তাই, তোমাদের জন্য এই নয়া মাদরাসা (জামেয়া) উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছে। যদি এই জামেয়ার দায়িত্ব সঠিকভাবে আঞ্জাম দাও তবে জেনে রেখো, এরপর তোমাদের জন্য আরো অনেক বড় বড় দায়িত্ব অপেক্ষা করছে। আর এই বড় দায়িত্ব যে ‘হুকুমত’ তাও তিনি কয়েক দফা উল্লেখ করেছেন। সুতরাং, মনে হচ্ছে, এখনো আমরা এই দায়িত্ব কাঙ্ক্ষিতভাবে পালন করতে পারিনি, তাই আজ হুকুমতও আমাদের হাতে নেই। কারণ, হুকুমতের যোগ্য লোক এখনো আমরা তৈরি করতে সক্ষম হইনি। তাই, আমাদের এই লক্ষে এগিয়ে যাওয়া উচিত।

বাংলাদেশে সুন্নিয়তের পূনর্জীবনের কারণে তিনি আজও প্রাতঃস্মরণীয়
সমগ্র বিশ্বে তাঁর দ্বীনি সেবার জ্বলন্ত নিদর্শন ও স্বাক্ষী থাকবার পরও বলতে হয় যে, বাংলাদেশই ছিল তাঁর খেদমতের এই ধারাবাহিকতায় পূর্ণতার ঠিকানা। যে আলোর মশাল নিয়ে তিনি আফ্রিকা থেকে এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে সফর করেছিলেন তা শেষ পর্যন্ত এই বাংলাদেশের চট্টগ্রামে এনে মজবুতভাবে গেঁড়ে দিয়েছেন বলে তাঁর নাতি পীর সাবির শাহ্ (মাজিআ) একবার চট্টগ্রাম জামেয়ার ময়দানে প্রদত্ত তাঁর এক ভাষনে মন্তব্য করেছিলেন। মনে হয়, তিনি বাঙালিদের জন্যই জন্মেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মাই ভি বাঙালি হুঁ। ১৯৫৮ ‘র পর যখন আর এ দেশ সফরে আসলেননা, তখন বাঙালি মুসলমানদের প্রতি তাঁর দরদ ভরা আশ্বাস ছিল ‘‘জিসিম মেরা সিরিকোট মে, আউর দিল মেরা বাঙ্গাল মে পড়া হুয়া হ্যায়’’। তিনি নাকি এমনও বলতেন যে, ‘‘বাঙালিওকা সাত মেরা হাশর হোগা’’। এটা আমাদের পরম সৌভাগ্যের খবর যে হুজুর সিরিকোটি (র) এদেশের মানুষকে ভালবাসেন, এবং নিজের করে নিয়েছেন। ১৯৪২ হতে ১৯৫৮ সনের আগ পর্যন্ত, কোন অসুস্থতাই তাঁকে বাংলা মুলুকে সফর করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। একবার প্রচন্ড জ্বর ও অন্যান্য অসুস্থতার কারণে তিনি যখন চলতে ফিরতে অক্ষম, এমন সময়ে পরিবার থেকে তাঁকে সে বার এ দেশ সফরে না আনার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি এ কথা শুনে বলেছিলেন -‘‘নেহী, মুঝেহ্ প্লেইন মে চড়হা দো, আগর রাস্তা মে মেরি মওত আয়ি তো মেই আল্লাহকা পাছ কেহ্ চোকেঙ্গা কে এয়া আল্লাহ্, তেরে রাস্তা মে মেরে মওত হুয়ি’’ সুবহানআল্লাহ! তখন হুজুরের বয়স একশ অতিক্রম করেছিল, এরপরও শারীরিক অপারগতা কখনো তিনি প্রকাশ করেননি, আর এমন ত্যাগের কারণেই তিনি বাংলাদেশের সুন্নিয়তের জাগরণে প্রধান পথিকৃৎ হতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশে তাঁর সফরকাল ছিল জীবনের শেষ ২৩ বছর। প্রথমে রেঙ্গুনে আসা যাওয়ার পথে যাত্রা বিরতিতে মাত্র কয়েকদিনের জন্য, এভাবে ১৯৩৬-৪১ পর্যন্ত। আর ১৯৪২-১৯৫৮ পর্যন্ত নিয়মিত শীতকালিন সফরে এসে থাকতেন বেশ কয়েক মাস।এই সময়ে তাঁর হাতে হাজার হাজার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয়, এবং শরিয়ত-ত্বরিকতের ব্যাপক উন্নতি সহ দ্বীনি শিক্ষা বিপ্লবের নেতৃত্ব প্রদানের ফলে তাঁর হাতে সুন্নিয়তের পূনর্জীবন ঘটে, যা আজ সত্যনিষ্ঠ নিরপেক্ষ মহল অকপটে স্বীকার করেন। আজো তাঁর হাতে গড়া চট্টগ্রামের জামেয়া-আনজুমান বাংলাদেশের সুন্নিদের নির্ভরতার প্রধান ঠিকানা হিসেবে অব্যাহত আছে। আজ তাঁর আন্জুমানের হাতে পরিচালিত হয় শতাধিক মাদ্রাসা। আর, নতুন এক বিপ্লবী সুন্নি ধারার মাদ্রাসা কায়েমের প্রলয়ংকরী এই যাত্রায় ‘‘মসলকে আ’লা হযরত ভিত্তিক চট্টগ্রামের জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া (১৯৫৪)’’ ছাড়াও , তাঁর হাতে ১৯৪২ সনে প্রতিষ্ঠিত হয় রাউজান দারুল ইসলাম মাদ্রাসা, যা বর্তমানে আনজুমান ট্রাস্ট’র হাতে পরিচালিত এবং মাস্টার্স স্তরের কামিল মাদ্রাসায় উন্নীত হয়েছে। তাছাড়া, তাঁর হাতে পূনর্জীবন লাভ করেছে আরো বহু প্রতিষ্ঠান, এর মধ্যে হাটহাজারীতে -কাটিরহাট মুফিদুল ইসলাম ফাজিল মাদ্রাসা অন্যতম। ১৯৫৮ সনে এই কাটিরহাট মাদ্রাসা হাটহাজারীর বাতিলদের কবল থেকে রক্ষা পায় হযরত সিরিকোটি হুজুরের পদক্ষেপ ও সেখানে তাঁর সরেজমিন শুভাগমনের মাধ্যমে। এমন আরও অনেক মাদ্রাসা রয়েছে যেসব তাঁর প্রভাবে নতুন জীবন পায়। বিশেষত তাঁর হাতে কাদেরিয়া ত্বরিকায় যেমন নতুন জোয়ার আসে, তেমনি এ দেশবাসী পায় ‘‘মসলকে আ’লা হযরত’’ নামক সুন্নিয়তের বিশুদ্ধতম ধারার সন্ধান লাভ। বিদ্যমান পীর, সিলসিলাহ্ ও দরবারগুলোর জন্যও তিনি ছিলেন এক মহান পথ প্রদর্শক ও সংস্কারক। গাউসে পাক জিলানি (রা) যেভাবে তাঁর বহুমুখী সংস্কারমূলক পদক্ষেপ এবং আধ্যাত্মিক প্রভাব দিয়ে দ্বীনের পূনর্জীবন দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে সিরিকোটি হুজুরের হাতে সুন্নিয়ত পায় নতুন জীবন। আজ বাংলাদেশের যেখানেই সুন্নিয়তের আলো দৃশ্যমান, সেখানে একটু দৃষ্টি দিলেই দেখা যাবে এর নেতৃত্বে, বা নেপথ্যে রয়েছে শাহানশাহে সিরিকোট, বা তাঁর মাদ্রাসাগুলোর ছাত্রদের অবদান। আর, চট্টগ্রামকে তিনি বানিয়ে গেছেন সুন্নিয়তের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে। কারণ, তাঁর জামেয়া ‘‘সুন্নিয়তের প্রধান ক্যান্টনমেন্ট’’ (উক্তি -শহীদ মৌলানা নুরুল ইসলাম ফারুকি ও স্বীকৃতি দেশের সকল মহলের) আজ ঢাকার মুহম্মদপুরে তাঁর আনজুমানের অপর কামিল-মাস্টার্স মানের সুন্নি মাদ্রাসা হল মুহম্মদপুরস্থ কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলিয়া মাদ্রাসা। যা রাজধানীর বুকে সুন্নিদের প্রধান অবলম্বন, এবং বাংলাদেশের সুন্নিয়ত রক্ষার দ্বিতীয় ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে আখ্যায়িত হয়। বর্তমানে ঢাকার বুকে আরও কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে ইনশাল্লাহ্, কারণ এখানে ১৯৫২ সনে শাহানশাহ্ এ সিরিকোটের হাতে প্রতিষ্ঠিত হয় কায়েৎটুলিস্থ খানকাহ্ শরিফ।

আরব দেশে তাঁর সফরের কারণে
মক্কা শরিফ, মদিনা শরিফ, বাগদাদ শরিফ বিভিন্ন সময়ে সফর করেছিলেন সিরিকোটি হুজুর। এ সব সফরের সময় তাঁর হাতে স্থানীয় এবং ভিন্ন দেশ হতে সফরকারী বহু লোক বায়াত গ্রহন করে দ্বীনের খেদমতে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এদের মধ্যে, ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের হজ্বের সময়ের একটি ঘটনা প্রনিধানযোগ্য। আর, ঘটনাটি হল, এই বছর সিরিকোটি হুজুর মদিনা শরিফে অবস্থানকালে সে সময়ে মদিনা পাকের রওজা শরিফের খাদেম সৈয়্যদ মনজুর আহমদের মত একজন অতিব সন্মানিত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব সিরিকোটি হুজুরের কাছে এসে, তাঁকে বায়াত করিয়ে নেবার আবেদন জানান। হুজুর কেবলা বলেন, ‘‘বর্তমান দুনিয়ায় আপনার চেয়ে এমন সম্মানিত হাস্তি আর কে হতে পারেন, যিনি খোদ রওজায়ে আক্বদাস শরিফের খেদমতে আছেন? সুতরাং আপনি কেন আমি অধমের হাতে বায়াত হবেন?’’। তখনি উক্ত সন্মানিত খাদেম সাহেব জানালেন যে, তিনি নিজের ইচ্ছায় নয়, বরং স্বয়ং রাসুলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ পেয়েই হযরত সিরিকোটি হুজুরের হাতে বায়াত গ্রহনের জন্য আসতে বাধ্য হয়েছেন। আর, সিরিকোটি হুজুরও তাঁকে শেষতক বায়াত করিয়ে নিজের মুরিদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নেন। সে থেকে উক্ত মহামান্য খাদেম সাহেব হুজুরের অনুসরণে চলতেন, এবং দ্বীনের সেবায় যোগ দেন। এ বছর, ১৯৪৫ সনের হজ্জের সময়েই ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি লর্ড ওয়াবেল ব্রিটেনের পথে জেদ্দা বিমান বন্দরে যাত্রা বিরতি করেছিলেন। এ সময়ে, সাংবাদিকদের প্রশ্নের এক উত্তরে তিনি বলেছিলেন যে,আন্দোলনরত ভারতীয় মুসলমানদের পাকিস্তান দাবি কখনো বাস্তবায়িত হবেনা। আর, এ খবর পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হবার পর সমগ্র বিশ্বের মুসলমানরা হতাশাগ্রস্থ হয় এবং ভারতীয় মুসলমানরা একদম ভেঙ্গে পড়েন। তাঁরা রওজা মোবারকে এ জন্য আরজি পেশ করবার জন্য হজ্বব্রত পালনরতদের মাধ্যমে উক্ত মহামান্য খাদেম হযরত সৈয়্যদ মনজুর আহমদ সাহেবের স্মরণাপন্ন হলেন। কিন্তু খাদেমজি নিজে সরাসরি রওজা পাকে ফরিয়াদ না করে চলে আসেন সিরিকোটি হুজুরের কাছে, এবং বিষয়টি হুজুরের কাছে পেশ করে বলেন, “হুজুর আপনি আমার পীর -মুর্শিদ, সুতরাং এখন আপনি এখানে অবস্থানকালে আমি সরাসরি এ ফরিয়াদ করতে পারিনা, তাই মেহেরবানি করে আপনি আসুন, এবং ভারতীয় মুসলমানদের স্বাধীনতার ফরিয়াদটি আপনি নিজেই দয়াল নবী পাক (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের) কদম পাকে পেশ করুন। হুজুর, খাদেম সাহেবের কাছে ওয়াবেলের কথা শুনে খুব ক্ষেপে যান এবং ‘‘এটা অসম্ভব’’ বলে মন্তব্য করেন। সাথে সাথে খাদেমকে সাথে নিয়ে রওজা শরিফের ভিতরের বিশেষ জায়গায় প্রবেশ করলেন, আর বের হয়ে, অত্যন্ত জালালি হালতে বললেন, ‘‘ওয়াবেলকা বাত ঝুটা হ্যায়, (মুসলমানুকা) পাকিস্তান করিব আ যায়েগা’’। আলহামদুলিল্লাহ্, এর দুই বছর পরই, ১৯৪৭ সনের ১৪ আগস্ট,পাকিস্তানের জন্ম হল, এবং ভারত থেকে স্বাধীনতার প্রথম স্বাদ পেল মুসলমানরা। এই প্রসঙ্গে, সিরিকোটি (র) ১৯৫২ সনের ২৪ ফেব্রুয়ারি, চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে অনুষ্ঠিত ‘‘জমিয়তে ওলামায়ে পাকিস্তান’’র এক জনসভায় সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন যে, তাঁর মহান পীর খাজা চৌহরভী (র) তাঁকে ২৭ বছর আগে (১৯২০ খ্রি) বলে দিয়েছিলেন, ‘‘ইংরেজ চলা যায়েঙ্গে, আউর মুসলমানুকা কাম দাড়িমুন্ডা সে সাম্বালেঙ্গে’’।
[খোতবায়ে ছদারাত, প্রকাশনায়, করাচি, পাকিস্তান] যা, সাতাশ বছর পর, ১৯৪৭ সনে বাস্তবায়িত হয় পাকিস্তানের জন্ম দাড়ি বিহীন নেতা ড. ইকবাল, জিন্নাহ্, লিয়াকত আলি খা, শেরে বাংলা ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী’দের নেতৃত্বে আলোর মুখ দেখার মধ্য দিয়ে। যা হোক, সিরিকোটি হুজুরের কোন সফরই দ্বীনের সেবার বাইরে ছিলনা। বাগদাদ শরিফ সহ আরো যে সব দেশে তাঁর ভ্রমন হয়েছে সেখানেও হয়ত পাওয়া যাবে তাঁর খেদমতের নিদর্শন, যা গবেষকদের মাধ্যমে ভবিষ্যতে বেরিয়ে আসবে ইনশাল্লাহ্।

অন্যান্য দেশে তাঁর প্রভাব
সিরিকোটি (র) যখন রেংগুনে আসা যাওয়ার পথে কলিকাতা যাত্রা বিরতি করতেন কয়েকদিন। এই সময়ে তিনি ধরমতলা ওয়াসেল মোল্লার সাত তলা ভবনে থাকতেন। এখানে তাঁর বিশিষ্ট মুরিদ এবং পরবর্তিতে খেলাফত প্রাপ্ত, বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাক্তার মুজাফ্ফরুল ইসলামের বাসভবনে তিনি উঠতেন। নোয়াখালি নিবাসি এই ডাক্তার হুজুরের খুব আপনজন ছিলেন। ডাক্তার ছিলেন ১৯২০ সালের এম বি পাশ ডাক্তার। তিনিও রেংগুনে সিরিকোটি হুজুরের হাতে বায়াত হয়েছিলেন। ১৯৩৫ সনের ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২১ জিলক্বদ, হুজুর কেবলা সিরিকোটি যখন রেঙ্গুন হতে দীর্ঘ ১৬ বছর পর স্বদেশে যাচ্ছিলেন সেবার পথিমধ্যে দু’দিন কলিকাতা থাকবার কথা তাঁর একটি চিঠি থেকে জানা যায়। [ইফতিতাহিয়্যা, ড. প্রফেসর মাসউদ আহমদ] উল্লেখ্য, রেঙ্গুন -কলিকাতা -করাচি রুটেই ছিল হুজুরের স্বদেশে আসা যাওয়া। ১৯৩৬ সন থেকে, এই পথে আসা যাওয়ার কোন এক সময়ে তিনি চট্টগ্রামেও যাত্রা বিরতি করতেন। চট্টগ্রামের এই মাত্র কয়েকদিনের অবস্থান পরবর্তিতে এখানকার মানুষের ভাগ্যকে প্রসন্ন করে দিয়েছিল, এবং ১৯৪২ হতে রেংগুনের ২১/২২ বছরের মিশন চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত হয়েছিল। যেহেতু, তিনি কলিকাতায়ও কিছুদিন থাকতেন তাই আশা করা যায় যে, সেখানেও তাঁর কিছু না কিছু অবদান থাকতে পারে, যা হয়ত ঠিকমত অনুসন্ধান করা হলে বের হয়ে আসবে। তবে, হুজুরের কলিকাতা সফরের বেশকিছু কারামতের কথা জানা যায়। এর একটি হল: একবার ডাক্তার মুজাফ্ফরুল ইসলামের বিবি আবেদা খাতুন কি এক কারণে হুজুরের কাছে আসবার সুযোগ পান, এবং এই সময় হঠাৎ আবেদার চোখ বেয়ে পানি এসে তা গড়িয়ে পড়তে থাকে। বিষয়টি হুজুরের দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। হুজুর জিজ্ঞেস করলেন যে কেন আবেদা কাঁদছেন, ডাক্তার(স্বামী) কিছু বলেছে? তিনি বলতে চাচ্ছিলেননা, কিন্তু হুজুর বারবার জানতে চাপ দিচ্ছিলেন, তাই বাধ্য হয়ে, বললেন হুজুর! ডাক্তার আরো একটা বিয়ে করবে বলেছে,কারণ, আমি কোন সন্তান দিতে পারিনাই।আজ আমাদের বিয়ে হয়েছে ১৬-১৭ বছর হল, কিন্তু কোন সন্তান সন্ততি নাই, তাই ডাক্তার দ্বিতীয় বিয়ে করবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে। আবেদার কান্না দেখে হুজুর খুব ব্যথিত হলেন, বললেন, ‘ডাক্তারের এত সাহস, আমার মেয়েকে ঘরে রেখে আবার বিয়ে করবে? ঠিক আছে, আজ আমি ডাক্তারের সাথে এর একটা দফা রফা করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্। হুজুর কেবলা আবেদাকে মেয়ে হিসেবে শুধু ডাকেননি, বরং ডাক্তার মুজাফ্ফর বাসায় আসার পর তাঁকে এক চোট নিয়ে ছাড়লেন, এবং পরিষ্কার করে বলে দিলেন- ‘যতদিন আমার মেয়ে আবেদা বেঁচে আছে ততদিন তোমার অন্য মেয়ে বিয়ে করা যাবেনা।’ এরপর, আল্লাহর দরবারে হাত উঠালেন সন্তানের জন্য। আলহামদুলিল্লাহ্, ঘটনাটা সম্ভবত ১৯৪২ এর দিকে হবে, আর ডাক্তারের ঘরে আবেদার সৌভাগ্যের নিদর্শন হয়ে পর পর দুই ছেলের জন্ম হল। প্রথম ছেলে শামসুল ইসলামের জন্ম হল ১৯৪৩ সনে, আর দ্বিতীয় ছেলে কামরুল ইসলামের জন্ম হল ১৯৪৫ সনে, সুবহানআল্লাহ। শামসুল ইসলাম এখন আর দুনিয়াতে নাই। মাত্র কয়েকবছর আগে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত জামেয়া -আনজুমানের সেবা করে গেছেন। আর, এখনো বেঁচে আছেন কামরুল ইসলাম, তিনি থাকেন চট্টগ্রামে। দুই ভাইয়ের কাছেই তাঁদের জন্মের প্রেক্ষাপট ও সিরিকোটি হুজুরের কারামতের প্রসঙ্গটি শুনেছি এবং লিখে রেখেছিলাম। যদিও এখানে কারামত বলাটা আমার উদ্দেশ্য নয়, ধারনা করা যায় যে, হুজুরের পদচারণা যেখানেই হয়েছে সেখানে দ্বীনের কোন না কোন সেবাও হয়েছে, যদিও এই মুহূর্তে সে তথ্যাদি আমার হাতে নাই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সিরিকোটি হুজুর শুধু কলিকাতা নয়, ভারতের বোম্বে সহ অন্যান্য কিছু জায়গায় ইসলামের খেদমত করেছেন বলে দৈনিক আজাদী’র কলামিস্ট শাখাওয়াত হোসেন মজনু’র একটি বক্তব্যে পাওয়া যায়। আর, হুজুরের আজমির শরিফ সফরের বিষয়টিত আছেই। একবার তাঁর আজমির সফরে শিশু শাহজাদা হাফেজ আল্লামা সৈয়্যদ মুহম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (র) সাথে ছিলেন, এবং সে সফরে একজন আগন্তুক বেশে স্বয়ং খাজা গরীবনওয়াজ (র) শিশু তৈয়্যব শাহ্ কে সাক্ষাত দেন, আলিঙ্গন করেন এবং হ্রদ্যতাপূর্ণ আলাপের সাথে কিছু দোয়া-কালাম শিক্ষা দেন বলে জানা যায়। প্রসঙ্গত জানাতে চাই যে, এ আজমির শরিফের বহু খাদেম পরিবার হুজুর তৈয়্যব শাহ্ (র) ‘র মুরীদ ছিলেন। ১৩-১৬ আগস্ট ২০১৭, আজমির সফরে, গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব পেয়ার মুহাম্মদ সহ অধম সেই পুরোনো নিদর্শনসমূহের একটি ‘কামাল মঞ্জিল’ এ গিয়েছিলাম। এ মঞ্জিলের বর্তমান গদীনশীন সৈয়দ সামির উদ্দিন চিশতি সে প্রসঙ্গ স্বীকার করে বলেন যে, তাঁর বাবা আলাউদ্দিন চিশতি সহ তাঁদের আত্মীয় স্বজনদের অনেকেই হুজুর কেবলা তৈয়্যব শাহ্’র মুরীদ, এবং হুজুর কেবলা তাঁদেরকে সে সময় আজমির শরিফে মাদ্রাসা তৈরীর বিষয়ে নির্দেশ দেন এবং এ বিষয়ে নিয়মিত খোঁজখবর নিতেন। সুতরাং বলা যায় যে, দ্বীনের খেদমতের এই ধারাবাহিকতা সিরিকোটি হুজুরের সময় হতেই চলে এসেছিল আজমিরে।সেদিনের সাক্ষাতে এক পর্যায়ে সামির চিশতি সাহেব আমাদেরকে বলেছিলেন যে, যদি এখন গাউসিয়া কমিটি -আনজুমান আজমিরে কোন মাদ্রাসা বানাতে চায়, তাহলে তাঁরা জায়গা দিতে প্রস্তুত আছেন।

মসলকে আ’লা হযরতের বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত
হযরত শাহানশাহে সিরিকোট ছিলেন বাংলাদেশ’র ‘মসলকে আ’লা হযরত’র বুনিয়াদ স্থাপনকারী, এমনকি পাকিস্তানের হরিপুর দারুল উলুমকেও তিনি সুন্নিয়তের এই বিশুদ্ধ ধারায় নিয়ে এসেছিলেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৪, সিরিকোটি হুজুরের ঐতিহাসিক অবদান হল চট্টগ্রামের জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসার যাত্রা। এর ভিত্তি প্রস্তর রাখবার সময়ই তিনি বলেন- ‘ইয়ে নয়া মাদ্রাসা কা বুনিয়াদ মসলকে আ’লা হযরত পর ঢালা গেয়া হ্যায়’। ২৫ জানুয়ারি ১৯৫৬, তারিখে এই মাদ্রাসার একাডেমিক যাত্রা শুরুর সময় এর নামের সাথে ‘জামেয়া’ শব্দ সংযুক্তি হয় একে মসলকে আ’লা হযরতের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপ দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে। তাই, এ চিন্তাধারার যোগ্য আলেম আল্লামা ওয়াকার উদ্দিন বেরেলী (র) কে নিয়োগ দেওয়া হয় এর প্রথম প্রিন্সিপ্যাল হিসেবে। পরবর্তিতে একই মসলকের বিশেষজ্ঞ আলেম আল্লামা নসরুল্লাহ্ খাঁন (র) কেও একই দায়িত্বে এনেছিলেন গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ্ (র)। তাঁরা স্থানীয় ওলামাদের নিয়ে এদেশে আ’লা হযরতের চিন্তাধারার আলেম ও জনগন তৈরীতে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান, যা আজ অনস্বীকার্য। শুধু তাই নয়, স্বদেশের হরিপুর সহ তাঁর সমস্ত আবাদি এলাকাতেই আজ মসলকে আলা হযরত যথেস্ট প্রভাবশালী একটি সুন্নি সহীহ্ ধারা হিসেবে পরিচিত। ‘শরহুল হুকুক’ সহ আ’লা হযরত রচিত বহু কিতাবের অনুবাদ করে স্থানীয়দের মধ্যে বিতরনের ব্যবস্থা হয়ে আসছে তাঁর হাতে পরিচালিত দারুল উলুম রহমানিয়া সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হতে, যা মূলত তাঁরই প্রেরনার ফসল বিধায়, উক্ত কিতাবের উর্দু তরজমাকারী আল্লামা আবদুল হাকিম শরফ কাদেরী (র)’র মত বিখ্যাত আলেম, উক্ত কিতাবের তরজমার মুখবন্ধে সিরিকোটি হুজুরের বিশাল দ্বীনি খেদমতের কথা অকপটে লিখে গেছেন। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আ’লা হযরত গবেষক প্রফেসর ড: মাসউদ আহমদ, মিশরের আল আজহারের প্রথম আ’লা হযরত বিষয়ে পি এইচ ডি ডিগ্রী লাভকারী মৌলানা মমতাজ আহমদ ছদীদি, পাকিস্তানের বিখ্যাত মুফতি আবদুল কাইউম হাজারভী (র), মাওলানা সৈয়্যদ আমির শাহ্ গীলানী পর্যন্ত বহু খ্যাতনামা গবেষক-আলেমের কলমে হযরত সিরিকোটি (র)’র অবদানের বিষয়টি উঠে এসেছে, আলহামদুলিল্লাহ্। আজ, এ দেশে, এমনকি মিশরের আল আজহার, কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়, সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই চিন্তাধারার উচ্চতর গবেষণায় সিরিকোটি হুজুরের জামেয়ার অবদান অনস্বীকার্য। আ’লা হযরত কৃত কোরানের বিশুদ্ধতম তরজমা কানজুল ঈমান সহ আজ বহু জরুরি কিতাবের অনুবাদ ও মৌলিক গ্রন্থ রচনায় যিনি বাঙালি সুন্নি মুসলমানদের কাছে পরম শ্রদ্ধার পাত্র, সেই জান্নাতি মানুষ মৌলানা আবদুল মান্নান সহ আজ এ মসলকের অধিকাংশ দায়িত্ব পালনকারীই জামেয়ার, বা ঢাকা কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়ার ছাত্র, যা দিনের সূর্যের মতই স্পষ্ট। উল্লেখ্য, আল্লামা সিরিকোটি (জন্ম ১৮৫৬-৫৭ খ্রি, ওফাত ১৯৬১ খ্রি) এবং আলা হযরত ইমাম আহমদ রেযা বেরলবী (জন্ম ১৮৫৬, ওফাত ১৯২১ খ্রি) সমসাময়িক বটে, কিন্তু সিরিকোটি হুজুর বেঁচে থাকেন আরো চল্লিশ বছর বেশি। তাঁর এমন লম্বা হায়াতের ১৯৫৮ পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন দেশে নিরলস দ্বীনি সেবার সুযোগ নেন, যেখানে মসলকে আ’লা হযরত পরিচিতিও ছিল, এবং পরের সময়টাতে কাটান স্বদেশের দ্বীনি সেবায়। তাঁর শতাধিক বছরের হায়াতটাই ছিল হায়াতে তাইয়্যেবা। যেখানে ছিলনা কোন বিশ্রাম,ছিলনা কোন অবসর।

সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়ার নতুন জীবন দান
ড: মুহম্মদ এনামুল হক, রচনাবলীর ১১৭ পৃষ্ঠায়, ‘বঙ্গে সূফী প্রভাব’ অংশে কাদেরিয়া ত্বরিকা সম্পর্কে মন্তব্য করা হয় যে, পশ্চিম বঙ্গের রাজধানী মুর্শিদাবাদে বাগদাদ হতে হযরত সৈয়্যদ শাহ্ কামিস এসে ইসলাম প্রচার করেন, বাংলায় তাঁর বহু ভক্ত ও খলিফা ছিলেন। তিনি ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে ওফাত বরণ করেন। এরপর, তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন শাহ্ সৈয়্যদ আবদুর রাজ্জাক নামক তাঁর খলিফা। এরপর, বাংলায় কাদেরিয়া ত্বরিকার মূলধারার অন্য কোন প্রতিনিধিত্বের তথ্য জানা যায়না
[মোহাম্মদ আবু তালেব, ইসলামী শিক্ষার উন্নয়নে বৃহত্তর চট্টগ্রামের সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের অবদান ১৯০০–২০০০, শীর্ষক গবেষণা পত্র] উপরোক্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে, আমরা ধরে নিতে পারি যে, ১৫৮৪ ‘র শাহ্ কামিস (রহ.)’র পর খলিফা শাহ্ আবদুর রাজ্জাক (র) যদি আরও একশ বছরও বেঁচে থাকেন, তবুও বলতে পারি যে, কাদেরিয়া ত্বরিকার মূলধারা, বা এর কোন বড় ধরনের প্রভাব দীর্ঘ আড়াইশ বছর (১৬৮৫–১৯৩৫) দৃশ্যমান হয়নি। আর, এ বিশ্বশ্রেষ্ঠ কাদেরিয়া ত্বরিকার মূলধারা আজ বাংলাদেশে বলা যায় প্রধান সূফি ধারা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে- যা শাহানশাহে সিরিকোট ‘র এক ঐতিহাসিক অবদান।
উল্লেখ্য, সিরিকোটি হুজুর রেঙ্গুন হতে কাদেরিয়া ত্বরিকার মশাল হাতে চট্টগ্রামে আসা -যাওয়া শুরু করেন ১৯৩৫-১৯৩৬ সনের দিকে। [সাজরা শরিফ] আর, ১৯৪২ হতে, পুরোদমে শুরু হয় তাঁর বাংলাদেশ মিশন, যা ১৯৫৮ পর্যন্ত তাঁর প্রত্যক্ষ সফরের মাধ্যমে, এবং পরবর্তিতে তাঁর শাহ্জাদা, মাতৃগর্ভের অলী হিসেবে খ্যাত, গাউসে জামান, আল্লামা তৈয়্যব শাহ্ হুজুর (১৯৬১-১৯৮৬) এবং তাঁর বড় নাতি রাহনুমায়ে শরিয়ত ও ত্বরিকত, আল্লামা তাহের শাহ্ (১৯৮৬-বর্তমান) ‘র হাতে ধারাবাহিক উপযুক্ত পরিচর্যার মাধ্যমে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে এই সিলসিলার মুরিদ-ভক্ত এবং অনুসারি সংখ্যা কল্পনাতীত, যারা আজ মাঠে-ময়দানে, শরিয়ত-ত্বরিকত, তথা সুন্নিয়তের জাগরণে প্রধান ধারার কর্মি হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত, আলহামদুলিল্লাহ্। বাংলাদেশের ইসলামী সংস্কৃতির শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সংস্কার জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) এ সিলসিলারই পরবর্তী সাজ্জাদানশীন গাউসে জামান আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ্ (রহ.)’র দান। বর্তমান সাজ্জাদানশীন আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ (মু.জি.আ.)’র হাতে এ জশনে জুলুস বর্তমানে ৪০ লাখ মানুষের গণজোয়ারে রূপ নিয়েছে। যা সুন্নিয়ত ও কাদেরিয়া তরিকার বর্তমান জাগরণকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
প্রসঙ্গত, গাউসুল আযম জিলানি (রা)’র শ্রেষ্ঠ কাদেরিয়া ত্বরিকা তাঁর বিভিন্ন খলিফা, এবং বংশীয় সাজ্জাদানশীনদের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপি বিকশিত হয়। বড়পীরের সবচেয়ে প্রিয় শাহজাদা ছিলেন শাহ্ আবদুর রাজ্জাক, যিনি বাগদাদে একজন শীর্ষ আলেমে দ্বীন হিসেবে খ্যাত ছিলেন। সেই শাহ্জাদা আবদুর রাজ্জাক, এবং বাগদাদের প্রধান বিচারপতি বড়পীরের নাতি খাজা আবু সালেহ নসর (রা)’র মাধ্যমে যে ধারা প্রবাহিত হয়, তাই মূল বা প্রধান ধারা, এমনকি শ্রেষ্ঠ ধারা বলা যায়। আর এই কাদেরিয়া সিলসিলাহর এই মূল ধারায় কয়েক শতাব্দির শ্রেষ্ঠ কামেল সাজ্জাদানশীন ছিলেন খাজা চৌহরভী (র) যাকে খলিফায়ে শাহে জীলান লক্ববে অভিহিত করা হয়। সেই গাওসে দাঁওরা, খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী (র)’রই সাজ্জাদানশীন প্রধান খলিফা হবার সৌভাগ্য লাভ হয় হযরত সিরিকোটি (র)’র। শুধু তাই নয়, হযরত খাজা চৌহরভী (র), সিরিকোটি হুজুরকে এ বলে ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করে বলেন যে, অলি আল্লাহদের প্রধান আধ্যাত্মিক আসন ‘গাউসে জামান’ পদটি কাদেরিয়া ত্বরিকায় থাকবে, যদি এর দায়িত্ব আওলাদে রাসুল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থাকেন। আর, এই রহস্যময় উক্তিটি ছিল হুজুর সিরিকোটি এবং তাঁর অব্যাবহিত কয়েকজন আওলাদে পাকের হাতে এ মোবারক দায়িত্ব থাকবার সুসংবাদ। আর, শত বছর আগেকার এ উক্তির তাৎপর্য এখন দিনের আলোর মতই সুস্পষ্ট। আজ কাদেরিয়া সিলসিলাহর সিরিকোটিয়া ধারার হাতেই দ্বীনের নেতৃত্ব অব্যাহত আছে, আলহামদুলিল্লাহ্। তাই সিরিকোটি (র) এ অঞ্চলে একাধারে কাদেরিয়া ত্বরিকার মূলধারার এবং ইসলামের মূলধারা সুন্নিয়তের নতুন জীবনদাতা মহান সংস্কারক অলি আল্লাহ্।

কৈফিয়ত
খুব অল্প সময় হাতে নিয়ে আজকের সেমিনারে উপস্থাপিত এই প্রবন্ধটি লিখিত হয়েছে। তাই, তথ্যসূত্রগুলো যথাযথভাবে প্রতিস্থাপন করা যায়নি। পরবর্তিতে, প্রবন্ধটি মুদ্রনের সুযোগ হলে তা করা হবে, ইনশাল্লাহ্। তবে, প্রবন্ধ আলোচকদের জিজ্ঞেসে মৌখিকভাবে সূত্রসমূহ বলা হবে। যেহেতু, শিরোনামের সাথে প্রাসঙ্গিকতা বজায় রেখে প্রবন্ধটি উপস্থাপনের প্রয়াস পেয়েছি, এবং সেমিনারের সময়ের দিক বিবেচেনা করেছি, তাই হুজুরের জীবনের কারামত, জীবনদর্শন সহ বহুদিক, বহু ঘটনা এখানে উপেক্ষিত হয়েছে। এমনকি তাঁর কোন অবদানের বিষয়েও বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি। বিশেষত সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়া, যা এদেশে সিরিকোটি হুজুরের হাতেই পূনর্জাগরিত হয়েছিল এর বিস্তারিত আলোচনাও উপেক্ষিত হয়েছে সঙ্গত কারণে। আজ ঘরে ঘরে খতমে গাউসিয়া, গেয়ারভী শরিফ চলছে, বাংলাদেশে স্থাপিত হয়েছে এ সিলসিলাহর হাজার হাজার খানেকাহ্ শরীফ, যা ইতোপূর্বে এদেশে এমনভাবে দেখা যায়নি। সিরিকোটি হুজুরের পদচারণায় কাদেরিয়া ত্বরিকা আজ এতটুকু আলোকিত। আশা করি, বিজ্ঞ আলোচকবৃন্দ অধমের এ সংক্ষিপ্ততা কে উদার দৃষ্টিতে বিবেচনা করবেন, এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবেন। আপনাদেরকে ধন্যবাদ।