ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ আবদুল খালেক-অধ্যাপক কাজী সামশুর রহমান

ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ আবদুল খালেক-অধ্যাপক কাজী সামশুর রহমান

ইঞ্জিনিয়ার আলহাজ্ব মুহাম্মদ আবদুল খালেক (রাহমাতুল্লাহি আলায়হি)

অধ্যাপক কাজী সামশুর রহমান

সুজলা-সুফলা গিরি কুন্তলা সাগর মেখলা প্রাচ্যের সৌন্দর্য্যরে রাণী ‘চট্টলা’ চাটগাম তথা চট্টগ্রাম। এ জেলার উত্তর পূর্বে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কোলঘেঁষে চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি সড়কের দু-পাশ ধরে অবস্থান গ্রাম সুলতানপুর, রাউজান উপজেলার একটি ইউনিয়ন রাউজান পৌরসভা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ও চিহ্নিত। বর্ধিষ্ণু এ গ্রামের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থতি মুকিম বাড়ির মরহুম বেলায়েত আলী চৌধুরী ও বেগম ফজিলাতুন্ নেছার ঔরসে এক শুভক্ষণে একটি শিশুর জন্ম হয় ২০ জুলাই ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দ। আনন্দঘন পরিবেশে ইসলামী শরীয়ত মতে নাম রাখা হয় আবদুল খালেক।
মোগল আমলের পদাতিক বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান শেখ বড় আদম লস্করের বংশধরের প্রদীপ হয়ে এ শিশু জন্মগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, স¤্রাট আওঙ্গজেবের আমলে চট্টগ্রাম মোগল সা¤্র্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। সে সময় মোগল পদাতিক বাহিনীর প্রধান হয়ে ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে গৌড় হতে বড় আদম লস্করের সুলতানপুর আগমন।

বড়বোন তামান্না ও আবদুল গণি চৌধুরীর আদরের ছোট ভাই শিশু আবদুল খালেক। শিশু আবদুল খালেক অতি অল্পবয়সেই পিতৃহারা হলেন। বড় ভাই-বোন পিতৃহারানোর বিয়োগ-ব্যথা উপলব্ধি করতে পারলেও শিশু আবদুল খালেক ছিলেন নিতান্তই অবুঝ। শোকাবহ এ সংসারকে বেগম ফজিলাতুন্ নেছা একাধারে মা ও বাবার দ্বৈত ভূমিকায় সন্তানদের আগলে রাখেন অতি কষ্ট করে। এমতাবস্থায় মরহুম বেলায়ত চৌধুরীর জ্ঞাতি ভাই চাচা মরহুম আহমদ মিয়া চৌধুরী এগিয়ে আসেন। ভাইয়ের এ সংসারকে টিকিয়ে রাখতে তিনি মহত্বের পরিচয় দেন। আহমদ মিয়া চৌধুরী ছিলেন সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়ার মহান মুর্শিদ কুতুবুল আউলিয়া আওলাদে রসুল (৩৯তম) দ. হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব হাফেয সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি (রহ.)-এর খলীফা আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট আলহাজ্ব আবু মুহাম্মদ তবিবুল আলমের পিতা। তিনি আলোকিত মানুষ ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক সম্পর্কে বলেন, মুরুব্বী, আত্মীয়-স্বজন ও পরিবারের সদস্যদের নিকট শুনেছি ভাইজান বাল্যকালে খুবই শান্ত স্বভাবের ছিলেন। পথ চলতেন ধীরলয়ে, কথা বলতেন ধীরলয়ে নরম স্বরে। আদুরে স্বভাবের শিশুটিকে সবাই আদর করতেন। বড় ভাই আবদুল গণি চৌধুরীর কাঁধে চড়ে চলতেন, প্রায়শ: বাড়ির ছোট ছেলে-মেয়েরা হাসতেন এবং তিনি অন্যদের খেলা উপভোগ করতেন। শুনেছি ডা. আবুল হাশেম (এম এ হাশেম জ্ঞাতি ভাই) ও তিনি বাল্যকালে একই স্বভাবের ছিলেন। হাশেম সাহেব কোলকাতা হতে এমবি পরীক্ষায় গোল্ডমেডেল লাভ করেছিলেন অসাধারণ কৃতিত্বের সাথে। তিনি একজন খ্যাতিমান চিকিৎসক হিসেবে আন্দরকিল্লা থেকে আমৃত্যু মানুষের সেবা করেছেন।

গরীব দুঃখী মানুষকে ভিক্ষা করতে দেখলে তিনি বেদনাহত হতেন। বাড়িতে ভিক্ষুক আসলে সবার অজান্তে মোটকা (চাউল রাখার পাত্র) থেকে চাউল এনে বিলিয়ে দিতেন। একা একা বাইরে বেরোতেন না। মসজিদ, মক্তবে যেতে হলেও কেউ একজন গিয়ে তাকে দিয়ে আসতেন। একান্ত লাজুক ও ঘর কুনো মানুষ বললে অত্যুক্তি হবে না। তিনি অল্পবয়স থেকেই ধার্মিক প্রকৃতির ছিলেন। বড়দের সাথে তিনি মসজিদে যেতেন। সব সময়ই বাল্যকাল হতেই তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। সুস্থ মূল্যবোধ সম্পন্ন পরিবারে বেড়ে উঠার কারণে তিনি একজন উন্নত ও নৈতিকতাসম্পন্ন চরিত্রের মানুষ বলেই নিজেকে গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন। নিষ্কলুষ চরিত্রের মানুষ হিসেবেই তিনি আলোকিত মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। পারিবারিক গন্ডীতেই একটি শিশুর মন-মানসিকতা গড়ে উঠে। একথা সকলেরই উপলব্ধি করা বাঞ্চনীয়। বখাটে ও উশৃংখল হবার ক্ষেত্রে পরিবারই অনেকটা দায়ী। প্রতিকুল পরিবেশে বেড়ে উঠা ও অনুকূল পরিবেশে গড়ে উঠা শিশুর মধ্যে বিস্তর ফারাক। আবদুল খালেক সাহেবের ধার্মিক ও সুকুমার মূল্যবোধের পরিবার ভবিষ্যৎ জীবন গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির পূর্বে তিনি মা, ভাই-বোনদের নিকট হতে প্রারম্ভিক পড়া-লেখার অনেকটাই আয়ত্ব করেছিলেন। পাঁচ বছর বয়সেই ভর্তি হন রাউজান ষ্টেশন প্রাইমারি স্কুলে। বিদ্যালয়টি রজনী মাষ্টারের স্কুল নামে পরিচিত লাভ করেছিল। পরবর্তীতে নামকরণ হয় ভিক্টোরিয়া প্রাইমারি স্কুল। প্রথম শ্রেণীর ছাত্র হলেও তিনি অধিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ ছিলেন বলেই ২য় ও ৫ম শ্রেণীতে বৃত্তি পাওয়ার মাধ্যমে তাঁর মেধার বিকাশ ঘটে। বৃটিশ শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক স্তরে ২টি অর্থাৎ ২য় ও ৫ম শ্রেণি এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণিতে বঙ্গীয় বৃত্তির ব্যবস্থা ছিল। ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাউজান আর আর এসি ইনষ্টিটিউশানে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। সে সময়কার মুসলিম ছেলেরা পড়ালেখায় অনগ্রসর ছিল। উপরন্তু মুসলিম সমাজে ইংরেজী ও বাংলা শেখার আগ্রহ ছিল খুবই কম। তবে গুটিকয়েক মুসলিম পরিবারে ইংরেজী ও বাংলা শিক্ষার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল। এ সকল পরিবারের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের পরিবার অন্যতম। প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক সুলতানপুর গ্রামে আরব দেশ হতে অনেক বুযুর্গ ও ব্যবসায়ী আগমন করেছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এখনো এ গ্রামে আরব দেশ হতে আগত নাগরিকদের বংশানুক্রম বিদ্যমান। অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়ে ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণিতে বঙ্গীয় বৃত্তি লাভ করে মেধার স্ফুরন ঘটায়। হিন্দু ছাত্রদের বঙ্গীয় বৃত্তি লাভের একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব হয়ে যাওয়ায় হিন্দু সম্প্রদায় যেমন মনঃক্ষুন্ন, তেমনি মুসলিম সম্প্রদায় ও পরিবার চট্টগ্রাম অঞ্চল হতে বঙ্গীয় বৃত্তি লাভ করায় ইনষ্টিটিউশান কর্তৃপক্ষ সুলতানপুরের দুই জ্ঞাতি ভাই ডা. মুহাম্মদ আবুল হোশেম ও ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেককে ৮ম শ্রেণিতে বৃত্তি লাভ করায় মহাখুশী। আনন্দে উদ্বেলিত ও উচ্ছসিত। রাউজান আর আর এসি ইনস্টিটিউশন কর্তৃপক্ষ সুলতানপুরের দুই জ্ঞাতি ভাই ডা. মুহাম্মদ আবুল হাশেম ও ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেককে ৮ম শ্রেণিতে বৃত্তি লাভ করায় সংম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেছিল। দু’ভাইয়ের জন্য দু’বার অনুষ্ঠান করেছিল। একই স্কুল হতে ১৯১২ খ্রীঃ এন্ট্রাশ (এসএসসি) পরীক্ষায় চট্টগ্রাম জেলায় প্রথম হয়ে প্রথম বিভাগে পাশ করেন। এ দু’ ভাইয়ের কৃতিত্ব নিয়ে সমগ্র চট্টগ্রাম জেলার মুসলিম সম্প্রদায় গৌরববোধ করেছিলেন এবং দেখার জন্য গ্রামের বাড়িতে যেতেন। ১৯১২ খ্রীঃ চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন আইএসসি শ্রেণিতে। অঙ্ক ও পদার্থ বিদ্যা ছিল তাঁর মূল বিষয়। জেলা বৃত্তি পাওয়ায় টিউশান ফি দিতে হয়নি। বই কেনার জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ টাকা দিয়েছিল। ১৯১৪ খ্রীঃ পুনরায় জেলা বৃত্তি নিয়ে তিনি আইএসসি পাশ করেন।

কি পড়বেন, কোথায় পড়বেন, আর্থিক সাহায্যই বা যোগাড় হবে কি করে, এসব যখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। (কেননা পনর টাকার মাসিক বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ সম্ভব নয়।) তখন চাচা আহমেদ মিয়া চৌধুরী (আবু মোহাম্মদ তবিবুল আলমের পিতা) বলেছেন আবুল হাশেম কলিকাতায় ডাক্তারি পড়ছে, আবদুল খালেকও সেখানে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে।
চাচার অনুপ্রেরণায় ও সাহসে ভর করে তিনি শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। ভর্তির ব্যাপারে বড় ভাই ডা. হাশেম সহযোগিতা করেন। চাচা আহমেদ মিয়া চৌধুরীর বদান্যতায় দীর্ঘ পাঁচ বছর পড়ালেখা করে কৃতিত্বের সাথে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। তিনি দেখতে সুপুরুষ ছিলেন। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষকবৃন্দ তাঁকে উর্দুভাষী ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান মনে করতেন। ইংরেজি ও উর্দু দু’ভাষাতেই তিনি পড়তেও লিখতে পারতেন। চমৎকার ভাষায় স্যারদের সাথে কথা বলতেন। এক পরীক্ষক একবার তাঁকে পরখ করার জন্য ইংরেজি ও উর্দু দু’ ভাষায় পরীক্ষা নেন। খালেক সাহেব দু’ভাষাতেই সমান পারদর্শিতার সাথে উত্তর দিয়ে পরীক্ষককে হতভম্ব করেন। তিনি অংকে ১০০ ও ইংরেজিতে ৯৮ নম্বর পেয়েছিলেন ৮ম শ্রেণী বৃত্তি পরীক্ষায়।
ইঞ্জিনিয়ার হয়ে আসার পর তিনি সকল স্কুল শিক্ষকদের সাথে দেখা করেছেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে। অবসর সময়ে বন্ধুদের নিয়ে মসজিদ ও মক্তব পরিষ্কার করতেন। বিনে পয়সায় ইংরেজি অঙ্ক শিখাতেন। স্কুলে স্কুলে গিয়েও তিনি ক্লাস নিতেন অবসর সময়ে। অনেক সময় মসজিদে আযান দেয়া ও ইমামতিও করেছেন। ধার্মিক, বন্ধুবৎসল, সমব্যথী পরোপকারী আবদুল খালেক ছিলেন সকলের প্রিয় ও আদর্শ মানুষ।

১৯২০ সালে চট্টগ্রাম ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানীতে সহকারী তড়িৎ প্রকৌশলী হিসেবে চাকুরী জীবন শুরু করেন। তাঁর কার্যক্রমে সন্তুষ্ট হয়ে কর্তৃপক্ষ ৫/৬ বছরের মধ্যে তাঁকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি দেন। চাকুরির প্রলোভনে তিনি আত্মসমর্পণ করেননি বলেই ১৯৩২ সালে চাকুরী থেকে ইস্তফা দেন। চিটাগাং ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোং আরো পদোন্নতি দিয়ে চাকুরী করার জন্য প্রস্তাব দিলেও তিনি সহাস্যে তা ফিরিয়ে দেন। আসলে ঐ সময় থেকেই মনের ভাবান্তর ঘটে। মানুষের জন্য দেশের জন্য কিছু করার মানসিকতায় তিনি আক্রান্ত হন। মধ্যবর্তী সময়ে স্কুলের সহপাঠি বন্ধু আবদুল জলিল বি.এ. (আলিগড়), (মাষ্টার আবদুল জলিলের সাথে) রেঙ্গুন গমন করেন। সে সময়েই কুতবুল আউলিয়া আউলাদে রসূল শাহেনশাহে সিরিকোটি পেশোয়ারী হুজুর হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব হাফেজ সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ (রহ.)এর সাথে পরিচয় হয়। অতঃপর বাইয়াত গ্রহণ করেন। কিছুকাল রেঙ্গুনে কাটিয়ে চট্টগ্রাম প্রত্যাবর্তন করেন। এরপরেও সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য কয়েকবার রেঙ্গুন সফর করেছেন। মুর্শিদের সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন বিন¤্র শ্রদ্ধা ও একাগ্রতার সাথে। শশ্রুমন্ডিত দুধে আলতা রং মেশানো সৌম্যকান্তি চেহারায় নূরানী ঝলক উদ্ভাসিত হতো সর্বদা। তাঁর আকর্ষণীয় নূরানী চেহারার দিকে তাকালে অজান্তে শ্রদ্ধায় বিগলিত হয়ে উঠতো যে কারো মন। আবেগহীন, সরল চাহনী, মধুর হাসি ও বিনয়ী বাক্যালাপে শ্রোতা দর্শক, বিন¤্র শ্রদ্ধায় ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ভক্ত হয়ে যেতো। স্বীয় কর্মপরিধিকে বিস্তৃত করে মানব কল্যাণে নিজেকে সমর্পিত করে ¯্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন করাই ছিল তাঁর প্রতিটি কর্মের মহৎ উদ্দেশ্য। ধার্মিক পরিবারের সন্তান বিধায় আল্লাহ্-রসূল এর প্রতি স্বভাবজাত শ্রদ্ধাবোধ ও নিঃশর্ত সমর্পণে তিনি সন্তুষ্ঠি লাভে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। মানুষ যে পেশায় থাকুক না কেন তাকে ঝড়পরধষ এবং জধঃরড়হধষ নবরহম হিসেবে সমাজে বিচরণ করতে হবে। নইলে তার সৃষ্টিশীল যে কোন কর্ম অভিশাপ হয়ে ফিরে আসবে নিজের দিকে।

ব্যবসায়ী জীবনের শুরুতে ১৯২৯ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন কোহিনূর লাইব্রেরি অথচ তড়িৎ প্রকৌশলীর ব্যবসা হওয়া ছিল লব্ধ জ্ঞান বিষয়ভিত্তিক। জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের মহাসোপান হচ্ছে লাইব্রেরি বা পাঠাগার। বিনে পয়সায় গরীব শিক্ষার্থীদের বই প্রদান, পত্রিকা পড়া ও বই পড়ার সুযোগ ছিল কোহিনূর লাইব্রেরীতে। জ্ঞানার্জন ও পাঠক সৃষ্টি করার গভীর প্রত্যয় নিয়ে তিনি প্রথম এ ব্যবসার গোড়াপত্তন করেন। সম্মানজনক পদবী ও মোটা অংকের মাসোহারা ত্যাগ করে সামান্য একটা লাইব্রেরি খুলে বসায় আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের অনেকেই মন ভারাক্রান্ত করেছিলেন সে সময়। কিন্তু স্থির প্রতিজ্ঞা ও লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করলে সুনাম অর্জনে সহায়ক হয়। তেমনি কয়েক বছরের মধ্যে কবি, সাহিত্যিক, জ্ঞানী-গুণী অনেকেই এ লাইব্রেরির নিয়মিত পাঠক বনে যান। জ্ঞান আহরণে সমৃদ্ধ হন। কিছুদিনের মধ্যে (১৯৩০ সালে) কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস স্থাপন করেন। ছাপাখানা জগতে নবদিগন্তের সূচনা করেন। উভয় প্রতিষ্ঠান ঐতিহাসিক আন্দরকিল্লা মোড়ের দু’পাশে অবস্থিত। অর্থপ্রাপ্তির চেয়ে বইপড়া, জ্ঞানসমৃদ্ধ হবার অভ্যাস গড়ে তোলার প্রয়োজনেই তিনি পাঠাগার ও ছাপাখানা স্থাপন করে একটি অপরটির পরিপূরক হিসেবে।

‘কোহিনূর’ পারিবারিক কারো নাম নয়। মুসলমানদের শৌর্যবির্যের প্রতীক মুঘল সা¤্রাজ্যের মহামূল্যবান হীরক খন্ডের মুকুটকে স্মরণ করেই এ নামাকরণ। মুসলমান কবি, সাহিত্যিকদের রচনা ছাপানোর জন্য কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বল্প অর্থে বা বিনা অর্থে ছাপার কাজ করে দিতেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন চলাকালীন ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে রফিক, জব্বার, বরকত, সালামসহ অনেক শহীদ হলে জলবসন্ত রোগে আক্রান্ত চট্টগ্রামের গৌরব লেখক কবি মাহবুব আলম চৌধুরী (গহিরা রাউজান উপজেলা) শহীদদের উদ্দেশ্য করে রচনা করেন ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ এক অমরগাথাঁ দীর্ঘ কবিতা। তৎকালিন নুরুল আমিন সরকারের প্রশাসনের নির্যাতনের ভয়ে সেই কবিতাখানা ছাপাতে কেউই রাজি হননি। অমিত সাহসের অধিকারি ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক মাতৃভাষার প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধার কারণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁর প্রেস থেকে ছাপিয়ে দেন। ভোর হতে না হতেই পুলিশ প্রেসে এসে ম্যানেজার দবির উদ্দিন ছাহেবকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। প্রেস মালিককে গ্রেফতার করতে চাইলে দবির আহমদ চৌধুরী স্বেচ্ছায় মালিকের অজান্তে এ কবিতা ছাপিয়েছেন বলে পুলিশকে অবহিত করেন যদিও এটা সত্য নয়, তথাপি শ্রদ্ধাস্পদ গুণীজনকে গ্রেফতার এড়ানোর কৌশল ছিল এটি। দবির আহমদ সাহেব কয়েকমাস জেল খেটে মুক্ত হন। একুশের প্রথম কবিতা ছাপিয়ে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক সর্বমহলে প্রশংসিত হলে দৃঢ়তা ও সাহস প্রত্যক্ষ করে আপামর জনতা আরেকবার বিন¤্র শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন এ মহানূভব ব্যক্তিত্বকে।

শৈশব থেকে তিনি ধর্মানুরাগী ছিলেন। একথা পূর্বে বিধৃত হয়েছে। প্রাথমিক হতে কলেজে পড়া অবধি সবসময়ই ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ধর্মীয় কার্যাদি যথাসময়ে নিষ্ঠার সাথে পালন করতেন। কোহিনূর লাইব্রেরি ও কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস স্থাপন করে লেখক পাঠক ও জ্ঞানচর্চার ধারা রচনা করলেও স্বাধীন মতামত জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহের ব্যাপারে গঠনমূলক আলোচনা-সমালোচনা ও যুক্তিনির্ভর পরামর্শ উপস্থাপন করতে হলে একটি সংবাদপত্র প্রয়োজন, যেখানে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা সম্ভব হবে। এ উপলব্ধি হতে তিনি সাপ্তাহিক কোহিনূর পত্রিকা বের করেন এবং ১৯৬০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদী পত্রিকা বের করেন। ইতোপূর্বে চট্টগ্রামে বহু সংবাদপত্র বের হলেও কোনটি স্থায়ীভাবে টিকে থাকতে পারেনি।

দৈনিক আজাদী প্রতিষ্ঠালগ্নে তিনি আপন মুর্শিদ আউলাদে রসূল কুতবুল আউলিয়া হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব হাফেজ সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি (রহ.) এর দো‘আ প্রার্থনা করেন। হুযুর পত্রিকার গ্রহণযোগ্যতা ও স্থায়িত্বের জন্য দোআ করেন এবং হুজুরের মুরীদানদের সকলকে একখানা পত্রিকা ক্রয় করে পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। হুজুর আরো বলেছিলেন চট্টগ্রামে কোন পত্রিকার প্রকাশনা স্থায়ী হয়নি। এ পত্রিকা স্থায়ীভাবে দ্বীন মিল্লাত মাযহাব ও কওমের খেদমত আঞ্জাম দিবে ইনশাআল্লাহ্। অসংখ্য ঘাত-প্রতিঘাতের মুখোমুখি হয়েও বন্ধুরপথ পাড়ি দিয়ে ‘দৈনিক আজাদী’ স্বতন্ত্রভাবে প্রতিষ্ঠা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করে চলেছে। এ পত্রিকার বৈশিষ্ট্য হলো, শরীয়ত তরিকত তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের প্রচার প্রসারে অনন্য ভূমিকা পালন ও লেখক, কবি সাহিত্যিক সৃষ্টি করা যা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
শেরে বাংলা আজিজুল হক আলকাদেরী (রহ.)’র ওপর ওহাবীদের সশস্ত্র আক্রমণ ও দৈহিকভাবে লাঞ্চিত করার বিরুদ্ধে তিনি তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং আদালতে মামলা চলাকালে সার্বিকভাবে সহায়তা করার ফলে দোষীদের জেল জরিমানা হয়েছিল।

আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের খতীব হিসেবে আউলাদে রসূল হযরতুল আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ আবদুল করিম (র.) কে খতীব নিয়োগ দেয়া হলে একদল নবী-ওলী দুশমন মুসল্লিদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন। তখন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বিজ্ঞপ্তি ছাপিয়ে যৌক্তিক বক্তব্য প্রদান করে মুসল্লীদের শান্ত করেন এবং খতীব সাহেব নির্বিঘেœ বহু বছর ইমামত ও খেতাবতের দায়িত্ব পালন করেন। ভিক্ষুক আসলে তাকে আজাদী পত্রিকার কতগুলো কপি হাতে দিয়ে এগুলো বিক্রী করে কমিশন নিয়ে জীবিকার্জন করার পরামর্শ দিতেন। এভাবে অনেক পত্রিকা হকার সৃষ্টি করেছেন তিনি।

রেঙ্গুনে গিয়ে তিনি পীর ছাহেব ক্বিবলা সৈয়্যদ আহমদ শাহ (রহ.) কে চট্টগ্রাম আসার অনুরোধ জানান। ১৯৪১ সালে রেঙ্গুন ত্যাগ করে ছিরিকোট শরীফে প্রত্যাবর্তনকালে হুযুর চট্টগ্রামে সংক্ষিপ্ত অবস্থান করেন। কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের ওপর তলায় হুজুর ক্বিবলার অবস্থান ছিল বিধায় এটা খানকাহ শরীফ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এখান হতে সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়া তথা সুন্নীয়তের আন্দোলনের গতি সঞ্চার হয়। ১৯৪২ সাল হতে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর হুজুর চট্টগ্রাম তথা পূর্ব পাকিস্তান সফরকালে কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের ওপরের তলায় অবস্থান করে শরীয়ত তরীক্বতের যাবতীয় কার্যাদি সম্পন্ন করতেন। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ধার্মিক স্ত্রী হুজুরের খানাপিনা, আগত মেহমানদের আপ্যায়ন প্রভৃতি কাজ অত্যন্ত আগ্রহ ও নিষ্ঠার সাথে সম্পাদন করতেন। হুজুর তাকেও খুবই ¯েœহ করতেন। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই ছিলেন ফানাফিশ শায়খ।
ঐতিহাসিক দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া প্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কোহিনূর লাইব্রেরির ওপর তলায় তাঁরই উপস্থিতিতে হতো। তিনি আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট ও জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া পরিচালনা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ একাধিক পদে অধিষ্ঠিত থেকে জোরালো ভূমিকা রেখেছেন। বছরের পর বছর তিনি ও তাঁর বিদূষী স্ত্রী হুজুরের ও পীরভাইদের খেদমত করেছেন সদা প্রফুল্লচিত্তে। হুজুর সিরিকোটি (রহ.) ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ছাহেবের খেদমত ও দ্বীন-মাযহাব মিল্লাতের প্রচার-প্রসারে নিঃস্বার্থ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রিয় মুরীদানকে সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়ার খেলাফতদানে গৌরবান্বিত করেন। নিরহংকার, সদা হাস্যোজ্জ্বল অভিব্যক্তি, ¯েœহ-মমতায় কথোপকথন, প্রচার-বিমুখ কার্যক্রম তাঁকে পীর ভাইসহ সকল পেশা শ্রেণির মানুষের নিকট অত্যন্ত প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেছিলেন। কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবি, সাংস্কৃতিক ব্যবসায়ী সরকারি আমলা থেকে শুরু করে ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে এমন কি ভিক্ষুক পর্যন্ত সকলের কাঁছে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব পরম শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। মুরুব্বীদের নিকট শুনেছি আমি নিজেও প্রত্যক্ষ করেছি যে, তিনি যার সাথে কথা বলেছেন, সেই তাঁকে আপন মনে করতেন। সকলের সুখ-দুঃখের সাথী হিসেবে তিনি নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। হুজুর ক্বেবলার সফরসঙ্গী হয়ে হজ্বব্রত পালন করেছেন। ১৯৫৮ সালে হুজুর সিরিকোটি (রহ.)’র দৌহিত্র সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ মাদ্দাজিল্লুহুল আলী ও একমাত্র ছাহেবজাদা গাউসে জমান হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (রহ.) কে সাথে নিয়ে চট্টগ্রাম সফরে এসে প্রায় ৬/৭ মাসব্যাপী অবস্থান করেন। হুজুর এখান হতেই ৩০/৩৫ জন মুরীদসহ ষ্টীমারযোগে হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে জেদ্দা যাত্রা করেন। হুজুর তৈয়্যব শাহ্ দেশে ফিরে যান। এটাই ছিল সিরিকোটি (রহ.)’র শেষ হজ্ব এবং চট্টগ্রাম তথা পূর্ব পাকিস্তানে আখেরী সফর। হজ্ব শেষে হুজুর জেদ্দা হতে স্বদেশ (পেশোয়ার) প্রত্যাবর্তন করেন। সফরসঙ্গী মুরীদানবৃন্দ ষ্টীমার যোগে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন। হুজুর দেশে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। হুজুরকে চট্টগ্রাম আনার জন্য ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের নেতৃত্বে ৮/১০ জন নেতৃস্থানীয় পীরভাই সিরিকোট শরীফ গমন করেন। কিন্তু হুজুর আসেননি। হুজুর বলেন মন চায় যাবার জন্য, কিন্তু ওপরওয়ালার হুকুম নেই। সুস্থ হলেই সফরে আসবেন এ রকম কথা বলে ভাইদের বিদায় দেন। মনঃক্ষুন্ন হয়ে ভাইয়েরা হুজুরের দোয়া নিয়ে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন। প্রাণপ্রিয় মুর্শিদকে আনতে না পেরে খুবই ব্যথিত হয়েছিলেন। বুঝতে বাকি রইলোনা যে, হুজুর তাঁদের ছেড়ে যাবেন।

১৯৬১ সালের ২২ মে শাহেনশাহে সিরিকোট আওলাদে রসূল, সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ ইন্তেকাল করেন (ইন্না……রাজেউন)। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব মুর্শিদের বিয়োগ ব্যথায় শোকাতুর হয়ে পড়েন।
মুর্শিদের সাথে বিচ্ছেদ তাঁকে খুব বেশী ব্যথিত করেছিল। অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে ১৯৬২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর এ মহান ব্যক্তিত্ব সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়ার উজ্জ্বল নক্ষত্র পীরভাইদের নয়নমণি সাধারণ মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু সমাজ সচেতন আলোকিত মানুষ শ্রদ্ধাস্পদ ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজেউন)
মানবসেবা ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ একথা তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস ও চর্চা করতেন কখনো নিরবে নিভৃতে কখনো প্রকাশ্যে। ১৯৩৮ সালে তুরস্কে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প হলে হাজার হাজার মানুষ মারা যান এবং বেঁচে যাওয়া মানুষের চরম হতাশায় অসহায় হয়ে পড়লে ইঞ্জিনিয়ারের দরদী মন কেঁদে উঠে। তিনি তুরস্কের দুর্গত মানুষের সাহায্যার্থে রাজপথে নেমেছিলেন সাহায্য সংগ্রহে। খান বাহাদুর ফরিদ আহমদ চৌধুরী, মুসলিম হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবদুর রহমান এম.এ.বিটি ও ডা. আবুল হাশেমসহ অনেক বিশিষ্টজন তার সাথে ঐকব্যদ্ধ হয়ে সাহায্য সামগ্রী সংগ্রহ করেন। সংগৃহীত অর্থ তুরস্কের দুর্গত মানুষের জন্য প্রেরণ করেছিলেন।

১৯৬০ সালের ৩১ অক্টোবর চট্টগ্রামসহ দেশের উপকুলীয় অঞ্চলে প্রলয়ংকারী ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে লক্ষ লক্ষ আদম সন্তান মারা যায়। বাড়ি ঘর, সহায় সম্পত্তি সবকিছু হারিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ খোলা আকাশের নিচে অনাহারে অর্দ্ধাহারে পড়ে থাকে। মানবসেবক ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক কালবিলম্ব না করে চট্টগ্রাম রেডক্রস মুসলিম লীগ চট্টগ্রাম চেম্বার ও আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া প্রভৃতি সংগঠনসমূহ একত্রিত করে তাঁরই উদ্যোগে ও নেতৃত্বে ত্রাণ কমিটি গঠন করেন। মরহুম জানে আলম দোভাষ, আবদুল গণি দোভাষ ও আলহাজ্ব মুন্সেফ আলীর নিকট হতে ৫টি ষ্টীমার বোঝাই চাল ডাল তেল শাড়ি, লুঙ্গিসহ মরহুম এডভোকেট কামাল উদ্দিনের নেতৃত্বে দক্ষিণ চট্টগ্রামের দুর্গত এলাকায় পাঠানো হয়। রিলিফ সামগ্রীর খাজাঞ্ঝীরূপে আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়ার সদস্য শেখ আফতাব উদ্দিন (শেখ সৈয়্যদ ক্লথ ষ্টোরের মালিক), ইসলাম ক্লথ (ষ্টোরের মালিক মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম) ন্যাশনাল প্রেসের মালিক আবদুর রহিম, রাউজানের মাওলানা মুহাম্মদ জাকারিয়া, কাজির দেউরীর আবদুস সালাম, পাথরঘাটার আবদুল জলিল, জাকের হোসেন, মুহাম্মদ শরীফ, হাজী আবুল কাশেমসহ জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার ২০ জন ছাত্রকে দূর্গত এলাকায় পাঠিয়ে ছিলেন। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ ‘আর্ত মানবতার সেবাই পরম ধর্ম’ একথা তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪০ সালে চট্টগ্রামে যে লঙ্গরখানা খোলা হয়েছিল তারও অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন এ মানবপ্রেমিক।

মেধা ও মননের সংমিশ্রণে তিনি সৃজনশীল প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। জ্ঞান নির্ভর সমাজ নির্মাণে আল্লাহ্-রসূল প্রেমে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষে তাঁর সমুদয় কর্মকান্ড আবর্তিত হতো। নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী সমসাময়িক ইতিহাসে জনদরদী ফানাপীর শায়খ, সহজ সরল নিষ্ঠাবান, ধার্মিক ব্যক্তি আলহাজ্ব ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক বহুমুখি প্রতিভাসম্পন্ন এক বিরল ব্যক্তিত্ব। তিনি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের আদর্শ ব্যক্তি। তাঁর সমকক্ষ মানুষ এখন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
তিনি শুধু লাইব্রেরি, ছাপাখানা, পত্রিকা, মাদরাসা, খানকা প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি নিজেও একজন সুলেখক, সমালোচক, সংবাদকর্মী হিসেবে সমধিক পরিচিত। মহাকবি স্যার আল্লামা ইকবালকে নিয়ে তাঁর লেখা কবিতার কয়েকটি চরণ:
কবি ইকবাল তুমি দিকপাল
বলিয়াছে কতজনে
আমি শুধু রূপ অভিনব,
আকিঁয়াছি মনে মনে।
ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের লিখিত ১৭টি বইয়ের নাম পাওয়া যায়।
১. প্রাথমিক ভূগোল বিজ্ঞান ও গ্রাম্যজীবন। ২. রচনার প্রথম ছড়া ৩. উর্দু প্রাইমার, ৪. বয়েস ইংলিশ গ্রামার, ৫. ফাস্ট বুক অব ট্রান্সলেশন, ৬. চাইল্ড পিকচার ওয়ার্ড বুক, ৭. ব্যাকরণ মঞ্জুষা, ৮. তাওয়াফ (হজ্বের বই) ৯. ঝলমল (শিশুপাঠ), ১০. মুসলিম বাল্য শিক্ষা, ১১. সহজ পাঠ (শিশু পাঠ)। এ ছাড়া সাপ্তাহিক কোহিনূর দৈনিক আজাদীতে অসংখ্য প্রবন্ধ সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছে। কোহিনূর পত্রিকার ১ম সংখ্যা ওরছুন্নবী (মিলাদুন্নবী) উপলক্ষে ‘বিশ্বনবী সংখ্যা’ নামে বের করা হয়েছিল।
উপমহাদেশের কবি সাহিত্যিক, রাজনীতিকদের অনেকের সাথেই তাঁর সখ্যতা ছিল।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি আপন মুর্শিদের দিকনির্দেশনা, হেদায়ত আমল করে কাটিয়েছেন। মরহুমের একমাত্র পুত্র দৈনিক আজাদীর মালিক সম্পাদক এম এ মালেক আনজুমান এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের সম্মানিত উপদেষ্টা, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ও তাঁর বিদূষী স্ত্রী মালেকা বেগমকে জামেয়া মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। আনজুমান ও জামেয়া তথা সিলসিলার প্রচার-প্রসারে তাঁর অমূল্য অবদানের কারণে তিনি আমাদের গৌরবোজ্জ্বল পথিকৃৎ। তাঁর আদর্শ অনুসরণে আমরা হতে পারি আল্লাহ্-রসূল (দ.)এর নৈকট্যধন্য ও মুর্শিদে বরহকের যোগ্য মুরীদ। আমাদের এ অভিভাবকের দরজা আল্লাহ্ জাল্লাশানুহু বুলন্দ করুন। কবির ভাষায় বলা যায়!
এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ
মরণে তাহা তুমি করে গেলে দান।’’
আল্লাহ্ আমাদের সকলকে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে অনুসরণ করার তওফিক দিন। আ-মী-ন।

প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স সেক্রেটারি-আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট, চট্টগ্রাম।