শাহানশাহ্-এ সিরিকোট বিশ্বব্যাপি সুন্নিয়তের জাগরণে তাঁর অবদান -১

শাহানশাহ্-এ সিরিকোট বিশ্বব্যাপি সুন্নিয়তের জাগরণে তাঁর অবদান -১

শাহানশাহ্-এ সিরিকোট বিশ্বব্যাপি সুন্নিয়তের জাগরণে তাঁর অবদান -১

মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার >

গাউসে জামান, সৈয়্যদুল আউলিয়া,পেশওয়ায়ে আহলে সুন্নাত, আল্লামা হাফেজ সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি, পেশোয়ারী (রাহ.), কালে কালে কখনো ‘আফ্রিকাওয়ালা পীর’, কখনো ‘সীমান্ত পীর’, কখনো ‘পেশওয়ারী সাহেব’, শেষের দিকে ‘সিরিকোটি হুজুর’, এমনকি চট্টগ্রামে শুভ আগমনের শুরুতে ‘ইন্জিনিয়ার সাহেবের পীর’ হিসেবেও অভিহিত হতেন। এই ক্ষণজন্মা মহান সংস্কারক অলীই এই নিবন্ধে ‘শাহানশাহ্ এ সিরিকোট’ উপাধিতে আলোচিতব্য। আজ বাংলাদেশ’র সুন্নি অঙ্গনে এই ‘শাহানশাহ্ এ সিরিকোট’ একটি প্রাতঃস্মরণীয় নাম, একটি জাগরণী শ্লোগান। শাহানশাহ্ এ সিরিকোট’র জন্ম পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের বর্তমান খাইবার পাখতুন প্রদেশের বিখ্যাত মাশওয়ানি, ‘সৈয়্যদ’ অধ্যুষিত ‘সিরিকোট’ পার্বত্য অঞ্চলের শেতালু শরিফে ১৮৫৬-৫৭ খ্রিষ্টাব্দে বা তারও কয়েকবছর আগে। তিনি বংশ পরম্পরায় হযরত ইমাম হোসাইন (রাদ্বি.)’র মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ৩৮তম অধস্তন বংশধর। [শাজরা শরীফ, প্রকাশনায়, আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট]

ইমাম হোসাইন (রাদ্বি.)’র পঞ্চম অধস্তন বংশধর সৈয়্যদ জালাল আর রিজাল (রাহ.)মদিনা পাক ছেড়ে ইরাকের ‘আউস’ এ চলে আসেন। পরবর্তিতে তাঁর ৫ম অধস্তন বংশধর মীর সৈয়্যদ মুহম্মদ গেসুদারাজ সুলতান মাহমুদ গজনবী (রাহ.)’র সময়ে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে আফগানিস্তান হিজরত করেন, এবং তাঁর সাথে ভারত অভিযানেও শরীক হন। আফগান-বেলুচিস্তানের সীমান্তের ‘কোহে সোলাইমানি’তে তিনি শায়িত আছেন, যে জায়গাটি সুলতান গজনবীর উপহার হিসেবেই তিনি লাভ করেন, এবং এখানে বসেই তিনি মুলতান পর্যন্ত ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে দিয়ে ৪২১ হিজরিতে ওফাত বরণ করেন, আর এই সময়টা ছিল খাজা গরীব নওয়াজ মঈনুদ্দিন চিশতি (রাহ.)র ভারত আগমনের দুইশ বছর আগে। এ গেসুদারাজ (আউয়াল)’রই ১২ তম অধস্তন পুুরুষ হলেন সিরিকোট বিজয়ী, ফাতেহ্ সিরিকোট সৈয়্যদ গফুর শাহ্ ওরফে কাপুর শাহ্ (রাহ.)। [Local govt. Act: (Ref-15) Hazara 1871]

তিনি আফগানের কোহে সোলাইমানি হতে হিজরত করে উত্তর- পশ্চিম সীমান্তের কোহে গঙ্গরে আসেন এবং অত্যাচারী শিখ রাজাদের প্রতিহত করে যে এলাকাটি ইসলামের জন্য আবাদ করেন এর বর্তমান কেন্দ্রস্থল ‘সিরিকোট’। ‘সের’ মানে মাথা, আর কোহ্ ‘হল পাহাড়। ‘সেরকোহ’ মানে ‘পাহাড়ের চূঁড়া’ বা পাহাড় শীর্ষ। এই ইসলাম বিজয়ী বীর হযরত সৈয়্যদ গফুর শাহ্ ওরফে কাপুর শাহ্ (রাহ.)গঙ্গর পাহাড়ের একদম মাথায় বসবাস করতেন বিধায় তাঁর আবাস বুঝাতে ‘সেরকোহ্ শব্দটি ব্যবহার হয়, এবং কালের বিবর্তনে মানুষের মুখে শব্দ পরিবর্তনের স্বাভাবিক ধারায় বর্তমানে এ এলাকা ‘সিরিকোট’ হিসেবে পরিচিত হয়েছে। ফাতেহ্ সিরিকোট সৈয়্যদ গফুর শাহ্ (রাহ.)’র ১৩ তম অধস্তন পুুরুষ হযরত সৈয়্যদ সদর শাহ্ (রাহ.)’র ই শাহজাদা হলেন এই প্রবন্ধে আলোচিত শাহানশাহ্ এ সিরিকোট, আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি, পেশোয়ারী (রাহ.)।
[শাজরা শরীফ, প্রকাশনায়, আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট] সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়ার এই মহান দিকপাল শুধু কাদেরিয়া ত্বরিকাকে নয়,এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে ভ্রমন করে সুন্নিয়তকেও পূনর্জাগরিত করেছিলেন তাঁর শতাধিক দীর্ঘ হায়াতে তাইয়্যেবাকে কাজে লাগিয়ে। তাই আজ বাংলাদেশ-বার্মা, আফ্রিকা-পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য সহ পৃথিবীর বহুদেশ-জনপদে একটি আদর্শ, একটি প্রেরণার নাম হলেন শাহানশাহে সিরিকোট (রাহ.)।

ক. শিক্ষা-দীক্ষা
ঐতিহ্যগত উন্নত পারিবারিক শিক্ষা, তালিম, তারবিয়তের পাশাপাশি তিনি ছিলেন পরিত্র কোরানে করিমের হাফেজ। কোরান, হাদিস, উসুল-ফেকাহ্ ইত্যাদি দ্বীনিয়াত বিষয়ে শিক্ষা তিনি স্থানীয় আটক জেলা সহ ভারত-পাকিস্তানের বিভিন্ন মাদ্রাসার উপযুক্ত ওস্তাদগন থেকে আয়ত্ব করেন। লিখিত সনদ অনুসারে, ১২৯৭ হিজরির শা’বান মাসে তাঁকে ‘মমতাজুল মুহাদ্দেসীন’ সনদ প্রদান করে দস্তারে ফজিলত অর্পন করা হয়।
যা ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের কোন এক তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ প্রদান করেন। তাঁর ত্বরিকত জীবনের দীক্ষা গুরু ছিলেন হরিপুরের বিখ্যাত কামেল অলী, গাউসে দাঁওরা, খলিফায়ে শাহে জীলাঁ, খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী আল আলাভী (রাহ.)। [শাজরা শরীফ, প্রকাশনায়, আনজুমান -এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট]

১৯১২ তে, আফ্রিকা হতে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তিনি শত শত বছরের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার এমন কামেল মুর্শিদের হাতে বায়াত গ্রহণ করে ত্বরিকত জীবনের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেন। তাঁর পীর খাজা চৌহরভী (রাহ.)’র আধ্যাত্মিক মর্যাদার অনুমান সাধারনের জন্য সাধ্যাতীত। যিনি প্রাতিষ্ঠানিক-আনুষ্ঠানিক কোন প্রকারের শিক্ষার্জনের সুযোগ লাভ করতে পারেননি, অথচ তাঁর অদৃশ্য আধ্যাত্মিক ‘ইলমে আতায়ি’ দিয়ে রচনা করে গেছেন ১৮ টি কিতাব। এর একটি কিতাব হল ৩০ পারা বিশিষ্ট দরুদ গ্রন্থ ‘মজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’, যা বড় বড় আল্লামাদের পর্যন্ত আক্বল হয়রান হবার মত একটি কিতাব। দুনিয়ার বুকে কোরান শরিফ, বোখারি শরিফের পর এটিই তৃতীয় ৩০ পারা কিতাব যা মাকসাদ হাসিল ও বরকতের জন্য খতম দেওয়ার রেওয়াজ চালু আছে। বিশুদ্ধ আরবীতে রচিত এ অনবদ্য দরুদ গ্রন্থের একটি কপি মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের এক আরব পাঠকের নজরে আসবার পর, তিনি কিতাবটির মলাটে আরবিতে একটি মন্তব্য লিখে যান যে, ‘‘এটা কখনো কোন অনারবের রচনা হতে পারেনা’’। উল্লেখ্য, যেহেতু এ বিরল দরুদ গ্রন্থের লেখক খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী (রাহ.)’র পরিচয় হল তিনি পাকিস্তানের হরিপুর জেলার বাসিন্দা, একজন অনারব। অর্থাৎ অনারবের পক্ষে এত উচ্ছাঙ্গের আরবী ভাষার কিতাব রচনা কখনও সম্ভব হবার কথা না।