ইসলামী ফিকহের বিস্ময় ইমামে আযম আবূ হানিফা

ইসলামী ফিকহের বিস্ময় ইমামে আযম আবূ হানিফা

ইসলামী ফিকহের বিস্ময় ইমামে আযম আবূ হানিফা –
মাওলানা আহমদুল্লাহ ফোরকান খান কাদেরী >

ইমাম আবূ হানীফা রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি হচ্ছেন ইমামুল আইম্মা  অর্থাৎ ইমামগণের ইমাম। বর্তমান যুগের আহলে হাদীস নামধারী গুটিকয়েক কুয়োর ব্যাঙ ছাড়া সকল যুগের সকল মাযহাবের মুফতি, মুহাদ্দিস ও মুফাস্সিরগণের কাছে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ও বরেণ্য। আমরা নির্ভরযোগ্য ও সুবিখ্যাত কয়েকটি কিতাব থেকে ইমামে আযমের অতুলনীয় ইলমের কয়েকটি ঝলক দেখবো। মজার ব্যাপার হচ্ছে- ওই কিতাবগুলোর লেখকগণ সকলেই শাফেয়ী মাযহাবের। পূর্বেই বলে রাখি এ লেখাটি ইমাম আবূ হানীফার জীবনীমূলক কোন নিবন্ধ নয়। তদুপরি এই লেখা বা নিম্নে বর্ণিত কয়েকটি ছোট ঘটনা থেকে ইমামে আ’যমের রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি মর্যাদা ও ইলমের গভীরতা আন্দাজ করা সমুদ্রতটে দাঁড়িয়ে পানির পরিমাপ করার মতোই দুঃসাধ্য।
ইমামে আ’যমের আলোচনা করতে গিয়ে হাফিয ইবনে কাসীর লিখেনঃইমাম শাফেয়ী (রহঃ) বলেছেন,
‘‘ইলমে ফিকহের অন্বেষণকারীগণ ইমাম আবূ হানীফার পোষ্যবর্গ বা সন্তান তুল্য।’’ (১)
আবদুল্লাহ বিন দাঊদ আল হুরাইবী বলেন, ‘‘প্রত্যেক মানুষের (মুসলমানের) উচিত, নামায পড়ে ইমাম আবূ হানীফার জন্য দোয়া করা – মুসলিম উম্মাহর জন্য ফিকহ ও সুন্নাহর ভান্ডার সংরক্ষণ করার জন্য।’’ (২)
খতীব বাগদাদী বর্ণনা করেন, ‘‘ইমাম আবূ হানীফা রাত্রি বেলায় নামাজ (তাহাজ্জুদ) পড়তেন। প্রতি রাতে কুরআন তিলাওয়াত করতেন যে,  সে সময় এমন কান্নাকাটি করতেন প্রতিবেশীরা (আতঙ্কিত হয়ে) তাঁর জন্য দোয়া করতো। চল্লিশ বছর যাবৎ এশার নামাযের ওযূ দিয়ে ফজরের নামায পড়েছেন। যে স্থানে তাঁর ইন্তেকাল হয়েছে  সেখানে সাত হাজার বার কুরআন করীম খতম করেছেন।’’(৩)
ইবনে কাসীর আরো লিখেন, ‘‘ইমামে আযমের ইন্তিকালের পর এত বেশী লোকের সমাগম হয়েছিল যে, তাঁর জানাযা হয়েছিল ছয়বার। (উল্লেখ্য, একাধিক জানাযা পূর্ব নির্ধারিত ছিল না। মানুষের অত্যধিক ভিড়ের কারণে একই স্থানে পরপর ছয়বার নামায পড়তে হয়েছিল)। (৪)
ইমাম আবূ হানীফা (রহ) এর পৌত্র ইসমাঈল বিন হাম্মাদ বিন আবূ হানীফা (রহঃ) বলেন,
‘‘ইমাম আ’যমের পিতা সাবিত শৈশবে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর কাছে (স্বীয় পিতার সাথে) গিয়েছিলেন। তখন হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁর ও তাঁর  বংশের বরকতের জন্য দোয়া করেন। আমাদের বিশ্বাস আল্লাহ তা‘আলা সেই দোয়া কবুল করেছেন।’’(৫)
আবূ ইয়াহয়া হাম্মানী বলেন, ‘‘আমি ইমাম আবূ হানীফাকে বলতে শুনেছি,
এক রাতের একটি স্বপ্ন দেখে আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। দেখলাম, আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর রওযা মোবারক খনন করছি। পরবর্তীতে আমি বসরায় আসলে এক লোকের মাধ্যমে মুহাম্মদ বিন সীরীনের কাছে উক্ত স্বপ্নের ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, এ লোক নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসগুলোকে খুঁজে বের করবে।’’ (৬)
ইমাম যাহাবী বলেন, ‘‘ইলমে ফিক্বহ ও ফিক্বহের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম বিষয়ের ইমামত তথা অনুসরণীয় হবার হকদার হচ্ছেন এ ইমাম। এটা এমন বিষয় যাতে কোন সন্দেহ নেই।’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘ইমাম আযমকে (রাঃ) বিষপান করিয়ে দেড়শত হিজরীতে ৭০ বছর বয়সে শহীদ করা হয়েছে। বাগদাদে তাঁর মাজার শরীফ ঝাঁকঝমকপূর্ণ। উপরে বড় গম্বুজ রয়েছে। (৭)
এবার আমরা ইমাম আ’যমের কয়েকটি ইলমী মাস‘আলার তাৎক্ষণিক সমাধান দেখবোঃ

।। এক।।
মুগীস বিন বুদাইল বলেন, বাদশাহ মানসূর ইমাম আ’যমকে প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণ করার প্রস্তাব দিলেন। ইমাম অস্বীকার করলেন। বাদশাহ বললেন, ‘যে দেশে আমরা (ক্ষমতায়) আছি সেখানে আপনি এ পদ গ্রহণ করতে অস্বীকার করছেন?’’ তিনি বললেন, ‘‘আমি এ পদের যোগ্য নই। ’’ মানসূর বললেন, ‘‘আপনি মিথ্যা বলছেন।’’
ইমাম বললেন, ‘‘আমীরুল মু’মিনীন নিজেই ফায়সালা করলেন আমি কাযী পদের  জন্য উপযুক্ত নই। কারণ আমি যদি মিথ্যাবাদী হই তাহলে মিথ্যাবাদী কখনো কাযী পদের জন্য যোগ্য হতে পারে না। আর আমি যদি সত্যবাদী হই  তাহলে আমি তো বলেই দিয়েছি যে আমি এ পদের উপযুক্ত নই।’’ (৮)

।। দুই।।
একবার ইমামে আ’যম মসজিদে বসা ছিলেন। এ সময় বেশ কিছু নাস্তিক খোলা তরবারী নিয়ে ইমামকে ঘিরে ফেললো। তারা বললো, ‘‘আপনি আমাদের প্রশ্নের জবাব  দেবেন। এরপর যা খুশি করুন। প্রশ্নটি ছিল, ‘‘এ মহাবিশ্বের যদি কোন স্রষ্টা বা নিয়ন্ত্রক থাকে তাহলে তার প্রমাণ দিন।’’
ইমাম জবাব দিলেন, ‘‘ওই ব্যক্তি সম্পর্কে তোমাদের কি অভিমত, যে বলে, ‘আমি উত্তাল সাগরে একটি জাহাজ দেখেছি। জাহাজটি ছিল যাত্রী ও মালামালে পরিপূর্ণ। সাগরের পানি এবং বাতাস ছিল ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ ও ভয়াল। আমি দেখলাম বিশাল জাহাজটি আপন গতিপথে সুন্দরভাবে এগিয়ে চলছে। জাহাজের নেই কোন চালক; নেই কোন নিয়ন্ত্রক।’ এখন বলো, ‘এটা কি সম্ভব – বা বিশ্বাসযোগ্য?’ তারা বললো, ‘‘না। এটা সম্ভব নয়।’’ তখন ইমাম বললেন, ‘‘যদি একটি জাহাজ কোন কাপ্তান বা নিয়ন্ত্রক ছাড়া নিজে নিজে চলতে না পারে তাহলে প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তনশীল এ পৃথিবী প্রতিকূল পরিস্থিতি, বৈচিত্রময় পরিবেশ, সুবিশাল পরিসর সত্ত্বেও কোন ¯্রষ্টা ও রক্ষক ছাড়া এমন সুশৃঙ্খলভাবে  কিভাবে চলতে পারে?’’
ইমামে আ’যমের যুক্তি শুনে সমস্ত নাস্তিক কান্নাকাটি শুরু করলো। তরবারি খাপে রেখে তাওবা করলো। অর্থাৎ ঈমান আনলেন। (৯)
।। তিন।।
আরেকদিন একই ধরণের  প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, ‘‘অনেক সময় পিতা আশা করেন পুত্র সন্তানের; কিন্তু ভুমিষ্ঠ হয় কন্যা সন্তান। আবার কন্যাপ্রার্থী মা বাবার ঘরে আসে পুত্র সন্তান। এ থেকেই বুঝা যায় সন্তান জন্ম দেয়ার ব্যাপারে পিতা মাতা একজন স্রষ্টার মুখাপেক্ষী।’’ (১০)

।। চার।।
একবার মদীনাবাসী একদল লোক ইমামে আ’যমের সাথে মুনাযারা তথা বিতর্ক করার জন্য এসেছিলেন। বিতর্কের বিষয় ছিল, ‘‘ইমামের পিছনে মুক্তাদীর ক্বিরাআত’’। তাদের মত ছিল ইমামের পিছনে মুক্তাদীর ক্বিরাতের পক্ষে। ইমামে আযমের অভিমত হচ্ছে ইমামের পিছনে মুক্তাদীর ক্বিরাআত জায়েয নয়। তারা সকলেই ইমামকে ভৎসনা করতে লাগলেন। ইমাম বললেন, ‘‘আপনাদের সবার সাথে একসাথে বিতর্ক করা সম্ভব নয়। আপনাদের মধ্য থেকে সবচেয়ে বিজ্ঞ লোককে নির্বাচন করুন। আমি তার সাথে বিতর্ক করবো।’’ তারা সকলে একজনের দিকে ইঙ্গিত করলেন। হযরত ইমাম প্রশ্ন করলেন, ‘‘ইনি কি আপনাদের মধ্যে সবচেয় জ্ঞানী?’’ তারা বললেন, ‘‘হ্যাঁ।’’
ইমাম বললেন, ‘‘উনার সাথে বিতর্ক কি সবার সাথেই বিতর্ক?’’
তারা বললেন, ‘‘হ্যাঁ।’’
ইমাম বললেন, ‘‘উনি কোন দলীল পেশ করলে তা কি সকলের দলীল?’’
তারা বললেন,  ‘‘হ্যাঁ।’’
ইমাম এবার বললেন, ‘‘আমি যদি তাঁর মতামতকে খন্ডন করি বা তাঁর মতের বিপক্ষে দলীল উপস্থাপন করি এবং তিনি যদি মেনে নেন তবে কি সকলেই মেনে নিবেন বা তাঁর কথা বলার সময় আপনারা চুপ থাকবেন?’’
তারা বললেন, ‘‘হ্যাঁ।’’
তখনই ইমামে আ’যম বললেন, ‘‘ঠিক এ কারণেই আমরা নামাযে ইমামের পেছনে ইক্বতিদা করলে ইমামের ক্বিরায়াতের সময় সকলে চুপ থাকি। একজন ইমামের ক্বিরাআতকে সকল মুক্বতাদির ক্বিরাআত হিসেবে গণ্য করি। এ ক্ষেত্রে ইমামই সকল মুক্বতাদীর পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন।’’
তখন সবাই ইমামে আযমের যুক্তি মেনে নিলেন। (১১)
ইমামে আ’যমের যুক্তিভিত্তিক জবাব পড়ে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, এ মাসআলায় হানাফী মাযহাবের পক্ষে কুরআন হাদীসের কোন দলীল কি নেই? পাঠকের  কৌতুহল মেটানোর জন্যই নিম্নে দলীল উপস্থাপন করা হলো।
হানাফী মাযহাবের ইমামদের মতে জামায়াতে নামায আদায়কালে মুক্বতাদীর ক্বিরাআতের প্রয়োজন নেই। এ মতের পক্ষে কুরআনের দলীল হচ্ছে,
وَ اِذَا قُرِیَٔ الۡقُرۡاٰنُ فَاسۡتَمِعُوۡا لَہ وَ اَنۡصِتُوۡا  لَعَلَّکُمۡ  تُرۡحَمُونَ
‘‘আর যখন ক্বোরআন পাঠ করা হয় তখন তোমরা কান লাগিয়ে শ্রবণ করো এবং চুপ থাকো যাতে তোমাদের উপর রহমত করা হয়।’’ [সূরা আরাফঃ২০৪] উক্ত আয়াতের বিধান হলো ইমাম যখন নামাজের মধ্যে ক্বোরআন তিলাওয়াত করবেন তখন মুক্বতাদীরা শুনবে – যদি ক্বিরাআত উচ্চস্বরে হয়; যেমন মাগরিব, এশা ও ফজরের নামায। আর ইমাম নিম্ন স্বরে তিলাওয়াত করলে মুক্বতাদীরা শুনতে না পেলেও চুপ থাকবে যেমন যোহর ও আসরের নামায। উভয় ক্ষেত্রেই মুক্বতাদী ক্বিরাআত থেকে বিরত থাকবে। এ ব্যাপারে হানাফী মাযহাবের পক্ষে বেশকিছু হাদীসও রয়েছে। (১২)

।। পাঁচ।।
এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে বললো, ‘‘আল্লাহর শপথ!আমার শপথের পর তুমি যদি আমার সাথে আগে কথা না বলো তাহলে আমি তোমার সাথে কখনো কথা বলবো না।’’ সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীও আল্লাহর নামে শপথ করে বললো,
‘‘আমিও যদি তোমার সাথে আগে কথা বলি তবে আমার সমুদয় সম্পদ সদকা করে দেবো।’’
দুজনে শপথ করার পর পড়লো মহাবিপদে। এবার কে আগে কথা বলবে। মাসআলাটি  শুনে সম্মানিত ফক্বীহ্গণ স্তব্ধ হয়ে গেলেন। কেউই এর সমাধান করতে পারলেন না। বলতে পারলেন না কে আগে কথা বললে শপথ ভঙ্গ হবে না। সেকালের বিখ্যাত ফক্বীহ ও মুজতাহিদ হযরত সুফিয়ান সাওরী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বললেন, যে আগে কথা বলবে তার শপথ ভঙ্গ হবে। তাকে শপথের কাফফারা দিতে হবে। অবশেষে মাসয়ালাটি ইমামে আযমের কাছে পেশ করা  হলো। ইমাম আ’যম স্বামীকে বললেন,
‘‘যাও তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে কথা বলো; তোমাদের কারো শপথ ভঙ্গ হবে না।’’ ইমামে আ’যমের রায় শুনে সুফিয়ান সাওরী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি রাগান্বিত হয়ে তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, ‘‘আপনি কি হারামকে হালাল করছেন?’’
ইমামে আযম বললেন,
‘‘আমি হারামকে হালাল করছিনা। এ মাসআলার এটাই সমাধান। আর তা একেবারেই সহজ। কারণ স্বামী শপথ করেছিল আগে কথা বলবে না। এরপর স্ত্রী যখন শপথ করলো তখন স্ত্রী আগে কথা বলে ফেললো। এখন স্বামী কথা বললে শপথ ভঙ্গ হওয়ার প্রশ্নই আসে না।’’
এ জবাব শুনে সুফিয়ান সাওরী (রহঃ) হতবাক হয়ে গেলেন।  বললেন, ‘‘আপনাকে আল্লাহ তা‘আলা এমন একধরনের ইল্ম দান করেছেন, যা আমাদের সকলের অজানা।’’(১৩)
।। ছয়।।
এক লোকের ঘরে  কিছু চোর ঢুকেছিল। যাওয়ার সময় ঘরের মালিক থেকে এ কথার শপথ নিল, যদি সে চোরের নাম বা পরিচয় বলে দেয়, তবে তার  স্ত্রীর উপর তিন তালাক পতিত হবে।
পরদিন সকালে তিনি দেখলেন চোরেরা তার ঘর থেকে চুরি করা মাল বিক্রি করছে – কিন্তু তিনি শপথের কারণে কিছুই বলতে পারছেন না। প্রতিবেশীরা ঘরের মালিকের কাছে চোরের পরিচয় জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘‘আমি যদি চোরের নাম বা পরিচয় বলে দেই তাহলে আমার স্ত্রী তালাকপ্রাপ্তা হয়ে  যাবে।’’ এমতাবস্থায় চোরকে ধরা বা শাস্তি দেয়া দুস্কর হয়ে পড়লো। এ মামলার বিচার করা কারো পক্ষে সম্ভব হলো না। পরিশেষে, লোকটি ইমামে আ’যমের দ্বারস্থ হলো। তিনি ঐ এলাকার মসজিদের ইমাম সহ সকল মহল্লাবাসীকে মসজিদের ভিতর একত্রিত করলেন। লোকটি তার হারানো মাল ফিরে পাক এটা সকলে চায় কিনা জিজ্ঞেস করলে সবাই সাঁয় দিলো। ইমাম আবূ হানীফা লোকটিকে বললেন,’’ আমি একজন একজন করে মসজিদ থেকে বের করবো। জিজ্ঞেস করবো, এ লোকটি কি চোর? তখন চোর না হলে তুমি বলবে – ‘‘না।’’ আর যদি চোর হয় তাহলে হ্যাঁ বা না কিছুই বলার প্রয়োজন নেই – চুপ থাকবে। আর তাতেই নাম পরিচয় কিছু বলা ছাড়া বা চোরের দিকে কোন রকম ইঙ্গিত করা ছাড়া সহজেই চোরকে সনাক্ত করা সম্ভব হবে।’’
এ কৌশলে খুব সহজে চোর ধরা পড়লো; লোকটাও তার মাল ফেরত পেলো। (১৪)

।। সাত।।
একব্যক্তি শপথ করে বসলো – সে রমযান মাসে দিনের বেলায় স্ত্রী সহবাস করবে। শপথ করেই পড়লো বিপদে। শপথ পূরণ করবে কিভাবে? দ্বারস্থ হলো মুফতি ফক্বীহগণের। কেউ শপথ পূর্ণ করার কোন সমাধান দিতে পারলেন না। কারণ শপথ পূর্ণ করতে গেলে দুজনকেই রোযা ছেড়ে দিতে হবে। আবার শপথ পূর্ণ না করলে কাফফারা দিতে হবে। অনন্যোপায় হয়ে হাজির হলো ইমামে আযমের দরবারে। তিনি কাল বিলম্ব না করেই জবাব দিলেন, তুমি তোমার স্ত্রীকে নিয়ে সফর করো। যেহেতু সফরকালীন রোযা না রাখার সুযোগ আছে (সফর থেকে ফিরে এসে কাযা করলেই চলে), তাই সফরকালীন চাইলে দিনের বেলায় সহবাস করতে কোন বাধা নেই। (১৫)

।। আট।।
ইমাম আবূ হানীফা (রহ) এর ছাত্র ইমাম আবূ ইউসুফ (রহঃ) একবার সিদ্ধান্ত নিলেন স্বীয় উস্তাযের ইলমী মজলিস ছেড়ে নিজে আলাদা মজলিস প্রতিষ্ঠা করবেন। তিনি তাই করলেন। বিষয়টি ইমাম আবূ হানীফার নজরে আসে। তিনি একজন লোককে একটি মাসয়ালা শিখিয়ে আবূ ইউসুফের কাছে পাঠালেন। মাসয়ালাটি হচ্ছে – ‘‘এক লোক দর্জির কাছে একটি কাপড় সেলাই করার জন্য দিল। কিছুদিন পর কাপড় আনতে গেলে সে বললো,আমার কাছে তোমার কোন কাপড় নেই। এর কিছুদিন পর দর্জি কাপড় ফেরত দিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে দর্জি সেলাইয়ের পারিশ্রমিক পাবে কিনা?’’
ইমাম আবূ ইউসুফ বললেন, ‘‘পাবে।’’
লোকটি বললো, ‘‘উত্তর সঠিক হয়নি।’’
আবূ ইউসুফ বললেন, ‘‘সে পারিশ্রমিক পাবে না।’’
লোকটি বললো, ‘‘এবারও উত্তর সঠিক হয় নি।’’
আবূ ইউসুফ বললেন, ‘‘তাহলে এর সমাধান কি?’’
লোকটি বললো, ‘‘এর জবাব আপনার উস্তায ইমাম আবূ হানীফার কাছে রয়েছে।’’
কাল বিলম্ব না করে ইমাম আবূ ইউসুফ উস্তাযের কাছে হাজির হলেন। ইমাম আবূ হানিফা (রহঃ) বললেন, ‘‘যদি দর্জি কাপড় সেলাই করার পর আত্মসাত করে, তবে সেলাইয়ের পারিশ্রমিক পাবে না। কারণ সে কাপড়টি নিজের জন্যই সেলাই করেছে বলে ধরা হবে।
আর যদি আত্মসাত করার পর ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সেলাই করে তখন সে পারিশ্রমিক পাবে। কারণ তখন সে কাপড়টি মালিকের জন্যই সেলাই করেছে বলে বিবেচিত হবে।’’
ইমামে আ’যমের জবাব শোনার সঙ্গে সঙ্গে ইমাম আবূ ইউসুফ নিজের ভুল বুঝতে পেরে আলাদা মজলিস করার চিন্তা বাদ দিলেন। পূর্বের ন্যায় ইমামে আ’যমের মজলিসের একজন ছাত্র হিসেবে থাকাই নিজের জন্য গর্বের বিষয় মনে করলেন। (১৬)

।। নয়।।
ভ্রান্ত জাহান্নামী ফিরকা শিয়াদের এক লোকের আক্বীদা ছিল, হযরত ওসমান বিন আফ্ফান (রাঃ) (নাঊযুবিল্লাহ) একজন ইহুদী ছিলেন। একদিন ইমাম আ’যম তার কাছে গিয়ে বললেন, ‘‘আমি তোমার মেয়ের জন্য বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। পাত্র খুবই ভদ্র, সম্পদশালী,ক্বুরআনের হাফিয, দানশীল, তাহাজ্জুদগুযার ও আল্লাহর ভয়ে রোদনকারী।’’
লোকটি বললো, ‘‘এটুকুই যথেষ্ট ; আমি তার সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজী।’’
ইমাম বললেন, ‘‘তবে পাত্রের একটি বৈশিষ্ট্য (?) আছে। সে ইহুদী।’’
লোকটি বললো, ‘‘সুবহানাল্লাহ! কি আশ্চর্য! আপনি আমাকে ইহুদীর সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে বলছেন?’’
ইমামে আযম বললেন, ‘‘তুমি কি তার সাথে বিয়ে দেবে না?’’
লোকটি  বললো, ‘‘কিছুতেই না।’’
ইমামে আ’যম বললেন, ‘‘নবী করীম (দঃ) তো (তোমার আকীদামতে)  একজন ইহুদীর কাছে নিজের দুজন কণ্যার বিবাহ দিয়েছেন (না‘ঊযু বিল্লাহ)। তাহলে তোমার অসুবিধা কোথায়?’’
লোকটি তৎক্ষণাত নিজের ভুল বুঝতে পারলো। হযরত ওসমান যিন নূরাঈনের (রাঃ) ব্যাপারে নিজের ভ্রান্ত আক্বীদা থেকে তাওবা করে নতুন করে ঈমান আনলো। (১৭)

।। দশ।।
একবার মদীনা মুনাওয়ারায় সাইয়িদুনা ইমাম মুহাম্মদ বাক্বির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সাথে ইমাম আবূ হানিফার (রাঃ) সাক্ষাৎ হলো। ইমাম বাক্বির (রাঃ) বললেন, ‘‘আপনার ব্যাপারে অভিযোগ আছে – আপনি আমার নানাজান রাসূলুল্লাহর (দঃ) রেখে যাওয়া দ্বীন ও হাদীসগুলোকে ‘কিয়াস’ বা যুক্তি দ্বারা পরিবর্তন করছেন। অর্থাৎ, আপনি ক্বিয়াসকে প্রাধান্য দিচ্ছেন।’’ ইমাম আবূ হানিফা বললেন, ‘‘এটা আমার বিরুদ্ধে অপবাদ। আপনার কদমে আমার আরয হচ্ছে, আপনি আমাকে যেখানে বসার জন্য সম্মতি দেবেন আমি সেখানেই উপস্থিত হয়ে এ অভিযোগের জবাব দেব। কারণ আমি আপনাকে তেমন সন্মান করি যেভাবে নবীজিকে (দঃ)  সাহাবায়ে কিরাম সন্মান করতেন।’’ ইমাম বাক্বির (রাঃ) এক জায়গায় বসলেন। ইমাম আবূ হানীফা তাঁর সামনে বিনয়ের সাথে বসলেন। বললেন, ‘‘আমি আপনার কাছে তিনটি প্রশ্ন আরয করবো – মেহেরবানী করে প্রশ্নগুলোর জবাব দেবেন।’’
প্রথম প্রশ্নঃ
‘‘কে বেশী দুর্বল- পুরুষ নাকি নারী?’’
ইমাম বাক্বির বললেন, ‘‘নারী।’’
ইমাম আবূ হানিফা বললেন, ‘‘ছেলে ও মেয়ের উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রাপ্য অংশ কতটুকু?’’
ইমাম বাক্বির (রাঃ)বললেন, ‘‘পুরুষের জন্য নারীর দ্বিগুণ।’’
এবার ইমামে আযম বললেন, ‘‘হুজুর! এটা আপনার নানাজানের (দঃ) প্রদত্ত আইন। আমি যদি আল্লাহ ও রাসূলের(দঃ) বিধানের উপর কিয়াসকে প্রাধান্য দিতাম, তবে নারীকে পুরুষের দ্বিগুণ সম্পদ প্রদানের কথা বলতাম।  কারণ নারী পুরুষের তুলনায় দুর্বল।’’
দ্বিতীয় প্রশ্নঃ
‘‘নামায ও রোযার মধ্যে কোনটি উত্তম?’’
ইমাম বাক্বির (রাঃ) বললেন, ‘‘নামায।’’
ইমাম আবূ হানিফা বললেন, ‘‘আমি যদি কিয়াস বা যুক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে আপনার নানাজানের দ্বীনকে পরিবর্তন করতাম তবে হায়েয থেকে পবিত্র হওয়া নারীদের রোযা নয়, নামায ক্বাযা করার নির্দেশ দিতাম।’’

তৃতীয় প্রশ্নঃ
‘‘কোনটা বেশী নাপাক – প্রস্রাব নাকি বীর্য?’’
ইমাম বাক্বির (রাঃ) জবাব দিলেন, ‘‘প্রস্রাব।’’
ইমাম আবূ হানিফা বললেন, ‘‘যদি আমি কিয়াসকে প্রাধান্য দিতাম তবে মানুষকে প্রস্রাব করে গোসল করার ও বীর্যপাতের পর ওযু করার নির্দেশ দিতাম। কিন্তু এমন অন্যায় থেকে আমি আল্লাহর কাছে পানাহ চাই।’’
ইমাম আবূ হানীফার কথা শেষ হতেই ইমাম বাক্বির (রাঃ) উঠে দাড়িয়ে তাঁর সাথে ‘মুআনাকা’ (আলিঙ্গন)
করলেন ; তাঁর কপালে চুম্বন করলেন। (১৮)
উল্লেখ্য, ইসলামের কোন বিধান অযৌক্তিক নয়। আল্লাহ তায়ালার হিকমাত অসীম।
কিন্তু মানুষের চিন্তাশক্তি  সীমিত বলে কোন একটি বিধান সীমিত জ্ঞানে বোধগম্য নাও  হতে পারে। তাই ইসলামের সকল বিধান নির্দ্বিধায় মেনে নেওয়ার নামই ঈমান।

তথ্যসুত্রঃ
১)হাফিয ইমাদুদ্দীন ইসমাঈল ইবনে কাসীর শাফেয়ী, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া (আরবী),১০ম খন্ড,পৃষ্ঠা ৮৭,প্রকাশনায়ঃ  মাকতাবাতুছ ছফা,কায়রো, মিশর।
২) প্রাগুক্ত
৩) প্রাগুক্ত
৪) প্রাগুক্ত
৫) হাফিয শামসুদ্দীন মুহাম্মাদ আয যাহাবী শাফেয়ী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা (আরবী), ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৯৫,প্রকাশনায়ঃ মুয়াস্সাসাতুর রিসালাহ, বৈরুত,লেবানন।
৬) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৯৮
৭) প্রাগুক্ত,পৃষ্ঠা ৪০৩
৮) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪০২
৯) ইমাম ফখরুদ্দীন মুহাম্মাদ রাযী শাফেয়ী, মাফাতিহুল গায়ব (আত্ তাফসীরুল কাবীর- আরবী), ১ম খন্ড, ২য় অংশ,পৃষ্ঠা ১০০ ,প্রকাশনায়ঃ আল মাকতাবাতুত্ তাওফীকিয়্যাহ,কায়রো,মিশর।
১০) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১০১
১১) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৯৪
১২) সহীহ মুসলিম,হাদীস নং ১৩২৬ , ৯৩২ ; সুনান নাসাঈ , হাদীস নং ৯২৯, ৯৩০; সুনান বায়হাক্বী, হাদীস নং ৩০১১।
১৩)ইমাম রাযী, মাফাতিহুল গায়ব (আরবী), ১ম খন্ড, ২য় অংশ ,পৃষ্ঠা নং১৯৬।
১৪) প্রাগুক্ত
১৫) প্রাগুক্ত
১৬)মুহাম্মাদ আবূ যাহরা, আবূ হানীফা :হায়াতুহু ওয়া আসরুহু ওয়া আরা-উহু ওয়া ফিকহুহ (আরবী), পৃষ্ঠা ৭৭, প্রকাশনায়ঃ দারুল ফিকর আল আরবী,কায়রো, মিশর।
১৭) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৫৯
১৮) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৬৯।