বান্দা আল্লাহর সর্বাধিক নিকটবর্তী হয় যখন সে সাজদায় নত হয়
হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ
اَفَبِهٰذَا الْحَدِیْثِ اَنْتُمْ مُّدْهِنُوْنَۙ(۸۱) وَتَجْعَلُوْنَ رِزْقَكُمْ اَنَّكُمْ تُكَذِّبُوْنَ (۸۲) فَلَوْ لَاۤ اِذَا بَلَغَتِ الْحُلْقُوْمَۙ(۸۳) وَاَنْتُمْ حِیْنَىٕذٍ تَنْظُرُوْنَۙ(۸۴) وَ نَحْنُ اَقْرَبُ اِلَیْهِ مِنْكُمْ وَلٰكِنْ لَّا تُبْصِرُوْنَ(۸۵) فَلَوْ لَاۤ اِنْ كُنْتُمْ غَیْرَ مَدِیْنِیْنَۙ(۸۶) تَرْجِعُوْنَهَاۤ اِنْ كُنْتُمْ صٰدِقِیْنَ (۸۷) فَاَمَّاۤ اِنْ كَانَ مِنَ الْمُقَرَّبِیْنَۙ (۸۸) فَرَوْحٌ وَّرَیْحَانٌ ﳔ وَّجَنَّتُ نَعِیْمٍ(۸۹) وَاَمَّاۤ اِنْ كَانَ مِنْ اَصْحٰبِ الْیَمِیْنِۙ(۹۰) فَسَلٰمٌ لَّكَ مِنْ اَصْحٰبِ الْیَمِیْنِؕ (۹۱) وَاَمَّاۤ اِنْ كَانَ مِنَ الْمُكَذِّبِیْنَ الضَّآلِّیْنَۙ(۹۲) فَنُزُلٌ مِّنْ حَمِیْمٍۙ(۹۳) وَّ تَصْلِیَةُ جَحِیْمٍ(۹۴) اِنَّ هٰذَا لَهُوَ حَقُّ الْیَقِیْنِۚ(۹۵) فَسَبِّحْ بِاسْمِ رَبِّكَ الْعَظِیْمِ۠(۹۶)
আল্লাহর নামে আরম্ভ, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়
তরজমা: (মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন-) তবে কি তোমরা এ বাণীর প্রতি শৈথিল্য প্রদর্শন করছো? এবং নিজেদের অংশ এটাই রাখছো যে, তোমরা অস্বীকার করছো? অত:পর এমন কেন হবে না, যখন প্রাণ কণ্ঠ পর্যন্ত পৌছবে। আর তোমরা তখন তাকিয়ে থাকছো। এবং আমি (অর্থাৎ আল্লাহ) তার অধিক নিকটে থাকি তোমাদের চেয়েও কিন্তু তোমরা দেখতে পাওনা। তবে কেন এমন হলো না, যদি তোমাদের প্রতিদান প্রাপ্ত হবার না থাকে। যে, সেটা ফেরত আনতে? যদি তোমরা সত্যবাদি হও? অত:পর ওই ব্যক্তি (অর্থাৎ মৃত্যুবরণকারী) যদি নৈকট্যপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে রয়েছে (তার জন্য) আরাম, এবং ফুল ও নেয়ামতের উদ্যান। আর যদি সে ডানর্পাশ্বস্থদের অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে (ওহে রাসুল দ.) আপনার উপর ‘সালাম’ হোক, ডানপার্শ্বস্থদের নিকট থেকে। আর যদি সে অস্বীকারকারী পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে তার আতিথ্য হবে-উত্তপ্ত পানি এবং জ্বলন্ত আগুনে ধ্বসিয়ে দেয়া। নিশ্চয় এটা চূড়ান্ত পর্যায়ের নিশ্চিত কথা। সুতরাং (ওহে রাসূল দ.) আপনি আপনার মহান প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা ঘোষণা করুন। [সুরা ওয়াক্বিয়াহ ৮১-৯৬ নং আয়াত]
আনুষঙ্গিক আলোচনা
فَلَوْلَا إِذَا بَلَغَتِ الْحُلْقُومَ ﴿٨٣﴾ وَأَنتُمْ حِينَئِذٍ تَنظُرُونَ
উদ্ধৃত আয়াত সমূহের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন- কাফির মুশরিকসহ সকল ধর্মদ্রোহী মহলের পক্ষ থেকে কেয়ামত সংঘটিত হওয়া এবং মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবিত হওয়াকে অস্বীকার করা যেন এ বিষয়ের দাবী যে, তাদের প্রাণ ও আত্মা তাদেরই করায়ত্তে। তাদের এহেন ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন ধারনা খন্ডনের জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন উদ্ধৃত আয়াত সমূহে একজন মরনোন্মুখ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করত: এরশাদ করেছেন- যখন তার আত্মা কন্ঠগত হয় আর আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব অসহায়ভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকে এবং তারা কামনা করে যে, তখন আমি আল্লাহ রব্বুল আলামীন জ্ঞান ও সামর্থ্যরে দিক দিয়ে তোমাদের অপেক্ষা তার অধিক নিকটে থাকি। নিকটে থাকার অর্থ এই যে, তার অ্যভন্তরীন ও বাহ্যিক অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত ও সক্ষম থাকি। কিন্তু তোমরা আমার নৈকট্য ও মরনোন্মুখ ব্যক্তি যে আমার করায়ত্তে এ বিষয়টি চর্মচক্ষে দেখ না। সারকথা এই যে, তোমরা সবাই মিলে তার জীবন ও আত্মার হেফাজত করতে চাও, কিন্তু তোমাদের সাধ্যে কুলায় না। তার আত্মার নির্গমন কেউ রোধ করতে পারে না। এই দৃষ্টান্ত পেশ করত: এরশাদ করা হয়েছে যদি তোমরা মনে কর যে, মৃত্যুর পর তোমাদেরকে জীবিত করা যাবে না এবং তোমরা এমন শক্তিশালী ও বীরপুরুষ যে আল্লাহর নাগালের বাইরে চলে গেছ, তবে এখানেই স্বীয় শক্তিমত্তা ও বীরত্ব পরীক্ষা করে দেখ এবং এই মরনোন্মুখ ব্যক্তির আত্মার নির্গমন রোধ কর কিংবা নির্গমনের পর তাকে পুনরায় দেহে ফিরিয়ে আন। তোমরা যখন এতটুকুও করতে পারো না তখন নিজেদেরকে আল্লাহর নাগালের বাইরে মনে করা এবং মৃত্যুর পর পুণরুজ্জীবনকে অস্বীকার করা কতটুকু নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক।
فَأَمَّا إِن كَانَ مِنَ الْمُقَرَّبِينَ
আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন-উদ্ধৃত আয়াতের মর্মবাণীর আলোকে প্রতীয়মান হয় যে, নৈকট্যধন্য বান্দাগণকে আমলনামা দেয়া হবে না- না ডান হাতে, না বাম হাতে। তাঁদের কোন হিসাবই হবে না। তেমনিভাবে শিশুরা। তাদের নিকট কোন আমলই নেই। মূলত: তাঁরা হলেন-ঐ সব সৌভাগ্যবান, যাঁরা বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশাধিকার লাভ করবেন। কেননা এখানে নৈকট্যধন্য বান্দাগণকে ডান ও বাম পার্শ্বস্থেেদর মোকাবেলায় করা হয়েছে। জাগতিক জীবনেও এর নমুনা পরিলক্ষিত হয় যে, সরকারী সর্বোচ্চ দরবারে সাধারণ লোকদেরকে পাস গ্রহণ করে প্রবেশ করতে হয়। কিন্তু মন্ত্রী-সচিবদের এর প্রয়োজন হয় না। নৈকট্যধন্য বান্দাগণ জান্নাতকে আপন কবর থেকে দেখতে পায়। কেয়ামত সংঘটিত হবার পর সেগুলোতে প্রবেশ করবেন। শহীদগণের রুহ মুবারক শাহাদত বরণের সঙ্গে সঙ্গে দেহ থেকে বের হতেই বেহেশতে পৌছে যায়। কিন্তু সশরীরে প্রবেশ করবে কেয়ামতের পর।
সুফিয়ায়ে কেরাম বলেন-নৈকট্টধন্য বান্দাগণের জন্য দুনিয়ায় মিলনের খুশবু ও প্রকৃত বন্ধুর সৌন্দর্যের ফুল রয়েছে। (তাফসিরে রুহুল বায়ান ও নুরুল ইরফান শরীফ)
সুরার প্রারম্ভে বলা হয়েছে যে, প্রতিদান ও শাস্তির পর সবাই তিন শ্রেণিতে বিভক্ত হবে এবং প্রত্যেকের প্রতিদান আলাদা আলাদা হবে। আলোচ্য আয়াতে তাই আবার সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মৃত্যুর পর ওই ব্যক্তি নৈকট্টশীলদের অন্তর্ভূক্ত হলে সুখই সুখ এবং আরামই আরাম ভোগ করবে। আর যদি ‘আসহাবুল ইয়ামীন’ তথা সাধারণ মুমিনদের একজন হয় তবে সেও জান্নাতের আরাম লাভ করবে। পক্ষান্তরে যদি ‘আসহাবে শেমাল’ তথা কাফের-মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়, তবে জাহান্নামের অগ্নি ও উত্তপ্ত পানিতে তাকে আপ্যায়ন করা হবে।
তাফসিরে রুহুল বায়ান শরীফে রয়েছে- জান্নাতী মানুষ মৃত্যুবরণ করার সময় তাঁর নিকটাত্মীয়দের রুহু সমূহ স্বাগত জানানোর জন্য আগমন করে। এবং তাকে সালাম করে। পক্ষান্তরে জাহন্নামী কাফির-মুশরিকদের মৃত্যুবরণ কালে স্বাগত জানানোর জন্য না তাদের পূর্বে মৃত্যুবরণকৃত লোকদের রুহসমূহ আগমন করবে না তাদের কে কেউ সালাম করবে। তেমনিভাবে, মৃত্যুর পর কবরে ও কেয়ামতের ময়দানে তাদের সাহায্যকারী কিংবা স্বাগত জানাবার মতো কেউ নেই। তাদের আতিথ্য হবে জাহান্নামে অবস্থান, সেখানকার ফুটন্ত গরম পানি এবং কর্তনকারী খাদ্য।
وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنكُمْ وَلَٰكِن لَّا تُبْصِرُونَ
মহান আল্লাহর ‘পবিত্র বাণী وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنكُمْ وَلَٰكِن অর্থাৎ আমি আল্লাহ তার অর্থাৎ বান্দার তোমাদের অপেক্ষা অধিক নিকটে থাকি কিন্তু তোমরা দেখ না।” এবং সুরা ক্বাফ এর ষোল নম্বর আয়াতে এরশাদ হয়েছে -ونحن اقرب اليه من حبل الوريد অর্থাৎ আমি আল্লাহ তার অর্থাৎ বান্দার গ্রীবাস্থিত ধমনী থেকেও অধিক নিকটবর্তী।” এ সকল আয়াতের ব্যাখ্যায় অধিকাংশ মুফাসসেরীনে কেরাম বলেন এই আয়াতে জ্ঞানগত নৈকট্ট বুঝানো হয়েছে। স্থানগত নৈকট্ট উদ্দেশ্য নয়। আরবি ভাষায় وريد শব্দের অর্থ প্রত্যেক প্রাণীর সেই সমস্ত শিরা উপ শিরা কে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। প্রথমত যা কলিজা থেকে উদগত হয়ে সারা দেহে খাঁটি রক্ত পৌছে দেয়। চিকিৎসা শাস্ত্রে এ জাতীয় শিরাকেই وريد বলা হয়। প্রথম প্রকার শিরা মোটা এবং দ্বিতীয় প্রকার শিরা চিকন হয়ে থাকে। আতএব আয়াতের উদ্দেশ্য মানুষের হৃদয়গত অবস্থা ও চিন্তাধারা অবগত হওয়া। তাই এই অর্থই অধিক উপযুক্ত। উল্লেখিত দুই অর্থের মধ্যে যে কোন অর্থই নেওয়া হোক সর্বাবস্থায় প্রাণীর জীবন এর উপর নির্ভরশীল। এসব শিরা কেটে দিলে প্রাণীর আত্মা বের হয়ে যায়। অতএব, সারকথা এই দাড়ালো যে, যে ধমনীর উপর মানবজীবন নির্ভরশীল, আমি আল্লাহ সে ধমনীর চাইতে ও অধিক তার নিকটবর্তী। অর্থাৎ তার সবকিছুই আমি-জানি।
সুফিয়ায়ে কেরামের মতে- আয়াতে কেবল জ্ঞানগত নৈকট্যই উদ্দেশ্য নয় বরং এখানে বিশেষ এক ধরনের সংলগ্নতা বুঝানো হয়েছে, যার স্বরূপ ও গুনাগুণ তো কারও জানা নেই। কিন্তু এই সংলগ্নতার অস্তিত্ব অবশ্যই বিদ্যমান আছে। কুরআনে করিমের একাধিক আয়াত এবং অনেক সহীহ হাদিস এ তথ্যের সাক্ষ্য দেয়। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন- وهو معكم اينما كنتم অর্থাৎ তিনি তোমাদের সঙ্গেই রয়েছেন যেখানেই তোমরা অবস্থান করনা কেন। হিজরতের ঘটনায় রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু বুকর সিদ্দিক রা. কে বলেছিলেন- لا تحزن ان الله معنا অর্থাৎ চিন্তিত হয়ো না, নি:সন্দেহে আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। হাদিস শরিফে এরশাদ হয়েছে মানব মহান আল্লাহর সর্বাধিক নিকটবর্তী তখন হয়, যখন সে সেজদায় থাকে। হাদীসে কুদসীতে আরো এরশাদ হয়েছে- মহান আল্লাহ বলেন- আমার বান্দা নফল এবাদতের দ্বারা আমার নৈকট্ট অর্জন করে।
এই নৈকট্ট ও সংলগ্নতা চোখে দেখা যায় না, বরং ঈমানি দূরদর্শিতা দ্বারা জানা যায়। তাফসীরে মাযহারী শরীফে এই নৈকট্ট ও সংলগ্নতাকেই আয়াতের মর্ম সাব্যস্থ করা হয়েছে।
عن ابن مسعود رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم من قراء سورة الواقعة كل ليلة لم تصبه فاقة ابدا
অর্থাৎ রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন -যে ব্যক্তি প্রতি রাতে সুরা ওয়াকিয়া পাঠ করবে তার জীবনে অভাব-অনটন পৌছবে না। [তাফসিরে ইবনে কাছির]
মহান আল্লাহর আলীশান দরবারে ফরিয়াদ জানাই, তিনি যেন সকল কে উপরোক্ত দরসে কুরআনের উপর আমল করার সৌভাগ্য নসীব করেন। আমীন।
লেখক: অধ্যক্ষ-কাদেরিয়া তৈয়বিয়া কামিল মাদরাসা, মুহাম্মদপুর, ঢাকা।