ইসলামে আহলে বায়তের মর্যাদা

ইসলামে আহলে বায়তের মর্যাদা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

عَنْ اِبْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ لَمَّا نَزَلَتْ هٰذِه الْاَيَةُ (قُلْ لاَ اَسْئَلُكُمْ عَلَيْهِ اَجْرًا اِلاَّ الْمُوَدَّةَ فِى الْقُرْبى) قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ قَرَبَتُكَ هَؤْلاَءِ الَّذِيْنَ وَجَبَتْ عَلَيْنَا مَوَدَّتْهُمْ قَالَ عَلِىُّ وَفَاطِمَةُ وَابْنَهُمَا [رواه الطبرانى]

অনুবাদ: হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় (হে প্রিয় রসূল! আপনি বলুন, আমি তোমাদের নিকট কেবলমাত্র আমার নিকটাত্মীয়তার প্রতি ভালবাসা চাই) তখন সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার নিকটাত্মীয় কারা? যাদের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করা আমাদের উপর ওয়াজিব করা হয়েছে? রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, আলী, ফাতেমা এবং তাদের পুত্রদ্বয় (হাসান ও হোসাইন) [তাবরানী, আল মু’জামুল কবীর, হাদীস:৩৪৫৬]

প্রাসঙ্গিক আলোচনা
আহলে বায়তের আলোচনা, তাঁদের মর্যাদা ও সম্মান এতো অধিক গুরুত্বপূর্ণ স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলা মহাগ্রন্থ আল কুরআন আহলে বায়তের শান-মান মর্যাদা ও তাদের পবিত্রতার কথা উল্লেখ করেছেন, এরশাদ হয়েছে-اِنَّمَا یُرِیْدُ اللّٰهُ لِیُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ اَهْلَ الْبَیْتِ وَ یُطَهِّرَكُمْ تَطْهِیْرًاۚ(۳۳)
হে আহলে বায়ত! আল্লাহ্ তা‘আলা তো এটাই চান যে, তোমাদের থেকে সকল প্রকার কলুষতা দূর করে দেবেন এবং তোমাদেরকে পূত:পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করে দেবেন। [সূরা আহযাব: আয়াত-৩৩]

আহলে বায়ত দ্বারা কারা উদ্দেশ্য
পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আয়াতে আহ্লে বায়ত বলতে কারা উদ্দেশ্য এ প্রসঙ্গে তাফসীরকারদের বিভিন্ন মত রয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন এবং তাফসীরকারকদের এক জামাতের মতানুসারে আহলে বায়ত দ্বারা হযরত মাওলা আলী, হযরত ফাতেমা, হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসাঈন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম উদ্দেশ্য।
তাফসীরকারকদের দ্বিতীয় একদলের মতানুসারে আহলে বায়ত দ্বারা নবীজির পবিত্র স্ত্রীগণ উদ্দেশ্য।
[বরকাতে আলে রসূল, পৃ. ৩২]
হযরত আল্লামা ইউসুফ বিন ইসমাঈল নিবহানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, অধিকাংশ ওলামায়ে কেরামের মতানুসারে আহলে বায়ত দ্বারা উম্মুহাতুল মু’মিনীন ও পবিত্র আওলাদগণ উদ্দেশ্য। উভয় শ্রেণি এতে অন্তর্ভুক্ত যেন সর্বপ্রকার দলীলের উপর আমল হয়ে যায়।
[বরকাতে আলে রসূল, পৃ. ৩৫, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড-১ম, পৃ. ৩১]
আহলে বায়ত নূহ আলাইহিস্ সালাম’র কিশতিতূল্য
عَنْ اَبِىْ ذَرٍّ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ اَلاَ اِنَّ مَثَلَ اَهْلَ بَيْتِىْ فِيْكُمْ مَثْلُ سَفِيْنَةِ نَوْحٍ مَنْ رَكَبِهَا نَجَاءَ وَمَنْ تَخَلَّفَ عَنْهَا هَلَكَ [رواه الطبرانى]
হযরত আবু যর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, সাবধান! তোমাদের মধ্যে আমার আহলে বায়তের উদাহরণ হলো নূহ আলায়হিস্ সালাম’র কিশতি তুল্য। যে এতে আরোহণ করল পরিত্রাণ পেল। আর যে এতে আরোহণ করল না পিছনে পড়ে রইলো। সে ধ্বংস হল। [মিশকাত শরীফ, পৃ. ৫৭৩]
হযরত ফারূক্বে আযম ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
اَصْحَابِىْ كَالنُّجُوْمِ بِاَيِّهِمْ اِقْتَدَيْتُمْ اِهْتَدَيْتُمْ
আমার সাহাবাগণ নক্ষত্ররাজি সদৃশ্য, তোমরা তাদের মধ্যে যাদেরকই অনুসরণ করবে সুপথ প্রাপ্ত হবে।
[মিশকাত শরীফ, পৃ. ৫৫৪]
ইমামুল মুফাস্সেরীন হযরত ইমাম রাযী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বর্ণনা করেন, আল্লাহ্ তা‘আলার বড়ই অনুগ্রহ যে, আমরা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারীগণ, আহলে বায়তের ভালোবাসার কিশতিতে আরোহী। উপরন্ত আমরা হেদায়তের সমুজ্জ্বল নক্ষত্র হযরাতে সাহাবায়ে কেরামের পদাঙ্ক অনুসারী। বিধায় কিয়ামতের কঠিন ক্রান্তিকালে ভীষণ ভয়াবহ অবস্থা ও জাহান্নামের শাস্তি থেকে আমরা নিরাপদ থাকব।
[মিরকাত, খন্ড-৫ম, পৃ. ৬১০]
জেনে রাখুন! হযরত নূহ্ আলায়হিস্ সালাম তাঁর কিশতিতে কেবলমাত্র মুমিনকেই আরোহণের সুযোগ দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে আহলে বায়তের ভালোবাসার কিশতিতে একমাত্র সুন্নী মুসলমানরাই আরোহণ করতে পারবে। তারাই প্রকৃত সুন্নী মুসলমান যারা আহলে বায়তকে ভালোবাসার সাথে সাথে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত ওমর ফারূক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত ওসমান জিন্নুরাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত উম্মুল মু’মেনীন আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহাসহ সকল সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম’র প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধা পোষণ করেন।

আহলে বায়তের প্রতি বিদ্বেষপোষণকারী জাহান্নামী
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যদি কোন ব্যক্তি রুকনে ইয়ামানী ও মক্বামে ইবরাহীমির মাঝখানে অবস্থান করে, তাতে নামায আদায় করে এবং রোজা রাখে অতঃপর এমতাবস্থায় নবীজির পরিবার বর্গের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী অবস্থায় মারা গেল সে জাহান্নামে প্রবেশ করল।
[তাবরানী, আল মুজামুল কবীর, হাদীস: ১১৪১২, আশশারফুল মুত্তয়্যাদ: পৃ. ৯২]
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমার আহলে বায়তের প্রতি একদিনের ভালোবাসা, পূর্ণ বৎসর ইবাদতের চেয়ে উত্তম। যে ব্যক্তি এ ভালোবাসার উপর মৃত্যু বরণ করল, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। [মুসনাদুল ফেরদৌস, খন্ড-২য়, খৃ.১৯২]

আহলে বায়তের প্রতি হযরত সিদ্দিকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ভালবাসা
হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এরশাদ করেছেন-
وَالَّذِىْ نَفْسِىْ بِيَدِهِ لَقُرْبَةُ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَحَبَّ اِلَىَّ اَنْ اَصِلَ مِنْ قَرْبَتِىْ [رواه البخارى]
অর্থ: আল্লাহর শপথ যার কুদরতী হস্তে আমার প্রাণ। আমার নিকট আমার নিকটাত্মীয় থেকে রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটাত্মীয় অধিক প্রিয়। [বোখারী শরীফ]

আহলে বায়তের প্রতি হযরত ফারূকে আজম ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ভালবাসা
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা বর্ণনা করেন, হযরত ফারুকে আজম ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শাসনামলে মাদায়েন বিজয় হলো। মসজিদে নববী শরীফে গণীমতের মাল আনা হলো, হযরত ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাশরীফ আনলেন, বললেন, হে আমিরুল মু’মিনীন, আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত আমার হক আমাকে প্রদান করুন, ফারুকে আজম তাঁকে এক হাজার দিরহাম প্রদান করলেন, এরপর হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাশরীফ আনলেন, তাঁকেও এক হাজার দিরহাম দিলেন, অতঃপর স্বীয় পুত্র হযরত আব্দুল্লাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাশরীফ আনলেন, তাঁকে পাঁচশত দিরহাম প্রদান করলেন, এতে হযরত আব্দুল্লাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আরয করলেন, আমিরুল মু’মিনীন, আমি রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের মুবারক যুগে যুবক ছিলাম। আপনার সাথে জিহাদে অংশ গ্রহণ করেছি, হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসাঈন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা তখন বয়সে ছোট ছিলেন, মদীনা মনোয়ার গলিতে খেলাধুলা করতেছিলেন, আপনি তাদেরকে এক হাজার, এক হাজার করে দিলেন, আমাকে দিলেন পাঁচশত দিরহাম। তখন হযরত ফারুকে আজম স্বীয় পুত্রকে বললেন, ওহে আমার ছেলে! প্রথমে ওই মর্যাদা অর্জন করো, যেটা ইমাম হাসান ও হোসাইনের মর্যাদা। তারপর এক হাজার দিরহাম দাবী করো।
জেনে রেখো! তাঁদের নানা হলেন রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, তাঁদের পিতা হযরত আলী শেরে খোদা, তাঁদের মাতা, ফাতেমাতুজ্ যাহরা, তাঁদের নানী, হযরত খাদীজাতুল ক্বোবরা, তাঁদের চাচা হযরত জাফর তায়্যার, তাঁদের ফুফী, হযরত উম্মে হানী, তাদের মামা ইব্রাহীম ইবনে রাসূলিল্লাহ্, তাঁদের খালা, হযরত রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম ও যয়নাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম। [আনোরুল বয়ান, খন্ড-১ম, পৃ. ৩৫]

লেখক: অধ্যক্ষ, মাদ্রাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া ফাযিল (ডিগ্রি), বন্দর, চট্টগ্রাম।

Share:

Leave Your Comment