উপমহাদেশে তরীক্বায়ে ক্বাদেরিয়ার সম্প্রসারণে শাহানশাহে সিরিকোটের অবদান

উপমহাদেশে তরীক্বায়ে ক্বাদেরিয়ার সম্প্রসারণে শাহানশাহে সিরিকোটের অবদান

ড. মোহাম্মদ সাইফুল আলম

তরীক্বায়ে ক্বাদেরিয়ার পরিচয় ও যোগসূত্র
ত্বরীকা-ই ক্বাদেরীয়া’র নাম শুনতেই মনে এসে যায়, এ ত্বরীকা হযরত গাউসুল আযম শায়খ আবদুল ক্বাদের জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে চালু ও প্রচলন হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে এ ত্বরীকার ভিত্তি স্থাপন করেন স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ওই দিনে, যখন তিনি হেরা পর্বতের গুহায় একাকী ইবাদত-বন্দেগী করেছিলেন। অহী আসল, হুকুম হল, আর সেই হুকুম পালনের জন্য ত্বরীকতের পথ নির্ধারণ করেন তিনি। স্বয়ং গাউসে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এরশাদ করেন, “আমি ঐ ত্বরীকা প্রতিষ্ঠায় চেষ্টা করি, যেটার উপর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, সাহাবীগণ ও তাবি‘ঈন ছিলেন। শেষ যমানায় অধিকাংশের উপাস্য দিরহাম ও দিনার হয়ে গেছে।”
নগদ অর্থের এই উপসনা তখনই দূর হবে, যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ত্বরীকায় মুসলমানদের আত্মা পবিত্র ও অন্তর পরিস্কার-পরিশুদ্ধ হবে। আর পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করার নিয়ম-রীতির নামই ত্বরীকা।
এ ত্বরীকা রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ও খোলাফা-ই রাশেদীনের যুগেও ছিল। যেমন, সাহাবীগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র হাতে বায়‘আত গ্রহণ করেছেন, সময়ের প্রেক্ষাপটে খোলাফা-ই রাশেদীন ও অপরাপর সাহাবা, ইমাম হাসান, ইমাম হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম) একে অন্যের নিকট বায়‘আত গ্রহণ করেছিলেন। যদিও মুসলিম মহামনীষীদের কেউ কেউ বায়‘আত গ্রহণের ধারা বর্ণনা করতে গিয়ে শুধু সালতানাত বা খেলাফতের বায়‘আতের কথা উল্লেখ করেছেন, তথাপি কেউ ত্বরীকার বায়‘আতকে অস্বীকার ও বিরোধিতা করেন নাই। কেননা এ দু’ধরনের বায়‘আতের অর্ন্তনিহিত ভাব হল আনুগত্য। পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র ‘উস্ওয়া-ই হাসানা’ ত্বরীকার একটি শাখা বেলায়ত তথা ওলী হওয়া। এটা হলো- সৃষ্টিজগতের জীবন-জীবিকার ভাল-মন্দ বিষয়াদির ব্যবস্থাপনা করার বিশেষ ক্ষমতা। সেটা হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর নিকট অর্পিত হয়। কেউ কেউ বলেন, এ ক্ষমতা রূহজগতে যখন আল্লাহ তা‘আলা প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন, তখনই হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর জন্য নির্ধারণ করেছেন। এ জন্য তাঁকে ‘শাহে বেলায়ত’ বলা হয়। তাঁর পরবর্তীতে ইমাম হাসান, ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হয়ে ক্রমান্বয়ে বার ইমামগণের পর এ দায়িত্ব হযরত গাউসুল আ’যম শায়খ আবদুল ক্বাদের জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর হাতে ন্যস্ত হয়। ইমাম মেহদীর শুভাগমণ পর্যন্ত এ দায়িত্ব তাঁরই হাতে বহাল থাকবে বলে আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞাবানগণ এ মত ব্যক্ত করেন। আবার হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে এ ত্বরীকার বেলায়তের ফয়য-বরকত শায়খ পরম্পরায় তিন ধারায় হযরত গাউসুল আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর সাথে মিলিত হয়ে ক্বাদেরীয়া ত্বরীকা রূপ লাভ করে। যেমন- হযরত হাসান বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর মাধ্যমে; এ ধারার নাম ক্বাদেরীয়া বসরীয়া, ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর মাধ্যমে, তাঁর অধ্ব:স্তন চতুর্থতম পুরুষ ইমাম মূসা আলী রেদ্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর নামানুসারে এ ধারার নাম ক্বাদেরীয়া রেদ্বভীয়া এবং ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর মাধ্যমে; এ ধারার নাম ক্বাদেরীয়া হাসানীয়া হিসেবে সূফীগণের নিকট পরিচিত। অবশ্য শেষোক্তটি প্রসিদ্ধ না হলেও হযরত গাউসুল আযম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বংশীয় পরম্পরায় ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর সাথে মিলিত হয়েছে।
অধিকন্তু বিলায়ত হচ্ছে- নুবূয়্যতের ছায়া। এটা স্বত:সিদ্ধ কথা বটে; কিন্তু ছায়া যে মূলের অনুরূপ হয়ে থাকে- এটাও বাস্তব সম্মত। দৃশ্যত: এ উভয় কথা সাংঘর্ষিক মনে হলেও বস্তুত কোন দ্বন্দ্ব নেই। ইমামগণের মতে, প্রত্যেক নবীর নুবূয়্যতের মাঝে বেলায়ত বিদ্যমান আর সে-ই বেলায়ত ঐ নুবূয়্যতের আসল বা মূল, সে-ই মূলের ছায়া বেলায়ত,ক্স স্বয়ং হযরত গাউসুল আযম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন,
“প্রত্যেক অলি কোন না কোন কদমে (নবীর ছায়ায়) রয়েছেন আর আমি পূর্ণ পূর্ণিমার চাঁদ রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কদমে আছি।”
কাজেই ত্বরীকা-ই ক্বাদেরীয়া’র ভিত্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ ত্বরীকা হযরত গাউসুল আযম শায়খ আবদুল ক্বাদের জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু যে সকল মাশায়িখ হতে প্রাপ্ত হন, তাঁদের প্রসিদ্ধ শাজরাদ্বয় (শায়খ পরম্পরা) নি¤œরূপ:

১. হযরত মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।
২. হযরত আলী ইবন আবি তালিব (রিদুওয়ানুল্লাহে আলাইহিম)
৩. হযরত শায়খ হাসান বসরী
৪. হযরত ইমাম হুসাইন
৫. হযরত শায়খ হাবীবে আযমী
৬. হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন
৭. হযরত শায়খ দাউদ তাঈ
৮. হযরত ইমাম মুহাম্মদ বাক্বের
(যিনি হযরত সালমান ফার্সী (র.)’র তত্ত্ববধানে লালিত-পালিত হন)
৯. হযরত ইমাম জাফর আল সাদেক
১০. হযরত ইমাম মূসা আল রেদ্বা
১১. হযরত শায়খ আল মা’রূফ আল কারখী হানাফী
১২. হযরত শায়খ আল সিররী আল সাক্বত্বী
১৩. হযরত শায়খ জুনাঈদ আল বাগদাদী
১৪. হযরত শায়খ আল শিবলী মালেকী
১৫. হযরত শায়খ আবুল ফদ্বল আবদুল ওয়াহেদ আল তামিমী
১৬. হযরত শায়খ আবুল ফারাহ আল ত্বারত্বূসী
১৭. হযরত শায়খ আবুল হাসান আলী আল হাঙ্কারী
১৮. হযরত শায়খ আবু সাঈদ আলী আল মুবারক আল মাখযুমী হাম্বলী
১৯. হযরত গাউসুল আযম শায়খ সায়্যিদ আবদুল ক্বাদের জিলানী

এ শায়খ পরম্পরা সূত্রে হযরত গাউসুল আযম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শায়খদের মধ্য সবাই হানাফী, মালেকী ও হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী রয়েছেন। আবার তাঁর শিক্ষকগণের শিক্ষা-সনদের চার মাযহাবের ইমাম যথাক্রমে হযরত ইমাম আযম আবূ হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেঈ ও ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম প্রমুখও তাঁর শায়খুল মাশায়িখ তথা উস্তাদগণের উস্তাদ। এ চার মাযহাবের কেন্দ্র হল রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামার নূরানী সত্ত্বা। সুতরাং ত্বরীকতের সূত্রে যেমন তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হতে ‘উসওয়া-ই হাসানা’ ও ত্বরীকা’র ফয়েয-বরকত প্রাপ্ত হন, তেমনি ইসলামী শরী‘আতের চার মাযহাবের ভিত্তিতেও প্রাপ্ত হন। এ কারণে যখনই তিনি ইসলামী শরী‘আতের কোন মাসআলা-মাসা-ইল সর্ম্পকে ফাত্ওয়া দিতেন, তখন চার মাযহাব অনুসারে সমাধান দিতেন।
তা ছাড়া, বংশগতভাবেও তিনি এ ত্বরীকা লাভ করেন। তিনি ছিলেন পিতা আবূ সালেহ মূসা জঙ্গী দোস্ত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর দিক দিয়ে ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বংশধর এবং মা উম্মুল খায়ের ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বংশীয় পরম্পরায় ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর সাথে মিলিত হয়েছে। তাঁর আম্মাজানের বংশ পরম্পরা এই-
হযরত গাউসুল আযম শায়খ সায়্যিদ আবদুল ক্বাদের জিলানী > উম্মুল খায়ের ফাতেমা > আবদুল্লাহ সাওমা‘ঈ > আবু জামাল > মুহাম্মদ > আবু মাহমুদ তাহির > আবুল ‘আতা আবদুল্লাহ > কামাল ঈসা > ‘আলাউদ্দীন মুহাম্মদ জাওয়াদ > ইমাম আলী রেদ্বা > ইমাম মূসা কাযেম > ইমাম জা‘ফর সাদেক > ইমাম মুহাম্মদ বাকের > ইমাম যয়নুল ‘আবেদীন > ইমাম হুসাইন > হযরত আলী ইব্নে আবী তালিব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম।
উপরন্তু তাঁর পিতার বংশ-পরম্পরা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর পাশাপাশি ইসলামের অন্যান্য তিন খলিফা যেমন- হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব, হযরত উমর ফারূক্ব ও হযরত উসমান যুন্নুরাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র সাথেও সম্পৃক্ত। হযরত গাউসুল আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর পিতৃকুলের বংশ পরম্পরা এই-
হযরত গাউসুল আযম শায়খ সায়্যিদ আবদুল ক্বাদের জিলানী > আবু সালেহ মূসা জঙ্গী > আবদুল্লাহ > ইয়াহিয়া আল যাহিদ > মুহাম্মদ > দাউদ > মূসা > আবদুল্লাহ > মূসা আল জূন > আবদুল্লাহ আল মাহাদ্ব্ > আল হাসান আল-মুসান্না > ইমাম হাসান > হযরত আলী ইব্নে আবী তালিব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম।
এখানে হযরত গাউসুল আযম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর দাদী ‘উম্মে সালমা’ (আবদুল্লাহ’র স্ত্রী) বংশ পরম্পরায় হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর পুত্র আবদুর রহমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর সাথে সম্পৃক্ত। আবার উধ্বতন নবম পুরুষ আবদুল্লাহ আল মাহাদ্বের পিতা ‘আল হাসান আল মুছান্নার ইন্তেকালের পর তাঁর মা ‘ফাতেমা’কে আবদুল্লাহ ইব্নে আল-মুযাফ্ফর বিয়ে করেন, যিনি হযরত উস্মান যুন্নুরাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর পুত্র উমরের বংশধর। আবার আবদুল্লাহ ইব্নে আল-মুযাফ্ফরের মা ‘হাফসা’ হযরত উমর ফারূক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর পুত্র আবদুল্লাহ’র কন্যা। যদিও পুত্র সন্তানের মাধ্যমে বংশ সাব্যস্ত হয়, তারপরও এ কথা স্বত:সিদ্ধ যে, সন্তান মাতৃকুলের গুণাবলী লাভ করে থাকে। সুতরাং হযরত গাউসুল আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ধমনীতে ইসলামের খলীফা চতুষ্টয়ের অন্তরস্থিত সদাশয়তা ও উত্তম গুণাবলী প্রবাহমান ছিল। এ কারণে তাঁর মাঝে একই সময় সিদ্দীক্বিয়াত (সততা-সত্যতা), ফারুক্বিয়াত (সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয়ে পারঙ্গমতা), উসমানিয়াত (সৃষ্টির প্রতি অমুখাপেক্ষীতা) এবং আলভিয়াত (মহত্ব ও উন্নতর সাহসিকতা) সমুজ্জ্বল। যে কারণে “ক্বাদেরিয়া ত্বরীকা’র অনুসারী শায়খগণের মাঝেও এ সব গুণের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
এ ছাড়াও, হযরত গাউসুল আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু শায়খ আহমদ আস্ওয়াদ দায়নূরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হ’তে ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু খিরক্বাহ (ত্বরীকার খেলাফতের বিশেষ পোশাক), হযরত আবুল খায়ের রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর খিরক্বাহ এবং শায়খ মুহাম্মদ মাগরিবী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র খিরক্বাহ লাভ করেন। এতদ্ব্যতীত তিনি ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুরও খিরক্বাহ প্রাপ্ত হন। কাজেই, এ দুই ধারায়ও তিনি এ ত্বরীকা প্রাপ্ত হন। বস্তুত: মহান আল্লাহ’র জালালী (তেজস্বী) ও জামালী (মহত্ব-সৌন্দর্য্য) গুণাবলীর একমাত্র প্রকাশস্থল হযরত মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হতে নি:সৃত যতগুলো ঝর্ণাধারা রয়েছে, সবগুলোর মিলনকেন্দ্র ছিলেন হযরত গাউসুল আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর পবিত্র সত্ত্বা। সে জন্যে হযরত সুলতান বাহু রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন,
“অন্যান্য সকল ত্বরীকার যেখানে শেষ, সেখান হতে এ ত্বরীক্বার সূচনা মাত্র”।
হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন,
“সকল ত্বরীকা হতে সর্বোৎকৃষ্ট তরীক্বা হল ‘ক্বাদেরিয়া ত্বরীকা’।”
তাছাড়া, সর্বপ্রথম সর্বসাধারণের উপযোগী করে ইল্ম-ই তাসাউফ তথা ত্বরীক্বতের মূলনীতি প্রণয়ন ও ভিত্ রচনা করার কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন হযরত গাউসুল আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু। তাই তাঁর নামের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে এ ত্বরীকা “ক্বাদেরিয়া ত্বরীকা” নামে খ্যাতি লাভ করে। যদিও তাঁর পূর্বে রাসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হতে ত্বরীকত চর্চা ও সূফী-সাধনা হয়ে আসছিল; কিন্তু সেটা অনুসরন-অনুশীলন সাধারণ মুসলমানদের জন্য সহজ সাধ্য ছিল না। সে জন্যে ক্বাদেরিয়া ত্বরীকা’র মূলনীতিগুলোর সাথে পূর্বেকার প্রচলিত ত্বরীকত চর্চা ও সূফী সাধনার সংশ্লিষ্টতা পর্যালোচনা করতে গিয়ে পরবর্তীকালের আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞাবানগণ এ ত্বরীকার যোগসূত্র নানা দৃষ্টিভঙ্গিতে নানা মত প্রকাশ করেছেন। যেমন,
সাধারণত: ধারণা করা হয় যে,
“এ ত্বরীকার র্উধ্বতন শায়খ হযরত আবুল ফারাহ আল ত্বারত্বূসী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র অনুসৃত রীতি-নীতির সাথে ক্বাদেরিয়া ত্বরীকার গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান।”

কিন্তু শাহজাদা দারাশিকূহ বলেন যে, “উসওয়া-ই হাসানা’ তথা সুন্নাত অনুসরণের দিক বিবেচনা করে এ ত্বরীকাকে সায়্যিদুত্ তায়িফা হযরত শায়খ জুনাঈদ আল-বাগদাদী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র সময়কাল পর্যন্ত জুনাঈদিয়া বলা হত।”

তবে হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন, “হযরত গাউসুল আযম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ত্বরীকার উদাহরণ এমন এক নদী, যা ক’দিন ভূ-পৃষ্ঠের উপর প্রবাহিত হয় আবার যমীনের ভিতর অদৃশ্য হয়ে পড়ে এবং ভিতরে ভিতরে অনেক দূর পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে ভিতরের কূপগুলো ভরে দেয়। আবার যমীন হতে বিদীর্ণ হয়ে ভূ-পৃষ্ঠের উপর অনেক দূর পর্যন্ত প্রবাহিত হয়। এটাই এ ত্বরীকার অবস্থা। যেরূপ শায়খগণের মাঝে একবার এ ত্বরীকার খেলাফত প্রদান ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে, দ্বিতীয়বার মধ্যখানের শায়খ বা পীর-মুরশিদ ছাড়াই বাত্বেনীভাবে এ ত্বরীকার নিসবত (সম্পৃক্ততা) গ্রহণ কোন কোন বুযুর্গ হতে প্রকাশ পায়। সত্যি করে জিজ্ঞেস করলে বলব, ত্বরীকায়ে ক্বাদেরীয়া পুরোটাই ওয়াইসিয়া।”
উল্লেখ্য, হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির এ অভিমতটি শাহানশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির শ্রদ্ধেয় পীর আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ধারাবাহিকভাবে স্বীয় পীর হযরত ইয়াকূব শাহ গিনছাতরী কাশ্মিরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি হতে খেলাফত লাভ এবং হযরত গাউসুল আযম রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির মাযার শরীফ যিয়ারত করার সময় বাত্বেনীভাবে নিসবত গ্রহণ প্রকাশিত হওয়ার সাথে হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

উপমহাদেশে ক্বাদেরীয়া ত্বরীকা
হিজরী প্রথম শতকের একেবারে গোড়ার দিকে উপমহাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ইসলামের আগমনের সাথে সাথে ত্বরীকত চর্চার সূচনা হয়। অত:পর ৭১৩ খৃষ্টাব্দে মুহাম্মদ বিন ক্বাসেম কর্তৃক সিন্ধু বিজয়ের পর থেকে হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন হাসান চিশতী আজমেরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির আগমন পর্যন্ত প্রায় পৌনে পাঁচশত বছর ইসলাম প্রচারের গতিধারা ছিল অত্যন্ত ধীরগতি সম্পন্ন। এই অর্ন্তবর্তীকালে অনেক উলামা-মাশা-ইখ আগমন করলেও তাঁদের ইসলাম প্রচার ছিল সীমিত স্থানে ও সময়ে আবদ্ধ। ফলে তা বেশীদূর পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। হযরত খাজা আজমেরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ছিলেন হযরত গাউসুল আযম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর আত্মীয় ও বয়সে প্রায় ষাট বছরের ছোট। গাউসুল আযম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁকে উপমহাদেশে এসে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব অর্পণ করেন। এ নির্দেশ তিনি তখনই প্রদান করেন, যখন তিনি হযরত গাউসুল আযম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ইতিপূর্বে এ ভূ-পৃষ্ঠে ইসলামের মজবুত ভিত্ রচনা করতে বিশ্বব্যাপী তাঁর সংস্কার কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলেন। ওই সময় নিজের সন্তান ও খলিফাদেরকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনাবাদী জায়গাতেও প্রেরণ পূর্বক আবাদ করেন। তাঁর আধ্যাত্মিক প্রভাবে চারিদিকে ক্বাদেরিয়া ত্বরীকার বিস্তার ঘটে; কিন্তু খাজা আজমীরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ছিলেন চিশতিয়া ত্বরীকার অনুসারী। তিনি উপমহাদেশের সাধারণ জনগণকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট ও ধাবিত যাবতীয় ব্যবস্থা করেন। ফলশ্রুতিতে উপমহাদেশের সাধারণ জনগণের মাঝে তাঁর ইসলাম প্রচার ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করে এবং দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে, যার কারণে চিশতীয়া ত্বরীকার প্রভাব ও হিজরী অষ্টম শতাব্দীতে ব্যাপকতা লাভ করে।
হিজরী ষষ্ঠ হতে অষ্টম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়কালে উপমহাদেশে আগত সোহরাওয়ার্দিয়া ত্বরীকার অনেক শায়খও সোহরাওযার্দীয়া ত্বরীকার প্রচার চালান। তবে এ উভয় ত্বরীকার শায়খগণের খানকাহগুলোতে ক্বাদেরিয়া ত্বরীকার ওযীফা ও কর্মগুলো, যেমন গেয়ারভী শরীফ, গাউসিয়া শরীফ, যিক্র ইত্যাদি অতি ভক্তি সহকারে পালন করা হত। যে কারণে এ সব ত্বরীকার সাধারণ মানুষ ক্বাদেরীয়া ত্বরীকার প্রতি ছিল বেশ শ্রদ্ধাশীল। যদিও সুন্নাতের পদাঙ্ক অনুসরণে ক্বাদেরিয়া ত্বরীকার নিয়ম-রীতিসমূহে তখনকার সাধারণ নও-মুসলমানদের অভ্যস্ত হতে কিছুটা কষ্টসাধ্য ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। সে কারণে আলেমসমাজে তখন এ ত্বরীকার চর্চা সীমাবদ্ধ থাকে। সে সময়কার অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থায় সময় ও স্থানগত পার্থক্য ও দূরত্ব থাকার প্রেক্ষিতে ক্বাদেরিয়া ত্বরীকার প্রচার উল্লেখযোগ্য ছিল না। অন্যদিকে পরবর্তীকালের ত্বরীকা সম্পর্কে কলামিষ্ট বুযর্গদের প্রায় ছিলেন চিশতীয়া ও সোহরাওযার্দীয়া ত্বরীকার অনুসারী; যারা নিজ নিজ ত্বরীকা নিয়ে তৎপর ছিলেন। ফলে উপমহাদেশে ক্বাদেরিয়া ত্বরীকা সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্ত অনুদ্ঘাটিত থেকে বলা যায়। কাজেই, উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ক্বাদেরিয়া ত্বরীকাকে প্রচার করেছে? এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে বলা খুবই কঠিন। ইদানিং কোন কোন গবেষক এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট মত ব্যক্ত করলেও তাতে ঐতিহাসিক তথ্যগত অসঙ্গতি ও পরস্পর সাংঘর্ষিক বক্তব্য বেশ লক্ষ্য করা যায়। যেমন-
মাস‘উদ হাসান শিহাব দেহলভী বর্ণনা করেন,
সিন্ধুতে ক্বাদেরীয়া ত্বরীকার প্রথম বুযর্গ ছিলেন হযরত গাউসুল আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শাহজাদা শায়খ শরফুদ্দীন ঈসা। তিনি শরফুদ্দীন ক্বাত্তাল নামে পরিচিত। উপমহাদেশে তিনি কিছু দিনের জন্য আগমন করেন।
ড. আবদুল মজীদ সিন্ধীর মতে,
হযরত গাউসুল আযম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শাহজাদা শায়খ সাইফুদ্দীন আবদুল ওয়াহাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ত্রিশ বছর বয়সে মাত্র আঠার দিন মুলতানে অবস্থান করতে বাগদাদে ফিরে যান।
ড. ইয়াহ্ইয়া আন্জুম বলেন,
হযরত খাজা আজমীরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর আবেদনের প্রেক্ষিতে তাঁর সাথে হযরত গাউসুল আযম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শাহজাদা শায়খ সাইফুদ্দীন আবদুল ওয়াহাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু কে চব্বিশ বছর বয়সে উপমহাদেশে প্রেরণ করেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে তার স্ত্রী আয়েশা ও খাদেম মুযাফ্ফরও ছিলেন। তিনি মাত্র ছয় মাস হযরত খাজা আজমীরীর সাথে আজমিরে অবস্থান করেন। অত:পর তাঁর অনুমতিক্রমে নাগূরে গমন করেন এবং সেখানে ওফাত বরণ করেন। নাগূরে তাঁর মাযার অবস্থিত।
ড. জালালুদ্দীন আহমদ নূরী বলেন,
হযরত গাউসুল আযম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র বংশধর ও খলীফাদের মধ্যে যাঁদের নাম উপমহাদেশে পাওয়া যায়, তাঁেদর অধিকাংশের বংশীয় ও সিলসিলার পরম্পরা (শাজরা) শাহজাদা শায়খ তাজুদ্দীন আবদুর রায্যাক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র সাথে সম্পৃক্ত।
এ সকল মতামতে উপমহাদেশে হযরত গাউসুল আযম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শাহজাদা শায়খ শরফুদ্দীন ঈসা ও শায়খ সাইফুদ্দীন আবদুল ওয়াহাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর আগমন উল্লেখ স্পষ্টতর; কিন্তু ওইগুলো ঐতিহাসিক তথ্যগতভাবে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যেমন, হযরত আবদুল ওয়াহাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বয়স ও আগমনের স্থানের মধ্যে মতামত ভিন্ন ভিন্ন। তবে আরবদেশের ইতিহাস ও জীবন চরিত গ্রন্থে উপমহাদেশে উল্লেখিত দু’জনের আগমন সম্পর্কে তথ্য নেই। ইরাকে হালবাহ্ কবরস্থানে তাঁদের মাযার শরীফ রয়েছে; যা ড. জালালুদ্দীন আহমদ নূরীও বাগদাদে অধ্যায়ন কালে যিয়ারত করেছেন বলে প্রামাণ্য তথ্য পেশ করেন। অবশ্য হযরত গাউসুল আযম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ওফাতের পর ১২৫৮ সালে বাগদাদে মঙ্গোলীয়দের হামলার আগে তাঁর বংশধরদের মধ্যে যাঁরা বেঁেচ ছিলেন, তাঁরা মিশর, সিরিয়া, তুরস্ক প্রভৃতি রাষ্ট্রে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে গমণ করেন। তাই ধারণা করা হয় যে, সেখান হতে তাঁদের বংশধরগণ উপমহাদেশে আগমন করেছেন।
শাহানশাহে সিরিকোটের পরিচিতি
ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ৩৭তম অধঃস্তন পুরুষ শাহানশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি। তাঁর আসল নাম আহমদ। তাঁর নামের আগে ‘সাইয়্যেদ’ শব্দটি বংশীয় উপাধি এবং নামের শেষে ‘শাহ’ শব্দটিও জাতিগত উপাধি। সিরিকোটি শব্দটি তাঁর গ্রামের দিকে সম্পৃক্ত হয়েছে। তিনি সাইয়্যেদ আহমদ শাহ সিরিকোটি’ নামে সমধিক খ্যাত। তিনি বরেণ্য ব্যক্তিত্ব সাইয়্যেদ সদর শাহ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির পাঁচ সন্তানের মধ্যে চতুর্থ। অধিকাংশের মতে, তাঁর জন্ম ১৮৫৭ সনে। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের বৈপ্লবিক সন্ধিক্ষণে পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সিরিকোট গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর শুভাগমন বার্তা হিদায়তের আলোকবর্তিকা ছিল, যা তাঁর বাস্তব জীবনে মুসলিম সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রতিফলিত হয় এবং আজকে তা আরো উৎকর্ষতা লাভ করে। তিনি অতি অল্প বয়সে কুরআন মজীদ হিফ্য করেন। স্থানীয় বিদ্যাপীঠে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করার পর ইসলামী শিক্ষার সকল বিষয়ে উচ্চতর জ্ঞানার্জন করেন হিন্দুস্তানের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানে। ১২৯৭ হি. মুতাবিক ১৮৮০ সালে উচ্চতর ডিগ্রীর সর্বশেষ সনদ ‘ফাদ্বিল’ অর্জন করেন। তারপর আঠারো শতকের নব্বই দশকে কোন এক সময় বিয়ে করেন। অত:পর ব্যবসার উদ্দেশ্যে দক্ষিণ আফ্রিকায় গমণ করেন। সেখানে সূতা ব্যবসায় প্রভূত: উন্নতি লাভ করেন। পরে ১৯১২ সালে স্বদেশে চলে আসেন এবং আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির সান্নিধ্যে এসে ক্বাদেরিয়া ত্বরীকায় বায়‘আত গ্রহণ করেন। ১৯২০ সালে পীরের নির্দেশে প্রায় ৬৩ বছর বয়সে বার্মায় গমন করেন ও ত্বরীকায়ে ক্বাদেরিয়া সম্প্রসারণের প্রয়াস পান। পরে চট্টগ্রাম-ঢাকা সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ ত্বরীকার প্রচার-প্রসারে প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক বহুমুখী অবদান রাখতে সক্ষম হন। অবশেষে ১৯৬১ সালে মাওলায়ে কায়েনাতের ডাকে লাব্বায়ক বলে সাড়া দেন।

প্রচারিত তরীক্বায়ে ক্বাদেরিয়ার উদ্দেশ্য
তরীক্বায়ে ক্বাদেরিয়া দ্বারা সিলসিলা আলিয়া ক্বাদেরিয়া-ই উদ্দেশ্য। শাহানশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি স্বীয় পীর আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি হতে ১৯২৩-১৯২৪ সালে খিলাফত প্রাপ্ত হয়ে এ তরীক্বার দায়িত্ব লাভ করেন। আর আল্লামা চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি স্বীয় পীর ইয়াকুব শাহ গিনছাতরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি হতে মাত্র দশ বছর বয়সে চিশতীয়া, নক্সবন্দীয়া সোহরাওর্য়াদীয়া, আকবরীয়া, কিবরাভীয়া, বদভীয়া, রিফাঈয়া, শাযলীয়া, জুনাঈদীয়া, দাসুক্বীয়া, খিল্ওয়াতিয়া, মাদারিয়া, ইদ্রীসিয়াসহ এ ক্বাদেরিয়া ত্বরীকার খেলাফত প্রাপ্ত হন। তাঁর প্রচারিত ক্বাদেরিয়া ত্বরীকার শাজরা এই-
হযরত শায়খ সুলতান সাইয়্যেদ আবদুল ক্বাদের জিলানী। > হযরত সাইয়্যেদ আবদুর রায্যাক্ব > হযরত সাইয়্যেদ আবু সালেহ > হযরত শিহাবুদ্দীন আহমদ > হযরত সাইয়্যেদ শরফুদ্দীন ইয়াহ্ইয়া আল ক্বুত্বুব > হযরত সাইয়্যেদ শামসুদ্দীন মুহাম্মদ > হযরত সাইয়্যেদ আলাউদ্দীন > হযরত সাইয়্যেদ বদরুদ্দীন > হযরত শরফুদ্দীন ইয়াহ্ইয়া আল সানী > হযরত সাইয়্যেদ শরফুদ্দীন আল ক্বাসেম > হযরত সাইয়্যেদ আহমদ > হযরত সাইয়্যেদ আল হুসাইন > হযরত সাইয়্যেদ আবদুল বাসেত > হযরত সাইয়্যেদ আবদুল ক্বাদের আল সানী > হযরত সাইয়্যেদ আল মাহমূদ > হযরত সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ > হযরত শায়খ ইনায়াতুল্লাহ শাহ্ > হযরত শায়খ হাফেয আহমদ > হযরত শায়খ আবদুস্ সবূর > হযরত গুল মুহাম্মদ কাঙ্গাল > হযরত শায়খ মুহাম্মদ রফীক্ব > হযরত শায়খ আবদুল্লাহ > হযরত শায়খ মুহাম্মদ আনোয়ার শাহ > হযরত শায়খ মুহাম্মদ ইয়া‘কুব শাহ > হযরত খাজা আবুল ফাদ্বলান আবদুর রহমান চৌহরভী (রা.)।
অবশ্য আল্লামা চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি যখন হযরত শায়খ সুলতান সাইয়্যেদ আবদুল ক্বাদের জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর মাযার শরীফ যিয়ারত করতে গেলেন; তখনও আবার সরাসরি মাযার শরীফ হতে এ ত্বরীকার খেলাফত প্রাপ্ত হন, যা ওই সময়কার গাউসে পাকের বংশধর ও দরবার শরীফের তদানীন্তন সাজ্জাদানশীল হযরত সাইয়্যেদ মোস্তফা ক্বাদেরী ইব্নে সাইয়্যেদ মুহাম্মদ ক্বাদেরী ইব্নে সাইয়্যেদ আবদুল আযীয রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি আদিষ্ট হয়ে তাঁেক ওযীফা পাঠ করে শুনান, যার ফলে এরূপে খেলাফত লাভের খবর প্রকাশ হয়ে যায়। আল্লামা চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর অনুসৃত এ তরীক্বার নাম রাখেনÑ“তরীক্বায়ে ক্বাদেরিয়া মাহবূবীয়াহ্”। শাহানশাহে সিরিকোট কর্তৃক প্রচারিত এ তরীক্বা পরবর্তীতে বাংলাদেশে প্রচারিত অন্যান্য ত্বরীকা হতে পৃথক পরিচয়ে ‘সিলসিলায়ে আলীয়া ক্বাদেরীয়া’ নামে প্রকাশ পায়।

উপমহাদেশে সম্প্রসারণ
মঙ্গোলীয়দের হামলায় আরব রাষ্ট্রসমূহে বিশেষত: বাগদাদে পর্যাপ্ত ক্ষতি হলেও উপমহাদেশে সে সব এলাকা হতে আগত বুযুর্গদের প্রচেষ্টায় ইসলামের দ্রুত প্রচার ও উন্নতির ক্ষেত্রে যথেষ্ট আলোক প্রতিফলিত হয়। ইসলামকে এমন জায়গাতে নিয়ে যায়, যেখানে তখনও পর্যন্ত ইসলামের নামও পৌঁছেনি। উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমে ও দক্ষিণে ইসলাম ও ত্বরীকার প্রচার এবং উন্নতি বহুলাংশে বেশী হয়। কিন্তু উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তথা বাংলা ও বার্মায় (মায়ানমারে) মধ্যযুগে যেভাবে বুযুর্গগণ এসে ইসলাম প্রচার করেছিলেন, সে-ই তুলনায় আধুনিককালে (১৭০০ খৃষ্টাব্দের পর) তাদেঁর আগমন ও ত্বরীকত প্রচার ছিল খুবই কম। মধ্যযুগে আগত বুযুর্গগণ যতদিন এ সব অঞ্চলে অবস্থান করেছিলেন, কেবল ততদিন সঠিক ত্বরীকা চর্চা হয়েছিল। তাঁদের ওফাত বা প্রত্যাবর্তনের পর যারা তাঁদের মাযার বা আস্তানা শরীফ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে আসছিলেন, তাঁেদর অধিকাংশই ওই সকল স্মৃতিগাহ্কে হয়ত: ব্যবসায়িক পূঁজির মাধ্যম করে রেখেছেন অথবা তারা নিজেরাই আত্মতুষ্টিতে ব্যতিব্যস্ত, স্বীয় মনমর্জিতে লিপ্ত, স্বার্থসিদ্ধিতে মশগুল। তাদের জীবন প্রণালী শুধু সুন্নাত বিরোধী নয়; বরং ক্ষেত্রবিশেষ ইসলামী মতবিশ্বাসের সাথেও সাংঘর্ষিক। বলা যায়- এ সকল লোক ছিল শরী‘আতের জ্ঞান সম্পর্কে নিরেট মূর্খ। এ সকল লোকদের উপর ধারণা ও অনুসরন করে সাধারণ মুসলমান ইসলামের মূলধারা হতে বিচ্যুত হতে থাকে। অধিকন্তু বৃটিশ উপনিবেশক ও এ অঞ্চলের কাফির-মুশরিকদের ষড়যন্ত্রের কারণে রাজনৈতিক ও ধর্মীয়ভাবে মুসলমানগণ বিভক্ত হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় হযরত গাউসুল আযম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর খলীফা আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ১৯২০ সালে শাহানশাহে সিরিকোট আল্লামা সাইয়্যেদ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিকে বার্মায় প্রেরণ করেন।
তিনি র্বামায় আসার পর শুভাকাক্সক্ষীদের সাথে আলাপ-আলোচনা করার সময় সদা সর্বদা অতি ভক্তি ভরে স্বীয় পীর-মুরশীদ আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির প্রশংসা করতেন। তাতে শ্রোতাদের হৃদয় প্রভাবিত হত। ফলে তাঁরাও আল্লামা চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির হাতে বায়‘আত হয়ে তরীকায়ে কাদেরিয়ায় অন্তর্ভূক্ত হতে ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিল। শাহানশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিও স্বীয় পীর-মুরশীদের নির্দেশনা অনুযায়ী সাধারণ মুসলমানদের মাঝে তরীকায়ে ক্বাদেরীয়া প্রচার-প্রসারের সাথে সাথে অমুসলমানদেরকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করতে থাকেন। ফলে অতি অল্প সময়ে বার্মার রাজধানী রেঙ্গুনে (ইয়াঙ্গুনে) তাঁর আধ্যাত্মিক প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। সে-সময়ে চট্টগ্রামের রেঙ্গুন প্রবাসী অনেকে সেখানে তাঁর হাতে বায়‘আত গ্রহণ করে ক্বাদেরীয়া ত্বরীকায় অনুসরণ ও অনুশীল করতে থাকেন। পরে তাদেঁরই আমন্ত্রণে শাহানশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বাংলা অঞ্চলে আগমণ করেন। এভাবে এ তরীকার সম্প্রসারণ সূচনা হয়।

শাহানশাহে সিরিকোট (র.)’র অনুসৃত পদ্ধতি
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তোমার রবের পথে প্রজ্ঞার সাথে (কৌশলে) এবং উত্তম ওয়াজ করে ডাকো। (আল ক্বোরআন)
শাহানশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিও পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আলোকে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং এ তরীক্বার সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ওয়াজ, লিখনী প্রকাশনা ও হিকমত তথা প্রজ্ঞার সাহায্য গ্রহণ করেন।

১.ওয়াজ
ইসলাম ও মুসলিম সমাজে সমাদৃত ও প্রচলিত গণজমায়েতের উত্তম স্থানগুলো তিনি ওয়াজের উপযুক্ত স্থান হিসেবে গ্রহণ করেন। আর বাস্তবায়ন করে তরীক্বায়ে ক্বাদেরিয়া সম্প্রসারণে কাজে লাগান।

১.ক. মসজিদ
বার্মা বৌদ্ধ শাসিত দেশ। যেখানে প্রকাশ্যে মাহফিল-সভা-সেমিনার করার কোন সুযোগ নেই। সেখানে সর্বপ্রথম তিনি মসজিদে ইমামতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মসজিদে বসে ধর্মীয় আলোচনা শুনতে সাধারণ মুসল্লীদের স্বভাবতই আকর্ষণ থাকে আর সে-ই আলোচনা যখন ওই মসজিদের ইমাম কিম্বা খতীব করেন, তখন তা অনুসরণে তাদের কোন প্রশ্ন থাকে না। তথ্য সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন আছর নামাযের পর তিনি মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে তাক্বরীর করতেন। এ ছাড়াও জুমার দিনে, ইসলামী দিবস, যেমন- শবে বরাত, শবে কদর, ঈদ ইত্যাদিতেও তাঁর হৃদয়গ্রাহী তাকরীরের মাধ্যমে সাধারণ মুসলমানদেরকে উদ্বুদ্ধ করেন। ফলে তরীক্বায়ে ক্বাদেরিয়াতে সাধারণ মানুষ আশ্রয় গ্রহণ করে।

১.খ. খানকাহ
১৯৩৫ সালের দিকে শাহানশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি চট্টগ্রামে আসেন এবং আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের অদূরে তাঁর বিশিষ্ট মুরিদ ‘কৌহিনূর পত্রিকা’ বর্তমানে ‘দৈনিক আজাদী’র প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ্ব ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক্বের বাসায় অবস্থান করেন। ওই সময় উক্ত মসজিদের খতীব হযরত আবদুল হামীদ বাগদাদী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির সাথে তার সু-সর্ম্পক গড়ে ওঠে। অত:পর দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরে স্বদেশ তথা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ সিরিকোট হতে যখনই চট্টগ্রামে আসতেন, তখন আন্দরকিল্লা মোড়স্থ কোহিনূর মঞ্জিলের দ্বিতীয় তলায় খানকাহ্ শরীফে অবস্থান গ্রহণ করেন। সেখানে আগত লোকদের মাঝে ক্বাদেরিয়া তরীক্বার দীক্ষা দান করেন। এ সময় অনেকে তাঁর কাছে আসত বিপদ থেকে মুক্তি লাভের আশায়। তিনি তাঁদের জন্য দো’আ করতেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শও দিতেন। ফলে বায়‘আত গ্রহণ করে অনেকের ভাগ্য পরিবর্তন হয়ে যেত অনেক দ্রুত, স্বচ্ছল জীবনও লাভ করত। এ পরিবর্তন দেখে দলে দলে মানুষ তাঁর অবস্থানরত খানক্বাহ্ মুখী হতে থাকে। ফলে ক্বাদেরিয়া তরীক্বার সম্প্রসারণের নব সূচনা হলো।

১.গ. মাহফিল
চট্টগ্রামে বিভিন্ন স্থানে মুরীদগণের বাসা-বাড়ীতে ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে মাহফিল তথা গণ সমাগম করে এ তরীক্বার সম্প্রসারণ করেন। ১৯৪৯ সালে বাঁশখালী শেখরখীলের মাহফিল এবং ১৯৫২ সালে লালদিঘীর ময়দানের জনসভা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সবে তিনি সভাপতির ভাষণ দান করেন। এ সময় তিনি বাতিলদের সাথে যেমন আপোষহীন কঠোর ছিলেন, তেমনি অন্যান্য হক্ব তরীক্বার ওলামা-মাশা-ইখের যথাযথ সম্মান করতেন। এ সময় হযরত আবদুল হামীদ বাগদাদী, শেরে বাঙলা আল-ক্বাদেরী প্রমুখসহ বিশিষ্ট সুন্নী উলামা-মাশা-ইখের সাথে তাঁর বন্ধত্বের সর্ম্পক গড়ে উঠেছিল। তৎসঙ্গে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ব্যাপারে অবমাননাকর উক্তি করত, তাদের ও এ সকল লোকের অনুসারীদের কার্যকলাপ তেজোদীপ্ত কন্ঠে প্রতিবাদ করতেন এবং স্বীয় ভক্ত-অনুরক্তদেরকে তাদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখানের নির্দেশ দিতেন।
উল্লেখ্য,আধ্যাত্মিক ও রূহানী উন্নতির জন্য তাঁর অনুসৃত ও প্রচারিত ক্বাদেরিয়া ত্বরীক্বার শায়খদের কেউ ওই সকল অবমাননাকারীর সাথে বিন্দুমাত্র সর্ম্পক ছিল না। ফলে নিখাদ-নিটোল হিসেবে তাঁর প্রচারিত ক্বাদেরিয়া তরীক্বা চুলসেরা বিশ্লেষক ও জ্ঞানী-গুণীজনদেও কাছে সমাদৃত হয় এবং এ ত্বরীকা সম্প্রসারণে অনুকল পরিবেশ তৈরী হয়।

১.ঘ. মাদ্রাসা
শাহানশাহে সিরিকোট আল্লামা সাইয়্যেদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির প্রচারিত তরীক্বায়ে ক্বাদেরিয়ার সকল কার্যক্রম-কর্মসূচী ইসলামী শরী‘আতের ভিত্তিতে প্রবর্তিত। কোনটি শরী‘আত বিরোধী নয়। তাঁর মতে, শরী’আতকে অবজ্ঞা-অবহেলা করে ত্বরীক্বত চর্চা করা আর ত্বরীক্বতকে অস্বীকার করে শরী’আত চর্চা করা, দু’টোই অসার, অর্থহীন ও বাতিল। তাই যাতে তাঁর প্রচারিত ত্বরীকাতে শরী‘আত বিরোধী কোন কার্যকলাপের আচ না লাগে, তৎজন্য ইসলামের সঠিক রূপরেখা ও মূলধারা ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা‘আতের’ মতাদর্শে তথা মাসলাক-ই ‘আলা হযরতের উপর ১৯৫৪ সালে আজকের এশিয়াখ্যাত জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়ার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। তারপর ১৯৫৬ সালে এই মাদ্রাসার শিক্ষার কার্যক্রম চালু করেন। যাতে ইসলামী শরী‘আতের উপর যাঁরা জ্ঞান রাখেন, তাঁদের সংস্পর্শে ও সহযোগীতায় এ ত্বরীকা আরো দীর্ঘ পরিজনের সম্প্রসারিত হয়। এ ছাড়াও ইতিপূর্বে বার্মা থাকাকালে শাহানশাহে সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর পীরের প্রতিষ্ঠিত কাঁচা ইটের হরিপুর ইসলামিয়া রহমানিয়া মাদরাসাটি পাকা ইট দিয়ে দ্বিতল ভবন নির্মাণ করেন। জমি কিনে জায়গা সম্প্রসারণ করেন এবং পরিচালনার দায়িত্বও গ্রহণ করেন।
ফলশ্রুতিতে আলেম-শিক্ষক-ছাত্র সমাজে ক্বাদেরিয়া তরীক্বার সঠিক পরিচয় পৌঁছে, তাঁদের মাধ্যমে তা আরো সম্প্রসারিত হয়। এ দুটো মাদরাসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনার জন্য প্রথমে ১৯২৫ সালে আনজুমানে শুরায়ে রহমানিয়া, পরে ১৯৩৫ সালে ঐ নামে আরেকটি শাখা চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন। অত:পর ১৯৫৪ সালে আরেকটি সংস্থা ‘আন্জুমান-এ আহমদিয়া’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে এ দু’টি সংস্থাকে ১৯৫৬ সালে একত্র করে ‘আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া’ নামে নামকরণ করেন। বর্তমানে এ নামের সাথে ট্রাস্ট সংযোজিত হয়েছে। ফলে তরীক্বায়ে ক্বাদেরিয়ার সম্প্রসারণে আরো ব্যপ্তি ঘটে।

২.লিখনী প্রকাশনা
সাধারণ মানুষের মনে নবীর প্রেম জাগরণের বিশেষ হাতিয়ার দুরূদ শরীফ চর্চার বিস্তারে স্বীয় পীরের লিখনী ৩০ পারা সম্বলিত দুরূদ গ্রন্থ ‘মাজমু‘আ-ই সালাওয়াতির রাসূল’ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রথমে ১৯৩৩ সালে, পরে ১৯৫৩ সালে দু‘বার প্রকাশনার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং সম্পূর্ণ ফ্রী বিতরণ করেন। ফলত: জন সাধারণ দুরূদ শরীফ চর্চার মাধ্যমে তরীকতে ধাবিত হয় আর ক্বাদেরিয়া ত্বরীকার সম্প্রসারণে তা সহায়ক হয়। অতঃপর এ বিরাটাকার দুরুদ শরীফ গ্রহণ উর্দু ভাষায় অনুদিত হয়। এরপর ওই গ্রন্তের অনুবাদসহ বাংলায় অনুবাদ করা হচ্ছে। তাছাড়া, শাজরা শরীফ প্রকাশনার ব্যবস্থা করেন। প্রকাশনার এ সূচনা এখন অনেক প্রাপ্তি লাভ করেছে।

৩.ত্বরীকাকে যুগোপযোগী করে উপস্থাপন
আল্লামা সৈয়দ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি কাল ও সময়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। পাশাপাশি মানসিক অবস্থাদির প্রতি গুরুত্ব দিতেন। আধুনিককালে জীবন সংগ্রামে জর্জরিত কর্মব্যস্ত মানুষের ধর্মকর্ম পালন সহজ-সাধ্য করে উপস্থাপনে তিনি ছিলেন বেশ মনোযোগী। তিনি ত্বরীকা-ই ক্বাদেরীয়া সম্প্রসারণে স্বীয় পীরের নির্দেশনা অনুসারে সর্ব প্রথম বায়‘আত ও ত্বরীকার ওযীফাগুলোকে সহজ ও সংক্ষিপ্ত করেন। অর্থাৎ আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি মুরীদগণদেরকে যে ওযীফা দিতেন, তার চেয়েও আরো সংক্ষিপ্ত পরিসরে শাহানশাহে সিরিকোট স্বীয় মুরীদানদের প্রদান করতেন।

৩.ক.বায়‘আত গ্রহণের জন্য সময় অনির্দিষ্ট রাখা
আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বায়‘আতের জন্য সময় নির্ধারিত ছিল। যেমন- তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে ঐ জায়নামাযে কিবলামুখী হয়ে বায়‘আত হবে। যেমন রেঙ্গুনে রুমালের মাধ্যমে যারা বায়‘আত হয়েছেন তাদেরকে এরূপে করেছেন। পক্ষান্তরে, শাহানশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি কোন সময় র্নিধারণ করেননি। যখন যে বায়‘আতের আগ্রহ প্রকাশ করত, তখন তাকে প্রয়োজনীয় উপদেশ বা নির্দেশনা দিয়ে ক্বাদেরিয়া ত্বরীকার অর্ন্তভূক্ত হবার সুযোগ দিতেন।

৩.খ. প্রদত্ত ওযীফাসমূহ সংক্ষিপ্তকরণ
আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির নিকট যারা বায়‘আত হতেন, তাদের ওযীফা ছিল নি¤œরূপ :
১। প্রত্যেক ওয়াক্ত নামাযের আগে-পরে দুরূদ-ই ইব্রাহিমী শরীফ একশ’ বার করে মোট (২০০ী৫) =১০০০ বার দৈনিক পাঠ করা ।
২। মাগরিবের নামাযের সাথে সাথে সালাত-ই আওয়াবীন ছয় রাক্‘আত আদায় করা।
৩। ফজর ও এশা নামাযের সাথে সাথে ইসমে জাত শরীফ তথা আল্লাহ তা‘আলার পবিত্র নামটি নফী-এসবাত সহকারে অর্থাৎ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, ‘ইল্লাল্লাহ্’ ও ‘আল্লাহু’ এ তিন যিক্র শ্বাস-প্রশ্বাসের সমন্বয়ে তিনশত বার করে (৩০০ী৩)=৯০০ী২=১৮০০ বার দৈনিক পাঠ করা ।
৪। ইচ্ছা করলে ফজর ও ইশা নামাযের সাথে আরো একশ’বার করে দুরূদ শরীফ (১০০ী২)=২০০ বার পাঠ করা ।
অপর দিকে, শাহান শাহে সিরিকোট তাঁর মুরীদানদের বায়‘আত হওয়ার পর যে সকল ওযীফা দিতেন তা পর্যালোচনায় দেখা যা
ক) ফজর নামাযের পর সংক্ষিপ্ত দুরূদ শরীফ – ১০০ বার এবং উক্ত তিন যিকর – ২০০ বার করে (২০০ী৩)=৬০০ বার।
খ) মাগরিবের নামাযের পর সালাতে আওয়াবীন ছয় রাক্‘আতের সাথে একশত বার দুরূদ শরীফ।
গ) এশা নামাযের পর কেবল ওই তিন যিকর ২০০ বার করে।

দৈনিক অযীফা
আগের অযীফা পরের অযীফা
দুরূদ শরীফ, দুরূদ শরীফ,
১০০০+২০০=১২০০ বার ২০০ বার
যিকর, যিকর ১৮০০ বার ১২০০ বার

৩.গ.বায়‘আত গ্রহণ সহজ লভ্য করন
ইতিপূর্বে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যারা তরীক্বত চর্চা করতে উৎসাহী ছিলেন, তাঁরা পীরের সন্ধানে ঘরের মায়া ত্যাগ করে পীরের দরবারে এসে বায়‘আত হতেন। কথায় আছেÑ‘পানির প্রয়োজন হলে কূয়া কিংবা পুকুর কিংবা জলাশয়ের নিকট আসবে, জলাশয় মানুষের নিকট যায় না।’ কথাটা আংশিক সত্য হলেও সৃষ্টি জগতের জন্য রহমত মহানবীর এই বংশধরের রহমতের সাগরে জোয়ারের উচ্ছ্বাস এতটা বেশী যে, মানুষের একেবারে কাছে পৌঁছে যায়।
শাহানশাহে সিরিকোট ৬৩ বছর বয়সে ১৯২০ সালে আপন পীরের নির্দেশে বার্মায় গমন করেন। ১৯৩৫ সালে ৭৮ বছর বয়সে চট্টগ্রামে আসেন। ১৯৪৯ সালে ৯২ বছর বয়সে বাঁশখালীতে গমন করেন। এমনটি ১৯৫৮ সালে প্রায় ১০১ বছর বয়সে ঢাকা-চট্টগ্রামে প্র্য়া ছয়মাস অবস্থান করেন, মাঠে-ময়দানে অজয় পাড়া-গ্রামে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে কষ্ট করে মানুষের ঘরে ঘরে ত্বরীকায়ে ক্বাদেরীয়ার দাওয়াত পৌঁছান। ফলে এ ত্বরীকার দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটে। তিনি ওই সময় সাধারণ মানুষের মানসিক অবস্থার খুবই গুরুত্ব দিতেন। সে সম্বন্ধে সম্যক ধারনার জন্য নীচে দু’টি ঘটনার অবতারণা করা হল:
এক .
শাহানশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি একদা বার্মার বাঙ্গালী মসজিদে ওয়াজ-তাক্বরীর করার সময় তাঁর মুরীদ সূফী আব্দুল গফূরের কাঁধে ভর দিয়ে কাকা সর্দার নামে এক প্রভাবশালী নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি মসজিদের দিকে আসল। ওই সর্দারকে আসতে দেখে হুজুর দাঁড়ালেন, করমর্দন করলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন-
হুজুর ; সর্দারজী কিয়া সময্কর ইঁহা আনা হুয়া (অর্থাৎ সর্দার সাহেব, কী মনে করে এখানে আসলেন)!
সর্দার : সূফী নে বাতায়া, ইঁহা জান্নাত মিলতা হ্যায়। মুঝে ভী জান্নাত চাহিয়ে, মুঝে জান্নাত দীজিয়ে। (সূফী বলেছেন, এখানে বেহেশ্ত পাওয়া যায়। আমারও বেহেশত দরকার, আমাকে বেহেশ্ত দিয়ে দিন।)
হুজুর : ঠিক হ্যায়, তুম কো জান্নাত মিল জায়েগী (ঠিক আছে, তুমি বেহেশত পাবে।)
সর্দার : মগর মাঁই শরাব পিনা নেহীঁ ছোড়োঁঙ্গা,আওর রণ্ডীখানে মে ভী জায়েঙ্গা (মদও পান করব, বেশ্যালয়েও যাব)।
হুজুর : ঠিক হ্যায়, মগর কভী ঝুট মাত বুলেঁ। খিঞ্জির কা বাচ্চা নেহীঁ খাওগে আওর হামারে সামনে হো কর রণ্ডীখানে মে মাত জানা। ( ঠিক আছে, তবে কখনও মিথ্যা বলবে না, শুকরের বাচ্চা খাবে না এবং আমার সামনে দিয়ে বেশ্যালয়ে যাবে না।)
সর্দার : ঠিক হ্যায়। (ঠিক আছে, মেনে নিলাম।)
অত:পর সর্দার তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের নিয়ে মদ পানে বসে গেল বটে; কিন্তু যখনই মদের বোতল পান পাত্র হাতে নিলেন, তখন সেখানে শুকরের বাচ্চা অবলোকণ করলেন সুতরাং তখনই তা ছুড়ে ফেলে দিলেন। নতুন বোতলে একই অবস্থা দেখে বিরক্ত হয়ে বেশ্যালয়ের পথে ছুটে যাচ্ছিলেন। যে পথ দিয়ে যান না কেন, ওই পথে হুযূরকে দেখতে পান! এভাবে সারা রাত ঘোরাঘুরি করে অবশেষে বাঙ্গালী মসজিদে এসে দেখেন; সেখানে হুযূর তাহাজ্জুদের নামাযেরত আছেন। উপায়ান্তর না দেখে ওযূ করে সর্দার ফজরের নামায আদায় করলেন হুযূরের ঠিক পেছনে। নামাযান্তে হুযূর তার কুশলাদি জিজ্ঞেস করা মাত্রই হু হু করে কেঁদে উঠলেন, পুরো ঘটনার বর্ণনা দিলেন, তাওবা করলেন এবং ক্ষমা চাইলেন। জবাবে হুযূর কেবলা বললেন, ‘‘জব আপ কো জান্নাত মিল গিয়া তো শরাব পিনা আওর রণ্ডীখানে মে জানে সে কেয়া ওয়াসত্বাহ্ হ্যায়? (যখন বেহেশত পেয়ে গেলেন, তখন মদ পান করা ও বেশ্যালয়ে যাওয়ার কী সর্ম্পক থাকতে পারে?)।
এ ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- শাহানশাহে সিরিকোট দা‘ওয়াতে খায়র তথা উত্তম দা‘ওয়াতই প্রদান করলেন। এ ক্ষেত্রে তিনি যে প্রক্রিয়াগুলো গ্রহণ করলেন, তা হল :
ক) ইমামতির দায়িত্ব গ্রহণ ও বাঙ্গালী মসজিদে তাক্বরীর করেছিলেন।
খ) কাকা সর্দারকে দেখে দাঁড়ালেন, করমর্দন করলেন।
গ) কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। [সর্দারজী কেয়া সমঝকর ইহাঁ আনা হুয়া?] ঘ) আগমনের উদ্দেশ্য জানতে চাইলেন।
ঙ) সর্দারের কথার ইতিবাচক জবাব দিলেন।
চ) সর্দারের শর্তের জবাবে শর্তারোপ করলেন।
ছ) পরের দিন সাক্ষাতে সর্দারের কুশলাদি আবার জানতে চাইলেন।
[আপ কা কেয়া হাল হ্যায়?] জ) বেহেশতীদের আচার-আচরণ সম্পর্কে অবহিত করলেন।
ঝ) পরিশেষে সান্ত¦না ও সুসংবাদ দিলেন।
ঞ) সর্বোপরি, ইতিবাচক কথা বললেন।
আবার শাহানশাহে সিরিকোট দাওয়াত প্রক্রিয়ায় যা পরিহার করলেন, সেগুলো হল:
ক) নেতিবাচক বক্তব্য।
খ) দূর্ব্যবহার।
গ) ভয়-ভীতি প্রদর্শন
ঘ) ধমক ও ঘৃণা প্রদর্শন এবং
ঙ) অবজ্ঞা।

দুই:
শাহানশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি একদা বাঙ্গালী মসজিদে ওয়াজ -তাকরীর করার সময় হঠাৎ রাস্তার দিকে ইশারা করে বললেন, ইস্ কো দো রুপিয়া দে দো। (এ’কে দু’টি টাকা দিয়ে দাও।)। উপস্থিত লোকেরা দেখল, যাকে টাকা দিতে বলা হয়েছে; সে নেশাগ্রস্ত ও বেশ্যালয়ে যাতায়তে অভ্যস্ত। তবুও হুজুরের নির্দেশ। তাই তাকে একজন মুসল্লি তাকে দু’ টাকা দিল। তখন মাসিক বেতন ছিল এক টাকা/দু’টাকা। লোকটি মুহুর্তে একত্রে দু’টাকা পেয়ে অভ্যাসবশত: বেশ্যালয়ের দিকে ছুটে গেল। কিছুক্ষণ পর ওই লোকটি একটা যুবতী মেয়ে সহ হুজুরের নিকট এসে কদমে লুটিয়ে পড়ল। আর কাঁদতে কাঁদতে ক্ষমা চাইতে লাগল। লোকটি বর্ণনা দিল যে, যুবতী মেয়েটি তার, এক আত্মীয় ফুস্লিয়ে তাকে বেশ্যালয়ে এক টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে। সেখানে তাঁর মেয়েকে দেখতে পেয়ে ঐ দু’টাকা দিয়ে কিনে এনেছে। অত:পর সে তাওবা করল।
এখানে শাহানশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি লোকটিকে দু’টাকা দিয়ে প্রয়োজন পূরণ করলেন। তখনকার সময়ে মানুষ পুরো মাস কাজ করে এক টাকা/দু’টাকা পেত। লোকটিকে ঘৃণা ও অবজ্ঞা ভরে তাড়িয়ে দেননি।

মূলত: আলোচ্য ঘটনা দু’টিতে শাহানশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি লোক দু’জনের প্রতি দয়া-মায়ার সাথে নিজকে এমনভাবে তুলে ধরলেন, যাতে তাদের আস্থা সৃষ্টি হয়, উপলব্ধি আসে, তারা বুঝতে পারে মুক্তির পথ কোথায়? সে জন্যে ওই দু’জন লোক শেষ পর্যন্ত তাঁর কাছে ছুটে এসেছিল। এটা বাস্তব যে, দয়া-মায়ার বাধঁনে দূরের লোককে সহজে কাছে নিয়ে আসা যায়। লোক দু’টির অভ্যাস (মদপান ও অবৈধ যৌন কর্মে লিপ্ত হওয়ার মত ঘৃণ্যকর্ম) যদিও একই এবং হারাম ও কবীরাহ গুণাহ’র কাজ ছিল, কিন্তু প্রতিশ্রতি রক্ষা ও সদা সত্য কথা বলার মত গুণ তাদের মাঝে বিরাজমান ছিল। যেন শাহানশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাদেরকে গুণাহ’র কর্ম হতে বিরত রাখাটা ছিল তাঁর পণ। দেখা গেছে যে, অনেকের বাড়ীতে নিমন্ত্রণ পেয়ে পরিবেশিত পানাহার বিনা সংকোচে তিনি গ্রহণ করেন। এভাবে ক্রমান্বয়ে আপনসূলভ আচার-ব্যবহার করে তাদের আস্থাভাজন হয়ে উঠেন এবং তাদেরকে ত্বরীকায়ে ক্বাদেরীয়ার দিকে ধাবিত করেন। এমনকি স্থানীয় অনেক পীর সাহেবও মুগ্ধ হয়ে স্ব স্ব ভক্তদেরকে শাহানশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির হাতে বায়‘আত হওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন। আবার অনেকে তাঁর কাছে এসে সংগোপনে বায়‘আত হওয়ার নজীরও আছে।
সুতরাং শাহানশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বাংলা অঞ্চলে ক্বাদেরিয়া ত্বরীকার সম্প্রসারণে উপযুক্ত ও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে যে অবদান রেখেছেন, তা শ্রদ্ধার সাথে কেবল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে স্মরণ করে না; বরং ইসলাম বিদ্বেষী কিম্বা ইসলামের ছদ্মাবরণে যারা প্রতিনিয়ত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবমাননা করে আসছে, তারাও নিঃসঙ্কুচে ও অকপটে স্বীকার করে যে, ‘যদি তিনি এ দেশে না আসতেন, তবে অনেক সাধারণ জনগণ নিঃসন্দেহে পথভ্রষ্ট হতো কিংবা ভ্রান্ত পথের পথিক থেকে যেতো।
ইসলাম ও ক্বাদেরিয়া ত্বরীকা সম্প্রসারণ স্থায়ীভাবে রূপদানে শাহানশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর কর্মসূচীকে বেগবান রাখার জন্য এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর ইন্তিকালের প্রায় পঞ্চাশ বছর পরও তা ফুলে-ফলে মহীরূহে পরিলক্ষিত হতে চলছে। এ ক্ষেত্রে তাঁর এ বাণী সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য “তৈয়্যব আউর তাহের কাম সাম্বালেঙ্গে, সাবের মুলকে বাঙ্গাল কা পীর হো-গা”। বাস্তবিকপক্ষে, তাঁর ইন্তেক্বালের পর স্থলাভিষিক্ত হয়ে তাঁর কনিষ্ঠ শাহজাদা পঞ্চাদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (র.) (১৯১৬-১৯৯৩ইং) বাংলাদেশের উত্তর-দক্ষিণে এ ত্বরীকার প্রসার ঘটান। অত:পর তাঁর বড় শাহজাদা গাউসে যমান আল্লামা তাহের শাহ (মু.যি.আ.) চারিদিকে বিস্তৃত করেন এবং সীমান্ত এলাকা জুড়ে এ ক্বাদেরীয়া ত্বরীকা সম্প্রসারণ করে আসছেন। এ দু’জনের প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষ প্রয়াসে বর্তমানে এ ত্বরীকার অনুসারী এতদ্অঞ্চলে প্রায় দু’কোটির অধিক।

গ্রন্থপঞ্জি

গ্রন্থকার গ্রন্থ
আবুল ফাদ্বলাইন আবদুর রহমান চৌহরভী
: মাজমূ‘আ-ই সালাওয়াতির রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) (পেশোয়ার : মঞ্জুর আম প্রেস-১৯৫৩ইং)
আবুল হাসান আলী নদভী : রিজালুল ফিকর ওয়াদ দা‘ওয়াত ফীল ইসলাম (কুয়েত : দারুল কলম লিল নছর-১৯৯১ইং)
মন্ত্রনালয় : আল জাওহারুল ছামীন ফী বা‘দ্বী মান ইশতাহারা যিকরুহু বায়নাল মুসলিমীন (লিবানন:দারুল মাশারীহ-২০০২ ইং)
ড. জালালুদ্দীন আহমদ নূরী : সায়্যিদিনা শায়খ আবদুল ক্বাদের গিলানী বাগদাদী কে ইলমী ওয়া ফিকরী আছরাত (করাচী : কুল্লীয়া মা‘আরিফ -ই ইসলামিয়া – ২০০৭ ইং)
ড. গোলাম ইয়াহইয়া আনজুম : তারীখে মাশায়িখে ক্বাদেরীয়া (নয়াদিল্লী : জামেয়া হামর্দদ -২০০৩ ইং)
আবদুল মুজতবা রেজভী : তাযকীরা-এ মাশায়িখে ক্বাদেরীয়া রেজভীয়া (ইউ.পি. :আল মাজমা‘উল মাসাবীহ জামেয়া আশরাফীয়া-১৯৮৯ ইং)
ড. প্রফেসর শায়খ মুহাম্মদ ইকরাম : উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষা সংস্কৃতির ইতিহাস [আবে কাউসার](ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-২০০৪)
ড. মুহাম্মদ মাস‘উদ আহমদ : ইফতেতাহিয়া (করাচী : এদারায়ে মাস‘উদিয়া -২০০২ ইং)
আবদুল হাকীম শরফ ক্বাদেরী : তাযকিরায়ে আকাবের-এ আহলে সুন্নাত(লাহোর :ফরীদ বুক স্টল-২০০০ ইং)
সায়্যিদ ইউসুফ শাহ : হালাত ই মাশওয়ানী (লাহোর মুহাম্মদী ষ্টীম প্রেস-১৯৩১ইং)
সাইফুর রহমান : তাযকিরায়ে আলেমে ইসলাম(হরিপুর :দারুল উলুম রহমানিয়া
ইসলামিয়া মাদ্রাসা-১৯৮৬ইং)
ড. তাহের হামীদ তানূলী : মাকতুবাত-এ রহমানিয়া (লাহোর : ইনষ্টিটিউড অফ রিসার্জ
এন্ড ডেভেলপমেন্ট -২০০৬ইং)

Share:

Leave Your Comment