তাসাওফ ও তরীক্বতের গুরুত্ব

তাসাওফ ও তরীক্বতের গুরুত্ব

মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভী

তাসাউফ
ইলমে তাসাওফ বা সুফীবাদ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ‘তাসাওফ’ তথা তরীক্বত চর্চা ও অনুশীলন করে মানবজাতি বাস্তব জীবনে ইসলামের প্রকৃত শান্তি উপলব্ধি করতে পারে। তাসাওফ ও তরীক্বত ভিত্তিক জীবন গঠন মানব জাতির ইহকালীন শান্তি, পরকালীন কল্যাণ ও মুক্তি নিশ্চিত করতে পারে। ‘তাসাওফ’ ও ‘তরীক্বত চর্চা’ ইসলামের নতুন কোন বিষয় নয় এবং তাসাওফ হচ্ছে ইসলামের প্রকৃত নির্যাস বা প্রাণ, ইসলামের মূলধারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আদর্শবিরোধী বাতিল অপশক্তিগুলো ইসলামের এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিতে বিলুপ্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে আসছে। ইসলাম বিদ্বেষী ও ইসলাম বিকৃতিকারীদের তাসাউফ ও তরীক্বত বিরোধী অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির কারণে একশ্রেণীর আধুনিক শিক্ষিত মুসলমানরাও তাসাওফ ও তরীক্বত চর্চার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছে অথবা এ ব্যাপারে উদাসীন হয়ে আছে। তাসাওফ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও ধারণা না থাকার কারণেই তারা এ ঐশী জ্ঞানের সংযোগ ও অলৌকিক শক্তির সুপ্রভাব বঞ্চিত হয়ে আসছে। তাসাওফ চর্চা মানুষকে সত্যিকার অর্থে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের যোগ্য প্রতিনিধি হিসেবে গড়ে তোলে। তাসাওফ ও তরীক্বত বর্ণিত ইসলাম প্রাণহীন ও ফ্যাকাশে। নৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের এ ক্রান্তিকালে তাসাওফ চর্চা ও তরীক্বতের শিক্ষা অনুসরণেই মুক্তির পথ সুগম হওয়া নিশ্চিত। উন্নত চরিত্র গঠনের লক্ষ্যে তাসাওফ শাস্ত্র এক নিয়ামক শক্তি।

‘তাসাওফ’ (تصوف) শব্দের বিশ্লেষণ
‘তাসাওফ’ (تصوف) শব্দটি আরবী। এর উৎস মূল নিয়ে বিভিন্ন অভিমত পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলেছেন, এটা صوف (সূফ) শব্দ থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ পশম। এ অর্থে ‘সূফী’ বলতে এমন ব্যক্তিকে বুঝায়, যিনি পার্থিব জগতের লোভ-লালসা ও আরাম-আয়েশ ত্যাগের নিদর্শন স্বরূপ পশমী কাপড় বা পোষাক পরিধান করেন। অবশ্য, আল্লামা ক্বোশায়রী বলেন, প্রকৃত সূফী হওয়ার জন্য এমনটি করা আবশ্যকীয় নয়। কারো কারো মতে تصوف শব্দটি صفا শব্দ থেকে নেয়া হয়েছে। এর অর্থ পরিচ্ছন্নতা, পবিত্রতা। এ অর্থে সূফী সাধকরা হচ্ছেন পবিত্র-পরিচ্ছন্ন চরিত্রের অধিকারী। কারো কারো মতে, শব্দটি صف (সফ) থেকে উৎকলিত। এর অর্থ কাতার বা সারি। এ অর্থে সূফীরা হচ্ছেন মর্যাদাসম্পন্ন প্রথম কাতারের মানুষ । কেউ কেউ বলেছেন, ‘সূফী শব্দটি সুফ্ফাহ্ থেকে গৃহীত। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সময়ে মসজিদে নবভী শরীফের একপাশে কিছু সাহাবী-ই রসূল সার্বক্ষণিকভাবে অবস্থান করতেন, যাঁরা ‘আসহাবে সুফ্ফা’ নামে পরিচিত। ইসলামের ইতিহাসে এখান থেকেই সুফীবাদ শব্দটির উৎপত্তি বলে তাঁদের ধারণা। কেননা, সুফীগণও এ ধরনের সাধনার মাধ্যমে পবিত্র আত্মার অধিকারী।
উল্লেখ্য, ‘সূফী’ ‘সুফ্ফা’ থেকে নির্গত হওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়- প্রায় সত্তরজন সাহাবী, যাঁরা মসজিদে নববীতে এক প্রকোষ্ঠে অবস্থান করতেন, রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁদের দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতেন।
ড. আর.এ. নিকলসন সূফী দর্শনের সমালোচক পন্ডিত, তিনি ‘সূফী’ শব্দটিকে সো ফিস্ট (ঝড়ঢ়যরংঃ) (আরবী سوف) থেকে নির্গত বলে মনে করেন। سوف (সূফ) অর্থ জ্ঞান আর سوفى মানে জ্ঞানী। سوف থেকে পরিবর্তিত হয়ে সূফী (صوفى) হচ্ছে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ জ্ঞানের আধার।
কিন্তু তরীক্বতপন্থী ও আরিফ বান্দাদের মতে, গ্রীক দার্শনিকদের সাথে ইসলামের সূফীদের কোন সম্পর্ক নেই। সুতরাং এ সম্পর্কে ওলামা-মাশাইখ, সূফীগণের অভিমত নি¤œরূপঃ

ওলামা মাশা-ইখ ও সূফীগণের দৃষ্টিতে তাসাওফ
যেহেতু তাসাওফ ও সূফীদের প্রকৃত পরিচিতি নির্ণয়ে ওলামা-মাশা-ইখ ও সূফীগণের বিভিন্ন মতামত পরিলক্ষিত হলেও নি¤œলিখিত কতিপয় মতামত থেকে উল্লেখযোগ্য তাসাওফ ও সূফীর সংজ্ঞা নির্ণয় করা যায়-
১. আধ্যাত্মিক জগতের মহান দিকপাল অলীকুল স¤্রাট হযরত শায়খ আবদুল কাদের জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাসাওফ সম্পর্কে বলেছেন-
اَلتَّصَوُّفُ اَرْبَعَةُ اَحْرُفٍ تَاءٌ وَصَادٌ وَوَاءٌ وَفَآءٌ ـ فَالتَّآءُ مِنَ التَّوْبَةِ وَهُوَ عَلى وَجْهَيْنِ تَوْبَةُ الظَّاهِرِ وَتَوْبَةُ الْبَاطِنِ ـ وَالصَّادُ مِنَ الصَّفَا وَهُوَ اَيْضًا عَلٰى وَجْهَيْنِ صَفَآءُ الْقَلْبِ وَصَفَاءُ السِّرِّ فَصَفَاءُ الْقَلْبِ اَنْ يَصْفِىَ قَلْبُه مِنَ الْكُدُوْرَاتِ الْبَشَرِيَّةِ مِثْلُ الْعَلاَئِقِ الَّتِىْ تُحْصَلُ فِى الْقَلْبِ مِنْ كَثْرَةِ الْاَكْلِ وَالشَّرَبِ وَالْمَنَامِ وَالْكَلاَمِ وَالْمُلاَخَطَاتِ الدُّنْيَوِيَّةِ الخـ وَاَمَّا صَفَاءُ السِّرِّ فَهُوَ بِاَلْاِجْتِنَابِ عَمَّا سِوَى اللهِ تَعَالٰى ـ وَاَمَّا الْوَاوُ فَهُوَ مِنَ الْوَلاَيَةِ … الخـ وَنَتِيْجَةُ الْوِلاَيَةِ اَنْ يَّتَحَقَّقَ بِاَخْلاَقِ اللهِ تَبَارَكَ وَتَعَالٰى كَمَا قَالَ عَلَيْهِ الصَّلوةُ وَالسَّلاَمُ تَخَلَّقُوْا بِاَخْلاَقِ اللهِ تَعَالى ـ وَاَمَّا الْفَآءُ فَهُوَ الْفَنَآءُ فى اللهِ جَلَّ جَلاَلُهٗ فَاِذَا فَنَتْ صِفَاتُ الْشَرِيَّةِ تَبْقى صِفَاتُ الْاَحَدِيََّةِ وَهُوَ سُبْحَانَهٗ لاَ يَفْنٰى وَلاَ يَزُوْلُ فَبَقِىَ الْعَبْدُ الْفَانِىَ مَعَ الرَّبِّ الْبَاقِىْ وَمَرْضِيَاتِهٖ الخـ
অর্থাৎ تَصَوُّفٌ (তাসাউফ) শব্দটি হচ্ছে আরবী চারটি বর্ণের সমষ্টিঃ প্রথম বর্ণ ت (তা), দ্বিতীয় বর্ণ ص (সোয়াদ), তৃতীয় বর্ণ و (ওয়াও) এবং চতুর্থ বর্ণ ف (ফা)। প্রতিটি বর্ণ মাহাত্ম্য জ্ঞাপক। যেমন ‘তা’ বর্ণ تَوْبَة (তাওবাহ্) এর দিকে ইঙ্গিতবহ। ‘তাওবাহ্’ দু’ প্রকার- বাহ্যিক তাওবাহ্ ও অভ্যন্তরীণ তাওবাহ্; ص সোয়াদ বর্ণ দ্বারা صَفَا -এর দিকে ইঙ্গিত করা হয়। এর অর্থ পরিচ্ছন্নতা। এটিও দু’প্রকারঃ ক্বলবের পরিচ্ছন্নতা ও অভ্যন্তরীণ পরিচ্ছন্নতা। ক্বলব বা অন্তরের পরিচ্ছন্নতা হলো মানবীয় পঙ্কিলতা থেকে অন্তর পবিত্র হওয়া, যা সাধারণত মানুষের অন্তরে পাওয়া যায়, যেমন অধিক পানাহার, অধিক নিদ্রা, অধিক কথা বলা ও দুনিয়ার সাথে অধিক সংশ্লিষ্টতা ইত্যাদি। আর অভ্যন্তরীণ পরিচ্ছন্নতা হলো, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য সব কিছু থেকে অন্তরাত্মাকে মুক্ত রাখা। আর واو (ওয়াও) বর্ণ দ্বারা (বেলায়ত) ولاية বুঝায়। বেলায়তের সারকথা হলো, বান্দা নিজেকে আল্লাহ্র গুণে গুণান্বিত করা। যেমন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘‘তোমরা আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হও।’’ ‘তাসাওফ’ শব্দের সর্বশেষ বর্ণ فاء; এটা দ্বারা فَنَافِى اللهِ -এর দিকে ইঙ্গিত করা যায়। অর্থাৎ বান্দা নিজেকে আল্লাহ্তে বিলীন করে দেওয়া। যখন মানবীয় গুণ বিলীন হয়ে যায়, তখন খোদায়ী গুণ বিকশিত হয়। আল্লাহ্র সত্তায় বিলীনতা নেই। সুতরাং ধ্বংসশীল বান্দা চিরন্তন সত্তার সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি বিধানে স্থায়িত্ব অর্জন করতে পারে।
২. হযরত মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে হুসাইন ইবনে আবূ তালিব রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি হতে বর্ণিত,
اَلتَّصَوُّفُ خُلُقٌ فَمَنْ زَادَ عَلَيْكَ فِى الْخُلُقِ زَادَ ০عَلَيْكَ فِى التَصَوُّفِ
অর্থাৎ ‘তাসাওফ’ অনুপম সুন্দর চরিত্রের নাম। যাঁর চরিত্র যত বেশী সৌন্দর্যমন্ডিত, তিনি তাসাওফের ততবেশি উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন হবেন।
৩. হযরত আবুল হুসাইন আননূরী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন,
اَلتَّصَوُّفُ تَرْكُ النَّفْسِ جُمْلَةً
অর্থাৎ সমষ্টিগতভাবে আত্মার কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ পরিত্যাগ করার নামই তাসাওফ।
৪. শায়খ আবুল হাসান রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন,
لَيْسَ التَّصَوُّفُ رُسُوْمًا وَلاَ عُلُوْمًا وَلٰكِنَّهٗ اَخْلاَقٌ
অর্থাৎ তাসাওফ নিছক প্রথাগত বিদ্যা ও কেবল একটি শাস্ত্রের নাম নয়; বরং চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনের নাম তাসাওফ।
৫. হযরত দাতাগঞ্জ বখশ মাখদুম আলী হাজভিরী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির প্রণীত বিখ্যাত গ্রন্থ كشف المحجوب -এ হযরত শায়খ খিযরীর বর্ণনা ব্যক্ত করেন,
اَلتَّصَوُّفُ صَفَاءُ السِّرِ مِنْ كُدُوْرَةِ الْمُخَالَفَةِ
অর্থাৎ তাসাওফ হচ্ছে সির্র বা অভ্যন্তরকে সত্যের বিরোধিতার পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র ও মুক্ত রাখার নাম।
৬. শায়খুল ইসলাম যাকারিয়া আনসারী তাসাওফ প্রসঙ্গে বলেন,
اَلتَّصَوُّفُ هُوَ عِلْمٌ تُعْرَفُ بِهٖ اَحْوَالُ تَزْكِىَةِ النُّفُوْسِ وَتَصْفِيَةُ الْاَخْلاَقِ وَتَعْمِيْرُ الظَّاهِرِ وَالْبَاطِنِ لِنَيْلِ السَّعَادَةِ الْاَبَدِيَّةِ
অর্থাৎ ‘তাসাওফ’ এমন এক শাস্ত্রের নাম, যে শাস্ত্রের চর্চায় আত্মার পবিত্রতা, চারিত্রিক পরিশুদ্ধি, চিরস্থায়ী কল্যাণ ও সৌভাগ্য অর্জনের নিমিত্তে আন্তরিক ও বাহ্যিক উৎকর্ষ ও সংস্কার সাধনের জ্ঞান অর্জিত হয়।
৭. প্রখ্যাত সূফীসাধক হযরত ইমাম মা’রূফ কারখী (ওফাত ৮১৫খ্রি.)
اَلتَّصَوُّفُ هُوَ الْاَخْذُ بِالْحَقَآَئِقِ وَالْيَأْسُ مِمَّا فِىْ اَيْدِى الْخَلآَئِقِ
অর্থাৎ তাসাওফ হচ্ছে হাক্বীক্বত তথা সত্যকে গ্রহণ করা এবং মানুষের হাতে যা আছে, তা অর্জন থেকে বিমুখ হয়ে যাওয়া।
মানুষের পার্থিব অর্জন, যশ-খ্যাতি, লোভ লালসা, কামনা-বাসনা ধন সম্পদের প্রাচুর্য এবং বিলাস বহুল জীবন যাপনের মহড়া থেকে নিজকে পবিত্র ও মুক্ত রেখে সত্যের পথে, ন্যায়ের পথে, কল্যাণের পথে, হেদায়তের পথে এবং আল্লাহ্ ও স্বীয় রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সন্তুষ্টি বিধানের পথে নিজকে নিয়োজিত রাখাই তাসাওফের মূল শিক্ষা।
৮. সিলসিলা-ই আলিয়া ক্বাদেরিয়ার শায়খুল মাশা-ইখ সৈয়্যদুল আউলিয়া হযরত শায়খ আবদুল ক্বাদের জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাসাওফের পরিচয় ব্যক্ত করেন এভাবে-
اَلتَصَوُّفُ اَلصِّدْقُ مَعَ الْحَقِّ وَحُسْنُ الْخُلُقِ مَعَ الْخَلْقِ
অর্থাৎ তাসাওফ হচ্ছে আল্লাহর সাথে সত্যপরায়ণতা ও সৃষ্টির সাথে সুন্দর ও উত্তম আচরণ তথা আদর্শিক ব্যবহার করা।
মহান ¯্রষ্টার প্রতিটি সৃষ্টির প্রতি মার্জিত, কাক্সিক্ষত, সুন্দর ব্যবহার ও উত্তম আচরণ প্রদর্শন তাসাওফের অন্যতম শিক্ষা ও আদর্শ।

সূফীদের পরিচয়
ইসলামী পরিভাষায় ওই ব্যক্তিকে ‘সূফী’ বলা হয়, যিনি আল্লাহর নির্দেশিত ও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রদর্শিত পথে নিজকে উৎসর্গ করেছেন, আল্লাহ্ ও তাঁর প্রিয় হাবীবের প্রেম ও ভালবাসায় সর্বপ্রকার ইবাদতে নিজকে মগ্ন রাখেন, আল্লাহ্ ও রসূলের সন্তুষ্টি অর্জন ছাড়া পাার্থিব জীবনের ঐশ্বর্য ও প্রতিপত্তির প্রতি তাঁর কোন কামনা-বাসনা থাকেনা এবং সৃষ্টি জগতের সবকিছুই যিনি আল্লাহ্তে বিলীন করে দেন তিনিই প্রকৃত সূফী।
সূফীদের পরিচয় প্রদানে ওলামা- মাশা-ইখের কতিপয় সংজ্ঞা নি¤েœ বর্ণিত হলোঃ
১. হযরত বিশর হাফী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির মতে,
اَلصُّوْفِىُّ مَنْ صَفَا قَلْبُهٗ بِذِكْرِاللهِ
অর্থাৎ আল্লাহর যিকরের মাধ্যমে যিনি স্বীয় আত্মা পরিশুদ্ধ করে নেন, তিনিই সূফী।
২. হযরত যুন্নূন মিসরী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন,
اَلصُّوْفِىُّ هُمْ قَوْمٌ اٰثَرُوا اللهَ عَزَّوَجَلَّ عَلٰى كُلِّ شَئٍ
অর্থাৎ সূফী এমন এক শ্রেণীর বিশেষ বান্দা, যাঁরা জীবনের প্রত্যেক বস্তুর উপরে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ভালবাসাকে প্রাধান্য ও অগ্রাধিকার দেন।
৩. হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি (ওফাত ২৯৭) বলেন,
اَلصُّوْفِىُّ اَنْ يَتَخَصَّصَ اللهَ بِالصَّفَاءَ فَمَنْ اصْطَفٰى
مِنْ كُلِّ مَاسِوَىَ اللهِ فَهُوَ الصُّوْفِىُّ
অর্থাৎ পবিত্রতার সাথে নিজকে আল্লাহর জন্য নির্র্দিষ্ট করা এবং আল্লাহ্ ছাড়া সকল কিছুর প্রভাব থেকে নিজকে মুক্ত রেখে আল্লাহর জন্য যিনি মনোনীত হয়েছেন, তিনি সূফী।
৪. সূফীগণ আসহাবে সূফ্ফার অনুসারী। হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবা-ই কেরাম সাদাসিধে জীবন যাপনে অভ্যস্থ ছিলেন। সূফীরাও হচ্ছেন ওই পুণ্যাত্মা বান্দাদের পদাঙ্ক অনুসারী। শায়খ আবূ বকর ইবনে ইসহাক্ব বুখারী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন,
قَالَ قَوْمٌ اِنَّمَا سُمُّوْا صُوْفِىَّةً لِقُرْبِ اَوْ صَافِهِمْ مِنْ اَوْصَافِ اَهْلِ الصُّفَّةِ الَّذِيْنَ كَانُوْا عَلَى عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
অর্থাৎ একদল আলেম বলেন, সূফীদের ‘সূফী’ নামে নামকরণ এ অর্থে করা হয় যে, তাঁরা নিজ গুণাবলীতে আসহাবে সুফ্ফার নিকটবর্তী; যাঁরা রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে ছিলেন।
৫. গাউসুল আ’যম দস্তগীর শায়খ আবদুল ক্বাদির জীলানী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি সূফীর পরিচয় দিয়ে বলেন,
اَلصُّوْفِىُّ مَنْ كَانَ صَافِيًا مِّنْ اٰفَةٍ النَّفْسِ خَالِيًا مِنْ مَذْمُوْمَاتِهَا سَالِمًا لِحَمِيْدِ مَذَهِبٍ مُلاَزِمًا لِلْحَقَائِقِ غَيْرَ سَاكِنٍ قَلْبُهٗ اِلٰى اَحَدٍ مِّنَ الْخَلاَئِقِ
অর্থাৎ ‘সূফী’ ওই ব্যক্তি, যিনি কুপ্রবৃত্তির বিপদ থেকে পবিত্র থেকেছেন, নিন্দিত অপকর্ম থেকে মুক্ত, নিরাপদ প্রশংসিত পথে পরিচালিত সত্যকে অনিবার্যরূপে গ্রহণ করেছেন, সৃষ্টিরাজির কারো সাথে অন্তরের সংযোগ রাখেন না।
৬. সূফীগণ পশমের পোশাক পরিধান করেন। অর্থাৎ সূফীগণ অনাড়ম্বর সাদাসিধে জীবন যাপন করে থাকেন, বৈচিত্রময় পোষাকের চাকচিক্য তাঁরা এড়িয়ে চলেন। আবূ নসর আস্ র্সারাজ এ প্রসঙ্গে বলেন-
اَلصُّوْفِيَةُ نُسِبُوْا اِلى ظَاهِرِ اللُّبْسَةِ لِاَنَّ لُبْسَةَ الصُّوْفِ ودَأْبُ الْاَنْبِيَآءِ وَشِعَارُ الْاَوْلِيَاءِ وَالْاَصْفِيَاءِ
অর্থাৎ বাহ্যিক পোষাকের দিক দিয়েও সূফীগণকে সূফী বলা হয়। কারণ, পশমের কম্বল পরিধান করা নবীগণ, ওলীগণ ও সূফীগণের নিদর্শন বা প্রতীক।
৭. পূর্ববর্তী সূফীগণ ইলমে শরীয়তের ইমাম ছিলেন। আল্লামা ইবনুল জওযী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ৫০৮ হিজরিতে বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন, ৫৯৭ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। তিনি একাধারে মুফাস্সির, মুহাদ্দিস, ঐতিহাসিক সমালোচক ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় সহ¯্রাধিক গ্রন্থের প্রণেতা ছিলেন। তিনি সূফীবাদের একজন সূক্ষ্ম বিশ্লেষক হিসেবে একথা স্বীকার করেন যে,
وَمَا كَانَ الْمُتَقَدِّمُوْنَ فِى التَّصَوُّفِ اِلاَّ رُؤَسَآءُ
فِى الْقُرْانِ وَالْفِقْهِ وَالْحَدِىْثِ وَالتَّفْسِىْرِ
অর্থাৎ পূর্ববর্তী সূফীগণ ক্বোরআন, ফিক্বহ্ ও হাদীস এবং তাফসীরের ইমাম ছিলেন।
আজকের যুগে সূফী নামধারীদের অনেকে শর‘ঈ জ্ঞানশূন্য। যথারীতি শর‘ঈ জ্ঞানে পারদর্শী না হয়েও ‘আল্লামা’ ও ‘শাহ্সূফী’ উপাধি ধারণকারী অনেক ভন্ড প্রতারকও প্রতিনিয়ত সরলপ্রাণ মুসলিম সমাজকে বিভ্রান্ত করে যাচ্ছে। ইসলামবিরোধী শরীয়তবিরোধী, আউলিয়া-ই কেরামের আদর্শ ও চেতনাবিরোধী বিভিন্ন কর্মকান্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার পরও ‘শাহ্’ ‘সূফী’ লক্বব ধারণ করা প্রকৃত সূফীবাদ তথা সূফীয়া-ই কেরামের শিক্ষা ও আদর্শের প্রতি প্রতারণা ও প্রহসনের শামিল। এসব ভন্ড সূফীদের বেশভূষা দেখে সাধারণ মানুষ প্রতারিত হচ্ছে। এদের স্বরূপ উম্মোচন এবং এদের অশুভ তৎপরতা ও প্রতারণা থেকে দেশ জাতি ও মুসলিম মিল্লাতকে রক্ষা করা সকলের ঈমানী দায়িত্ব। এ প্রসঙ্গে হযরত ইয়াহ্ইয়া মু‘আয রাযী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন,
اِجْتَنِبْ صُحْبَةَ ثَلاَثَةِ اَصْنَافٍ مِنَ النَّاسِ ـ
اَلْعُلَمَآءِ الْغَافِليْنَ وَالْفُقَرَاءِ الْمُدَاهِنِيْنَ وَالْمُتَصَوِّفَةِ الْجَاهِلِيْنَ
অর্থাৎ তিনি প্রকার লোকের সংস্পর্শ থেকে বিরত থাকা অপহিরার্যঃ এক. অলস ও অমনোযোগী আলিম থেকে, দুই. প্রতারক পদলেহী তোষামোদকারী ফক্বীর থেকে এবং তিন. অজ্ঞ সূফী থেকে।

সূফীবাদের ক্রমবিকাশ
মহাগ্রন্থ ক্বোরআনুল করীম ও প্রিয়নবীর সুন্নাহ তথা হাদসি শরীফই সূফীবাদের উৎস। পবিত্র ক্বোরআনে এরশাদ হয়েছে-
قَدْ اَفْلَحَ مَنْ زَكّٰهَا وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسّٰهَا
অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজ আত্মাকে বিশুদ্ধ করেছে, সে সফলকাম হয়েছে আর যে একে কলুষিত করেছে, সে অকৃতকার্য হয়েছে।
এতে প্রমাণিত হয় যে, আত্মশুদ্ধি তথা তাসাওফ অর্জন ও চর্চা ব্যতীত কল্যাণ ও সফলতা আশা করা যায়না।
অসংখ্য হাদীস শরীফেও ইলমে তাসাওফ তথা বাতেনী বা আধ্যাত্মিক ইলমের কথা বর্ণিত হয়েছে।
হযরত হাসান বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন,
قَالَ اَلْعِلْمُ عِلْمَانِ فَعِلْمٌ فِى الْقَلْبِ فَذَالِكَ الْعِلْمُ النَّافِعُ
وَعِلْمٌ عَلَى اللِّسَانِ فَذَالِكَ حُجَّةُ اللهِ عَلٰى اِبْن اٰدمَ
অর্থাৎ ইলম দু’ প্রকার: অন্তরের ইল্ম, এটি উপকারী ইলম। মুখের ইলম এটি আদম সন্তানের উপর দলীল।
বর্ণিত হাদীসে অন্তর সম্পর্কিত ইলমই হলো তাসাওফ বা সূফীবাদ। এ প্রকার ইলমের অপর নাম ইলমে বাত্বিন। যেমন, হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত,
عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ حَفِظْتُ مِنْ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
وِعَئَُيْنِ فَاَمَّا اَحَدُهُمَا قَدْ بَيَّنْتُ فِيْكُمْ وَاَمَّا الْاٰخَرُ فَلَوْ بَيَّنْتُ فَقُطِعْ الْبَلْعُوْمُ
অর্থাৎ হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূল করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট থেকে দু’টি জ্ঞানের পাত্র সংরক্ষণ করেছি; এক প্রকার যাহেরী জ্ঞান, যা আমি তোমাদের মধ্যে বর্ণনা করেছি। অপরটি যদি আমি বর্ণনা করতাম, তাহলে আমার কণ্ঠনালী কেটে ফেলা হতো। এর অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক তত্ত্বই ইসলামে তাসাওফ নামে খ্যাত। যেমন সূরা কাহ্ফের বর্ণনায় হযরত মুসা আলায়হিস্ সালাম ও হযরত খাদ্বির আলায়হিস্ সালামের মধ্যে সংগঠিত ঘটনায় আধ্যাত্মিক জ্ঞানের প্রমাণ পাওয়া যায়।
ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই আল্লাহর সূফীবাদী পূণ্যাত্মা প্রিয় বান্দারা এ প্রকার ইলমের অধিকারী। এ প্রকারের ইল্মে তাসাওফের সূচনা হয় হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম থেকেই। তাসাওফের প্রথম শিক্ষক হলেন হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম। নবী প্রেরণের ধারাবাহিকতায় সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হলেন তাসাওফের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাদাতা।
সাহাবা-ই কেরাম থেকে যাহেরী ও বাতেনী ইলম অর্জন করে নিজেদেরকে ধন্য করেন। সাহাবা-ই কেরাম ও তাবে‘ঈদের যুগে তাসাওফ চর্চা অব্যাহত থাকলেও তাদেরকে সূফী নামে অভিহিত করা হতো না, দার্শনিক আল বেরুনীর মতে, ‘সূফী’ শব্দটি প্রথম কুফাবাসী আবূ হাশিম উসমান ইবনে শরীফ (ওফাত-১৬২ হিজরী, ৭৭৭ খ্রি.) থেকে শুরু হয়।
অন্যদের মতে, ‘সূফী’ নামটি প্রথম যুক্ত হয় হযরত জাবির ইবনে হাইয়্যান (ওফাত ১৬৪হি.) এর উপর। দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষভাগে ‘সূফী’ নামটি জন সাধারণে বিস্তার লাভ করে। এ সময়ের কতিপয় উল্লেখযোগ্য সূফীসাধক বিশেষভাবে স্মরণীয়- ১. হযরত হাসান আল বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু। তিনি হিজরি ২১ সালে ৬৪২ খৃস্টাব্দে মদীনা শরীফে জন্মগ্রহণ করেন। হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর খিলাফতকালে তিনি বসরায় গমন করেন। হিজরি ১১০ সালে এখানেই তিনি ইন্তিকাল করেন। এখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। ১২০ জন সাহাবীকে দেখার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছে, যাঁদের মধ্যে ৭০ জনই ছিলেন বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী মহান সাহাবী।
ইবরাহীম ইবনে ঈসা বলেন, আমি আখিরাতের চিন্তায় হাসান বসরীর চেয়ে অধিক চিন্তিত ও ক্রন্দনকারী আর কাউকে দেখিনি।
হযরত হাসান বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলতেন,
اِبْنَ اٰدَمَ بِعْ دُنْيَاكَ بِاٰخِرَتِكَ تَرَبَحْهُمَا جَمِيْعًا
وَلاَ تَبِعْ اخِرَتَكَ بِدُنْيَاكَ فَتَخْسِرَهُمَا جَميْعًا
অর্থাৎ হে মানব সন্তান! তুমি আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়া বিক্রি করে দাও। এতে তোমরা দু’টিই লাভ করতে পারবে। সাবধান, দুনিয়ার বিনিময়ে আখিরাতকে বিক্রি করো না। এতে দু’টিই হারাবে।
২. হযরত রাবেয়া বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা (ওফাত ১৫৮হি.)। হযরত রাবেয়া বসরী ছিলেন এক মহিয়সী রমণী। বর্ণিত আছে যে, এক সময় তিনি এক হাতে পানি এবং আরেক হাতে আগুন নিয়ে দৌঁড়ে যাচ্ছিলেন। জিজ্ঞেস করা হলো কেন দৌঁড়াচ্ছেন? তিনি বললেন ‘‘মানুষ দোযখের ভয়ে ইবাদত করে। আমি পানি দিয়ে দোযখকে নিভিয়ে দেবো। আর কিছু লোক জান্নাতের লোভে ইবাদত করে। এ জন্য আগুন দিয়ে জান্নাতকে জ্বালিয়ে দেবো।’’ বান্দা তার সব আমল যেন আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের সন্তুষ্টির জন্যই করে। এটাই একমাত্র সূফীতত্বের মূলকথা।
৩. হযরত ইমাম জা’ফর সাদিক (ওফাত ৭৬৫খ্রি.)
৪. হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম। (ওফাত ৭৭৭ খ্রি.)
৫. হযরত মা’রূফ কারখী (ওফাত ৮১৫ খ্রি.)
৬. হযরত ফুদ্বাইল ইবনে আয়ায (ওফাত ৭৯৪খ্রি.)
৭. হযরত দাঊদ আত্ তাঈ। (ওফাত ৭৮২খ্রি.)
৮. হযরত শফীক্ব আল বলখী। (ওফাত ৮১০খ্রি.)
৯. হযরত হারিস আল মুহাসিবি। (ওফাত ৮৫৭খ্রি.)
১০. সমকালীন সময়ে মিশরের অন্যতম সূফী সাধক ছিলেন হযরত আবুল ফয়য সওবান ইবনে ইব্রাহীম (প্রসিদ্ধ যুননূন আল মিসরী) হিসেবে। তিনি সূফীবাদে ‘মাক্বাম’ ও ‘হাল’ স্তর সম্পর্কিত ধারনার প্রবর্তন করেন।
১১. পারস্য দেশীয় সূফী মনসূর হাল্লাজ। (ওফাত ৯২২)। তিনি সূফী তত্বের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর মতে, মানব সত্তা ঐশী সত্বার সাথে একাকার হয়ে গেলে সাধক ব্যক্তিগত দ্রষ্টায় পরিণত হয়। তখনি বলে উঠেন ‘আনাল হক’ হযরত মনসূর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি নিজেই এ উক্তি করেছিলেন। তৎকালীন যাহেরী ইলমের অধিকারী এক শ্রেণীর আলেম তাঁকে অভিযুক্ত করেন।
১২. সূফী মতবাদের বিকাশে আধ্যাত্মিক সাধক হযরত মহিউদ্দিন ইবনুল আরাবী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি (ওফাত ১২৪১)। তিনি ছিলেন ‘ওয়াহ্দাতুল ওজূদ’-এর প্রবক্তা, যার সারকথা, আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্টির প্রতিটি অণুর মধ্যে প্রকাশিত হন। কবির ভাষায়-
وَفِىْ كُلِّ شَئٍ لَهٗ اٰيَةٌ تَدُلُّ عَلٰى اَنَّهٗ الْوَاحِدُ
অর্থাৎ বিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টির মাঝে তাঁর সত্তার নিদর্শন রয়েছে। ওই নিদর্শনই প্রমাণ করে যে, তিনি এক ও অদ্বিতীয়।
১৩. সূফীবাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধিকরণ ও দার্শনিক মাত্রায় সূফী তত্বের বাস্তবতা প্রতিষ্ঠায় হযরত ইমাম গায্যালী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি (১০৫৮-১১১১) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি হযরত জুনায়েদ বাগদাদী, হযরত বায়েযীদ বোস্তামী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিম (ওফাত ৮৭৪) ও হযরত শিবলী প্রমুখ সূফীর আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। তিনি সূফীবাদের সমর্থন ও প্রশংসা জ্ঞাপন এবং বিভ্রান্তির স্বরূপ উন্মোচন করেন। তিনি ‘আল মুনক্বিয মিানদ্ব্দ্বালাল’ ‘ভ্রান্তি থেকে মুক্তিদাতা’ পবিত্রতা নামে একটি মূল্যবান গ্রন্থও রচনা করেন।
সূফীবাদের গ্রহণযোগ্যতা সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে এবং এ ভাবধারাকে সর্বাধিক জনপ্রিয় করে তোলার লক্ষ্যে সাহিত্য রচনা ও কাব্য রচনার মাধ্যমে যাঁরা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে হযরত আবদুল করীম জীলী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি, হযরত মোল্লা জামী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি, হযরত শেখ সা’দী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি, হযরত ফরিদ উদ্দিন আত্তার রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি, আল্লামা জালাল উদ্দীন রুমী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি প্রমুখে ভূমিকা চির অম্লান হয়ে থাকবে।
—০—

।। দুই।।

ত্বরীক্বত 
ত্বরীক্বতের গুরুত্ব
طريقت (ত্বরিক্বত) শব্দটি طرق (ত্বুরুক) থেকে গৃহীত। এর আধিভানিক অর্থ পথ, রাস্তা, নির্দেশনা। আর পারিভাষিক অর্থ- পথ চলার নিয়ম-কানুন, বিধি-বিধান, আইন-কানূন, নিয়মাবলী, পদ্ধতি-প্রণালী, নির্দেশনা, নির্দেশিকা, দিশা-দিশারী প্রভৃতি। ইলমে মা’রিফাতপন্থীদের একটি পরিভাষা তরীক্বত। মা’রিফতের পরিভাষায় চারটি মূলনীতি সহকারে খোদাপ্রাপ্তির সাধনা করতে হয়। যথা-
১. শরীয়ত, ২. তরীক্বত, ৩. হাক্বীক্বত ও ৪. মা’রিফাত। খোলাফা-ই রাশেদীনের পরবর্তী যুগে সূফীবাদের বিস্তার ঘটলে আউলিয়া-ই কেরাম ও সূফীসাধকগণের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার প্রসারে বিভিন্ন তরীক্বার উদ্ভব ঘটে। হানাফী, শাফে‘ঈ, মালেকী ও হাম্বলী মাযহাবগুলো যেমনি ইলমে শরীয়তকে পরিপূর্ণতা দান করেছে, তরীক্বতগুলোও তেমনি ইলমে মা’রিফাতকে পূর্ণাঙ্গতা দান করেছে।

ক্বোরআন মজীদে ত্বরীক্বতের নির্দেশনা
আল্লাহর নির্দেশিত, প্রিয়নবীর প্রদর্শিত এবং সাহাবা-ই কেরামের অনুসৃত বিধিমালার যথার্থ অনুসরণের নাম তরীক্বত। যুগে যুগে আল্লাহর প্রিয় বান্দারা ক্বোরআন, সুন্নাহর আলোকে সৎপথের নির্দেশ দিয়ে মুক্তিকামী মানুষের পরিত্রাণের ব্যবস্থা করেছেন। তাঁরা অন্ধকার থেকে আলোর পথে পৌঁছার যে নিয়ম-পদ্ধতি ও দিক-নির্দেশনা দিয়ে গেছেন সেটাই তরীক্বত বা তরীক্বাহ্।
তরীক্বতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তরীক্বত অবলম্বণের অপরিহার্যতা প্রমাণে ক্বোরআন-সুন্নাহর নির্দেশনাই মূলভিত্তি। নি¤েœ এ প্রসঙ্গে কয়েকটি ক্বোরআনিক দলীল পেশ করা হলোঃ
তরীক্বতের মূলনীতি প্রসঙ্গে সূরা ফাতিহায় এরশাদ হয়েছে,
اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيْم ـ صِرَاطَ الَّذِىْنَ اَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ
তরজমা: (হে আল্লাহ!) আমাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করো, তাদেরই পথে, যাদেরকে তুমি অনুগ্রহ করেছো।
উপরোক্ত আয়াতের তাফসীর বা বিশদ বর্ণনায় নি¤েœাক্ত আয়াতে চার শ্রেণীর নি’মাত প্রাপ্ত বান্দাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করার শিক্ষা দিয়েছেন।
এরশাদ হয়েছে,
وَمَن يُّطِعِ اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَـٰئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ
عَلَيْهِم مِّنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَآءِ وَالصَّالِحِينَ ۚ
তরজমা: যারা আল্লাহ্ রসূলের আনুগত্য করে তারা ওইসব লোকের সাথে থাকবে, যাদের উপর আল্লাহ্ অনুগ্রহ করেছেন, অর্থাৎ নবীগণ সত্যনিষ্ঠগণ, শহীদগণ এবং সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তিগণ।
আল্লাহর মনোনীত বুযুর্গনে দ্বীন সালেহীন পুণ্যাত্মাবান্দাদের অনুসরণের কথা ক্বোরআনুল করীমের বহু স্থানে নির্দেশ করা হয়েছে।
মহান আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ ﴿١١٩﴾
তরজমা: হে মু’মিনগণ, আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গ অবলম্বন করো।
আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের জীবনাদর্শ বিশ্বমানবজাতির জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে এ শ্রেণীর প্রিয় বান্দাদের পদাঙ্ক অনুসরণের কথা পবিত্র ক্বোরআনে বহু স্থানে বিঘোষিত হয়েছে।
এরশাদ হয়েছে-
وَابْتَغِ سَبِيْلَ مَنْ اَنَابَ اِلَىَّ
তরজমা: যে ব্যক্তি আমার দিকে রুজু’ করেছে, তার পথকে অনুসরণ করো।
উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে রূহুল বয়ানে উল্লেখ করা হয়েছে,
اَلْوَصُوْلُ لاَ يَحْصِلُ اِلاَّ بِالْوَسِيْلَةِ وَهِىَ عُلَمَآءُ الْحَقِيْقَةِ وَمَشَائِخُ الطَّرِيْقَةِ
অর্থাৎ ওসীলা ব্যতীত আল্লাহ্ তা‘আলার নৈকট্য অর্জন করা যায়না। ওসীলা হচ্ছেন হক্কানী ওলামা-ই কেরাম ও ত্বরীক্বতপন্থী মাশায়েখ বা কামিল পীর মুর্শিদগণ। সত্যিকার তরীক্বতপন্থী দ্বীনের অনুসারী মুত্তাক্বী পরহেযগার বান্দারা হচ্ছেন হিদায়তপ্রাপ্ত। তরীক্বতের আদর্শ শিক্ষাচ্যুত বান্দা গোমরাহ্ বা পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত।
আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেন,
مَنْ يَّهْدِ اللهُ فَهُوَ الْمُهْتَدُ وَمَنْ يُّضْلِلْ فَلَنْ تَجِدَ لَهٗ وَلِىًّا مُّرْشِدًا
তরজমা: আল্লাহ্ পাক যাকে হিদায়ত করেন, সে হিদায়ত পায় এবং যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার জন্য কোন ওলী (কামিল), মুর্শিদ পাবেনা।
ঈমান আক্বীদার হিফাযতের জন্য সকল মুজতাহিদ ইমাম কামিল পীর মুর্শিদের পদাঙ্ক অনুসরণকে অপরিহার্য মনে করেছেন। হুযূর গাউসুল আ’যম শায়খ আবদুল ক্বাদির জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু প্রণীত ‘সিররুল আসরার’ কিতাবে উল্লেখ করেন,
وَلِذَالِكَ طَلَبُ اَهْلِ التَّلْقِيْنِ لِحَيَاةِ الْقُلُوْبِ فَرْضٌ
অর্থাৎ অন্তরাত্মাকে যিন্দা করার জন্য আহলে তালক্বীন তথা কামিল মুর্শিদের শরণাপন্ন হওয়া অত্যাবশ্যক।
ইমামুল আইম্মাহ্, কাশফুল গুম্মাহ্ হানাফী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইমাম-ই আ’যম আবূ হানীফা রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন,
لَوْلاَ ثِِنْتَانِ لَهَلَكَ نُعْمَانُ
অর্থাৎ আমি (আবূ হানীফা) যদি আমার পীর-মুর্শিদ ইমাম জা’ফর সাদেক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর নিকট বায়আত গ্রহণপূর্বক তাঁর সান্নিধ্যে দু’বছর না থাকতাম, তবে আমি ধ্বংস হয়ে যেতাম।
হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গায্যালী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি প্রণীত ‘কীমিয়া-ই সা‘আদাত’ গ্রন্থে, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি প্রণীত ‘মাকতূবাত শরীফ’-এ সৈয়্যদুল আউলিয়া হযরত ইমাম আহমদ কবীর রেফা‘ঈ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি প্রণীত ‘আল বুনিয়ানুল মুশাইয়্যাদ’ গ্রন্থে আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা ফাযেলে বেরলভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি প্রণিত ‘নাক্বাউস সুলাক্বাহ্ ফী আহকামিল বায়‘আত ওয়াল খিলাফাহ’ (১৩১৯হি.) গ্রন্থে ইলমে তাসাওফ অর্জন তথা পীর-মুর্শিদের বায়‘আত গ্রহণ করাকে অপরিহার্য বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
এ ক্ষেত্রে বিখ্যাত সুফী সাধক আল্লামা জালালুদ্দিন রুমী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ও তাঁর পীর মুর্শিদ হযরত শামসুদ্দীন তাবরীযির ঘটনা প্রণিধানযোগ্য। মাওলানা রুমী বলেন,
مولانا هرگزنشد ملائےروم ـ تاغلام شمس تبريز نشد
অর্থাৎ আমি মাওলানা রুম মাওলানা রুমী হতে পারতাম না, যদি না আমার পীর শামসে তাবরীযের গোলামী করতাম।
এ কারণে যতবড় জ্ঞানী হোক না কেন, শর‘ঈ জ্ঞানের পাশাপাশি তরীক্বত তথা তাসাওফের জ্ঞান না থাকলে গোমরাহ্ তথা পথভ্রষ্ট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
হযরত ইমাম মালিক রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি প্রনীত ‘মু‘আত্তা’য় এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন,
مَنْ تَفَقَّهَ وَلَمْ يَتَصَوَّفْ فَقَدْ تَفَسَّقَ وَمَنْ تَصَوَّفَ
وَلَمْ يَتَفَقَّهُ فَقَدْ تَزَنْدَقَ وَمَنْ جَمَعَ بَيْنَهُمَا فَقَدْ تَحَقَّقَ
অর্থাৎ যে ব্যক্তি ইলমে ফিক্বহ তথা শর‘ঈ জ্ঞান অর্জন করলো এবং ইলমে তাসাওফ তথা তরীক্বতের জ্ঞান অর্জন করলো না, সে ফাসিক্ব হলো, যে ব্যক্তি ইলমে তাসাওফ অর্জন করল অথচ ইলমে ফিক্বহ অর্জন করলো না সে যিন্দীক্ব হলো। আর যে ব্যক্তি উভয় প্রকার ইল্ম অর্জন করল, সে প্রকৃত সত্যের সন্ধান লাভ করলো।

প্রসিদ্ধ তরীক্বাসমূহ
বিশ্বব্যাপী ইসলামী আদর্শ শিক্ষা ও নৈতিকতার উৎকর্ষ সাধনে বিভিন্ন তরীক্বার ভূমিকা ও অবদান অপরিসীম। ইসলামী গবেষকদের পরিবেশিত তথ্য অনুসারে এ পর্যন্ত বিশ্বে ৩১৩ টি তরীক্বার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তন্মধ্যে ১১০টি তরীক্বা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে দ্বীনী আখলাক্ব সৃষ্টি ও আলোকিত মানুষ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। উপমহাদেশে ১০/১২টি তরীক্বা বিস্তার লাভ করেছে। এর মধ্যে ৪টি তরীক্বা প্রধান। যথা- ক্বাদেরীয়া, চিশতীয়া, নক্বশবন্দিয়া ও মুজাদ্দেদিয়াহ্। অন্যান্য তরীক্বাগুলোকে বর্ণিত প্রসিদ্ধ চারটি তরীক্বার শাখা-প্রশাখা বা সমন্বয় বলা হয়। এ চারটি তরীক্বা ৪০০ হিজরীর শেষে এবং ৫০০ হিজরীর প্রারম্ভে মুসলিম বিশ্বের নানাস্থানে বিশেষত পাক-ভারত উপমহাদেশে, মুসলমানদের রুহানী জগতে যে ইনকিলাব তথা বিপ্লব সাধন করেছে, তা ইতিহাসের এক স্বর্ণালী অধ্যায়। এ প্রসিদ্ধ চার তরীক্বার মধ্যে ক্বাদেরীয়াহ্ তরীক্বাহ্ হচ্ছে সবচেয়ে প্রাচীন তরীক্বাহ্। হযরত শায়খ সৈয়্যদ আবদুল ক্বাদির জীলানী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এ তরীক্বার প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর নামানুসারে এ তরীক্বাহ্“সিলসিলা-এ আলীয়া ক্বাদেরীয়া’ নামে বিশ্বব্যাপী প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। তিনি ৪৭০ মতান্তরে ৪৭১ হিজরীর ১লা রমযান (২৯ শা’বান দিবাগত রাত) মোতাবেক ১০৭৮ খ্রিস্টাব্দে আল্লাহর শতসহ¯্র ওলীর স্মৃতি বিজড়িত পুণ্যভূমি জীলান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বুযুর্গ পিতার নাম সাইয়্যেদ আবূ সালেহ মূসা জঙ্গী দোস্ত। মাতার নাম হযরত সাইয়্যেদাহ্ ফাতেমা বিনতে সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ্ সাওমা‘ঈ যাহেদ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিম আজমাঈন। ইসলামের এ মহান সাধক ওলীকুল স¤্রাট হযরত আবদুল ক্বাদির জীলানী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ৫৬১ হিজরি সনে ১১ রবিউস্ সানী সোমবার ৯১ বছর বয়সে পুণ্যভূমি বাগদাদে ইন্তিক্বাল করেন।

চিশতিয়া তরীক্বা
হযরত খাজা মু‘ঈনুদ্দিন চিশতী আজমিরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি হলেন চিশতিয়া তরীক্বার অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ৫৩৭ হিজরী মোতাবেক ১১৪২ খ্রিস্টাব্দে সীস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি পাক-ভারতে আসেন। ৬৩৩ হিজরি মোতাবেক ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে আজমীরে ইন্তেকাল করেন। চিশতিয়া তরীক্বাহ্ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, চীন আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের কতিপয় দেশে বিস্তার লাভ করে এবং নানা শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে বিশ্বে বহু দেশে প্রচলিত আছে।
খাজা-এ খাজেগান আতা-এ রসূল হযরত খাজা গরীব-নাওয়ায মঈন উদ্দীন চিশতী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি চৌহান বংশীয় রাজা পৃথ্বিরাজের সকল চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে ভারতবর্ষে কলেমার আওয়াজ বুলন্দ করেন। মূলতঃ হযরত গরীব নাওয়াযের বরকতময় হাতেই ভারতে ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। কালক্রমে গরীব-নাওয়াযের ভাবাদর্শে উজ্জীবিত সৈনিকদের নিরলস প্রচেষ্টায় এ উপমহাদেশে ইসলামের বিজয়-নিশান উড্ডীন হয়েছে। সুলতান ইলতুৎমিশের যুগে বিখ্যাত সূফী সাধক খাজা ক্বুত্বুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি, সুলতান আলা উদ্দীনের যুগে হযরত খাজা নিযাম উদ্দীন আউলিয়া রাহমাতুল্লাহি, তা‘আলা আলায়হি ফিরোজ শাহ্ তুঘলক্বের শাসনামলে হযরত নাসীর উদ্দিন মাহমূদ চেরাগ দেহলভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি স¤্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে বিশ্ববিখ্যাত আধ্যাত্মিক সাধক হযরত মোজাদ্দিদ আলফেসানী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি, স¤্রাট আওরঙ্গ যেবের যুগে বিশ্ববিখ্যাত আলিমে দ্বীন মোল্লা জীবন রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি প্রমুখ জাতির ক্রান্তিকালে ইসলামী তাহযীব-তমুদ্দুন, সভ্যতা ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার কাজে যে কোরবানী বা ত্যাগের নযীরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
চিশতিয়া তরীক্বার অনুসারীদের মতে, প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র শিক্ষা ও আদর্শ হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর মাধ্যমে হযরত হাসান বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু লাভ করেন। এ তা’লীম রূহানীভাবে হযরত খাজা ওসমান হারওয়ানী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি পর্যন্ত চলে আসে। খাজা মুঈন উদ্দীন চিশতী গরীব নাওয়ায তাঁর খলীফা হিসেবে এ তরীক্বার নিয়ম-পদ্ধতি সুবিন্যস্তরূপে বিধিবদ্ধ ও সুনিয়ন্ত্রিত করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর খলীফাগণও তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে অসাধারণ অবদান রাখেন।

নক্বশবন্দিয়া তরীক্বা
নক্বশবন্দিয়া তরীক্বার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হযরত শায়খ খাজা বাহাউদ্দিন ইবনে মাহমূদ বোখারী। তিনি ৭১৮ হিজরী সনে মধ্য এশিয়ার বোখারায় জন্ম গ্রহণ করেন। ১৮ বছর বয়সেই তিনি সূফীত্বের দীক্ষা লাভ করেন। জনশ্রুতি আছে যে, তিনি যখন কামালিয়াতের উচ্চ মার্গে অবস্থান করেন, তখন তিনি যেদিকে থাকাতেন সেদিকেই শুধু ‘আল্লাহ্’ নামের চিত্ররূপ দেখতে পেতেন। অথবা তিনি যেদিকেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন, সেদিকেই ‘আল্লাহ’ নামের নক্বশা অঙ্কিত হয়ে যেত। সে কারণেই তিনি ইতিহাসে ‘বাহাউদ্দিন নক্বশবন্দ’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। তিনি ৭৯১ হিজরিতে ইন্তেক্বাল করেন। এ তরীক্বার গুরুত্বপূর্ণ তা’লীম হলো, ছয় লতীফার উপর সাধনা করা ও প্রতিক্রিয়া ঘটানো। লত্বীফাগুলো হলো, ক্বলব, রুহ, নাফ্স, সির, খফী ও আখফা।
এ তরীক্বার অনুসারীগণ মনে করেন, মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমীরুল মু’মিনীন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে যে গুপ্ত ইল্ম দান করেছিলেন, তা এ তরীক্বার শায়খগণের ধারাবাহিকতায় পৃথিবীতে বিদ্যমান রয়েছে।
নক্বশবন্দিয়া তরীক্বার অনুসারী ও সূফীগণ ইসলামী শরীয়তের নির্দেশনাবলীর প্রতি একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও মনযোগ সহকারে অধিকতর মনোনিবেশ করে থাকেন। তরীক্বতের বিভিন্ন ওযীফা, মোরাক্বাবা ও যিকরের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও আত্মার উৎকর্ষ সাধনে সচেষ্ট থাকেন। খাজা বাহাউদ্দিন নক্বশন্দ এ তরীক্বার তা’লীমকে সুসংবদ্ধ, সুবিন্যস্ত ও সুনিয়ন্ত্রিত করেন। এ তরীক্বার শীষ্যরা ‘আল্লাহ’ নামের বরকতময় ইসমটির নক্বশা বা চিত্র হৃদয়ে ধারণ করেন বলেই এ তরীক্বার নাম নক্বশবন্দীয়া তরীক্বা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে।

মুজাদ্দেদিয়া তরীক্বা
হযরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী ওরফে হযরত শায়খ আহমদ ফারুক্বী সেরহিন্দি রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি মুজাদ্দেদীয়া তরীক্বার প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ৯৭১ হিজরীতে ভারতবর্ষের সেরহিন্দ নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ভারতীয় মহাদেশে যখন খোদাদ্রোহী, নবীদ্রোহী, তাগুতি ও কুফরিশক্তির প্রভাবে সর্বত্র কুফর শির্ক, বিদ্‘আত, অত্যাচার, অবিচার, যুল্ম, নির্যাতন, শোষণ-নিপীড়ন, কুসংস্কার, ইসলামবিরোধী শরীয়তবিরোধী নানাধরনের কর্মকান্ড সর্বত্র ছেয়ে গিয়েছিল, ইসলামের এমনি এক ক্রান্তিকালে গণমানুষকে মুক্ত করার লক্ষ্যে এবং সর্বত্র ইসলামের সুমহান আদর্শ ও সুশিক্ষার বাণী পৌঁছিয়ে দেয়ার প্রয়াসে তাঁর নিরবচ্ছিন্ন কর্মপ্রচেষ্টা। ইসলামে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছে। তাঁর বেলায়ত ও মাকালাতের খোদাপ্রদত্ত শক্তির প্রভাবে, সর্বপ্রকার কুফর শির্ক ও বিদ্‘আতের বিরুদ্ধে প্রাণপণ সংগ্রাম করে ইসলামের নিস্কলুষ ভাবধারা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
স¤্রাট আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত তথাকথিত ‘দ্বীন-ই ইলাহী’র মূলমন্ত্র ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আকবর খলীফাতুল্লাহ্’ ইসলামের বিরুদ্ধে এক সুগভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখা দেয়। এর কালো মেঘে যখন ভারতবর্ষ আচ্ছাদিত হচ্ছিল, তখনই ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফে সানী তখন পূর্ণ বেলায়তী শক্তি দিয়ে আকবরের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, ইসলামের নামে বিকৃতি ও ষড়যন্ত্রের সকল বিষদাঁত ভেঙ্গে দেন। ইসলামের মূলমন্ত্র কলেমার সুমহান বাণী ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্’র দাবী ও আবেদন শ্রেষ্ঠত্ব ও মহানত্বকে পূর্ণমাত্রায় প্রতিষ্ঠিত করেন। এ ছাড়াও তিনি উলঙ্গপনা, বেহায়াপনা, নাচ-গান ইত্যাদি কুসংস্কারপূর্ণ অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধেও কঠোর সংগ্রাম চালিয়ে যান। ইসলামের আধ্যাত্মিক জেহাদের এই কঠিন সংগ্রামে তিনি সকল প্রকার বাতিল শক্তিকে পরাভূত করেন। ইসলামী ঝান্ডাকে সমুন্নত করেন। ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। সেই ধারাবাহিকতায় এ তরীক্বার শায়খগণ আজও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে মানবজাতির চরিত্র গঠনে ও আত্মার সংশোধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।

ভারতীয় উপমহাদেশে ক্বাদেরিয়া তরীক্বার প্রচার-প্রসার
বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার-প্রসারে ক্বাদেরিয়া তরীক্বার সূফীসাধক ও মাশা-ইখের ভূমিকা ও অবদান অগ্রগণ্য। বিশেষতঃ ভারতীয় উপমহাদেশে ক্বাদেরীয়া তরীক্বার শায়খগণের অক্লান্ত সাধনার বদৌলতে ইসলামের যে সম্প্রসারণ ও বিস্তার ঘটেছে, তা ইতিহাসের এক স্মরণীয় অধ্যায়। ঐতিহাসিকদের পরিবেশিত তথ্যমতে, প্রখ্যাত ওলীয়ে কামেল হযরত আবদুল করীম ইবনে ইব্রাহীম আলজীলী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ক্বাদেরীয়া তরীক্বার প্রসার ঘটে। ১৩৮৮ খৃস্টাব্দে তিনি ভারত উপমহাদেশে আগমন করেন। উল্লেখ্য যে, এ সময়েরও অনেক পূর্বে বাবা আদম শহীদ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ১১৪২ খৃস্টাব্দে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে ১২ জনের আরবীয় বণিক কাফেলাসহ জাহাজযোগে চট্টগ্রাম আগমন করেন। তিনি বাংলাদেশের মহাস্থানগড়ে ক্বাদেরীয়া তরীক্বার প্রচার-প্রসার কল্পে খানক্বাহ্ প্রতিষ্ঠা করেন। রাজা বল্লাল সেনের সাথে তাঁর সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে বাবা আদম বিক্রমপুরে শাহাদত বরণ করেন। একইভাবে গাউসুল আ’যম জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর রূহানী নির্দেশক্রমে এ দেশে তিনি ইসলাম প্রচারে অসাধারণ অবদান রেখেছেন, তিনিও ক্বাদেরীয়া তরীক্বার অন্যতম মহান শায়খ। হযরত শাহ্ মাখদূম রোপোশ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি রাজশাহীর বৃহত্তম অঞ্চলে ১১৮৪ খৃস্টাব্দে ইসলাম প্রচার করেন। ৬১৫ হিজরীর ২ রজব তিনি বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন।
হুযূর গাউসে পাকের ২৭ পুত্রের একজন হলেন হযরত আযাল্লাহ শাহ্ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি। হযরত আযাল্লাহ্ শাহ্ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির ২য় পুত্র হলেন হযরত শাহ্ মাখদূম রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি। এ হিসেবে তিনি ওলীকুল স¤্রাট গাউসুল আযম দস্তগীরের প্রিয়তম পৌত্র তথা নাতি। এ ছাড়া হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি রচিত তাফসীরে নইমীর সূরা আন‘আম-এর তাফসীরের এক পর্যায়ে ভারতবর্ষে ক্বাদেরিয়া তরীক্বার প্রচারক হিসেবে হযরত সৈয়্যদ কবির উদ্দিন দুল্হা দরিয়ায়ী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির নাম উল্লেখ করেন। তিনি আনুমানিক ১০৬১ হিজরি মোতাবেক ১৬৬৭ খৃস্টাব্দের দিকে পাঞ্জাবের গুজরাটে ইন্তেকাল করেন।
এক বর্ণনা মতে হযরত শাহ্ ক্বাসিম রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এতদঞ্চলে সর্বপ্রথম ক্বাদেরীয়া তরীক্বার প্রচারক ছিলেন। তিনি ছিলেন গাউসে বাগদাদের বংশধর। বাংলার মা’লার বা মালোরা নামক স্থানে তিনি ইন্তেক্বাল করেন। হযরত সৈয়্যদ আবদুর রায্যাক্ব রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ছিলেন তার প্রধান খলীফা। ক্বাদেরিয়া ত্বরীক্বার প্রচারে এ মহামনীষীর নামও উল্লেখযোগ্য।
এভাবে পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে অসংখ্য সূফী সাধক মাশা-ইখের অক্লান্ত ত্যাগ ও ক্বোরবানীর বদৌলতে সিলসিলাহর ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় ক্বাদেরিয়া তরীক্বা এতদঞ্চলে সর্বত্র দ্রুত প্রচার প্রসার ও বিস্তার লাভ করে।
এ তরীক্বার প্রচার-প্রসারে আরো যাঁদের নাম কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণীয়, তাঁদের অন্যতম হচ্ছেন- খাজায়ে খাজেগান খলীফায়ে শাহে জীলান গাউসে যমান ক্বুত্বুবে দাওরান, গুপ্ত রহস্যাবলীর অন্তর্দ্রষ্টা, মা’আরিফে লাদুন্নিয়ার প্র¯্রবণ হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ১২৬২ হিজরী মোতাবেক ১৮৪৩ খৃস্টাব্দে পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের এবোটাবাদ জেলার হরিপুরের চৌহর শরীফে প্রখ্যাত ওলীয়ে কামেল হযরত খাজা ফক্বীর মুহাম্মদ খিদ্বরী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি পবিত্র ঔরশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরই প্রধান খলীফা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র ৩৯তম বংশধর হযরত হাফেজ ক্বারী মাওলানা সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ছিলেন ক্বাদেরিয়া তরীক্বার একজন সফল প্রচারক। তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রচেষ্টায় ভারত, পাকিস্তান, বার্মা (মায়ানমার)সহ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অসংখ্য মাদরাসা, মক্তব, মসজিদ ও খানক্বাহ্ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশের এবোটাবাদ, শেতালু শরীফ সিরিকোট গ্রামের সৈয়্যদাবাদ শরীফের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে হযরত সৈয়্যদখানী যামান শাহ্ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির সাহেবজাদা হযরত সৈয়্যদ সদর শাহ্ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র ঔরশে ১২৭১/৭২ হিজরি মোতাবেক ১৮৫২ সালে ক্বত্ববুল আউলিয়া হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি জন্ম গ্রহণ করেন। তারই ঔরশে ১৩৩৬ হিজরী, মোতাবিক ১৯১৬ সনে জন্মগ্রহণ করেন মাতৃগর্ভের ওলী গাউসে যমান আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি।
তিনি ছিলেন প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র চল্লিশতম অধঃস্তন পুরুষ এবং আল্লামা সৈয়দ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির সাহেবযাদা। ১৯৯৩’র ৭ জুন ১৫ যিলহজ্ব ১৪১৩ হিজরী সোমবার সকাল ৯টায় এ মহান আধ্যাত্মিক সাধক পুরুষ ইন্তেকাল করেন।
১৯৭৭ সালে হুযূর কেবলা আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর দুই সাহেবযাদা মাখদূমে মিল্লাত রাহনুমায়ে শরীয়ত ও তরীক্বত আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ (মু.যি.আ.) ও রওনক্বে আহলে সুন্নাত রাহবরে মিল্লাত সাহেবযাদা আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ সাবির শাহ্ (মু.যি.আ.)কে সিলসিলায়ে আলিয়া ক্বাদেরিয়ার খিলাফত প্রদান করেন।
এ দু’ মহান দিক্পাল বর্তমানে কাদেরিয়া তরীক্বার প্রচার-প্রসার, শরীয়ত-তরীক্বত, মাযহাব-মিল্লাত তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মতাদর্শ বিস্তারে বিশ্বব্যাপী বহুমুখী খিদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে আউলিয়া কেরাম, সূফী সাধক, ওলামা-মাশায়েখ, হক্কানী, রব্বানী, আলেম-ওলামা ও মাশায়েখ-ই ‘ইযামের বিরামহীন প্রচেষ্টা ও সাধনার বদৌলতে নানা বাধা বিপত্তি প্রতিকূলতা প্রতিবন্ধকতা এবং প্রতিপক্ষের বিরোধিতা সত্ত্বেও তাঁদের ব্যবহারিক জীবনের আদর্শ, অনুপম শিক্ষা, চরিত্রমাধুর্য দিয়ে কলুষিত মানবাত্মাকে হিদায়তের পথে, কল্যাণের পথে, সত্যের পথে, মুক্তির পথে আহ্বান করে যাচ্ছেন। অসংখ্য দিশেহারা বিভ্রান্ত পথভ্রষ্ট মুক্তিকামী মানুষ আজ আউলিয়া-ই কেরাম ও মাশায়েখ-ই এযামের সান্নিধ্যে সিরাতুল মুস্তাক্বীম তথা ইসলামের সঠিক আক্বিদা-বিশ্বাস ও আমল-আখলাক্বের ভিত্তিতে নিজেদের জীবনকে পুণ্যময় ও আলোকিত করার সুযোগ লাভ করে ধন্য হচ্ছেন। মূলতঃ এঁদের কর্মময় জীবন আমাদের মুক্তির পাথেয়। তাঁদের জীবনাদর্শ অনুসরণ আমাদের উভয় জগতের নাজাতের ওসীলা।
আল্লাহ্ পাক তাঁদের পথে চলার তাওফীক্ব দান করুন। আ-মী-ন।

অধ্যক্ষ-মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল, হালিশহর, বন্দর, চট্টগ্রাম।
—০—