তাবলীগ জামাত ও তাদের ইজতিমার স্বরূপ – মাওলানা আবূ মাক্নূন ইসলামাবাদী (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

তাবলীগ জামাত ও তাদের ইজতিমার স্বরূপ – মাওলানা আবূ মাক্নূন ইসলামাবাদী (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

নবমত, প্রসঙ্গত সচেতন সুন্নী কর্ণধারবৃন্দের ঈমানী দায়িত্ব পালন ও দেওবন্দী-ওহাবীদের হঠকারিতা প্রসঙ্গে আলোচনা করার প্রয়াস পেলাম। ভারতে ওহাবী মতবাদ প্রচারের প্রাথমিক পর্যায়ে মৌলভী ইসমাঈল দেহলভী মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব নজদীর বিতর্কিত পুস্তক ‘কিতাবুত্ তাওহীদ’-এর ভাবানুবাদ ‘তাক্বভিয়াতুল ঈমান’ প্রকাশ করে বিশেষত ‘নবী করীমের সমক থাকা সম্ভব বলে প্রচার করে ‘খাতামুন্নাবীয়্যীন’ ইত্যাদি গুণাবলী দ্বারা গুণান্বিত আরো কেউ আত্মপ্রকাশ করাও সম্ভব বলে ফেললো, তখন আহলে সুন্নাতের ওলামা-ই কেরাম বিশেষ করে ‘খাতেমুল হুকামা’ আল্লামা মুহাম্মদ ফয্লে হক খায়রাবাদী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাদের ওই ভুল ও ঈমানবিধ্বংসী দৃষ্টিভঙ্গির খণ্ডন লিখিত ও মৌখিকভাবে করেছেন। তবুও না মৌং ইসমাঈল দেহলভী তার কথা প্রত্যাহার করেছেন, না ওহাবীরা এই ইসমাঈল দেহলভীকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
তাছাড়া, মীর্যা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানী ভণ্ড নুবূয়তের দাবিদার হয়ে মুরতাদ হল। মুসলমানরা একবাক্যে তাকে ধিক্কার দিল। এ দেশের সুন্নীদের সাথে ওহাবীরাও তাকে কাফির-মুরতাদ বলার েেত্র সুর মিলালো। তারা সেটাকে রাজনৈতিক ইস্যু করে ক্বাদিয়ানীদের অমুসলমান ঘোষণা করার দাবিও করেছে। অথচ ইতোপূর্বে তাদেরই মুরব্বী, দেওবন্দ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মৌং কাসেম নানুতভী সাহেব কোরআনী আয়াতের ‘খাতাম’ শব্দের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ‘আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরে কোন নবী আসলেও হুযূরের শেষনবী হবার মধ্যে অসুবিধা নেই’ বলে ফাত্ওয়া দিয়ে ওই গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানীর জন্য পথ খুলে দিয়েছেন। দেওবন্দী মুফতী মৌং রশীদ আহমদ গাঙ্গূহী ‘আল্লাহর পে মিথ্যা বলা সম্ভব’ বলে ফাতওয়া দেন। মৌং খলীল আহমদ আম্বেটভী হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জ্ঞান অপো শয়তান ও মালাকুল মাওতের জ্ঞান বেশি বলে তাঁর কিতাবে লিখেছেন। (দু’জায়গায়) উল্লেখ করা হয়েছে যে, দেওবন্দী ও তাবলীগীদের হাকীমুল উম্মত মৌং আশরাফ আলী থানভী হুযূর করীমের জ্ঞানকে গৃহপালিত পশু, শিশু ও পাগলের জ্ঞানের সাথে তুলনা করেছেন। বস্তুত এসব মন্তব্য যে, যথাক্রমে আল্লাহ্ ও তাঁর হাবীবের শানে জঘন্য বেয়াদবী হবার কারণে নিশ্চিত ‘কুফর’ -তা বিবেকবান মাত্রই বলতে পারেন।
ইমামে আহলে সুন্নাত, মুজাদ্দিদে মিল্লাত, শাহ-ই বেরেলী ইমাম আহমদ রেযা খান রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাদের ওই সব মন্তব্য ও আক্বীদা গভীরভাবে পর্যালোচনা করেছেন। শতাধিক বিষয়ের বিশারদ, সহস্রাধিক গ্রন্থ-পুস্তকের রচয়িতা, অদ্বিতীয় ফিক্ব্হশাস্ত্রবিদ আ’লা হযরতের দৃষ্টিতেও ওইসব মন্তব্য নিশ্চিত ‘কুফর’ বলে সাব্যস্ত হলে তিনি প্রত্যেকের নিকট জবাব চেয়ে চিঠি লিখেছেন। দীর্ঘদিন তাদেরকে সুযোগ দিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের প থেকে কোনরূপ জবাব কিংবা অনুশোচনা-প্রত্যাহারের মনোভাব না পেয়ে, বরং হঠকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ১৩২০ হিজরিতে ‘আল্-মু’তামাদ আল্-মুন্তাক্বাদ’ প্রণয়ন করে- মীর্যা ক্বাদিয়ানী, মৌং কাসেম নানুতভী, মৌং রশীদ আহমদ গাঙ্গূহী, মৌং খলীল আহমদ আম্বেটভী এবং মৌং আশরাফ আলী থানভীর উপর, ওই সব মন্তব্যের ভিত্তিতে কুফরের ফাতওয়া আরোপ করলেন। (এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রণীত হয়- ‘আল্-মু’তামাদ আল্-মুস্তানাদ’ নামে।)
আমি আবারো জোরালোভাবে বলতে পারি যে, বস্তুত আ’লা হযরতের এ ফাতওয়া দেওবন্দী আলিমদের বিরুদ্ধে কোন ব্যক্তিগত মনগড়া ভিত্তিতে ছিল না, বরং নিরেট আল্লাহ্ ও তাঁর নবীর মর্যাদা রার খাতিরেই ছিল। দ্বীন ইসলামের পবিত্রতা ও সত্যতাকে সমুন্নত রাখার েেত্র তিনি তাঁর ঈমানী দায়িত্বই পালন করেছেন। অতঃপর ১৩২৪ হিজরিতে আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর উপরোক্ত কিতাব থেকে উল্লিখিত ব্যক্তিদের উপর আরোপিত ফাতওয়ার অংশখানা ‘হেরমাঈন শরীফাঈন’-এর ওলামা কেরামের নিকট পেশ করলেন। যার উপর উভয় হেরমের ৩৩জন আলিম তাঁদের জোরালো সমর্থনসূচক মন্তব্য লিপিবদ্ধ করেছেন। এ ফাতওয়া ও ওইসব মন্তব্য সহকারে ১৩২৪ হিজরিতেই ‘হুসামুল হেরমাঈন ‘আলা মানহারিল কুফরি ওয়াল মায়ন’ (কুফর ও মিথ্যার গ্রীবাদেশে হেরমাঈন শরীফাঈনের শানিত তরবারী) নামে প্রকাশ করা হয়েছে। ওই কিতাব এখনো বিদ্যমান। বাংলায়ও অনূদিত এবং প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ওই ব্যক্তিরা আত্মশুদ্ধির পথ অবলম্বন করেন নি।
উল্লেখ্য, পরবর্তীতে মৌং হুসাইন আহমদ টাণ্ডভী ও মৌং মুরতাদ্বা হাসান দরভঙ্গীর মত দেওবন্দী আলিমগণও স্বীকার করেছেন যে, যারা আল্লাহ্ ও তাঁর নবীর শানে এহেন বেআদবীপূর্ণ মন্তব্য করে তারা যে কোন অবস্থাতেই কাফির না হয়ে পারে না। আর ইমাম আহমদ রেযাও তাদের ওই সব কুফরিপূর্ণ মন্তব্য দেখে তাদের উপর কুফরের ফাত্ওয়া আরোপ করে শুধু তাঁর ঈমানী দায়িত্বই পালন করেন নি, বরং তা না করলে তিনি নিজেও কাফির হয়ে যেতেন। কারণ কুফরকে সমর্থন করা এবং কুফর মনে না করাও কুফর। [আশ্-শিহাবুস্ সাক্বিব ইত্যাদি দ্রষ্টব্য] সুতরাং দেওবন্দী ওহাবী-তাবলীগীদের যেখানে ওইসব কুফরী বক্তব্য, আক্বীদা এবং এমন বক্তব্য ওই আক্বীদাসম্পন্নদের প্রত্যাখ্যান ও বর্জন করা উচিত ছিল, সেখানে তাদেরকে মুরব্বী ও অনুকরণীয় হিসেবে গ্রহণ ও বরণ করে তাদেরই তথাকথিত শিার প্রসার ও প্রতিষ্ঠার জন্য ‘তাবলীগের ছয় উসূল’ কায়েম করেছে, জামাতবন্দী হয়েছে, বিশাল ‘ইজতিমা’ ইত্যাদি করেছে, কায়েম করছে কওমী ধাঁচের মাদরাসার পর মাদরাসা, প্রতিষ্ঠানের পর প্রতিষ্ঠান, অপরদিকে আ’লা হযরত ও সুন্নী মুসলমানদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সুন্নী মতাদর্শকেই অবলম্বণ করার পরিবর্তে তাঁদের প্রতি উল্টো মিথ্যা অপবাদ দিলে কিংবা তাদের বিরুদ্ধে নানা প্রপাগাণ্ডা ও চক্রান্ত করলে তাদের সম্পর্কে মন্তব্যও নি®প্রয়োজন বৈ-কি।
দশমত, সর্বোপরি টঙ্গীর ইজতিমায় সফর করে যাওয়া তাদের মুরব্বীর ফাত্ওয়া অনুযায়ীও হারাম এবং অবৈধ কাজ। কারণ, ‘তাবলীগ জামাত’-এর উৎসপুরুষ হলেন মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব নজদী। এ ইবনে আবদুল ওহাবের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গুরু হলেন ইবনে তাইমিয়্যাহ্। দেওবন্দী আলিমগণও ইবনে তাইমিয়্যার চিন্তাধারার সমর্থক। ইবনে তাইমিয়্যার মতে, তিন মসজিদ ব্যতীত অন্য কোথাও এমনকি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বরকতময় যিয়ারতের উদ্দেশেও সফর করা যাবে না। তারই অনুসরণে মৌং আবদুর রহীম ওহাবী তার ‘সুন্নাত ও বিদ‘আত’-এ লিখেছেন হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যিয়ারতের উদ্দেশে সফর করা যাবেনা, যেতে চাইলে মসজিদে নববীর যিয়ারত বা তা’তে নামায পড়ার উদ্দেশ্যেই যেতে হবে। ওহাবীপন্থী মি.মওদূদী-ওহাবী প্রমুখ খাজা গরীব নাওয়ায ও হযরত সালার-ই মাস‘ঊদের মাযারে যাওয়াকে জঘন্য পাপ বলে ফাতওয়া দিয়েছে। অথচ নবী পাকের রওযা-ই পাকের যিয়ারত সম্পর্কে হাদীস শরীফে বহু ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, পবিত্র ক্বোরআনে হুযূরের দরবারে যাওয়ার মহা উপকার এরশাদ হয়েছে। বিশ্বের ইমামগণ পর্যন্ত নবী পাক এবং ওলীগণের রওযা ও মাযার শরীফে যিয়ারতের উদ্দেশে সফর করেছেন। কিন্তু টঙ্গীর উদ্দেশে সফর করার, তাতে হাজীদের মত অবস্থান করার এবং তাদের চিল্লাগুলোয় যোগদান করে জামাতবন্দী হয়ে ওহাবিয়াত প্রচার করার পে শরীয়তের কোন প্রমাণ তো নেইই; বরং উল্টো তাদের মুরব্বীদের ফাত্ওয়ায় কঠোরভাবে নিষেধই পাওয়া যায়। সহীহ হাদীস শরীফে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এহেন ভ্রান্তদের প্রসঙ্গেই এরশাদ ফরমায়েছেন, “ইয়্যা-কুম ওয়া ইয়্যা-হুম” (তোমরা তাদের কাছে যেওনা, তাদেরকেও তোমাদের কাছে আসতে দিও না)। অথচ এ ইজতিমা আসলে তাবলীগীরা তো আছেই, তাদের সঙ্গে সরলপ্রাণ মুসলমানগণ জরুরি কাজ-কর্ম বাদ দিয়ে ওদিকে ধাবিত হয়। অফিস-আদালত, এমনকি হাসপাতাল-কিনিকের কাজকর্ম পর্যন্ত ব্যাহত হয়। সরকারকে ব্যস্ত থাকতে হয় তাদেরকে সামাল দিতে ইত্যাদি। রেল কর্তৃপ ঠিকমত ভাড়াও পায় না।
পরিশেষে, কারো নিছক বাহ্যিক অবস্থা দেখে ভুলে না গিয়ে তার মূল ও প্রকৃত অবস্থার খোঁজ-খবর নিয়ে পা বাড়ানোই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। অন্যথায়, মহাতির সম্মুখীন হওয়া অনিবার্য। উপরিউক্ত বর্ণনা থেকে এ কথা সুস্পষ্ট হল যে, তাবলীগ জামাত ও তাদের ইজতিমার বাহ্যিকরূপ যা-ই হোক না কেন, তাদের মূল হচ্ছে ওহাবী-খারেজীর মতবাদ অনুসরণ। তাদের আসল উদ্দেশ্যই হচ্ছে এ দেশে ভ্রান্তি ওহাবী মতবাদ প্রচার করা। এ মতবাদ সুন্নী মতাদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত। তাই তাদের ইজতিমা ও মুনাজাতেরও কোন গুরুত্ব থাকার কথা নয়। আক্বীদা ও উদ্দেশ্য বিশুদ্ধ না হলে আল্লাহর দরবারে কোন আমলের গুরুত্বই নেই।
তাই এ ওহাবী তাবলীগ জামাত ও তাদের ইজতিমাকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন ও প্রত্যাখ্যান করার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
ইসলামে তাবলীগ বা অমুসলমানদের নিকট ধর্মপ্রচার এবং তা’লীম বা দ্বীনের বিষয়াদির শিক্ষদানের গুরুত্ব আছে। সুতরাং এ তাবলীগ ও তা’লীমের প্রসার উভয় জগতের কল্যাণ তখনই বয়ে আনবে যদি ইসলামের সঠিক রূপরেখা (সুন্নী মতাদর্শ)-এর প্রচারণা ও শিক্ষা দেওয়া হয়। আসুন! আমরা যেন সবসময় সুন্নী মতাদর্শের উপরই অটল থাকতে পারি। আল্লাহ্ পাক তাওফীক্ব দিন; আ-মী-ন্।
তাবলীগ সমাচার
প্রচলিত ছয় উসূলী তাবলীগ জামাত যে ওহাবী সম্প্রদায়ের একটি শাখা, চরমপন্থী বাতিল দল ও গোমরাহ্ ফেরকা তা এখন সুস্পষ্ট। তারা সৌদী আরবের মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদীর অনুসারী। ভারতের দেওবন্দ মাদরাসা ওই ওহাবী মতবাদের অন্যতম শিা প্রতিষ্ঠান। উক্ত দেওবন্দ মাদরাসায় শিাপ্রাপ্ত দিল্লীর মৌং ইলিয়াস মেওয়াতী সাহেব স্বপ্নের মাধ্যমে প্রচলিত ছয় উসূলী তাবলীগ জামাত ও চিল্লা-গাশতের নিয়ম পদ্ধতির প্রচলন করেন।
‘মলফুজাতে ইলিয়াস’’- ৫০ পৃ. (উর্দু) -এ উল্লেখ করা হয়েছে- ‘‘আপনে ফরমায়া কেহ ইস্ তাবলীগ কা তরীক্বা ভী মুঝ পর খাব মে মুনকাশাফ হুয়া।’’ অর্থাৎ মৌং ইলিয়াছ সাহেব বলেন, ‘‘প্রচলিত তাবলীগ জামাতের নিয়ম-পদ্ধতিও আমি স্বপ্নের মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়েছি।’’ সুতরাং বুঝা গেল যে, এটা ক্বোরআন-সুন্নাহ ও ইজমা-কিয়াস সম্মত নয়; বরং মৌং ইলিয়াস সাহেবের কথায়ও প্রমাণিত হলো যে, প্রচলিত ছয় উছুলী তাবলীগ জামায়াতের মূল উৎস হচ্ছে মৌং ইলিয়াসের স্বপ্ন। ইলিয়াস সাহেব আরো বলেন, ‘‘কুনতুম খাইরা উম্মাতিন উখরিজাত লিন্নাসি তা’মুরু-না বিল মারূফে ওয়া তানহওনা ‘আনিল মুনকারে ওয়া তু’মিনূ-না বিল্লাহ’ কী তাফসীর খাব মে ইয়ে এলক্বা হুয়ী কেহ্ ‘‘তোম মিছলে আম্বিয়া আলাহিমুস্ সাল্লামকে লোগোঁকে ওয়াস্তে জাহের কিয়ে গেয়ে হো।’’ ‘‘মালফুজাতে ইলিয়াস’’ ৫০ পৃ. (উর্দু)। অর্থাৎ মৌং ইলিয়াস সাহেব বললেন, ‘‘কুনতুম খাইরা উম্মাতিন’’ এ আয়াতের তাফসীর স্বপ্নযোগে আমার উপর এভাবে ইলক্বা (এলহাম) হয়, ‘‘হে ইলিয়াস, তুমি নবীদের ‘মতই’ মানুষের জন্য প্রেরিত হয়েছো।’’ এখানে ‘মিসলে আম্বিয়া’ দ্বারা মৌং ইলিয়াস সাহেব পূর্ণ নুবূয়তের দাবি করেছেন। কারণ আরবীতে ‘মিসল’ শব্দটি পূর্ণাঙ্গ সমকতা বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। তাই মৌং ইলিয়াস ‘মিসলে আম্বিয়া’ অর্থাৎ নবীগণের সমক হওয়ার দাবি করেছেন, এটা কুফরীই (নাঊ‘যুবিল্লাহ)।
এ ছাড়া উর্দু মলফুযাতের ১২৫ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, মৌং ইলিয়াস বলেন, ‘‘আমি উত্তরাধিকার সূত্রে নুবূয়তের তোহ্ফা প্রাপ্ত হয়েছি।’’ (নাঊ‘যুুবিল্লাহ)। মৌং ইলিয়াস সাহেব নিজেই বলেন, ‘‘প্রচলিত তাবলীগ ও তার নিয়ম-পদ্ধতি আমি স্বপ্নে প্রাপ্ত হয়েছি।’’ এখানে জিজ্ঞাস্য হচ্ছে নবী ব্যতীত কারো স্বপ্ন নির্বিচারে শরীয়তের দলিল হতে পারে কি? স্বপ্নে মানুষ টাকা পায়, রাজা-বাদশা হয়, রেলগাড়ীতে চড়ে, বিবাহ্ করে, বোম্বাই-করাচী যায়, মিষ্টি খায়। জাগ্রত হলে সবই শূন্য হয়ে যায়। সাধারণ মানুষকে শয়তানও স্বপ্ন দেখিয়ে থাকে।
মৌং ইলিয়াসের স্বপ্ন যে শয়তানী নয় তার গ্যারান্টি কি? মনে করুন- স্বপ্নে এক ব্যক্তি বিবাহ্ করল। পর দিন এ স্বপ্নের ভিত্তিতে সে ওই মহিলাকে তার সম্মতিতে আক্বদ পড়ানো ছাড়া তার স্ত্রী বলে দাবী করে ঘরে আনতে পারবে কি? মোটেও পারবে না। যেহেতু স্বপ্ন শরীয়ত নয়, সেহেতু শরীয়তের দৃষ্টিতে এ বিবাহ্ ভিত্তিহীন বলে গণ্য হবে। স্বপ্নে কেউ তার স্ত্রীকে তালাক দিলেও তালাক হবে না। কারণ সাধারণ মানুষের স্বপ্ন শরীয়ত নয়। স্বপ্নে বিবাহ্ ও তালাক শরীয়তের দৃষ্টিতে বাতিল। কেননা একমাত্র নবীগণের স্বপ্ন ব্যতীত অন্য কারো স্বপ্ন দ্বারা শরীয়তের কোন হুকুম প্রতিষ্ঠিত হয় না। তাই কি করে ইলিয়াস সাহেবের স্বপ্নের তাবলীগ শরীয়ত সম্মত হবে?
উপরন্তু এরা বলে থাকে যে, প্রচলিত তাবলীগ ‘‘নারী পুরুষ প্রত্যেকের উপর ফরযে আইন।’’ দেখুন ‘দাওয়াতে তাবলীগ’ ২য় খণ্ড ৩৭ পৃ., লেখক মাওঃ আম্বর আলী’’ তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা তাবলীগকে শুধু আলিমদের জন্য খাছ করে দিয়েছি। অথচ, তাবলীগ প্রত্যেকের উপর ফরযে আইন।’’ তিনি যদি প্রচলিত তাবলীগ জামাতের কথা বুঝান আর প্রচলিত তাবলীগ যদি প্রত্যেকের উপর ‘ফরযে আইন’ বলে গণ্য হয়, তবে ইলিয়াস সাহেবের তাবলীগ যারা করেনি, বা করেন না, যেমন মুজতাহিদ, মুজাদ্দিদ, গাউছ-কুতুব, ইমাম, ফোক্বাহা, আউলিয়ায়ে কেরাম ও দুনিয়ার সুন্নী মুসলমানগণ, এই ছয় উসূলী তাবলীগ না করে এবং চিল্লা-গাশ্ত ও টঙ্গী ইজমেতায় যোগদান না করে তথাকথিত ফরযে আইন তরক করে গিয়েছেন, তাঁদের কি উপায় হবে? মোটকথা, পবিত্র কোরআন ও হাদীস শরীফে কোথাও এই ছয় উসূলী তাবলীগের প্রমাণ নেই। প্রচলিত তাবলীগ কেবলমাত্র ইলিয়াস সাহেবের স্বপ্ন ও তার মনগড়া।
দেখুন- ‘‘তাবলীগের পথে’’ ২৪ পৃ., লেখক মাওলানা বছির উদ্দিন, ২য় সংস্করণ ১৯৬০ইং। ‘‘মৌং ইলিয়াস-এর প্রবর্তিত তাবলীগের নিয়ম সম্পর্কে তার কৃত মলফুযাত কিতাবে বলেন, ‘‘এই তাবলীগের নিয়ম আমার উপর স্বপ্নে প্রদত্ত হইয়াছে, খোদা তা‘আলার এরশাদ- ‘কুনতুম খাইরা উম্মাতিন- এর পরিপ্রেেিত এই হুকুম হইল- হে ইলিয়াছ তুমি পয়গাম্বরদের মতই মানুষের জন্য প্রেরিত হইয়াছ।’’ (না‘ঊযু বিল্লাহ!)
তাবলীগ ওয়ালারা নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকেও মুসলমান জানে না। এজন্যই মুসলমানদের নিকট কলেমার দাওয়াত নিয়ে আসে। [সূত্র. মলফুজাতে ইলিয়াছ ৪৬ পৃ. (উর্দু)] ‘‘মুসলমান দুহি কিসিমকে হো সেকতে হ্যাঁয়, তেস্রি কুই কিসিম নেঁিহ। ইয়া আল্লাহকে রাস্তে মে খোদ নিকলনে ওয়ালে হো, ইয়া নিকলনে ওয়ালূঁ কো মদদ করণে ওয়ালা হো। অর্থাৎ মুসলমান দুই প্রকারই হতে পারে, ৩য় প্রকারের কোন মুসলমান নেই। ১. যারা নিজে আল্লাহর রাস্তায় (চিল্লা করতে বের হয়ে যায়,) এবং ২. যারা এদেরকে সাহায্য করে। মৌং ইলিয়াসের ফাত্ওয়ানুসারে তাবলীগী নয় এমন কেউই মুসলমান নয়। কারণ অনেকেই তাবলীগের চিল্লায় যায় না, যারা যায় তাদের সাহায্যও করে না। ইলিয়াস সাহেবের পূর্ববর্তী জামানায় কেউই তো এই ছয় উসূলী তাবলীগের চিল্লা-গাশ্ত ও টঙ্গী ইজতেমায় যোগদান করেননি। তাহলে তারা কি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত নন? (নাঊযুবিল্লাহি মিন যালিকা) মৌং ইলিয়াসের বাপ-দাদাগণও তো প্রচলিত তাবলীগের চিল্লা ও ইজতেমায় যোগ দেয়নি, উক্ত ফাত্ওয়ার ভিত্তিতে তাদের কি উপায় হবে?
এরা ১৪শ’ বছর পূর্বের মদীনার ইসলামকে কয়েকযুগ পূর্বের দিল্লীর স্বপ্নের ইসলাম দ্বারা বদলে ফেলেছে। দেখুন, ‘‘আল আছর’’, কৃত. মাওলানা হাছান আলী, সাং ও পোঃ বেলাব, রায়পুরা, ঢাকা। সে লিখেছে- ‘‘আজকাল আমাদের ব্যবস্থা দিয়া নবী ‘ছাহেবের’(!) ব্যবস্থা বদল করা হইয়াছে।’’ (নাউযুবিল্লা মিন যালিক)। উক্ত ুদ্র পুস্তিকার ৩য় পৃ. সে আরো লিখেছে, ওয়াজ ও মাদরাসা দ্বারা নাস তৈয়ার হয় আর তাবলীগের জামায়াতে রূহ তৈয়ার হয় শুধু নাস দ্বারা সত্যিকার প্রচার বাকী থাকবে এবং জাহান্নামে যাইতেই হইবে। (নাঊযুবিল্লাহ্)
উক্ত লেখক জোর দিয়ে বলেন যারা তাবলীগের মাধ্যমে সত্যিকার প্রচার করবে না, তাদেরকে জাহান্নামে যেতেই হবে। আমার প্রশ্ন, যারা এই তাবলীগের জামানা পাননি তারা সকলেই কি জাহান্নামী? (না‘ঊযুবিল্লাহ) ইসলাম ধর্মের ‘বেনা’ (উসূল) হলো ৫টি। যথাঃ কলেমা, নামাজ, রোজা, যাকাত ও হজ্ব। মৌং ইলিয়াস এই পঞ্চ বেনা ভেঙ্গে মনগড়া ছয় উসূল গড়ে নিয়েছেন। যথা: কলেমা, নামাজ, একরামূল মুছলেমীন, এলেম ও জিকির, তাসহীহে নিয়ত* ও নফর ফি সাবীলিল্লাহ্ বা তাবলীগ। ইসলামের পঞ্চবেনা সবগুলোই ফরজ। যে কোন একটিকে অস্বীকার করলে কাফের হয়ে যাবে। ফরয জেনে অবজ্ঞা করলে হবে ফাসিক। নবীয়ে দোজাহানের শরীয়তের উপর কারও কর্তৃত্ব চলে না। শরীয়তের হুকুমে বাড়ানো বা কমানো নবীর কাজ, এতে উম্মতের কোন অধিকার নেই। মৌং ইলিয়াস আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পঞ্চবেনা তোয়াক্কা না করে তার ইচ্ছামত ছয় উসূলী তাবলীগী ইসলাম বানিয়ে নিয়েছেন। তাবলীগওয়ালারা মুসলমানদের ধোঁকা দিয়ে বলে থাকে, এইগুলো ইসলামের বেনা নয়। এইগুলো তাবলীগের উসূল। তাবলীগ বা প্রচারের উসূলেই নামায ও রোযাকে নেওয়া হলে বাকী তিনটি বাদ দেয়া হলো কেন? মোটকথা, এভাবে তারা সরল প্রাণ মুসলমানদেরকে ধোঁকা দিয়ে থাকে।
মৌলভী ইলিয়াসের ছয় উসূলের মধ্যে একটি হচ্ছে- তাস্হীহে নিয়্যত, অর্থাৎ নিয়্যত শুদ্ধ করা। অথচ তার নিয়্যত শুদ্ধ নয়। কারণ, তাঁর উদ্দেশ্য ইসলাম প্রচার নয়; বরং নজদ থেকে আমদানী কৃত ভ্রান্ত ওহাবী মতবাদ প্রচার করা। যেমন, এ পুস্তিকার প্রথম অধ্যায়ে বলা হয়েছে। ওহাবী মতবাদ তথা কুফরী মতবাদ প্রচার তথা তাবলীগ তো হারামই। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে- মন্দের দিকে পথপ্রদর্শনকারীও তার মত অপরাধী।
তাবলীগ জামাতের মিথ্যাচার
ল্যণীয় যে, গায়েবের সংবাদাতা হায়াতুন্নবী ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন- আখেরী জানামায় মিথ্যাবাদী দাগাবাজ লোক বের হবে। তারা তোমাদের নিকট এমন মিথ্যা হাদীস নিয়ে আসবে, যা তোমরা ইতোপূর্বে কখনো শোননি; এমন কি তোমাদের বাপ-দাদাগণও শোনেনি। (মিশকাত শরীফ) তাবলীগীরা বলে- এক কদমে ৪০ বছরের পাপমোচন হয়, চিল্লায় এক রাকাতের নামাজ ৭ ল রাকাতের সমান। এক টাকা চিল্লায় খরচ করলে ৪৯ কোটি টাকার সওয়াব, পাওয়া যায়। টঙ্গীর ইজতেমা আরাফাত সমতুল্য ইত্যাদি। (নাউজুবিল্লাহ) এগুলোর সব ক’টি আশ্বাসই মিথ্যা ও বানোয়াট।
নজদী, ওহাবী, তাবলীগী জামাতিদের ভ্রান্ত আক্বিদা পোষণকারী কাঠ মোল্লাদের ভ্রান্ত ঈমান হরণকারী আহ্বান ও প্রচারণা থেকে নিজেদের ঈমান রা করুন এবং অপর মুসলমান ভাইদেরকেও ঈমান হারা হতে হেফাজত করুন।
ব্রিটিশ গোয়েন্দা মি. হাফ্রের ডায়েরী থেকে
আদিকাল থেকে ইহুদি এবং নাসারা ইসলামের চিরশত্র“। তাই ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রত্য ও পরোভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন থেকে গভীর ষড়যন্ত্র বলে আসছে এবং তাদের বহুমুখী নীল নকশা বাস্তবায়ন করে চলেছে। বিশ্বের সর্বত্র মুসলিম দেশসমূহে বিভিন্ন প্রকারের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সঙ্কট সৃষ্টি করে তারা গোলযোগ লাগিয়ে রেখেছে। ফলে মুসলিম সমাজে আত্মকলহও লেগেই আছে, আর মুসলমানদের কাঁধে নির্বিচারে চাপিয়ে দিচ্ছে এর দায়ভার। একদিকে সন্ত্রাস, বোমাবাজি, রক্তপাত, লুটপাট আর অমানুষিক বর্বরতা চলছে আর অপরদিকে তথাকথিত ইসলাম নামধারী সংগঠন, যেমন- খারেজী, রাফেযী, সালাফী, শিয়া, কাদিয়ানী, ওয়াহাবী (কওমী গোষ্ঠী), তাবলীগী, মওদুদী, আহলে হাদীস ইত্যাদি নামে বহু ভ্রান্ত মতবাদী ঈমান ধবংসকারী উপদল সৃষ্টি করে তারা প্রকৃত ইসলামের মূলধারা ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত’কে প্রতিপ করেছে। যেখানে তাফসীর ও হাদীস বিশারদ এবং ইসলামী আইনবীদ, নীতিনির্ধারক বা মাযহাবের ইমামগণের সর্বসম্মত ঐকমত্য হল প্রকৃত ইসলাম ও মুসলমানদের জান্নাতী সঠিক দলের নাম হচ্ছে ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত’, সাহাবা, তাবে‘ঈন, তাবয়ে তাবে‘ঈন এবং চার মাযহাবের ইমামগণ যেখানে যুগে যুগে ওই তাগূতি শক্তিকে পরাস্ত করার মধ্য দিয়ে বিশ্বের সর্বত্র ঈমান-ইসলামের প্রচার করে আসছেন, গাউস, কুতুব, আবদাল, কামেল পীর-আউলিয়া, হক্কানী সুন্নী আলেমগণ যেখানে এ দলের অনুসরণ করে থাকে, সেখানে উল্লিখিত ভ্রান্ত দলগুলো ইসলামের লেবেলে সরলপ্রাণ মুসলমানদের ঈমান, আমল ধবংস করে চলেছে। সাম্প্রতিককালে কোরআনী শাসন প্রতিষ্ঠা কিংবা ইসলামী জিহাদের নামে সর্বত্র বোমাবাজি, মাযারে ও ওরসে হামলা, মিলাদ ও জশনে জুলুসে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, আক্রমণ ইত্যাদি চলছে। লণীয় যে, এসব অপকর্মে যারা জড়িত এবং যারা এজন্য ফাঁিসতে ঝুলেছে, জেলখানায়ও বন্দী আছে, তাদের বেশীর ভাগ এ ওহাবী মতবাদী, তাবলীগ ও কওমী সমর্থক। আল-কাদেয়া নেতা উসামাও সৌদী-ওহাবী তথা একই মতবাদী।
সুন্নী মতাদর্শের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বাতিল দলগুলো ইসলামের নামে প্রকারান্তরে খ্রিস্টান-ইহুদিদের মিশন বাস্তবায়নে কাজ করছে। এমনকি খ্রিস্টান মিশনারীগুলোর সাথে দেখা যায় না এসব ওহাবীপন্থীদের কোন বিরোধ। তারা যেন, গোড়ায় কোথাও ঐকমত্যে পৌঁছে দু’ধারায় মানুষকে প্রতারণা করছে।
অনুরূপ চাঞ্চল্যকর ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে ভারতের লৌক্ষ্মস্থ ‘নদওয়াতুল ওলামা’ সম্পাদিত পাকি সাময়িকী ‘আমীর-ই হায়াত’ বিগত ২ এপ্রিল ১৯৯৮ ইংরেজী সংখ্যায় যা দৈনিক ইনকিলাবের বরাত দিয়ে ১৯২৮ আগস্ট ৯৮ ইংরেজী দৈনিক দিনকালে ‘মার্কিন দূতাবাসে হামলাকারীরা মুসলমান না অন্য কেউ’ শীর্ষক নিবন্ধে কলামিস্ট শাহাদাত হোসেন খানের উদ্ধৃতি থেকেও এমনটি জানা যায়। ঘটনাটি হচ্ছে এ রকম:
উত্তর প্রদেশের গভর্নর নওয়াব ছাতারি কোন এক কাজে ইংল্যান্ড যান। ব্রিটিশ সরকারের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল খুবই মধুর। তিনি পাকিস্তান ও ভারত কোন দেশের স্বাধীনতার পইে ছিলেন না। তাঁর এ ভূমিকার জন্য তিনি আলীগড়ের জমিদার থেকে উত্তর প্রদশের গভর্নর হন। লন্ডনে অবস্থানকালে তাঁর সঙ্গে সাাৎ করতে আসেন এক সময়ে ভারতে কর্মরত ছিলেন এমন একজন পরিচিত কালেক্টর। নওয়াব ছাতারি এ সাাতকালে তাঁকে নতুন কিছু দেখানোর অনুরোধ করেন। নওয়াব ছাতারির অনুরোধে ওই ব্রিটিশ কালেক্টর রাজি হন এবং তাঁকে নতুন কিছু দেখার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন।
এরপর একদিন তারা বের হন এবং এক সময় রাজধানী লন্ডনের উপকণ্ঠ ছাড়িয়ে যান। যেতে যেতে তাঁরা গিয়ে পৌঁছেন নির্জন বনভূমিতে। বিরাট এক ফটকের সামনে ব্রেক কষে গাড়ি থেকে নামলেন ইংরেজ কালেক্টর। তাঁকে অনুসরণ করলেন ছাতারি। ফটকের মধ্য দিয়ে কালেক্টর তাঁকে নিয়ে সামনে যেতে থাকেন। পথের দু’পাশে উঁচু দেয়াল। কাঁটাতারের দেয়াল ডিঙ্গিয়ে কারো পে বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। নির্জন বনভূমিতে এক সুড়ঙ্গ পথে থমথমে পরিবেশ। নওয়াব ছাতারি জানতে চাইলেন তাকে কোথায় নিয়ে আসা হয়েছে। কালেক্টর তাঁকে এখান থেকে বের হওয়া নাগাদ মুখ বন্ধ রাখতে বললেন। নিরুপায় নওয়াব ছাতারি চোখের সামনে দেখতে পেলেন এক অজানা জগৎ। আস্তে আস্তে একজন দু’জন করে কিছু লোকের আনাগোনা তিনি দেখতে পেলেন। আরবীয় জুব্বা ও টুপি পরিহিত লম্বা শশ্মধারী একজনকে দেখে তাঁর সঙ্গে তিনি কথা বলতে গেলেন, কিন্তু কালেক্টর তাঁকে থামিয়ে দিলেন। এ সময় তাঁর চোখের সামনে একটি লম্বা ঘর ভেসে ওঠল। তিনি দেখলেন ঘরের প্রত্যেক লোকই ইসলামী রীতিতে সালাম বিনিময় করছে, মুসাফাহা করছে। আশেপাশের প্রতিটি ক থেকে সুর করে আরবি পড়ার আওয়াজ আসছে। কোথাও হাদীস নিয়ে আলোচনা, কোথাও বা ইসলামী ইতিহাস নিয়ে। কোথাও ফিকহ্-উসূল নিয়ে আলোচনা। কোন কিছুই বাদ যাচ্ছে না। এমন একটা ইসলামী পরিবেশে এসে নওয়াব ছাতারির প্রাণটা শান্তিতে ভরে গেল, তবে তাঁর মন থেকে খটকা দূর হল না। এ ইসলামী প্রতিষ্ঠানটি এ জনমানবহীন সুড়ঙ্গ পথে কেন? বেশ কিছুণ ঘুরে ফিরে সব দেখার পর তিনি সেখান থেকে বিদায় নেন। পথে গাড়িতে কালেক্টরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘ভাই, তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিলে?’’ তখন তাঁকে কালেক্টর জানালেন যে, তাঁকে যা দেখানো হয়েছে তা কোন মক্তব বা মাদরাসা নয়, ব্রিটিশ গোয়েন্দা প্রশিণ কেন্দ্র। তিনি আরও জানালেন যে, এখান থেকে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা কোরআন-হাদীস, ইসলামী ইতিহাস ও সভ্যতা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। এসব প্রশিণপ্রাপ্ত গোয়েন্দারা মুসলমানের ছদ্মবেশে মুসলিম সমাজে বিভ্রান্তি ও অশান্তির বীজ বপন করে এবং অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করে ইসলামকে শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছে নিন্দনীয় করে তোলে।
এরা সেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, যারা আরববাসীদের সাথে অহেতুক যুদ্ধে জড়িয়ে দিয়ে পবিত্র হেজাজের পাহারাদার তুর্কিদেরকে আরবের ভূ-খণ্ড থেকে চিরদিনের জন্য বিতাড়িত করে সেখানে নজদীদের পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করে দেয়। ফিলিস্তিনকে ধবংস করে ইসরাইলের গোড়াপত্তন করে দেয়। সৃষ্টি করে কাদিয়ানী ভ্রান্ত দল। সুদানে ‘মাহদীয়তের’ ফ্যাসাদ কায়েম করে। সেই ইংরেজরা মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাবকে নিজেদের এজেন্ট বানিয়ে অর্থবিত্ত ও সুন্দরী নারীর সঙ্গদান, যেনা, মদ্যপান, মুতা বিয়ে (চুক্তিভিত্তিক সাময়িক বিয়ে) ইত্যাদিতে আসক্ত করে এবং অস্ত্র ও জঙ্গি বাহিনীর সহযোগিতা দিয়ে হেজাজের মাটিতে এলোপাতাড়িভাবে মুসলমানদের উপর হত্যাযজ্ঞ ও অত্যাচার চালায়। এরপর সেখানে ওহাবী মাযহাব প্রতিষ্ঠা করে। সে সব চাঞ্চল্যকর বিস্তারিত ঘটনাবলী ব্রিটিশ গোয়েন্দা মি. হামফ্রে তার ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করেন। হামফ্রে আরবি, ফার্সিসহ ইসলামের পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করে। উক্ত ডায়েরি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিরা ‘ইস্পাগাল’ নামক তাদের মুখপত্রে ধারাবাহিকভাবে প্রচার করে ইসলামের বিরুদ্ধে ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন করে দেয়। ওই ডায়েরি লেবাননে আরবী ভাষায় অনূদিত হয়। অতঃপর পাকিস্তান ও ভারতে তা উর্দুতে ভাষান্তর হয়। ভারতের অনূদিত সংখ্যা থেকে কিছু উদ্ধৃত করা হল। মি. হামফ্রে বলেন-
১. বহুকাল থেকে ব্রিটিশ সরকার নতুন নতুন আবাদি ও দখলকৃত জায়গা নিয়ে কিভাবে নিজেদের একটি শক্তিশালী বিশাল এলাকা গড়ে তুলবে সে বিষয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছে। তাঁদের রাজ্যের সীমানা এতটুকু প্রসারিত হয়েছে এখনো; কিন্তু তাদের সীমানায় সূর্যাস্ত হচ্ছে না। কিন্তু ভারত, চীন এবং অন্যান্য অসংখ্য নতুন আবাদিযুক্ত দেশ তাদের হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে অনেক ছোট দেখা যাচ্ছে। আবার তাদের পররাষ্ট্রনীতি ও কূটকৌশল সব দেশে সমান বলে মনে হচ্ছিল না। কোন কোন দেশ বাহ্যত শাসন মতার লাগাম সে সব দেশের লোকদের হাতে, কিন্তু নেপথ্যে গোটা সাম্রাজ্য ব্রিটিশের অধীনস্থ। এখন শুধু সময়ের ব্যাপার সে সব অঞ্চলের শাসন মতা থেকে ছিন্ন হয়ে ব্রিটিশের হাতে চলে আসাটা। সুতরাং এখন দু’টি বিষয়ের প্রতি আমাদের মনযোগ দেয়া একান্ত প্রয়োজন। তা হলো:
ক. এমন তদবীর অবলম্বন করতে হবে যাতে ইংল্যান্ডের নতুন আবাদি এলাকাগুলোর কার্যক্রম, দখল এবং আয়ত্ত শক্তিশালী হয়।
খ. এমন কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে যে, সে সব দেশে যেন আমাদের স্থায়িত্ব ও প্রভাব প্রতিষ্ঠা হয়, যেগুলো এখনো আমাদের আয়ত্তে আসেনি।
ইংরেজ সরকারের নতুন আবাদি ও দখলকৃত এলাকা বিষয়ক মন্ত্রণালয় উল্লিখিত বিষয়ে প্রয়োজন অনুভব করেছে যে নতুন আবাদি অথবা আবাদ হওয়ার পথে এমন এলাকাসমূহে গোয়েন্দাগিরি এবং প্রাপ্ত গোয়েন্দা রিপোর্ট উক্ত মন্ত্রণালয়ে সরবরাহের জন্য যেন কিছু প্রতিনিধি প্রেরণ করা হয়। আমি উক্ত মন্ত্রণালয়ের শুরু থেকে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে কর্তৃপরে সুনাম অর্জন করতে সম হয়েছি। বিশেষ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিষয়সমূহ যাচাই এবং পর্যবেণকালে আমার কর্মদতা সম্পদ মন্ত্রণালয়ে আমাকে একটি ভাল পদবীতে উন্নীত করেছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রকাশ্যত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা গেলেও মূলত তা ছিল গোয়েন্দাগিরির আড্ডাখানা। হিন্দুস্তানসহ গোটা এশিয়াকে কিভাবে সম্পূর্ণরূপে ইংরেজ ব্রিটিশের দখলে নিয়ে আধিপত্য বিস্তার করা যায় সে পথ খুঁজে বের করাই ছিল ভারতবর্ষে তাদের অবস্থানের মূল কারণ।
মন্ত্রণালয়ের অভিজ্ঞ মহল মনে করেন আগামী শতাব্দির মধ্যে ওসমানী শাসন ধসে যাবে। আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ মুসলিম দেশসমূহ ওসমানী এবং ইরানীদের অধীনে থেকে জোরালোভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তারা ইংরেজ সরকারের উদ্দেশ্য সাধনে সুস্পষ্ট সাফল্য অর্জন করেছে। সর্বত্র কার্যালয় (মুসলিম) গুলোতে সাধারণভাবে সুদ, ঘুষ প্রথা চালু করে দাফতরিক নিয়মনীতিকে উলট-পালট করে দিয়েছে। রাজা-বাদশাহদেরকে বিলাসিতায় উৎসাহিত করে তাদের জন্য ভোগ্যপণ্য সরবরাহ করতে আরম্ভ করে। এভাবে তাদের সরকারকে দোদুল্যমান এবং দুর্বল করে দিয়েছে। একবার নতুন আবাদি এলাকা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে রুশ, ফ্রান্স এবং ব্রিটিশ-এর উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি সম্মেলন ডাকা হয়। সেখানে রাজনীতিক, ধর্মীয়সহ প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গ অংশগ্রহণ করেছিলেন। সৌভাগ্যবশত আমিও তথায় উপস্থিত ছিলাম। আলোচ্য বিষয় ছিল ‘ইসলামী দেশসমূহে ইংরেজ সাম্রাজ্যের চিন্তাধারা সংযোজন করা এবং তাতে সঙ্কটের উদ্ভব হলে তা নিরসন করা।’ এতে প্রত্যেকে আলোচনা করেন কীভাবে মুসলমানদের শক্তি ধবংস করা যায় এবং তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সন্দেহের বীজ বপন করে ঈমানকে দুর্বল করে দেয়া যায়। উক্ত কনফারেন্সে উত্থাপিত সব ঘটনা আমার রচিত ‘বিশাল মসীহের দিকে এক উড্ডয়ন’ নামক পুস্তকে বর্ণনা করেছি।
এখন ঐ সময়টি এসে গেছে, খ্রিস্টানরা মুসলমানদের থেকে বদলা আদায় করে নেবে এবং নিজেদের হারানো মর্যাদা পুনরুদ্ধার করবে। বর্তমানে সব চেয়ে বড় ইহুদি শাসন বিশাল ব্রিটিশ-এর হাতে, এখন চায় জোরালো সংগ্রামী যুদ্ধ পতাকাও তাদের (ব্রিটিশ) হাতে আসুক।
২. ১৭১০ সনে ইংল্যান্ডের নতুন আবাদি এলাকা বিষয়ক মন্ত্রণালয়-এর প থেকে মিশর, ইরাক, ইরান, হেজাজ এবং ওসমানী খেলাফতের কেন্দ্র ইস্তাম্বুলে (তখনকার কুসতুনতুনিয়া) গোয়েন্দা দায়িত্ব পালনের জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি। ঐসব এলাকায় মুসলমানদেরকে এলোমেলো করে যাতে সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা প্রচলন করা যায় সে সব পথ অনুসন্ধান করার কাজই ছিল আমার। আমার সাথে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন গোয়েন্দা বিভাগের উচ্চ বেতনধারী আরো দ লোকজন দেয়া হয়। যারা উপরিউক্ত দেশগুলো থেকে মানচিত্র ও বিভিন্ন সংগৃহীত তথ্যাবলী যেন মন্ত্রণালয়ে সরবরাহ করে। তাদেরকে ঐ সমস্ত মুসলিম দেশের বুদ্ধিজীবী, মন্ত্রী, সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, ওলামা এবং সমাজপতিদের নামের তালিকা দেয়া হয়েছে। বিদায়কালে (ত্রাণ বিষয়ক মন্ত্রী) আমাকে বলেছেন, ‘‘তোমার সাফল্যে আমাদের দেশের ভবিষ্যত উজ্জ্বল হবে। সুতরাং সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করবে, তাতে সফলতা তোমার পদচুম্বন করবে।
অতএব, আমি আনন্দের সাথে ইস্তাম্বুলের উদ্দেশে রওনা দিয়েছি। উপলব্ধি করছি আরবি, ফার্সি, তুর্কি ভাষা শিা গ্রহণ করা এবং কোরআন গবেষণা করা প্রয়োজন। প্রথমে আমার নাম ‘মুহাম্মদ’ (ছদ্মনাম) ধারণ করলাম। ওসমানী খেলাফতের রাজধানী ইস্তাম্বুল এসে শহরের জামে মসজিদে প্রবেশ করে তথাকার লোকজনের মনোভাব, পবিত্রতা, নিয়ম-শৃঙ্খলা, আদর্শ ইত্যাদি দেখে মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলাম, আমি এই পবিত্র মনের মানুষদের সঙ্কটাপন্ন করার পেছনে কেন লেগে গেলাম। হঠাৎ স্মরণ হল যে, আমি তো ব্রিটিশ বাহাদুরের মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মচারী, আমাকে শেষ নিঃশ্বাস অবধি অর্পিত দায়িত্ব বিশ্বস্ততার সাথে পালন করে যেতে হবে।
শহরে প্রবেশ করার পর আমার পরিচয় হল দেশের একজন আলেমেদ্বীন, নেককার, পরহেযগার, মর্যাদাবান, ভদ্র, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের বুযুর্গ, পেশওয়ার সাথে, যার নাম আহমদ আফিনদী। আমি আমাদের পাদ্রীদের মধ্যে এ রকম সবসময় এবাদতে মশগুল মানুষ দেখিনি। পরিচয়ের সময় ভাগ্যক্রমে তিনি খান্দান সম্পর্কে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। তাকে বলেছি আমি পিতৃমাতৃহীন, কোন ভাই-বোন আমার নেই এবং পিতামাতা আমার জন্য অনেক কিছু রেখে গেছেন। তাঁর কাছে একটি ডাহা মিথ্যা কথা বলেছি যে, আমি ওসমানী খেলাফতের কাজ করে যাচ্ছি। এতে তিনি আমার প্রতি আরো দয়া-পরবশ হন এবং আমাকে মুহাম্মদ আফিনদী নামে ডাকতেন। তিনি বেশিরভাগ সময় আমার তালাশ করতেন, আমাকে সুনজরে রাখতেন। তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করলে সম্মান ও ভদ্রতার সাথে উত্তর দিতেন। আমি কোরআন, আরবি, তুর্কি ভাষা শিা গ্রহণ করার জন্য ইসলামের কেন্দ্র ইস্তাম্বুল সফরে এসেছি- এ কথা তিনি জানতে পেরে আমাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে অনেক মূল্যবান উপদেশ দিলেন। তাঁর সান্নিধ্যে থেকে আমি কোরআন, তাজবীদ, আরবি, ফার্সি, তুর্কি ভাষা ও ইসলামী শরীয়ত শিা লাভ করেছি। প্রত্যহ আসর নামাযের পর তাঁর কাছে গিয়ে দুই ঘন্টা কোরআনখানীতে সময় ব্যয় করতাম। ইস্তাম্বুলে দুই বছর অবস্থানকালে ওসমানী শাসনের পর্যবেণ করে গোপনে প্রতিমাসে লন্ডনে রিপোর্ট পাঠাতে হত।
অবশেষে হযরত শায়খ আহমদ আফিনদীর অনুরোধ উপো করে তাঁর থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম লন্ডনে। কারণ কোন অবস্থাতেই আমার প্রত্যাবর্তন তিনি চাননি। তাঁর বিরহ বেদনা আমাকে অনেক দিন অস্থির করে রেখেছিল এবং চোখের অশ্র“ সংবরণ করতে পারতাম না। কিন্তু নিরুপায় হয়ে কর্তব্যকে প্রাধান্য দিতে হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের কনফারেন্সে সচিব আমাকে বললেন, আগামীতে দু’টি বিষয়ের উপর তোমাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
১. মুসলমানদের দুর্বলতাগুলোকে চিহ্নিত করা, যা আমাদেরকে অগ্রসর করবে এবং তাদের বিভিন্ন গোত্রে ফাটল সৃষ্টিতে সাফল্য অর্জিত হবে। কেননা দুশমনের উপর আমাদের সাফল্যের মূল রহস্য উপরিউক্ত বিষয়গুলো চিহ্নিতকরণের উপর নির্ভরশীল।
২. তোমার দ্বিতীয় কাজ হবে তাদের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করা, সর্বশক্তি ব্যয় করে এ কাজে কৃতকার্য হওয়ার পর তুমি নিশ্চিত হতে পারবে যে, তোমাকে ইংরেজ গোয়েন্দাদের মধ্যে প্রথম সারিতে গণ্য করা হচ্ছে। এর মধ্যে মন্ত্রণালয়ের জোরালো নির্দেশ এসেছে, দায়িত্ব নিয়ে আমাকে ইরাক যাওয়ার জন্য। স্ত্রী সন্তানের মায়া-মমতাকে চাপা দিয়ে অবশেষে অনিচ্ছায় বসরায় এসে পৌঁছলাম। এখানে আরবি, ইরানী, সুন্নী, শিয়া এক সারিতে বসবাস করছে।
ইরাক আসার পূর্বে সচিব এক বৈঠকে আমাকে বললেন, ‘‘হামফ্রে! তুমি কি জান, ঝগড়া ও যুদ্ধ মানুষের প্রকৃতিগত বিষয়। খোদা আদম সৃষ্টি করেছেন এবং হাবিল ও ক্বাবিল-এর জন্ম মতভেদকে মাথাচাড়া দিয়ে তুলেছে। আমি মানুষের মতভেদকে পাঁচ প্রকারে বিভক্ত করতে পারি। ১. বংশগত মতভেদ, ২. গোত্রীয় মতভেদ, ৩. ভূমি সংক্রান্ত মতভেদ, ৪. জাতিগত মতভেদ, ৫. মাযহাবী মতভেদ।
এ সফরে তোমার কর্তব্য কাজ হবে মুসলমানদের মধ্যে মতভেদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জন করা। তুমি যদি ইসলামী দেশগুলোতে প্রবলভাবে শিয়া-সুন্নী দাঙ্গা বাধিয়ে দিতে পার তাহলে বুঝা যাবে যে, ব্রিটিশ সরকারের বড় একটি খেদমত করেছ।
অতঃপর হামফ্রে! তুমি প্রথমে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, গোলযোগ, ফাটল সৃষ্টিও মতভেদের যে কোন পথ বের করে সেখান থেকে কাজ শুরু কর। এ মুহূর্তে ওসমানী ও ইরানী সরকার দুর্বল হয়ে গেছে। তোমার ফরজ কাজ হবে তাদের প্রশাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে িেপয়ে তোলা।
বসরায় মুসাফিরখানায় থাকা অবস্থায় প্রত্যহ নিয়মিত নামায আদায় এবং সকালে এক ঘন্টার অধিক সময় কোরআন তিলাওয়াত করতাম। আবদুর রেজা নামক জনৈক তুর্কি শিয়ার দোকানে চাকরি নেয়ার পর এমন এক লোকের সাথে আমার সাাৎ হল যিনি সেখানে নিয়মিত আসা-যাওয়া করেন এবং তুর্কি, ফার্সি ও আরবি ভাষায় কথাবার্তা বলেন। তাঁর নাম মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব। তিনি উসমানী খেলাফতের ঘোর বিরোধী এবং উগ্র মনোভাব ও আত্মগরিমা পোষণকারী মানুষ। তার কাছে হানাফী, শাফে‘ঈ, মালেকী, হাম্বলী চিন্তাধারার কোন গুরুত্বই নেই। তার বক্তব্য হল আল্লাহ্ কোরআনে যা বলেছেন তাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। এ লোকটি কোরআন-হাদীস যথেষ্ট অধ্যয়ন করেন। কিন্তু তার ধ্যান ও চিন্তাধারা জগত বিখ্যাত ওলামা-ই দ্বীনের বিপরীত। তাঁর উক্তি হল, শুধু কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণ করাই আমাদের ওপর ওয়াজিব। ওলামা-ই দ্বীন, আইম্মা-ই আরবা‘আহ্, এমনকি সাহাবা-ই কেরামের রায়ও হোকনা কেন তাঁদের ঐকমত্য ও মতভেদের উপর আমাদের ধর্মকে মজবুত না করা চাই।
ব্রিটিশ গোয়েন্দা হামফ্রে বর্ণনা করছেন, একদিন আহারের বৈঠকে ইসলামের মৌলিক ও বিভিন্ন বিষয়ের উপর আব্দুর রেজা তুর্কানের আমন্ত্রণে ইরান থেকে আগত হযরত শায়খ জাওয়াদ কুস্মী নামক এক কট্টর সুন্নী আলেমের তর্কযুদ্ধ হয় মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাবের সাথে। বয়োজ্যেষ্ঠ সুদ শায়খ জওয়াদের অকাট্য দলিল ও যুক্তির সামনে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব ও তার সমস্ত যুক্তি-প্রমাণ মশার মত উড়ে গেল। এতে তার দুরন্তপনার গতি স্তিমিত হয়ে গেল। তখন তাদের বিতর্ক থেকে আমি বড় মজা উপভোগ করছিলাম।
মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাবের সাথে মেলামেশার পর আমি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্যকে কাজে পরিণত করতে উচ্চাভিলাষী ও অহঙ্কারী এ লোকটিই যথার্থ বলে পরিলতি হচ্ছে। কেননা, ওলামা-ই কেরাম ও মাশাইখে ইসলাম’র সাথে তার চরম শত্র“তা। এমনকি খোলাফা-ই রাশেদীনকে পর্যন্ত সে তার সমালোচনার টার্গেট করেছে। সে প্রকৃত ও সত্যের পরিপন্থী হয়ে স্বার্থসিদ্ধি করতে কোরআন-হাদীসের অপব্যাখ্যা করতেও বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হয় না। তাই নিশ্চিত হওয়া গেছে তার দ্বারা সহজেই ফায়দা অর্জন করা যেতে পারে।
আমি ভাবছিলাম কোথায় ওই অহঙ্কারী যুবক (ইবনে আব্দুল ওহাব) আর কোথায় ইস্তাম্বুলের সেই বৃদ্ধ ব্যক্তিটি (আহমদ আফিন্দি), যাঁর সুচিন্তাধারা ও সৎ কর্মকাণ্ড হাজার বছরের পূর্বেকার মানুষের সৎকর্ম ও আদর্শের চিত্রগুলোকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এ মানুষটি হযরত আবু হানিফার নাম উচ্চারণ করার আগে অজু করতেন এবং আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে হাদীস শাস্ত্রের উচ্চ মর্যাদার কিতাব ‘বুখারী শরীফ’ প্রত্যহ নিয়মিত পাঠ-পর্যালোচনা করা ফরজ (একান্ত অপরিহার্য) মনে করতেন। অথচ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব ইমাম আবু হানিফার কট্টর বিরোধিতা ও সমালোচনা করে বলত যে, ‘‘আমি আবু হানিফা থেকেও অনেক বেশি জানি’’ এবং সে আরো বলত ‘‘বুখারী শরীফের অর্ধেকাংশই নাকি অনর্থক (অপ্রয়োজনীয়)’’। হামফ্রে লিখেছেন- অবশেষে, মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাবের সাথে আমার বন্ধুত্বকে গভীর ও সম্পর্ককে অবিচ্ছেদ্য করে তুলেছি। আমি বারবার তার কানে রস গুলিয়ে দিচ্ছিলাম যে, ‘‘আল্লাহ্ তোমাকে হযরত আলী ও হযরত ওমর থেকেও অধিক যোগ্যতা, মর্যাদা ও বুযুর্গী দান করেছেন। এমনকি তুমি যদি রাসূলে পাকের যুগে হতে, অবশ্যই তাঁর স্থলাভিষিক্ত হতে। আমি আশার সুরে তাকে বলতাম- ‘‘আমি চাই ইসলামে যে আন্দোলন প্রয়োজন সেটা তোমার পবিত্র (!) হাতেই সম্ভব হোক। তুমি এমন এক ব্যক্তিত্ব, যে ইসলামকে পতনের হাত থেকে রা করতে পারে। এ বিষয়ে সকলে তোমার উপর আশাবাদী।’’
আমি মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাবের সাথে চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আমরা দুজনে মিলে ওলামা-ই কেরাম, বুযুর্গানে দ্বীন, মুফাস্সিরীন, মাযহাবের ইমামগণ ও সাহাবাই কেরাম থেকে দূরে সরে নতুন চিন্তাধারা তৈরির ভিত্তিতে কোরআনের উপর আলোচনা করব। আমি কোরআনের আয়াত পাঠ করে এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের পর আমার নিজস্ব মত প্রকাশ করতাম। আমার আসল কাজ ছিল যে কোন প্রকারেই হোক তাদের ইংরেজের বর্ণিত মন্ত্রণালয়ের ফাঁদেই আটকিয়ে দেয়া।
আমি ধীরে ধীরে তাকে আমার আলোচনার মারপ্যাঁচের জালে আটকাতে শুরু করলাম। সেও প্রকৃত অবস্থা থেকে সরে স্বাধীন মনোভাব নিয়ে আমাদের উদ্দেশ্যের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। অনুভব করলাম আমি আমার কাজে সাফল্য অর্জন করতে যাচ্ছি।
আর একদিন মুতা’ (সাময়িক) বিয়ে সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করলাম- ‘‘মহিলাদের সাথে মুতা’ বিয়ে জায়েয আছে কিনা।’’ সে বলল, ‘কখনো না।’’ আমি বললাম, ‘‘কেন! কোরআনে সেটাকে জায়েয বলা হয়েছে যে, ‘‘এবং যখন তোমরা তাদের সাথে মুতা’ কর, তখন তাদের মোহরানা আদায় করে দাও।’’ [সূরা নিসা, আয়াত-২৪] সে উত্তর দিল- ‘‘হ্যাঁ, আয়াত নিজের জায়গায় ঠিক আছে। কিন্তু হযরত ওমর সেটাকে এই বলে হারাম উল্লেখ করে ঘোষণা দিয়েছেন যে, মুতা’ নবীর যামানায় হালাল ছিল, আমি সেটাকে হারাম ঘোষণা দিচ্ছি এবং এখন থেকে কেউ এ ব্যাপারে অপরাধী হলে আমি তাকে শাস্তি দেব।’’
আমি বললাম- ‘‘আশ্চর্য! তুমি কি হযরত ওমরকে অনুসরণ করছ? অথচ নিজেকে হযরত ওমর থেকে অধিক জ্ঞানী দাবী কর। হযরত ওমরের কি অধিকার আছে নবীর হালালকৃত বিষয়কে হারাম করার? তাহলে কি তুমি কোরআনকে অগ্রাহ্য করে হযরত ওমরের রায়কে মেনে নিলে?
মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব কোন উত্তর দিল না। নীরবতা সম্মতির প্রমাণ। উক্ত বিষয়ে তার মনের পরিবর্তন ঘটিয়ে তাকে মুতা’ বিয়ে সম্পর্কে উদ্বুদ্ধ করলাম। সে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি প্রকাশ করল। যাবতীয় ব্যবস্থাপনার আশ্বাস দিয়ে তাকে বললাম- ‘‘সব ধরনের গোপনীয়তা রা করা হবে। বিষয়টি তোমার আর আমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। এমনকি সে মহিলাকেও তোমার আসল নাম বলা হবে না।’’
অতঃপর ইংল্যান্ডের উক্ত মন্ত্রণালয়ের প থেকে বসরায় নিয়োজিত মুসলিম যুবকদের পথভ্রষ্ট ও চরিত্রহীন করার জন্য প্রমোদবালাদের কাজে লাগানোর ব্যবস্থা হল। এরপর এক যুবতী যৌনকর্মীর সাথে আসল উদ্দেশ্য বিস্তারিত আলাপ করলাম। তাকে রাজি করিয়ে সাময়িকভাবে ‘সুফিয়া’ নাম দিয়ে এক আশরাফী মোহরানা ধার্য করে এক সপ্তাহের জন্য ওই সুফিয়ার সাথে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব’র আকদ দিয়ে দিলাম। বিয়ের তৃতীয় দিন মদ্যপান বিষয়ে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাবের সাথে আলাপচারিতার সময় মদ্যপান হারামের উপর তার উপস্থাপিত সমস্ত দলিল খণ্ডন করে তার নিকট মদ্যপান বৈধ প্রমাণ করলাম। বাইরে আমি এবং আড়ালে সুফিয়াকে দিয়ে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাবকে বিভ্রান্ত করে দীনের সমস্ত বিধানকে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম। সুফিয়াকে বললাম- ‘‘সুযোগ পেলে যত পার তাকে মদ-শরাব পান করিয়ে বিভোর করে দেবে।’’
পরের দিন সুফিয়া আমাকে অবহিত করল যে, সে ইবনে আব্দুল ওহাবকে ইচ্ছে মত মদ-শরাব পান করিয়েছে। সে মদের প্রতিক্রিয়ায় ঘর থেকে বের হয়ে উন্মাদের মত শোর চিৎকার শুরু করে দিয়েছে। এমনকি রাতের শেষের দিকে সুফিয়ার সাথে কয়েকবার দৈহিক মিলন করেছে। তার মধ্যে অন্য এক ধরনের অস্থিরতা এবং উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। শেষ হয়ে গেছে তার মুখের উজ্জ্বলতাও।
মোটকথা, আমি আর সুফিয়া তাকে আচ্ছাদিত করে ফেলেছি। সফলকাম হয়েছি তার ঈমানকে বিনাশ করে দিতে। কিন্তু তার সাথে সদ্ভাব ও মিষ্টি কথার ফুলঝুরি নিয়মিত চালু রেখে মগজ ধোলাই করে চলেছি। শিয়া-সুন্নীর ফেরকাবন্দি ছাড়াও মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাবের নেতৃত্বে তৃতীয় একটি সম্প্রদায় তৈরির কাজ শুরু করেছি। এতে সুফিয়া আমাকে সার্বিক সহযোগিতা দিয়েছে। কেননা, সে সুফিয়ার প্রতি এমন আসক্ত হয়ে গেছে যে, প্রতি সপ্তাহে মুতা’র মেয়াদ বাড়াতে লাগল। আমি ইংল্যান্ডে প্রতি মাসে নিয়মিত রিপোর্ট পাঠানো অব্যাহত রাখলাম। তাকে সব সময় আশ্বস্ত করতে লাগলাম যে, একটি অত্যুজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তোমার জন্য অপো করছে।
একদিন তার কাছে একটি মিথ্যা স্বপ্নে বর্ণনা দিয়ে বললাম, ‘‘রাতে আমি স্বপ্নে হযরত রসূলে করীমকে সশরীরে কুরসীর উপর উপবিষ্ট দেখলাম। দেখতে পেলাম তাঁর চারিদিকে আমার অপরিচিত অনেক আলেম ও বুযুর্গ ব্যক্তি বসে আছেন। তখন হঠাৎ তুমি সেখানে প্রবেশ করেছ এবং তোমার মুখমণ্ডল থেকে নুরের দীপ্তি বিচ্ছুরিত হতে লাগল। তখন তুমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র সামনে পৌঁছামাত্র তিনি দাঁড়িয়ে তোমাকে সম্মান জানালেন এবং তোমার মাথায় চুম্বন করে বললেন- ‘‘হে আমার নামীয় মুহাম্মদ! তুমি আমার ইলমের উত্তরাধিকার এবং মুসলমানগণকে জাগতিক ও পরলৌকিকভাবে পরিচালনার জন্য আমার স্থলাভিষিক্ত হয়েছ’। একথা শুনে তুমি উত্তর দিয়েছ-‘‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! মানুষের কাছে নিজের ইলমকে প্রকাশ করতে আমার বড় ভয় হচ্ছে। তিনি বললেন, ‘‘ভয়কে তোমার অন্তরে স্থান দিওনা। কারণ তুমি নিজেকে যতটুকু মনে করছ, তার চেয়েও তুমি আরো অধিক মর্যাদার অধিকারী।’’
মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব আমার স্বপ্নের মনগড়া কথা শুনে বারবার আমাকে জিজ্ঞেস করতে লাগল- আমার স্বপ্ন সত্যি হয় কিনা। আমি অবিরতভাবে তাকে আশ্বস্ত করে সন্তুষ্ট থাকতে বললাম। উপলব্ধি করলাম সে আমার স্বপ্নের বর্ণনা শুনে মনে মনে নতুন ধর্ম (মতবাদ) সৃষ্টি ও তা ঘোষণা দেওয়ার দৃঢ় আকাক্সা পোষণ করছে।
বিশেষ করে আমার কর্মদতার জন্য মন্ত্রী মহোদয়ের প্রশংসাই আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাবকে আমার আয়ত্তে আবদ্ধ করতে। মন্ত্রী মহোদয় আমাকে কঠোরভাবে বলে দিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের প থেকে সুশৃঙ্খল পরিকল্পনার আওতায় যেন মুহাম্মদ (ইবনে আব্দুল ওহাব) আমাদের জন্য ভবিষ্যতে কাজ করে। কেননা আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করার জন্য শেখ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাবের মত ব্যক্তির প্রয়োজন আছে। তার কোন বিকল্প নেই।
ইস্পাহানে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় আব্দুল করীম নামক জনৈক কলামিস্ট এবং ব্রিটিশ নতুন আবাদি এলাকা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পুরাতন খ্রিস্টান কর্মচারীর। তিনি শায়খ মুহাম্মদের (ইবনে আব্দুল ওহাব) সাথে কৃত্রিম আন্তরিকতার আকর্ষণ দিয়ে তার (শায়খ) অন্তরের সমস্ত রহস্য জেনে নেয়। তার সাথে সুফিয়াও কিছুদিনের জন্য ইস্পাহানে বেড়াতে এসেছে এবং আরো দু’মাসের জন্য সুফিয়ার সাথে মুতা’র মেয়াদ বৃদ্ধি করেছে। তবে ‘সিরায’ শহর সফরের সময়ে সে সুফিয়ার সাথে ছিল না। আব্দুল করীম সুফিয়াকে সঙ্গে রেখেছে। আব্দুল করীম মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাবের জন্য সুফিয়া থেকেও অত্যধিক রূপসী আছিয়া নামের আরেক ইহুদী যুবতী কন্যার ব্যবস্থা করেছে। যিনি ইরাকে ব্রিটিশের পে কাজ করার জন্য নিয়োজিত কর্মচারী। আব্দুল করিম, সুফিয়া, আছিয়া ও এ অধম মিলে দিবারাত্র প্রচেষ্টা চালিয়ে শায়খ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাবকে হাত করেছি মন্ত্রণালয়ের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য তাকে পূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছি। মুসলিম বিশ্বকে দুর্বল করে নির্মূল করার জন্য যে সব বিষয় ও চুক্তি গুরুত্বের সাথে চিহ্নিত করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ-নেয়া হয় সেগুলোর কিছু নিম্নে উল্লেখ করা হল:
১. ভুল ধারণা ও ভুল বুঝাবুঝির মাধ্যমে শিয়া-সুন্নীর মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে দেয়া এবং একে অপরের বিরুদ্ধে কুৎসা ও অপবাদ রটিয়ে সমাজে হেয় করা।
২. মুসলমানদেরকে অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখা। মসজিদ ও দ্বীনী মাদরাসাসমূহকে প্রতিষ্ঠিত হতে না দেয়া এবং মুসলিম পাঠাগারগুলোতে অগ্নিসংযোগ করা।
৩. প্রকৃত ওলামা-ই দ্বীন এবং মুসলিম জনগণের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে দেয়া।
৪. উক্ত মন্ত্রণালয়ের সাথে সম্পৃক্ত কিছু ব্যক্তিকে আলেমের বেশে জামেউল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়, নজফ, কারবালা এবং ইস্তাম্বুলের দ্বীনী ইলমের কেন্দ্র ও ধর্মীয় স্থানগুলোতে ঢুকিয়ে দিয়ে খাঁটি আলেম-ওলামা থেকে মুসলমানদের আত্মার বন্ধন ছিন্ন করার রাস্তা উদ্ভাবন করে মুসলিম ছাত্রদেরকে তাদের (মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ত আলেম বেশধারী) দায়িত্বে নিয়ে ভুল শিা, বিকৃত অর্থ ও অপব্যাখ্যা দিয়ে ওসমানী (সুন্নী) খলীফাদের থেকে পৃথক করে তাদের (খলিফাদের) বিপে িেপয়ে তোলা।
৫. মুসলমানদের ইবাদত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া একান্ত আবশ্যক। হজ্ব একটি বেকার আমল হিসেবে আখ্যায়িত করা হোক। মুসলমানদের মক্কা মদিনায় যাওয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা। বড় বড় মাহফিলগুলোকে নিষিদ্ধ করা। কারণ বড় মাহফিল আমাদের জন্য বিপদ ঘন্টা। মসজিদ, মাযার, মাদরাসা যাতে নির্মাণ করা না যায় সেদিকে ল্য রাখা।
৬. পর্দা প্রথা উঠিয়ে দেয়া। যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে বুঝাতে হবে যে, এ প্রথা বনু আব্বাসের সময় থেকে চালু হয়েছে। এটা নবীর যামানায় ছিল না বিধায় তা সুন্নাত নয়।
৭. আমাদের কাছে কঠিন সমস্যাগুলোর মধে বড় সমস্যা হচ্ছে বুযুর্গানে দ্বীনের মাযাসমূহে মুসলমানদের উপস্থিতি। এখন প্রয়োজন বিভিন্ন যুক্তি দ্বারা প্রমাণ করতে হবে যে, কবরকে গুরুত্ব দেয়া এবং সেখানে সজ্জিত করা বিদ‘আত ও শরীয়তের পরিপন্থী, হযরত রসূলে পাকের যামানায় এ সব ছিল না। ক্রমান্বয়ে সমস্ত মাযার ধবংস করে মানুষকে যিয়ারত থেকে রুখে দেয়া।
এ ব্যাপারে সুবিধাজনক কর্মসূচি হল- ওই সমস্ত মাযার সম্পর্কে বলা যেতে পারে হযরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববীর মধ্যে দাফন হননি। বরং তার আম্মাজানের কবরের মধ্যেই তিনি আরাম করছেন। অনুরূপভাবে হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর জান্নাতুল বাকীতে দাফন হয়েছেন। হযরত ওসমানের মাযার কোথায় তার কোন পাত্তা নেই। হযরত আলীর মাযার নজফে নয়, নজফে মুগীরা ইবনে শো’বার কবর। ইমাম হুসাইনের মস্তক মুবারক মসজিদে হান্নানায় দাফন হয়েছে, তাঁর দেহ মুবারক সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য নেই। কাজেমীন এর বিখ্যাত মাযারে হযরত ইমাম মুসা কাজেম ও ইমাম তক্বীর পরিবর্তে দু’জন আব্বাসীয় খলিফার কবর। জান্নাতুল বাকীকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া, ইসলামী দেশসমূহের যিয়ারতের স্থান ও চিহ্নগুলোকে বিরানভূমিতে পরিণত করে দিতে হবে।
নবী বংশের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা উঠিয়ে দেয়ার জন্য বেতনধারী কিছু মানুষকে মিথ্যা বানোয়াট সৈয়দ সৃষ্টি করে কালো এবং সবুজ পাগড়ি পরিয়ে দিয়ে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাতে একেতো তাদের দিকে মানুষ আকৃষ্ট হতে থাকবে, অপরদিকে প্রকৃত সৈয়দ বংশ এবং ওলামা-ই দ্বীন থেকে ক্রমশ মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং নবীবংশের সাথে আত্মার বন্ধনের ধারা ধীরে ধীরে চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।
মন্ত্রণালয়ের সচিবের দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে যে, নতুন আবাদি এলাকা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পিত কর্মসূচিগুলোকে কার্যে পরিণত করার জন্য মুহাম্মদ আব্দুল ওহাবই মনপূত ব্যক্তি। ব্রিটিশ সরকার শায়খ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাবকে স্বতন্ত্রভাবে প্রস্তুত করার পর প্রয়োজনে আরো সহযোগিতা দেয়ার আশ্বাস দিয়ে বলেছে যে, শায়খের মর্জি অনুসারে ‘জাযীরাতুল আরব’-এ অবস্থিত নজদের নিকটবর্তী এলাকাসমূহকে তার রাজ্যের প্রথম অবস্থান (প্রশাসনিক সদর দফতর) নির্ধারণ করা হয়েছে।
ব্রিটিশ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দের সর্বসম্মতিক্রমে যে সব চুক্তি ও প্রস্তাব পাস করা হয়েছে, তন্মধ্যে কিছু উল্লেখ করা হল:
১. খানায়ে কা’বা, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর প্রতিনিধিগণ এবং মুসলমানদের যিয়ারতের স্থানগুলোকে শিরক ও মূর্তি পূজার সাথে তুলনা দিয়ে ধবংস করে দেয়া।
২. কোরআন এর মধ্যে ওলট-পালট কম-বেশী ও পরিবর্তন করে নতুন ধারায় কোরআন শরীফ প্রকাশ করা। মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি এক পর্যায়ে আমাকে বলেছেন, ইতিপূর্বে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব শিথিল হওয়া আন্দোলনকে জোরালো করেছেন। আমাদের দৃষ্টিতে আন্দোলনকে তিনি মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহর মত (নাউজুবিল্লাহ) বেগবান করে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেন।
৩. মুসলমানদের ফির্কাগুলোর মধ্যে ইন্ধন যুগিয়ে তাদের মতানৈক্যকে জোরদার করা, যাতে স্ব স্ব ফির্কা শুধুমাত্র নিজেদেরকে মুসলমান জানে এবং অন্যদের কাফির মনে করে।
৪. জেনা, বলাৎকার, মদ্যপান, জুয়া এবং এ ধরনের বদ অভ্যাসগুলো মুসলমানদের মধ্যে প্রচলন করার প্রয়োজন আছে।
অনেক পরিশ্রমের পর আমি আমার উদ্দেশ্যস্থলে উপনীত হয়েছি। কিছুদিন বিচ্ছিন্ন থাকার পর একদিন আমি নজদে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাবের বাড়িতে গিয়েছি। সে দ্বিতীয় বিয়ে করার কারণে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। আমি তাকে অনেক উপদেশ ও বুঝিয়ে সুজিয়ে আমার মতের মধ্যে নিয়ে আনলাম। তাকে বললাম যে, সামনে আমাদের দু’জনকে মিলে বহু কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। এ জন্য আমি আমার নাম আব্দুল্লাহ্ প্রকাশ করে সেখানে বললাম শায়খ সাহেব আমাকে ক্রয় করে এনেছেন। মুহাম্মদ বিন আবদুল ওহাবও আমার পরিচয় সেভাবে তুলে ধরেছে। নজদবাসীরা আমাকে তার গোলাম হিসাবে মনে করতে লাগল। এখানে এ বিষয়টিও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, শায়খের জন্য নতুন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে যাবতীয় ব্যবস্থা ও সরঞ্জাম সরবরাহ করতে দু’বছর সময় লেগেছে।
১১৪৩ হিজরির মাঝামাঝি সময়ে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব ‘জাযীরাতুল আরব’-এ তার নিজের নতুন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তার সমমনা বন্ধুবান্ধব ও আপনজনদের নিয়ে এক বৈঠকে মিলিত হয় এবং তারা তাকে সহযোগিতার ওয়াদা দেয়। প্রাথমিকভাবে সংপ্তি পরিসরে তার দাওয়াত সীমিত পর্যায়ে থাকলেও ক্রমান্বয়ে আমরা তার এলাকায় অর্থ দিয়ে সমাবেশ করে মানুষের সহযোগিতা নিয়ে লোকজন বাড়াতে লাগলাম এবং ভবিষ্যৎ শত্র“ সম্পর্কেও তাকে সতর্ক করলাম। তার মতবাদ প্রচার ও প্রসারের পাশাপাশি শত্র“ সংখ্যা ও বাড়তে লাগল এবং আক্রমণ-হামলা আসতে শুরু হল। অবশ্য আমি তার মনোবল শক্ত রাখলাম।
অবশেষে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব আমাকে আশ্বস্ত করল যে, সে নতুন আবাদি এলাকা মন্ত্রণালয়ের দাবিগুলো পূরণে কাজ করে যাবে। কিন্তু দাবিগুলোর মধ্যে ২টি দাবির কথা আমি তাকে বলিনি। সে দু’টি হল ১. কা’বা শরীফ ধবংস করে দেয়া। ২. নতুন ধারায় কোরআন শরীফ প্রণয়ন করা।
মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাবের মতবাদ (ওহাবী) প্রচারের কয়েক বছর পর যখন পরিকল্পনাগুলো সাফল্যের দিকে এগুতে লাগল তখন মন্ত্রণালয় জাযীরাতুল আরবে এবার রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু কাজ করার উদ্দেশ্য পোষণ করতে লাগল। তাই নজদের অধিবাসী মুহাম্মদ ইবনে সাউদকে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাবের কাছে গোপনীয়ভাবে একজন প্রতিনিধি প্রেরণ করে ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্যগুলোর বিবরণ তুলে ধরা হয়। জোর দিয়ে বলা হয় যে, ধর্মীয় বিষয়ে সার্বিকভাবে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ থাকবে মুহাম্মদ ইবনে সাউদের দায়িত্বে। ইতিহাস স্যা দেয় যে, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় প্রভাব থেকে ধর্মীয় প্রভাব অধিক শক্তিশালী।
এ দু’ নেতাই নজদের অন্তর্গত ‘দরইয়া’ শহরকে তাদের রাজধানী নির্ধারণ করল। তাদেরকে মন্ত্রণালয় গোপনীয়ভাবে প্রচার আর্থিক ও পর্যাপ্ত দ্রব্যসামগ্রী দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা দিতে লাগল। মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার আওতায় কিছু গোলাম ক্রয় করেছে, সেগুলো মূলত উক্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশিণপ্রাপ্ত ব্যক্তি; যাদের আরবী ভাষার অভিজ্ঞতা ও গেরিলা যুদ্ধের দতা আছে। আমরা নজদের অধিবাসী মেয়েদের বিয়ে-শাদী শুরু করলাম। আমাদের এ কথাটি প্রশংসার সাথে স্বীকার করতে হয় যে, মুসলমানদের মেয়েদের প্রেম-ভালবাসা, নিষ্ঠা, পতিভক্তি ও স্বামী সেবা সত্যিই চমৎকার এবং প্রশংসনীয়। আমরা এভাবে আত্মীয়তা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে নজদীদের সাথে বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা এবং সুসম্পর্ক আরো দৃঢ় করতে পেরেছি।
এ সময়টিতে আমরা তাদের সাথে বন্ধুত্বের গভীরে অবস্থান করছি। আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার জাযীরাতুল আরবে নিজস্ব কর্তৃত্ব ও মতা প্রতিষ্ঠায় সফলতা লাভ করেছে। যদি কোন অনাকাক্সিত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয় তাহলে অতিসত্বর ইসলামী বিশ্বে আমাদের রোপিত বীজের চারা গজিয়ে ফলন্ত বৃে পরিণত হবে এবং আমরা তা থেকে আমাদের উদ্দেশ্যের ফল ভোগ করা যাবে।
সম্মানিত পাঠক!
ব্রিটিশ গোয়েন্দা মি. হামফ্রের ডাইরি থেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইহুদী-নাসারাদের সূক্ষ্ম অথচ ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের অধ্যায়ের কিছু নমুনা তুলে ধরা হল। একেতো প্রত্য ও পরোভাবে বিশ্ব মুসলিম ইঙ্গ-মার্কিনীদের হাতে সবদিকে নিপীড়িত হয়ে চরম সঙ্কটের ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, অন্যদিকে নিশ্চয় অনুধাবন করতে পারছেন- আজ যারা ইসলামের লেবাস নিয়ে, দ্বীন-ধর্মের দোহাই দিয়ে মুসলমান দাবী করে নবী, ওলী, মাশাইখসহ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের বিরুদ্ধে সব ধরনের চক্রান্ত ও শত্র“তায় লিপ্ত রয়েছে, সরকারের ভিতর ঢুকে সংসদে সুন্নী বিরোধী আইন পাস করছে, সুকৌশলে তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। ধর্মীয় বিভিন্ন নামের ব্যানারে রাজনৈতিক অরাজনৈতিক ও নানা সাংগঠনিক নতুন নতুন ইস্যু নিয়ে মিটিং-মিছিল আর স্লোগানে রাজপথ উত্তপ্ত করছে। যেমন তথাকথিত কওমী মাদরাসা নামের ওহাবী মাদরাসার সরকারী স্বীকৃতি দাবি নিয়ে মাঠে কোমর বেঁধে নেমেছে। আর কত কী। কখনো হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ছে মাযার ও ওরস অনুষ্ঠানে, আক্রমণ চালায় সুন্নী আলিম-ওলামা, জশনে জুলুসে ও মিলাদুন্নবীর মাহফিলে। শহীদ করে দিয়েছে অনেক সুন্নী পীর-মাশাইখে কেরামকে। মুফতী, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, শায়খুল হাদীস সেজে মাদরাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে আসন গেড়ে রয়েছে। আল মক্কী, আল মাদানী, আল জুবাইরী প্রভৃতি উপাধি ধারণ করে আওলাদে রাসুল (সৈয়দ) দাবি করে মুসলিম মিল্লাতকে ধোঁকা দিয়ে দেশ-বিদেশের বড় বড় জামে মসজিদগুলো দখল করে মুসলিম মিল্লাতকে ধোঁকা দিয়ে নবী-অলীর দুশমনদের আড্ডাখানা করে রেখেছে। অথচ নবীর প্রতি বৈরীভাব ছাড়া রসূলপ্রেমের কোন লণই তাদের কাছে নেই। যাঁরা নবীর প্রকৃত বংশ (সৈয়্যদ), নবীর সাথে রক্ত সম্পর্কে থাকার কারণে নবীর প্রেম ভালবাসা, শান-মান, মর্যাদা তাঁদের কাছে ভাল লাগবে, তাঁদের অস্তিত্ব ও মানসিকতার মধ্যে নবী প্রেম বিরাজ করা স্বাভাবিক। কিন্তু এরা নবীবংশ দাবি করে অথচ কোনদিন ভুলেও আহলে বাইতের কথা স্মরণ করে না। আশুরা দিবস পালন করাকে শিয়াদের কাজ বলে। ঈদে মিলাদুন্নবী, জশনে জুলুস, নাতে রাসূল, নারায়ে রিসালতের স্লোগান ও নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিরুদ্ধে ফতোয়াবাজী করে। মুসলিম জনগণকে নবীর রূহানী সম্পর্ক থেকে এবং প্রকৃত সৈয়দ থেকে দূরে সরিয়ে দেয় (না‘ঊযুবিল্লাহ)। তারা প্রকৃত সৈয়দ বা আওলাদ রসূল নয়। সৈয়দ কোনদিন নবীর প্রশংসা, মিলাদ-কিয়ামের বিরোধিতা এবং নবীর সমালোচনা করতে পারে না। তাহলে এরা কারা? কি তাদের উদ্দেশ্য? এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর হল তাদের উদ্দেশ্য- ইসলাম ও মুসলমান ধ্বংসে ইঙ্গ-মার্কিনীদের নীলনক্সা বাস্তবায়নকারী বিচণ গোয়েন্দা মি. হামফ্রের তৈরি করা মতবাদ ‘ওহাবী’ ধর্মের প্রচার, ইংরেজ ব্রিটিশের এজেন্ট মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাবের ভ্রান্ত আক্বীদা পোষণকারী ও অনুসারী হিসেবে তারা প্রকৃতপে ওহাবী এবং মি. হামফ্রের তৈরি করা (যা পূর্বে হামফ্রের বর্ণনায় এসেছে)। কারণ তারা মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাবের ভ্রান্ত আক্বীদা ও মতবাদ নিজেরা তো অনুসরণ করছেই এবং সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে (যেমন, জমিয়তে ওলামা-ই ইসলাম, নেজামে ইসলাম, খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোট, তাহাফ্ফুযে খতমে নবুয়ত, আরো বিভিন্ন নামে), প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, (যেমন উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠিত তাদের তথাকথিত কওমী মাদরাসাগুলো) আর এবং প্রকাশনার মাধ্যমে যেমন কোরআন হাদীসের বিকৃত অর্থ ও ব্যাখ্যা করে প্রকাশ করা আর তাদের বই পুস্তক ছাড়াও মাসিক মঈনুল ইসলাম, আদর্শ নারী ইত্যাদির প্রকাশনা ও প্রচারণা এেেত্র বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রাষ্ট্রীয়ভাবেও তারা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে ব্যাপক প্রচারকার্য চালিয়ে যাচ্ছে আর তা কার্যকর করছে।
এখানে আরেকটা বিষয় ল্যণীয় যে, এ উপমহাদেশে হামফ্রের হাতের পুতুল মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদীর প্রবর্তিত ওহাবী মতবাদ প্রচারের জন্য নিয়োজিত হয়েছিলেন ভারতের সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও তার সহযোগী মৌং ইসমা‘ঈল দেহলভী, যাদের উত্তরসূরি হিসেবে সুন্নী অঙ্গনে মুখোশ পরে পীর-মুরীদী করে যাচ্ছে অনেক বালাকোট প্রেমী সুন্নীবেশী ওহাবী, দ্বিতীয়ত ভারতের দেওবন্দ মাদরাসা, নদওয়াতুল ওলামা, আমাদের দেশের ওহাবী কওমী মাদরাসাগুলো, নূরানী মাদরাসাগুলো একই পরম্পরায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সর্বোপরি, সরলপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ওই ওহাবী ভাবধারার তাবলীগী জামাত, আর প্রতি বছর আয়োজন করে টঙ্গীসহ বিভিন্ন স্থানে তাবলীগী ইজতিমা।
এদিকে জঙ্গীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে বোমাবাজিসহ নানা অপকর্ম করে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানির মত’ তারা সব ধরনের অপরাধ থেকে পার পেয়ে যাচ্ছে। যেন তাদের মত সাধু আর কেউ নেই। সংক্রামক বিষাক্ত, মরণব্যাধির মত মুসলমানদের ঈমান ধবংসকারী বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে, পূর্ণগ্রাস করেছে বাংলাদেশকে। অতএব ঈমানদার মুসলমানদের, সবেেত্র তাদের ভ্রান্ত মত ও পথ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে। আল্লাহ্ তৌফিক দিন।