আহলে হাদীস নামধারী ভ্রান্ত ও লা-মাযহাবীদের খন্ডন (পর্ব-5)

আহলে হাদীস নামধারী ভ্রান্ত ও লা-মাযহাবীদের খন্ডন (পর্ব-5)

ইমামের পেছনে মুক্বতাদি ক্বিরআত সম্পন্ন করবে না

ইমামের পেছনে মুক্বতাদীর জন্য ক্বোরআন শরীফ পড়া (ক্বিরাআত) কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু গায়র মুক্বাল্লিদ ওহাবীরা মুক্বতাদীর উপর সূরা ফাতিহা পড়া ফরয বলে জানে। এ কাজটা করা নিষিদ্ধ হবার পক্ষে ক্বোরআন-ই করীম, বহু হাদীস শরীফ, শীর্ষস্থানীয় সাহাবা-ই কেরামের অভিমতগুলো এবং যুক্তিগ্রাহ্য বহু দলীল রয়েছে। সুতরাং আমি এ অধ্যায়কেও দু’টি পরিচ্ছেদ বিন্যস্থ করেছি। প্রথম পরিচ্ছেদে এ নিষেধের পক্ষে প্রমাণাদি আর দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে এর বিপক্ষে প্রশ্নাবলী (আপত্তিসমূহ) ও সেগুলোর খন্ডন উল্লেখ করেছি। আল্লাহ্ তা‘আলা ক্ববূল করুন!

প্রথম পরিচ্ছেদ
ইমামের পেছনে মুক্বতাদীর জন্য ক্বোরআন তিলাওয়াত করা নিষিদ্ধ, নিশ্চুপ থাকা জরুরী। দলীলাদি লক্ষ্য করুন-

আয়াত-১.
ক্বোরআন-ই করীম-এ এরশাদ হচ্ছে- وَاِذَا قُرِئَ الْقُرْانُ فَاسْتَمِعُوْا لَه وَاَنْصِتُوْا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ
তরজমা: এবং যখন ক্বোরআন শরীফ পড়া হয়, তখন সেটাকে কান লাগিয়ে শোনো এবং নিশ্চুপ থাকো, যাতে তোমাদের প্রতি দয়া করা হয়।
স্মর্তব্য যে, ইসলামের প্রারম্ভিককালে নামাযে দুনিয়াবী কথাবার্তা বলা জায়েয (বৈধ) ছিলো। আর মুক্বতাদী ক্বিরাআতও পড়তো, কথাবার্তাও বলতো। এটা এ আয়াত শরীফের মাধ্যমে মানসূখ (রহিত) হয়ে গেছে-

আয়াত-২
আল্লাহ্ তা‘আলা আরো এরশাদ ফরমান-وَقُوْمُوْا لِلهِ قَانِتِيْنَ
তরজমা: এবং দন্ডায়মান হও আল্লাহর জন্য আনুগত্যকারী হয়ে।
সুতরাং ইমাম মুসলিম ‘বা-বু তাহরী-মিল কালা-মি ফিস্ সালা-তি’ এবং ইমাম বোখারী ‘বা-বু মা-ইয়ুন্হা মিনাল কালামি ফিস্ সালা-তি’-এর মধ্যে হযরত যায়েদ ইবনে আরক্বাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বরাতে বর্ণনা করেছেন-
قَالَ كُنَّا نَتَكَلَّمُ فِى الصَّلاَةِ يُكَلِّمُ الرَّجُلْ صَاحِبَه وَهُوَ اِلى جَنْبِه فِى الصَّلٰوةِ حَتّى نَزَلَتْ وَقُوْمُوْا لِلهِ قَانِتِيْنَ فَاُمِرْ بِالسُّكُوْتِ وَنُهِيْنَا مِنْ الْكَلاَمِ
অর্থ: আমরা নামাযের অভ্যন্তরে কথাবার্তা বলে ফেলতাম। প্রত্যেকে নিজ নিজ সাথীর সাথে নামাযরত অবস্থায় কথোপকথন করতাম এ পর্যন্ত যে, এ আয়াত শরীফ অবতীর্ণ হয়েছে- ওয়া ক্বু-মূ-লিল্লাহি…। তারপর আমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে নিশ্চুপ থাকার এবং কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে।
এরপর থেকে নামাযে কথা বলা নিষিদ্ধ হলো; কিন্তু ক্বোরআন তিলাওয়াত মুক্বতাদী করতে থাকে। যখন এ আয়াত শরীফ অবতীর্ণ হলো তখন মুক্বতাদীর জন্য ক্বোরআন তিলাওয়াতও নিষিদ্ধ হয়ে গেলো, وَاِذَا قُرِئَ الْقُرْانُ فَاسْتَمِعُوْا… الاية ـ (এবং যখন ক্বোরআন পড়া হয় তখন তা মনযোগ সহকারে শোনো এবং নিশ্চুপ থাকো)।
সুতরাং ‘তাফসীর-ই মাদারিক’ শরীফে এ আয়াত ‘ওয়াইযা- ক্বুরিআল ক্বোরআনু-এর তাফসীরে উল্লেখ করা হয়েছে- وَجَمْهُوْرُ الصَّحَابَةِ عَلى اَنَّه فِى اسْتِمَاعِ الْمُؤْتَمِّ
অর্থ: আম সাহাবা-ই কেরামের অভিমত হচ্ছে এ আয়াত শরীফ মুক্বতাদী কর্তৃক ইমামের ক্বিরাআত শ্রবণ করার প্রসঙ্গেই।
‘তাফসীর খাযিন’-এ এ-ই আয়াত- وَاِذَا قُرِئَ (যখন ক্বোরআন পড়া হয়…)-এর ব্যাখ্যায় একটি বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে-
وَعَنْ اِبْنِ مَسْعُوْدٍ اَنَّه سَمِعَ نَاسًا يَقْرَءُوْنَ مَعَ الْاِمَامِ فَلَّمَا انْصَرَفَ قَالَ اَمَا أَنَّ لَكُمْ اَنْ تَفْقَهُوْا وَاِذَا قُرَئَ الْقُرْانُ
অর্থ: হযরত ইবনে মাস‘ঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু কিছু লোককে ইমামের সাথে ক্বোরআন পড়তে শুনেছেন। যখন নামায শেষ করলেন, তখন বললেন, এখনো কি এ সময় আসেনি যে, তোমরা এ আয়াতের মর্মার্থ বুঝবে- ‘এবং যখন ক্বোরআন পড়া হয়…’?
‘তানভীর-ই মিক্ব্ইয়াস মিন তাফসীর-ই ইবনে আব্বাস’ শরীফে এ আয়াতের তাফসীরে আছে-
وَاِذَا قُرِئَ الْقُرْانُ فِى الصَّلاَةِ الْمَكْتُوْبَةِ فَاسْتَمِعُوْا لَه اِلى قِرَأَتِه وَاَنْصِتُوْا لِقِرَاَتِه
অর্থ: যখন ফরয নামাযে ক্বোরআন পড়া হয়, তখন সেটার ক্বিরাআত কান পেতে শোনো এবং ক্বোরআন পঠিত হওয়ার সময় নিশ্চুপ থাকো।
আমার এ গবেষণালব্ধ বর্ণনা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইমামের পেছনে মুক্বতাদী ক্বিরাআত সম্পন্ন করতেন। এ আয়াত শরীফ নাযিল হবার পর ইমামের পেছনে ক্বিরাআত মানসূখ (রহিত) হয়ে গেছে। এখন হাদীস শরীফগুলো দেখুন-

হাদীস নং-১
‘মুসলিম শরীফ: বাবু সুজূ-দিত্ তিলাওয়াত’- এ হযরত আত্বা ইবনে ইয়াসির রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত-
اَنَّه سَأَلَ زَيْدَ بْنَ ثَابِتٍ عَنِ الْقِرَأَةِ مَعَ الْاِمَامِ فَقَالَ لاَ قِرَأَةَ مَعَ الْاِمَامِ فِىْ شَئٍ
অর্থ: তিনি হযরত যায়দ ইবনে সাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু (সাহাবী)কে ইমামের সাথে ক্বিরাআত সম্পন্ন করা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তদুত্তরে তিনি বললেন, ‘‘ইমামের সাথে ক্বিরাআত মোটেই জায়েয নয়।’’

হাদীস নং-২
‘মুসলিম শরীফ: বাবুত্ তাশাহ্হুদ’-এ বর্ণিত হয়েছে-
فَقَالَ لَه اَبُوْبَكْرٍ فَحَدِيْثُ اَبِىْ هُرَيْرَةَ فَقَالَ هُوَ صَحِيْحٌ يَعْنِىْ وَاِذَا قُرِئَ فَاَنْصِتُوْا
অর্থ: আবূ বকর সালমানকে জিজ্ঞাসা করলেন, হযরত আবূ হোরায়রার হাদীস কেমন? তদুত্তরে তিনি বললেন, ‘‘একেবারে সহীহ্ (বিশুদ্ধ)।’’ অর্থাৎ এ-ই হাদীস ‘‘যখন ইমাম ক্বিরাআত সম্পন্ন করে, তখন নিশ্চুপ থাকো!’’ একেবারে বিশুদ্ধ।

হাদীস নং-৩
ইমাম তিরমিযী তাঁর তিরমিযী শরীফে হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বরাতে বর্ণনা করেন-
مَنْ صَلَّى رَكْعَةً ثُمَّ يَقْرَاُ فِيْهَا بِاُمِّ الْقُرْانِ فَلَمْ يُصَلِّ اِلاَّ اَنْ يَّكُوْنَ وَرَاَءَ الْاِمَامِ ـ هذَا حَدِيْثٌ حَسَنٌ صَحِيْحٌ
অর্থ: যে কেউ নামায পড়ে, তাতে সূরা ফাতিহা না পড়ে, সে নামাযই পড়েনি; কিন্তু যদি ইমামের পেছনে পড়ে থাকে। (অর্থাৎ তখন যদি সূরা ফাতিহা না পড়ে, তবে নামায শুদ্ধ হবে।) এ হাদীস শরীফ ‘হাসান- সহীহ্’ পর্যায়ের।

হাদীস নং-৪
নাসাঈ শরীফে হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর সূত্রে বর্ণিত-
قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اِنَّمَا جُعِلَ الْاِمَامُ لِيُؤْتَمَّ
بِه فَاِذَا كَبَّرَ فَكَبِّرُوْا وَاِذَا قَرَأَ فَاَنْصِتُوْا
অর্থ: হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ইমাম এ জন্য নিয়োগ করা হয়েছে যেন তাঁর অনুসরণ করা হয়। সুতরাং তিনি যখন তাকবীর বলেন, তখন তোমরাও তাকবীর বলো, আর যখন তিনি ক্বিরাআত সম্পন্ন করেন, তখন তোমরা নিশ্চুপ থাকো।
আমি হাদীস নং ২-এ মুসলিম শরীফের বরাতে বর্ণনা করেছি যে, হযরত আবূ হোরায়রার এ হাদীস সহীহ্ (সঠিক)।

হাদীস নং-৫
তাহাভী শরীফে হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বরাতে বর্ণিত-
اَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَنْ كَانَ لَه اِمَامٌ فَقِرَأَةُ الْاِمَامِ لَه قِرَأَةٌ
অর্থ: নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যার ইমাম থাকেন, তখন ইমামের তিলাওয়াত তারই তিলাওয়াত।

হাদীস নং- ৬-১০
ইমাম মুহাম্মদ মুআত্তা শরীফে, ইমাম আবূ হানীফা মূসা ইবনে আবূ আয়েশা থেকে, তিনি আবদুল্লাহ্ ইবনে শাদ্দাদ থেকে, তিনি হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ থেকে বর্ণনা করেছেন-
اَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَنْ كَانَ لَه اِمَامٌ فَقِرَأَةُ الْاِمَامِ لَه قِرَاَةٌ ـ قَالَ مُحَمَّدُ بْنُ مَنِيْعٍ وَاِبْنُ الْهُمَامِ هذَا الْاِسْنَادُ صَحِيْحٌ عَلى شَرْطِ الشَّيْخَيْنِ
অর্থ: হুযূর নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যার ইমাম থাকে, তবে ইমামের তিলাওয়াত তারই তিলাওয়াত। মুহাম্মদ ইবনে মানী’ ও ইমাম ইবনে হুমাম বলেছেন, এ সনদ সহীহ এবং ইমাম মুসলিম ও ইমাম বোখারীর শর্তানুরূপ।
এ হাদীস সর্ব ইমাম আহমদ, ইবনে মাজাহ্, দারু ক্বুত্বনী বায়হাক্বীও বর্ণনা করেছেন। [সহীহুল বিহারী]

হাদীস-১১
ত্বাহাভী শরীফে হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বরাতে বর্ণিত-
قَالَ صَلّى رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثُمَّ اَقْبَلَ بِوَجْهِه فَقَالَ اَتَقْرَءُوْنَ اَلْاِمَامُ يَقْرَاُ فَسَكَتُوْا فَسَاَلَهُمْ ثَلثًا فَقَالُوْا اِنَّا لَنَفْعَلُ قَالَ فَلاَ تَفْعَلُوْا
অর্থ: হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, একবার হুযূর-ই আক্রাম নামায পড়িয়েছেন। তারপর সাহাবীদের দিকে চেহারা মুবারক ফেরালেন। আর এরশাদ করলেন, তোমরা কি ইমাম ক্বিরাআত সম্পন্ন করার অবস্থায় তিলাওয়াত করো? সাহাবীগণ নিশ্চুপ রইলেন। হুযূর-ই আক্রাম এটা তিনবার জিজ্ঞাসা করলেন। তখন সাহাবীগণ আরয করলেন, ‘‘হ্যাঁ আমরা এমনটি করি’’। হুযূর এরশাদ করলেন, ‘‘আগামীতে এমন করোনা।’’

হাদীস নং-১২
ত্বাহাভী শরীফে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বরাতে বর্ণিত-
مَنْ قَرَأَ خَلْفَ الْاِمَامِ فَلَيْسَ عَلى فِطْرَةٍ
অর্থ: যে ব্যক্তি ইমামের পেছনে তিলাওয়াত করে, সে ‘দ্বীন-ই ফিত্বরাত’-এর উপর নেই।

হাদীস নং-১৩
ইমাম দারু ক্বুত্বনী হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বরাতে বর্ণনা করেছেন-
اَنَّه قَالَ قَالَ رَجُلٌ لِلنَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَقْرَأُ خَلْفَ الْاِمَامِ اَوْ اِنْصِتُ قَالَ بَلْ اَنْصِتْ فَاِنَّه يَكْفِيْكَ
অর্থ: নিশ্চয় তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র দরবারে আরয করলেন, ‘‘আমি কি ইমামের পেছনে ক্বিরাআত করবো না নিশ্চুপ থাকবো?’’ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘‘বরং তুমি নিশ্চুপ থাকো। কারণ তা তোমার জন্য যথেষ্ট হবে।’’

হাদীস নং-১৪
ইমাম দারু ক্বুত্বনী হযরত শা’বী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বরাতে বর্ণনা করেছেন-
اَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لاَ قِرَأَةَ خَلْفَ الْاِمَامِ
অর্থ: নিশ্চয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘‘ইমামের পেছনে তিলাওয়াত করা জায়েয নয়।’’

হাদীস নং-১৫
ইমাম বায়হাক্বী ক্বিরাআতের আলোচনায় হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বরাতে বর্ণনা করেছেন-
أَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ كُلُّ صَلواةٍ لمْ يُقْرَأُ فِيْهَا بِاُمِّ الْكِتَابِ فَهِىَ خِدَاجٌ اِلاَّ صَلواةً خَلْفَ الْاِمَامِ
অর্থ: নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে নামাযে সূরা ফাতিহা পড়া হয় না, তা অপরিপূর্ণ। ওই নামায ব্যতীত, যা ইমামের পেছনে পড়া হয়।

হাদীস নং ১৬-১৭
ইমাম মুহাম্মদ ‘মুআত্তা’য়, ইমাম আবদুর রায্যাক্ব তাঁর ‘মুসান্নাফ’-এ হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বরাতে বর্ণনা করেছেন-
قَالَ لَيْتَ فِىْ فَمِ الَّذِىْ يَقْرَأُ خَلْفَ الْاِمَامِ حَجَرًا
অর্থ: তিনি বলেন, আহা, যদি ইমামের পেছনে তিলাওয়াতকারীর মুখগহ্বরে পাথর পুরে দেওয়া হতো!

হাদীস নং ১৮-২৪
ইমাম ত্বাহাভী হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাস‘ঊদ, হযরত যায়দ ইবনে সাবিত হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে ওমর, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস, হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্, হযরত আলক্বামাহ্, হযরত আলী মুরতাদ্বা ও হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম প্রমুখ সাহাবা-ই কেরাম থেকে পরিপূর্ণ সনদগুলো এ মর্মে বর্ণনাদি সহকারে পেশ করেছেন যে, এসব হযরত ইমামের পেছনে ক্বিরাআতের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কোন সাহাবী বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি ইমামের পেছনে তিলাওয়াত করবে, তার মুখে যেন আগুন পুরে দেওয়া হয়।’’ ‘‘কেউ বলেছেন, ‘‘তার মুখে যেন পাথর পুরে দেওয়া হয়।’’ অন্য কেউ বলেছেন, ‘‘সে দ্বীন-ই ফিত্বরাতের বিরোধী।’’ যদি আমি এ কিতাবের পরিসর বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা না করতাম, তবে ওইসব বর্ণনা (রেওয়ায়ত) এখানে উল্লেখ করতাম।
এতদ্ব্যতীত ইমামের পেছনে ক্বিরাআত সম্পন্ন করার বিপক্ষে অনেক হাদীস রয়েছে, যেগুলো থেকে আমি শুধু ২৪টি হাদীস উল্লেখ করে ক্ষান্ত হলাম। যদি কেউ ওইগুলো পাঠ- পর্যালোচনা করার আগ্রহ রাখেন, তবে যেন ত্বাহাভী শরীফ, মুআত্তা-ই ইমাম মুহাম্মদ, সহীহুল বিহারী ও আমার হাশিয়া-ই বোখারী ‘নঈমুল বারী’, ইত্যাদি পাঠ-পর্যালোচনা করেন।
আক্বল বা বিবেকও চাচ্ছে যেন মুক্বতাদী ইমামের পেছনে তিলাওয়াত না করে। তাও কয়েকটা কারণে-
এক. নামাযে যেমন সূরা ফাতিহা পাঠ করা জরুরী, তেমনি সূরা মিলানোও জরুরী। মুসলিম শরীফে আছে-
لاَ صَلوةَ لِمَنْ لَّمْ يَقْرَأْ بِاُمِّ الْقُرْانِ فَصَاعِدًا
অর্থ: তার নামায হয় না, যে সূরা ফাতিহা এবং আরো কিছু না পড়ে।
গায়র মুক্বাল্লিদগণ (লা-মাযহাবীরা)ও একথা মানে যে, মুক্বতাদী ইমামের পেছনে সূরা পড়বে না।
সুতরাং সূরা ফাতিহাও না পড়া উচিৎ হবে। কারণ, যেমন সূরার বেলায় ইমামের ক্বিরাআত যথেষ্ট, তেমনি সূরা ফাতিহার বেলায়ও যথেষ্ট হওয়া চাই।
দুই. যে কেউ রুকূ’তে ইমামের সাথে মিলিত হয়, সে ওই রাক্‘আত পেয়ে যায়। যদি মুক্বতাদীর উপর সূরা ফাতিহা পড়া অপরিহার্য হতো, তবে সে রাক্‘আত পেয়েছে বলে বিবেচিত না হওয়া উচিৎ ছিলো। দেখুন, যদি এ ব্যক্তি তাকবীর-ই তাহরীমা না বলে, অথবা তাকবীর-ই তাহরীমার সাথে এক তাসবীহর সমপরিমাণ ক্বিয়াম না করে; বরং সোজা রুকূ’তে চলে যায়, তবে সে ওই রাক্‘আত পাবে না, কেননা তাকবীর-ই তাহরীমা ও ক্বিয়াম মুক্বতাদীর উপর ফরয; অনুরূপ, যদি তার উপর সূরা ফাতিহা পড়া ফরয হতো, তবে তা ব্যতীত রাক্‘আত পাওয়া যেতোনা।
বুঝা গেলো যে, ইমামের ক্বিরাআত তার জন্য যথেষ্ট। যখন ওই মুক্বতাদীকে ক্বিরাআত থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, তখন উচিৎ হবে অন্যান্য মুক্বতাদীকেও অব্যাহতি দেওয়া।
তিন. যদি মুক্বতাদীর উপর ‘সূরা ফাতিহা’ পড়াও অপরিহার্য হয় আর ‘আ-মী-ন’ বলাও, তবে বলো, যদি ইমাম মুক্বতাদীর পূর্বে সূরা ফাতিহা পড়ে শেষ করে নেন, আর এ মুক্বতাদী, যে এখন সূরা ফাতিহার মধ্যখানে রয়েছে, তবে সে ‘আ-মী-ন’ বলবে কিনা? আর সে নিজে যেই সূরা ফাতিহা পড়ছে, সেটার পর সে আ-মী-ন বলবে কিনা? এ প্রশ্নের যে জবাবই দেবেন, হাদীস দেখিয়ে (হাদীসের আলোকে) দেবেন। বস্তুত: না দু’বার ‘আ-মী-ন’ বলা জায়েয, না সূরা ফাতিহার মধ্যভাগে ‘আ-মী-ন’ বলা দুরস্ত আছে।
চার. যদি মুক্বতাদী সূরা ফাতিহার মধ্যখানে থাকে, আর ইমাম রুকূ’তে চলে যান, তবে বলো, এ মুক্বতাদী কি সূরা ফাতিহার বাকী অর্দ্ধেক ছেড়ে দেবে, না রুকূ’ ছেড়ে দেবে? এর যে জবাবই দেবেন, হাদীসের আলোকে, হাদীস দেখিয়ে দেবেন; নিজের বিবেক বা যুক্তির আলোকে জবাব দেবেন না।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আহলে হাদীসের সব আলিমের প্রতি আম ঘোষণা- এ ২,৩ ও ৪নং প্রশ্নের উত্তরগুলো সবাই মিলে পরামর্শ করে দিন; কিন্তু শর্ত হচ্ছে- সুস্পষ্ট হাদীস দ্বারা দেবেন; নিজেদের নিছক অভিমত দ্বারা দেবেন না। ইনশা-আল্লাহ্, দিতেও পারবেন না। সুতরাং উচিৎ হবে জেদ্ ছাড়–ন, হানাফীদের মতো ক্বোরআন-হাদীসের নির্দেশ অনুসারে আমল করুন! ইমামের অর্থাৎ ইমামের পেছনে ক্বিরাআত সম্পন্ন করবেন না।
পাঁচ. শাহী দরবারে যখন কোন প্রতিনিধি দল যায়, তখন দরবারের আদাব (নিয়ামাবলী) সবাই পালন করে; কিন্তু বাদানুবাদ সবাই করেন না, যিনি মুখপাত্র হন তিনিই করেন। অনুরূপ, জামা‘আত সহকারে নামায সম্পন্নকারী মহান রবের দরবারে প্রতিনিধি দলের আকারে হাযির হন। তখন তাকবীর, তাসবীহ্, ও তাশাহ্হুদ ইত্যাদি সবাই পড়বেন। এটা হচ্ছে ওই দরবারের সালামীর প্রদর্শনী। এটা সবাই প্রদর্শন করবেন। কিন্তু ক্বোরআন তিলাওয়াত, যা হচ্ছে আবেদন-নিবেদনই, শুধু সম্প্রদায়ের (জাতি) প্রতিনিধি (মুখপাত্র)-ই করবেন; অর্থাৎ ইমাম।

দ্বিতীয় পরিচ্ছদ
[এ মাসআলার বিপক্ষে আনীত কিছু প্রশ্ন ও সেগুলোর জবাব]
এ মাসআলায় ‘গায়র মুক্বাল্লিদগণ’ এ পর্যন্ত যে সব আপত্তি করতে পেরেছে, আমরা আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহক্রমে, প্রত্যেকটা আপত্তি উদ্ধৃত করে সব ক’টির জবাব পৃথক পৃথকভাবে দিয়ে থাকি। আর যে পদ্ধতিতে তাদের প্রশ্নগুলো আমরা উদ্ধৃত করছি, ইনশা-আল্লাহ্ ওই নিয়মে তারাও করতে পারবেনা। মহামহিম রব কবূল করুন।

আপত্তি নম্বর -১
আয়াত শরীফ- وَاِذَا قُرِئَ الْقُرْانُ -তে ‘ক্বোরআন’ মানে জুমু‘আহ্র খোৎবা, মুক্বতাদীর নামায নয়, যেমনটি কোন কোন তাফসীরকারক এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন। সুতরাং জুমু‘আহর খোৎবা প্রদানের সময় নিশ্চুপ থাকা জরুরি; তবে মুক্বতাদির জন্য ‘সূরা ফাতিহা’ পড়া নিষিদ্ধ নয়।

জবাব
এ কথা ভুল। কেননা এ আয়াত শরীফ মক্কী (হিজরতের পূর্বে নাযিল হয়েছে)। সূরা আ’রাফের এ আয়াত। আর জুমু‘আহ্র নামায ও খোৎবা মদীনা মুনাওয়ারায় হিজরতের পর আরম্ভ হয়েছে। সুতরাং এ আয়াতে জুমু‘আহর খোৎবার কথা কিভাবে বুঝানো হতে পারে?

দ্বিতীয়ত যদিও কিছুক্ষণের জন্য, অসম্ভব কল্পনায়, তা মেনেও নেয়া হয় তবুও যেহেতু আয়াতে খোৎবার শর্তারোপ করা হয়নি, শুধু ক্বোরআন পাঠের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেহেতু এ নির্দেশ সব ক’টি বিষয়ে প্রযোজ্য। কেননা, আয়াতে ব্যাপকতাই বিবেচ্য। আয়াতটি সেটার শানে নুযূল বা অবতরণের প্রেক্ষাপটের সাথেও খাস নয়।

তৃতীয়ত যখন খোৎবায় লোকজনকে কিছু বলা হারাম, অথচ পূর্ণ খোৎবা তো ক্বোরআন নয় বরং তাতে ক্বোরআনের দু’/একটি আয়াত শরীফ পাঠ করা হয়,

ইমামের পেছনে, যখন পূর্ণ ক্বোরআন পড়া হয়, তখন নিশ্চুপ থাকা কেন জরুরী হবে না? আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ওহে লা মাযহাবীরা! আপনারা জুমু‘আহ্র খোৎবা পড়ার সময় নিশ্চুপ থাকা জরুরী বলেন, কিন্তু ইমামের পেছনে নিশ্চুপ থাকতে নিষেধ করছেন!

আপত্তি নম্বর-২
আয়াত শরীফ-وَاِذَا قُرِئَ -এর মধ্যে মক্কার মুশরিকদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে; যারা হুযূর-ই আকরামের ক্বোরআন তিলাওয়াতের সময় শোর-চিৎকার করতো আর আয়াতের মর্মার্থ হচ্ছে- ‘ক্বোরআন পাঠের সময় দুনিয়াবী কথাবার্তা বলে শোরগোল করোনা; সুতরাং (ইমামের পেছনে) সূরা ফাতিহা পড়া এ নিষেধের আওতায় পড়ে না।

জবাব
এটাও ভুল কথা। আয়াতে সম্বোধন শুধু মুসলমানদেরকে করা হয়েছে। কেননা, কাফিরদের উপর কোন ইবাদত অপরিহার্য নয়, যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে। ক্বোরআন শোনাও ইবাদত। এটা তাদের (মুশরিকগণ) উপর ঈমান না আনলে কীভাবে ওয়াজিব হবে?

দ্বিতীয়ত আয়াত শরীফের শেষ ভাগে আছে- لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ (যাতে তোমাদের উপর দয়া করা হয়)। ক্বোরআন শুনলে রহমত শুধু মুসলমানদের উপর বর্ষিত হয়; কাফির ঈমান না এনে যে কোন নেক কাজ করুক না কেন, রহমত পাবার উপযোগী হতে পারে না। মহান রব এরশাদ ফরমাচ্ছেন- مِنْهُمْ مَنْ يَّسْتَمَعُ اِلَيْكَ وَجَعَلْنَا عَلٰى قُلُوْبِهِمْ اَكِنَّةً অর্থাৎ ‘‘কোন কোন কাফির আপনার দিকে কান লাগিয়ে শোনে। আমি তাদের হৃদয়ের উপর পর্দা ঢেলে দিয়েছি।’’ দেখুন, কাফিরদের মনযোগ সহকারে শোনা তাদের কোন উপকারে আসেনি।

অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে-
وَقَدِمْنَا اِلى مَا عَمِلُوْا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاءً مَّنْثُوْرًا অর্থাৎ তারা যা কিছু আমল করেছিলো আমি ইচ্ছা করে সেগুলোকে সূক্ষ্ম বালি কণার ন্যায় করে দিয়েছি।

যদি কাফির গোটা ক্বোরআন মুখস্থও করে নেয় আর প্রতিদিন তিলাওয়াতও করে, তবুও তারা সাওয়াবের উপযোগী হবে না। ওযূ ব্যতীত নামায শুদ্ধ হয় না। ঈমান ব্যতীত কোন আমল কবূল হয় না।

তৃতীয়ত ক্বোরআন করীমে এরশাদ হয়েছে- وَاَنْصِتُوْا (এবং তোমরা নিশ্চুপ থাকো)। এ নিশ্চুপ থাকার মানে হচ্ছে- না কথাবার্তা বলো, না কোন কিছু পাঠ করো। যদি সূরা ফাতিহা পড়তে থাকো, তবে নিশ্চুপ রইলে কি করে? মোটকথা, না এ আয়াত কাফিরদের উদ্দেশে নাযিল হয়েছে, না জুমু‘আর খোৎবার জন্য; বরং নামাযীদেরকে ইমামের পেছনে ক্বিরআত থেকে বিরত থাকার জন্য নাযিল হয়েছে। সুতরাং বায়হাক্বী শরীফে হযরত মুজাহিদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত-
قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقْرَأُ فِى الصَّلٰوةِ فَسَمِعَ قِرْأَةَ فَتًى مِّنَ الْاَنْصَارِ فَنَزَلَ وَاِذَا قُرِئَ الْقُرْاٰنُ ..الخـ
অর্থাৎ তিনি বলেন, হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নামাযে ক্বিরআত সম্পন্ন করছিলেন। তিনি এক আনসারী যুবকের ক্বিরআত শুনতে পেলেন। তখন এ আয়াত শরীফ নাযিল হয়েছেঃ ‘‘এবং যখন ক্বোরআন পড়া হয়…।’’ [সহীহ্-ই বিহারী]

ইবনে মরদুয়াইহ্ তাঁর তাফসীরগ্রন্থে সনদ সহকারে হযরত মু‘আভিয়া ইবনে র্ক্বুরাহ্ থেকে বর্ণনা করেছেন; তিনি হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মুগাফ্ফাল সাহাবী-ই রসূলকে এ আয়াত শরীফের অবতরণের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি জবাবে বললেন-
قَالَ اِنَّمَا نَزَلَتْ هٰذِه الْايَةُ وَاِذَا قُرِئَ الْقُرْاٰنُ الخـ فِى الْقِرْأَةِ خَلْفَ الْاِمَامِ ـ وَاِذَا قَرَأَ الْاِمَامُ فَاسْتَمِعْ لَه وَاَنْصِتْ [بهارى] অর্থাৎ এ আয়াত وَاِذَا قُرِئَ الخـ ইমামের পেছনে ক্বিরআতের প্রসঙ্গে নাযিল হয়েছে। সুতরাং যখন ইমাম ক্বিরাআত সম্পন্ন করেন, তখন তোমরা মনযোগ সহকারে শোনো এবং চুপ থাকো। [সহীহ্-ই বিহারী]

আপত্তি নম্বর -৩
যদি ক্বোরআন তিলাওয়াতের সময় সবাইকে নিশ্চুপ থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়, তবে তো মুসীবৎ এসে যাবে। আজকাল রেডিওতে ক্বোরআন তিলাওয়াত করা হয়, যা সমগ্র দেশে শোনা যায়, সুতরাং সবার কাজ-কারবার, সালাম-কালাম হারাম হয়ে যাবে। ইমাম তারাবীহ্ পড়াচ্ছেন। এক ব্যক্তি আসলো, যে তখনো ফরয পড়েনি; অথচ সে ওই মসজিদে এশার ফরয পড়ে থাকে; যেখানে ‘ক্বিরআত’ (ক্বোরাআন তিলাওয়াত)-এর আওয়াজ আসছে। এটাও তো হারাম হয়ে যাবে। মোটকথা, এ ‘মর্মার্থ’ উম্মতের জন্য অসহনীয় কষ্টের কারণ হয়ে যাবে। [বর্তমানকার ওহাবী প্রশ্নকর্তা]

জবাব
সমস্ত উম্মতের ঐকমত্য একথার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, ক্বোরআনের তিলাওয়াত শোনা ‘ফরয-ই কেফায়া’; ‘ফরয-ই আইন’ নয়। যদি ক্বারীর ক্বিরাআত একজন মুসলমানও শুনে, তাহলে যথেষ্ট; যেমন জানাযার নামায। তা যদিও সবার উপর ফরয, কিন্তু একজন পড়ে নিলে সবাই দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে। ইমামের পেছনে সকল মুক্বতাদী ‘এক ব্যক্তি’ বলে বিবেচিত। যেমন জানাযার নামাযের জমা‘আত। সুতরাং মুক্বতাদীদের মধ্য থেকে তো কেউ সালাম – কালাম ও তিলাওয়াত করতে পারে না। যারা মুক্বতাদী হয়নি, তাদের জন্যও ওইসব মুক্বতাদীর শোনা যথেষ্ট হয়ে যাবে। অবশ্য যদি সবলোক কাজ-কারবারে ব্যস্ত থাকে, কেউ না শোনে, তাহলে উচ্চ আওয়াজে তিলাওয়াত করা নিষিদ্ধ। অনুরূপ, এক মজলিসে কয়েকজন লোক উচ্চস্বরে ক্বোরআন-ই করীম তিলাওয়াত করা নিষিদ্ধ। সুতরাং হয়তো একজন তিলাওয়াত করবে, সবাই শুনবে, অথবা সবাই বিনা আওয়াজে পাঠ করবে। এর গবেষণাধর্মী বিবরণ ‘শামী’ ইত্যাদি ফিক্বহ্-ফাত্ওয়ার কিতাবে দেখুন। সুতরাং তখন না কোন বিপদ হবে, না কোন মুসীবৎ।

আপত্তি নম্বর -৪
এ থেকে একথা অপরিহার্য হয়ে যায় যে, (এমনটি হলে) মকতবে একাধিক শিশু একসাথে ক্বোরআন শরীফ উচ্চ আওয়াজে শিখতে বা মুখস্থ করতে পারবেনা। এটাতো আরেক মহা সমস্যা!

জবাব
ওখানে তো ক্বোরআন শিক্ষা দেয়া হয়, নিছক তিলাওয়াত করা হয় না। তিলাওয়াত শোনা ফরয, তবে ক্বোরআন শিক্ষা দেওয়ার সময় শোনা (ফরয) নয়। এ কারণে মহান রব এরশাদ করেছেন- اِذَا قُرِئَ (যখন তিলাওয়াত করা হয়); اِذَا تُعَلَّمُ (যখন শিক্ষা দেওয়া হয়) এরশাদ করেননি।
দেখুন, মহামহিম রব এরশাদ ফরমাচ্ছেন-
اِذَا قَرَأْتَ الْقُرْانَ فَاسْتَعِذْ بِاللهِ (যখন তুমি ক্বোরআন পড়ার ইচ্ছা করো, তখন ক্বোরআন তিলাওয়াতের পূর্বক্ষণে ‘আঊযুবিল্লাহ্’ পড়ো। কিন্তু যখন ছাত্র শিক্ষককে ক্বোরআন শোনায়, তখন ‘আ‘ঊযু’ পড়বেনা। কারণ, এটা ক্বোরআনের নিছক তিলাওয়াত নয়; বরং ক্বোরআন শিক্ষা দেওয়া। [সূত্র. ফাতাওয়া-ই শামী ইত্যাদি] অনুরূপ, ক্বোরআন মজীদ উল্টো বিন্যাসে ছাপানো নিষিদ্ধ; বরং সঠিক বিন্যাসে ছাপানো জরুরী। কিন্তু শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য সর্বশেষ পারা (আমপারা) উল্টোভাবে ছাপানোও হয়, উল্টো দিক থেকে পড়ানোও হয়।
শিক্ষাদান ও ক্বিরাআত (তিলাওয়াত)-এর বিধানের মধ্যে পার্থক্য আছে। ক্বোরআন করীমও তিলাওয়াত ও তা’লীমের মধ্যে পার্থক্য করেছে। মহান রব এরশাদ ফরমাচ্ছেন- يَتْلُوْا عَلَيْهِمْ اٰيَاتِه وَيُزَكِّيْهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ الخـ (অর্থাৎ: ওই নবী মুসলমানদের নিকট আয়াতগুলো তিলাওয়াত করছেন এবং তাদেরকে পবিত্র করছেন; তাদেরকে ক্বোরআন ও হিকমত শিক্ষা দিচ্ছেন)। যদি তিলাওয়াত ও শিক্ষাদানের মধ্যে পার্থক্য না থাকতো, তাহলে ওই দু’টিকে পৃথক পৃথকভাবে কেন এরশাদ করেছেন?

আপত্তি নম্বর-৫
আপনাদের (হানাফী সুন্নীগণ) পেশকৃত হাদীস শরীফ-قِرْأَةُ الْاِمَامِ لَهٗ قِرَأَةٌ এবং وَاِذَا قُرِئَ فَاَنْصِتُوْا (যথাক্রমে, ইমামের ক্বিরআত মুক্বতাদীদের জন্য যথেষ্ট এবং যখন ক্বিরআত করা হয় তখন তোমরা নিশ্চুপ থাকো)-এর মধ্যে قِرَأَة শব্দ এসেছে, যার অর্থ ‘পাঠ করা’। সুতরাং এ হাদীস দু’টির মর্মার্থ হলো- ‘যখন ইমাম পড়বেন, তখন তোমরা নিশ্চুপ থাকো’। তিনি যাই পড়–ন না কেন? ক্বোরআন পড়–ন কিংবা অন্য কিছু। সুতরাং ইমামের পেছনে ‘সুবহানাল্লাহ্’, ‘আত্তাহিয়্যাত’ ও দুরূদ শরীফ ইত্যাদিও পড়া যাবেনা; কারণ, ইমামতো পড়ছেন। (প্রশ্নকর্তা: বর্তমানকার বিবেকবান বলে দাবীদার ওহাবী।)

জবাব
এর দু’টি জবাব দেওয়া যায়ঃ একটা ‘ইলযামী’ (তাদের কথার ভিত্তিতে), আর অপরটি গবেষণাভিত্তিক। প্রথমোক্ত পদ্ধতিতে জবাব হচ্ছে- যদি এভাবে শব্দগুলোর আভিধানিক অর্থই নেওয়া হয়, তবে হে (লা-মাযহাবীরা!) আপনারাও বিপদে পড়বেন। যেমন- আপনারা নিজেদেরকে ‘আহলে হাদীস’ বলে দাবী করে থাকেন; অথচ ‘হাদীস’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘কথাবার্তা’, ‘কিচ্ছা-কাহিনী’। যেমন- আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমাচ্ছেন- فَبِاَىِّ حَدِيْثٍ بَعْدَه يُؤْمِنُوْنَ অর্থাৎ এরপর তারা কোন্ কথার উপর ঈমান আনবে? আরো এরশাদ হচ্ছে- فَجَعَلْنَاهُمْ اَحَادِيْثَ অর্থাৎ: আমি ওই জনগোষ্ঠীকে কিচ্ছা-কাহিনীতে পরিণত করে দিয়েছি। সুতরাং ‘আহলে হাদীস’-এর অর্থ দাঁড়ায় হয়তো মনগড়া কথাবার্তা রচনাকারী বাচাল, অথবা কিচ্ছা-কাহিনী ও নভেল পাঠক কিংবা পড়ে শোনায় এমন কিছুলোক।

শুনুন, এখানে ‘হাদীস’ শব্দের পারিভাষিক অর্থ বুঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ‘ফরমান’ বা পবিত্র ‘বাণী’। ‘ওহী’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘ইঙ্গিত’। ‘ইসলাম’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘আনুগত্য করা’ আর ‘কলেমা’র অর্থ ‘লফয’ (মুখ থেকে নিক্ষেপ করা)। পবিত্র ক্বোরআনে এসব শব্দ এসব (আভিধানিক) অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে। বলুন, এখন কোথায় যাবেন? (এভাবে অর্থ করলে) সম্পূর্ণ ইসলামই শেষ হয়ে যাবে, ক্বোরআনের বিধানগুলো নিঃশেষ হয়ে যাবে।

আর গবেষণাভিত্তিক জবাব হচ্ছে- নামাযের কথা উল্লেখ করার সময় যখন ‘ক্বিরাআত (قِراة) শব্দটা বলা হয়, তখন তা দ্বারা ‘ক্বোরআন তিলাওয়াত’ বুঝায়। আমরা বলি নামাযের ছয়টি ‘রুকন’ আছে- তাকবীর-ই তাহ্রীমাহ্, ক্বিয়াম, ক্বিরাআত, রুকূ’, সাজদাহ্ এবং শেষ বৈঠক অর্থাৎ আত্তাহিয়্যাত পড়ার জন্য বসা। এখানে ‘ক্বিয়াম’ মানে ‘নর্তন করার জন্য দাঁড়ানো’ নয়, ‘ক্বিরআত’ মানেও ‘নভেল পড়া’ নয়। কাজেই, একটু বুঝেসুঝে কথা বলুন। এতটুকু বুঝেই কি রসূল-ই পাকের হাদীস শরীফ বুঝার দাবী করছেন? কবি বলেন-
گرهميں مكتب وهميں ملا ـ كار طفلاں تمام خواهد شد
অর্থাৎ যদি আমাদের জন্য একটি মকতব আর মকতবে মোল্লাজি পাওয়াই যথেষ্ট হতো, তবে তো (মকতবের) শিশুদের পড়াই যথেষ্ট হয়ে যেতো।

আপত্তি নম্বর -৬
বোখারী ও মুসলিম শরীফে আছে, হুযূর করীম এরশাদ করেছেন- لاَ صَلٰواة لِمَنْ لَّمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ (অর্থাৎ তার নামায হয়না, যে সূরা ফাতিহা পড়েনা।) এ হাদীস শরীফ থেকে দু’টি মাসআলা প্রতীয়মান হয়- ১. নামাযে সূরা ফাতিহা পড়া ফয়য; এটা ব্যতীত নামায একেবারে শুদ্ধ হয়না; যেমন ক্বিয়াম ও রুকূ’ ইত্যাদি, ২. সবার উপর (সূরা ফাতিহা পড়া) ফরয:নামাযী একাকী নামায পড়–ক কিংবা ইমাম হোন, অথবা মুক্বতাদী হোক। হাদীস শরীফে কোনরূপ শর্তারোপ করা হয়নি।

জবাব
এর তিনটি জবাব রয়েছে- দু’টি ‘ইলযামী’ (বিরুদ্ধবাদীদের কথার ভিত্তিতে), আরেকটি গবেষণাভিত্তিক।
প্রথম ইলযামী জবাব তো এ’যে, হাদীসটা ইমাম মুসলিম এভাবে বর্ণনা করেছেন-
فَصَاعِدًا لاَ صَلٰواةَ لِمَنْ لَّمْ يَقْرَأَ بِاُمِّ الْقُرْانِ অর্থাৎ তার নামায হয়না, যে সূরা ফাতিহা অতঃপর আরো কিছু পড়েনা।
আর ‘মুআত্বত্বা-ই ইমাম মালিক’-এ এ-ই হাদীস এভাবে বর্ণিত হয়েছে- لاَ صَلٰوة اِلاَّ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ وَالسُّوْرَةِ (নামায হয়না, কিন্তু সূরা ফাতিহা এবং আরো সূরা পড়লে।) সুতরাং (হে সালাফী, লা-মাযহাবীরা!) আপনাদের উচিত হচ্ছে- মুক্বতাদীর উপর সূরা ফাতিহা পড়াকে ফরয বলে জানা, সূরা মিলানোকেও। আপনারা তো কিছু সংখ্যক হাদীসের উপর ঈমান আনছেন, আর কিছু সংখ্যককে অস্বীকার করছেন।

দ্বিতীয় (ইলযামী) জবাব
আপনাদের পেশকৃত হাদীস তো ক্বোরআন-ই করীমেরও বিপরীত আর ওইসব হাদীসেরও, যেগুলো আমি প্রথম পরিচ্ছেদে পেশ করেছি; বরং আপনাদেরও বিপক্ষে। (কারণ) ক্বোরআন-ই করীম এরশাদ করছে- فَاقْرَؤُا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْاٰنِ …الاية (সুতরাং ক্বোরআন থেকে যে পরিমাণ সহজ হয়, পড়ে নাও)! কাজেই, সূরা ফাতিহা পড়া কীভাবে ফরয হতে পারে? আরো এরশাদ হচ্ছে- وَاِذَا قُرِئَ الْقُرْانُ فَاسْتَمِعُوْا لَهُ وَاَنْصِتُوْا (অর্থাৎ আর যখন ক্বোরআন পড়া হয়, তখন কান লাগিয়ে শোনো এবং নিশ্চুপ থাকো… আল-আয়াত) তারপরও মুক্বতাদী ইমামের সাথে সূরা ফাতিহা পড়ে মহান রবের এ হুকুমের বিরোধিতা কিভাবে করবে? আমি অনেক হাদীস বর্ণনা করেছি, যেগুলোতে এরশাদ করা হয়েছে যে, ‘ইমামের ক্বিরআতই মুক্বতাদীর ক্বিরআত’। যখন ইমাম ক্বিরআত সম্পন্ন করবেন, তখন তোমরা নিশ্চুপ থাকো’ ইত্যাদি।

আপনারাও বলে থাকেন, যে ব্যক্তি রুকূ’তে ইমামের সাথে মিলিত হয়েছে সে রাক‘আত পেয়ে গেছে। যদি মুক্বতাদীর উপর সূরা ফাতিহা ফরয হতো, তবে সে তা ব্যতীত রাক‘আত কীভাবে পেলো? তার উপর ওযূ, পবিত্রতা অর্জন, তাকবীর-ই তাহরীমা ও ক্বিয়াম ফরয ছিলো। যদি তন্মধ্যে কোন একটাও ছেড়ে দিয়ে রুকূ’তে সামিল হয়ে যায়, তা হলেও তো নামায পাবে বলে বিবেচিত হবেনা। সূরা ফাতিহা কীভাবে মাফ হয়ে গেলো? তা তো (আপনাদের মতে) ফরয ছিলো!

গবেষণার আলোকে জবাব হচ্ছে- এ হাদীসের এমন অর্থ করা চাই, যাতে ক্বোরআন ও হাদীসের বিরোধিতা না হয়, হাদীসগুলোও পরস্পর বিরোধী না হয়ে যায়, আপত্তিও না আসে। তা হচ্ছে এ-ইঃ لاَصَلوةَ -এর لا -نفى جنس -এর; যার اسم হচ্ছে صلوة ; তবে একটা অংশ এখানে উহ্য রয়েছে। অর্থাৎ كامل (কামিল)। সুতরাং অর্থ দাঁড়ায় নামায সূরা ফাতিহা ব্যতীত পরিপূর্ণ (কামিল) হয়না। ক্বোরআনের যে কোন অংশ থেকে (প্রয়োজনীয় পরিমাণ) পড়া ক্বোরআনের হুকুমে ফরয হলো, আর সূরা ফাতিহা হাদীস শরীফের নির্দেশে ‘ওয়াজিব’ হলো। যেমন-
لاَ صَلٰوة اِلاَّ بِحُضُوْرِ الْقَلْبِ (হুযূর-ই ক্বলব বা একাগ্রচিত্তে না পড়লে নামায হয় না) এবং لاَ صَلٰوةَ لِفِجَارِ الْمَسْجِدِ اِلاَّ فِى الْمَسْجِدِ (যে ব্যক্তি মসজিদের নিকটে থাকে, তার নামায মসজিদে ব্যতীত হয়না।) এ দু’টি হাদীসে لاَ صلٰوة -এর মধ্যে নামাযের পরিপূর্ণতা (كمال صلٰوة)-এর অস্বীকৃতি রয়েছে; মূল নামাযের নয়। তদুপরি, এখানে لم يَقْرَأ -এর মধ্যে প্রত্যক্ষ ক্বিরাআত ও পরোক্ষ ক্বিরআত উভয়ই সামিল রয়েছে। অর্থাৎ ইমাম ও একাকী নামায সম্পন্নকারীর জন্য প্রত্যক্ষভাবে ‘সূরা ফাতিহা’ পড়া ওয়াজিব, আর মুক্বতাদীর উপর পরোক্ষভাবে। অর্থাৎ ইমামের পড়া তার জন্য যথেষ্ট। আমাদের পেশকৃত হাদীসগুলো এ হাদীসেরই ব্যাখ্যা। অথবা এ হাদীস ব্যাপক (عام) আর আমাদের পেশকৃত হাদীসগুলো সেটাকে বিশেষিত (خاص) করে; যেগুলো মুক্বতাদীকে এ নির্দেশের সাথে খাস করেছে।

আপত্তি নং ৭
তিরমিযী শরীফে হযরত ওবাদাহ্ ইবনে সামিত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে একটি হাদীস বর্ণিত, যার শেষের শব্দাবলী নি¤œরূপ-
قَالَ اِنِّىْ اَرَاكُمْ تَقْرَءُوْنَ وَرَآءَ اِمَامِكُمْ قَالَ قُلْنَا بَلى قَالَ لاَ تَقْرَءُوْا اِلاَّ بِاُمِّ الْقُرْانِ
অর্থ: হুযূর-ই আক্রাম সাহাবীদের বললেন, আমার মনে হয় যে, তোমরা তোমাদের ইমামের পেছনে ক্বিরাআত সম্পন্ন করো। আমরা আরয করলাম, হ্যাঁ, তিনি বললেন, ‘‘সূরা ফাতিহা ব্যতীত আর কিছু পড়ো না।’’
এ হাদীসে স্পষ্টভাবে এরশাদ হচ্ছে যে, ইমামের পেছনে মুক্বতাদী সূরা ফাতিহা পড়বে। অন্য কোন সূরা পড়বে না। আমরা তো এটাই বলছি। হযরত ওবাদাহ্ ইবনে সামিতের এ হাদীস আবূ দা‘ঊদ, নাসাঈ ও বায়হাক্বী শরীফেও আছে।

খন্ডন
এ আপত্তির কয়েকটা জবাব দেওয়া যায়-
এক. এ হাদীস আপনাদেরও পরিপন্থী। কেননা আপনারাও বলেন যে, ইমামের সাথে রুকূ’তে মিলিত হলে রাক্‘আত পাওয়া যায়। কেন জনাব? যখন মুক্বতাদীর উপর সূরা ফাতিহা পড়া ফরয, তখন ওই মুক্বতাদী সূরা ফাতিহা পড়া ব্যতীত এ রাক্‘আত কিভাবে পেয়ে গেলেন? এর জবাব চিন্তা করে বের করুন! আপনারা যা জবাব দেবেন, আমাদের জবাবও তা-ই হবে।
দুই. শুধু হযরত ওবাদাহ্ ইবনে সামিত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে এ হাদীস ‘মারফূ’ সূত্রে বর্ণিত, যাতে হুযূর-ই আক্রাম ইমামের পেছনে সূরা ফাতিহা পড়ার হুকুম দিয়েছেন। কিন্তু এর বিপরীত হযরত জাবির, হযরত আলক্বামাহ্, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাস‘ঊদ, হযরত যায়দ ইবনে সাবিত, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর, হযরত আলী ও হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম থেকে অনেক হাদীস বর্ণিত, ওইগুলো থেকে কয়েকটা হাদীস আমি প্রথম পরিচ্ছেদে বর্ণনা করেছি এবং ত্বাহাভী শরীফে ও সহীহুল বিহারীতে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং হযরত ওবাদার এ বর্ণনা ‘খবর-ই ওয়াহিদ’ হলো আর ওই সাহাবা-ই কেরামের বর্ণনাগুলো ‘হাদীস-ই মাশহুর’-এর মর্যাদা রাখে। সুতরাং ওই গুলোকেই প্রাধান্য দেওয়া হবে।
তিন. আপনাদের পেশকৃত হাদীস-ই ওবাদাহ্ ক্বোরআনেরও পরিপন্থী। ক্বোরআন মজীদ ক্বোরআন তিলাওয়াতের সময় নিশ্চুপ থাকার নির্দেশ দিয়েছে। আমাদের উপস্থাপিত হাদীস শরীফগুলোকে যেহেতু ক্বোরআন-ই করীম সমর্থন করছে, সেহেতু সেগুলোকেই প্রাধান্য দেওয়া হবে।

চার. আপনাদের পেশকৃত হাদীসে ইমামের পেছনে সূরা ফাতিহা পড়ার নির্দেশ রয়েছে। আর ওইসব হাদীসে, যেগুলো আমরা পেশ করেছি, তা পড়তে নিষেধ করা হয়েছে। ‘নাসগুলো’ পরস্পর বিরোধী হলে, নিষেধের ‘নাসগুলো’কে প্রাধান্য দিতে হয়। দেখুন, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কাউকে সম্মানের সাজদা করার হুকুম ক্বোরআন করীমে মওজূদ আছে। ফেরেশতাদেরকে এর হুকুম দেওয়া হয়েছে, বরং শয়তান ‘আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য সত্তা (হযরত আদম) কে সাজদা না করার কারণে ধিক্কৃত হয়ে গেছে; কিন্তু অন্যান্য ‘নাস’-এ এ সাজদা করতে নিষেধ করা হয়েছে। এখন এ নিষেধ অনুসারেই আমল করা হয়।

পাঁচ. হযরত ওবাদাহ্ ইবনে সামিতের এ হাদীস না ইমাম বোখারী উল্লেখ করেছেন, না ইমাম মুসলিম। নিষেধের হাদীস মুসলিম শরীফে রয়েছে। তাছাড়া, ইমাম তিরমিযী সেটা উদ্ধৃত করে সেটাকে ‘সহীহ্’ বলেননি, বরং ‘হাসান’ পর্যায়ের বলেছেন। আর বলেছেন, ‘‘অধিকতর সহীহ্ হচ্ছে অন্য কিছু।’’ বরাত দেখুন, তিরমিযীতে তোমাদের পেশকৃত হাদীসের সাথে এটাই রয়েছে-
قَالَ اَبُوْ عِيْسى حَدِيْثُ عُبَادَةَ حَدِيْثٌ حَسَنٌ وَرَوٰى هذَا الْحَدِيْثَ الزُّهْرِىُّ عَنْ مَحْمُوْدِ بْنِ الرَّبِيْعِ عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ قَالَ لاَ صَلوةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأُ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ وَهَذَا اَصَحُّ
অর্থ: ইমাম আবূ ঈসা বলেন, হযরত ওবাদার এ হাদীস ‘হাসান’; (সহীহ্ নয়।) এ-ই হাদীস ইমাম যুহ্রী মাহমূদ ইবনে রাবী’ থেকে, তিনি হযরত ওবাদাহ্ ইবনে সামিত থেকে বর্ণনা করেছেন এ মর্মে যে, হযরত ওবাদাহ্ বলেছেন, যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পড়ে না, তার নামায হয় না। এ বর্ণনাই বেশী সহীহ্।

বুঝা গেলো যে, অধিকতর সহীহ্ হচ্ছে ওই বচনগুলো, যেগুলোতে ইমামের পেছনে মুক্বতাদীর সূরা ফাতিহা’ পড়ার উল্লেখ নেই। ‘আশ্চর্য! আপনারা সহীহ্ হাদীসের মোকাবেলায় এমন এক হাদীস পেশ করছেন, যা ক্বোরআনেরও বিপক্ষে, ‘মশ্হুর হাদীসগুলো’রও বিপরীত। আর ইমাম তিরমিযীর মতে ‘সহীহ্’ও নয়; বরং ‘হাসান’ পর্যায়ের। আর বিপরীতে যা রয়েছে তা বেশী সহীহ। আপনারা হানাফীদের বিপক্ষে যার অভিযোগ করছেন, তা নিজেরা (নিজেদের বিপক্ষে) করছেন!

আপত্তি নং ৮
অধিকাংশ সাহাবা-ই কেরামের আমল হচ্ছে এটাই যে, তাঁরা ইমামের পেছনে ক্বিরাআত সম্পন্ন করতেন। ইমাম তিরমিযী এ হাদীস-ই ওবাদাহ্ ইবনে সামিতের ব্যাখ্যায় বলছেন-
وَالْعَمَلُ عَلى هذَا الْحَدِيْثِ فِى الْقِرَأَةِ خَلْفَ الْاِمَامِ عِنْدَ اَكْثَرِ اَهْلِ الْعِلْمِ مِنْ اَصْحَابِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَالتَّابِعِيْنَ
অর্থ: ইমামের পেছনে ক্বিরাআত সম্পর্কে বেশীর ভাগ সাহাবী ও তাবে‘ঈর এ হাদীসে ওবাদাহ্ অনুসারে আমল রয়েছে।
যখন বেশীরভাগ সাহাবীর আমল এ অনুসারে রয়েছে, তখন সূরা ফাতিহা অবশ্যই পড়া চাই।
খন্ডন
এর কতিপয় জবাব দেওয়া যায়-
এক. ইমাম তিরমিযীর এখানে ‘আকসার’ (বেশীর ভাগ) বলা আপেক্ষিক নয় বরং প্রকৃতই। এর অর্থ এ নয় যে, বেশীর ভাগ সাহাবী তো ইমামের পেছনে সূরা ফাতিহা পড়তেন, কম সংখ্যক সাহাবী পড়তেন না; বরং ‘আকসার’ মানে কয়েকজন। ক্বোরআন করীমে এরশাদ হয়েছে-
وَكَثِيْرٌ مُّنْهُمْ عَلى الْهُدى وَكَثِيْرٌ حَقَّ عَلَيْهِمُ الضَّلاَلَةُ
অর্থ: তাদের মধ্যে অনেকে হিদায়তের উপর রয়েছে, আর অনেকের উপর পথ ভ্রষ্টতা অবধারিত হয়েছে।
সঠিক কথা হচ্ছে- বেশীর ভাগ সাহাবী ইমামের পেছনে ক্বিরাআতের ঘোর বিরোধী, যেমন-

১. হযরত যায়দ ইবনে সাবিত বলেন- যে ব্যক্তি ইমামের পেছনে তিলাওয়াত করে তার নামায হয় না। [সহীহুল বিহারী]

২. হযরত আনাস বলেন, যে ইমামের পেছনে তিলাওয়াত করে, তার মুখ যেন আগুনে ভর্তি হয়ে যায়! [ইবনে হাব্বান]

৩. হযরত আবদুল্লাহ্ বলেন, যে ব্যক্তি ইমামের পেছনে তিলাওয়াত করে, তার মুখ যেন দুর্গন্ধে ভর্তি হয়ে যায়। [ইবনে হাব্বান]

৪ ও ৫. হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাস‘ঊদ ও হযরত আলক্বামাহ্ বলেন, যে ব্যক্তি ইমামের পেছনে ক্বিরাআত সম্পন্ন করে, তার মুখে মাটি পড়ুক! [ত্বাহাভী শরীফ]

৬. হযরত আলী মুরতাদ্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি ইমামের পেছনে তিলাওয়াত করে, সে ফিত্বরাত-এর উপর নেই।’’ [ত্বাহাভী শরীফ]

৭. হযরত যায়দ ইবনে সাবিত বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি ইমামের পেছনে তিলাওয়াত করে তার নামায হয় না।’’ [ইবনে জূযী ফিল ‘ইলাল]

৮. হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি ইমামের পেছনে তিলাওয়াত করে, আহা, যদি তার মুখে পাথর পড়তো!’’ [মুআত্তা-ই ইমাম মুহাম্মদ ওয়া আবদুর রায্যাক্ব]

৯. হযরত সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্বক্বাস বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি ইমামের পেছনে তিলাওয়াত করে, তার মুখে যেন অঙ্গার হয়।’’[মুআত্তা-ই ইমাম মুহাম্মদ, আবদুর রায্যাক্ব]

১০. হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর নিজেও ইমামের পেছনে তিলাওয়াত করতেন না, কঠোরভাবে অন্য লোকদের নিষেধও করতেন, আর বলতেন, ‘‘ইমামের ক্বিরাআত’ যথেষ্ট।’’ [মুআত্তা-ই ইমাম মুহাম্মদ]

এসব ক’টি বর্ণনা ‘ত্বাহাভী শরীফ’ এবং ‘সহীহুল বিহারী’ তে মওজূদ আছে। এগুলো তো নমুনা স্বরূপ পেশ করা হয়েছে। অন্যথায় আশিজন সাহাবী থেকে বর্ণিত যে, তাঁরা ইমামের পেছনে ক্বিরাআত করতে কঠোরভাবে নিষেধ করতেন। দেখুন, ‘শামী’, ‘ফাত্হুল ক্বদীর’ ইত্যাদি। যদি কিছু সংখ্যক রেওয়ায়ত এ মর্মে এসে যায় যে, তাঁদের মধ্যে কিছু সংখ্যক হযরত সূরা ফাতিহা পড়তেন, তাহলে হয়তো তা তাঁদের প্রথম দিকের আমল ছিলো, যা পরবর্তীতে মান্সূখ হয়ে গেছে, অথবা ওইসব রেওয়ায়ত বর্জনযোগ্য, কেননা, ক্বোরআনের পরিপন্থী।

আপত্তি নং ৯
এসব ক’টি রেওয়ায়ত দ্ব‘ঈফ (দুর্বল)। (ওই পুরানা সবক)

খন্ডন
জ্বী-হাঁ! এজন্য দ্ব‘ঈফ বা দুর্বল যে, সেগুলো আপনাদের বিপক্ষে। হয়তো আপনাদের উপর ওইগুলো দ্ব‘ঈফ মর্মে ইলহাম হয়েছে। আমরা ‘দ্ব‘ঈফ’ (দুর্বল) সম্পর্কে ইতোপূর্বে অনেক কিছু আরয করেছি। যেমন- ‘জরহে মুবহাম’ (সন্দেহপূর্ণ ত্রুটি নির্ণয়) বিবেচনাযোগ্য নয়। তাছাড়া, ইমাম-ই আ’যম যখন এ হাদীসগুলো গ্রহণ করেছেন, তখনতো সেগুলো ‘দ্ব‘ঈফ’ (দুর্বল) ছিলোনা; পরবর্তীতে দুর্বলতা এসেছে। পরবর্তীকালীন দুর্বলতা ইমাম-ই আ’যমের জন্য ক্ষতিকর নয়। তাছাড়া, কয়েকটা দুর্বল হাদীস মিলে হাদীসকে ‘হাসান’ করে দেয়। ইত্যাদি।

আপত্তি- ১০
যদি ইমাম নি¤œস্বরে তিলাওয়াত করছেন, যেমন যোহর ও আসরে, অথবা মুক্বতাদী অনেক দূরে থাকে, যেখানে ইমামের ক্বিরাআতের আওয়াজ পৌঁছেনা, তবে উচিৎ হবে তার সূরা ফাতিহা পড়ে নেওয়া; কেননা, এখনতো সূরা ফাতিহা পড়লে ক্বোরআন শোনার মধ্যে ক্ষতি হচ্ছে না।

খন্ডন
এ আপত্তি তখনই দুরস্ত হতো, যখন নিশ্চুপ থাকা শুধু ক্বোরআন শোনার জন্য হতো, অথচ নিশ্চুপ থাকার বিধান আলাদা এবং শোনার নির্দেশ আলাদা। মহান রব এরশাদ ফরমাচ্ছেন-فَاسْتَمِعُوْا لَه وَاَنْصِتُوْا (সুতরাং তা মনযোগ সহকারে শোনো এবং নিশ্চুপ থাকো)। এটা তেমনি, যেমন আল্লাহ্ তা‘আলার এরশাদ- اَقِيْمُوْا الصَّلٰوةَ وَاتُوْا الزَّكٰوةَ (তোমরা নামায কায়েম করো এবং যাকাত প্রদান করো। যেমন যাকাত ফরয হওয়া, নামাযের কারণে নয়; বরং এটা নামায থেকে পৃথক স্বতন্ত্র ফরয, তেমনি নিশ্চুপ থাকা একটি স্বতন্ত্র জরুরী জিনিস। নিরব নামাযগুলোতে নিশ্চুপ থাকা রয়েছে, শোনা নেই। উচ্চস্বরে ক্বিরাআতের নামাযগুলোতে নিশ্চুপ থাকাও জরুরী, শোনাও জরুরী।

আপত্তি নং-১১
যখন মুক্তাদী নামাযের সমস্ত রুকন (অভ্যন্তরীণ ফরয) সম্পন্ন করে, যেমন- তাকবীর-ই তাহরীমাহ্, ক্বিয়াম, রুকূ’ ইত্যাদি, তখন তিলাওয়াতও নামাযের এটা রুক্ন। তাও পালন করুন। এটা কেমন নিয়ম যে, সব ক’টি রুক্ন পালন করছেন, এ একটা ছেড়ে দিচ্ছেন?

খন্ডন
এর জবাব আমি ইতোপূর্বে দিয়েছি। তা হচ্ছে- জমা‘আত সহকারে নামাযে মুসলমানগণ প্রতিনিধিদল হয়ে আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে হাযির হয়, তাদের প্রধান হন ইমাম। শাহী দরবারের নিয়মানুসারে ক্বিয়াম, রুকূ’, সাজদাহ্, তাহিয়্যাহ্ ও সানা সবই আরয করবে; কিন্তু আবেদন-নিবেদন অর্থাৎ তিলাওয়াত-ই ক্বোরআন শুধু দল-প্রধানই তাদের পক্ষ থেকে করবেন। মুক্বতাদীর উপর এজন্যই তিলাওয়াত ফরয নয়; বরং নিষিদ্ধ। তার উপর আদব সহকারে দাঁড়িয়ে থাকা ক্বোরআন-ই করীমের নির্দেশেই ফরয।

আপত্তি নং ১২
রুকূ’তে মিলিত হয় এমন মুক্বতাদীর উপর সূরা ফাতিহা পড়া মাফ, যেমন মুসাফিরের উপর, চার রাক্‘আত বিশিষ্ট নামাযে দু’ রাক্‘আত মাফ। কেননা, এ বিধান হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে।

খন্ডন
আলহামদু লিল্লাহ্! আপনারা হানাফী মাযহাবের কাছাকাছি হয়ে গেছেন! ব্যাস, আমরা তো এটাই বলে থাকি যে, ইমামের পেছনে ‘সূরা ফাতিহা’ পড়া মাফ, যেমন মুসাফিরের উপর দু’ রাক্‘আত ফরয নামায মাফ। কেননা, ইমামের ক্বিরাআত তার ক্বিরাআত। আপনারা মেনে নিলেন যে, لاَ صَلوةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأُ… (যারা সূরা ফাতিহা পড়েনি, তাদের নামায নেই) বিশিষ্ট হাদীস সেটার বাহ্যিক ব্যাপকতার উপর নেই; কোন কোন নামাযী এ বিধান বর্হিভূত। ব্যাস! আমরা তো এটাই শুনতে চাই যে, আপনাদের মতেও বিশেষ বিশেষ মুসল্লী এ বিধান-বর্হিভূত; আর আমাদের মতে আম মুক্বতাদী। হাদীসে ‘কিছু সংখ্যক বর্হিভুত’ মানার মধ্যে আমরা ও আপনারা এক সমান হয়ে গেলাম; শুধু বহির্ভূতদের পরিমাণের মধ্যে কিছুটা আলোচনার অবকাশ রয়েছে মাত্র। ইনশা-আল্লাহ্! তাও মেনে যাবেন। এ খন্ডন ‘ইলযামী’ (আপত্তির ভিত্তিতে পাল্টা) জবাবই ছিলো।
গবেষণাধর্মী খন্ডন বা জবাব নি¤œরূপঃ

শরীয়তে, কোন কোন অবস্থায় নামায অর্দ্ধেক হয়ে থেকে যায়; যেমন- সফরে, কখনো কখনো একেবারে মাফ হয়ে যায়। যেমন- স্থায়ী উম্মাদনা, নারীসূলভ অপবিত্রতার অবস্থায়। কিন্তু নামাযের অভ্যন্তরীণ ও বহির্গত ফরযগুলো কোন অবস্থায় মাফ হয় না। অবশ্য কোন কোন বিশেষ কারণে এর পরিবর্তে বিকল্প বিধান দেওয়া হয়; একেবারে মাফ কখনো হয় না। যেমন- ওযূর বিকল্প তায়াম্মুম, ক্বিয়ামের বিকল্প ‘ক্বা’দাহ্’ রাখা হয়েছে; কিন্তু ওযূ ব্যতীত কোন কারণেই নামায জায়েয নয়। যদি মুক্বতাদীর জন্য সূরা ফাতিহা পড়া নামাযের রুক্ন হতো, তবে তা ছুটে গেলে রাক্‘আত মোটেই পাওয়া যেতো না। বুঝা গেলো যে, তার জন্য ইমামের ক্বিরাআত হচ্ছে বিকল্প। ব্যাস, আমরা এটাই বলি। সুতরাং এ মাসআলাকে সফরের নামাযের উপর ক্বিয়াস করা একেবারে বিবেকগ্রাহ্য নয়। দেখুন, যদি নামাযে কেউ রুকূ’তে সামিল হয়, তবে ওয়াজিব হচ্ছে রুকূ’তেই ঈদের তাকবীরগুলো বলে নেয়া। জানাযার নামায কেউ আখেরী তাকবীরে সামিল হলে তার উপর ওয়াজিব পূর্ববর্তী তাকবীরগুলো বলে নেওয়া। যখন রুকূ’তে শামিল হয়েছে এমন মুকতাদীর উপর ঈদের তাকবীরগুলো মাফ হয়নি, আর শেষভাগে সামিল হয়েছে এমন লোকের উপর জানাযার নামাযের তাকবীরগুলো মাফ হয় না, তাহলে, যদি মুক্বতাদীর উপর সূরা ফাতিহা পড়া ফরয হতো, তবে রুকূ’তে শামিল হলে কেন তা মাফ হয়ে গেলো?

আপত্তি নং ১৩
রুকূ’ পেয়েছে এমন মুক্বতাদীর উপর ওই রাক্‘আতের ক্বিয়াম মাফ হয়ে গেলো, যা ফরয ছিলো, তাহলে যদি সূরা ফাতিহা মাফ হয়ে যায়, তবে ক্ষতি কি?

খন্ডন
এটা ভুল কথা। তার উপর ক্বিয়াম মাফ হয়নি। তার জন্য তাকবীর-ই তাহরীমাহ্ বলে কমপক্ষে এক তাসবীহ্ পরিমাণ ক্বিয়াম করা, তারপর দ্বিতীয়বার তাকবীর বলে রুকূ’ করা জরুরী। অন্যথায় সে নামায পাবে না।

আপত্তি নং ১৪
আয়াত শরীফ- وَاِذَا قُرِئَ الْقُرْانُ الخـ.. (এবং যখন ক্বোরআন পড়া হয়…) মক্কী, হিজরতের পূর্বে নাযিল হয়েছে। আর সূরা ফাতিহা হচ্ছে মাদানী, মদীনা মুনাওয়ারায় ফরয হয়েছে। কাজেই, সূরা ফাতিহা পড়া এ আয়াত দ্বারা কীভাবে মান্সূখ হতে পারে? পূর্বে নাযিল হয়েছে এমন আয়াত কি পরে নাযিল হয়েছে এমন আয়াতের নাসিখ (রহিতকারী) হতে পারে? (আপত্তিকারী কোন নতুন ওহাবী)

খন্ডন
এটা নিছক আপনারই রায় বা অভিমত। আপনি আমার উক্তির পক্ষে কোন বরাত পেশ করলেন না। যখন সূরা ফাতিহা মক্কী, আর নামাযও মক্কা মু‘আয্যামায় ফরয হয়েছিলো, তখন এর কি কারণ হতে পারে যে, সূরা ফাতিহা পড়া মক্কা মু‘আয্যামায় ফরয হলোনা? তাহারাত ও ওযূর ফরয হওয়া কি মাদানী?
—০—