আহলে হাদীস নামধারী ভ্রান্ত ও লা-মাযহাবীদের খন্ডন (পর্ব-4)

আহলে হাদীস নামধারী ভ্রান্ত ও লা-মাযহাবীদের খন্ডন (পর্ব-4)

নামাযে ‘বিসমিল্লাহ্’ নিরবে পড়বেন

সুন্নাত হচ্ছে নামাযী সূরা ফাতিহার প্রারম্ভে ‘বিস্মিল্লাহ্ শরীফ’ নীরবে বলা, ‘আলহামদু লিল্লাহ্’ থেকে ক্বিরা’আত আরম্ভ করা; কিন্তু গায়র মুক্বাল্লিদ ওহাবী সম্প্রদায় ‘বিস্মিল্লাহ্’ও উচ্চরবে পড়ে থাকে, যা একেবারে সুন্নাত বিরোধী।

‘বিস্মিল্লাহ্’ নীরবে পড়া সম্পর্কে অনেক হাদীস শরীফ বর্ণিত হয়েছে। ওইগুলো থেকে কয়েকটা নিম্নে পেশ করা হচ্ছে। আল্লাহ্ তা‘আলা কবূল করুন!

প্রথম পরিচ্ছেদ

হাদীস নম্বর ১-৩
বোখারী, মুসলিম ও ইমাম আহমদ হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন-
قَالَ صَلَّيْتُ خَلْفَ رَسُوْلِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَخَلْفَ اِبِىْ بَكْرٍ وَّعُمَرَ وَعُثْمَانَ فَلَمْ اَسْمَعْ اَحَدًا مِّنْهُمْ يَقْرَأُ بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنٍ الرَّحِيْمِ-
অর্থ: আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, আবূ বকর সিদ্দীক্ব, ওমর ফারুক্ব ও ওসমান গণি রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম-এর পেছনে নামায পড়েছি। তাঁদের মধ্যে কাউকে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ সরবে পড়তে শুনিনি।

হাদীস নম্বর ৪
মুসলিম শরীফ হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেছে-
وَعَنْ اَنَسٍ اَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَاَبَا بَكْرٍ وَعُمَرَ كَانُوْا يَفْتَتِحُوْنَ الصَّلَوةَ بِالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ-
অর্থ: নিশ্চয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, হযরত আবূ বকর ও হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা ‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল ‘আলামীন’ দ্বারা ক্বিরআত আরম্ভ করতেন।

হাদীস নম্বর ৫-৭
নাসাঈ, ইবনে হাব্বান ও ত্বাহাভী শরীফ হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেছে-
قَالَ صَلَّيْتُ خَلْفَ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَاَبِىْ بَكْرٍ وَعُمَرَ وَعُثْمَانَ فَلَمْ اَسْمَعْ اَحَدًا مِنْهُمْ يَجْهَرُ بِبِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ-
অর্থ: আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, হযরত আবূ বকর, হযরত ওমর ও হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম-এর পেছনে নামায পড়েছি। ওই সব হযরতের কাউকে ‘বিসমিল্লাহ্’ উচুঁ আওয়াজে পড়তে শুনিনি।

হাদীস নম্বর-৮-১১
ত্বাব্রানী মু’জাম-ই কবীর-এ, আবূ নু‘আয়ম ‘হুলিয়া’য় এবং ইবনে খোযায়মাহ্ ও ত্বাহাভী হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন-
اَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَاَبَابَكْرٍ وَعُمَرَ كَانُوْا يُسِرُّوْنَ بِبِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحٍيْمِ-
অর্থ: নিশ্চয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, হযরত আবূ বকর ও হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা ‘বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ নীরবে পড়তেন।

হাদীস নম্বর ১২-১৪
আবূ দাঊদ, দারেমী ও ত্বাহাভী হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
اَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَاَبَابَكَرٍ وَعُمَرَ وَعُثْمَانَ كَانُوْا يُسْتَفْتِحُوْنَ الْقِرْأَةَ بِالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ-
অর্থ: নিশ্চয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এবং হযরত আবূ বকর, হযরত ওমর ও হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম ‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল ‘আ-লামীন’ দ্বারা ক্বিরআত আরম্ভ করতেন।

হাদীস নম্বর ১৫
মুসলিম শরীফে হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত-
اَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَاَبَابَكْرٍ وَّعُمَرَ وَعُثْمَانَ كَانُوْا يَسْتَفْتِحُوْنَ الْقِرْأَةَ بِالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ لَايَذْكُرُوْنَ بِسْمِ اللهِ الرَّحَمْنِ الرَّحِيْمِ فِىْ اَوَّلِ الْقِرْأَةِ وَلَافِىْ اَخِرِهَا-
অর্থ: নিশ্চয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এবং হযরত আবূ বকর, হযরত ওমর ও হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম ‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ-লামীন’ দ্বারা ক্বিরআত আরম্ভ করতেন ‘বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ না ক্বিরআতের শুরুতে উল্লেখ করতেন, না ক্বিরআতের শেষ ভাগে।

হাদীস নম্বর ১৬
ইবনে আবী শায়বাহ্ সাইয়্যেদুনা হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাস‘ঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
عَنْ اِبْنِ مَسْعُوْدٍ اَنَّهُ كَانَ يُخْفِىْ بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ وَالْاِسْتِعَاذَةَ وَرَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ-
অর্থ: হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাস‘ঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’, ‘আ‘ঊযু বিল্লাহ্’ ও ‘রাব্বানা-লাকাল হামদু’ নীরবে বলতেন।

হাদীস নম্বর ১৭
ইমাম মুহাম্মদ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ‘কিতাবুল আ-সা-র’-এ হযরত ইব্রাহীম নাখ‘ঈ থেকে বর্ণনা করেন-
قَالَ اَرْبَعٌ يُخْفِيْهِنَّ الْاِمَامُ بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ وَسُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَالتَّعَوُّذَ وَاٰمِيْنَ-
অর্থ: তিনি বলেন, চারটি বিষয় ইমাম নীরবে পড়বেন-‘বিসমিল্লাহ্’, ‘সুবহা-নাকাল্লা-হুম্মা’, ‘আ‘ঊযু বিল্লাহ্’ এবং ‘আ-মী-ন’।

হাদীস নম্বং ১৮-১৯
ইমাম মুসলিম ও ইমাম আবূ দাঊদ হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে বর্ণনা করেন-
قَالَتْ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيْتَفْتِحُ الصَّلَوةَ بِالتَّكْبِيْرِ وَالْقِرأَةً بِالْحَمْدُ لِلَّهِ رِبِّ الْعَالَمِيْنَ-
অর্থ: তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নামাযকে ‘তাকবীর’ দ্বারা আরম্ভ করতেন আর ক্বিরআতকে (আরম্ভ করতেন) ‘আলহামদু লিল্লা-হি’ দ্বারা।

হাদীস ২০
আবদুর রায্যাক্ব আবূ ফাখ্তাহ্ থেকে বর্ণনা করেন-
اَنَّ عَلِيًا كَانَ لَا يَجْهَرُ بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ وَكَانَ يَجْهَرُ بِالْحَمْدُ لِلَّهِ رِبِّ الْعَالَمِيْنَ-
অর্থ: হযরত আলী মুরতাদ্বা ‘বিস্মিল্লাহ্’ উচুঁ আওয়াজে পড়তেন না, আর ‘আলহামদু লিল্লাহ্’ উঁচু আওয়াজে পড়তেন।
মোটকথা, এ সম্পর্কে আরো বহু হাদীস শরীফ পেশ করা যেতে পারে। কিন্তু আমি এখানে শুধু বিশটি হাদীস পেশ করে ক্ষান্ত হলাম। যদি আগ্রহ থাকে, তবে ‘ত্বাহাভী’ ও ‘সহীহুল বিহারী’ শরীফ পাঠ-পর্যালোচনা করুন।
যুক্তিও চায় যে, ‘বিস্মিল্লাহ্’ উঁচু আওয়াজে না পড়া হোক। কেননা, সূরাগুলোর প্রারম্ভে যে ‘বিস্মিল্লাহ্’ লিখা হয়েছে, তা ওই সূরাগুলোর অংশ নয়। শুধু সূরাগুলোকে পরস্পর পৃথক বুঝানোর জন্য লিখা হয়েছে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে- যে ভাল কাজকে বিসমিল্লাহ্ দ্বারা আরম্ভ করা না হয়, তা অসম্পূর্ণ। সুতরাং যেভাবে বরকতের জন্য নামাযী ক্বিরআতের আগে ‘আ‘ঊযু বিল্লাহ্’ পড়ে, কিন্তু নবীবে, কেননা, ‘আ‘ঊযু বিল্লাহ্’ সূরার অংশ নয়, তেমনি বরকতের জন্য ‘বিসমিল্লাহ্’ পড়বে, কিন্তু নীরবে পড়বে। কেননা, এটাও সূরার অংশ নয়। অবশ্য, সূরা ‘নাম্ল’ শরীফে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ সূরার আয়াতের অংশ। ইমাম সেখানে উচ্চ আওয়াজে পড়ে থাকেন। কেননা সেটা সেখানকার আয়াতই। মোটকথা, ইমাম শুধু ক্বোরআন করীমকেই উঁচু আওয়াজে পড়বেন। যে ‘বিস্মিল্লাহ্’ সূরার প্রারম্ভে রয়েছে, তা সূরার অংশ নয়। তাই সেটা নিরবে পড়া চাই।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
[এর বিপক্ষে আনীত আপত্তিসমূহ ও সেগুলোর খণ্ডন] আপত্তি-১
যেহেতু ‘বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ প্রত্যেক সূরার অংশ; যদি অংশ না হতো, তাহলে ক্বোরআনে এভাবে লেখা হতো না, ক্বোরআন-ই করীমেতো শুধু ক্বোরআনের আয়াতগুলোই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, ক্বোরআন নয় এমন কিছু লিপিবদ্ধ করা হয়নি, সেহেতু যেমন অন্য আয়াতগুলো উঁচু আওয়াজে পড়া হয়, তেমনি ‘বিসমিল্লাহ্’ও উঁচু আওয়াজে পড়া চাই।

খণ্ডন
এ আপত্তির কয়েকটা জবাব হতে পারে-
এক. ‘বিসমিল্লাহ্’ প্রত্যেক সূরার অংশ নয়; কেননা সেটা প্রত্যেক সূরার সাথে নাযিল হয়নি। সূতরাং বোখারী শরীফের প্রারম্ভে ‘ওহী নাযিল হওয়া কিভাবে আরম্ভ হয়েছিল?’ শীর্ষক অধ্যায়ে ইমাম বোখারী সর্বপ্রথম ওহী সম্পর্কে বর্ণনা (রেওয়ায়ত) এনেছেন। যেমন হযরত জিব্রাঈল আমীন হুযূর-ই আকরামের খিদমতে আরয করেছেন اِقْرَأ ‘ইক্বরা’ (পড়–ন)! আর হুযূর-ই আকরাম বলেছেন- مَااَنَا بِقَارِى (আমি পড়বো না)। তারপর হযরত জিব্রাঈল আরয করলেন, اِقْرَأْ (পড়–ন)! হুযূর এবারও ওই জবাব দিয়েছেন। শেষ বারে আরয করলেন, اِقْرَأْ بِسْمِ رِبِّكَ الَّذِىْ خَلَقَ (আপনি আপনার ওই মহান রবের নামে পড়–ন, যিনি সৃষ্টি করেছেন)। মোটকথা, প্রথম ওহী এটাই। এতে ‘বিসমিল্লাহ্’র উল্লেখ নেই। বুঝা গেলো যে, সূরাগুলোর প্রারম্ভে ‘বিসমিল্লাহ্ শরীফ’ নাযিল হয়নি।

দুই. যদি ‘বিসমিল্লাহ্’ প্রত্যেক সূরার অংশ হতো, তাহলে সূরার উপরে পৃথকভাবে অক্ষরগুলোকে দীর্ঘ করে লিপিবদ্ধ করা হতো না; বরং যেভাবে অন্যান্য আয়াত মিলিতভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, তেমনি ‘বিসমিল্লাহ্’ সমস্ত আয়াতের সাথে লিখা হতো। দেখুন, সূরা নামল শরীফে ‘বিসমিল্লাহ্’ ওই সূরার অংশ। সুতরাং সেখানে পৃথক আঙ্গিকে লিপিবদ্ধ করা হয়নি, বরং সেটাও অন্য সমস্ত আয়াতগুলোর সাথে একইভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। বুঝা গেলো, সূরাগুলোর প্রারম্ভে ‘বিসমিল্লাহ্’কে বিশেষ আঙ্গিকে পৃৃথক করে লিপিবদ্ধ করা প্রত্যেক সূরাকে পরস্পর পৃথক করার জন্যই।

আপত্তি-২
ত্বাহাভী শরীফে হযরত উম্মুল মু’মিনীন উম্মে সালামাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে বর্ণিত-
اَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يُصَلِّى فِى بَيْتِهَا فَيَقْرَأُ بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ اَلْحَمْدُ لِلَّهِ-
অর্থ: নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমার ঘরে নামায পড়তেন। তিনি পড়তেন- ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম, ‘আলহামদুলিল্লাহ্’ শেষ পর্যন্ত। বুঝা গেলো যে, হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নামাযে ‘বিস্মিল্লাহ্’ উঁচু আওয়াজে পড়তেন, অন্যথায় হযরত উম্মে সালামাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা কীভাবে শুনলেন?

খণ্ডন
এ হাদীসে ‘আওয়াজ’-এর কথা উল্লেখ করা হয়নি, শুধু ‘বিসমিল্লাহ্’ পড়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আমরাও বলি যে, তিনি ‘বিসমিল্লাহ্’ পড়েছেন, কিন্তু নিম্নস্বরে পড়েছেন। প্রকাশ তো এটাই থাকে যে, হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এখানে নীরবে পড়তেন। আর ওই নামায, যা তিনি হযরত উম্মে সালামার ঘরে পড়তেন, তা ফরয নামায ছিলো না, নফল ছিলো। ফরয তো তিনি মসজিদ শরীফে জামা‘আত সহকারে পড়তেন। নফল নামাযে ক্বোরআনের ক্বিরআত নিম্নস্বরেই হয়ে থাকে। সুতরাং এখানে ‘বিসমিল্লাহ্’ও নিম্নস্বরে ছিলো। আর ‘আলহামদু লিল্লাহ্’ও নীরবে। হযরত উম্মে সালামাহ্ এমন সময় হুযূর-ই আকরামের কাছেই থাকতেন। এ কারণে তিনি হুযূর-ই আকরামের নিম্নস্বরে পড়ার আওয়াজটুকুও শুনতেন। নিম্নস্বরে উচ্চারিত ক্বিরআতও এতটুকু আওয়াজ দ্বারা সম্পন্ন করা যায় যেন পার্শ্ববর্তী লোকও শুনতে পায়। একেবারে নীরবে ক্বিরআত হয় না, বরং চিন্তা বা কল্পনাই হয়। সুতরাং এ হাদীস শরীফ থেকে আপত্তিকারীর দাবী প্রমাণিত হচ্ছে না।

আপত্তি-৩
তিরমিযী শরীফে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে বর্ণিত-
قَالَ كَانَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَفْتَتِحُ صَلَوتَهُ بِبِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ-
অর্থ: তিনি বলেন, হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আপন নামায ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ দ্বারা আরম্ভ করতেন।

খণ্ডন
এর দু’টি জবাব হতে পারে-
এক. আফসোস্! হে আপত্তিকারী! আপনিতো ইমাম তিরমিযীর এখানে এর পরবর্তী মন্তব্যটা দেখেননি (কিংবা উল্লেখ করেনি)। তা হচ্ছে, তিনি বলেন, مِنْ اَحَادِيْثَ لَيْسَ اِسْنَادُهُ بِذَاكَ অর্থাৎ ‘‘এটা এমন এক হাদীস, যার সনদ বলতে কিছুই নেই।’’
আফসোস্! হে আপত্তিকারীরা, আপনারা আমাদের পেশকৃত হাদীসগুলোকে বিনা কারণে ‘দুর্বল’ বলে প্রত্যাখ্যান করে থাকেন, আর নিজেরা এমন হাদীস পেশ করছেন, যার কোন পাত্তাই নেই।

দুই. যদি এ হাদীসকে ‘সহীহ’ (বিশুদ্ধ) বলে মেনেও নেওয়া হয়, তবুও তাতে ‘বিসমিল্লাহ্’ উঁচু আওয়াজে পড়ার উল্লেখ নেই। তাতে শুধু এতটুকু আছে যে, ‘‘তিনি নামায ‘বিসমিল্লাহ্’ দ্বারা আরম্ভ করতেন।’’ আমরাও তো বলছি যে, ‘বিসমিল্লাহ্’ পড়া চাই, তবে নিম্নস্বরে।
তিন. হতে পারে যে, তিনি তাকবীর-ই তাহরীমার পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ্’ পড়ছিলেন। কারণ, তাতে ‘সালা-তাহু’ (তাঁর নামায আরম্ভ করতেন) বলেছেন, ‘কিরাআতাহু’ (ক্বিরআত শুরু করতেন) বলেন নি।

আপত্তি-৪
ত্বাহাভী শরীফে, হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবযা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেছেন-
صَلَّيْتُ خَلْفَ عُمَرَ فَجَهَرَ بِبِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ وَكَانَ يَجْهَرُ اَبِىْ بِبِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ-
অর্থ: আমি হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর পেছনে নামায পড়েছি। তিনি ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ উঁচু আওয়াজে পড়েছেন। আমার পিতাও উঁচু আওয়াজে ‘বিসমিল্লাহির রাহমা-নির রাহীম’ পড়তেন। বুঝা গেলো যে, হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু উঁচু আওয়াজে ‘বিসমিল্লাহ্’ পড়তেন।

খণ্ডন
এর কয়েকটা জবাব হতে পারে-
এক. এ হাদীস ওই সব প্রসিদ্ধ (মাশহুর) হাদীস শরীফের পরিপন্থী, যেগুলো আমি প্রথম পরিচ্ছেদে উল্লেখ করেছি। ওইগুলোর মধ্যে বোখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীসও রয়েছে, যেগুলো থেকে একথা অতি মজবুতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এবং হযরাত খোলাফা-ই রাশেদীন ‘আলহামদু লিল্লাহ্’ দ্বারা ক্বিরাআত আরম্ভ করতেন, ‘বিসমিল্লাহ্’ নিম্নস্বরে পড়তেন। সুতরাং এ হাদীস ‘শায’ (বিরল) পর্যায়ের। বস্তুত ‘মাশহুর’ পর্যায়ের হাদীসগুলোর মোকাবেলায় ‘শায’ পর্যায়ের হাদীস আমলযোগ্য হয় না।

দুই. এ হাদীস শরীফে এ কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়নি যে, হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নামাযের অভ্যন্তরে ‘সুবহানাকা’ পড়ার পর ‘আলহামদু’ পড়ার পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ্’ উঁচু আওয়াজে পড়তেন। এর অর্থ এও হতে পারে যে, হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নামায সমাপ্ত করে দো’আর পূর্বে বরকতের জন্য ‘বিসমিল্লাহ্’ শরীফ পড়তেন; তারপর দো’আ করতেন। এমতাবস্থায় এ হাদীস শরীফ আমাদের উপস্থাপিত হাদীস শরীফগুলোর বিপরীত নয়। বস্তুত যথাসম্ভব হাদীস শরীফগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা চাই।

তিন. সূরার পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ্’ উঁচু আওয়াজে পড়া হতো যদি তা প্রত্যেক সূরার অংশ হয়; অথচ সূরার অংশ হওয়া অকাট্য ও নিশ্চিত হাদীস শরীফ দ্বারা-ই সাব্যস্ত হতে পারে; ‘খবরে ওয়াহিদ’ দ্বারা নয়। কাজেই, আপত্তিকারীর পেশকৃত হাদীস হচ্ছে ‘খবর-ই ওয়াহিদ’, যা একথা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট নয়।

আফসোস তো এজন্য যে, আমরা নিম্নস্বরে ‘বিসমিল্লাহ্’ পড়ার পক্ষে বোখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীসসমূহ পেশ করছি, আর আপনারা বিরুদ্ধবাদীরা! সেগুলোর বিরোধিতা করার জন্য ত্বাহাভী শরীফের আশ্রয় নিচ্ছেন! অথচ ত্বাহাভী শরীফের উপরও আপনাদের ভরসা নেই।
—০—