রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম হাযির-নাযির

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম হাযির-নাযির

মূল: আল্লামা আলহাজ্ব আবূ দাঊদ মুহাম্মদ সাদেক্ব রেযভী
ভাষান্তর: আলহাজ্ব মাওলানা সৈয়দ আবূ তালেব মুহাম্মদ আলাউদ্দিন

এ’তে সন্দেহ নেই যে, এ বিষয় পবিত্র ক্বোরআন ও বিশুদ্ধ হাদীস, ইজমা’-ই উম্মত এবং বরেণ্য ইমামদের অভিমত দ্বারা প্রমাণিত। এ নিবন্ধে এ প্রসঙ্গে কতিপয় দলীল পেশ করার প্রয়াস পাচ্ছি। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন,

اِنَّا اَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَّمُبَشِّرًاوَّ وَنَذِيْرًا وَدَاعِيًا اِلَى اللهِ بِاِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُنِيْرًا

তরজমা: ‘নিশ্চয় আমি আপনাকে হাযের-নাযের, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে পাঠিয়েছি এবং আল্লাহ্র অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহ্বানকারী ও উজ্জ্বল প্রদীপ রূপে।’ [সূরা আহযাব: আয়াত- ৪৫] ওলামায়ে ইসলাম বা সর্বযুগের ইসলামী মনীষী, আওলিয়া-ই কেরাম ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের ইমামদের সুষ্পষ্ট বর্ণনা মতে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা ও অনুগ্রহ দ্বারা হায়াতে হাক্বীক্বী বা প্রকৃত জীবন নিয়ে জীবিত এবং হাযির-নাযির আছেন। সমগ্র বিশ্ব তাঁর দৃষ্টি বা চোখের সম্মুখে। রূহানিয়্যাত (আত্মিক শক্তি), নূরানিয়াত (জ্যোতির্ময়তা) এবং সমস্ত বিশ্বের রহমত হওয়া তাঁর শানের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ্ প্রদত্ত ক্ষমতা ও ইল্ম-এর বিশাল জগতে সর্বত্র তাঁরই উজ্জ্বলতা বিরাজিত। দুনিয়ার কোন স্থান ও বস্তু তাঁর নিকট থেকে অদৃশ্য নয়। তিনি যেখানে চান যত স্থানে চান একই সময়ে উপস্থিত হয়ে স্বীয় গোলামদেরকে স্বীয় দিদার এবং ফয়য ও বরকত দিয়ে তাদেরকে সাহায্য করতে পারেন। উক্ত মাস‘আলার অনুকূলে ক্বোরআনের আরো কিছু আয়াত এবং কতিপয় সহীহ হাদীস এবং হক্কানী ওলামায়ে কেরামের নির্ভরযোগ্য উক্তি পেশ করা হচ্ছে।
আশাকরি, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অনুসারীরা ওইগুলো পাঠ করে নিজেদের ঈমানকে তাজা করবেন এবং আহলে সুন্নাতের বিরুদ্ধবাদীরা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর শান ও শওকত এবং পরিপূর্ণ মর্যাদার অস্বীকার এবং আহলে সুন্নাতের অনুসারীদেরকে কাফির-মুশরিক ইত্যাদি বলা থেকে বিরত থাকার সুযোগ পাবে।

পবিত্র ক্বোরআন থেকে
আয়াত-১
وَكَذَالِكَ جَعَلْنَاكُمْ اُمَّةً وَّسَطًا لِتَكُوْنُوْا شُهَدَآءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُوْنَ الرَّسُوْلُ عَلَيْكُمْ شَهِيْدًا০
তরজমা: এবং কথা হলো এরূপই যে, আমি তোমাদেরকে সব উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ করেছি, যাতে তোমরা মানব জাতির উপর সাক্ষী হও। আর এ রসূল হন তোমাদের রক্ষক ও সাক্ষী। [সূরা বাক্বারা: আয়াত-১৪৩] মৌলভী শব্বির আহমদ ওসমানী উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত আছে যে, যখন পূর্ববর্তী উম্মতদের কাফিরগণ (ক্বিয়ামত দিবসে) তাদের নবীগণের দাবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে এবং এ অভিযোগ করবে যে, তাদেরকে দুনিয়াতে কেউ সত্যপথ প্রদর্শন করেন নি, তখন প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর উম্মতগণ ওই নবীগণের কৃত দাবীর পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করবেন এবং রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম), যিনি (ক্বিয়ামত অবধি) সমস্ত উম্মতদের অবস্থা সম্পর্কে অবগত, এতে তাঁর উম্মতদের সত্যতা ও ন্যায়পরায়ণতার পক্ষে সাক্ষী হবেন।
[হাশিয়ায়ে ক্বোরআন, কৃত: শব্বির আহমদ, পৃ.২৭]

এ আয়াতে করীমাহ্, হাদীস শরীফ এবং উক্ত তাফসীর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, হুযূূূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম স্বীয় উম্মতদের সমস্ত অবস্থা সম্পর্কে অবগত আর তিনি তাঁর সম্যক জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে উম্মতদের পক্ষে সাক্ষী হবেন। কেননা, তিনি উম্মতদের সকল আমল ও অবস্থা নুবূয়তের নূর দ্বারা প্রত্যক্ষ করেন। তাই বিশিষ্ট তাফসীরকারক শাহ্ আবদুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ও আল্লামা ইসমাঈল হক্বক্বী এ আয়াতের উপর লিখিত টীকায় বলেন: রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) নূরে হক্ব ও নূরে নুবূয়ত দ্বারা সমস্ত উম্মতের ঈমানের হাকীক্বত, তাদের ধর্মীয় অবস্থান, বাহ্যিক ভালমন্দ কর্মকাণ্ড, আল্লাহর প্রতি তাদের একাগ্রতা কপটতা এবং অন্তরের অবস্থাদি সম্পর্কেও তিনি পরিজ্ঞাত।
[তাফসীরে আযীযী: পৃ. ৯৬ এবং রূহুল বয়ান, ১ম খণ্ড, পৃ.২৪৬ দ্রষ্টব্য] মোল্লা আলী ক্বারী (রাহমাতুল্লাহি আলায়হি) বলেন, হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়সাল্লাম-এর পবিত্র রূহ সমস্ত মুসলমানের ঘরে হাযির থাকে।
[শরহে শেফা: ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪৬৪]

আয়াত-২

فَكَيْفَ اِذَا جِئْنَا مِنْ كُلِّ اُمَّةٍ بِشَهِيْدٍ وَجِئْنَابِكَ عَلَى هَؤُلَاءِ شَهِيْدًا-

তরজমা: তখন কেমন হবে, যখন আমি প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করবো এবং হে মাহবূব, আপনাকে সবার উপর সাক্ষী এবং পর্যবেক্ষণকারী রূপে উপস্থিত করবো। [সূরা নিসা: আয়ত- ৪১]

এ আয়াতের একটি তাফসীর এ যে, প্রত্যেক নবী স্বীয় উম্মতের ঈমান ও কুফর এবং ভাল ও মন্দ কাজের সাক্ষী। সর্বোপরি, রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) পূর্ববর্তী সকল উম্মতের সাক্ষ্যদাতা। প্রকৃতপক্ষে এ আয়াতেও প্রথমোক্ত আয়াতের মতো হুযূরে পাক (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর শানমান ও নুবূয়তের জ্যোতির্ময়তার অধিক সমারোহ বিদ্যমান। কেননা, প্রথমোক্ত আয়াতে হুযূরে পাক (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)’র উম্মতের উপরই তাঁর সাক্ষ্য প্রদানের প্রমাণ রয়েছে, আর এ আয়াত পূর্ববর্তী সকল উম্মতের উপর হুযূর (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)’র চূড়ান্ত সাক্ষ্য প্রদানের প্রমাণ বহন করে। এ বর্ণনার আলোকে দ্ব্যর্থহীনভাবে একথা প্রমাণিত হয় যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যেভাবে নিজের উম্মতের কর্মকাণ্ড অবলোকন করেন, তেমনি অন্যান্য উম্মতদের ক্রিয়াকলাপও তাঁর চোখের সামনে।

মৌলভী শব্বির আহমদ ওসমানী দেওবন্দী উক্ত আয়াতের তাফসীরে লিখেছেন, পূর্ববর্তী নবীগণ যেমন নিজ নিজ উম্মতের কাফির ও ফাসিক্বের কুফর ও ফিসক্ব-এর সাক্ষ্য প্রদান করবেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনিও তাদের সকল মন্দ কাজের সাক্ষী হবেন, যা দ্বারা তাদের কুকর্ম ও অমঙ্গল প্রকৃষ্টরূপে প্রমাণিত হবে।
তাফসীরে নিশাপুরীতে রয়েছে যে, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সবার উপর সাক্ষ্যদাতা বানানোর কারণ এ যে, তাঁর রূহ-ই আন্ওয়ার (নূরানী আত্মা) সমগ্র পৃথিবীতে অন্যান্য রূহের উপর, অন্তরের উপর এবং প্রত্যেকের অন্তরাত্মার উপর তাঁর দৃষ্টিপাত হয়। (উল্লেখ্য যে, সাক্ষীর জন্যে দেখা আবশ্যক।) স্বয়ং রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমায়েছেন যে, আল্লাহ্ তা‘আলা সর্বপ্রথম আমার রূহকে সৃষ্টি করেছেন। (সুতরাং সৃষ্টিজগতে যা কিছু হয়েছে সবই তাঁর সামনে হয়েছে।)

তাফসীরে নসফী, তাফসীরে বগভী এবং তাফসীরে মাযহারীসহ অন্যান্য তাফসীরে রয়েছে যে, তিনি সকল উম্মতের ‘শাহেদ’ বা সাক্ষ্যদাতা-তিনি প্রকাশ্যে দেখুন কিংবা না-ই দেখুন। কেননা, তাঁর নুবূয়তের কাছে কোন জিনিস গোপন থাকতে পারে না। তাই তিনি ঈমানদারের ঈমান, কাফিরের কুফর এবং মুনাফিক্বের নেফাক্ব সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবেন। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মুবারক এবং হযরত সা‘ঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে বর্ণিত যে, প্রত্যেক দিন সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর উম্মতকে তাঁর সম্মুখস্থ করা হয় এবং তিনি তাদের সকলকে নিজ নিজ নিদর্শন ও কর্মকাণ্ড সহকারে চিনেন। এ দেখার কারণে তিনি সাক্ষ্যদাতা নিরূপিত হবেন।

আয়াত-৩

اِنَّا اَرْسَلْنَكَ شَاهِدًا

তরজমা: নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষী (হাযির-নাযির) করে…। [সূরা আহযাব, আয়াত: ৪৫, কান্যুল ঈমান] অত্র আয়াতে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে شاهدবলা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে- সাক্ষী তথা হাযির-নাযির। তাই غائب (অনুপস্থিত/অদৃশ্য) শব্দের বিপরীতে ব্যাপকভাবে شاهد (হাযির-নাযির) শব্দের ব্যবহার হয়। জানাযার নামাযে যে شاهدنا وغائبنا পড়া হয় তার অর্থও হচ্ছে যথাক্রমে হাযির ও গায়েব। এজন্য সাক্ষ্যদাতাকেও شاهد বলা হয়। যেহেতু সে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকে এবং মোশাহাদার (প্রত্যক্ষ দর্শন)-এর সাথে অর্জিত জ্ঞানেরই বর্ণনা প্রদান করে। ‘মুফরাদাতে ইমাম রাগেব’ এবং অন্যান্য অভিধান গ্রন্থে রয়েছে যে, ‘শাহেদ’ অর্থ হচ্ছে-
اّلشُّهُوْدُ وَالشَّهَادَةُ اَلْحُضُوْرُ مَعَ الْمُشَاهِدَةِ اِمَّا بِالْبَصَرِ اَوْ بِالْبَصِيْرَةِ-
অর্থাৎ ‘শুহুদ’ ও ‘শাহাদাত’ মানে স্বচক্ষে দর্শন বা প্রত্যক্ষ করা সহকারে হাযির থাকা- চাই এ প্রত্যক্ষ করা কপালের চোখে হোক, কিংবা অন্তরের চোখে হোক।
আল্লামা হক্বক্বী ইমাম কাশানী হতে বর্ণনা করেছেন যে,
اَلشَّهِيْدُ وَالشَّاهِدُ مَا يَحْضُرُ كُلُّ وَاحِدٍ مِّمَّا بَلَغَهُ مِنَ الدَّرَجَةِ- (روح البيان ২১১)
অর্থাৎ প্রত্যেকে যে স্তরে পৌঁছেছে, ওই স্তরে সে শাহিদ ও শহীদ (যথাক্রমে সাক্ষী ও হাযির)। [রূহুল বয়ান, পৃ. ২১১] শেখ মুহাক্বক্বিক্ব আল্লামা আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী বলেন,
شاهد عالم وحاضر بحال امت تصديق وتكذيب ونجات هلاكت ايشاں-
অর্থাৎ شاهد ওই সত্তার নাম, যিনি নিজ উম্মতের অবস্থাদি, মুক্তি ও ধ্বংস, নবীর প্রতি তাদের সত্যায়ন ও মিথ্যা প্রতিপাদন ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ে সম্যক জ্ঞাত এবং দর্শক। [মাদারিজুন্নুবূয়াত: ১ম খণ্ড, পৃ.২৬০] তাফসীরে আবুস সা‘ঊদ, জুমাল, কবীর, রূহুল মা‘আনী ইত্যাদি তাফসীর গ্রন্থে এ আয়াতের তাফসীরে রয়েছে,
اِنَّا اَرْسَلْنٰكَ شَاهِدًا عَلَى مَنْ بُعِثَ اِلَيْهِمْ تُرَاقِبَ اَحْوَالَهُمْ تُشَاهِدُ اَعْمَالَهُمْ-
অর্থাৎ নিশ্চয়ই আমি আপনাকে ওই সমস্ত ব্যক্তির উপর شاهد (সাক্ষী) বানিয়ে প্রেরণ করেছি, যাদের অবস্থাদি ও কার্যাদি আপনি প্রত্যক্ষ করেন। তাফসীরে রূহুল মা‘আনীতে নিন্মোক্ত পংক্তিখানা বর্ণনা করেছেন-
در نظر بودش مقامات العباد – زا ںسبب نامش خدا شاهد نهاد
অর্থাৎ ঃ বান্দার সব কিছু তাঁর দৃষ্টির সামনে, ফলে আল্লাহ্ তাঁর নাম ‘শাহেদ’ রেখেছেন।

ফরমানে রেসালত
‘মুসনাদে ইমাম আহমদ’-এ স্বয়ং রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর একখানা হাদীস شاهد (শাহিদ) শব্দের ওই অর্থের প্রতি ইঙ্গিতবহ, যা আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি। যেমন: اَلشَّاهِدُ يَرَى مَالَايَرَى الْغَائِبُ উপস্থিত ব্যক্তি যা দেখে অনুপস্থিত ব্যক্তি তা দেখেনা। উপরোক্ত সমস্ত বিশ্লেষণ দ্বারা একথা দিবালোকের ন্যায়ে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হাযির-নাযির।
জ্ঞাতব্য যে, প্রত্যেক সাক্ষ্যদাতা নিজ নিজ ক্ষমতা ও মর্যাদানুযায়ী তার সংশ্লিষ্ট স্থানে হাযির-নাযির হয়ে থাকে। তবে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যেহেতু সমস্ত উম্মত তথা সমগ্র সৃষ্ট জগতের প্রতি প্রেরিত হয়েছেন, সেহেতু সমগ্র উম্মত ও সৃষ্ট জগতের জন্য তিনি হাযির-নাযির ও শাহেদ।

আয়াত-৪
وَمَا اَرْسَلْنَكَ اِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِيْنَ-
তরজমা: আমি আপনাকে সমস্ত জগদ্বাসীর জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি। [সূরা আম্বিয়া: আয়াত-১০৭] এ আয়াতে সর্বনিয়ন্তা আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় হাবীবে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’ আখ্যা দিয়েছেন।
এ আয়াতের তাফসীর প্রসংগে আল্লামা ইসমাঈল হক্বক্বী লিখেছেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর রহমত সমগ্র বিশ্বজগত পরিব্যাপ্ত, ধরাকীর্ণ এবং ব্যাপক। [তাফসীরে রূহুল বয়ান: ৫ম খণ্ড, পৃ.৫২৮] আল্লামা ইয়ূসুফ নাবহানী সূফীকুল সম্রাট শায়খ আবদুল করীম জীলী হতে বর্ণনা করেছেন যে, তাঁর (প্রিয়নবী) মহান রহমত সমগ্র সৃষ্টির প্রতি ব্যাপক।

অন্যত্র আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমান, رَحْمَتِىْ وَسِعَتْ كُلَّ شَيْئٍঅর্থাৎ আমার রহমত প্রত্যেক বস্তুর উপর পরিব্যাপ্ত। এ প্রসঙ্গে এ বাণীও প্রমাণবহ। অর্থাৎ সমস্ত বস্তু তাঁর রহমতের বৃত্তরেখা এবং প্রশস্ততার আওতাভুক্ত, তিনি হচ্ছেন সমগ্র জাহানের প্রাণ। বিশিষ্ট ওলামায়ে কেরামও এ মাসআলার ব্যাপারে স্পষ্ট বর্ণনা প্রদান করেছেন। [জওয়াহেরুল বেহার: পৃ. ২৪৫/২৬৫] সুতরাং প্রতীয়মান হলো যে, সমগ্র সৃষ্টিজগত তাঁর রহমতের মুখাপেক্ষী। তিনি সমগ্র জাহানের প্রাণ, সকলের জন্যে তিনি হাযির-নাযির। সমগ্র বিশ্বে তাঁর শান-শওকত বিদ্যমান। বিশ্বের সকল বস্তু তাঁরই দয়ার সাগরে নিমজ্জিত।
ذَالِكَ فَضْلُ اللهِ يُؤْتِيْهِ مَنْ يَّشَاءُ- (তা আল্লাহর অনুগ্রহ তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন।)

আয়াত-৫
اَلنَّبِىُّ اَوْلَى بِالْمُؤْمِنِيْنَ مِنْ اَنْفُسِهِمْ-
তরজমা: নবী মু’মিনদের, তাদের প্রাণ অপেক্ষাও অধিকতর নিকটে। [সূরা আহযাব: আয়াত-৬] উক্ত আয়াতে ঈমানদারের সাথে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর এমন নৈকট্য ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে, যার উপর না অন্য কোন নৈকট্যের ধারণা করা যায়, না কোন একাত্মতার কথা কল্পনা করা হয়। যখন তিনি (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) মু’মিনদের এত নিকটে, তখন এত নিকটে অবস্থানকারী নবী (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) হাযির-নাযির হওয়ার ব্যাপারে আর কি সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে?
তাফসীরে খাযিন, মা‘আলিমুত্তান্যীল ও তাফসীরে মাযহারীতে এ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়সাল্লাম-এর নিম্নোক্ত বাণীর উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে-
‘‘কোন ঈমানদার ব্যক্তির কাছে আমি অপরাপর সকল মানুষ থেকে অত্যোধিক নিকটবর্তী। যদি তার (প্রমাণ) চাও তবে اَلنَّبِىُّ اَوْلَى بِالْمُؤْمِنِيْنَ مِنْ اَنْفُسِهِمْ- আয়াতটি পাঠ কর।’’ অন্যত্র প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- اِنَّ اَوْلَى النَّاسِ بِىْ اَلْمُتَّقِيْنَ مَنْ كَانُوْا حَيْثُ كَانُوْا
অর্থাৎ মানুষের মধ্যেকার খোদাভীরু ব্যক্তিরাই আমার সর্বাধিক নিকটবর্তী, সে যে-ই হোক বা যেখানে থাকুক। [মিশকাত:২৬৩ পৃষ্ঠা] ওহাবীদের প্রাণকেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মৌলভী ক্বাসেম নানূতবী লিখেছেন, ‘‘আয়াতাংশের প্রতি লক্ষ্য করলে বুঝা যায়- উম্মতের সাথে রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর এতই গভীর নৈকট্য ও একাত্মতা রয়েছে, যা তাদের সাথে তাদের আত্মারও নেই।’’ [তাহ্যীরুন নাস] দেওবন্দী শীর্ষস্থানীয় মৌলভী আশরাফ আলী থানভী লিখেছেন- ‘‘স্বাগতম হে মুজতবা, হে মুরতাদ্বা, (আল্লাহর পছন্দনীয় ও চয়নকৃত রসূল!) আপনি যদি দূরে চলে যান তবে মৃত্যু এসে যাবে এবং আকাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাবে।’’ [হায়াতুল মুসলিমীন: পৃষ্ঠা ৫] সুতরাং উক্ত আলোচনা দ্বারা বুঝা গেল যে, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) আমাদের থেকে অদৃশ্য এবং দূরে নন; বরঞ্চ তিনি হাযির এবং নিকটবর্তী।

একটি ঐতিহাসিক ঘটনা
আল্লাহর একজন নৈকট্যপ্রাপ্ত বুযুর্গ স্বীয় ‘পাস’ নামক শহর অতিক্রম করে হুযূরে পাক (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)’র রওযায় উপস্থিত হয়ে আরয করলেন- ‘‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি এখন থেকে পুনরায় ‘পাসে’ চলে যাবার উদ্দেশ্যে আসিনি; বরঞ্চ যদি আপনার অনুমতি পাই তবে এখানেই থেকে যাবো।’’ তখন রওযায়ে পাক হতে উত্তর আসল, ‘‘যদি আমি এ কবরের মধ্যে সীমিত থাকতাম, তবে তোমাদের মধ্য হতে যে এখানে আসতো সে-ই এখানে থেকে যেতো; অথচ كُنْتُ مَعَ اُمَّتِىْ حَيْثُمَا كَانَتْ অর্থাৎ ‘আমার উম্মত যেখানেই থাকুক না কেন আমি তার সাথেই আছি।’ সুতরাং তুমি পুনরায় ফিরে যাও।
[আল্ ইবরীজ: ২২৪ পৃষ্ঠা]

হাদীস শরীফের আলোকে
এতক্ষণ হুযূর করীম (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর হাযির-নাযির হওয়ার বিষয়টি পবিত্র ক্বোরআনের আলোকে আলোচনার প্রয়াস পেয়েছি। এখন বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থের বরাতে বিশুদ্ধতম হাদীসসমূহ উপস্থাপন করছি, যেগুলো দ্বারা বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে যাবেঃ

হাদীস-১
اِنِّى اَرٰى مَا لَاتَرَوْنَ وَاَسْمَعُ مَالَا تَسْمَعُوْنَ اِلَى قوله لَوْ تَعْلَمُوْنَ مَااَعْلَمُ لَضَحِكْتُمْ قَلِيْلًا وَلَبَكَيْتُمْ كَثِيْرًا-
অর্থাৎ: নিশ্চয় আমি যা দেখি তোমরা তা দেখ না এবং আমি যা শুনি তোমরা তা শুন না। এর দ্বারা মহান এ বাণীর প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে, আর তা হলো যা পূর্বে ব্যক্ত হয়েছে اَلشَّاهِدُ يَرٰى مَالاَ يَرَى الْغائِبُ অর্থাৎ উপস্থিত ব্যক্তি তা দেখে, যা অনুপস্থিত ব্যক্তি দেখেনা। [তিরমিযী, ইবনে মাজাহ্ ও মিশকাত: ৪৫৭ পৃষ্ঠা] উক্ত হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, রাসূলে পাকের সামনে না কোন অন্তরাল আছে, না কোন বস্তু তাঁর নিকট থেকে দূরে বা গোপন আছে; বরঞ্চ সমস্ত বস্তুই তাঁর গোচরীভুত (দৃষ্ট) ও শ্র“ত।

হাদীস-২
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘‘আমি তোমাদের সাক্ষ্যদাতা এবং হাউযে কাউসার তোমাদের জন্যে অবধারিত ও প্রতিশ্র“ত। তিনি আরো বলেন- اِنِّىْ وَاللهِ لَاَنْطُرُ اِلَيْهِ وَاَنَا فِىْ مَقَامِىْ هَذَا
অর্থাৎ আল্লাহরই ক্বসম! নিশ্চয়ই আমি এ স্থান হতে হাউযে কাউসার প্রতিনিয়ত অবলোকন করছি। [বোখারী শরীফ: ২য় খণ্ড, ২৭৯ পৃষ্ঠা, মিশকাত ৫৪৭ পৃষ্ঠা] সুবহানাল্লাহ্! সপ্ত আসমানের ঊর্ধ্বে হাউযে কাউসারের উপর যে নবীর দৃষ্টি রয়েছে এ যমীনের কোন্ জিনিস বা স্থান তাঁর থেকে দূরে থাকতে পারে?

হাদীস-৩
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান- مَنْ رَاْنِىْ فِىْ المَنَامِ فَسَيَرَانِىْ فِىْ اليَقْظَةِ-
অর্থাৎ ‘যে আমাকে স্বপ্নযোগে দেখেছে নিশ্চয় সে আমাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখবে।’ [বোখারী, মুসলিম, মিশকাত-কিতাবুর রু’ইয়া: পৃ. ৩৯৪] বুঝা গেল যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রকৃত হায়াত নিয়ে জীবিত এবং পৃৃথিবীর যে কোন স্থানে চান সেখানে গিয়ে স্বীয় আশেক্বদেরকে নিদ্রা ও জাগ্রত অবস্থায় দর্শন দিয়ে ধন্য করতে পারেন। বর্ণিত আছে যে, আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহমাতুল্লাহি আলায়হি পঁচাত্তর বার জাগ্রতাবস্থায় প্রিয়নবীর দীদার লাভ করেছেন।

হাদীস-৪
সম্মানিত মুহাদ্দেসীনে কেরাম, তাবরানী ম’ুজামে কবীর, ন‘ঈম ইবনে হাম্মাদ কিতাবুল ফিতান এবং আবূ নু‘আয়ম হুলইয়াতুল আওলিয়ার মধ্যে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা হতে বর্ণনা করেন, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পাক সমগ্র সৃষ্টিজগত আমার সম্মুখে (এমনভাবে) পেশ করেছেন যে, এতে আমি দুনিয়া এবং ক্বিয়ামত অবধি যা কিছু হবে সবকিছু এমনভাবে দেখেছি كَانَّمَا اَنْظُرُ اِلَى كَفِّىْ هٰذِهِ অর্থাৎ যেমন আমি আমার দুই হাতের তালু দেখতে পাচ্ছি। [যারক্বানী: ৭ম খণ্ড, খাসা-ইসে কুবরা: ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪০০, রূহুল বয়ান: ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪০১]

হাদীস-৫
বোখারী, মুসলিম, মিশকাত ও অন্যান্য হাদীসগ্রন্থে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নামাযের মাঝে ‘আত্তাহিয়্যাতু’ পড়ার যে একক নিয়ম শিক্ষা দিয়েছেন তা এরূপ যে, صيغه خطاب (সম্বোধনসূচক শব্দ) দ্বারা এরূপ বলতে হবে- اَلسَّلَامُ عَلَيْكَ اَيُّهَاالنَّبِىُّ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكاتُهُ-
এখানে হযরত عليك মধ্যম পুরুষ সর্বনাম দ্বারা সালাম দিতে হবে, যা দ্বারা উপস্থিত ব্যক্তিকে সম্বোধন করা হয়।
এখানে আবদুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কতিপয় আরিফ বান্দা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, সম্বোধন সূচক শব্দ দ্বারা সালাম করার কারণ এ যে, হাক্বীক্বতে মুহাম্মদিয়া সকল বস্তুতে বিরাজমান। সুতরাং মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বস্তু জগতে সব কিছুকে পরিবেষ্টন করে আছেন। সুতরাং তিনি সকল নামাযীর নিকট হাযির ও শাহিদ এবং তার ব্যক্তি সত্তায় বিরাজমান। প্রত্যেক নামাযীকে এ বিষয়টি ভালভাবে অবহিত হওয়া জরুরী।
[আশি’‘আতুল লুম‘আত: ৪৩০ পৃষ্ঠা, হাশিয়ায়ে আখবারুল আখইয়ার: ৩১৬ পৃষ্ঠা] তাক্বলীদের বিরূদ্ধবাদী ওহাবীদের ইমাম নওয়াব সিদ্দীক্ব হাসান খাঁন ভূপালী উক্ত বিষয়ের উপর আলোচনা করার পর ‘মিস্কুল খিতাম’ (مسك الختام) নামক গ্রন্থের ২৪৪ পৃষ্ঠায় নিন্মোক্ত পংক্তিখানা লিখেছেন-
در راہ عشق مرحله قرب وبُعد نيست – مى بينيمت عياں ودعامى فرستمت
অর্থাৎ ইশক্বের পথে নিকট ও দূরের কোন সোপান নেই। আমি তোমাকে প্রকাশ্যে দেখতে পাচ্ছি এবং তোমার অনুকূলে আমার শুভ কামনা প্রেরণ করছি।

হাদীস-৬
হাদীস ও জীবন চরিতমূলক গ্রন্থের আলোকে প্রত্যেক মুসলমান জানেন যে, মি’রাজের রাত্রিতে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মসজিদে আক্বসার মধ্যে সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরামের ইমামতি করেছিলেন এবং এরপরে সাতটি আসমানে বিভিন্ন নবী আলায়হিমুস্ সালাম-এর সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন; অথচ তাঁরা নিজ নিজ কবরেও অবস্থান করেছিলেন। শায়খে আকবর মুহিউদ্দীন ইবনে আরাবী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি হতে ইমাম শা’রানী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বর্ণনা করেছেন যে, মি’রাজের হাদীস শরীফ দ্বারা একই সময়ে একই সত্তার একাধিক স্থানে উপস্থিত হওয়া প্রমাণিত হয়।
আল্লামা ইঊসুফ নাবহানী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি শায়খ আলী হালাবী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি হতে বর্ণনা করেন যে, অন্যান্য নবীগণের ব্যাপারে যখন একই সময়ে একাধিক স্থানে উপস্থিত হওয়া সত্য প্রমাণিত হলো, তখন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ক্ষেত্রে একই সময়ে প্রত্যেক স্থানে হাযির-নাযির হওয়া সন্দেহাতীতভাবে সত্য। [কিতাবুল ইয়াওয়াক্বীত: ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৬, জাওয়াহেরুল বিহার: ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৮৪]

হাদীস-৭
বোখারী, মুসলিম ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মৃত ব্যক্তিকে যখন কবরে সমাধিস্থ করা হবে তখনই দু’জন ফেরেশতা (মুনকার ও নকীর) তার কাছে এসে তাকে বসিয়ে (মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর প্রতি ইশারা করে বলবেন-مَا كُنْتَ تَقُوْلُ فِى هَذَا الرَّجُلِ অর্থাৎ ওই সত্তা (প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) সম্পর্কে তুমি কি বলতে? এখানে هذا ইঙ্গিত বাচক পদটি রাসূলুল্লাহ্ বান্দার কবরে হাযির-নাযির ও নিকটবর্তী হবার প্রমাণবহ।

শায়খ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর মত বিশ্ববিখ্যাত হাদীস বিশারদ উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, এতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর যিয়ারতে উদগ্রীব ও উৎসর্গী কৃতপ্রাণ আশেক্বদের জন্যে শুভ সংবাদ রয়েছে। [লুম‘আত: পৃষ্ঠা-১২৪]

বলা বাহুল্য, এতে আশ্চর্য হওয়ার বা একে অস্বীকার করার জো নেই। কারণ যে ক্ষেত্রে মালাকুল মওত ও মুনকার-নকীরের একই সময়ে একাধিক মৃতের কবরে হাযির হওয়াতে না কোন প্রকার শিরকের প্রশ্ন আসে, না তাতে কোন তা’ভীল বা ভিন্ন কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ এবং সবার উর্ধ্বে যাঁর শান, তাঁর জন্যে একই সময়ে প্রত্যেক জায়গায় প্রত্যেক কবরে হাযির-নাযির হওয়াতে শিরক অথবা তা’ভীল করার প্রশ্ন আসবে কেন? তবে কি তাঁদের তুলনায় রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মাঝে কামালিয়াতের ঘাটতি আছে? মোটেই নেই বরং যেখানে ফেরেশতাদের ক্ষমতা হয়েছে, সেখানে প্রিয়নবীর ক্ষমতা আরো বেশী রয়েছে; অথচ যেখানে প্রিয়নবীর রসায়ী (ক্ষমতা) হয়েছে, সেখানে ফেরেশতাদের পৌঁছানো আদৌ সম্ভব নয়।
এক্ষেত্রে শীর্ষতম ফেরেশতা হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম-এর অবিস্মরণীয় নিন্মোক্ত উক্তিটি সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য-
اگرايك سرموئے برترپرم- فروغ تجلى بسوزد پرم
অর্থাৎ যদি আমি এক চুল বরাবরও উপরের দিকে অগ্রসর হই, তবে আমার ডানা পুড়ে ভস্ম হয়ে যাবে।
আরিফ বিল্লাহ্ আল্লামা আবদুল ওয়াহ্হাব শা’রানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেছেন, মদীনাওয়ালা নবী এবং আম্বিয়ায়ে কেরাম ও আওলিয়ায়ে কেরাম যথাক্রমে আপন আপন উম্মত ও ভক্ত-অনুরক্ত এবং অনুসারী-মুরীদের বিপদে-আপদে সাহায্য করেন, মৃত্যুকালে ও মুনকার-নকীরের প্রশ্ন জিজ্ঞাসাকালে তাদের প্রতি সুদৃষ্টি রাখেন এবং মদদ করেন, সবশেষে ক্বিয়ামতের দিনে তাদের জন্য সুপারিশ করবেন। অন্যান্য সম্মানিত নবীগণ ও আওলিয়ায়ে কেরামের ক্ষেত্রে এরূপ হলে সরকারে মদীনা (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর ব্যাপারে কি হবে, তা আর বলার অপেক্ষাই রাখে না। হুযূর করীম (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর রাজ্য ও রাজত্ব তো আল্লাহর অনুগ্রহক্রমে অতি বৃহৎ এবং সুদুর প্রসারী। [আল্ মীযানুল কুবরা: পৃষ্ঠা-৫৩]

হাদীস-৮
রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- اِذَادَخَلَتِ الشَّوْكَةُ فِىْ رِجْلِ اَحَدِكُمْ اَجِدُ اَلَمَهَا
অর্থাৎ তোমাদের কারো পায়ে যখন কাঁটা বিদ্ধ হয়, তখন আমি এর ব্যথা অনুভব করি। [জাওয়াহেরুল বেহার: ৩য় খণ্ড, ১০৪৭পৃষ্ঠা] বলা বাহুল্য যে, অনুভূতি রূহের উপর নির্ভরশীল, রূহবিহীন কায়া অনুভূতিশূন্য। সুতরাং এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক মু’মিনের জন্যে তাদের রূহতুল্য। প্রত্যেক মু’মিনের সাথে তাঁর এমন ঘনিষ্টতা ও একাত্মতার সম্পর্ক রয়েছে, যেমনটি দেহের সাথে রূহের। সে কারণেই তিনি তাদের বিষাদ-বেদনা অনুভব করেন।

হাদীস- ৯ ও ১০
হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি স্বপ্নে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)কে রক্তের বোতল হাতে ধূলা মলিন অবস্থায় দেখতে পেলাম, অতঃপর আমি আরয করলাম, ‘‘আমার মা-বাবা আপনার উপর ক্বোরবান হোক, এটা কি?’’ উত্তরে হুযূর (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘‘এ হচ্ছে হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁর সহযোদ্ধাদের রক্তধারা- যা আমি আজ একত্রিত করেছি।’’ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, যখন আমি যাচাই করে দেখতে পেলাম ওই সময়টিই ছিলো কারবালার মর্মন্তুদ ঘটনার বিভীষিকাময় মুহূর্ত।
অনুরূপ, হযরত উম্মে সালামাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা স্বপ্নযোগে রাসূলে পাককে ধূলা মিশ্রিত অবস্থায় দেখতে পেলেন এবং এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) প্রতি উত্তরে বলেন, شَهِدْتُ قَتْلَ الحُسَيْنِ اَنِفًا সবেমাত্র আমি আমার প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু)-এর শাহাদাত স্থলে হাযির ছিলাম। [বায়হাক্বী, তিরমিযী, মিশকাত: পৃষ্ঠা ৫৭০-৫৭২] প্রকৃত রহস্য এ যে, সরকারে দু’আলম (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) সংঘটিত সকল অবস্থা সম্পর্কে সম্যক পরিজ্ঞাত এবং স্বয়ং তথাকার প্রত্যক্ষদর্শী।

হাদীস-১১
মহানবী (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা সমগ্র যমীনকে আমার সম্মুখে হাতের তালুর ন্যায় একত্রিত করে দিয়েছেন এবং এতে আমি পূর্ব পশ্চিম সব কিছু দেখতে পেয়েছি। [মুসলিম, মিশকাত শরীফ: ৫০২ পৃষ্ঠা]

হাদীস-১২
যখন কোন স্ত্রীলোক স্বীয় স্বামীকে কোন প্রকার দুঃখ বা যন্ত্রণা দেয়, তখন বেহেশতে ওই ব্যক্তির হুর উক্ত স্ত্রীকে সম্বোধন করে বলে, ‘‘আল্লাহ্ তোমাকে লা’নত করুন! তিনিতো (এ স্বামী) তোমার কাছে স্বল্প কয়েকদিনের মেহমান ও নিকটাত্মীয় স্বরূপ; অতঃপর তিনি আমার নিকট চলে আসবেন।’’
[তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মিশকাত: ২৮১ পৃষ্ঠা] মিশকাত শরীফের ভাষ্যকার মোল্লা আলী ক্বারী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেছেন, হাদীস ও স্বামীর অবাধ্য স্ত্রীর উপর ফেরেশতার লা’নত সম্বলিত হাদীস দ্বারা এ বিষয়টিও প্রতীয়মান হয় যে, দুনিয়াবাসীর কৃতকর্ম সম্বন্ধে বেহেশতের হুর, গেলমান এবং ফেরেশতারাও অবগত আছেন। [মেশকাত ৩য় খণ্ড, ৪৬৭ পৃ.] হুযূর (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর গোলামদের বেহেশতী সাথী হুরদের যদি এ অবস্থা হয় যে, পৃথিবীর যে কোন অঞ্চলে তার ইহলৌকিক স্ত্রীর সকল কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত, সেখানে তাঁর হাযির-নাযির হওয়াতে কোন প্রকারের সন্দেহ এবং র্শিক বলার অবকাশ থাকতে পারে না।

সর্বজন স্বীকৃত সিদ্ধান্ত
বিশিষ্ট হাদীস বিশারদ আল্লামা শায়খ আবদুল হক্ব মোহাদিসে দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বর্ণনা করেন যে, ফুরূ‘ঈ তথা বিভিন্ন অনুমিত মাসআলাসমূহে যদিও ওলামায়ে উম্মতের মত পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই যে, সরকারে দু’আলম (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) হায়াতে হাক্বীক্বী নিয়েই জীবিত। এতে না আছে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ, না কোনরূপ তা’ভীলের স্থান এবং তিনি উম্মতের আমলের উপর হাযির-নাযির এবং সত্যানুসন্ধিৎসুকে যেমনি পথ নির্দেশনা দেন তেমনি তাঁর দ্বারস্থ সকলকে তিনি ফয়য বিতরণ করে থাকেন।
[রেসালায়ে আক্বরাবুস্ সুবুল হাশিয়ায়ে আখবারুল আখইয়ার পৃষ্ঠা ১৫৫] ইমাম সূয়ূতী ও শেখ আলী হালবী রহমাতুল্লাহি আলায়হিমা হাযির-নাযির বিষয়টির উপর স্বতন্ত্র পুস্তক রচনা করেছেন।ক্স

প্রতিপক্ষের স্বীকৃতি
দেওবন্দী এবং ওহাবীদের বিশিষ্ট নেতা মৌলভী রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী এবং মৌলভী হোসাইন আহমদ মাদানী লিখেছেন, মুরীদ যেন একথা দৃঢ়তার সাথে জেনে রাখে যে, পীরের রূহ শুধুমাত্র একটি স্থানে আবদ্ধ নয়। এজন্যে মুরীদ কাছে থাকুক বা দূরে থাকুক, বাহ্যিক দৃষ্টিতে মুরীদ পীর হতে দূরে হলেও সে তাঁর রূহানিয়াত থেকে দূরে নয়। [এমদাদুস্সুলূক: পৃষ্ঠা ২৪, ও শিহাবুস্সাক্বিব: পৃষ্ঠা ৬১]

আল্লাহু আকবর! যখন নজদী ও দেওবন্দীরা নিজ নিজ ধারণামতে পীর সাহেবের রূহ হতে দূরে নয়, সেখানে আহলে ইসলাম কিভাবে স্বীয় নবী (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর রূহানিয়্যাত, নূরানিয়্যাত এবং তাঁর রহমত এবং কৃপাদৃষ্টি থেকে দূরে হবেন? কিন্তু এ ক্ষেত্রে ঈমান এবং ইসলাম পূর্বশর্ত।
ديدئه كو ركوكيا آئے نظر كيا ديكھے
অর্থাৎ যার চক্ষু দৃষ্টিহীন, সে কোন বস্তুকে কি ভাবে দেখবে?

—০—

Share:

Leave Your Comment