গেয়ারভী শরিফের ইতিহাস

গেয়ারভী শরিফের ইতিহাস

মাওলানা মুহাম্মদ খোরশেদ আলম আল-ক্বাদেরী

‘উর্দু ভাষায় এগারকে ‘গিয়ারাহ্’ বলে। আর ‘একাদশ’কে বলা হয় ‘গিয়ারভী’। সুতরাং মাসের এগার তারিখের ইবাদতবন্দেগীক ‘গিয়ারভী শরীফ বলা হয়। হাকীমূল উম্মুত মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী (রহমাতুল­াহি আলায়হি) স্বীয় রচিত তাফসীর গ্রন্থ ‘আশরাফুত্ তাফসীর’ সংক্ষেপে তাফসীরে নঈমীর প্রথম পারা, সূরা বাক্বারা ২৭ নম্বর আয়াত, পৃ. ২৯৭ তে হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম-এর তাওবা প্রসঙ্গে সংক্ষেপে গেয়ারভী শরীফের ভিত্তি ও ইতিকথা লিপিবদ্ধ করেছেন। সেখানে তিনি প্রসিদ্ধ আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস্ সালাম-এর গেয়ারভী শরীফ পালনের ইতিকথা বর্ণনা করেছেন। নিম্নে তা উলে­খ করা হলো-
১. হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম কর্তৃক গেয়ারভী শরীফ পালন
সমগ্র মানবজাতির আদি পিতা ও আদিমাতা হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম ও হযরত হাওয়া আলাইহাস্ সালাম বেহেশত হতে দুনিয়াতে আসার পর আল­াহর নিষেধের কথা ভুলে যাবার জন্য অনুশোচনায় ৩৬০ বছর একাধারে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়ে ছিলেন এবং তাওবা করেছিলেন। তাঁদের প্রথম আমল ছিল অনুতাপ ও তাওবা। তাই আল­াহর নিকট বান্দার তাওবা ও চোখের পানি অতি প্রিয়। ৩৬০ বছর পর মহান আল­াহ্ পাকের দয়া হলো। হযরত আদম আলায়হিস্ সালামের অন্তরে আল­াহ্ তা‘আলা কতিপয় তাওবার বাক্য গোপনে ঢেলে দিলেন। হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম ওই সব দো‘আ করলেন। তিনি মহান আল­াহ্ পাকের আরশে আজীমের গায়ে লেখা নাম মুহাম্মদুর রাসূলুল­াহ্ সাল­াল­াহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল­াম-এর ওসীলা ধরে ক্ষমা চাইলেন। আল­াহ্ তা‘আলা এতে খুশি হয়ে হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম ও হযরত হাওয়া আলাইহাস্ সালাম-এর তাওবা কবুল করলেন। যেদিন আল­াহ্ তা‘আলা তাদের দো‘আ ও তাওবা কবুল করলেন, ওই দিনটি ছিল আশুরা তথা মুহাররমের দশ তারিখ, শুক্রবার। এই মহাবিপদ থেকে মুক্তি পেয়ে হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম ও হাওয়া আলাইহাস্ সালাম ওই রাতে অর্থাৎ দশ তারিখ দিবাগত রাতে তাওবা কবুল ও বিপদ থেকে মুক্তির শুকরিয়া স্বরূপ যে বিশেষ ইবাদত করেছিলেন সেই বিশেষ ইবাদতেই ছিল তাঁদের গেয়ারভী শরীফ।
২. হযরত নূহ্ আলায়হিস্ সালাম মহা প্লাবনের সময় রজব মাসের ১০ তারিখ থেকে মুহাররম মাসের দশ তারিখ পর্যন্ত ছয় মাস ৭২ জন সঙ্গী নিয়ে কিশতির মধ্যে ভাসমান অবস্থায় ছিলেন। গাছ-পালা, পাহাড়-পর্বত সবকিছু পানির নিচে। অতঃপর আল­াহর অশেষ রহমতে ৬ মাস পর হযরত নূহ্ আলায়হিস্ সালাম এর কিশতি বা নৌকা জুদী পাহাড়ের চূড়ায় এসে ঠেকল। পানি কমে গেলে তিনি দুনিয়ায় নেমে আসেন। যেদিন নূহ্ আলাইহিস্ সালাম কিশতি থেকে অবতরণ করলেন সেই দিন ছিল আশুরা তথা মুহাররমের দশ তারিখ। তিনি এই মহাবিপদ থেকে মহামুক্তি উপলক্ষে সকলকে নিয়ে ১০ তারিখ দিবাগত রাতে মহান আল­াহ্ তা‘আলার শুকরিয়া স্বরূপ ইবাদত করেছিলেন। এটা ছিল হযরত নূহ্ আলায়হিস্ সালাম এর গেয়ারভী শরীফ।
৩. হযরত ইবরাহীম আলায়হিস্ সালামকে কোন রকমেই তার ইসলাম প্রচার থেকে বিরত করতে না পেরে এবং সকল বাহাস বিতর্কে পরাজিত হয়ে অবশেষে জালেম বাদশাহ্ নমরূদ হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালামকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করলো। চলি­শ দিন পর্যন্ত তাকে অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে রাখা হলো। আল­াহ্ পাকের অশেষ রহমতের আগুনের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলো এবং অগ্নিকুণ্ড ফুল বাগিচায় পরিণত হলো। চলি­শ দিন পর যেদিন হযরত ইবরাহীম আলায়হিস্ সালাম আগুন থেকে বের হয়ে আসলেন সেই দিনটিও ছিল আশুরা তথা মুহাররমের ১০ তারিখ। তিনি এই মহামুক্তির শুকরিয়া আদায় করলেন ১০ তারিখের রাতে বিশেষ ইবাদতের মাধ্যমে। আর এটাই ছিল হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালামের গেয়ারভী শরীফ।
৪. হযরত ইয়াকুব আলায়হিস্ সালাম আপন প্রিয়তম পুত্র হযরত ইউসুফ আলায়হিস্ সালামকে হারিয়ে চলি­শ বছর একাধারে কান্নারত ছিলেন। পবিত্র কালামূল­াহ্ শরীফের ১২ পারার সূরা ইউসুফে বর্ণিত বহু ঘটনার পর অবশেষে তিনি হারানো পুত্রকে ফিরে পেলেন এবং তাঁর অন্ধ চক্ষু হযরত ইউসুফ আলায়হিস্ সালামের জামার বরকতে ফিরে পেলেন। এই দীর্ঘ বিপদ মুক্তির দিনটিও ছিল আশুরার দিন। হযরত ইয়াকুব আলায়হিস্ সালাম আল­াহ্ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করে ওই রাতে বিশেষ ইবাদত করেছিলেন। এটা ছিল হযরত ইয়াকুব আলায়হিস্ সালাম এর গেয়ারভী শরীফ।
৫. হযরত আইউব আলায়হিস্ সালাম মহান আল­াহ্ তা‘আলার পরীক্ষা স্বরূপ দীর্ঘ ১৮ বছর কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। পোকায় সমস্ত শরীরের মাংস খেয়ে শুধু হাড় বাকি রেখেছিল। অবশেষে হযরত আইউব আলায়হিস্ সালাম আমাদের দয়ালু নবীর ওসীলা নিয়ে আল­াহ্ পাকের দরবারে ফরিয়াদ করলে আল­াহ্ তা‘আলা তাঁর দোয়া-মুনাজাত কবুল করেন এবং তাকে রোগমুক্তি দেন। তাঁর এই রোগমুক্তির দিনটিও ছিল আশুরা তথা মুহাররমের ১০ তারিখ। তিনি ওই রোগমুক্তি ও ঈমানী পরীক্ষায় পাশের শুকরিয়া স্বরূপ ওই ১০ তারিখ দিবাগত রাত ইবাদতে কাটালেন। এটা ছিল হযরত আইউব আলায়হিস্ সালামের গেয়ারভী শরীফ।
৬. হযরত মুসা আলায়হিস্ সালাম ও বনী ইসরাঈলকে মিশরের অধিপতি ফেরাউন বহু কষ্ট দিয়েছিল। আল­াহর নবীর সাথে বেয়াদবী যখন সীমা ছাড়িয়ে যায় এবং তার খোদায়ী দাবীর মেয়াদ ফুরিয়ে যায়, তখন আল­াহর নির্দেশে হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম শিশুসহ ১২ লক্ষ বনী ইসরাইলকে নিয়ে মিশর ত্যাগ করেন। সামনে লোহিত সাগর। আল­াহ্ তা‘লার নির্দেশে হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম-এর লাঠির আঘাতে লোহিত সাগরের পানি দু’ভাগ হয়ে দু’দিকে পাহাড়ের মত দেয়াল স্বরূপ দাঁড়িয়ে যায় এবং ১২টি শুকনো রাস্তা হয়ে যায়। প্রত্যেক রাস্তা দিয়ে ১ লক্ষ লোক খুব দ্রুত গতিতে অতিক্রম করে নদীর অপর তীরে এশিয়া ভুখণ্ডে প্রবেশ করে। ফেরাউন তাদের পচাঁদ্বাবন করতে গিয়ে দু’দিকের পাহাড় সম পানির তোড়ে সৈন্যসহ ডুবে মরে যান। হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম ও তাঁর সঙ্গীদের এই মহামুক্তির দিনটিও ছিল আশুরার দিন। তিনি সঙ্গীসহ এই আশুরা তথা মুহাররমের ১০ তারিখ দিবাগত রাত আল­াহ্ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করার জন্য ইবাদতে মশগুল থাকেন। এটা ছিল হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম-এর গেয়ারভী শরীফ।
৭. হযরত ইউনুস আলায়হিস্ সালাম দীর্ঘ চলি­শ দিন পর মাছের পেট থেকে মোসলের নাইনুওয়া নামক স্থানে মুক্তি পেয়েছিলেন। আল­াহর নির্দেশে তিনি তাঁর স¤প্রদায় লোকদের কাছে কলেমার দাওয়াত দিতে গেলে তারা হযরত ইউনুস আলায়হিস্ সালামকে উল্টো অত্যাচার, নির্যাতন করে ভীষণ কষ্ট দেয়। রাগে ক্ষোভে হযরত ইউনুস আলায়হিস্ সালাম দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে রওয়ানা হলে পথিমধ্যে নদী পড়ে যায়। ওপারে যাওয়ার জন্য নদীতে নৌকায় চড়লেন। মাঝপথে তিনি নদীতে ঝাপ দিলে আল­াহর কুদরতের পরীক্ষা স্বরূপ হযরত ইউনুছ আলায়হিস্ সালাম মাছের পেটে ঢুকে যান। তিনি যেদিন মাছের পেট থেকে মুক্তি পান সেদিনও ছিল আশুরা তথা মুহাররমের ১০ তারিখ। তাই তিনি ওই ১০ তারিখ দিবাগত রাতে শারীরিক দুর্বলতা থাকা সত্তে¡ও আল­াহ্ পাকের শুকরিয়া আদায় করে বিশেষ ইবাদতে মশগুল ছিলেন। এটাই ছিল হযরত ইউনুস আলায়হিস্ সালামের গেয়ারভী শরীফ।
৮. হযরত দাউদ আলায়হিস্ সালাম একশতম বিবাহের কারণে আল­াহ তা‘আলার ইঙ্গিতে অনুতপ্ত হয়ে আল­াহর কাছে সিজদায় পড়ে তাওবা করেন। আল­াহ্ তা‘আলা তাঁর তাওবা কবুল করে খুশি হয়ে যান। ওই দিনটিও ছিল আশুরার দিন। তাই হযরত দাউদ আলায়হিস্ সালাম ওই রাতে ইবাদতের মাধ্যমে আল­াহ্ পাকের শুকরিয়া আদায় করেন। এটা ছিল হযরত দাউদ আলায়হিস্ সালামের গেয়ারভী শরীফ।
৯. হযরত সুলায়মান আলায়হিস্ সালাম একবার জ্বিন জাতির কারণে রাজ্য ও সিংহাসন হারা হয়েছিলেন। জিন জাতি তাঁর মুজিজার আংটি লুকিয়ে রেখেছিল। ফলে তার রাজ্য ও সিংহাসন হাতছাড়া হয়ে যায়। চলি­শ দিন পর জিন জাতি কর্তৃক লুকায়িত তাঁর হারানো আংটি ফেরত পেয়ে তাঁর রাজ্য ও সিংহাসন উদ্ধার করেন এবং জিন জাতিকে শাস্তি প্রদান করেন। সৌভাগ্যক্রমে হযরত সুলায়মান আলায়হিস্ সালাম হারানো নেয়ামতটি যেদিন ফেরত পেয়েছিলেন সেদিন ছিল মুহাররমের ১০ তারিখ। তিনি মহান আল­াহ্র দরবারে এই নিয়ামতের শুকরিয়া স্বরূপ ওই রাতে ইবাদত-বন্দেগী করেন। এটা ছিল হযরত সুলায়মান আলায়হিস্ সালাম এর গেয়ারভী শরীফ।
১০. আল­াহর নবী হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালামকে ইয়াহুদি জাতি কখনো বরদাস্ত করতে পারেনি। ইয়াহুদি রাজা হেরো ডেটাস গুপ্তচর মারফত হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালামকে গ্রেফতার ও শহীদ করার ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু আল­াহ্ তা‘আলা হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালামকে জিবরাঈল ফিরিশতার মাধ্যমে ৪র্থ আসমানে তুলে নেন এবং ওই গুপ্তচরের আকৃতি পরিবর্তন করে হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালামের আকৃতির অনুরূপ করে দেন। অবশেষে হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালামের শত্র“ই ধৃত হয়ে শূলে বিদ্ধ হয়। হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম এর আসমানে উত্তোলনের দিনটিও ছিল আশুরার দিন। তিনি ওই মহাবিপদ থেকে মুক্তি পেয়ে ওই রাতে আকাশে আল­াহ্ পাকের শুকরিয়া আদায় করেন ইবাদতের মাধ্যমে। এটাই ছিল হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম এর গেয়ারভী শরীফ।
১১. আক্বা ও মাওলা তাজেদারে মদীনা, শাফাআতের কাণ্ডারী, উম্মতকে ত্বরানে ওয়ালা হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল­াল­াহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল­াম ষষ্ঠ হিজরীতে চৌদ্দশত সাহাবায়ে কেরামকে সাথে নিয়ে ওমরাহ্ করার উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফ রওয়ানা হন। কিন্তু মক্কার অদূরে হুদায়বিয়া নামক জায়গায় পৌছে মক্কার কুরাইশদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হন। ১৯দিন পর অবশেষে একটি চুক্তির মাধ্যমে তিনি সে বছর ওমরাহ্ না করেই মদীনার পথে ফিরতি যাত্রা করেন। সাহাবায়ে কেরাম এটাকে গ্লানি মনে করে মনক্ষুণœ হলেও রাসূলে পাকের নির্দেশ নতশিরে মেনে নেন। মদিনার পথে কুরা গামীম নামক স্থানে পৌঁছে নবী করীম সাল­াল­াহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল­াম বিশ্রামের জন্য তাঁবু ফেলেন। ওইখানে সূরা আল ফাতাহ্ এর প্রথম কয়েকটি আয়াত নাযিল হয়। এতে মনক্ষুণœ সাহাবায়ে কেরামকে সান্ত্বনা দিয়ে আল­াহ্ তার প্রিয় হাবীব সাল­াল­াহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল­ামকে লক্ষ করে বলেন, হে রাসূল সাল­াল­াহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল­াম! আমি আপনার কারণেই হুদায়বিয়ার সন্ধিকে একটি মহান বিজয় হিসেবে দান করেছি। আপনার ওসীলায় আপনার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের গুনাহ্ মাফ করে দিয়েছেন। যে দিন ওই সুসংবাদ সম্পন্ন আয়াত নাযিল হয়, সে দিনটি ছিল মুহাররম মাসের ১০ তারিখ। মহাবিজয় ও গুনাহ্ মাগফিরাতের সুসংবাদ শ্রবণ করে সাহাবায়ে কেরাম হুদায়বিয়ার চুক্তির প্রকৃত রহস্য বুঝতে পারেন। নবী করীম সাল­াল­াহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল­াম এবং সাহাবায়ে কেরাম ওই ১০ তারিখের রাত্রে আল­াহ্ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করে ইবাদতের মাধ্যমে কাটিয়ে দেন। এটা ছিল হুজুর পাক সাল­াল­াহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল­াম ও সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল­াহু তা‘আলা আনহুমগণের গেয়ারভী শরীফ।
প্রিয় পাঠক, এখানে সর্বমোট ১১ জন প্রসিদ্ধ নবী ও রাসূল আলায়হিমুস্ সালাম এর গেয়ারভী শরীফের দলীল ও ইতিহাস তুলে ধরা হলো। এভাবে একলক্ষ চব্বিশ হাজার, মতান্তরে দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গাম্বর সকলেই গেয়ারভী শরীফ পালন করেছেন যার প্রমাণ কুরআন, হাদীস ও বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থে বিদ্যমান। এখানে ১১ জনের দলিল তুলে ধরলাম। যেহেতু প্রসঙ্গ হচ্ছে গেয়ারভী শরীফ। সেহেতু গেয়ারভী শরীফের ভাবার্থ হচ্ছে প্রত্যেক চন্দ্রমাসের ১১ তারিখের রাতে কোন না কোন নবী রাসূল আলায়হিমুস্ সালাম, মহান আল­াহ্ পাকের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শুকরিয়া স্বরূপ বিশেষ ইবাদত তথা, নামায, তাসবীহ্, তাহলীল, জিকির-আজকার, আল­াহর কালাম, তিলাওয়াতসহ বিভিন্ন নফল ইবাদত করে আল­াহ পাকের পক্ষ থেকে দয়া, অনুগ্রহ, করুনা, ক্ষমা ইত্যাদি পেয়ে তাঁরা প্রিয় পাত্র হয়েছেন। অতএব নবী রাসূলগণ যেহেতু সম্মানিত, আল­াহ্ পাকের দেয়া আরবী মাস, তথা চন্দ্রমাসগুলো সম্মানিত, সেই হিসেবে উক্ত তারিখের ইবাদতকে ‘গেয়ারভী শরীফ’ বা একাদশ শরীফ’ও বলা হয়। আর এই একাদশ শরীফের প্রতি লক্ষ্য রেখেই এগারজন নবী ও রাসূল আলায়হিমুস্ সালামগণের দলিল ও ইতিহাস তুলে ধরা হলোঃ
পীরানে পীর দস্তগীর মাহবুবে সুবহানী গাউসুল আযম হযরত আবদুল কাদের জীলানী আল-হাসানী ওয়াল হুসাইনী রাহমাতুল­াহি আলায়হি কিতাবের নবীগণের এই গেয়ারভী শরীফ পেলেন-
‘গেয়ারভী শরীফ’ মূলত খতম ও দু‘আ বিশেষ। হযরত বড় পীর গাউসুল আযম আবদুল কাদের জিলানী রাহমাতুল­াহি আলায়হির অনুকরণে প্রতি চান্দ্রমাসের ১১ তারিখের রাতে বা দিনে গাউছে পাকের পবিত্র রূহে ইছালে সাওয়াবের উদ্দেশ্যে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ওলামা ও পীর মাশায়েখ উক্ত গেয়ারভী শরীফ বিশেষ নিয়মে খতমের মাধ্যমে পালন করে থাকেন। হযরত গাউছে পাক আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল­াহি আলায়হি কিভাবে এই গেয়ারভী শরীফ পেলেন সে সম্পর্কে ‘মীলাদে শায়খে বরহক’ নামক কিতাবে বর্ণিত আছে-
হযরত গাউসুল আজম আবদুল কাদের জিলানী রাহমাতুল­াহি আলায়হি (৪৭১-৫৬১হিজরী) নবী করীম সাল­াল­াহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল­াম-এর বেলাদত দিবস প্রতি বছর ১২ রবিউল আউয়াল তারিখটি নিয়মিতভাবে ভক্তি ও শ্রদ্ধাসহকারে পালন করতেন। একদিন স্বপ্নযোগে নবী করীম সাল­াল­াহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল­াম গাউছে পাককে বললেন- ১২ রবিউল আউয়াল আমার মিলাদ শরীফকে তুমি যেভাবে সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে আমার মহব্বতে পালন করে আসছ এর বিনিময়ে আমি নবী সন্তুষ্ট হয়ে তোমাকে সম্মানিত নবীগণের ‘গেয়ারভী শরীফ’ দান করলাম। (সুবহানাল­াহ্!)
হযরত গাউছে পাক আবদুল কাদের জিলানী রাহমাতুল­াহি আলায়হির তরিকাসহ অন্যান্য ত্বরিকার মাশায়েখ ও হযরত গাউসে পাকের অনুসরণে প্রতি চান্দ্র মাসের ১১ তারিখের রাতে বা দিনে বিশেষ নিয়মে এ গেয়ারভী শরীফ পালন করে থাকেন এবং কেয়ামত পর্যন্ত এটা চালু থাকবে, ইনশাআল­াহ্।

গেয়ারভী শরীফের ফযিলত-
‘ফাযায়েলে গাউসিয়া’ কিতাবের মধ্যে পাওয়া যায়, যে ব্যক্তি নিয়মিতভাবে প্রতি চাঁদের ১১ তারিখে গেয়ারভী শরীফ পালন করবে, সে অল্পদিনের মধ্যে ধনবান ও স্বচ্ছল হবে এবং দারিদ্র্য দূর হয়ে যাবে। যে এটাকে অস্বীকার করবে, সে দারিদ্যের মধ্যে থাকবে। যেখানে বা যে এলাকায় এই গেয়ারভী শরীফ পালিত হয় সেখানে আল­াহ্ পাকের রহমত নাযিল হয়। কেননা হাদীস শরীফে আছে- نَتْزِلُ الرَّحْمَةُ عِنْدَ ذِكْرِ الصَّالِحِيْنَ অর্থাৎ আউলিয়া কেরামের জিকিরের মজলিশে আল­াহর রহমত নাযিল হয়। যে ব্যক্তি গেয়ারভী শরীফ পালন করবে, সে খায়র ও বরকত লাভ করবে। যে ব্যক্তি নিয়মিতভাবে গেয়ারভী শরীফ পালন করবে, সে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাবে, দুঃখ ও চিন্তামুক্ত হবে এবং সুখে-শান্তিতে জীবন যাপন করবে। মহান আল­াহ্ পাক তাঁর প্রিয় হাবীব সাল­াল­াহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল­াম-এর ওসীলায় আউলিয়ায়ে কেরামগণের দেখানো পথ ও মত অনুসরণ করে তাঁদের রূহানী ফয়ূজাত অর্জনের মাধ্যমে আল­াহ্ পাক ও তাঁর প্রিয় হাবীব সাল­াল­াহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল­াম-এর নৈকট্য হাসিল করার তাওফিক দান করুক। আমিন।
প্রামাণ্যগ্রন্থ
১. বাহজাতুল আসরার, ২. তাফসীরে নঈমী, ৩. কারামতে গাউসুল আজম, ৪. গুনিয়াতুত্ তালেবীন, ৫. মিলাদে শায়খে বরহক ও ৬. ফাজায়েলে গাউছিয়া।

Share:

Leave Your Comment