ক্বোরবানীর তাৎপর্য ও উপকারিতা

ক্বোরবানীর তাৎপর্য ও উপকারিতা

মাওলানা মুহাম্মদ আবুল হাশেম

‘আল্ ক্বোরবান’ (القُرْبَانُ) শব্দটি আরবী, এর অর্থ: নৈকট্য, সান্নিধ্য, উৎসর্গ, ক্বোরবানী করা প্রভৃতি। পরিভাষায়-
القُرْبَانُ: ما يُتَقَرَّبُ بِهِ إِلَى اللهِ وَصَارَ فِي التَّعَارُفِ اِسْمًا لِلنَّسِيْكَةِ الَّتِيْ هِيَ الذَّبِيْحَة.
“ক্বোরবানী ওই বস্তু, যা দ্বারা আল্লাহ্ তা‘আলার নৈকট্য অর্জন করা হয়, শর‘ঈ পরিভাষায় এ ক্বোরবানী পশু যবেহ করার নাম।”
ক্বোরবানীর জন্য পবিত্র ক্বোরআন কারীমে সাধারণত তিনটি শব্দ ব্যবহার হয়। যথা:
১. ‘ক্বোরবানী’ (قربانی) : যেমন- إِذْ قَرَّبا قُرْبَاناً ‘যখন তারা উভয়ে এক একটা ক্বোরবানী পেশ করলো।”
(সূরা মা-ইদাহ: ২৭, তরজমা-ই কান্যুল ঈমান)
২. ‘মান্সাক’ ( منسک) : যেমন- ইরশাদ হচ্ছে,
وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا لِيَذْكُرُوْا اسْمَ اللّٰهِ عَلٰى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيْمَةِ الْأَنْعَامِ. (الحج: ২২: ৩৪)
“এবং প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি একটা ক্বোরবানী নির্ধারিত করেছি যেন তারা আল্লাহ্র নাম নেয় তাঁর প্রদত্ত বাক্শক্তিহীন চতুষ্পদ পশুগুলোর উপর।”
৩. ‘নাহ্র’ (نحر): যেমন- সূরা আল্ কাউসার-এ এসেছে,
إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ – فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ – إِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الْأَبْتَرُ.

“হে মাহবূব! নিশ্চয় আমি আপনাকে অসংখ্য গুণাবলি দান করেছি; সুতরাং আপনি আপনার রবের জন্য নামায পড়–ন এবং ক্বোরবানী করুন। নিশ্চয় যে আপনার শত্রæ, সে-ই সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।”
أَنَّ الْمُرَادَ هُوَ نَحْرُ الْبُدْنِ (تفسیر کبیر: ৩২؍৩১৭)
“উদ্দেশ্য হচ্ছে, পশু ক্বোরবানী।”

হাদীস-ই নবভীর আলোকে ক্বোরবানী:
 ইমাম তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ্ হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্  ইরশাদ করেন:
مَا عَمِلَ ابْنُ آدَمَ مِنْ عَمَلٍ يَوْمَ النَّحْرِ أَحَبَّ إِلَى اللّٰهِ مِنْ إِهْرَاقِ الدَّمِ وَإِنَّهُ لَيَأْتِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِقُرُوْنِهَا وَأَشْعَارِهَا وَأَظْلَافِهَا وَإِنَّ الدَّمَ لَيَقَعُ مِنَ اللهِ بمَكَانٍ قَبْلَ أَنْ يَّقَعَ بِالْأَرْضِ فَطِيْبُوْا بِهَا نَفْسًا.
“মানুষ ক্বোরবানীর ঈদের দিন এমন কোন নেক আমল করে না, যা রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে আল্লাহ্র নিকট অধিক প্রিয়। এ ক্বোরবানী ক্বিয়ামত দিবসে স্বীয় শিং, পশম ও খুরসহ আসবে। আর রক্ত ভ‚মিতে পতিত হওয়ার পূর্বেই আল্লাহ্র দরবারে ক্ববূল হয়ে যায়। সুতরাং আনন্দচিত্তে ক্বোরবানী করো।”

 হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
ضَحّٰى رَسُوْلُ اللّٰهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِكَبْشَيْنِ أَمْلَحَيْنِ أَقْرَنَيْنِ ذَبَحَهُمَا بِيَدِهِ وَسَمّٰى وَكَبَّرَ قَالَ: رَأَيْتُهُ وَاضِعًا قَدَمَهُ عَلٰى صِفَاحِهِمَا وَيَقُوْلُ: بِسْمِ اللّٰهِ وَاللّٰهُ أَكْبَرُ.
রসূলুল্লাহ্  দু’টি সাদা-কালো মিশ্রিত বর্ণের শিং বিশিষ্ট ছাগল (মেষ) ক্বোরবানী করলেন। তিনি ওইগুলোকে নিজ হাত মুবারক দ্বারা যবেহ করেছেন, বিস্মিল্লাহ্ ও তাকবীর বলেছেন। বর্ণনাকারী বলেন, আমি নবী করীমকে ওই বকরীগুলোর পার্শ¦দেশে স্বীয় পা মুবারক রাখতে দেখলাম। তিনি বলেছিলেন- ‘বিস্মিল্লাহি আল্লাহু আকবর।”

 ইমাম মুসলিম হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে বর্ণনা করেন,
أَنَّ رَسُوْلَ اللّٰهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَمَرَ بِكَبْشٍ أَقْرَنَ يَطَأُ فِيْ سَوَادٍ وَيَبْرَكُ فِيْ سَوَادٍ وَيَنْظُرُ فِيْ سَوَادٍ فَأُتِيَ بِهِ لِيُضَحِّيَ بِهِ قَالَ: يَا عَائِشَةُ هَلُمِّي الْمُدْيَةَ ثُمَّ قَالَ: اشْحَذِيْهَا بِحَجَرٍ فَفَعَلَتْ ثُمَّ أَخَذَهَا وَأَخَذَ الْكَبْشَ فَأَضْجَعَهُ ثُمَّ ذَبَحَهُ ثُمَّ قَالَ: بِسْمِ اللّٰهِ اللّٰهُمَّ تَقَبَّلْ مِنْ مُحَمَّدٍ وَآلِ مُحَمَّدٍ وَمِنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ .

“রাসূলুল্লাহ্  শিংবিশিষ্ট এমনি একটি ছাগল আনার আদেশ দিয়েছেন, যা কালো বর্ণে চলে, কালো রং-এ বসে এবং কালো রং-এ দেখে। অতঃপর তা তাঁর খিদমতে হাযির করা হলো- ক্বোরবানী করার জন্য। হুযূর ইরশাদ করেন: “হে আয়েশা! ছুরি আনো।” তারপর ইরশাদ করলেন, “সেটাকে পাথরে ধারালো করে নাও।” আমি তা করলাম। তারপর তিনি ছুরি নিলেন এবং ছাগলটিকে ধরে শায়িত করলেন। তারপর সেটাকে যবেহ করলেন। এরপর বললেন, ‘বিস্মিল্লাহ্’। হে আল্লাহ্! এটাকে মুহাম্মদ মোস্তফা, মুহাম্মদ মোস্তফার পরিবার-পরিজন এবং মুহাম্মদ মোস্তফা -এর উম্মতের পক্ষ থেকে ক্ববূল করো।”

 ইমাম বুখারী হযরত ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন,
كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَذْبَحُ وَيَنْحَرُ بِالْمُصَلّٰى.
“নবী করীম  ঈদগাহে যবেহ ও নহর করতেন।”

 ইমাম মুসলিম ও আবূ দাঊদ হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন। নবী করীম  ইরশাদ করেন:
اَلْبَقَرَةُ عَنْ سَبْعَةٍ وَالْجَزُوْرُ عَنْ سَبْعَةٍ.
“গরু সাতজনের পক্ষ থেকে এবং উট সাতজনের পক্ষ থেকে (ক্বোরবানী করা যায়)”
উপর্যুক্ত রেওয়ায়ত, যাতে মুহাম্মদ মোস্তফা, মুহাম্মদ মোস্তফার পরিবার-পরিজন এবং মুহাম্মদ মোস্তফা -এর উম্মতের বর্ণনা রয়েছে, তাতে আহমদ, আবূ দাঊদ ও তিরমিযী নি¤েœাক্ত শব্দাবলি বৃদ্ধি করেছেন-
اَللّٰهُمَّ هٰذَا عَنِّيْ وَعَمَّنْ لَمْ يُضَحِّ مِنْ أُمَّتِيْ.
“ হে আল্লাহ্! এটা আমার পক্ষ থেকে এবং আমার ওই সকল উম্মতের পক্ষ থেকে, যারা ক্বোরবানী করতে পারে না।”
সুবহানাল্লাহ্! উম্মতের সম্পদশালী ব্যক্তিবর্গকে তাদের ক্বোরবানী মুবারক হোক। খোদা তা‘আলা তা এভাবে মঞ্জুর করেন যে, সেটা হবে হালাল উপার্জন থেকে, নিষ্ঠার সাথে, উন্নত ও গৃহীত। উম্মতের দরিদ্রদের পরম সৌভাগ্য দেখুন, তাদের অভাবের অনুভ‚তিকে আক্বা করীম  নিজের পক্ষ থেকে ক্বোরবানী প্রদান করে সদাসর্বদার জন্য বিলুপ্ত করে দিয়েছেন। যাতে কোন হতদরিদ্র মুসলমান এটা ভেবে হীনমন্যতার শিকার না হয় যে, সম্পদশালীরা ক্বোরবানীর সমস্ত সাওয়াব অর্জন করে নিয়েছে আর আমরা বঞ্ছিত রয়ে গেলাম।
جو نہ بھولا ہم غریبوں کی رضا ـ ذکر اس کا اپنی عادت کیجئے
‘যিনি ভুলেন নি আমরা দরিদ্রদের সন্তুষ্টির কথা, তাঁরই যিক্র করাকে নিজ অভ্যাসে পরিণত করুন।”

হে উম্মতের দরিদ্রগণ! কখনো এটা ভাববেন না যে, আমরা ক্বোরবানীর প্রতিদান ও সাওয়াব থেকে বঞ্ছিত। এটি কখনোই নয়, তোমাদের ক্বোরবানীসমূহ কবূল, ধনী ব্যক্তিবর্গের ক্বোরবানীসমূহ কবূল ও প্রত্যাখ্যান উভয়ের অবকাশ রাখে, উপার্জন সন্দেহপূর্ণ হতে পারে। সম্পদ অবৈধ হতে পারে, নিয়তের বিশুদ্ধতায় তারতম্য হতে পারে, কিন্তু উম্মতের দরিদ্রদের ক্বোরবানী, যা আক্বা করীম  দিয়ে দিয়েছেন, তাতে কবূলই কবূল, প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সংশয়ও নেই। গরীবদের মুবারকবাদ!

আক্বা করীম  ক্বোরবানীর পশুগুলোকে শুয়ায়ে এ দো‘আ পড়েন:
إِنِّيْ وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِيْ فَطَرَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ عَلَى مِلَّةِ إِبْرَاهِيْمَ حَنِيْفًا وَّمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ إِنَّ صَلَاتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ لَا شَرِيْكَ لَهُ وَبِذٰلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ اللّٰهُمَّ مِنْكَ وَلَكَ عَنْ مُحَمَّدٍ وَأُمَّتِهِ بِسْمِ اللّٰهِ وَاللّٰهُ أَكْبَرُ.

“নিশ্চয় আমি নিজেকে ওই সত্তার দিকে ফেরালাম, যিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস সালাম-এর দ্বীনের উপর রয়ে; আমি সকল বে-দ্বীনী থেকে পৃথক। আমি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত নই। নিঃসন্দেহে আমার নামায, আমার ক্বোরবানী, আমার জীবন, আমার মৃত্যু সমগ্র জগতের মহান রবের জন্য; তাঁর কোন শরীক নেই। আমাকে এ কথার নির্দেশই প্রদান করা হয়েছে এবং আমি অনুগত বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত। হে আল্লাহ্! এটা তোমার পক্ষ থেকে এবং তোমারই জন্য মুহাম্মদ মোস্তফা ও তাঁর উম্মতের পক্ষ থেকে। বিস্মিল্লাহি আল্লাহু আকবর।”

 হানশ বলেন আমি হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে দু’টি ছাগল দিয়ে ক্বোরবানী দিতে দেখে আরয করলাম: এটা কি? তিনি বললেন:
إِنَّ رَسُوْلَ اللّٰهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَوْصَانِيْ أَنْ أُضَحِّيَ عَنْهُ فَأَنَا أُضَحِّيْ عَنْهُ.
‘আমাকে রসূলুল্লাহ্  নির্দেশ দিয়েছেন যেন আমি তাঁর পক্ষ থেকে এ ক্বোরবানী করি। সুতরাং আমি হুযূরের তরফ থেকে ক্বোরবানী করে থাকি।”
সুবহানাল্লাহ্! কেমন সৌভাগ্যবান ওই কল্যাণের অধিকারীগণ, যারা হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর পদাংক অনুসরণে পরম সম্মানিত রসূল ’র পক্ষ থেকেও আজও উন্নত ক্বোরবানী দিয়ে থাকেন, নিশ্চয় এতে আক্বা করীম  রূহ মুবারক খুশি হবেন এবং নিশ্চয় সেটার ওসীলায় তাদের নিজ নিজ ক্বোরবানীও গৃহিত হওয়ার মর্যাদা অর্জন করবে। আল্লাহ্ তা‘আলা তাওফীক্ব দান করুন।

 হযরত বারা বলেন, নবী করীম  ক্বোরবানীর দিন আমাদেরকে খোতবা দেন এবং ইরশাদ করেন:
إِنَّ أَوَّلَ مَا نَبْدَأُ بِهِ فِي يَوْمِنَا هٰذَا أَنْ نُصَلِّيَ ثُمَّ نَرْجِعَ فَنَنْحَرَ فَمَنْ فَعَلَ ذٰلِكَ فَقَدْ أَصَابَ سُنَّتَنَا وَمَنْ ذَبَحَ قَبْلَ أَنْ نُصَلِّيَ فَإِنَّمَا هُوَ شَاةُ لَحْمٍ عَجَّلَهُ لِأَهْلِهِ لَيْسَ مِنَ النُّسُكِ فِيْ شَيْءٍ.
“আজকের এ দিনে যে জিনিস দ্বারা আমরা আরম্ভ করবো, তা এ যে, আমরা নামায পড়বো, তারপর ফিরে আসবো। অতঃপর ক্বোরবানী করবো। যে এরূপ করবে, সে আমাদের সুন্নাত পেয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি আমাদের নামাযের আগে যবেহ করে নিলো, তা গোশতের ছাগল, যা সে স্বীয় ঘরের লোকদের জন্য যবেহ করলো। তা কিছুতেই ক্বোরবানী নয়।” (বুখারী ও মুসলিম)

 অপর বর্ণনায় আছে,
مَنْ ذَبَحَ قَبْلَ الصَّلَاةِ فَلْيَذْبَحْ مَكَانَهَا أُخْرَى.
“যে ব্যক্তি আমাদের নামাযের পূর্বে যবেহ করে নেয়, সে যেন সেটার স্থলে অন্য একটি যবেহ করে।”

 ইমাম তিরমিযী হযরত ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:
أَقَامَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالْمَدِيْنَةِ عَشْرَ سِنِيْنَ يُضَحِّيْ.
“রাসূলুল্লাহ্  মদীনা শরীফে দশ বছর অবস্থান করেছিলেন। তিনি সবসময় ক্বোরবানী করতে থাকেন।”
 হযরত যায়দ ইবনে আরক্বাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন:
قَالَ أَصْحَابُ رَسُوْلِ اللّٰهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَا رَسُوْلَ اللّٰهِ مَا هٰذِهِ الْأَضَاحِيُّ؟ قَالَ: سُنَّةُ أَبِيْكُمْ إِبْرَاهِيْمَ عَلَيْهِ السَّلَامُ قَالُوْا: فَمَا لَنَا فِيْهَا يَا رَسُوْلَ اللّٰهِ؟ قَالَ: بِكُلِّ شَعْرَةٍ حَسَنَةٌ . قَالُوا: فَالصُّوْفُ يَا رَسُوْلَ اللّٰهِ؟ قَالَ: بِكُلِّ شَعْرَةٍ مِنَ الصُّوْفِ حَسَنَةٌ.
রসূলুল্লাহ্ ’র সাহাবীগণ আরয করলেন, হে আল্লাহ্র রসূল! এ ক্বোরবানী কি? এরশাদ করলেন, ‘তোমাদের পিতা ইব্রাহীম আলায়হিস সালাম-এর সুন্নাত। তাঁরা আরয করলেন, তাতে আমরা কী পাবো? হুযূর ইরশাদ করেন: ‘প্রতিটি লোমের বিণিময়ে সাওয়াব পাবে। তাঁরা আরয করলেন, তাহলে পশম বিশিষ্ট পশু, ইয়া রাসূলাল্লাহ্? হুযূর ইরশাদ করেন: প্রত্যেকটি পশম বিশিষ্ট পশুর প্রতিটি লোমের বিণিময়ে নেকী পাবে।”

 হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ‘আমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা বলেন, রাসূলুল্লাহ্  ইরশাদ করেন:
أُمِرْتُ بِيَوْمِ الْأَضْحٰى عِيْدًا جَعَلَهُ اللّٰهُ لِهٰذِهِ الْأُمَّةِ. قَالَ لَهُ رَجُلٌ: يَا رَسُوْلَ اللّٰهِ أَرَأَيْتَ إِنْ لَمْ أَجِدْ إِلَّا مَنِيْحَةً أُنْثٰى أَفَأُضَحِّيْ بِهَا؟ قَالَ: لَا وَلَكِنْ خُذْ مِنْ شَعْرِكَ وَأَظْفَارِكَ وَتَقُصُّ مِنْ شَارِبِكَ وَتَحْلِقُ عَانَتَكَ فَذٰلِكَ تَمَامُ أُضْحِيَّتِكَ عِنْدَ اللّٰهِ.
“আমি ক্বোরবানীর ঈদের দিন ঈদ পালন করার নির্দেশ পেয়েছি, যা আল্লাহ্ তা‘আলা এ উম্মতের জন্য নির্ধারণ করেছেন। এক ব্যক্তি হুযূরের দরবারে আরয করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! বলুন, যদি আমি দুধ পানের জন্য ধার দেয়া ‘মানীহা’ (পশু) ব্যতীত অন্য কোন পশু না পাই, তবে সেটা ক্বোরবানী করবো? হুযূর ইরশাদ করলেন, না। কিন্তু তুমি স্বীয় চুল ও নখ কেটে নাও। গোঁফগুলো ছাটিয়ে নাও এবং নাভীর নীচের লোম পরিস্কার করবে। তোমার জন্য এটাই পরিপূর্ণ ক্বোরবানী আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে।
সুবহানাল্লাহ্! ক্বোরবানীর বিষয়কে কী বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন। সম্পদশালীও আমল করতে পারবে এবং সাধারণ নিঃস্ব-দরিদ্র মুসলমানও। কল্যাণ ও বরকতের সমুদ্র প্রবাহমান, এটা থেকে প্রত্যেক তৃষ্ণার্ত পরিতৃপ্ত হোক।

ক্বোরবানীর আদাব বা শিষ্টাচারসমূহ-
 হযরত উম্মে সালামাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্  ইরশাদ করেন: “যখন ‘আশরাহ্’ (যিলহজ্জের দশক) এসে যায় আর তোমাদের কেউ ক্বোরবানী করার ইচ্ছা করে,
فَلَا يَمَسَّ مِنْ شَعْرِهِ وَبَشَرِهِ شَيْئًا وَفِي رِوَايَةٍ فَلَا يَأْخُذَنَّ شَعْرًا وَلَا يَقْلِمَنَّ ظُفْرًا.
তখন স্বীয় চুল ও চামড়ায় যেনো মোটেই হাত না লাগায়। অপর বর্ণনায় আছে, সে না কোন চুল নেবে, না নখ কাটবে।”
 হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ্ আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে,
أَنْ نَسْتَشْرِفَ الْعَيْنَ وَالْأُذُنَ وَأَلَّا نُضَحِّيَ ‌بِمُقَابَلَةٍ وَلَا مُدَابَرَةٍ وَلَا شَرْقَاءَ وَلَا خَرْقَاءَ.
“আমরা যেন ক্বোরবানীর পশুর চোখ ও কান ভালো করে দেখে নেই এবং এমন পশুসমূহের ক্বোরবানী না করি, যেগুলোর কান সামনের দিক এবং পিছনের দিক থেকে কাটা, না ছেঁড়া কান বিশিষ্ট পশুর, না যার কানে ছিদ্র রয়েছে।”
 তাঁরই নিকট থেকে বর্ণিত যে,
نَهٰى رَسُوْلُ اللّٰهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَن نُضَحِّيَ بِأَعْضَبِ الْقَرْنِ وَالْأُذُنِ.
“রাসূলুল্লাহ্  শিং ভাঙ্গা ও কান কাটা পশু দ্বারা ক্বোরবানী করতে নিষেধ করেছেন।”

 হযরত বারা ইবনে আযেব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্  কে জিজ্ঞেস করা হয়েছে
مَاذَا يُتَّقٰى مِنَ الضَّحَايَا؟ فَأَشَارَ بِيَدِهِ فَقَالَ: أَرْبَعًا الْعَرْجَاءُ وَالْبَيّنُ ظَلْعُهَا وَالْعَرْوَاءَ الْبَيِّنُ عَوَرُهَا وَالْمَرِيْضَةُ الْبَيِّنُ مَرَضُهَا وَالْعَجْفَاءُ الَّتِيْ لَا تَنْقٰى.
“কোন্ কোন্ ক্বোরবানী থেকে বেঁচে থাকা চাই। তখন তিনি হাত মুবারকের ইশারায় বললেন, চারটি থেকে: খোঁড়া পশু, যার খোঁড়াপনা সুস্পষ্ট, কানা পশু থেকে, যার কানা হওয়া প্রকাশ্য, রুগ্ন পশু তেকে, যার রোগগ্রস্ততা সুস্পষ্ট এবং দুর্বল প্রাণী থেকে, যার হাড়ে মজ্জা নেই।”
 হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্  ইরশাদ করেন:
مَنْ كَانَ لَهُ سَعَةٌ وَلَمْ يُضَحِّ ‌فَلَا ‌يَقْرَبَنَّ مُصَلَّانَا.
“যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও ক্বোরবানী করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।”

ক্বোরবানীর হিকমতসমূহ ও উপকারিতা-
১. খোদাপ্রদত্ত নি’মাতসমূহের কৃতজ্ঞতা আদায় করার উত্তম পদ্ধতি হচ্ছে, তাঁরই নির্দেশে খোদার সৃষ্টির জন্য উন্নত মানের খাবার আয়োজন করা।
২. ক্বোরবানীদাতা-ই হক্বের সুরক্ষা এবং যুল্ম (নির্যাতন) প্রতিরোধের সময় আসলে স্বীয় দেহ, মন, ধন-সম্পদ, দেশ, সন্তান-সন্তুতি সবকিছু উৎসর্গ করতে পারে এবং এ প্রেরণা জাতির সমৃদ্ধ জীবনের রক্ষাকবচ।
৩. সম্পদশালীদের অন্তর থেকে মাল-সম্পদের মুহাব্বত হ্রাস পায় এবং ¯্রষ্টার মুহাব্বত ও সৃষ্টির প্রতি ¯েœহপরায়ণ হওয়ার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। আর এটিই মানবতার প্রকৃত অলংকার।
৪. ক্বোরবানীর চামড়া ও চামড়ার বিক্রয়লব্দ অর্থ দিয়ে অসংখ্য জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে দ্বীনী প্রতিষ্ঠান চলে। দরিদ্র, ইয়াতীম এবং বিধবাদের অর্থনৈতিক সমস্যা নিরসন হয়।
৫. ক্বোরবানী উপলক্ষে হাজার হাজার লোক সারাদেশে গবাদি পশু পালনে অর্থ বিণিয়োগ করে এবং উপযুক্ত সময়ে বিক্রি করে নিজের মেহনতের সুফল ভোগ করে। এর দ্বারা তাদের পুরো বছরের রুজির ব্যবস্থা হয়। ক্বোরবানীর পশুর চামড়া, চুল এবং হাড্ডি জাতীয় রাজস্ব বৃদ্ধির অন্যতম উপায়। অতএব, যে দিক থেকেই বিবেচনা করা হোক না কেন, ক্বোরবানী পার্থিব ও পরকালীন অগণিত উপকার ধারন করে আছে।

Share:

Leave Your Comment