হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি তা’আলা আলাইহি’র কারামত

হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি তা’আলা আলাইহি’র কারামত

আল্লাহ্ তা‘আলার যাবতীয় সৃষ্টি এক স্বাভাবিক নিয়মে আল্লাহ্ তা‘আলারই ক্বুদরতে পরিচালিত হয়। ওই স্বাভাবিক নিয়ম হচ্ছে ইসলামী পরিভাষায় ‘আদত’ (عادت)। আবার কখনো কখনো এ ‘আদত’ বা স্বাভাবিক নিয়ম ভঙ্গ করে সম্পাদিত হয় অনেক কাজ। তাও আল্লাহ্ তা‘আলার ক্বুদ্রত দ্বারাই সম্পাদিত হয়। এটাকে বলা হয় خارق عادت (স্বাভাবিক নিয়মের পরিপন্থী)। তা অন্য কথায় ‘অলৌকিক ঘটনা’ হিসেবে পরিচিত। এ ‘খারিক্বে আদত’ বা অলৌকিক ঘটনা যদি আল্লাহর কোন নবী-রসূলের মাধ্যমে প্রকাশ পায়, তবে সেটাকে বলা হয় ‘মু’জিযা’। কোন নবীর নুবূয়ত প্রকাশের পর সম্পাদিত হলে তা-ই মু’জিযা, আর যদি নুবূয়ত প্রকাশের পূর্বে প্রকাশ পায়, তবে সেটাকে বলা হয় ‘ইরহাস’। যেমন, ওই অলৌকিক ঘটনাবলী, যেগুলো হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বেলাদত (জন্ম) শরীফের সময় প্রকাশিত হয়েছিলো। যে ‘খেলাফ-ই আদত’ কাজ ওলী থেকে প্রকাশ পায়, সেটাকে ‘কারামত’ বলা হয়। যে খেলাফ-ই আদত কাজ কাফিরগণ ও ফাসিক্বদের দ্বারা সম্পন্ন হয়, তাকে ‘প্রতারণা ও ইস্তিদ্রাজ’ বলা হয়। আর যে-ই অলৌকিক কাজ আম মুসলমানদের থেকে প্রকাশ পায় তাকে ‘মা‘ঊনাত’ বলা হয়। যদি কোন কাজ প্রকাশ পাবার ছিলো এক ধরনের; কিন্তু প্রকাশ পেয়ে গেছে অন্য ধরনের, সেটাকে বলা হয় ‘ইহানাত’; যেমন মুসায়লামা কায্যাব থেকে প্রকাশ পেয়েছিলো। সে দো‘আ করেছিলো যেন এক কানা ব্যক্তির চোখ সুস্থ হয়ে যায়; কিন্তু তার অপর সুস্থ চোখটিও টেরা হয়ে গিয়েছিলো। যাদুর প্রভাব ‘খেলাফ-ই আদত’ (অলৌকিক) নয়; বরং তা উপকরণাদি দ্বারা প্রকাশ পায়। বস্তুতঃ যা স্বাভাবিক উপকরণাদি দ্বারা প্রকাশ পায় তা ‘খেলাফ-ই আদত’ হয় না। যেমন ঔষধ সেবন করলে শেফা অর্জিত হয়ে যায়। [আশি’‘আতুল লুম্‘আত: ৪র্থ খন্ড, পৃ. ৫৪০]
হুযূর ক্বেবলা শাহানশাহে সিরিকোট হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটী আলায়হির রাহমাহ্ এক যুগশ্রেষ্ঠ মহান ওলী ছিলেন। তাঁর বরকতমÐিত যাত (সত্তা) থেকেও অনেক অলৌকিক ঘটনা বা কারামত প্রকাশ পেয়েছিলো। কারামত প্রকাশ পাওয়া বা প্রকাশ করা ওলী হওয়ার জন্য পূর্বশর্ত বা জরুরী না হলেও ঘটনাচক্রে কিংবা বিশেষ প্রয়োজনে যেসব কারামত প্রকাশ পেয়ে যায়, সেগুলো সংশ্লিষ্ট ওলীর বেলায়তের প্রমাণ বহন করে। শাহানশাহে সিরিকোটের মাধ্যমেও অনেক কারামত বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ পেয়েছিলো। নি¤েœ তাঁর কিছু কারামত বর্ণনা করার প্রয়াস পেলাম।
।। এক।।
রসূল-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর রওযা-ই পাক থেকে আহŸান শ্রবণ
ওলী ও পীর-মুর্শিদের বেলায়ত ও কামিল হবার সর্বাপেক্ষা বড় প্রমাণ হচ্ছে তাঁর, আল্লাহ্ তা‘আলা ও রসূল-ই আক্রামের দরবারে মাক্ববূল বা গ্রহণযোগ্য হওয়া। এমন একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ হযরত শাহানশাহে সিরিকোট সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির ক্ষেত্রে অকাট্যভাবে পাওয়া যায়। বিগত ১৯৪৫ইংরেজি সালে শাহানশাহে সিরিকোট আলায়হির রাহমাহ্ হজ্জ্বে তাশরীফ নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি যখন তাজদার-ই মদীনা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র রওযা-ই পাকে হুযূর-ই আক্রামকে বিদায়ী সালাম পেশ করছিলেন, তখন রওযা-ই পাক থেকে আগামীবার হজ্জ্বে আসার সময় তাঁর নাতি সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ সাহেবকে সাথে নিয়ে আসার সদয় নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। সুতরাং তিনি তাঁর এ নাতি হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ সাহেব মুদ্দাযিল্লুহুল আলী সাবালক হলে বিগত ১৯৫৮ইংরেজি সালে তাঁকে সাথে নিয়ে হজ্জ্বে গিয়েছিলেন এবং রসূল-ই আক্রামের রওযা-ই পাকে সালাম আরয করেছিলেন।
উল্লেখ্য, ওই হজ্জ্বেই আরাফাতের ময়দানে হযরত সিরিকোটী আলায়হির রাহমাহ্ হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ সাহেবকে আপন বরকতময় হাতে হাত রেখে বায়‘আত করান এবং ফুয়ূযাতে ভরপুর করে দিলেন।
।। দুই।।
এক মদ্যপকে মুত্তাক্বী-পরহেযগার করা
শাহানশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি একদা বার্মার বাঙ্গালী মসজিদে ওয়ায-তাক্বরীর করার সময় তাঁর মুরীদ সূফী আব্দুল গফূরের কাঁধে ভর করে বার্মার কাকা সর্দার নামে এক প্রভাবশালী নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি মসজিদের দিকে আসল। ওই সর্দারকে আসতে দেখে হুযূর ক্বেবলা দাঁড়ালেন, করমর্দন করলেন তারপর কথোপকথন শুরু হলোঃ
হুজুর ক্বেবলা-সর্দারজী কিয়া সমঝকর এহাঁ আনা হুয়া? (অর্থাৎ সর্দার সাহেব, কী মনে করে এখানে আসলেন?)
সর্দার- সূফী নে বাতায়া, এহাঁ জান্নাত মিলতী হ্যায়। মুঝে ভী জান্নাত চাহিয়ে, মুঝে জান্নাত দীজিয়ে। (সূফী বলেছেন, এখানে বেহেশ্ত পাওয়া যায়। আমারও বেহেশত দরকার, আমাকে বেহেশ্ত দিন।)
হুযূর ক্বেবলা- ঠিক হ্যায়, তোম কো জান্নাত মিল জায়েগী। (ঠিক আছে, তুমি বেহেশত পেয়ে যাবে।)
সর্দার- মগর মাঁই শরাব পিনা নেহীঁ ছোড়োঙ্গা, আওর রÐীখানে মে ভী জাওঙ্গা। (কিন্তু মদ পানও আমি ছাড়বো না, বেশ্যালয়েও যাবো)।
হুযূর ক্বেবলা- ঠিক হ্যায়, মগর কভী ঝুট মাত বোলনা, খিঞ্জীর কা বাচ্চা নেহীঁ খানা, আওর হামারে সামনে হো কর রÐীখানে মে মাত জানা। ( ঠিক আছে, তবে কখনও মিথ্যা বলবে না, শুকরের বাচ্চা খাবে না এবং আমার সামনে দিয়ে বেশ্যালয়ে যাবে না।)
সর্দার : ঠিক হ্যায়। (ঠিক আছে, মেনে নিলাম।)
অত:পর সর্দার তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের নিয়ে মদ পানে বসে গেল বটে; কিন্তু যখনই মদের বোতল ও পান-পাত্র হাতে নিলো, তখন তাতে ছোট ছোট শুকরের বাচ্চা দেখতে পেলো। সর্দার তখনই তা ছুঁড়ে মারলো। শরাবের নতুন বোতল আনা হলো। তাতেও একই দৃশ্য দেখে বিরক্ত হয়ে সর্দার বেশ্যালয়ের পথে ছুটে যাচ্ছিলো। কিন্তু যে পথ দিয়েই যেতে চাচ্ছিলো, ওই পথে হুযূরকে দেখতে পাচ্ছিলো। এভাবে সারা রাত ঘোরাঘুরি করে অবশেষে বাঙ্গালী মসজিদে গিয়ে দেখলো সেখানে হুযূর ক্বেবলা তাহাজ্জুদের নামাযে রত আছেন। উপায়ান্তর না দেখে ওযূ করে সর্দার ফজরের নামায আদায় করলো হুযূরের ঠিক পেছনে। নামাযান্তে হুযূর তার কুশলাদি জিজ্ঞেস করা মাত্রই সর্দার হু হু করে কেঁদে ফেললো। পুরো ঘটনার বর্ণনা দিলো, তাওবা করলো এবং ক্ষমা চাইলো। জবাবে হুযূর কেবলা বললেন, ‘‘জব আপ কো জান্নাত মিল গায়ী তো শরাব পীনে আওর রÐীখানে মে জানে সে কেয়া ওয়াসত্বাহ্ হ্যায়? (যখন বেহেশত পেয়ে গেছেন, তখন মদ পান করা ও বেশ্যালয়ে যাওয়ার সাথে কী সম্পর্ক থাকতে পারে?)।
এ ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- শাহানশাহে সিরিকোট দ্বীন ও কল্যাণের দিকে অতি উত্তম দা‘ঈ ছিলেন। কারণ পাপী মানুষকে সৎ পথে আনার জন্য তিনি যেসব উত্তমপন্থা অবলম্বন করলেন সেগুলো হলো-
১. তিনি ইমামতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন ও বাঙ্গালী মসজিদে তাক্বরীর করতেন।
২. কাকা সর্দারকে দেখে দাঁড়ালেন, করমর্দন করলেন।
৩. কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন- সর্দারজী কেয়া সমঝকর এহাঁ আনা হুয়া? অর্থাৎ আগমনের উদ্দেশ্য জানতে চাইলেন।
৪. সর্দারের কথার ইতিবাচক জবাব দিলেন।
৫. সর্দারের শর্তের জবাবে শর্তারোপ করলেন।
৬. পরের দিন সাক্ষাতে সর্দারের কুশলাদি আবার জানতে চাইলেন- আপ কা কেয়া হাল হ্যায়?
৭. বেহেশতীদের আচার-আচরণ সম্পর্কে অবহিত করলেন।
৮. পরিশেষে সান্ত¦না ও সুসংবাদ দিলেন।
৯. সর্বোপরি, ইতিবাচক কথা বললেন।
আবার শাহানশাহে সিরিকোট দাওয়াত প্রক্রিয়ায় যা পরিহার করলেন, সেগুলো হল: নেতিবাচক বক্তব্য, দূর্ব্যবহার, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, ধমক ও ঘৃণা প্রদর্শন এবং অবজ্ঞা।
।। তিন।।
তাকে দু’টি টাকা দিয়ে দাও
শাহানশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি একদা বাঙ্গালী মসজিদে ওয়া’য-তাক্বরীর করার সময় হঠাৎ রাস্তার দিকে ইশারা করে বললেন, উস্ কো দো রুপিয়া দে দো। (তাকে দু’টি টাকা দিয়ে দাও।)। উপস্থিত লোকেরা দেখল, যাকে টাকা দিতে বলা হয়েছে, সে নেশাগ্রস্ত ও বেশ্যালয়ে যাতায়তে অভ্যস্ত। তবুও হুজুরের নির্দেশ। তাই একজন মুসল্লী তাকে দু’টি টাকা দিল। তখন মাসিক বেতন ছিল এক টাকা/দু’টাকা। লোকটি ওই মুহুর্তে একত্রে দু’টাকা পেয়ে অভ্যাসবশত: বেশ্যালয়ের দিকে ছুটে গেল। কিছুক্ষণ পর ওই লোকটি একটা যুবতী মেয়ে সহ হুযূরের দরবারে এসে কদমে লুটিয়ে পড়ল। আর কাঁদতে কাঁদতে ক্ষমা চাইতে লাগল। লোকটি বর্ণনা দিল যে, যুবতী মেয়েটি তারই কন্যা। এক আত্মীয় ফুস্লিয়ে তাকে বেশ্যালয়ে এক টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে। সেখানে তার মেয়েকে দেখতে পেয়ে সে তাকে ঐ দু’টাকা দিয়ে কিনে নিল। অত:পর সে তাওবা করল।
এখানে শাহানশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি কাশ্ফ দ্বারা লোকটির অগোচরে তার মেয়ের বিপদ সম্পর্কে জেনে গেছেন এবং তাকে উদ্ধার করার জন্য দু’টাকা দিয়ে তা সম্পন্ন করালেন। লোকটিকে ঘৃণা ও অবজ্ঞা ভরে তাড়িয়ে দেননি।
মূলত: আলোচ্য ঘটনা দু’টিতে শাহানশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি লোক দু’জনের প্রতি দয়া-মায়ার সাথে নিজকে এমনভাবে তুলে ধরলেন, যাতে তাদের আস্থাও সৃষ্টি হয়, উপলব্ধিও আসে, তারাও যেন বুঝতে পারে মুক্তির পথ কোথায়? সে জন্যে ওই দু’জন লোক শেষ পর্যন্ত তাঁর কাছে ছুটে এসেছিল। এটা বাস্তব যে, দয়া-মায়ার বাধঁনে দূরের লোককে সহজে কাছে নিয়ে আসা যায়। যদিও লোক দু’টির অভ্যাস ছিল মদপান ও অবৈধ যৌন কর্মে লিপ্ত হওয়ার মত ঘৃণ্যকর্ম আর হারাম ও কবীরাহ গুণাহ’র কাজ, কিন্তু প্রতিশ্রতি রক্ষা ও সদা সত্য কথা বলার মত গুণ তাদের মাঝে বিরাজমান ছিল। এদিকে শাহানশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি চাচ্ছিলেন তাদেরকে গুণাহ’র কর্ম হতে বিরত রাখতে ও সৎ পথে ফিরিয়ে আনতে। অতি বেলায়তী প্রজ্ঞার মাধ্যমে তিনি তা সম্পন্ন করেছিলেন। তাছাড়া এটাও দেখা গেছে যে, অনেকের বাড়ীতে দাওয়াত পেয়ে পরিবেশিত পানাহার বিনা সংকোচে তিনি গ্রহণ করেছেন। এভাবে ক্রমান্বয়ে আপনসূলভ আচার-ব্যবহার করে তাদের আস্থাভাজন হয়ে উঠেন এবং তাদেরকে ত্বরীকায়ে ক্বাদেরিয়ার দিকে ধাবিত করেন। এমনকি স্থানীয় অনেক পীর সাহেবও মুগ্ধ হয়ে স্ব স্ব ভক্তদেরকে শাহানশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির হাতে বায়‘আত হওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন। আবার অনেকে তাঁর কাছে এসে সংগোপনে বায়‘আত হওয়ার নযীরও আছে।
সুতরাং শাহানশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বাংলা-অঞ্চলে ক্বাদেরিয়া ত্বরীকার স¤প্রসারণে উপযুক্ত ও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে যে অবদান রেখেছেন, তা যুগ যুগ ধরে স্মরণীয় হয়ে থাকবে আর সবাই শ্রদ্ধার সাথে নিঃসঙ্কোচে ও অকপটে স্বীকার করে ও করতে থাকবে যে, ‘যদি তিনি এ দেশে না আসতেন, তবে অনেক সরলপ্রাণ মানুষ নিঃসন্দেহে পথভ্রষ্ট হতো কিংবা ভ্রান্ত পথের পথিক হয়ে থেকে যেতো।
ইসলাম ও ক্বাদেরিয়া ত্বরীকা স¤প্রসারণের স্থায়ীভাবে রূপদানে শাহানশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর ইন্তিকালের প্রায় পঞ্চাশ বছর পরও তা ফুলে-ফলে মহীরূহে পরিণত হতে চলছে। এ ক্ষেত্রে তাঁর এ বাণী সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য- “তৈয়্যব আউর তাহের কাম সাম্ভালেঙ্গে, সাবের মুলকে বাঙ্গাল কা পীর হো-গা”। (অর্থাৎ তৈয়্যব শাহ্ ও তাহের শাহ্ যাবতীয় কাজ সমাধা করবেন। সাবির শাহ্ বাংলাদেশ অঞ্চলের পীর হবেন।) বাস্তবিকপক্ষে, তাঁর ইন্তেক্বালের পর তাঁরই স্থলাভিষিক্ত হয়ে তাঁর কনিষ্ঠ শাহজাদা গাউসে যামান আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি (১৯১৬-১৯৯৩ইং) বাংলাদেশের উত্তর থেকে দক্ষিণে (সর্বত্র) এ ত্বরীকার প্রসার ঘটান। অত:পর হযরত তৈয়্যব শাহ্র বড় শাহজাদা গাউসে যমান আল্লামা তাহের শাহ মুদ্দাযিল্লহুল আলী সেটাকে আরো বিস্তৃত করেন এবং বিশাল এলাকা জুড়ে এ ক্বাদেরীয়া ত্বরীকার স¤প্রসারণ করে আসছেন। এ দু’জনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রয়াসে বর্তমানে এ ত্বরীকার অনুসারীর সংখ্যা এতদ্অঞ্চলে প্রায় দু’ কোটির অধিক। উল্লেখ্য, হযরত সাবির শাহ মুদ্দাযিল্লুহুল আলী সম্পর্কে শাহানশাহে সিরিকোট আলায়হির রাহমাহ্ যেই ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন, তাও বাস্তবায়িত হতে চলেছে। তিনিও এখন বায়‘আত গ্রহণ, আনজুমান-জামেয়ার প্রতিটি কাজ সুষ্ঠুরূপে সম্পাদন ইত্যাদির প্রত্যক্ষ তদারকি করে ত্বরীক্বত ও আন্জুমান ইত্যাদিকে উন্নতির দিকে দ্রæত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
।। চার।।
হযরত খাদ্বির আলায়হিস সালাম-এর প্রভাব
হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটী আলায়হির রাহমাহ্ অসংখ্য কারামতের আধার ছিলেন। ওইগুলোর মধ্যে একটি হলো- তাঁর মধ্যে হযরত খাদ্বির আলায়হিস্ সালাম-এর প্রভাব ছিলো। তিনি যখন কোন ইচ্ছা পোষণ করতেন, তখন তা হযরত খাদ্বির পূরণ করে দিতেন। রেঙ্গুনে অবস্থান কালে তাঁর বাবুর্চি হিসেবে কর্মরত ছিলেন মরহুম ফযলুর রহমান সরকার। একদিন তিনি সকালে বাজার করার জন্য হুযূর ক্বেবলার নিকট টাকা চাইলেন। হুযূর ক্বেবলা তাঁকে অপেক্ষা করতে বললেন, আর তিনি দোতলায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এদিকে দুপুর গড়িয়ে গেলো। বাবুর্চি ফযলুর রহমানের অপেক্ষা ও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছিলো। এক সময় দেখলেন এক অতি সুন্দর নূরানী চেহারাধারী আগন্তুক এসে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলেন। কিছুক্ষণ পর লোকটি চলে গেলে হুযূর ক্বেবলা বাবুর্চিকে ডাকলেন এবং কিছু টাকা দিয়ে বাজারে যেতে বললেন। বাবুর্চিও আগন্তুক লোকটার পরিচয় জানার জন্য চেষ্টা করলেন। তিনি বললেন, ‘‘আজ বাজারে যাবোনা, প্রয়োজনে ভ‚খা থাকবো, যতক্ষণ না আগন্তুকটির পরিচয় বলবেন।’’
হুযূর ক্বেবলা বললেন, ‘‘আমার নিকট টাকা ছিলোনা। তাই তোমাকে অপেক্ষা করতে বলেছিলাম। কিছুক্ষণ পূর্বে হযরত খাদ্বির আলায়হিস্ সালাম এসে কিছু টাকা দিয়ে গেলেন।’’
বাবুর্চি ফজলুর রহমান এবার খুশী মনে বাজারে গেলেন।
।। পাঁচ।।
ইবলীস শয়তানের সাথে সফল মোকাবেলা
প্রকাশ থাকে থাকে যে, নাফ্স ও শয়তানের সাথে সফলভাবে মোকাবেলা করে আল্লাহর ওলীগণ বেলায়তের উচ্চাসনে আসীন হন। কখনও শয়তান বান্দাদের পিছু ছাড়েনা। সুযোগ পেতেই তাদেরকে পথচ্যুত করতে চায়; কিন্তু আল্লাহর ওলীগণ তার প্ররোচনা অনুধাবন করতে পারেন এবং সাথে সাথে তার কঠোর বিরোধিতা করে নিজেদের সংরক্ষণ করে ফেলেন। এমনিভাবে শাহানশাহে সিরিকোট দু’বার শয়তানের বিরুদ্ধে সফল মোকাবেলা করেন।
হুজুর কেবলা শাহানশাহে সিরিকোটের দীর্ঘদিনের একনিষ্ঠ খাদিম জনাব মাস্টার আবদুল কাইয়্যূম মরহুম মাগফুর বলেন, একবার শাহানশাহে সিরিকোট আলায়হির রাহমাহ্ আপন পীর-মুর্শিদের অবস্থানস্থল চৌহার শরীফ থেকে ফেরার পথে এক মহল্লার মসজিদে নামায পড়তে ঢুকলেন। তিনি নামায পড়তে থাকেন। নামাযরত অবস্থায় এক হিং¯্র বাঘের সূরতে এসে শয়তান হযরত সিরিকোটি আলায়হির রাহমাহকে আক্রমণ করার জন্য উদ্যত হলো। হুযূর কেবলা সেটার দিকে থুথু নিক্ষেপ করলেন। ফলে শয়তান অদৃশ্য হয়ে গেলো।
আরেকবার শয়তান গোপনভাবে শাহানশাহে সিরিকোটকে ওয়াস্ওয়াসাহ্ দিচ্ছিলো। অমনি তিনি শয়তানের চক্রান্ত অনুধাবন করতে পারলেন এবং তার বিরোধিতা করে তার চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিলেন। ঘটনা হচ্ছে- হযরত চৌহরভী আলায়হির রাহমাহ্র, মাদরাসা ও এতিমখানার জন্য মিঠাই কেনার কর্মসূচি ছিলো। ইত্যবসরে, তাঁর নিজের কিছু কাজ সমাধার ব্যয়ও সামনে আসলো। তখন শয়তান হাযির। সে ওয়াস্ওয়াসাহ্ দিচ্ছিলো এতিমখানার মিঠাইর টাকায় ব্যক্তিগত কাজ সমাধার জন্য।
কিন্তু হযরত শাহানশাহে সিরিকোট শয়তানের চক্রান্ত বুঝতে পারলেন এবং ঠিকই মিঠাইর টাকায় মিঠাই কিনে নিয়ে এতিমখানায় যথাসময়ে হাযির হয়ে যান।
।। ছয়।।
বিষধর সাপের দংশন ও সেটার মৃত্যু
ডাক্তার মুহাম্মদ হাশেম মরহুম মাগফ‚র বর্ণনা করেছেন, হুযূর ক্বেবলা শাহানশাহে সিরিকোট আলায়হির রাহমাহ্ একবার ছোটতর হাজত পূরণের জন্য এক পর্দাসম্মত জায়গায় যান। তিনি হাজত পূরণরত অবস্থায় এক বিষধর সাপ এসে তাঁকে দংশন করলো। হুযূর ক্বেবলা এরপর সেটার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘‘আরে নাদান!’’ (ওহে বোকা!) ব্যাস! সাপটি আছাড় খেতে খেতে মরে গেলো। এদিকে হুযূর ক্বেবলার কোন ক্ষতি হয়নি; কারণ, সেটার বিষ এ মহান ওলীর শরীরে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি; বরং সেটা নিজেই শাস্তি পেয়ে গেলো। আলহামদুলিল্লাহ!
।। সাত।।
অমুসলিম যুবতীর ইসলাম গ্রহণ
হুযূর ক্বেবলা ইয়াঙ্গুন (বার্মা) অবস্থানকালে এক অমুসলিম যুবতী পানি পড়া নেওয়ার জন্য হুযূর ক্বেবলার পবিত্র দরবারে আসলো। হুযূর ক্বেবলা মেয়েটির দিকে কৃপা দৃষ্টি দিলেন। মেয়েটি আরয করলো, ‘‘হুযূর! আপনি আমার দিকে তাকিয়ে কি ভাবছেন?” হুযূর ক্বেবলা এরশাদ করলেন, ‘‘আল্লাহ্ তোমাকে অবয়বগত সৌন্দর্য দিয়েছেন; কিন্তু তুমি দোযখে জ্বললে কেমন হবে ভাবছি।’’ বস্তুতঃ
نگاه ولى ميں يه تاثير ديكھي ـ بدلتى هزاروں كى تقدير ديكھي
অর্থ: আল্লাহর ওলীর কৃপাদৃষ্টিতে এমন প্রভাব দেখেছি, এ প্রভাবে হাজারো লোকের তাক্বদীর পরিবর্তিত হয়ে যেতে দেখেছি।
অমনি যুবতীটির মনে দোযখের ভয় স্থান পেয়ে গেলো। সে আরয করলো হুযূর, ‘‘আমি দোযখে যেতে চাইনা। আমি কিভাবে দোযখ থেকে বাঁচতে পারবো?’’
হুযূর ক্বেবলা বললেন, ‘‘তুমি কলেমা পড়ে মুসলমান হয়ে যাও! দোযখ থেকে রেহাই পাবে, বেহেশতের উপযোগী হবে।’’ সুতরাং মেয়েটি হুযূর ক্বেবলার হিদায়ত অনুসারে কলেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেলো। হুযূর ক্বেবলা তাকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও দীক্ষা দিলেন। বিশেষতঃ পর্দা করার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করলেন। মেয়েটির নাম হুযূর ক্বেবলা ফাত্বিমা রাখলেন। খুব সম্ভব মেয়েটি তার ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি গোপন রেখেছিলো অথবা ওই দেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকায় সামাজিকভাবে তার তেমন কোন অসুবিধা হয়নি।
আল্লাহ্ তা‘আলার মর্জি! ইসলাম গ্রহণের কিছুদিন পর মেয়েটির মৃত্যু হয়ে গেলো। সুতরাং মেয়েটির বিধর্মী আত্মীয়-স্বজন তার সৎকার করার জন্য প্রস্তুতি নিলো। কিন্তু যাঁরা মেয়েটির ইসলাম গ্রহণের কথা জানতেন তাঁরা তাদেরকে সেকথা জানালেন এবং মুসলমানগণ ইসলামী শরীয়ত অনুসারে কাফন-দাফনের জন্য লাশ হস্তান্তরের দাবী জানালেন। কিন্তু তারা তাতে অস্বীকৃতি জানালো। ফলে বাক-বিতÐা শুরু হয়ে গেলো।
এদিকে হুযূর ক্বেবলা মেয়েটির মৃত্যু সংবাদ পেলেন এবং তিনি সশরীরে মেয়েটির কফীনের নিকট গিয়ে তার ইসলাম গ্রহণের কথা জানালেন; কিন্তু তাতেও তার আত্মীয়-স্বজন মানতে রাজি না হলে হুযূর ক্বেবলা মৃত মেয়েটিকে সম্বোধন করে বললেন, ‘‘ফাত্বিমা, ত‚ কাহ্ দে, তু কেয়া হ্যায়?’’ (ফাত্বিমা তুমি বলে দাও, তুমি কে?) অমনি মেয়েটি ‘আল্লাহু আকবার’ বলে উঠে বসে গেলো এবং সরবে কলেমা শরীফ ‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লা-হ্’ পড়ে নিলো। তারপর চির নিদ্রায় চলে গেলো। এবার সবাই বিশ্বাস করলো যে, মেয়েটি মুসলমান হয়ে গিয়েছিলো আর মুসলমানগণ তার লাশ এনে ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক কাফন পরিয়ে, জানাযা পড়ে দাফন করলেন।
।। আট।।
শিরণীতে অস্বাভাবিক বরকত
বার্মা প্রবাসী হাফেয নূরুল আলম। জনাব মুস্তাফিজুর রহমানের শ্যালক। আসাদগঞ্জ ইসলাম কলোনীর বাসিন্দা। নিজ বাড়ি নোয়াপাড়া রাউজান, চট্টগ্রাম। তিনি বার্মা থেকে দেশে আসলে জনাব মোস্তাফিজুর রহমানের ছেলে জনাব ফজলে আকবার তাঁর সক্ষাতের জন্য গেলেন। কুশলাদি বিনিময়ের পর বার্মায় হুযূর ক্বেবলা শাহানশাহে সিরিকোটের বিভিন্ন কারামতপূর্ণ অবস্থার আলোচনাও হলো। সবাই অতি উৎসুক হয়ে সেখানকার অবস্থাদি শুনেছেন। তিনি এক পর্যায়ে হুযূর ক্বেবলার নি¤œলিখিত কারামতও বর্ণনা করলেন-
বার্মায় হুযূর কেবলা আলায়হির রাহমাহ্র নিয়ম ছিলো তিনি প্রতিদিন বাদে আসর ওয়া’য-তাক্বরীর করতেন। তিনি তাক্বরীর শুরু করার পূর্বে একটি ডেকসীতে এক পোয়া পরিমাণ শিরণী রান্না করতেন।
মাহফিলের পর হুযূর ক্বেবলা উক্ত ডেকসী থেকে, বিসমিল্লাহ্ পড়ে উপস্থিত লোকদের মধ্যে শিরণী পরিবেশন করতেন। কোন কোন দিন শ্রোতার সংখ্যা ৪০/৫০ জন পর্যন্ত হয়ে যেতো। হুযূর ক্বেবলা সবাইকে ডেকসীটি থেকে শিরণী পরিবেশন করে নিজেও আহার করতেন এবং এরপর ডেকসিটি ধুয়ে ফেলতেন।
।। নয়।।
এক সময় দু’ জায়গায়
হুযূর ক্বেবলা শাহানশাহে সিরিকোট বার্মায় বাঙ্গালী মসজিদের দ্বিতীয় তলায় ওয়াজ করতেন। একদিন ওই মসজিদের মুআযযিন পার্শ্ববর্তী পুস্করিণীতে সাফ-সাফা‘ইর জন্য গেলে দেখলো হুযূর ক্বেবলা তাতে ওযূ করছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে মু‘আয্যিন দ্বি-তলায় গেলে দেখতে পেলেন হুযূর সেখানে তাক্বরীর (ওয়াজ) করছেন। একই সময়ে দু’ জায়গায় হাযির আছেন দেখে মুআয্যিন হতবাক! এ’যে হুযূর ক্বেবলার এক বিরাট কারামত তা’তে সন্দেহ থাকার কথা নয়।
।। দশ।।
খানায় অকল্পনীয় বরকত
চট্টগ্রামে ‘তাজ লাইব্রেরী’র মালিক জনাব ওবায়দুর রহমান চৌধুরীর জামাতা জনাব মুযাফ্ফর আহমদ সওদাগর, সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম।
তিনি প্রথমে তাজ লাইব্রেরীর কর্মচারী ছিলেন। পরবর্তীতে মূল মালিক তাঁকে পূর্ণ দোকানের মালিক করে দিয়েছিলেন। এটাও হুযূর ক্বেবলার দো‘আর ফসল।
লাইব্রেরীর মালিক (জনাব মোযাফ্ফর আহমদ সওদাগর) তাঁর বাড়ীতে হুযূর ক্বেবলা শাহানশাহে সিরিকোট আলায়হির রাহমাহ্কে দাওয়াত দিলেন। কিন্তু হুযূর ক্বেবলার শুভাগমনের ফলে লোক সমাগম বৃদ্ধি পেয়ে গেলো। তাঁরা সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। হুযূর ক্বেবলা তাদের অবস্থা বুঝতে পারলেন। তিনি বললেন, ‘‘ভাত এবং গরু ও মুরগীর গোশত ইত্যাদি যা তৈরী করা হয়েছে, তা হাযির করো। তারপর হুযূর-ই ক্বেবলা তাতে দম করলেন। তারপর বললেন, ‘‘এবার বিসমিল্লাহ্ পড়ে যতটুকু দরকার ততটুকু ঢাকনা ফাঁক করে খাবার নিয়ে পরিবেশন করতে থাকো।’’
সুতরাং তাই করা হলো। ওই স্বল্প পরিমাণ খাদ্য ওই বিরাট সংখ্যক মেহমান আহার করে তৃপ্ত হলেন। হুযূর ক্বেবলা দাওয়াতকারী ও উপস্থিত সবার জন্য দো‘আ করলেন। তিনি সওদাগর সাহেবের অনুক‚লে ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, তাঁর দু’ ছেলে হবে। ছেলে দু’টির নামও দিলেন, মাহমুদুর রহমান ও মাহমুদুল হক। তাঁরা এখনো জীবিত।
।। এগার।।
বর্তমান হুযূর ক্বেবলার বর্ণনাঃ
এক ব্যক্তির মরহুম পিতার সান্নিধ্য লাভের আকাক্সক্ষা পূরণ
সিরিকোট শরীফের দরবারে হুযূর ক্বেবলা শাহানশাহে সিরিকোট নামায পড়াচ্ছিলেন। প্রতিবেশী রসূল শাহ্ ইবনে মুহাম্মদ শাহ্ ওই জমা‘আতে নামায পড়ছিলেন। হঠাৎ নামাযের মধ্যে রসূল শাহর আপন পিতার কথা স্মরণ হলো এবং তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করার প্রবল ইচছা জন্মালো। রসূল শাহ্ সাথে সাথে বুঝতে পারলেন যে, তাঁর পিতা মুহাম্মদ শাহ্ই তাঁর পাশে নামায পড়ছেন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, নামাযের পরক্ষণে তাঁর পিতার সাথে সাক্ষাৎ করবেন। কিন্তু সালাম ফেরানোর পর তাঁর পিতা অদৃশ্য হয়ে গেছেন। রসূল শাহ্ সাক্ষাৎ করতে না পারলেও সান্নিধ্য তো পেয়ে গেছেন। নামাযে ‘আমল-ই ক্বলীল’-এর সাথে এ সান্নিধ্য অনুভব করেছেন। এটা হুযূর ক্বেবলার পেছনে নামায পড়ারই বরকত ছিলো বৈ-কি।
।। বার।।
চুপকে সে মুঝে বাতা দে-না
হুযূর ক্বেবলা হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি আলায়হির রাহমাহ্র দীর্ঘ দিনের খাদিম মাস্টার আব্দুল ক্বাইয়ূম সাহেবকে এক পীরভাই জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি প্রত্যেক রাতে যথাসময়ে তাহাজ্জুদ নামাযের জন্য কিভাবে জেগে ওঠেন? জনাব মাস্টার সাহেব বললেন, ‘‘আমার হুযূর ক্বেবলা শাহানশাহে সিরিকোট আমাকে প্রত্যেক রাতে জাগিয়ে দেন।’’ পীর ভাইটি বললেন, ‘‘তা কিভাবে?’’ তদুত্তরে মাস্টার সাহেব বললেন, ‘‘আমি হুযূর ক্বেবলার দরবারে আরয করলাম, ‘‘হুযূর কখনো কখনো তাহাজ্জুদের সময় আমি জাগ্রত হতে পারি না।’’ তখন হুযূর ক্বেবলা বললেন, ‘‘আপ সো-তে ওয়াক্বত চুপকে সে মুঝে বাতা দে-না।’’ (আপনি শয়ন করার সময় আমাকে চুপিসারে বলে দেবেন।’’
এরপর থেকে আমি রাতে শয়ন করার সময় চুপিসারে বলে দিই, ‘‘হুযূর আমি ঘুমাচ্ছি। তাহাজ্জুদের সময় যেন আমি জেগে যাই।’’ সুতরাং প্রতি রাতে তাহাজ্জুদের সময় হুযুর ক্বেবলা আমাকে যথাসময়ে ডেকে দেন।
।। তের।।
শিক্ষকের মন্দ আমলের অশুভ পরিণতি ও আরোগ্য লাভ
চট্টগ্রামের পাঠানদন্ডী নিবাসী এক পীর ভাই-এর কন্যাকে এক পীরভাই গৃহ শিক্ষক হিসেবে পড়াতেন। মেয়েটিকে শিক্ষক সাহেব পছন্দ করতেন এবং বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সময়-সুযোগের অপেক্ষায় প্রহর গুণছিলেন। ইত্যবসরে মেয়েটির জন্য এক যোগ্য পাত্র বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসলেন। এটা জানতে পেরে শিক্ষক সাহেব প্রস্তাবকারীদেরকে উল্টো সিধে বলে ফিরিয়ে দিলেন।
শিক্ষকটির এহেন কাজটির কারণে মেয়ের বিয়েটা না হওয়ায় মেয়ের পিতা অসন্তুষ্ট হন এবং হুযূর ক্বেবলাকে শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন। হুযূর ক্বেবলা শুধু এতটুকু বললেন, ‘‘সে কি এমনটি করেছে? সে তো ভালো করেনি।’’ ব্যাস শিক্ষকজী বিবেকের ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন। রাস্তায় রাস্তায় ভবঘুরের মতো প্রদক্ষিণ করতে লাগলেন। ময়লা-আবর্জ্জনা পর্যন্ত ঘাটাঘাটি করছিলেন। এমনকি অখাদ্য-কুখাদ্য আহার করে দিনাতিপাত করছিলেন।
এদিকে হুযূর ক্বেবলা শাহানশাহে সিরিকোটের ওফাত হয়ে গেলো। এরপর হুযূর ক্বেবলা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রাহমাহ্ বাংলাদেশে তাশরীফ আনতে লাগলেন। একদিন ভোরে পায়চারী করার জন্য বের হলে হুযূর ক্বেবলার সাথে মাস্টার আবদুল কাইয়্যূম সাহেবও বের হয়েছিলেন। মাস্টার সাহেব ওই পাগল হয়ে যাওয়া শিক্ষককে রাস্তার ধারে দেখতে পান এবং তিনি হুযূর ক্বেবলাকে তার দিকে ইঙ্গিত করে দূর থেকে তাকে দেখালেন।
এরপর একদিন বলুয়ারদিঘী পাড়স্থ খানক্বাহ্ শরীফে হুযূর ক্বেবলা যেই বড় কামরাটির অন্যান্য পীর-ভাইদের নিয়ে নাস্তা করার জন্য তাশরীফ রাখছিলেন, সেখানে এক কোণে ওই শিক্ষকও বসেছিলেন। মাস্টার আবদুল ক্বাইয়্যুম সাহেব ওই শিক্ষককে নাস্তা দিলেও তাকে চিনতে পারেননি। পরক্ষণে হুযূর ক্বেবলা মাস্টার সাহেবকে বললেন, ‘‘আপনি ওই দিন সকালে যেই শিক্ষককে দেখিয়েছিলেন আজকে তিনি এখানে এসেছেন। আপনি কি তাকে দেখেননি?’’ মাস্টার সাহেব বললেন, ‘‘হুযূর! না আমি তো তার দিকে মনযোগ দিইনি।’’ এভাবে আরেকদিন নাস্তা পরিবেশনের সময় হুযূর ক্বেবলা মাস্টার সাহেবকে ডেকে বললেন, ‘‘ওই যে শিক্ষক! তাঁকে নাস্তা দিন!’’ মাস্টার সাহেব মনযোগ সহকারে তার দিকে তাকালেন এবং চিনতে পেরেছেন। তিনি হুযূর ক্বেবলার নির্দেশক্রমে তাকে নাস্তা দিলেন। সুবহা-নাল্লাহ! ওই তাবাররুক আহার করার পর থেকে শিক্ষকটির মানসিক অবস্থার দ্রæত পরিবর্তন হতে লাগলো। এক পর্যায়ে এসে তিনি পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলেন।
।। চৌদ্দ।।
মাস্টার আবদুল ক্বাইয়্যুম সাহেব এ তরীক্বতে কিভাবে এলেন?
মাস্টার আব্দুল ক্বাইয়্যূম সাহেব চট্টগ্রামের এক পীরের হাতে বায়‘আত গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তখন অবিবাহিত। বিবাহ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি পাত্রীর খোঁজ করছিলেন। তিনি ওই পীরের এক শীষ্যের মেয়েকে পছন্দ করলেন। তিনি পাত্রীর পিতাকে প্রস্তাব দেওয়ার পূর্বে আপন পীর সাহেবকে তাঁর পছন্দের কথাটা বললেন।
একদিন এক মজলিসে অন্যান্য মুরীদের সাথে ওই মেয়ের পিতাও হাযির ছিলো। পীর সাহেব মেয়ের পিতাকে ডেকে ওই মজলিসেই উপহাসচ্ছলে বললেন, ‘‘তোমার মেয়েকে মাস্টার আবদুল কাইয়্যূম পছন্দ করেছে।’’ এতে মাস্টার সাহেব ও মেয়েটির পিতা বিব্রত অবস্থায় পড়ে যান। পীর সাহেবের এহেন আচরণ মাস্টার সাহেবের মোটেই ভাল লাগেনি। তিনি পীর সাহেবকে বললেন, ‘‘আপনি আমার পীর। আপনার নিকট একটা ছোট্ট আমানত রেখেছিলাম, তা আপনি রক্ষা করতে পারেননি; বরং আমাকে নিয়ে উপহাস করলেন। সুতরাং আপনার সাথে আমার সম্পর্ক এখানে শেষ।’’
আমার রুমমেট ছিলেন জনাব বদিউল আলম। তিনি হুযূর ক্বেবলা শাহানশাহে সিরিকোটের নিকট চিঠি লিখছিলেন। আমি তাঁকে চিঠিতে আমার জন্যও দো‘আ চাইতে লিখলাম। তিনি তা করলেন। পরবর্তী বছর হুযূর ক্বেবলা বাংলাদেশে তাশরীফ আনলেন। কয়েকদিন পর বাদে আসর হুযূর ক্বেবলা বায়‘আত করছিলেন। মাস্টার আবদুল ক্বাইয়্যুম সাহেবও হুযূর ক্বেবলার হাতে বায়‘আত গ্রহণ করে ধন্য হলেন।
—০—

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান রচিত ও প্রকাশিতব্য হযরত সিরিকোটি (রহ.)’র জীবনীগ্রন্থ থেকে সংকলিত।

Share:

Leave Your Comment