বৃক্ষরোপনে ইসলামী নির্দেশনা

বৃক্ষরোপনে ইসলামী নির্দেশনা

মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম ক্বাদিরী

ভূমিকা:

পৃথিবীতে জীবজগত প্রাণী ও উদ্ভিদ দুইশ্রেণিতে বিভক্ত। এই দুইশ্রেণি তাদের জীবনপ্রবাহ পরিচালনার জন্য পরস্পর পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। শ্বাস—প্রশ্বাসের ক্ষেত্রে উভয় শ্রেণির মধ্যে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো— একের বর্জন অন্যের গ্রহণ! অর্থাৎ— প্রাণিকূল কার্বন—ডাই—অক্সসাইড ((Carbon Di-oxide) ) নামে বিষাক্ত গ্যাস হিসাবে যে নিঃশ্বাস ছাড়ে উদ্ভিদ শ্রেণি তা নিঃশ্বাস হিসাবে টেনে নেয় আর সেই উদ্ভিদ অক্সিজেন (Oxygen) হিসাবে যা ছাড়ে প্রাণিকূল তা গ্রহণ করে জীবনধারণ করে। সুবহানাল্লাহ! কী কুদরতী সার্কেল! শিল্পবিপ্লবের পর কারখানাগুলোতে জীবাশ্মা জ্বালানী ও বৃক্ষ নিধনের ফলে প্রাণিজ কার্বন নিঃস্বরণ এবং শিল্প—কারখানা হতে উৎসরিত কার্বন মিলে বিশ্বজগত আজ মহা হুমকির সম্মুখীন। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি সুজলা—সুফলা, শষ্য—শ্যামলা নাতিশীতোষ্ণ বাংলাদেশও আজ গরমের দেশে পরিণত হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন (Global Warming) অনেক সবুজ—শ্যামল অঞ্চলকে মরুভুমিতে পরিণত করছে। প্রচন্ড খরতাপ মেরুদেশীয় জমাট বরফ গলিয়ে পৃথিবীর নিম্নাঞ্চল ডুবিয়ে দিচ্ছে। একটি দেশের মোট স্থলভাগের ২৫% ভাগ বনভূমি থাকা আবশ্যক; তবেই ঐ দেশের আবহাওয়া সহনীয় পর্যায়ে থাকবে। কিন্তু অপরিনামদশীর্—স্বার্থবাজ বিশ্বমোড়লরা শিল্পায়নের নামে যত্রতত্র বন—বৃক্ষ নিধন করে শিল্প—কারখানা প্রতিষ্ঠাকরণ এবং নিজস্ব শক্তিমত্তা জাহির করার জন্য পরমাণু উৎপাদনে জ্বালানির অযথা ব্যবহার ও পরমানবিক পরীক্ষার ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়েই চলেছে। যার ফলে মানবতা আজ হুমকির সম্মুখীন। অতিমাত্রায় কার্বন নিঃস্বরণ রোধ করা না হলে প্রাণিজগত শীঘ্রই নিঃশেষ হয়ে যাবে। আর এই অতি কার্বন নিঃস্বরণ রোধ সম্ভব একমাত্র বনায়ন সংরক্ষণ ও সম্প্রাসারণের মাধ্যমেই। ইসলাম ধর্মে এজন্য মানবতার সুরক্ষা ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ধর্মে বেশি বেশি বৃক্ষরোপনের উপর তাগিদ দিয়েছে।

 প্রকৃতিতে অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণের প্রভাব
কার্বন—ডাই—অক্সাইড (Carbon Di-oxide) যার সাংক্ষেতিক চিহ্ন CO2 এবং কার্বন—মনো—অক্সাইড (Carbon Mon-oxide) যার সাংক্ষেতিক চিহ্ন CO উভয়ের অতিবৃদ্ধি প্রাণিজগতের জন্য বিশাল ক্ষতির কারণ। বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য দায়ী অতিমাত্রায় এই দু’প্রকারের কার্বনের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি। এর পরিবেশগত প্রভাব খুবই মারাত্মক। কার্বন—ডাই—অক্সাইড একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রিনহাউজ গ্যাস (Greenhouse Gas) যা ভূ—পৃষ্ঠের বিকৃর্ণ তাপ শোষণ করে। বায়ুমন্ডলীয় কার্বন—ডাই—অক্সাইড পৃথিবীতে জীবনের একটি প্রাথমিক উৎস এবং এর ঘনত্ব পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে সালোকসংশ্লেষণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। শিল্পবিপ্লবের পর থেকে কার্বন ভিত্তিক জ্বালানি দহনের ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বন—ডাই—অক্সাইডের ঘনত্ব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সাথে সাথে জীব জগতে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। এটি সমুদ্রকে অম্লীয়করণের প্রধান উৎস। এটি পানিতে কার্বনিক অ্যাসিড রুপে দ্রবীভূত হয়ে জলে ও বাতাসে লবণাক্ততা বাড়িয়ে প্রাণি—উদ্ভিদ—ক্ষেতকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাতাসে কার্বনের বৃদ্ধির ফলে দম বন্ধ বন্ধ লাগে, শ্বাস কষ্ট হয়; যেহেতু শরীর স্বাভাবিক অক্সিজেন পায় না। অক্সিজেনের ঘাটতি পূরণ করতে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। এর ফলে বুকে কষ্ট হয়, এমনকি ব্যাথাও হয়ে যেতে পারে। মস্তিষ্কে অক্সিজেন কম পৌঁছার জন্য চিন্তাশক্তির উপর প্রভাব পড়ে। চোখে ঘুম ঘুম পায়, অতিরিক্ত অক্সিজেন জোগাড় করতে ঘন ঘন হাই ওঠে। উল্টোপাল্টা আজগুবি চিন্তা মাথায় আসে। মস্তিষ্কে অক্সিজেন কমে যাওয়ায় তার কিছু কিছু অংশ কাজ করা বন্ধ করে দেয়। তার ফলে প্রথমে ব্যক্তির জ্ঞান হারিয়ে যায়। একে ব্ল্যাক আউট বলে। এর পরে মস্তিষ্কের নিউরনগুলো নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। এর ফলে প্রথমে মস্তিষ্কের ক্ষতি (ব্রেন ড্যামেজ), পরে মস্তিষ্কের মৃত্যু (ব্রেনডেথ) ঘটে। হৃৎস্পন্দন খুব বেড়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত হৃদযন্ত্র কাজ করা বন্ধ করে দেয়; যার ফলে মৃত্যু হয়।
এইপ্রসঙ্গে বলি, কার্বন—মোনো—অক্সাইড এর প্রভাবও কিছুটা একই রকম। কার্বন মনোক্সাইড (CO) পেট্রোল, কাঠ, কয়লা, কেরোসিন, সিগারেট ইত্যাদি আধাপোড়া হলে এর বর্ণহীন, গন্ধহীন গ্যাসে বায়ুদূষণ হয়। প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বায়ু বা বাতাস। অন্যান্য যে কোনো দূষণের চেয়ে বায়ুদূষণের পরিধি এবং ব্যাপকতা সবচেয়ে বেশি। কারণ, বাতাস স্বল্প সময়ে দূষিত পদার্থকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিতে পারে। বায়ুদূষণ স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় পরিবেশগত ঝুঁকিগুলোর একটি। পুরো বিশ্বে ১০ জনের মধ্যে ৯ জন লোক দূষণযুক্ত বায়ুতে শ্বাস নেয়। প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৭ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর কারণ বায়ুদূষণ। বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে ২০১৯ সালে প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫০০ জন মৃত্যুবরণ করেছেন, যা ২০১৭ সালের তুলনায় প্রায় ৫০ হাজার বেশি। তবে, কার্বন—মোনো—অক্সাইড—এর ক্ষেত্রে অক্সিজেন দিলেও লাভ হয় না। কারণ, কার্বন—মোনো—অক্সাইড রক্তে স্থিতিশীল কার্বক্সি হিমোগ্লোবিন (Carboxy hemoglobin) তৈরি করে, যার ফলে রক্ত তার স্বাভাবিক অক্সিজেন বহন করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। যার ফলে প্রাণি দ্রুত মৃত্যুবরণ করে।
প্রাণিদের বেঁচে থাকার প্রধান ও মূল উপকরণ হলো— অক্সিজেন, যা বৃক্ষ থেকেই উৎপন্ন ও নির্গত হয় এবং প্রাণিজগৎ বায়বীয়ভাবে গ্রহন করে। বৃক্ষ প্রকৃতি শোধনকারী। একটি পূর্ণবয়স্ক বৃক্ষ বছরে যে পরিমাণ অক্সিজেন উৎপাদন করে তা ১০ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের সারা বছরের চাহিদা মেটায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টি. এম. দাস ১৯৭৯ সালে পূর্ণবয়স্ক একটি বৃক্ষের অবদান আর্থিক মূল্যে বিবেচনা করে দেখান যে, একটি ৫০ বছর বয়সী বৃক্ষের অর্থনৈতিক মূল্য প্রায় ১,৮৮,০০০ ডলার; যার বর্তমান মূল্য ১ ডলার = ১০৯.৮৪১ টাকা হিসাবে— ২,০৬,৫০,১০৮ টাকা। আল্লাহু আকবার! (সূত্র: ইন্ডিয়ান বায়োলজিস্ট, ভলিয়ম—১১, সংখ্যা—১—২)।
বর্তমান বিশ্বে প্রতি বছর ৪০ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই—অক্সাইড নিঃসৃত হয়। প্রত্যেক শ্বাস—প্রশ্বাসে প্রাণিজগৎ বিষাক্ত পদার্থ কার্বন—ডাই—অক্সাইড বর্জন করে। বৃক্ষ সেই দূষিত কার্বন—ডাই—অক্সাইড গ্রহণ করে এবং প্রাণীকূলের বেঁচে থাকার মূল উপাদান অক্সিজেন নিঃসরণ করে। বুঝা গেলো— উদ্ভিদ/গাছই প্রাণিজগৎকে এই বিষাক্তগ্যাস হতে রক্ষা করে এবং অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। আর তাই পরিবেশ সুরক্ষায় ইসলাম বৃক্ষরোপণের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে।

 ইসলামে বৃক্ষরোপণ ও সংরক্ষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
প্রাকৃতিক জগৎ সৃষ্টির জন্য আল্লাহর মহাদান। সুতরাং প্রাকৃতিক পরিবেশকে সুরক্ষা দেয়া এর সুফলভোগী সকলের মহান দায়িত্ব। বন ও বন্য পশু—পাখি গাছপালা আল্লাহ পাকের মহান নিয়া‘মাত। মহান আল্লাহর সৃষ্টি বৃক্ষ রাজি যে কত বড় নিয়ামত, পবিত্র কুরআন মাজীদে একাধিক আয়াতে তা প্রমাণিত। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হচ্ছে “তারা কি লক্ষ্য করেনা, আমি ঊষর ভূমির উপর পানি প্রবাহিত করে তার সাহায্যে উদগত করি শস্য, যা থেকে তাদের গবাদি পশু এবং তারা নিজেরা আহার গ্রহণ করে।”
(সূরা: আস—সাজদাহ, আয়াত নং— ২৭)
আল্লাহপাক আরো বলেন, “মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুক। আমিই প্রচুর বারি বর্ষণ করি, অতঃপর আমি ভূমিকে ভালভাবে কর্ষিত করি এবং আমি উৎপন্ন করি শস্য, আঙ্গুর, শাক—সবজি, যায়তুন, খেজুর, বহু বৃক্ষবিশিষ্ট উদ্যান, ফল এবং গবাদি পশুর খাদ্য, এটা তোমাদের এবং তোমাদের পশুগুলোর ভোগের জন্য।
(সূরা: আবাসা, আয়াত নং— ২৪—৩২)
পবিত্র জান্নাত নামীয় মু’মিনের পরকালীণ চিরস্থায়ী ঘরকে মহান আল্লাহপাক নানাজাতীয় বৃক্ষ, ফুল—ফল, লতা—পাত দিয়ে মনোরম করে সৃষ্টি করেছেন। দুনিয়াবী প্রাকৃতিক পরিবেশের অন্যতম অনুষঙ্গ উদ্ভিদ তথা গাছপালা—লতাপাতা। গাছগাছালি, বৃক্ষতরু ও লতাগুল্ম থেকেই আসে আমাদের জীবন—জীবিকার সব উপকরণ। এজন্য নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহ ওয়া সাল্লাম এগুলোর সংরক্ষণের উপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন। প্রিয় নাবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহ ওয়া সাল্লাম নিজ হাতে গাছ লাগিয়েছেন, সাহাবাগণ রাদিয়াল্লাহু আনহুমকে গাছ লাগাতে ও বাগান করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ব্যক্তিগত ও সামাজিক বনায়নও করেছেন। তিনি মাক্কা মুকাররমা ও মাদীনা মুনাওয়ারার বিশেষ এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা (হেরম) বলে ঘোষণা করেছেন। ঐ এলাকায় গাছপালা কাটা এবং সেখানে পশুপাখি শিকার করা সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ করেছেন।
মানবজীবনে গাছের গুরুত্ব বুঝাতে তিনি মু’মিনকে সবুজ বৃক্ষের সাথে তুলনা করেছেন। যেমন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহ ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘মুমিনের উপমা হলো এমন একটি সবুজ বৃক্ষের ন্যায়, যার পাতা ঝরে পড়ে না এবং মলিন হয় না। তখন কেউ একজন বলল, এটি অমুক অমুক গাছ। তখন আমি বলতে চেয়েছিলাম যে, এটি খেজুর গাছ। তবে আমি অল্প বয়সী হওয়ায় বড়দের সামনে বলতে সংকোচ বোধ করলাম। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহ ওয়া সাল্লাম বলে দিলেন যে, সেটি হলো খেজুর গাছ। অতঃপর ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, তুমি যদি এটা সবার সামনে বলতে, তবে তা এত এত ধন—সম্পদ থেকেও আমার জন্য বেশী খুশীর কারণ হতো।’
(বুখারী শারীফ, হাদীছ নং—১৩১; মুসলিম শারীফ, হাদীছ নং—২৮১১)
এছাড়া উদ্ভিদের কাঠ, পাতা, কান্ড, ছাল—বাকল, ফলমূল সবই যেমন সৃষ্টিজগতের জন্য উপকারী, তেমনি প্রতিটি মু’মিনের আচার—আচরণ, উঠা—বসা, লেনদেন সবকিছুই অপর মু’মিন ভাইয়ের জন্য কল্যাণকর হওয়াই সমচীন— এই হাদীছ শারীফে তাই শিক্ষাই দেওয়া হয়েছে। সুবহানাল্লাহ্!
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বৃক্ষরোপণকে সাদক্বা—এ জারিয়া (চলমান দান— যে দানের সাওয়াব ক্বিয়ামাত পূর্ব পর্যন্ত কবর জগতে প্রবাহমান থাকবে) বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘মানুষ, পাখি বা পশু যখন তাদের খাবার গ্রহণ করে, তখন তা তার (রোপণকারী) পক্ষে একটি সাদাক্বা (দান) হিসেবে পরিগণিত হয়।’ (বুখারী শারীফ, হাদীছ নং—২৩২০ ও মুসলিম শারীফ, হাদীছ নং—১৫৫৩)
সাহাবী হযরত আবুদ—দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, একদা তিনি দামিস্কে বৃক্ষরোপণ করছিলেন। এমতাবস্থায় জনৈক ব্যক্তি তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় বললো, আপনি এ কাজ করছেন! অথচ, আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহ ওয়া সাল্লাম—এর সাহাবী? তখন তিনি বললেন, আপনি ব্যতিব্যস্ত হবেন না। আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহ ওয়া সাল্লাম—কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এমন বৃক্ষরোপণ করল, যা থেকে কোন মানুষ বা আল্লাহর কোন সৃষ্ট জীব খেলো, তাতে তার জন্য সাদাক্বার ছাওয়াব রয়েছে।’ (মুসনাদু আহমাদ শারীফ, হাদীছ নং— ২৭৫৪৬; বুখারী শারীফ, হাদীছ নং— ৬৪০০।)
অন্যত্র তিনি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহ ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, ‘মুসলমান যদি বৃক্ষ রোপণ করে বা ফসল চাষাবাদ করে, অতঃপর তা থেকে পাখী, মানুষ অথবা চতুষ্পদ প্রাণি কিছু খেয়ে নেয়, তবে তার জন্য সেটি সাদাক্বাহ হিসাবে গণ্য হবে।’ (বুখারী শারীফ, হাদীছ নং— ২৩২০; মুসলিম শারীফ, হাদীছ নং— ১৫৫২; মিশকাত শারীফ, হাদীছ নং— ১৯০০।)
এ প্রসঙ্গে হাদীছ—এ মুবারাকায় আরো এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো বৃক্ষ রোপণ করল, আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন এর বিনিময়ে তাকে এই বৃক্ষের ফলের সমপরিমাণ প্রতিফল দান করবেন।’ (মুসনাদু আহমাদ শারীফ, হাদীছ নং— ২৩৫২০।)
খাদেমে রাসূল হযরত আনাস বিন মা’লিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহ ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন ‘মানুষের মৃত্যুর পর তার কবরে সাতপ্রকারের নেক আমলের ছাওয়াব যাওয়া চলমান থাকে। যথা: (১) যে ব্যক্তি উপকারী জ্ঞান শিক্ষা দিল বা (২) খাল—নালা খনন পূর্বক প্রবাহিত করল অথবা (৩) কূপ খনন করল বা (৪) ফলজবৃক্ষ রোপণ করল অথবা (৫) মাসজিদ নির্মাণ করল বা (৬) কুরআনের উত্তরাধিকারী বানাল অথবা (৭) এমন সুসস্তান রেখে গেল, যে মৃত্যুর পর তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করবে।’ (শু‘আবুল ‘ঈমান, হাদীছ নং— ৩১৭৫; আত—তারগীব ওয়াত—তারহীব, হাদীছ নং— ৭৩।)
অপর এক হাদীছ শারীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহ ওয়া সাল্লাম একবার উম্মু মা‘বাদ নামীয় মহিলা সাহাবী—এর বাগানে প্রবেশ করেন। তখন তিনি নতুন রোপন করা একটি গাছ দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ওহে উম্মে মা‘বাদ! এ গাছটি কে রোপণ করেছে? কোন মুসলমান, না কাফির? প্রতিত্তরে উম্মু মা‘বাদ বললেন, মুসলমান রোপণ করেছে। উত্তর শুণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহ ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘কোন মুসলমান যদি বৃক্ষরোপণ করে, আর তা হতে কোন মানুষ বা চতুষ্পদ প্রাণি অথবা পাখি কিছু খায়, তবে ক্বিয়ামাতের দিন পর্যস্ত তার জন্য তা সাদাক্বা হিসাবে থাকবে।’ (মুসলিম শারীফ, হাদীছ নং— ১৫৫২; মুসনাদু আহমাদ শারীফ, হাদীছ নং— ১৩০২২।)
এমনকি বৃক্ষের ফল অন্য কেউ বিনা অনুমতিতে খেলেও সাদাক্বার ছওয়াব পাবেন রোপনকারী ব্যক্তি। এ প্রসঙ্গে রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহ ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘কোন মুসলমানের বপিত বৃক্ষ থেকে যা কিছু খাওয়া হয় তা তার জন্য সাদাক্বা স্বরূপ; যা কিছু চুরি হয়ে যায়, তাও সাদাক্বা। এমনকি হিং¯্র পশু যা খেয়ে নেয়, তাও সাদাক্বা। সেখান থেকে পাখী যা খায়, তাও সাদাক্বা। আর কেউ ঐ বৃক্ষের ক্ষতি সাধন করলে সেটাও তার (মালিকের) জন্য সাদাক্বা হিসাবে গণ্য হয়।’ (মুসলিম শারীফ, হাদীছ নং— ১৫৫২।)
ধরিত্রীর তরে গাছ কতই প্রয়োজনীয় বস্তু তা প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহ ওয়া সাল্লাম—এর আগত বাণী হতে সহজেই অনুমেয়। তিনি ক্বিয়ামাত সংঘটনের পূর্বেও যদি কারো কাছে একটি চারা থাকে তা রোপণ করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, “যদি ক্বিয়ামাত সংগঠিত হওয়ার সময়ও এসে যায়, আর তোমাদের হাতে একটি চারা গাছ থাকে, তাহলে বসা অবস্থায় থাকলে দাঁড়ানোর পূর্বেই যেন সে তা রোপণ করে দেয়।’ সুবহানাল্লাহ্!
(মুসনাদু আহমাদ শারীফ, হাদীছ নং— ১২৯০২ ও ১৩০০৪।)

 বিনা প্রয়োজনে বৃক্ষ নিধন নিষিদ্ধ
গাছপালা, লতা—পাতা তথা উদ্ভিদ শ্রেণি প্রাণিকুলের জন্য মহান আল্লাহপাকের বিশেষ নিয়া‘মাত । গাছ প্রাণীকুলকে রোদের প্রচন্ড খরতাপ থেকে ছায়া প্রদান করে। আমরা যত রকমের সুস্বাদু ফল—মূল খাই, সবই বৃক্ষ থেকে আহরিত। প্রাণিদেহের মরণব্যাধি নানান রোগের ঔষধ এই বৃক্ষের কান্ড—পাতা, রস—কষ, বাকল—শিকড়—মূল, ফল—ফুল থেকেই তৈরী হয়। তাই প্রিয় নাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহ ওয়া সাল্লাম বিনা প্রয়োজনে বৃক্ষ নিধন করাকে সম্পূর্ণরূপে নিষেধ করেছেন। যেমন তিনি ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে কুল/বরই বৃক্ষ কর্তন করবে, আল্লাহ তাকে অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন’। (সুনানু আবী দাঊদ শারীফ, হাদীছ নং— ৫২৩৯; মিশকাত শারীফ, হাদীছ নং— ২৯৭০।)
ইসলাম প্রচারক এবং মুসলিম বিজয়ীরা যে দেশে গিয়েছেন সে দেশকে গাছপালা দ্বারা সবুজ করে তোলার চেষ্টা করেছেন। মূলতঃ পবিত্র কুরআন মাজীদ ও হাদীছ শারীফ থেকেই তাঁরা এ কাজের অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন। ইসলামের ইতিহাসে এর যথেষ্ট নজীর রয়েছে। কৃষির উন্নয়ন ও সংরক্ষণের প্রতিও মুসলিম খালীফাগণ সব সময় সজাগ ও সচেষ্ট ছিলেন। যেমন, প্রথম খালীফা হযরত আবূ বাকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু অপ্রয়োজনে গাছ কাটার ব্যাপারে সাবধান করেছেন। তিনি ইয়াযীদ বিন আবী সুফিয়ানকে সিরিয়িা প্রেরণের সময় বিনা প্রয়োজনে কোন ফলজ বৃক্ষ কর্তন করতে নিষেধ করেছিলেন।’ (সুনানু তিরমিযী শারীফ, হাদীছ নং— ১৫৫২; আস—সুনানুল কুবরাহ লিল—বায়হাক্বী, হাদীছ নং— ১৮৬১৬।)
একদা এক ব্যক্তি হযরত ‘উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর নিকট অভিযোগ করেন যে, তার (সিরিয়ায়) একটি শস্যক্ষেত মুসলিম সৈন্যরা যাওয়ার সময় নষ্ট করে দিয়েছে। খালীফা অভিযোগ শুনে ঐ ব্যক্তিকে তার ক্ষতিপূরণস্বরূপ বায়তুল মাল থেকে দশ হাজার দিরহাম দান করেন (কিতাবুল খিরাজ লি—ইমাম আবী ইউসূফ)। খাদ্য, কাপড়, বাসস্থান ও চিকিৎসাসহ মানবজীবনের প্রায় সব প্রয়োজনীয় বস্তুই গাছকে ঘিরে এবং গাছ থেকেই প্রাপ্ত হয়। যারা নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করবে, শস্য ও প্রাণি বিনাশের চেষ্টা করবে তারা আল্লাহর রাগ ও শাস্তির শিকার হবে। আল্লাহপাক বলেন, “যখন সে ফিরে যায় (অথবা নেতৃত্বে আসীন হয়), তখন সে পৃথিবীতে অশাস্তি সৃষ্টির এবং শস্য ও প্রাণী বিনাশের চেষ্টা করে। অথচ আল্লাহ অশাস্তি পছন্দ করেন না।”
(সূরা: আল—বাক্বারাহ, আয়াত নং— ২০৫)
সুতরাং আমরা যেন পৃথিবীতে অশাস্তি সৃষ্টি এবং শস্যক্ষেত্র ও প্রাণী ধ্বংসের পাঁয়তারা করে আল্লাহর ক্রোধের শিকার না হই।

 ইকোসিস্টেম—এর ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষ
প্রাজ্ঞময় আল্লাহপাকের সৃষ্ট ইকোসিস্টেম (Ecosystem- হচ্ছে জৈব—অজৈব পদার্থ ও বিভিন্ন জীবসমন্বিত এমন প্রাকৃতিক একক যেখানে বিভিন্ন জীবসমষ্টি পরস্পরের সাথে এবং তাদের পারিপার্শ্বিক জৈব ও অজৈব উপাদানের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে একটি জীবনধারা গড়ে তোলে। জীব ও তার পরিবেশের পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্ক চর্চার বিষয়কে বাস্তুবিদ্যা বা Ecology বলে।) বা বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যতা রক্ষায় এবং তাঁর বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে পরিমিতভাবে সৃষ্টি হয়েছে বৃক্ষ। প্রত্যেক সৃষ্ট বস্তু বা বিষয়ের মধ্যে আল্লাহপাক আভ্যন্তরীণ সম্পর্ক (Inter-relations) নির্ধারণ করেছেন। এই আন্তঃসম্পর্ক পরিমিত থাকলে বিশ্বজগৎ ঠিক; অন্যথায় বিপর্যয়। আল্লাহপাক বলেন, “আর পৃথিবীকে আমি বিস্তৃত করেছি এবং ওতে পাহাড়সমূহ স্থাপন করেছি। আর আমি তাতে প্রত্যেক বস্তু উৎপন্ন করেছি সুপরিমিতভাবে।” (সূরা: আল—হিজার, আয়াত নং—১৯।)
বৃক্ষরাজি ও প্রাণীজগতের মধ্যে এক গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আল্লাহপাক নিজেই একথা উল্লেখ করে বলেন, “যিনি সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর বিন্যস্ত করেছেন এবং যিনি নিয়ন্ত্রণ করেছেন, তারপর নিদের্শনা দিয়েছেন। যিনি তৃণাদী উৎপন্ন করেছেন। অতঃপর তাকে শুষ্ক—বিমলিন করেছেন।’ (সূরা: আল—আ‘লা, আয়াত নং— ২—৫)
আল্লাহর সৃষ্টিসমূহের মধ্যে গাছপালা, লতা—পাতা বহুমুখী গুরুত্ববহ ও তাৎপর্যমন্ডিত এক অনবদ্য সৃষ্টি। বৃক্ষরাজিসহ সম্পূর্ণ ইকোসিস্টেমকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করা সৃষ্টির সেরে মানুষের উপর আবশ্যক। কারণ, তাতেই নিহিত রয়েছে পুরো প্রাণিজগৎ ও ভৌতজগৎ—এর পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া। ইকোসিস্টেমের হাজারো অংশীদারের মানুষ একটি উপাদান মাত্র এবং তার নিজের কল্যাণের জন্যই প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেম সুরক্ষা অবশ্যই প্রয়োজন। পরিমিত বৃক্ষ ইকোসিস্টেমের অন্যতম উপাদান; এর সুরক্ষাও আবশ্যক। বৃক্ষের সুরক্ষায় মানবজাতির রক্ষা। অন্যথায় অপরিনামদশীর্ মনুষ্যজাতি নিজেও একদিন বিপন্ন ও বিলুপ্ত জাতি হিসাবে ইতিহাস হয়ে যাবে। আল্লাহপানাহ!

 গাছ লাগাই—ধরিত্রি বাঁচাই
গাছ রোপন করার ক্ষমতা আল্লাহপাক মানুষকেই দিয়েছেন। পৃথিবীর ইকোলজিক্যাল ভারসাম্যতা নিজ প্রয়েজনে মানুষকেই রক্ষা করতে হবে। মানুষকে আল্লাহপাকের সৃষ্টির কল্যাণে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। সৃষ্টির সেরা জীবের পরিচয় দিতে হবে। নিয়্যাত রাখতে হবে বৃহত্তর মানবজাতি ও সৃষ্টিকুলের কল্যাণ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহ ওয়া সাল্লাম—এর নির্দেশনা অনূযায়ী বৃক্ষরোপনের পর তার সংরক্ষণ ও পরিচর্যার প্রতিও বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহ ওয়া সাল্লাম নিজ হাত মুবারক দিয়ে বৃক্ষরোপণ করেছেন। একে ইবাদত ও প্রবাহমান সাদাক্বাহ হিসাবে ঘোষণা করেছেন। তিনি উম্মতকে বৃক্ষরোপণ করতে বারংবার তাগীদ দিয়েছেন। যাতে উদ্ভিদ বৃদ্ধি পায় এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হয়। তাই আসুন! সামনে বর্ষাকালে গাছ লাগাই—ধরিত্রি বাঁচাই! মানবজাতি বাঁচাই! একজন অপরজনকে গাছ উপহার দিই। আমাদের লাগানো গাছের অক্সিজেন দিয়ে আমাদের ভাবী প্রজন্ম স্বত্বির নিঃশ্বাস নিক। প্রবাহমান সাদাক্বাহ হিসাবে তা আমাদের মুক্তির মাধ্যম হউক! আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে বেশী বেশী গাছ লাগানোর তাওফীক দান করুন— আমীন!

লেখক: প্রভাক (আরবী) হাশিমপুর ইসলামিয়া মকবুলিয়া কামিল (এম.এ.) মাদরাসা— চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম।

Share:

Leave Your Comment