কবিরা গুনাহ : পরিণতি-২

কবিরা গুনাহ : পরিণতি-২

মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ্ আল-মাসুম>

ইবাদাতের সাথে সংশ্লিষ্ট সাতটি কবিরা গুনাহের বিষয়ে কুরআন হাদীসের আলোকে বর্ণনার প্রয়াস পাচ্ছি। যথা-

২:১. প্রস্রাব বিষয়ে সতর্ক না থাকা
স্বাস্থ্যবিধি মতে, সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি দিনে ৬ থেকে ৮ বার প্রস্রাব করা স্বাভাবিক। আর প্রস্রাব করার পর প্রত্যেকবার পবিত্রতা অর্জন করা জরুরি। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বারংবার তাগিদ দিয়েছেন। কেনানা,প্রস্রাব থেকে ভালোভাবে পবিত্রতা অর্জন না করা কবীরা গুনাহের পর্যায়ভুক্ত। কবরের অধিকাংশ শাস্তি তা থেকে সতর্ক না থাকার কারণে। ইরশাদ হচ্ছে-
عن أبي هريرة رضي الله عنه مرفوعًا: اسْتَنْزِهوا من البول؛ فإنَّ عامَّة عذاب القبر منه
অর্থাৎ কবরের অধিকাংশ আজাব হবে প্রস্রাব হতে পবিত্রতা অর্জন না করার কারণে। প্রস্রাব থেকে ভালোভাবে পবিত্রতা অর্জন না করার মধ্যে এটিও যে, আপনি প্রস্রাব শেষেই দ্রুত উঠে গেলেন অথচ প্রস্রাবের কয়েক ফোঁটা এখনো থেকে গেছে যা পরবর্তীতে কাপড়কে নাপাক করে দিচ্ছে অথবা প্রস্রাবের পর পানি বা ঢিলা কিছুই ব্যবহার না করা। এ প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন,
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ مَرَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِقَبْرَيْنِ فَقَالَ إِنَّهُمَا لَيُعَذَّبَانِ وَمَا يُعَذَّبَانِ فِي كَبِيرٍ أَمَّا أَحدهمَا فَكَانَ لَا يَسْتَتِرُ مِنَ الْبَوْلِ – وَفِي رِوَايَةٍ لمُسلم: لَا يستنزه مِنَ الْبَوْلِ – وَأَمَّا الْاٰخَرُ فَكَانَ يَمْشِي بِالنَّمِيمَةِ ثمَّ أَخذ جَرِيدَة رطبَة فَشَقهَا نِصْفَيْنِ ثُمَّ غَرَزَ فِي كُلِّ قَبْرٍ وَاحِدَةً قَالُوا يَا رَسُوْلَ اللهِ لِمَ صَنَعْتَ هٰذَا قَالَ لَعَلَّه يُخَفف عَنْهُمَا مَا لم ييبسا
অর্থাৎ একদিন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’টি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি বললেন, এ দু’জন কবরবাসীকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। তবে তা কোন বড় অপরাধের জন্য নয়। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, বাস্তবে তা সত্যিই বড় অপরাধ অথবা বস্তুত উক্ত দু’টি গুনাহ থেকে রক্ষা পাওয়া তাদের জন্য কোন কষ্টকরই ছিলো না। তাদের এক জন প্রস্রাব থেকে ভালোভাবে পবিত্রতা অর্জন করতো না আর অপর জন মানুষের মাঝে চোগলখুরি করে বেড়াতো। অতঃপর রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেজুর গাছের একটি তাজা ডালকে দু’ভাগ করে প্রত্যেক কবরে একটি করে গেড়ে দিলেন। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন: হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম!) আপনি কেন এমন করলেন? রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, অবশ্যই যতক্ষণ না ডাল দু’টি শুকাবে (ডালের তাসবীহ পাঠের বিনিময়ে) তাদের শাস্তি হালকা করে দেয়া হবে ।

২:২. নামায পরিত্যাগ করা
নামায না পড়া মারাত্মক অপরাধসমূহের মধ্যে অন্যতম। নামায ত্যাগকারী ব্যক্তিরাই বস্তুত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। আখিরাতে প্রথম বিচার হবে নামাযের। নামায ত্যাগকারী দুনিয়া, কবর ও আখিরাত সর্বত্রই কঠিন অবস্থায় পতিত হবে। কবর তার জন্য সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়বে ও আগুনে ভর্তি থাকবে। আখিরাতে কঠোরভাবে হিসাব গ্রহণ করা হবে, আল্লাহ তাআলা তার প্রতি রাগান্বিত হবেন এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। ইরশাদ হচ্ছে,
فَخَلَفَ مِنۡۢ بَعۡدِهِمۡ خَلۡفٌ اَضَاعُوا الصَّلٰوۃَ
وَ اتَّبَعُوا الشَّهَوٰتِ فَسَوۡفَ یَلۡقَوۡنَ غَیًّا
অর্থাৎ- তাদের পরে এলো (নিকৃষ্ট) বংশধর। তারা নামায নষ্ট করল এবং লালসার বশবর্তী হলো। ফলে অচিরেই তারা কু-কর্মের শাস্তি ভোগ করবে।’ ইমাম ইবনুল ক্বায়্যিম বর্ণনা করেন, বস্তুত অর্থসম্পদের ব্যস্ততা, রাজত্বের ব্যস্ততা, সরকারি কাজের ব্যস্ততা কিংবা ব্যবসায়-বাণিজ্যের ব্যস্ততা প্রভৃতির কারণে নামাযের হিফাজত করে না, নামায ত্যাগ করে। সুতরাং যে তার অর্থসম্পদ (উপার্জন ও রক্ষায়) ব্যস্ততায় নামায ত্যাগ করে, সে কারুনের সাথী হবে। যে ব্যক্তি দেশ ও রাজত্ব পরিচালনার ব্যস্ততায় নামায ত্যাগ করে, সে হবে ফিরাউনের সাথী। যে ব্যক্তি সরকারি কাজের ব্যস্ততায় নামায ত্যাগ করে, সে হবে হামানের সাথী। আর যে ব্যক্তি ব্যবসায়-বাণিজ্য (এবং চাকরি বাকরির) ব্যস্ততায় নামায ত্যাগ করে, সে হবে উবাই ইবনে খালফের সাথী। ইসলামী রাষ্ট্রে, নামায না পড়ার শাস্তি প্রসঙ্গে ইমামে আজম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘তারা তওবা না করলে জেলখানায় আবদ্ধ করে রাখা হবে যতক্ষণ না তওবা করে বা মৃত্যু হয়। ইমামত্রয় (ইমাম মালেক, ইমাম হাম্বল ও ইমাম শাফেয়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহিম) বলেন, বেনামাযিকে মুরতাদ হিসেবে ঘোষণা করে তাদের তওবা করার জন্য আহ্বান জানানো হবে। ফিরে না এলে তাদেরকে হত্যা করা হবে।’

২:৩. নামাযে ইমামের পূর্বে কোন কাজ করা
জামাতে নামায পড়ার সময় নামাযের প্রত্যেক রুকনেই মুকতাদির জন্য ইমামের অনুসরণ করা আবশ্যক। ইমামের আগে বেড়ে কোন কাজ করা হারাম। কেননা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
أَمَا يَخْشَى الَّذِي يَرْفَعُ رَأْسَهُ قَبْلَ الْإِمَامِ
أَنْ يُحَوِّلَ اللهُ رَأْسَهُ رَأْسَ حِمَارٍ
অর্থাৎ “যে ব্যক্তি ইমামের পূর্বে মাথা উঠায় সে কি ভয় করে না যে, আল্লাহ্ তার মাথাটি গাধার মাথায় রূপান্তরিত করে দেবেন? অথবা তার আকৃতিকে গাধার আকৃতিতে পরিবর্তন করে দেবেন?” নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেন,
إِنَّمَا جُعِلَ الْإِمَامُ لِيُؤْتَمَّ بِهِ فَإِذَا كَبَّرَ فَكَبِّرُوا وَلَا تُكَبِّرُوا حَتَّى يُكَبِّرَ وَإِذَا رَكَعَ فَارْكَعُوا وَلَا تَرْكَعُوا حَتَّى يَرْكَعَ
অর্থাৎ “অনুসরণ করার জন্য ইমাম নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি তাকবীর দেয়ার পর তোমরা তাকবীর দিবে, তিনি তাকবীর দিয়ে শেষ না করলে তোমরা তাকবীর দিবে না। তিনি রুকূ করলে তোমরা রুকূ করবে। তিনি রুকূতে না যাওয়া পর্যন্ত তোমরা রুকু করবে না।” উল্লেখ্য যে, ইমামের সাথে মুক্তাদীর চারটি অবস্থা হতে পারে। যথা-
১. ইমামের আগে বেড়ে কোন কিছু করা।
২. ইমামের সাথে সাথে করা।
৩. ইমামের পিছনে পিছনে করা।
৪. ইমামের অনুসরণ করা।
ইমামের আগ বেড়ে কোন কিছু করা অর্থাৎ ইমাম শুরু করার আগেই তা করে নেয়া। এরূপ করা নিষেধ। একাজ যদি তাকবীরে তাহরীমার ক্ষেত্রে হয় তবে তার নামাযই হবে না। নামায পুনরায় পড়া ওয়াজিব। ইমামের সাথে সাথে করা অর্থাৎ ইমামের রুকূর সাথে রুকূ করা, সিজদা করার সাথে সাথে সিজদা করা, উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথে উঠে দাঁড়ানো। প্রকাশ্য দলীল সমূহ অনুযায়ী এরূপ করাও নিষেধ। কেননা, এমনটি করতে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারণ করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে, “তিনি (ইমাম) রুকূতে না যাওয়া পর্যন্ত তোমরা রুকূ করবে না।” ইমামের পিছনে পিছনে করা অর্থাৎ অতিরিক্ত বিলম্ব করে ইমামের অনুসরণ করা সুন্নাত বহির্ভূত। ইমামের অনুসরণ করা অর্থাৎ ইমামের পর পর দেরী না করে তার অনুসরণ করা। এটাই হচ্ছে সুন্নাত পদ্ধতি।

২:৩. সালাত আদায়কারীর সামনে দিয়ে অতিক্রম করা
নামাযী ব্যক্তির সামনে দিয়ে অতিক্রমের ব্যাপারে হাদিস শরীফে কঠোর নিষেধাজ্ঞা এসেছে। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,, ‘যে ব্যক্তি কোনো নামাজির সামনে দিয়ে অতিক্রম করে, সে যদি জানত (এর গুনাহ কিংবা শাস্তি কতটা ভয়াবহ)- তাহলে নামাজরত ব্যক্তির সামনে দিয়ে এ পদক্ষেপের তুলনায় তার কাছে একশত বছর দাঁড়িয়ে থাকা উত্তম মনে হতো।’ তাই নবীজি নামায শুরু করার আগে সুতরা সামনে রেখে নামায পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। নামাযের জন্য কোন কিছুর আড়াল করাকে সুতরা বলা হয়। বস্তুত বড় মসজিদে নামাযে দাঁড়ালে সামনে একটি বস্তু (দেয়াল, পিলার, লাঠি ইত্যাদি) রাখা জরুরি। যার ফলে নামায অবস্থায় সামনে দিয়ে লোকজন চলাফেরা করতে না পারে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘সুতরা ছাড়া নামায পড় না।’ এখন প্রশ্ন হলো নামাযী ব্যক্তি সুতরা কোথায় রাখবে এবং সুতরা কিসের হবে? এর উত্তরে বিজ্ঞ আলেমগণ বলেন, সুতরা হতে হবে মাটি থেকে অল্প উঁচু কোনো বস্তু অর্থাৎ সর্বনিম্ন এক হাত লম্বা প্রায় আধা গজ এবং আঙ্গুল বরাবর মোটা হওয়া আবশ্যক। আর তা রাখতে হবে সিজদার জায়গার অল্প সামনে। হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামাকে সুতরার পরিমাপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, হাওদার লাঠির মতো। এর ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত তাবেয়ী হযরত আতা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, হাওদার লাঠির দৈর্ঘ্য হলো, “এক হাত বা তার চেয়ে একটু বেশি।” রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদের খুঁটিকে, ফাঁকা ময়দানে বর্শা গেড়ে, নিজের সওয়ারি উটকে আড়াআড়িভাবে দাঁড় করিয়ে সুতরা বানাতেন। এছাড়াও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন সময় উটের পিঠে বসার জিনপোশ (গদি), গাছ ও শয়নের খাটকে সামনে রেখেও নামায পড়েছেন। সুতরা বিষয়ে নিম্নোক্ত কয়েকটি মাসআলা জানা অতিব জরুরী-
১. মসজিদ যদি বড় হয় অর্থাৎ মসজিদের প্রশস্ততা চল্লিশ হাতের বেশি হয় তবে উক্ত মসজিদে নামাযরত ব্যক্তির দুই কাতার সামনে দিয়ে অতিক্রম করা জায়েয আছে। অর্থাৎ নামাযীর কাতারসহ মোট তিন কাতার দূরত্ব দিয়ে যাওয়া যাবে। পক্ষান্তরে যদি চল্লিশ হাতের চেয়ে ছোট মসজিদ হয়, সেক্ষেত্রে নামাযরত ব্যক্তির সামনে দিয়ে সুতরা (প্রতিবন্ধক) ব্যতীত অতিক্রম করা যাবে না। সুতরা সামনে রেখেই প্রয়োজনে অতিক্রম করতে পারবে।
২. নামাযী ব্যক্তির সামনে দিয়ে যদি অন্যদের যাতায়াতের সম্ভাবনা থাকে তাহলে নামায় শুরু করার পূর্বেই সামনে ‘সুতরা’ রেখে নামায আরম্ভ করা সুন্নত।
৩. যদি নামাযী ব্যক্তির সামনে জুতার বক্স থাকে। তবে হাত বাড়িয়ে নামাযী ব্যক্তির সামনের জুতার বক্স থেকে জুতা নিতে কোনো অসুবিধা নেই। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখা দরকার, যেন তার নামাযের কোন ব্যাঘাত না ঘটে।
৪. মাঝে মাঝে মসজিদে কিছু মুসল্লিকে দেখা যায়, তারা দ্রুত বের হওয়ার জন্য নামাযরত ব্যক্তির সামনে দিয়ে রুমাল বা হাতে থাকা জায়নামাজ সুতরা হিসেবে ব্যবহার করে হাঁটতে থাকে। এই ধরনের ‘চলমান সুতরা’ নামাযী ব্যক্তির সামনে দিয়ে অতিক্রম করার জন্য সুতরা হিসেবে যথেষ্ট নয়। তাই এর থেকে বিরত থাকতে হবে।
৫. কেউ যদি অজ্ঞতাবশত নামাযী ব্যক্তির সামনে দিয়ে অতিক্রম করে তাহলে তাকে হাত দিয়ে কিংবা একটু উচ্চস্বরে তাসবিহ পড়ে সতর্ক করাও জায়েজ আছে। । তবে হ্যাঁ, তার সামনে দিয়ে কারো অতিক্রম করার আশঙ্কা থাকলে নামায শুরু করার পূর্বেই সুতরা সামনে রাখা সুন্নত।
৬. অনেক সময় দেখা যায়, কোনো মুসল্লি নামাযরত ব্যক্তির সামনে সুতরা রেখে অতিক্রম করে, এরপর আরেক জনের সামনে সুতরা রাখে। এইভাবে সে একাধিক ব্যক্তির সামনে সুতরা রেখে মসজিদ থেকে বের হয়। এইভাবে অতিক্রম করা নাজায়েজ নয়। তবে এতে নামাযী ব্যক্তির মনোযোগ বিনষ্ট হতে পারে। তাই প্রয়োজন ছাড়া এমনটি করা থেকে বিরত থাকা চায়।
৭. ইমামের সামনে সুতরা থাকলে মুক্তাদির জন্য পৃথক সুতরার দরকার নেই। তবে কোন ইমাম যদি সুতরা না দেন, তাহলে মুক্তাদির সুতরা দিতে হবে।
৮. জায়নামাযের শেষ প্রান্তকে সুতরা বলে গণ্য করা যাবে না।
৯. বিনা সুতরায় নামায পড়লে কেউ সামনে দিয়ে গেলে নামায নষ্ট হয় না। কিন্তু নামাযের ক্ষতি হয়। মানুষ চলাফেরা করতে পারে, এমন স্থানে সুতরা না রেখে নামায পড়া গুনাহের কাজ।

২:৪. যাকাত প্রদান না করা
ধনাঢ্য ব্যক্তির যাকাত আদায় না করা কবিরা গুনাহ। আর যাকাত অনাদায়ের সাজার বর্ণনা দিতে গিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
্রمَنْ آتَاهُ اللَّهُ مَالًا، فَلَمْ يُؤَدِّ زَكَاتَهُ مُثِّلَ لَهُ مَالُهُ يَوْمَ القِيَامَةِ شُجَاعًا أَقْرَعَ لَهُ زَبِيبَتَانِ يُطَوَّقُهُ يَوْمَ القِيَامَةِ، ثُمَّ يَأْخُذُ بِلِهْزِمَتَيْهِ – يَعْنِي بِشِدْقَيْهِ – ثُمَّ يَقُولُ أَنَا مَالُكَ أَنَا كَنْزُكَ-
অর্থাৎ যাকে আল্লাহ তা‘আলা সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে এর যাকাত আদায় করে নি, কিয়ামতের দিন তার সম্পদকে টেকো মাথা বিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় মালা পরিয়ে দেওয়া হবে, সাপটি তার মুখের দুই পার্শ্ব কামড় দিয়ে বলতে থাকবে, আমি তোমার সম্পদ আমি তোমার জমাকৃত সম্পদ। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত আয়াত তিলাওয়াত করেন। ইরশাদ হচ্ছে,
وَلَا يَحۡسَبَنَّ ٱلَّذِينَ يَبۡخَلُونَ بِمَآ ءَاتَىٰهُمُ ٱللَّهُ مِن فَضۡلِهِۦ هُوَ خَيۡرٗا لَّهُمۖ بَلۡ هُوَ شَرّٞ لَّهُمۡۖ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُواْ بِهِۦ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِۗ
অর্থাৎ ঁ“আর আল্লাহ যাদেরকে তাঁর অনুগ্রহ থেকে যা দান করেছেন তা নিয়ে যারা কৃপণতা করে তারা যেন ধারণা না করে যে, তা তাদের জন্য কল্যাণকর, বরং তা তাদের জন্য অকল্যাণকর। যা নিয়ে তারা কৃপণতা করেছিল, কিয়ামত দিবসে তা দিয়ে তাদের বেড়ি পরানো হবে।”। আর যারা যাকাত আদায়ে উদাসীনতা দেখায় তাদের বিষয়ে কুরআনুল করিমে কঠিন হুশিয়ারী এসেছে। ইরশাদ হচ্ছে,
وَٱلَّذِينَ يَكۡنِزُونَ ٱلذَّهَبَ وَٱلۡفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ فَبَشِّرۡهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٖ ٣٤ يَوۡمَ يُحۡمَىٰ عَلَيۡهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكۡوَىٰ بِهَا جِبَاهُهُمۡ وَجُنُوبُهُمۡ وَظُهُورُهُمۡۖ هَٰذَا مَا كَنَزۡتُمۡ لِأَنفُسِكُمۡ فَذُوقُواْ مَا كُنتُمۡ تَكۡنِزُونَ-
অর্থাৎ “আর যারা সোনা ও রূপা পুঞ্জীভূত করে রাখে, আর তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না, আপনি তাদের বেদনাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দিন। যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা গরম করা হবে, অতঃপর তা দ্বারা তাদের কপালে, পার্শ্বে এবং পিঠে সেঁক দেওয়া হবে। (আর বলা হবে) ‘এটা তা-ই যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে। সুতরাং তোমরা যা জমা করেছিলে তার স্বাদ উপভোগ কর’’। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন
وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَا يَمُوتُ رَجُلٌ فَيَدَعُ إِبِلًا أَوْ بَقَرًا لَمْ يُؤَدِّ زَكَاتَهَا إِلَّا جَاءَتْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْظَمَ مَا كَانَتْ وَأَسْمَنَهُ تَطَؤُهُ بِأَخْفَافِهَا وَتَنْطَحُهُ بِقُرُونِهَا كُلَّمَا نَفِدَتْ أُخْرَاهَا أُعِيدَتْ أُولَاهَا حَتَّى يُقْضَى بَيْنَ النَّاسِ-
অর্থাৎ ঐ সত্তার শপথ, যার হাতে আমার জীবন রয়েছে, যে ব্যক্তি উট, গরুর যাকাত আদায় না করে মারা যায় কিয়ামতের দিন সেগুলোকে পূর্বাপেক্ষা বিরাট এবং বলিষ্ঠাকারে তার সামনে আনা হবে; সেগুলো তাকে ক্ষুর দ্বারা পদদলিত করতে থাকবে এবং শিং দ্বারা আঘাত করতে থাকবে। যখন দ্বিতীয়টা ফিরে যাবে প্রথমটা ফিরে আসবে। এরূপ চলতে থাকবে লোকজনের মাঝে বিচার কার্য নিম্পন্ন না পর্যন্ত।

২:৫. রোজা পরিত্যাগ করা
ইসলাম অনুমোদিত অপারগতা ছাড়া প্রাপ্তবয়স্ক কোনো মুসলমানের রোজার বিধান পরিত্যাগ করার অনুমতি নেই। ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ রোজা ভঙ্গ করলে ইসলামের দৃষ্টিতে সে বড় পাপী এবং পরকালে তার জন্য আছে ভয়াবহ শাস্তি। রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
بينما أنا نائم أتاني رجلان فأخذا بضبعي فأتيابي جبلا وعرا فقالا : اصعد؛ فقلت : إني لا أطيقه. فقالا: سنسهله لك، فصعدت حتى إذا كنت في سواء الجبل إذا بأصوات شديدة، قلت : ما هذه الأصوات؟ قالوا هذا عواء أهل النار، ثم انطلق بي، فإذا أنا بقوم معلقين بعراقيبهم، مشققة اشداقهم، تسيل اشداقهم دما. قال : قلت : من هؤلاء : قال : الذين يفطرون قبل تحلة صومهم.
অর্থাৎ আমি স্বপ্নে দেখলাম, আমার কাছে দুই ব্যক্তি আগমন করল। তারা আমার বাহুদ্বয় ধরে আমাকে এক দুর্গম পাহাড়ে নিয়ে গেল। তারপর আমাকে বলল, আপনি পাহাড়ের ওপর উঠুন। আমি বললাম, আমি তো উঠতে পারব না। তারা বলল, আমরা আপনাকে সহজ করে দেব। আমি ওপরে উঠলাম। যখন পাহাড়ের সমতলে পৌঁছলাম, হঠাৎ ভয়ংকর আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি বললাম, এসব কিসের আওয়াজ? তারা বলল, এটা জাহান্নামিদের আর্তনাদ। তারপর তারা আমাকে নিয়ে এগিয়ে চলল। হঠাৎ কিছু লোক দেখতে পেলাম, যাদের পায়ের মাংস পেশি দ্বারা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এবং তাদের মুখের দুই প্রান্ত ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে এবং তা থেকে রক্ত ঝরছে। আমি বললাম, এরা কারা? তারা বলল, যারা ইফতারের সময় হওয়ার আগেই রোজা ভেঙ্গে ফেলে।’ রমযান মাসের একটি রোযা না রাখলে মানুষ শুধু গুনাহগারই হয় না, ঐ রোযার পরিবর্তে আজীবন রোযা রাখলেও রমযানের এক রোযার যে মর্যাদা ও কল্যাণ, যে রহমত ও খায়ের-বরকত রয়েছে; তা কখনো লাভ করতে পারবে না এবং কোনোভাবেই এর যথার্থ ক্ষতিপূরণ আদায় হবে না। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহু বলেন,
من افطر يوما من رمضان متعمدا من غير سفر ولا مرض لم يقضه ابدا، وان صام الدهر كله، ..
অর্থাৎ ‘যে ব্যক্তি অসুস্থতা ও সফর ব্যতীত ইচ্ছাকৃতভাবে রমযানের একটি রোযাও ভঙ্গ করে, সে আজীবন রোযা রাখলেও ঐ রোযার হক আদায় হবে না।’

২:৬. হজ্ব পরিত্যাগ করা
সামর্থ্যবানদের জন্য জীবনে একবার হজ্ব করা ফরজ ইবাদত। সামর্থ্য থাকার পরও ইচ্ছাকৃত যারা হজ করে না; এটি তাদের জন্য কবিরা গুনাহ। কেননা, রব্বে করিম ইরশাদ করেন,
وَلِلّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلاً
وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ الله غَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ-
অর্থাৎ আর এ ঘরের হজ করা সে সব মানুষের জন্য অবশ্যক কর্তব্য; যারা সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য রাখে । যে প্রত্যাখ্যান করবে সে জেনে রাখুক- আল্লাহ সারা বিশ্বের কোনো কিছুরই পরোয়া করেন না।’
[সূরা আলে ইমরান,আয়াত: ৯৭]
ফরজ হজ্ব অনাদায়ীর করুণ পরিণতি বর্ণনা করে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘কোন ব্যক্তি আল্লাহর ঘর পর্যন্ত পৌঁছার (খরচ বহনের) মতো সম্বল (ধন-সম্পদ) ও বাহনের অধিকারী হওয়ার পরও যদি হজ্ব না করে তবে সে ইহুদি হয়ে মারা যাক কিংবা খ্রিস্টান হয়ে মারা যাক তাতে (আল্লাহর) কোনো ভাবনা নেই।’
[সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৮১২]

২:৭. আল্লাহকে স্মরণ না করা
মুমিন মাত্রই আল্লাহর স্মরণে সদা মগ্ন থাকবে। এটাই মহান রবের নির্দেশ। ইরশাদ হচ্ছে,
وَ اذۡکُرۡ رَّبَّکَ فِیۡ نَفۡسِکَ تَضَرُّعًا وَّ خِیۡفَۃً وَّ دُوۡنَ الۡجَهۡرِ
مِنَ الۡقَوۡلِ بِالۡغُدُوِّ وَ الۡاٰصَالِ وَ لَا تَکُنۡ مِّنَ الۡغٰفِلِیۡنَ
অর্থাৎ ‘আর তুমি নিজ মনে আপন প্রতিপালককে স্মরণ কর সকাল-সন্ধ্যায় অনুনয়-বিনয় ও ভীতি সহকারে এবং অনুচ্চ স্বরে। আর (হে বান্দা!) তুমি উদাসীনদের দলভুক্ত হয়ো না।’ [সূরা আরাফ, আয়াত: ২০৫]
কেননা,মহান আল্লাহর যিকর থেকে বিমুখ হওয়া মারাত্মক অপরাধ। পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হচ্ছে,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تُلۡهِکُمۡ اَمۡوَالُکُمۡ وَ لَاۤ اَوۡلَادُکُمۡ عَنۡ ذِکۡرِ اللّٰهِ ۚ وَ مَنۡ یَّفۡعَلۡ ذٰلِکَ فَاُولٰٓئِکَ هُمُ الۡخٰسِرُوۡنَ
অর্থাৎ ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের ধন-সম্পত্তি ও সন্তান- সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ হতে উদাসিন না করে, আর যারা উদাসীন হবে, তারাই তো ক্ষতিগ্রস্থ।’ [সূরা মুনাফিকুন,আয়াত :৯]
(চলবে)

লেখক: আরবী প্রভাষক, তাজুশ শরী’আহ দরসে নিযামী মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম।