অতুলনীয় রসূলের অতুলনীয় বাশারিয়াত

অতুলনীয় রসূলের অতুলনীয় বাশারিয়াত

‘ইন্নামা- আনা বাশারুম মিসলুকুম’-আয়াতে মুতাশা-বিহাত
[অতুলনীয় রসূলের অতুলনীয় বাশারিয়াত]
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান > 
সূরা কাহফের সর্বশেষ আয়াত ‘‘ক্বুল ইন্নামা আনা বাশারুম মিস্লুকুম’’ অবলম্বনে এক শ্রেণীর মানুষ (বরং মুসলমান নামধারী) রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ‘আমাদের মতো মানুষ’, ‘মাটির মানুষ’, ‘সাধারণ মানুষ’ ইত্যাদি মন্তব্য করেই যাচ্ছে। এ মন্তব্যগুলো আসলে আয়াত শরীফটার ভুল ও মনগড়া ব্যাখ্যা বৈ-কিছুই নয়। এমন ভুল ও মনগড়া ব্যাখ্যার ফলে রসূলে আকরামের প্রতি জঘন্য মানহানিই। এটা ঈমান বিধ্বংসী ব্যাখ্যা। তাই এ নিবন্ধে আয়াত শরীফটার সঠিক ও যথার্থ ব্যাখ্যা উপস্থাপনের প্রয়াস পাচ্ছিঃ
প্রথমে আয়াতটির সঠিক অনুবাদ (তরজমা) দেখুন-‘‘হে মাহবূব! আপনি লোকজনকে এটা বলে দিন যে, যাহেরী মানবীয় আকৃতিতে আমি তোমাদের মতো।’’ এখন সর্বপ্রথম আমাদেরকে গভীরভাবে জানতে হবে যে, রসূলের কোন্ বিষয়ে আমাদের মতো! রসূল-ই আকরামের সাথে আমাদের সামঞ্জস্যের মানদ- কি! এ আয়াতের মাহাত্ম্য কি এটাই যে, রসূল-ই আক্রামের বরকতময় দৈহিক অঙ্গগুলো, যেমন চোখ, নাক ও কান ইত্যাদির কার্যকারিতা ও বৈশিষ্ট্যাবলী আমাদের দেহের অঙ্গগুলোর কার্য ও বৈশিষ্ট্যের মতো? যদি ‘বাশারুম মিস্লুকুম’ (তোমাদের মতো বশর)-এর এ অর্থ নেওয়া হয়, তবে তা হবে একেবারেই ভুল ও অবাস্তব। কেননা, হুযূর-ই আক্রামের বরকতমণ্ডিত অঙ্গগুলোর কার্যাদি ও বৈশিষ্ট্যাবলী আমাদের দেহের অঙ্গগুলোর মতো নয়। কারণ, কে জানে না যে, হুযূর-ই আকরামের শরীর মুবারকের ছায়া ছিলো না। আর আমাদের শরীরের ছায়া পড়ে। নবী-ই আকরামের শরীর মুবারকের উপর কখনো মাছি বসেনি, আর আমাদের শরীরের উপর হাজারো মাছি বসে আর ওঠে। রসূল-ই আকরামের ঘাম মুবারক থেকে মিশ্ক, আম্বর ও গোলাবের ছেয়েও বেশী খুশবু প্রবাহিত হতো; আর আমাদের ঘাম থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়। রসূল-ই আকরামের চক্ষুযুগল সামনে-পেছনে, উপরে-নিচে, ডানে-বামে এক সময়ে দেখতে পেতো, আর আমাদের চক্ষু যুগল শুধু সামনের দিকে দেখতে পায়। রসূল-ই আন্ওয়ারের শুধু চক্ষুযুগল ঘুমাতো, কিন্তু হৃদয় মুবারক জাগ্রত থাকতো। আমাদের চক্ষুযুগলও ঘুমে বিভোর হয়ে যায়, হৃদয়ও ঘুমিয়ে পড়ে। রসূল-ই আকরাম যে গলিতে কদম মুবারক রাখতেন ওই পুরো গলি হুযূর-ই আকরামের খুশবুতে ভরে যেতো, আর আমাদের মতো কোন মানুষই তো তেমন নয়, যা থেকে খুশ্বু বের হয়। সুতরাং বুঝা গেলো যে, হুযূর-ই আনওয়ারের বরকতময় অঙ্গগুলোর কার্যাদি ও বৈশিষ্ট্যাবলীর মতো সমগ্র দুনিয়ার কোন মানুষেরই হতে পারে না; না ক্বিয়ামত পর্যন্ত হতে পারে। সুতরাং ‘‘ইন্নামা আনা বাশারুম মিসলুকুম’-এর এ অর্থ হতে পারে না যে, রসূল-ই আকরামের বরকতময় কান, চোখ, হাত, পা ইত্যাদি আমাদের মতো। তাহলে আয়াতের সঠিক অর্থ ও মাহাত্ম্য কি?
তাছাড়া, শরীয়তের বিধানাবলীতে কি রসূল-ই আকরাম আমাদের মতো? বাস্তবিকপক্ষে তিনি তাতেও আমাদের মতো নন। কারণ, হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালামের উপর তাহাজ্জুদের নামায ফরয ছিলো, আমাদের উপর তাহাজ্জুদের নামায ফরয নয়। হুযূর-ই আক্রামের উপর যাকাত ফরয ছিলো না। আর আমাদের ধনবানদের উপর যাকাত ফরয। হুযূর-ই আক্রামের জন্য চারের চেয়ে বেশী স্ত্রী গ্রহণ জায়েয ছিলো, আমাদের জন্য চারের অধিক স্ত্রী হালাল নয়। হুযূর-ই আক্রামের ওযূ ঘুমালে ভঙ্গ হতো না; আমাদের ওযূ ঘুমের কারণে ভেঙ্গে যায়। মোটকথা, শরীয়তের অনেক বিধান হুযূরের সাথে খাস। সুতরাং কেউ একথা বলতে পারে না যে, হুযূর-ই আকরাম শরীয়তের বিধানাবলীতে আমাদের মতো। কাজেই, যখন তিনি দৈহিক দিক দিয়ে এবং শরীয়তের বিধানাবলীর দিক দিয়ে আমাদের মতো নন, তখন পবিত্র ক্বোরআনের উক্ত আয়াতের সঠিক মর্মার্থ কি হবে? নবী-ই আকরাম ও অন্য মানুষের মধ্যে সামঞ্জস্য কোন্ বিষয়ে?
তদুপরি, হুযূর-ই আকরামও হাদীস শরীফে এরশাদ করেছেন, ‘‘আইয়্যুকুম মিসলী?’’ (মিশকাত, কিতাবুস্ সাওম) অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে কে আছো আমার মতো? অন্য হাদীস শরীফে হুযূর-ই আকরাম এরশাদ করেছেন, ‘‘লাস্তু কাআহাদিম মিনকুম।’’ (আমি তোমাদের মধ্যে কারো মত নই)। সুতরাং এ দু’ হাদীস শরীফের ভিত্তিতে আয়াত ‘ইন্নামা আনা বাশারুম মিস্লুকুম’ (নিশ্চয় আমি তোমাদের মতো বশর)-এর অর্থ ও মাহাত্ম্য কি হতে পারে?
এতে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, হুযূর-ই আকরামের শান বা মর্যাদা সমস্ত সৃষ্টির উপরে, হুযূর-ই আকরামের পবিত্র বিবিগণের শানও অনুপম। খোদ আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমায়েছেন-  يَا نِسَآءَ النَّبِىِّ لَسْتُنَّ كَاَحَدٍ مِّنَ النِّسَآءِ
(হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা অন্যান্য নারীদের মত নও! সূরা আহযাব)। যখন হুযূর-ই আকরামের বিবিগণ অন্য কোন নারীর মতো নন, তখন হুযূর-ই আকরাম কিভাবে অন্য কারো মত হতে পারেন?
সুতরাং উক্ত আয়াতের সঠিক অর্থ কি হতে পারে, তা ক্বোরআন ও হাদীসের অর্থ ও মাহাত্ম্য অনুধাবনে যারা পারদর্শী তাঁদের দিকে আমাদের প্রত্যাবর্তন করা অনিবার্য। তাই নিম্নে  কতিপয় সুদক্ষ তাফসীরকারকের গবেষণালব্ধ অভিমত পেশ করার প্রয়াস পাচ্ছি-
এক. শায়খ-ই মুহাক্বক্বিক্ব হযরত আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভীর অভিমত
তিনি তাঁর বিশ্বখ্যাত কিতাব ‘মাদারিজুন্নবূয়ত’-এ লিখেছেন- درحقيقت متشابهات اند অর্থাৎ আয়াত-  اِنَّمَا اَنَا بَشَرٌمِّثْلُكُمْ(ইন্নামা আনা বাশারুম্ মিস্লুকুম) এবং এ ধরনের আয়াতগুলো مُتَشَابِهَاتُ (মুতাশাবিহাত) পর্যায়ের আয়াতগুলোর অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল ব্যতীত গোটা বিশ্বে কেউ এ আয়াতগুলোর প্রকৃত অর্থ ও মাহাত্ম্য জানে না। সুতরাং এ আয়াতের যাহেরী (বাহ্যিক) অর্থ গ্রহণ করা যাবে না। যেমন-يَدُ اللهِ فَوْقَ اَيْدِيْهِمْ  (এর يَدُ اللهِ) এবং فَثَمَّ وَجْهُ اللهِ (এর وَجْهُ اللهُ) -এর যাহেরী অর্থ গ্রহণ করা অকাট্যভাবে ভুল। তাই, শরীয়তের হুকুম হচ্ছে- ‘ইয়াদুল্লা-হি’ ও ‘ওয়াজহুল্লা-হি’-এর সঠিক অর্থ কি, তা আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলই জানেন। অনুরূপ, ‘বাশারুম মিস্লুকুম’-এর সঠিক মাহাত্ম্য সম্পর্কে আমাদের আক্বীদা বা বিশ্বাস রাখতে হবে যে, এর সঠিক অর্থও আল্লাহ্ এবং তাঁর রসূলই জানেন।
আল্লাহ্ তা‘আলা শায়খ মুহাক্বক্বিক্ব রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির মাযার-ই পাকের উপর রহমতের ফুল বর্ষণ করুন, যিনি আয়াতটিকে ‘মুতাশাবিহাত’ বলে সাব্যস্ত করে দরবারে রিসালতের গোস্তাখদের মুখে তালা লাগিয়ে দিয়েছেন। কারণ, এখন তারা এ আয়াত শরীফকে দলীল বানিয়ে রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে আমাদের মত মানুষ বলতে পারবে না। কারণ, ‘আয়াতে মুতাশাবিহাত’ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন- لاَ يَعْلَمْ تَأْوِيْلَه اِلاَّ اللهُ (অর্থাৎ এমন আয়াতগুলোর সঠিক অর্থ আল্লাহ্ ব্যতীত কেউ জানে না। অবশ্য আল্লাহ্ তা‘আলা বাত্লিয়ে দেয়ার ফলে তাঁর রসূলও জানেন। সুতরাং আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল ব্যতীত এমন আয়াতগুলোর সঠিক অর্থ ও মাহাত্ম্য অন্য কেউ জানে না। তাই, এ আয়াতগুলোকে শরীয়তের বিধানাবলীর উৎস (দলীল) বানানোর অবকাশ নেই।
দুই. ইমাম রাযীর তাফসীর
ইসলামী বিশ্বের প্রসিদ্ধ ও সর্বজন মান্য তাফসীরকার হযরত ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর ‘তাফসীর-ই কবীর’-এ আয়াত ‘ইন্নামা আনা বাশারুম মিসলুকুম’-এর তাফসীর প্রসঙ্গে লিখেছেন-اَمَرَمُحَمَّدًا صَلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِاَنْ يَّسْلُكَ طَرِيْقَ التَّوَاضُعِ অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলা এ আয়াতে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে হুকুম দিয়েছেন যেন বিনয়ের পথে চলেন। আর অগণিত ফযীলত ও পূর্ণতা থাকা সত্ত্বেও যেন আপন উম্মতকে বিনয়ের সুরে বলেন, ‘‘নিশ্চয় আমি তোমাদের মত মানুষ (বশর)।’’ সুতরাং একথা সুস্পষ্ট হলো যে, হুযূর-ই আকরাম নিজেকে ‘তোমাদের মত মানুষ’ কথাটা বিনয় বশতঃ বলেছেন।’ সুতরাং এ কথা কে জানেনা যে, বিনয়বশতঃ যে কথা বলা হয় তা যাহেরী অর্থে ব্যবহৃত হয় না। আর ওই শব্দ বলা অন্য কারো জন্য বৈধ নয়। বুযুর্গদের নিয়ম হচ্ছে- তাঁরা বিনয়বশতঃ অনেক কিছু বলে ফেলেন; কিন্তু ছোটদের জন্য ওই সব শব্দ তাঁর শানে বলা ঠিক নয়। যেমন বাদশাহ্ যদি তাঁর প্রজাদের উদ্দেশে বলেন, ‘‘আমি তোমাদের খাদিম (সেবক)’’, তবে কি প্রজারা তাঁকে খাদিম মনে করে তাদের জন্য কোন কাজের নির্দেশ দিতে পারে? কেউ যদি তা করে তবে তো ওই বোকামীর জন্য তাকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। অনুরূপ, উক্ত আয়াতের ভিত্তিতে কোন উম্মত আল্লাহ্র হাবীবকে তার মতো মানুষ (বশর) বলতে পারে না।
উপরোক্ত আয়াত এবং হাদীস শরীফগুলো থেকে একথাও প্রমাণিত হয় যে, রসূল-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মধ্যে ‘বাশারিয়াত’-এর বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। রসূল-ই আকরামের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলো যেমন অতুলনীয়, তাঁর বাশারিয়াতও অনুপম-অতুলনীয়। আমাদের বাশারিয়াত (মানবীয়তা) ও রসূল-ই আকরামের বাশারিয়াতের মধ্যে আসমান ও তাহতুস্ সারার মতো ব্যবধান বিদ্যমান। এ পার্থক্যের দিকে এক কবি ইঙ্গিত করে বলেছেন-
مُحَمَّدٌ بَشَرٌ لَا كَالْبَشَرِ ـ بَلْ كَيَا قُوتٍ بَيْنَ الْحَجَرِ
অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামও বশর, তবে তিনি অন্য কোন বশরের মতো নন; বরং তাঁর বাশারিয়াত তেমনি যেমন পাথরগুলোর মধ্যে ইয়াক্বূত পাথর’। মর্মর পাথরও পাথর আর ইয়াক্বূতও পাথর। কোথায় মর্মর আর কোথায় ইয়াক্বূত? কেউ কি বলতে পারে যে, উভয় পাথর এক সমান। অনুরূপ, রসূল বশর; কিন্তু আমাদের মতো বশর নন। আমরা এমন বশর যে, ঘুমালে দ্বীন ও দুনিয়া থেকে গাফিল হয়ে যাই, আর জাগ্রত হলেও খোদা-পরিচিতি সম্পর্কে জাহিল (অজ্ঞ)। আর রসূল-ই আকরাম এমন বশর যে,
وه سوجائيں تو معراج منامى   – وه جا گيں تو خدا سے هم كلامى
অর্থ: তিনি ঘুমালে ঘুমন্ত অবস্থার মি’রাজ হয়, আর জাগ্রত হলে খোদা তা‘আলার সাথে কথা বলেন।
আমরা এমন বশর যে, ফেরেশতারা- مَنْ يُفْسِدُ فِيْهَ وَيَسْفِكُ الدِّمَاءَ (যারা যমীনে ফ্যাসাদ ছড়াবে এবং রক্তপাত ঘটাবে) বলে তুচ্ছার্থক শব্দাবলী দ্বারা অভিযোগ করেছিলো। আর রসূল হচ্ছেন এমন বশর তাঁকে দেখে নৈকট্য ধন্য ফেরেশতাগণ ভক্তিপূর্ণ ভাষায় বলেন-
ائے  هزاراں   جبرئيل     اندر  بشر
بهر حق سوئے غريبا ں اك نظر
অর্থ: এ মহান বশরের মধ্যে হাজারো জিব্রাঈলের মর্যাদা ও ক্ষমতা রয়েছে। আল্লাহর ওয়াস্তে আমরা গরীবদের দিকে একটি মাত্র কৃপাদৃষ্টি দিন!
বেরাদরানে মিল্লাত!
আমাদের রসূলের বাশারিয়াতের এমন মহত্ব যে, তিনি এ-ই বশরী পোশাকে আল্লাহর আরশে পদব্রজে অতিক্রম করে যখন আল্লাহর একান্ত নৈকট্যের উঁচুতর মনযিলে পৌঁছেছিলেন, তখন তাঁর বশরিয়াতের এমন মহত্ব প্রত্যক্ষকারী ফেরেশ্তাদের এমন অবস্থা হয়ে গিয়েছিলো যে,
جب سے ديكھا هے لباس بشرى ميں تم كو
هر فرشتے  كى تمنا هے كه انسان   هو جائے
অর্থ: এয়া রসূলাল্লাহ্! যখন থেকে বশরী পোষাকে আপনাকে দেখলো, তখন প্রতিটি ফেরেশতার মনে এ আরজু জন্মালো যে, ইনসান (বশর) হয়ে যাবেন।
রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে নিছক বশর (মানুষ) বলা ‘জঘন্য’ বেয়াদবী
মুসলিম ভাইয়েরা!
রসূলুল্লাহকে নিজেদের মতো বশর (মানুষ) বলা অত্যন্ত জঘন্য ও ঘৃণ্য বেয়াদবী। আমরা তো বলছি যে, আমাদের ঈমান হচ্ছে- রসূল নিঃসন্দেহে জিন্ও নন, ফেরেশতাও নন, খোদাও নন; বরং নিশ্চিত ও অকাট্যভাবে বশর। এতে কোনরূপ সন্দেহ নেই। কিন্তু তবুও তাঁকে তাঁর ওইসব বড় বড় ও উঁচু উঁচু খেতাব ও উপাধি বাদ দিয়ে, যেগুলোর কারণে তিনি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ, তাঁকে নিছক ‘বশর’ ও ‘মানুষ’ বলে স্মরণ করা, তাও হুযূর-ই আক্রামের পবিত্র শানে, এক প্রকার জঘন্য বেয়াদবীই। কারণ, এমনটি করলে হুযূর-ই আক্বদাসের উঁচুতম মর্যাদাগুলোকে এক প্রকার অস্বীকারই করা হয়। তাই বিনা প্রয়োজনে তাঁকে ‘নিছক মানুষ’ বলা নিশ্চিতভাবে হারাম ও গুনাহর কাজ।
এখানে একটি প্রশ্ন ও সেটার জবাব দেখুন!
প্রশ্ন: যখন আমাদের ঈমান এবং ক্বোরআন মজীদ থেকে প্রমাণিত যে, রসূল জিন্ কিংবা ফেরেশতা নন, বরং ইনসান ও বশরই, তখন রসূলুল্লাহকে বশর বলা বেয়াদবী, হারাম ও গুনাহ্ হবে কেন? একটি সত্য বলা কথাও কি হারাম ও গুনাহ হতে পারে?
জবাব: হাঁ, হাঁ, কখনো কখনো সত্য কথা বললেও বেয়াদবী হয়ে যায়। যে কথার উপর আমাদের ঈমান, ক্বোরআন মজীদ থেকেও তা প্রমাণিত, তা বললেও কোন কোন স্থানে মানহানি হয়ে যায়; সেটা বেয়াদবী হিসেবে গণ্য হয়। উদাহরণ স্বরূপ, পবিত্র ক্বোরআনে আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন-
اِنَّا خَلَقْنَا الْاِنْسَانَ مِنْ نُطْفَةٍ اَمْشَاجٍ
তরজমা: নিশ্চয় আমি (আল্লাহ্) মানুষকে নারী ও পুরুষের মিশ্রিত বীর্য থেকে পয়দা করেছি।
পবিত্র ক্বোরআনে অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে-
حَمَلَتْهُ اُمُّهٗ كُرْهًا وَوَضَعَتْهُ كُرْهًا
তরজমা: প্রত্যেক মানুষকে তার মাতা কষ্ট সহ্য করে গর্ভে ধারণ করেছে এবং কষ্ট সহ্য করে তাকে জন্ম দিয়েছে (প্রসব করেছে)।
দেখুন! যদি হাইকোর্টের জজ সাহেব যখন বিচারকের কুরসীতে বসেন, আর কেউ তাঁকে এটা বলে আহ্বান করে, ‘‘হে নর ও নারীর বীর্য থেকে সৃষ্ট!’’ অথবা বলে, ‘‘হে আপন মায়ের গর্ভে অবস্থানকারী! আপন মায়ের প্রসূত সন্তান!’’ বলুন, তখন এ সত্য কথাগুলো বলে জজ সাহেবকে সম্বোধন করা তাঁর মানহানি হবে কিনা? জজ সাহেবকে এমন সব শব্দ দ্বারা সম্বোধনকারীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মুকাদ্দমা দায়ের করা হবে কিনা? এর জবাবে আপনি ‘হাঁ’ বলা ছাড়া আর কিইবা বলতে পারেন? তখন তো ওই ব্যক্তি শাস্তি পাবে। কারণ, যখন ‘জজ সাহেব বিচারকের কুরসীতে বসে যান, তখন থেকে তাঁকে ‘মাননীয় জজ সাহেব!’ ব্যতীত অন্য কিছু বলা জঘন্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। এমনকি তখন তাঁকে তাঁর নাম নিয়ে ডাকা এবং তাঁকে মানুষ বলে সম্বোধন করা আদালত অবমাননা বলে সাব্যস্ত হবে।
সুতরাং তুলনা নয় বরং বাস্তবতা হচ্ছে যখন আহকামুল হাকিমীন আল্লাহ্ তা‘আলা আপন হাবীবকে ‘সাইয়্যেদুল মুরসালীন’ (রসূলকুল সরদার)-এর সর্বোচ্চ আসনে আসীন করেছেন, তাঁকে ‘খাতামুন্নবিয়্যীন’ (সর্বশেষ নবী) সম্মানজনক পদ দান করেছেন এবং তাঁকে সম্বোধন করার জন্য ‘ইয়া রসূলাল্লাহ্’, ‘ইয়া হাবীবাল্লাহ্’ সম্মানজনক খেতাবও নির্দ্ধারণ করে দিয়েছেন, তখন এসব সম্মানজনক খেতাব ছেড়ে তাঁকে বশর ও মানুষ বলে স্মরণ ও সম্বোধন করা মানহানি ও বেয়াদবী হওয়া তো নিশ্চিতই। নিশ্চয়, রসূলুল্লাহকে সাধারণ শব্দ দ্বারা স্মরণকারী দরবারে রিসালতে অপরাধী বলে সাব্যস্ত হবে। সে মহাপরাক্রমশালী খোদা তা‘আলার পক্ষ থেকে অবশ্যই কঠিন শাস্তি পাবে।
কাফিরদের বুলি!
আল্লাহর রসূলগণ নিছক বশর (মানুষ) বলা ঈমানদারদের বুলি নয় বরং কাফিরদেরই বুলি। যারা রসূলগণকে নিজেদের মত মানুষ বলে বেড়ায়, তাদের উদ্দেশে বলছি, তোমরা পূর্ণ ক্বোরআন পড়ে দেখো, তোমাদের কোথাও একথা নজরে পড়বে না যে, কোন নবীর উম্মতের ঈমানদারগণ তাদের নবীকে তাদের মত ‘বশর’ (মানুষ) বলেছে; বরং পবিত্র ক্বোরআন পর্যালোচনা করলে একথা সুস্পষ্ট হবে যে, সর্বপ্রথম নবীকে যে ‘বশর’ (মাটির মানুষ) বলেছে সে হচ্ছে শয়তান। যেমন, পবিত্র ক্বোরআনের বর্ণনা হচ্ছে- যখন আল্লাহ্ তা‘আলা ফেরেশতাদেরকে হযরত আদম আলায়হিস্ সালামের সামনে সাজদাহ্ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তখন সমস্ত ফেরেশতা কালবিলম্ব না করে তাঁকে সাজদাহ্ করেছিলেন, কিন্তু শয়তান সাজদাহ তো করেনি; বরং আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে সাজদাহ্ না করার কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে বলেছিলো-
قَالَ لَمْ أَكُن لِّأَسْجُدَ لِبَشَرٍ خَلَقْتَهُۥ مِن صَلْصَـالٍۢ مِّنْ حَمَإٍۢ مَّسْنُونٍۢ-
তরজমা: শয়তান বললো, ‘আমার জন্য শোভা পায় না যে, আমি এমন এক ‘বশর’ (মানুষ)কে সাজদাহ্ করবো, যাকে তুমি ঠনঠনে মাটি থেকে তৈরী করেছো, যা কালো বর্ণের দুর্গন্ধময় কাদা মাটি থেকে ছিলো।  [সূরা হিজর]
দেখলেন তো! সর্বপ্রথম যেই বে-আদব হতভাগা আল্লাহর এক নবী হযরত আদম আলায়হিস্ সালামকে ‘বশর’ বলেছিলো, সে ছিলো ইবলিস (শয়তান)। এ থেকে প্রমাণিত হলো যে, নবীগণ আলায়হিমুস্ সালামকে ‘বশর’ বলা শয়তানেরই বুলি, অথবা কাফিরদেই বুলি। শয়তানের বুলি তো দেখলেন। এখন কাফিরদের বুলিও দেখে নিন, হযরত নূহ আলায়হিস্ সালাম যখন আপন সম্প্রদায়কে আল্লাহর আযাব সম্পর্কে সতর্ক করলেন, তখন তাঁর সম্প্রদায়ের কাফিরগণ যা বলেছিলো, তা আল্লাহ্ তা‘আলার ক্বোরআনের ভাষায় দেখুন-
فَقَالَ الْمَلَأُ الَّذِينَ كَفَرُوْا مِنْ قَوْمِه مَا نَرَىٰكَ إِلَّا بَشَرًا مِّثْلَنَا-
তরজমা: তাঁর সম্প্রদায়ের সরদারগণ, যারা কাফির ছিলো, তারা বলেছিলো, ‘‘আমরা তো তোমাকে আমাদের মতো বশর (মানুষ) দেখতে পাচ্ছি।’’ এভাবে হযরত নূহ্ আলায়হিস্ সালামের সম্প্রদায়, আদ ও সামূদ সম্প্রদায়গুলোর কাফিররা সবাই নিজ নিজ পয়গাম্বরকে এটাই বলেছিলো-
إِنْ أَنتُمْ إِلَّا بَشَرٌ مِّثْلُنَا تُرِيدُونَ أَن تَصُدُّونَا عَمَّا كَانَ يَعْبُدُ آبَاؤُنَا فَأْتُونَا بِسُلْطَانٍ مُّبِينٍ-
তরজমা: তোমরা তো আমাদের মত মানুষ, তোমরা চাচ্ছো আমাদের বাপদাদার উপাস্যগুলো থেকে আমাদেরকে বিরত রাখতে। সুতরাং তোমরা কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ আমাদের নিকট নিয়ে এসো! [সূরা হূদ]
অনুরূপ, হযরত শো‘আয়ব আলায়হিস্ সালাম যখন তাঁর সম্প্রদায়ের নিকট হিদায়তের পয়গাম নিয়ে এসেছিলেন, তখন কাফিররা তাঁকে বলেছিলো,
مَا اَنْتَ اِلَّا بَشَرٌ مِثْلُنَا وَاِنْ نَظُنُّكَ لَمِنَ الْكَاذِبِيْنَ-
তরজমা: তুমি তো আমাদেরই মত মানুষ, আমাদের নিশ্চিত ধারণা যে, তুমি মিথ্যুকদের অর্ন্তভুক্ত। [সূরা শু‘আরা]
এভাবে, ইন্তাকিয়া শহরের কাফিরগণ, যখন হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর হাওয়ারীগণের মুখে হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর হিদায়তের বাণী শুনেছিলো, তখন বলেছিলো-
قَالُوا مَا أَنتُمْ إِلَّا بَشَرٌ مِّثْلُنَا وَمَا أَنزَلَ الرَّحْمَٰنُ مِن شَيْءٍ إِنْ أَنتُمْ إِلَّا تَكْذِبُونَ-
তরজমা: তুমি তো আমাদের মতো মানুষই। পরম করুণাময় কিছুই নাযিল করেননি। তোমরা হলে নিরেট মিথ্যুক।
এমনকি সূরা ‘তাগাবুন’-এ খোদাওয়ান্দে আলম এরশাদ করেছেন, সমস্ত কাফিরের এটাই দস্তুর ছিলো যে, যখনই কোন নবী (আলায়হিস্ সালাম) লোকজনের নিকট খোদা তা‘আলার পয়গাম নিয়ে এসেছেন, তখন ওই কাফিররা এটাই বলেছিলো-اَبْشَرٌ يَّهْدُوْنَنَا (একজন বশর বা মানুষই কি আমাদেরকে হিদায়ত করবে?)
মোটকথা, আল্লাহ্ তা‘আলার নবীগণ আলায়হিমুস্ সালামকে ‘বশর’ বলা কাফিরদেরই বুলি। এটা ঈমানদারদের বুলি নয়। কারণ, কখনোই কোন মু’মিন কোন নবীকে এভাবে তুচ্ছার্থে ‘বশর’ বলেনি। আর যদি কোন মু’মিন কখনো হুযূর-ই আকরামকে ‘বশর’ বলে থাকেন, তবে তিনি একথা জানানোর জন্যই বলেছেন যে, হুযূর-ই আক্রাম খোদা নন, জিন নন, ফেরেশতা নন; বরং বশর, অর্থাৎ ইনসান ছিলেন। মানুষ ছিলেন, বশর বা মানুষও ছিলেন অতুলনীয়।
কাফিরদের, রসূলগণকে কথায় কথায় মানুষ (বশর) বলা সম্পর্কে মাওলানা রূম আলায়হির রাহমাহ্ বলেছেন-
كافر اں گفتد   احمد را   بشر
ايں نمى ديدند ازو شق القمر
অর্থাৎ কাফিরগণ হুযূর-ই আকরাম আহমদ মুজতাবা মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে বশর বলেছে অথচ এটা দেখেনি যে, তাঁর ইশারায় চাঁদ দ্বি-খ-িত হয়েছিলো।
মাওলানা রূম অন্যত্র বলেছেন-
گفت   ا ينك    ما    بشر  ايشاں    بشرـ ما و ايشاں      بستۂ  خواهم  و  خور
অর্থাৎ কাফিররা এভাবে বলেছে যে, আমরাও বশর, নবীগণও বশর। আমরাও ঘুমাই, পানাহার করি, নবীগণও শয়ন করেন, পানাহার করেন।
ايں ندا نستند ايشاں  از عمى ـ  هست فرقے در مياں بے انتها
অর্থাৎ তারা তাদের অন্ধত্বের কারণে এতটুকুও জানে না যে, আমাদেরও সম্মানিত নবীগণের মধ্যে সীমাহীন পার্থক্য বিরাজমান। সুবহানাল্লাহ!
পরিশেষে. আলোচ্য আয়াত শরীফটার সঠিক অনুবাদ করে এ নিবন্ধের ইতি টানছি। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমায়েছেন-
قُلْ إِنَّمَآ أَنَا۠ بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوحٰىٓ  إِلَىَّ أَنَّمَآ إِلٰهُكُمْ إِلٰهٌ وَاحِدٌ-
তরজমা:  হে মাহবূব! আপনি বলে দিন, যাহেরী বশরী সূরতে (বাহ্যিক মানবীয় আকৃতিতে) আমি তোমাদের মতো একজন মানুষ। আমার উপর ওহী করা হয় যে, তোমাদের উপাস্য একমাত্র উপাস্যই।
فَمَنْ كَانَ يَرْجُوْ لِقَاءَ رَبِّه فَلْيْعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَّلَايُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّه اَحَدًا-
তরজমা:  সুতরাং যার আপন রবের সাথে সাক্ষাতের আশা থাকে তার উচিৎ হচ্ছে পুণ্যময় কাজ করা এবং আপন রবের বন্দেগীতে কাউকে শরীক না করা।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ  লক্ষ্য করুন! আয়াতটির শেষভাগে আল্লাহ্ তা‘আলা দু’টি জিনিস বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন- একটি হচ্ছে فَلْيْعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا অর্থাৎ যে ব্যক্তি  আল্লাহ্র সাক্ষাৎ প্রার্থী সে যেন সৎ কার্যাদির ভা-ার গড়ে নেয়। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছেوَّلَايُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّه اَحَدًا অর্থাৎ এবং আপন রবের ইবাদতে কাউকে যেন শরীক না করে। অর্থাৎ শির্ক থেকে বাঁচতে থাকে। কারণ আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন-
اِنَّ اللهَ لَا يَغْفِرُ اَنْ يُشْرَكَ بِه وَيَغْفِرُ مَا دُوْنَ ذَالِكَ لِمَنْ يَّشَاءُ
অর্থাৎ নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর সাথে শির্ক করাকে ক্ষমা করবেন না, শির্ক অপেক্ষা কম পর্যায়ের অন্য সব গুনাহ্ যার জন্য চান ক্ষমা করে দেন। মোটকথা, রসূল-ই আকরাম সম্পর্কে সঠিক আক্বীদা ও নেক আমল মানুষকে আল্লাহ্ পর্যন্ত পৌঁছায়। আল্লাহ্ নসীব করুন! আ-মী-ন।
 লেখক: মহাপরিচালক-আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।