ইসলামের দৃষ্টিতে পরামর্শ করার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

ইসলামের দৃষ্টিতে পরামর্শ করার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি > 

عَنْ اَنَسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَاخَابَ مَنْ اَسْتَخَارَ وَلاَ نَدِمَ مَنْ اَسْتَشَارَ وَلاَ عَالَ مَنْ اَقْتَصَدَ [المعجم الصغير]
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اِذَا كُنْتُمْ ثَلاَثَةٌ فَلاَ يَتَنَاجِىْ رَجْلاَنْ دُوْنَ الْاخِرِ حَتّى تَخْتَلِطُوْا بِالنَّاسِ فَاِنَّ ذَالِكَ يخزنهُ ـ [متفق عليه]

অনুবাদ: হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি এস্তেখারা করল, সে কোনো কাজে ব্যর্থ হবেনা, যে পরামর্শ করল সে লজ্জিত হবে না। যে মধ্যপন্থা অবলম্বন করল সে দারিদ্র্যে নিমজ্জিত হবে না। [আল মুজামুস্ সগীর]
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যখন তোমরা তিনজন একত্রে থাক একজনকে বাদ দিয়ে দু’জন কোনো পরামর্শ করবে না। যে পর্যন্ত না তোমরা অনেক লোকের মধ্যে মিশে যাও। কারণ এটা তাকে দুঃখ দিতে পারে। [বুখারী ও মুসলিম]

প্রাসঙ্গিক আলোচনা
বর্ণিত হাদীস শরীফদ্বয়ে পরামর্শ ভিত্তিক কাজ করার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। পরামর্শকে আরবিতে ‘শুরা’ বলা হয়। মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ১১৪টি সূরার মধ্যে একটি সূরার নাম সূরা ‘শুরা’ ইসলামী জীবন বিধানে মানবজাতির ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে প্রতিটি কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে পরামর্শ গ্রহণের ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন, وشاورهم فى الامر فاذا عزمت فتوكل على الله ان الله يحب المتوكلين
এবং কাজে কর্মে তাদের সাথে আল্লাহর উপর ভরসা করুন। যারা (আল্লাহর উপর) ভরসা রাখে আল্লাহ্ তাদেরকে ভালোবাসেন। [সূরা আল-ই ইমরান, আয়াত-১৫৯]

পরামর্শ ভিত্তিক কাজ করা মু’মিনের বৈশিষ্ট্য
যে কোন কাজের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টির একটি দিক হলো পরামর্শ দেয়া বা নেয়া।
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে- ما اسعد احد برأيه وماشقى احد عن مشورة অর্থ: নিজের একক সিদ্ধান্তে কেউ সফল হয়নি আর পরামর্শ করে কেউ কখনো বিফল হয়নি। [জামে সগীর: ২/৩১]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত মুআয ইবনে জাবল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে ইয়ামেনের বিচারক হিসেবে প্রেরণের সময় নির্দেশ করেছেন-استشر فان المستشير معان والمستشارمؤتمن পরামর্শ করে কাজ করুন। কারণ পরামর্শকারী আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত হয়। আর যার পরামর্শ গ্রহণ করা হয় সে এ ব্যাপারে যিম্মাদার। [জামেউল আহাদীস, হাদীস নং-৮৮৪০]

পরামর্শ করা নবীজির সুন্নাত
রাসূলূল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করতেন, সাহাবীদেরকেও পরামর্শ গ্রহণের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। পরামর্শ না করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো জ্ঞান ও প্রজ্ঞা আল্লাহ্ তা‘আলা নবীজিকে দান করেছিলেন, তা সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শ না করে তিনি সিদ্ধান্ত নিতেন না। পরামর্শ ছাড়া আমীর নিযুক্ত করা যাবে না।
পারস্পরিক মতামত ও পরামর্শ উপেক্ষা করে আমীর বা নেতা দাবী করা ইসলাম সম্মত নয়। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
يقول رسول الله صلى الله عليه وسلم من بايع اميرًا عن غير مشورة المسلمين فلا بيعة ولا الذى بايعه [مسند احمد]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মুসলমানের পরামর্শ ছাড়া আমীর হিসেবে বায়আত নিল তার বায়আত বৈধ হবে না। আর যারা তার নেতৃত্বের বায়আত গ্রহণ করবে, তাদের বায়আতও বৈধ হবে না। [মুসনাদে আহমদ]

তিনটি গুণ কল্যাণকর, তিনটি দোষ ক্ষতিকর
عن ابى هريرة رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا كان اُمراؤكم خياركم واغنياؤكم سمحاؤكم وامركم شورٰى بينكم فظهر الارض خيرلكم من بطنها ـ واذا كان امرأؤكم شراركم واغنياؤكم بخلاؤكم وامركم الى نساء كم فبطن الارض خيرلكم من ظهرها ـ [رواه الترمذى]
হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘‘তোমাদের শাসকগণ যখন নেককার হবে, তোমাদের সম্পদশালীরা দানশীল হবে এবং তোমরা পরস্পর পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করবে, জমীনের পেটের তুলনায় পিটই তোমাদের জন্য উত্তম হবে। অর্থাৎ মৃত্যুর চেয়ে জীবনে বেঁচে থাকাটা কল্যাণকর হবে।
আর যখন তোমাদের শাসকরা মন্দ ও দুষ্ট প্রকৃতির হবে তোমাদের সম্পদশালীরা কৃপণ হয়ে যাবে আর পুরুষরা নারীদের পরামর্শে কাজ করবে তখন তোমাদের জন্য জমীনের পিট অপেক্ষা পেটই উত্তম হবে। অর্থাৎ বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু বরণ করাই ভালো। [তিরমিযী: ২২৬৬]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের জীবনে পরামর্শ গ্রহণের দৃষ্টান্ত
১. নামাযের জন্য ‘আযান’ প্রবর্তনের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাহাবাগণের পরামর্শ নিয়েছিলেন। [বুখারী, আযান অধ্যায়]
২. বদর যুদ্ধ প্রসঙ্গে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাহাবগণের পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন, এ প্রসঙ্গে ইবনে ইসহাক, ওয়াকিদী, ইমাম বুখারী ও ইমাম তাবারী বলেন, মুহাজিরদের পক্ষ থেকে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এবং মিকদাদ ইবনে আমর আল-খুযাই নবীজির পরিকল্পনা সমর্থন করেন। আনসারদের মধ্যে হযরত সাদ ইবনে আওস, সাদ ইবনে ওবাদাহ্, হুবাব ইবনে আল মুনযির পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। যুদ্ধ শেষে যুদ্ধবন্দীদের বিষয়টি নিষ্পন্ন করার প্রশ্নে নবীজি পুনরায় সাহাবাদের পরামর্শ গ্রহণ করেন।
হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর পরামর্শ ছিল, মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদেরকে মুক্তি দেয়ার। হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর পরামর্শ ছিল তাদেরকে হত্যা করার, এ ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর পরামর্শ গ্রহণ করেন। [তাবারী, ২য় খন্ড, পৃ.৪৪৭]
৩. উহুদ যুদ্ধের বিষয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মদীনা নগরীর অভ্যন্তরে থেকেই আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ পরিচালনার পক্ষে দৃঢ় মত পোষণ করলেও সাহাবাদের সাথে পরামর্শ করেছেন। যাদের মধ্যে অধিক সংখ্যক যুবক ও প্রবীণ অতি উৎসাহী হয়ে শত্রুদের সাথে উন্মুক্ত ময়দানে মুকাবিলা করার মত প্রকাশ করেন। ওয়াকিদীর বর্ণনা মতে অতি উৎসাহীগণের মধ্যে ছিলেন, হযরত হামযাহ্ বিন আবদুল মুত্তালিব, সাদ ইবনে ওবাদাহ্, নুমান ইবনে মালিক, মালিক ইবনে সিনান, আয়াস ইবনে আওস, খায়সামাহ্ ইবনে আল-হারিস, আনাস ইবনে কাতাদাহ্ প্রমুখ।
৪. আহযাব যুদ্ধের সময় হযরত সালমান ফারসী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নগরীর চতুর্পার্শ্বে খন্দক (পরিখা) খননের পরামর্শ দিয়েছিলেন।
[ইবনে ইসহাক, পৃ. ৪৪৫]
৫. হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর পরামর্শক্রমে হুদায়বিয়া অভিযানকালে মক্কাবাসীদের নিকট হযরত উসমান ইবনে আফ্ফান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দূত হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন।
[সিরতে ইবনে হিশাম, খ–২, পৃ. ৩১৫]
৬. রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মদীনা মুনাওয়ারাহতে পরামর্শের ভিত্তিতেই মসজিদে নববীর স্থান নির্ধারিত করেছিলেন। [ইবনে ইসহাক, পৃ. ২৩৪]
এভাবে বিভিন্ন বিষয়ে ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনায় নবীজি, তাঁর প্রিয় সাহাবাদের সাথে পরামর্শ করতেন। এটাই সুন্নাহ সম্মত অনুসৃত নীতি। ইসলামের আদর্শ ও মহান শিক্ষা। মহান আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদেরকে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: অধ্যক্ষ, মাদ্রাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া ফাযিল (ডিগ্রি), বন্দর, চট্টগ্রাম।