আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অন্যতম নিদর্শন তাক্বওয়া ও ক্রন্দন

আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অন্যতম নিদর্শন তাক্বওয়া ও ক্রন্দন

মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ জসিম উদ্দিন আবিদী>
গত সংখ্যার পর>

হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালামের ক্রন্দন
হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম আল্লাহ তাআলার ভয়ে দিবা-রাত্রি সর্বদা কাঁদতেন। আর যখন নামাযে দাড়াতেন তখন আল্লাহর ভয়ে তাঁর অন্তরে এমন উত্তাল তরঙ্গের সৃষ্টি হতো এর শব্দ এক মাইল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তো। একদা হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম বাণী নিয়ে আসলেন, আল্লাহ তাআ’লা এরশাদ ফরমান হে ইব্রাহীম! এরূপ করছ কেন? তুমি কী কোথাও কী শুনেছ বন্ধু বন্ধুকে আগুনে জ্বালাতে? তিনি বললেন, হে জিব্রাঈল! নিজের অবস্থার দিকে যখন তাকাই তখন সব বন্ধুত্বের কথা ভুলে যাই।

হুযুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র ক্রন্দন
হুযুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এমন মর্যাদার অধিকারী যাঁর নিস্পাপের অলংকার দ্বারা আসমান-যমীন সৃজন করা হয়েছে এবং উভয় জাহানের রাজত্বের খুৎবা তাঁরই পবিত্র নামে পঠিত হয়েছে। এতদ সত্বেও তিনি আল্লাহ তাআলাকে এমন ভাবে ভয় করতেন, যদি এর কিঞ্চিত পরিমাণ এ জগতে চমকানো হতো কারো অন্তরে খুশী ও আনন্দের লেশমাত্রও থাকতোনা। তিনি (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) প্রতিদিন সত্তর অথবা একশতবার সাজদায় আল্লাহ তাআলার নিকট মাথা অবনত করতেন এবং ন¤্রতা ও উৎসর্গের নিমিত্তে ইস্তিগফার করতেন।
প্রিয় পাঠক! আম্বিয়ায়ে কেরাম আলায়হিমাস্ সালাম ও আউলিয়ায়ে ইযাম রাহমাতুল্লাহি আলায়হিম আল্লাহ ভীতির অবস্থার কথা আপনারা শুনেছেন। আপনাদের ত্রুটি ও পাপাচারের এ ভয়াবহ পরিস্থিতি হওয়া সত্বেও কিভাবে দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে মহাপরাক্রমশালীর নাফরমানী করছে এবং তাঁর রাগ ও শাস্তি নিয়ে কোন চিন্তা ভাবনা করছে না। আপনার ত্রিশ বছর অতিক্রম হয়ে গেছে, কিন্তু পরকালের কোন চিন্তাই নেই। সময়তো এটা এসেছে, ওযুর মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করে পরিপূর্ণ অক্ষমতা প্রকাশ করে স্বীয় মালিকের নিকট প্রার্থনা করার, হে মাবুদ! আপনিতো অতি ক্ষমাশীল, আর আমিতো গোনাহগার, গোনাহগারদের ঠিকানা আপনার দ্বার ব্যাতীত আর কোথা হতে পারে? মাবুদ! এ অপরাধী আপনার দরবারে এসে পড়েছে। তাকে বঞ্চিত করোনা। যদি আপনি তাকে বঞ্চিত করেন, তখন তার আশ্রয় আর কোথাও থাকবেনা। [আলকালামুল আওযাহ ফী তাফসীরে সুরা আলাম নাশারাহ,কৃত আল্লামা নাক্বী আলী খাঁ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি পৃ.১৬৭-১৬৯ পৃ. পর্যন্ত]

এছাড়াও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী সত্বাগত নিষ্পাপ হওয়া সত্বেও সারা রাত জাগ্রত অবস্থায় আল্লাহ তাআলার দরবারে ইবাদত ও ক্রন্দনরত অবস্থায় অতিবাহিত করতেন। সহীহ বুখারী শরীফে হাদীস শরীফ বর্ণিত রয়েছে, হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা হুযুর কারীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র এ অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ ফরমান- افلا اكون عبدا شكورا -صحيح البخاري
অর্থ:- আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দাহ হবনা? অর্থাৎ আমি নিষ্পাপ হলেও আল্লাহ তাআ’লা আমাকে যে নিয়ামতের অধিকারী করেছেন আমি এর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে। আমি সারারাত এভাবে অতিবাহিত করে থাকি কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে ও আমার উম্মতের গোনাহ ক্ষমা করানোর উদ্দেশে।
আল্লামা শরফুদ্দিন বুছিরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর ক্বাছীদায়ে বুরদা শরীফের ৩য় পরিচ্ছেদ’র প্রথম দিকে উল্লেখ করেন-
ظلمت سنة من احي الظلام إلى
أن اشتكت قدماه الضر من ورم
অর্থ: “হুযুর কারীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র সুন্নাত ছেড়ে আমি নিজের উপর অত্যাচার করেছি। যিনি ইবাদতের মাধ্যমে জাগ্রতাবস্থায় রাত অতিবাহিত করেছে এমন কি তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) দু পা মোবারক ফুলে যেত।”
তিনি আরো বলেন-
وشد من سغب أحشاء وطوى؛
تحت الحجارة كشحا شرف الادم
অর্থ:- ক্ষুধার তাড়নায় তিনি পেটে পাথর বেঁধেছেন, অতি ন¤্র ও সুক্ষাতিসূক্ষ বিশিষ্ট দেহ মোবারকের অধিকারী হওয়া সত্বেও পাথরের নিচে শয়ন করতেন”। [ক্বাসীদায়ে বুরদা, কৃত : আল্লামা শরফুদ্দিন বুছিরী রহ.]
এর দ্বারা সুষ্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি এত মর্যাদার অধিকারী হওয়া সত্বেও আল্লাহ তাআ’লার ভয় ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনার্থে কী ধরনের কষ্ট স্বীকার করে ইবাদত ও রিয়াযত করেছেন। আর আমরা সারাক্ষণ গোনাহে লিপ্ত হয়েও আরাম আয়েশের জীবন যাপন করছি। বিন্দুমাত্র খোদা ভীতি আমাদের অন্তরে স্থান দিতে পারছিনা। আল্লামা নাক্বী আলী খাঁ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর প্রাগুক্ত কিতাবে নবী রাসূল আলায়হিমুস্ সালাম ছাড়াও আল্লাহর প্রিয় বান্দাহদের তাক্বওয়া ও ক্রন্দনের চিত্র তুলে ধরে আরো অনেকের অবস্থা বর্ণনা করেছেন। যেমন-

হযরত আবূ বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র ক্রন্দন
হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এত মর্যাদা ও নৈকট্য অর্জনের পরও বলে থাকতেন, হায়! দুনিয়াতে যদি আবু বকরের নাম ও চিহ্ন না হত কতইনা উত্তম হত। তিনি আরো বলতেন, হে মানুষ! আল্লাহ তাআলার দরবারে ক্রন্দন করতে থাক। যদি ক্রন্দন না আসে জোর পূর্বক অন্তরকে ক্রন্দন করায় মনোনিবেশ কর। এক রাতে তিনি নামাযে কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত করছিলেন, যখন এ আয়াত পর্যন্ত পৌঁছলেন-
إن الله اشترى من المؤمنين أنفسهم وأموالهم بإن لهم الجنة-(التوبة “নিশ্চয় আল্লাহ মুসলমানদের নিকট থেকে তাদের সম্পদ ও জীবন ক্রয় করে নিয়েছেন এ বিনিময়ের উপর যে, তাদের জন্য জান্নাত রয়েছে”। [সূরা তাওবা ১১১,কানযুল ঈমান]
তখন তিনি এমন ভাবে ক্রন্দন করলেন এ দিকে ফযর হয়ে গেল। অন্যদিকে চোখে অশ্রুজল প্রবাহিত ছিল। কেউ জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এভাবে ক্রন্দন করছেন কেন? তিনি বলেন, বেহেশত আমাদের প্রাণ ও সম্পদের বিনিময়ে। হতেও পারে ক্বিয়ামতের দিন পরোয়ার দিগার এ অযোগ্যকে যার মধ্যে হাজারো ত্রুটি ও স্বল্পতা রয়েছে। যার কারণে বেহেশত ফেরৎ ও নিতে পারেন। তা ছাড়া ক্রয়কৃত বস্তুর পরিপূর্ণ মূল্য পরিশোধের পরও যদি কৃপা না হয়, তাহলে তাঁর কী ক্ষতি হতে পারে?

হযরত ওমর ফারূক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র ক্রন্দন
হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শানে প্রিয়নবী এরশাদ ফরমান- لو كان بعدى نبى لكان عمر نبيا-(الحديث অর্থাৎ: আমার পর যদি কেউ নবী হত, অবশ্যই ওমর নবী হত। এ ধরণের মর্যাদার অধিকারী হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু কুরআন মজীদের তেলওয়াত শ্রবণ করে অধিকাংশ সময় বেহুশ হয়ে পড়তেন। লোক তাঁর সেবার জন্য আসতেন। অধিক ক্রন্দনের ফলে তাঁর মুখমন্ডলের দু পাশে অশ্রুজলের কালো দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিনি অধিকাংশ সময় এ কথা বলতেন ‘যদি ওমর সৃষ্টি না হত”। একদা তিনি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন কেউ কুরআন মজীদের আয়াত- إن عذاب ربك لواقع-(الطور:٧ অর্থ:“নিশ্চয় তোমার প্রতিপালকের শাস্তি অবশ্যম্ভাবী”। [সুরা তুর : ৭, কানযুল ঈমান]
আয়াতখানা তেলওয়াত করছিলেন, তখন তিনি খচ্ছরের পিঠ থেকে পড়ে দেয়ালের সাথে আঘাত পেয়ে বেহুশ হয়ে গেলেন।

হযরত মনছূর বিন মাখরামা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র ক্রন্দন
হযরত মনছুর বিন মাখারামা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র কুরআন মাজীদ শ্রবণের শক্তি ছিলনা। একদা কেউ কুরআন মাজীদের আয়াত- يوم نحشر المتقين إلى الرحمن وفدا ونسوق المجرمين إلى جهنم وردا-(مريم:٨٦ অর্থ: “যেদিন আমি খোদাভীরুদেরকে পরম দয়াময়ের প্রতি নিয়ে যাবো মেহমান বানিয়ে এবং অপরাধীদেরকে জাহান্নামের দিকে খেদিয়ে নিয়ে যাবো তৃষ্ণাতুর অবস্থায়”। [সুরা মারয়াম : ৮৬,কানযুল ঈমান]
আয়াতখানা যখন কেউ তেলওয়াত করছিলেন, এটি শুনে ক্রন্দন করে তিনি বলেন, আমি মুত্তাক্বী বা আল্লাহভীরু নই, বরং আমি মুজরিম বা অপরাধী। এ আয়াতটি পুনরায় আমাকে একটু শোনান। ওই ব্যক্তি আবার শুনালেন, তখন তিনি বিকট চিৎকার মেরে মৃত্যু বরণ করলেন।

হযরত আত্বা ছালামী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র ক্রন্দন
হযরত আ’ত্বা ছালামী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু আল্লাহ তাআ’লার ভয়ে চল্লিশ বছর আসমানের দিকে তাকাননি। একদা তাঁর দৃষ্টি উপরের দিকে নিপতিত হলো। মুহুর্তের মধ্যেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। তখন তিনি বলেন,আগুন জ্বালিয়ে যদি আহ্বান করা হয় যে ব্যক্তি এ অগ্নিকুন্ডে পতিত হয়,সে সর্বকালের জন্য ধ্বংস হয়ে যাবে এবং রোয ক্বিয়ামতে হিসাব-নিকাশ থেকে পরিত্রাণ পাবে। আল্লাহর শপথ আমি এত আনন্দিত হব যে, আগুনে ঝাপ দেয়ার পূর্বেই মৃত্যুর আনন্দে উদ্বেলিত হব। [আলকালামুল, আওযাহ, কৃত: আল্লামা নাক্বী আলী খাঁ ব্রেলভী[
এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর মাওলানা আব্দুল গণি তারেক লিখিত صالحین کے آنسو (ছালিহীন কে আছুঁ) নামক একটি গ্রন্থ রয়েছে যাতে আল্লাহর প্রিয় বান্দাহদের খোদাভীতি ও অশ্রুজল বিসর্জনের অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। উক্ত গ্রন্থের ১৩ নং পৃষ্ঠায় রয়েছে-

ইমাম আযম হযরত ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র ক্রন্দন
আল্লামা ইবনে হাজর মক্কী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ত্রিশ অথবা চল্লিশ বছর পর্যন্ত ইশার ওযু দিয়ে ফযরের নামায আদায় এবং এক রাকাআতে কুরআন খতম করতেন বিপুল পরিমাণ বর্ণনাকারীর বর্ণনা দ্বারা সাব্যস্ত। তিনি নামাযে এভাবে ক্রন্দন করতেন, এতে তাঁর প্রতিবেশীর করুণা এসে যেত।
[আলখায়রাতুল হিসান,কৃত: আল্লামা ইবনে হাজর মাক্কী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, পৃ.৫০ ও মানাক্বিবু আবিহানিফা, কৃত: আল্লামা যাহাবী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, পৃ.২১-২৩]
মুহাদ্দিস ফুদাইল বিন দাকীন রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বর্ণনা করেন, আমি তাবেঈনদের মাঝে ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলায়হির চেয়ে উত্তম নামায আদায়কারী আর কাউকে দেখিনি। তিনি নামায শুরুর প্রারম্ভে ক্রন্দন করে প্রার্থনা করতেন। আহ্বানকারী আহ্বান করতেন আল্লাহর শপথ, এটি আল্লাহ ভীতির কারণে। অধিক পরিমাণ ইবাদতের কারণে তাঁকে দেখতে পুরাতন মশকের ন্যায় মনে হত।
[আল খায়রাতুল হিসান, পৃষ্ঠা নং৫১]
একরাতে ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কুরআন মাজীদের আয়াত- بل الساعة موعدهم والساعة أدهى وأمر-القمر:(٤٦ অর্থ:-‘‘বরং তাদের প্রতিশ্রুতি ক্বিয়ামতের উপরই এবং ক্বিয়ামত অতি কঠিন ও অত্যন্ত তিক্ত”। [সুরা ক্বামার: ৪৬, কানযুল ঈমান]
আয়াতখানা পাঠ করত: ক্রন্দন করছিলেন। [আল খায়রাতুল হিসান, পৃ.-৫১]
ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এক রাত কুরআন মজীদের আয়াত – فمن الله علينا وقنا عذاب السموم-(الطور:٢٧ অর্থ: অতঃপর আল্লাহ আমাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাদের কে ‘লু’ এর অর্থ জাহান্নামের আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করেছেন”। [সূরা তুর:২৭,কানযুল ঈমান]
এ পর্যন্ত পেীঁছলে এটা বারংবার তেলাওয়াত করতে থাকেন এবং কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এক পর্যায়ে ফযরের আযান হয়ে গেল।
[আল খায়রাতুল হিসান পৃ.নং:৫১ ও মানাক্বিবু আবি হানিফা পৃ. নং:-২২]
এক ব্যক্তি বর্ণনা করেন, আমি ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলায়হির নিকট ছিলাম। তিনি যখন রাতের নামায আদায় করছিলেন তাঁর অশ্রুজল নামাযের চাটাইয়ে পড়ার শব্দ আমি শুনেছি। মনে হচ্ছিল বৃষ্টি পড়ছে। তাঁর ক্রন্দনের চিহ্ন স্বীয় চোখ ও মুখমন্ডলে পরিলক্ষিত হত। আল্লাহ তাআ’লা তাঁর উপর করুণাময় ও সন্তুষ্ট হোক। [আল খায়রাতুল হিসান, পৃ.নং ৫৪]
আল্লামা ইবনে হাজার মক্বী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বর্ণনা করেন, ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি যখন শেষবার হজ্জ পালন করলেন, তখন কা’বা শরীফের খাদেমকে তাঁর অর্ধেক সম্পদ দান করলেন। যাতে তাঁকে কা’বা শরীফের অভ্যন্তরে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হয়। অনুমতি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে এক পায়ের উপর ভর করে কুরআন মাজীদের অর্ধেক, অন্য একপায়ের উপর দাড়িয়ে বাকী অর্ধেকের খতম আদায় করেন। অতঃপর ক্রন্দনাবস্থায় এ প্রার্থনা করেন, হে পালনকর্তা! আপনার পরিচিতি যতটুকু আমার পক্ষে সম্ভব অর্জন করেছি। তবে আপনার ইবাদত যথাযথ করতে পারিনি। ইবাদতের যে স্বল্পতা রয়েছে তা আমার অর্জিত মারেফাত দ্বারা পরিপূর্ণ করে দেন। কা’বা শরীফের এক কোণা থেকে শব্দ ভেসে এলো “তুমি মারেফাত যেমনি উত্তমরুপে অর্জন করেছ,তেমনিভাবে ইবাদতের হক্ব ও আদায় করেছ উত্তম পন্থায়। আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত যারা তোমার মাযহাবের উপর জীবন পরিচালনা করবে তাদেরও ক্ষমা করে দিয়েছি। [আলখায়রাতুল হিসান পৃ.নং ৫৪]

হযরত আইয়ূব ছাখতিয়ানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র ক্রন্দন
ছাঈদ বিন আমির রাহমাতুল্লাহি আলায়হি হযরত ছালমান রাহমাতুল্লাহি আলায়হি থেকে বর্ণনা করেন, হযরত আইয়ুব ছাখতিয়ানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি আল্লাহ ভীতির কারণে সারারাত ইবাদতে মাশগুল থাকতেন এবং মহান আল্লাহর পবিত্র দরবারে কান্নাকাটি করতেন। রাতে কান্নার শব্দ নিম্ন পর্যায়ে রাখতেন, যাতে রাত জাগরণের কথা কেউ জানতে না পারে। ফযরের সময় হলে শব্দ উঁচু করতেন,যাতে মানুষ বুঝে তিনি এখনই জাগ্রত হয়েছেন।
[হুলয়াতুল আউলিয়া, খন্ড নং-৩, পৃ.নং-৮]
এমনিভাবে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য প্রাপ্ত প্রিয় বান্দাহগণ সর্বদা আল্লাহ ভীতিতে বিভোর থাকতেন এবং তাঁর দরবারে আহজারি করতেন। আল্লাহ তাআ’লার নিকট প্রিয় তাঁর বান্দাহদের অশ্রুজল। সেজন্য হাদীস শরীফে উম্মতদের অধিকহারে ক্রন্দনের নির্দেশ প্রদান করেছেন প্রিয়নবী। যদি কান্না না আসে অন্তত কান্নার ভান করার কথা বলা হয়েছে। হুযুর কারীম ইরশাদ ফরমান- إن الدموع تطففى غضب الرب-(الحديث
অর্থ: নিশ্চয় চোখের পানি পালনকর্তার রাগ প্রশমিত করে”। [আলহদীস]
বুঝা গেল আল্লাহ তাআ’লার রাগ ও গযব থেকে মুক্তি প্রাপ্তির জন্য বান্দাহর এক ফোটা চোখের পানিই যথেষ্ট। এর বাস্তবতা উপলব্দি করতে পেরে আল্লাহর প্রিয় বান্দাহগণ সর্বদা তাঁর দরবারে কাঁদতেন।
প্রায় সকল অলিআল্লাহর পবিত্র জীবনে এ চিত্র প্রস্ফুটিত হয়েছে। তাঁরা সর্বদা আল্লাহ তাআ’লার ইবাদত ও রিয়াযতে মাশগুল থাকতেন এবং ক্রন্দন করতেন। তাঁদের জীবন থেকে মুত্তাক্বী পরহেযগার হবার অনেক শিক্ষণীয় দিক রয়েছে। যেটিকে সম্বল করে আমাদের জীবন পরিচালনা করলে আমরা অবশ্যই সফলকাম হতে পারি। যেদিকে আমরা সাধরণত: ভ্রুক্ষেপ করিনা।
আ’লা হযরত ইমামে আহলে সুন্নাত শাহ ইমাম আহমদ রযা খাঁ ফাযেলে ব্রেলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর হাদায়েক্বে বখশীশ নামক কাব্য গ্রন্থের ৫২ নম্বর পৃষ্ঠায় চমৎকার বলেছেন-
رزق خدا کھایا کیا فرمان حق ٹالا کیا؛
شکر کرم ترس سزا یہ بھی نہیں وہ بھی نہی
-)حدائق بخشش(
অর্থঃ- “আল্লাহ তাআ’লা প্রদত্ত রিযিক খেয়ে তাঁর হুকুম অমান্য করল, নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা আর শাস্তির ভয় এটাও হলোনা” ওটাও হলোনা। [হাদায়েকে বখশীশ]
প্রখ্যাত ইসলামী দার্শনিক ড. আল্লামা ইকবাল তাঁর রচিত (শেকওয়া এবং জওয়াবে শেকওয়ায়) বলেছেন-
قلب میں سوز نہیں روح میں احساس نہیں؛
کچہ بھی پیغام محمد کا تمھی پاس نہیں
অর্থ: “রুহে নাহি অনুভুতি, অন্তরে না জ্বালা আছে? মুহম্মদের (সাল্লাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) পয়গামের ও মর্যাদা নাই তোদের কাছে।”
আফসোস! মুসলমানদের করুণ চিত্র আজ এটাই। যা মুসলমান জাতির কান্ডারী ড. আল্লামা ইকবাল অনেক পূর্বেই সতর্ক করে দিয়েছেন। সাথে সাথে মুসলমানদের এ করুণ পরিস্থিতির কারণ উল্লেখ করে প্রাগুক্ত পুস্তিকায় উল্লেখ করেন-
وہ زمانے میں معزز تھے مسلماں ہو کر
؛اور تم خوار ہوۓ تارک قرآں ہو کر
অর্থ: “মুসলমানী নিয়ে তারা মুখ্য ছিল ধরা তলে, আর তোমরা কুরআন ছেড়ে যাচ্ছ আজ রসাতলে”।
এ দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালে আমাদের বুঝার বাকি থাকেনা তখনকার মুসলমানরা মান-মর্যাদার অধিকারী ছিলেন কুরআন মাজীদকে বুকে ধারণ করার কারনে আল্লাহ ভীতি অর্জন ও বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী হুযুর আকরাম’র আদর্শের প্রকৃত অনুসারী হয়ে। আজ মুসলমানরা অবহেলিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, পদদলিত, ও অপমানিত হচ্ছে সে আদর্শ থেকে সরে যাবার কারণে। এটাই বর্তমান মুসলিম বিশ্বের করুণ পরিস্থিতির মূল কারণ। আমরা যদি বর্তমানে ফিলিস্তিন, ইরাক, ইয়েমেন, সিরিয়া, আফগানিস্তান, ভারত ও মায়ানমারের দিকে তাকাই এ চিত্র আমাদের সম্মুখে প্রস্ফুটিত হবে। এহেন দুর্যোগপূর্ণ করুণ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সে স্বর্ণালী যুগের হারানো ঐতিহ্য ও আদর্শের দিকে ফিরে যেতে হবে। তা হলে সে পূর্বের মান-মর্যাদা, শক্তি ও ক্ষমতা আমাদের নিকট ফিরে আসবে।
আল্লাহ তাআ’লা তাঁর প্রিয় বান্দাহদের খোদাভীতি, ক্রন্দন ও অশ্রুজল বিসর্জন, ঈমানী জযবা, একাগ্রচিত্ততা ও আদর্শের অনুসরণ করত: তাঁদের মতে পথে জীবন গঠন করে সফলতা অর্জনের তাওফীক্ব আমাদের দান করেন। আমীন, বিহুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালীন।

উপাধ্যক্ষ, বেতাগী রহমানিয়া জামেউল উলুম সিনিয়র মাদরাসা, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।