ফিলিস্তিনে ফের ইসরায়েলি বর্বরতা মুসলিম বিশ্বের প্রশ্নবিদ্ধ নিষ্ক্রিয়তা
আবসার মাহফুজ>
স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের আকস্মিক হামলার প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েলের মুহুর্মুহু জঙ্গিবিমান হামলায় পুরোপুরি বিধ্বস্ত ও মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে ফিলিস্তিনিদের গাজা উপত্যকা। পুরো গাজাকে অবরুদ্ধ করেও রাখা হয়েছে। এতে গাজা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কারাগরে পরিণত হয়েছে। খাদ্যসহ যাবতীয় বস্তু সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ায় সেখানে দেখা দিয়েছে চরম মানবিক সংকট। এ পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনিদের অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডটির লাখ লাখ মানুষের ঘুমানোর কোনও জায়গা নেই বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (আইসিআরসি)। ১৩ অক্টোবর ২০২৩, এই নিবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত ইসরায়েলি বিমান হামলায় আড়াই হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে ৮ শতাধিক শিশু। ইসরায়েল অবরোধে খাবার, সুপেয় পানি ও জ্বালানির সঙ্কটও তীব্রতর হওয়ায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার কথা বলেছে জাতিসংঘ। জ্বালানি সঙ্কটে গাজার একমাত্র বিদ্যুৎকেন্দ্রও বন্ধ হয়ে গেছে। বন্দীদের মুক্তি না দেয়া পর্যন্ত গাজার ওপর অবরোধ আরোপ রাখা হবে বলে জানিয়েছে ইসরায়েল। তা ছাড়া গাজা সীমান্তের কাছে সাড়ে চার লাখ সেনা জড়ো করেছে ইসরায়েল। গাজায় সাঁড়াশি অভিযানের জন্য তারা সাধারণ মানুষদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গাজা ছাড়ার আল্টিমেটাম দিয়েছে। আবার গাজা ছেড়ে যাওয়া নিরীহ মানুষদের ওপর চালাচ্ছে বোমা হামলা। এমন আচরণ যুদ্ধাপরাধের সামিল হলেও ইসরায়েলকে সহায়তার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারি অস্ত্রসহ একটি নৌবহর পাঠিয়েছে, যুক্তরাজ্যও ইসরায়েলকে সহায়তায় অস্ত্রভর্তি জাহাজ ও গুপ্তচর বিমান পাঠিয়েছে। তবে প্রতিরোধ আন্দোলনরত হামাস বলেছে, তারা এতে ভয় পায় না। পশ্চিমাবিশ্ব ‘মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া’ খ্যাত অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েলের পাশে থেকে তার মানবতাবিরোধী কুকর্মকে সমর্থন দিয়ে গেলেও ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় ইরান এবং তুরস্ক ছাড়া মুসলিমবিশ্বের ন্যাক্কারজনক নীরবতা লক্ষ করা যাচ্ছে। জাতিসংঘেরও নেই কোনো ইতিবাচক ভূমিকা। এতে নীরিহ ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েল আরো বেপরোয়া হয়ে উঠার সাহস পাচ্ছে। এটি দুঃখজনক।
উল্লেখ্য, বর্তমান সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত-নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর নাম ‘ফিলিস্তিনি’। ফিলিস্তিনিরা আজ নিজ দেশেই পরবাসী। জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের দমন-নিপীড়ন ও গণহত্যার শিকার ফিলিস্তিনিরা প্রাণ বাঁচাতে আজ নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে দেশে দেশে উদ্বাস্তু জীবন বেছে নিয়েছে। একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্যে সুদীর্ঘ ৭৫ বছর অপেক্ষা করেও তারা পায়নি তাদের স্বপ্নের দেশ। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর সহায়তায় ইসরায়েল দখল করে আছে পুরো ফিলিস্তিন। দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূমিতে তারা সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে একের পর এক ইহুদি বসতি নির্মাণ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদিদের এনে পুনর্বাসন করে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের ফসল ও ফলবান বৃক্ষ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। গাজা ও পশ্চিম তীরসহ বিভিন্ন এলাকায় নানা ছুঁতোয় আরোপ করছে অর্থনৈতিক অবরোধ। অবরোধের কারণে খাদ্য ও ঔষধের অভাবে প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে শত শত ফিলিস্তিনি শিশু ও বয়স্ক মানুষ। একের পর এক বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে অসহায় ফিলিস্তিনিদের বাড়ি-ঘর। ইসরায়েলি সৈন্যদের বুলেটবিদ্ধ হয়ে প্রতিদিনই মারা যাচ্ছেন শত শত ফিলিস্তিনি। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সকল আইনে ইসরায়েলের এই তৎপরতা চরম অপরাধ হিসেবে গণ্য। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অসহায় নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় কেউই এগিয়ে আসছে না। মুসলমানদের আন্তর্জাতিক সংস্থা ওআইসিসহ কোনো মুসলিম সংগঠন ও দেশও ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। এটি মানব-মর্যাদা ও মানব-সভ্যতার জন্যে চরম অবমাননাকরই বলতে হয়।
এমন পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনিদের মুক্তিকামী গেরিলা সংগঠন গাজার হামাস বাহিনীর বিশেষ শাখা ‘অভিজাত নুখবা ফোর্স’ জীবন বাজি রেখে গত ৭ অক্টোবর কাঁটা তারের বেড়া ভেঙ্গে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ঢুকে সেখানে সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। এ অপারেশনের নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’। হামাসের ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’-এর পরিকল্পনা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে করা হয়েছিল। ইসরায়েলে তাদের এই আক্রমণের তারিখ যুক্ত ছিল দুটি বিষয়ের সঙ্গে। প্রথমত, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তাঁর ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্য’ মানচিত্র তুলে ধরেছিলেন। সেখানে তিনি ফিলিস্তিনকে সম্পূর্ণরূপে বাদ দেন এবং এ বিষয়ে জাতিসংঘের প্রতিটি প্রস্তাবকে উপহাস করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, জেরুজালেমের পবিত্র আল-আকসা মসজিদে ধারাবাহিক উস্কানি। এর মধ্যে সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি হলো, ‘আল-আকসা ফ্লাড’-এর দু’দিন আগে অর্থাৎ ৫ অক্টোবর অন্তত ৮০০ ইসরায়েল সেটলার মসজিদটির চারপাশে আক্রমণ শুরু করে; সেখানে আসা মানুষদের মারধর করে; ফিলিস্তিনি দোকান ধ্বংস করে। এগুলো হয়েছে ইসরায়েল নিরাপত্তা বাহিনীর ইন্ধনে ও চোখের সামনেই। কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন প্রত্যেকেই জানেন, আল-আকসা সংবেদনশীল জায়গা। এটি ফিলিস্তিনিদের জন্য যেমন আবেগের স্থান, তেমনি সব আরব ও মুসলিম বিশ্বের জন্যও। কিন্তু ইসরায়েল বার বার নানা অজুহাতে ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করেছে এবং নিধনযজ্ঞ চালিয়েছে। তারা নারী ও শিশুদেরও নির্দয়ভাবে হত্যা করে চলেছে। যার কারণে ফিলিস্তিনিরা নিজেদের রক্ষায় বিভিন্ন সময় প্রতিরোধযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে। ইসরায়েলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্র হারেৎজ সরাসরি স্বীকার করেছে, ‘আসলে ফিলিস্তিনিদের অধিকার না দেওয়ার জন্য যা ঘটেছে (আল-আকসা ফ্লাড), তার জন্য ইসরায়েল সরকারই দায়ী।’
সর্বশেষ হামাস ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে আক্রমণাত্বক ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো। কারণ তাদের সামনে ‘ডু অর ডাই’ নীতি ছাড়া বিকল্প নেই। আর হামাসের এ ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’ এর নেতৃত্ব দেয় ‘নুখবা ফোর্স’। উল্লেখ্য, এই ফোর্সটির নাম এসেছে ‘আল-নুখবা’ শব্দ থেকে। আরবি ভাষায় যার অর্থ ‘অভিজাত’। এর কমান্ডাররা হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সুরক্ষায়ও কাজ করে। এই সংগঠনের প্রধান কাজ টানেলে অনুপ্রবেশসহ বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করা। তারা অ্যান্টি-ট্যাংক মিসাইল, রকেট ও স্নাইপার ব্যবহারে বিশেষজ্ঞ। ফোর্সটি হামাসের সামরিক শাখা ইজ আল-দিন আল-কাসেম ব্রিগেডের প্রধান যুদ্ধ ইউনিটের অংশ। ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর প্রকাশিত একটি বিবৃতি অনুযায়ী, ‘নুখবা এলিট বাহিনীর সদস্যরদর হামাসের ঊর্ধ্বতন অপারেটিভদের দ্বারা নির্বাচন করা হয়েছে। যাদের প্রধান কাজ অভিযান পরিচালনা, সুড়ঙ্গে অনুপ্রবেশ অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল চালানোসহ রকেট ও স্নাইপার ফায়ার পরিচালনা। ইসরায়েলের শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ভেদ করে ৭ অক্টোবর ভোরে ভয়াবহ অভিযান চালিয়েছে তারা। বিশ্বের কড়া নিরাপত্তার জাল ফাঁকি দিয়ে চালিয়েছে প্রতিশোধের অভিযান। সেদিন মাত্র ২০ মিনিটের পাঁচ হাজার রকেট হামলার তান্ডবে হতভম্ব হয়ে গেছে ইসরায়েলি বাহিনী। অধিকৃত ভূখণ্ড রক্ষায় গাজা সীমান্তে নির্মিত ‘আকাশচুম্বী’ নিরাপত্তা দেওয়ালও হার মানল হামাসের চৌকশ যোদ্ধাদের কাছে। অথচ অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি এ ‘গর্বের ধন’কে বিশ্বে ‘স্মার্ট বেড়া’র তকমা দিয়েছিল ইসরায়েল। সুড়ঙ্গ খুঁড়েও যেন কেউ ঢুকতে না পারে সেলক্ষ্যে সীমান্তে ৬৫ কিমি. দীর্ঘ ভূগর্ভস্থ কংক্রিটের দেওয়ালের ওপর ২০ ফুট উঁচু ধাতব বেড়া দিয়েছে ইসরায়েল। এখানেই শেষ নয়- দেওয়ালের মাথা থেকে পা পর্যন্ত অর্থাৎ সারা গায়ে পেঁচানো হয়েছে ধারালো কাঁটাতারের কুণ্ডলী। গাজায় হামাস বাহিনীর টানেল শনাক্তকরণে দেওয়ালের ভূগর্ভে বসানো হয় সেন্সর। আর দেওয়ালের উপরের অংশের ৮১% জায়াগাজুড়ে বসানো হয় শত শত ক্যামেরা, রাডার এবং সেন্সর। এককথায় ফিলিস্তিনিদের দখলকৃত ভূখণ্ড নিজেদের রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেনি দেশটির দখলদার বাহিনী। কিন্তু নিশ্চিন্ত নিরাপত্তার এই দেওয়ালই এখন বড় দুশ্চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে ইসরায়েলে। টানা সাড়ে তিন বছর ধরে ১৪ হাজার টন লোহা ও স্টিল দিয়ে নির্মাণ করা ১.১১ বিলিয়ন ডলারের দুর্ভেদ্য ‘লোহার দেওয়াল’ কিভাবে ভাঙল ছোট্ট হামাস দল? তা এখন গবেষণার বিষয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে, ইসরায়েলের কড়া ‘পাহারাবেড়া’ ভাঙার একটি মাধ্যম ছিল ড্রোন। বাণিজ্যিক ড্রোনগুলো হামাস পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, যোগাযোগ অবকাঠামো এবং অস্ত্র ব্যবস্থায় বোমাবর্ষণের কাজে ব্যবহার করেছে। ইসরায়েলের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাক ধ্বংস করার আরও একটি মাধ্যম ছিল রকেট। ফ্যানচালিত হ্যাং এবং প্যারা গ্লাইডারের মাধ্যমে ২০ মিনিটে ৫০০০ রকেট হামলা চালিয়েছে হামাস। এত দ্রুত সময়ে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা সেন্সরগুলো সব রকেট হামলাকে প্রতিহত করতে পারেনি। ফলে রকেটগুলো ইসরায়েলের তেল আবিব থেকে জেরুজালেম পর্যন্ত আঘাত হানে। অবরোধের কিছু অংশ উড়িয়ে দেওয়ার জন্যও বিস্ফোরক ব্যবহার করেছিল হামাস। এরপর মোটরবাইকে করে ফাঁকা দিয়ে হামাস বাহিনীর গাড়ি ভেতরে প্রবেশ করে। পরবর্তীতে বুলডোজার দিয়ে অবরোধের জায়গাকে আরও প্রশস্ত করে ভেতরে প্রবেশ করা হয়। ইসরায়েলের শীর্ষ ভূতাত্ত্বিক ইয়োসি ল্যাঙ্গোটস্কি বলেন, ‘বিশাল বেড়াটি হামাসের সজাগ দৃষ্টিতে নির্মিত হয়েছিল, যারা প্রতিটি কাজ দেখেছিল এবং পরীক্ষা করে দেখেছিল যে বাধাটি মাটিতে কত গভীরে নামানো হচ্ছে। এটা স্পষ্ট যে, তারা প্রকল্পটি অধ্যয়ন করছে এবং তাদের শুধু দরকার ছিল এ ফাঁদে একটি চতুর উপায় খুঁজে বের করা।’ ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ঢুকে হামাসের এ আকস্মিক হামলায় ৩০০ ইসরায়েল সৈন্য সহ প্রায় দেড় হাজার ইসরায়েল’র মৃত্যু হয়েছে। বন্দি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে আরো প্রায় ৪০০ জনকে। হামাসের এমন আকস্মিক আক্রমণের যের কয়েক লাখ ইসরায়েল দেশ ত্যাগ করার খবর এসেছে সংবাদ মাধ্যমে। ইসরায়েলের ঘরে ঘরে এখন ‘নুখবা ফোর্স’ আতঙ্ক। হামাসের দুঃসাহসী এই বাহিনী নিধনেই এখন গাজায় বেপরোয়া বিমান হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। গাজাজুড়ে হামাসকে লক্ষ্যবস্তু করে ‘বিস্তৃত স্থল আক্রমণও’ শুরু করেছে। এসব অভিযানে আন্তর্জাতিক বিধি লঙ্ঘন করে নিষিদ্ধ রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগও উঠেছে। হামাসের টানেলগুলো ধ্বংসেও ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে ইসরায়েল। দেশটির দাবি, ৭ অক্টোবরের হামলায় ‘নুখবা ফোর্স’ টানেলও ব্যবহার করেছিল। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) মুখপাত্র জোনাথন কনরিকাস বলেছেন, হামাস ২০০৭ খ্রিস্টব্দে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকেই গাজা শহর থেকে শুরু করে উপত্যকার অন্যান্য অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ টানেলের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। আর এই টানেলগুলো ব্যবহার করেই এখন নুখবা ফোর্সসহ হামাসের অন্যান্য ফোর্সগুলো হামলা চালাচ্ছে।
কনরিকাস আরও জানান, ‘এই টানেলগুলোই এখন ইসরায়েলের বিমান হামলার একটি বিশেষ অগ্রাধিকার। টানেলগুলো ব্যবহার করে হামলা চালানোর পাশাপাশি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পরিকল্পনা ও অপারেশন চালানোর জন্য ব্যবহার করা হয়।’ হামাসের জ্যেষ্ঠ কমান্ডোরা রয়েছেন এমন অবকাঠামো ও অবস্থানগুলোকে লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে আইডিএফ। উল্লেখ্য, পুরো গাজা উপত্যকায় হামাসের ৫০০ মাইলের সুড়ঙ্গ ফাঁদ রয়েছে। মুখে যাই বলুক, ভেতর ভেতর ইসরায়েলের বড় ভয় এই সুড়ঙ্গ (টনেল পথ)। দুর্ধর্ষ ইসরায়েল বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তেই বছরের পর বছর ধরে হামাস গাজায় সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক তৈরি ও সম্প্রসারণ করেছে। প্রায় একটি ভূগর্ভস্থ শহরের মতো গাজার এই টানেলগুলোর গল্প এতটাই মুখরোচক যে প্রতিবেশী দেশগুলোতে সুড়ঙ্গ পথের বদলে ‘শহরের নিচে আরেক শহর’ নামেই বেশি পরিচিত। বিচক্ষণ হামাস যোদ্ধারা শুরু থেকেই বুঝেছিলেন, অবরুদ্ধ গাজায় পশ্চিমা মদদপুষ্ট ইসরায়েলের সঙ্গে লড়তে হলে মাটির ওপরের পাশাপাশি মাটির নিচেও যোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে। আর এখন এটিই হয়ে উঠেছে তাদের বড় রণশক্তি। বেড়েছে কৌশলগত সুবিধাও। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হামাস এই মডেল উদ্ভাবন করেনি। এটি লেবাননের শিয়া ইসলামি রাজনৈতিক দল হিজবুল্লাহ থেকে আমদানি করা হয়েছিল। যারা ১৯৯০-এর দশকে ইসরায়েলের আকাশসীমার আধিপত্য মোকাবিলার প্রয়াসে দক্ষিণ লেবাননে অনুরূপ নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিল। এএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এর মধ্যে কিছু টানেল গাজা থেকে সরাসরি সীমান্তের কাছে ইসরায়েলি সম্প্রদায়ের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। যার মাধ্যমে হামাস ইসরায়েলি অভিযানে সক্ষম হয়। সুড়ঙ্গগুলোর বেশিরভাগই এক মিটার চওড়া ও আড়াই মিটার উঁচু। ফলে একজন মানুষ সহজে প্রবেশ করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে সুড়ঙ্গগুলো ভূপৃষ্ঠের গভীর পর্যন্ত যায়। ভূপৃষ্ঠের ৩০ মিটার নিচে পৌঁছায়। হামাস এটি তৈরিতে বিশাল অর্থ ব্যয় করেছে। ওয়াশিংটন পোস্টের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, হামাস ২০০৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১.২৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ১ হাজার ৩০০টিরও বেশি টনেল তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, হামাস গাজার নিচে তিনটি ভিন্ন ধরনের টানেল তৈরি করছে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক এডো হেচট ব্যাখ্যা করেছেন, গাজা এবং মিসরের মধ্যে পণ্য সরবরাহের জন্য একটি সুড়ঙ্গ রয়েছে। গাজার অভ্যন্তরে প্রতিরক্ষামূলক টানেল রয়েছে, যা কমান্ড সেন্টার এবং অস্ত্র সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়। সবশেষ ইসরায়েলে আন্তঃসীমান্ত আক্রমণের জন্য আক্রমণাত্মক টানেল রয়েছে। সুড়ঙ্গগুলোকে ‘দ্য মেট্রো’ বলে অভিহিত করা হয়। স্থল হামলায় নামার আগে সে কারণেই গাজার টানেল গুলো লক্ষ্য করে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল সেনারা। প্রসঙ্গত, গাজা উপত্যকার টানেল গুঁড়িয়ে দেওয়ার টার্গেট এটিই প্রথম নয় ইসরায়েলের। ২০২১ খ্রিস্টাব্দে ইসরায়েল গাজায় ৬২ মাইলেরও বেশি সুড়ঙ্গ ধ্বংস করেছিল। ৫৪টি বিমান এ অপারেশনে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু হামাস বারবার টানেল সিস্টেমে বিনিয়োগ করেছে। ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে যখন হামাস ক্ষমতায় আসার সময় ইসরায়েলি অবরোধ ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন সুড়ঙ্গগুলো দিয়ে ভূখণ্ডে বসবাসকারী ২ মিলিয়ন ফিলিস্তিনির জন্য খাদ্য ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসা হয়েছিল। হামাস পরবর্তীতে তার নিজস্ব সামরিক উদ্দেশ্যে টানেলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। অনেকগুলো ধ্বংস হয়ে গেলেও ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে হামাস আবারও ভূগর্ভস্থ পথ খনন করে। কিছু সুড়ঙ্গ মাটির ৩০ অথবা ৪০ মিটার (১০০ বা ১৩০ ফুট) পর্যন্ত গভীর। এখন ইসরায়েল চাইছে এই টানেলগুলো গুড়িয়ে দিতে। তবে তা পুরোপুরি সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন সমর বিশারদরা। হামাসের টানেল যুদ্ধ সম্পর্কে সতর্ক করে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিষয়ক সোফান সেন্টার থিঙ্ক ট্যাঙ্কের গবেষণা পরিচালক কলিন পি. ক্লার্ক বলেছেন, ‘গাজার তলদেশে একটি দীর্ঘ সুড়ঙ্গ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হামাস ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) সঙ্গে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এটি যুদ্ধকে জটিল করে তুলতে পারে। সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্ক কেমন সে সম্পর্কে ব্যাপক বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন। ইসরায়েলিদের এ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকলে ফাঁদে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’ নীতি গবেষণা বিষয়ক জেরুজালেমের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক জেরুজালেম ইনস্টিটিউট ফর স্ট্রাটেজি অ্যান্ড সিকিউরিটির (জেআইএসএস) বিশেষজ্ঞ আলেকজান্ডার গ্রিনবার্গ বলেন, হামাসের টানেলের সুবিধা একটি ফাঁদ হতে পারে। ফরাসি সংবাদ টেলিভিশন নেটওয়ার্ক ফ্রান্স ২৪-কে আরও বলেছেন, ‘সুড়ঙ্গের প্রবেশপথ বেসামরিক ভবনগুলোতে অবস্থিত হতে পারে, যা ইসরায়েল বাহিনীর পরিকল্পিত আক্রমণকে জটিল করে তুলতে পারে।’ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ৭ অক্টোবরের হামলায় হামাস যোদ্ধারা এই ভূগর্ভস্থ পথ দিয়েই ইসরায়েলে প্রবেশ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনের বিশেষজ্ঞ ব্রুস হফম্যান বিপজ্জনক সুড়ঙ্গের কথা উল্লেখ করে বলেন, সুড়ঙ্গগুলোতে ইসরায়েল জিম্মিদের সম্ভাব্য অবস্থান হতে পারে। এজন্য সুড়ঙ্গপথ ধ্বংস করাও বিপজ্জনক। তিনি আরও বলেন, ভূগর্ভস্থ যুদ্ধ হামাসের রক্ষক এবং তাদের নেতৃত্বকে একটি বড় কৌশলগত সুবিধা দেবে। ইসরায়েলের পক্ষে সুড়ঙ্গগুলো শনাক্ত করা খুব কঠিন। তবে আলজাজিরার প্রতিবেদনে জানা যায়, ইতোমধ্যে চলমান যুদ্ধে আইডিএফ তাদের আন্দোলনকে শ্বাসরোধ করতে হামাসের সুড়ঙ্গে আঘাত করছে। আইডিএফ মুখপাত্র জোনাথন কনরিকাস গণমাধ্যম এবং-এর একটি পোস্টে বলেছেন, ‘সর্বশেষ বিমান হামলার লক্ষ্য ছিল গাজা উপত্যকার সুড়ঙ্গের একটি নেটওয়ার্ক ধ্বংস করা, যা হামাস কয়েক দশক ধরে একটি অপারেশন সেন্টার হিসাবে ব্যবহার করে আসছে।’ আলজাজিরা আরও জানায়, সুড়ঙ্গগুলো ধ্বংস করার প্রয়াসে ইসরায়েল একটি শক্তিশালী বোমা বাঙ্কার বাস্টারও ব্যবহার করছে। এই বাঙ্কার বাস্টারগুলো বিস্ফারণের আগে মাটির গভীরে গর্ত করে। এরপর শক্ত লক্ষ্য বস্তুগুলোকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। লণ্ডনের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক চ্যাথাম হাউজের ইসরায়েলের বিশেষজ্ঞ ইয়োসি মেকেলবার্গ এগুলোকে শক্তিশালী কিন্তু ভয়ংকর গোলাবারুদ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু সাবেক ঊর্ধ্বতন সামরিক ব্যক্তিত্বরা ব্যাখ্যা করেছেন, প্রতিটি সুড়ঙ্গ খুঁজে বের করে ধ্বংস করা কঠিন হতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, সুড়ঙ্গগুলো গাজা উপত্যাকার খান ইউনিস থেকে রাফাহ শহর পর্যন্ত চলে গেছে। যদিও ইসরায়েল বলছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে তারা হামাস ও হামাসের টনেল গুলো ধংস করে দেবে। কিন্তু সমর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাজটি সহজ নয়।
গাজাকে বিধ্বস্ত ও মৃত্যুপুরী বানানোর পরও হামাস ইসরায়েলে রকেট ছুড়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। তারা এখন পাকা খেলোয়াড়। তাদের পেছনে যারা আছে তারাও আগের চেয়ে আর্থ-সামরিক দিক দিয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। ইসরায়েলের অস্তিত্ব মুছে না যাওয়া পর্যন্ত তারা থামবে না। তবে ইসরায়েল হামাস বিনাসের নামে যেভাবে নারী ও শিশুসহ নিরীহ ফিলিস্তিনিদের নির্বিচারে হত্যা করে যাচ্ছে তা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পুরোপুরি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, ‘যুদ্ধাপরাধ’। এ বিষয়ে মানবিক চেতনার সব মানুষকে সোচ্ছার হওয়া জরুরি। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বরক করঠার অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমাবিশ্ব ও তাদের মিত্ররা সমানতালে অস্ত্রশস্ত্র, মন্ত্রণা, সাহস দিয়ে দখলদার ইসরায়েল বাহিনীর শক্তি ও সাহস জুগিয়ে চলেছে। তারা ইসরায়েল বাহিনীকে ফিলিস্তিনি নারী, পুরুষ, শিশু হত্যায় উৎসাহিত করে চলেছে। এ অবস্থায় ইসরায়েল ও আমেরিকার যৌথ শক্তির তীব্র আক্রমণের মুখে নিরস্ত্র, অসহায় ফিলিস্তিনি জনগণের বুকফাটা আর্তনাদ ছাড়া আর কিছুই করার নেই। ইসরায়েল বোমা হামলার মুখে নারী, পুরুষ, শিশু বেঘোরে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে প্রমাণ করে চলেছে কতটা নিষ্ঠুর ও নির্দয় ইসরায়েল বাহিনী ও তাদের মিত্ররা। এর বিপরীতে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় মুসলিম বিশ্বকেই এগিয়ে আসতে হবে। পালন করতেহবে ত্রাতার ভূমিকা। মুসলিম ভাই হিসেবে, ফিলিস্তিনিদের জন্যে যা যা করার তার সবই করতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, আন্তর্জাতিক সংবাদ বিশ্লেষক, সহকারী সম্পাদক দৈনিক পূর্বকোণ।