ইসলামে প্রতিবেশীর অধিকার

ইসলামে প্রতিবেশীর অধিকার

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

عَنْ اَبِىْ شُرَيْحٍ اَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ وَاللهِ لاَ يُؤمِنُ وَاللهِ لاَ يُؤْمِنُ وَاللهِ لاَ يُؤْمِنُ قِيْلَ وَمَنْ يَا رَسُوْلَ اللهِ ، قَالَ الَّذِىْ لاَ يَأْمَنُ جَارُهُ بَوَايقِه [رواه البخارى]
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ رَضِى اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَجُلٌ لِرَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَيْفَ لِىْ اَنْ اَعْلَمَ اِذَا اَحْسَنْتَ وَاِذَا اَسَاتُ فَقَالَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اِذَا سَمِعْتَ جِيْرَانِكَ يَقُوْلُوْنَ قَدْ اَحْسَنْتَ فَقَدْ اَحْسَنْتَ وَاِذَا سَمِعْتُمْ يَقُوْلُوْنَ قَدْ اَسَأْتَ فَقَدْ اَسَأْتَ [رواه مسند احمد]

অনুবাদ: হযরত আবূ শুরাইহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, সে লোকটি কিছুতেই ঈমানদার নয়, আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি সে লোকটি কিছুতেই ঈমানদার নয়, জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রসূল! লোকটি কে? রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যার অনিষ্ট হতে তার প্রতিবেশী নিরাপদ থাকে না। [বুখারী শরীফ, পৃ. ৬০১৬]
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামা’র নিকট আরয করল, হে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) আমি ভালো করছি না মন্দ করছি তা আমি কি করে জানব? নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যখন তোমার প্রতিবেশীদের বলতে শুনবে যে, তুমি ভালো করছ, তবে প্রকৃতই তুমি ভালো করেছ। আর যখন প্রতিবেশীদের বলতে শুনবে, তুমি মন্দ করেছ তবে তুমি মনে করবে ঠিকই তুমি মন্দ কাজ করেছ। [মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং-৩৮০৮]

প্রাসঙ্গিক আলোচনা
বর্ণিত হাদীস শরীফ দ্বয়ে প্রতিবেশীর অধিকার, গুরুত্ব ও মূল্যায়ন সম্পর্কে আলোকপাত হয়েছে, সিহাহ্-সিত্তাহ্ সহ অসংখ্য হাদীসের গ্রন্থসমূহে প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কিত অসংখ্য হাদীস শরীফ বর্ণিত হয়েছে, কয়েকটি হাদীস শরীফের উদ্ধৃতির আলোকে এ সংক্ষিপ্ত প্রয়াসঃ

প্রতিবেশীর সংজ্ঞা
প্রতিবেশীর আরবি শব্দ جَارٌ ‘জারুন’ এক বচন, বহুবচনে ‘জিরান’ শব্দটির মূল অর্থ প্রবাহিত হওয়া। ইমাম রাগিব আল ইস্পাহানী বর্ণনা করেন, الجار من يقرب مسكنه منك বসবাসে যার বসতবাড়ী তোমার নিকটে তিনিই তোমার প্রতিবেশী।
ইবনুল মনযুরের বর্ণনা মতে- وهو من جاورك جوارًا شرعيا سواء كان مسلمًا او كافرًا برَّا او فاجِرًا صديقًا او عدوًا محسنا او مسيا ـ نافعا او ضارًا قريبًا او جنيبًا بلديًا او غريبًا
[لسان العرب]
অর্থ: যে ব্যক্তি তোমার পাশে বসবাস করছে তিনি তোমার প্রতিবেশী, তোমার প্রতিবেশী সে মুসলিম হোক অমুসলিম হোক, নেককার হোক পাপী হোক, বন্ধু হোক বা শত্রু, পরোপকারী হোক বা মন্দধারণাকারী হোক, উপকারী হোক বা ক্ষতিকারক হোক, আত্মীয় হোক বা অনাত্মীয় হোক, দেশী হোক বা বিদেশী হোক। [লিসানুল আরব: খণ্ড-৪, পৃ. ১৫৩]
যারা পাশের বাড়ীতে থাকেন তারা প্রতিবেশী, ইসলামের দৃষ্টিতে কতটুকু দূরত্বে বসবাসকারী লোকেরা প্রতিবেশী হিসেবে গণ্য হবে, সে সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিতে সুস্পষ্ট অভিমত রয়েছে।
হাসান (র.) প্রতিবেশীর বর্ণনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন, اربيعن دارًا امامه اربعين خلفه اربعين عن يمينه واربعين عن يساره নিজ গৃহের সামনে চল্লিশ ঘর। পিছনে চল্লিশ ঘর, ডানে চল্লিশ ঘর, বামে চল্লিশ ঘর পর্যন্ত প্রতিবেশী হিসেবে গণ্য হবে। কারো মতে চারিদিকে দশ ঘর প্রতিবেশী হিসেবে গণ্য হবে। কারো মতে যারা একই মসজিদে সমবেত হয় তারা প্রতিবেশী। [আত্ তাফযীর ফী হুকুকীল জার]

প্রতিবেশীর প্রকারভেদ
১. আত্মীয় মুসলিম প্রতিবেশী, ২. অনাত্মীয় মুসলিম প্রতিবেশী, ৩. অমুসলিম প্রতিবেশী।
আত্মীয় মুসলিম প্রতিবেশীর তিনটি অধিকার রয়েছে- ক. আত্মীয়তার হক, খ. প্রতিবেশীর হক, গ. মুসলিম হওয়ার হক।
অনাত্মীয় প্রতিবেশীর দু’টি হক রয়েছেঃ ক. একটি প্রতিবেশী হওয়ার হক, খ. অপরটি হলো মুসলিম হওয়ার হক।
তৃতীয় পর্যায়ের প্রতিবেশী হচ্ছে ক্ষণিকের সঙ্গী, পার্শ্ব সাথী, যেমন গাড়ীতে, বাহনে ট্রেনে, বিমানে, আপনার পাশে বসা ব্যক্তি বা পাশের সীটে বসা সাথী বা দূর-দূরান্তের সফর সঙ্গী অথবা মসজিদে, মজলিসে, নামাযে ও মাহফিলে আপনার পাশে বসা লোকটি। হতে পারে তিনি আপনার অপরিচিত, হয়তো জীবনে কোনো দিন দেখেননি, না আর কোনদিন তার সাথে সাক্ষাতের সম্ভাবনা আছে, চলার পথে কিছু সময়ের জন্য সঙ্গী হওয়ার কারণে ইসলাম তাকেও প্রতিবেশীর মর্যাদা দিয়েছে। তাঁর সাথে সুন্দর আচরণ ও সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কোনোভাবে তাকে অসম্মান করা যাবে না।

প্রতিবেশীর প্রতি সদ্ব্যবহার করা
প্রতিবেশীর খোঁজ খবর রাখা, প্রতিবেশীর কল্যাণে কাজ করা, প্রতিবেশীর প্রতি ভালো ব্যবহার করা, প্রতিবেশীর কোনো প্রকার ক্ষতি না করা, প্রতিবেশীর সম্মান ও শ্রদ্ধা করাই ইসলামী আদর্শ ও মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা।
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-من كان يؤمن بالله واليوم الاخر فليحسن جاره যে লোকই আল্লাহ্ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে তারই কর্তব্য প্রতিবেশীর প্রতি সদাচরণ করা। [সহীহ্ মুসলিম, হাদীস-৭৭]

প্রতিবেশীকে সম্মান করা
আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি যার বিশ্বাস রয়েছে, দ্বীনি আদর্শ ও চরিত্র যিনি ধারণ করেন, কুরআন ও সুন্নাহর আদর্শ অনুসরণ করা যার প্রত্যয় তিনি প্রতিবেশীর প্রতি কোনো প্রকার অশোভন, অরুচিকর ও বিরূপ মন্তব্য করতে পারেন না। প্রতিবেশীর প্রতি মার্জিত শালীন সুন্দর ও আদর্শিক আচরণ মুমীনের পরিচায়ক।
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে- من كان يُؤمن بالله واليوم الاخر فليكرم جاره যে লোক আল্লাহ্ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে তার কর্তব্য প্রতিবেশীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। [বুখারী শরীফ, হাদীস-৬০১৯]

সৎ প্রতিবেশী সৌভাগ্যের প্রতীক
সৎ প্রতিবেশী উপকার ও কল্যাণধর্মী কাজে প্রতিবেশীকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করে থাকে। অসৎ প্রতিবেশী সর্বদা অসৎ চিন্তা ও প্রতিবেশীর ক্ষতি সাধনে সক্রীয় থাকে।

তিনটি জিনিস সৌভাগ্যের নিদর্শন
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
عن نافع بن عبد الحارث رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من سعادة المرء المسلم المسكن الواسع ـ والجار الصالح والمركب الهنى [ادب المفرد]
অর্থ: হযরত নাফে ইবনে আবদুল হারিস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, তিনটি জিনিস মুসলমানদের সৌভাগ্যের অন্তর্ভুক্তঃ ১. প্রশস্ত বাসস্থান, ২. সৎ প্রতিবেশী, ৩. চমৎকার সওয়ারি (যানবাহন)। [আল আদাবুল মুফরাদ]

ক্ষুধার্ত প্রতিবেশীর খোঁজ খবর রাখা মু’মিনের পরিচায়ক
সমাজের অনেক প্রভাবশালী, সম্পদশালী ব্যক্তিবর্গ, বিলাসবহুল জীবন যাপনে নিমগ্ন অথচ সমাজে অসংখ্য বনী আদম অনাহারে অর্ধাহারে ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। সমাজের অসংখ্য অগণিত, নিঃস্ব, হতদরিদ্র, অবহেলিত, বঞ্চিত জনগোষ্ঠী পরিবারের দৈনন্দিন মৌলিক চাহিদা ও অভাব পূরণ তো দূরের কথা, দু’বেলা খাবার যোগাড়েও তারা ব্যর্থ। মানবতার উৎসর্গীত নিবেদিতপ্রাণ, মানবিক মানুষগুলো অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানবতার ধর্ম ইসলামের আদর্শ ও ত্যাগের মহিমাকে উজ্জ্বীবিত করে তোলে।
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
عن عبد الله بن عباس رضى الله عنه قال سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول ليس المؤمن الذى يشبع وجاره جائع الى جنبه [رواه البيهقى]
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে একথা বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি তৃপ্তি সহকারে উদরপূর্তি করে আহার করে আর তারই পাশে তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে সে ঈমানদার নয়। [বায়হাক্বী:১/৬৯৪]

প্রতিবেশীর ভালমন্দ মূল্যায়ন
আপনার প্রতিবেশী যদি আপনার কর্মের স্বীকৃতি ও ত্যাগের মূল্যায়ন করে সেটা হবে প্রকৃত মূল্যায়ন। প্রতিবেশী আপনার পারিবারিক, সামাজিক, কার্যক্রর্মের প্রত্যক্ষদর্শী। আপনার কর্মের নীরব সাক্ষী।
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে- হযরত জিবরাইল আলায়হিস্ সালাম কর্তৃক প্রতিবেশীর হকের উপর ব্যাপক গুরুত্বারোপ করেছেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম প্রতিবেশীর অধিকারের ব্যাপারে আমাকে এতোবেশী গুরুত্বারোপ করেছেন, এমনকি আমার ধারণা জন্মেছিল হয়তো প্রতিবেশীকে সম্পত্তিতে হকদার (ওয়ারিশ) তথা উত্তরাধিকারীদের মধ্যে গণ্য করা হবে।
[বুখারী শরীফ, হাদীস-৫৫৫৫]
আল্লাহ্ তা‘আলা প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে আমাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহর আদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: অধ্যক্ষ, মাদ্রাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া ফাযিল (ডিগ্রি), বন্দর, চট্টগ্রাম।