হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ’র শাহাদত

হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ’র শাহাদত

হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জামান>

হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁবুতে প্রবেশ করলেন। যুদ্ধ সামগ্রী বের করলেন। মিসরী ক্বাবা’ (কোট বিশেষ) পরিধান করলেন। নানাজান হুযূর মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র ব্যবহৃত পাগড়ী মুবারক মাথায় বাঁধলেন। শহীদকুল সর্দার হযরত আমীর হামযা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র বর্ম গায়ে জড়িয়ে নিলেন। বড় ভাই হযরত ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র কোমরবন্ধ নিজ কোমরে বাঁধলেন। আব্বাজান হায়দার কার্রার রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর তলোয়ার ঐতিহাসিক যুলফিকার হাতে নিয়ে শহীদানের স¤্রাট, জান্নাতী যুবকদের অগ্রনায়ক আল্লাহর রাহে সবকিছুই উৎসর্গ করে নিজের শির মোবারক নযরানা দিতে প্রস্তুত হয়ে গেলেন। মহিলাদের তাঁবুতে এলেন। বিবিগণ এ অবস্থা দেখে যারপরনাই অসহায়বোধ করলেন। চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। দুঃখ-বেদনার নিরব প্রতিচ্ছবি সে পবিত্রা মহিলাদের চোখ বেয়ে বেদনার অশ্রু মুক্তো বিন্দুর মত টপকে পড়তে লাগল।
এ দিকে ইমামে পাক বলতে লাগলেন, তোমাদের প্রতি আমার সালাম! ব্যথায় নিমজ্জিত আহত কণ্ঠে বোনেরা ডাকল, ‘প্রিয় ভাইয়া’ বিবি বললেন, ‘প্রাণনাথ’, সকীনা বললেন, ‘‘আব্বাজান! কোথায় যাচ্ছেন? এ জঙ্গলে আমাদের কার কাছে সঁপে যাচ্ছেন? যে পশুরা আলী আসগরের মত নিষ্পাপ শিশুর প্রতি সামান্য দয়া করেনি, তারা আমাদের সাথে কী রূপ আচরণ করবে?’’ তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহ তোমাদের রক্ষাকারী’’। তিনি তাঁদের ধৈর্য্য ধারণের পরামর্শ দিলেন এবং আল্লাহর ইচ্ছায় সহনশীল এবং কৃতজ্ঞ থাকতে উপদেশ দিলেন।

ইমামে পাকের অত্যধিক প্রিয়কন্যা হযরত সকীনা এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরলেন। আর্তস্বরে বলে উঠলেন, ‘‘বাবা, আপনি চলে গেলে আমি ‘‘বাবা’ বলে কাকে ডাকব? পরম মমতায় আমার মাথায় হাত বুলাবে কে?’’ ইমামে পাক সকীনাকে কোলে তুলে নিলেন। অনেক আদর করে বোন হযরত যয়নবের কোলে দিতে দিতে বললেন, ‘‘বোন, এ আমার অনেক যতেœ গড়া বড় আদরের মেয়ে। তাকে কখনো কাঁদতে দিও না। এতিমের বেদনা যেন আমার এ কন্যাটি বুঝতে না পারে। আমার লাশের কাছে তাকে আসতে দিও না।’’ যয়নব বললেন, ‘‘মরণ আমার! আজ এক সকীনাই শুধু এতিম হচ্ছেনা; আজ আমরা সকলেই নিরাশ্রয় আর এতিম হতে চলেছি। হায়, আজ যদি আমার মৃত্যুই এসে যেত, আমার চোখে এ মর্মান্তিক পরিস্থিতি দেখতে হতো না। ভাইয়া, আপনাকে ছাড়া এবং আপনার পরে আমাদের আর বেঁচে থাকার কী অর্থ আছে? আমাদেরও আপনার সাথে নিয়ে চলুন। আপনার সাথে সাথে লড়াই করতে করতে আমরাও জীবন উৎসর্গ করে দেবো।’’ ইমাম বললেন, ‘‘বোন আমার, তোমরা যে ধৈর্য্যশীলদের সন্তান সন্তুতি! নিয়তি আর খোদায়ী সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থেকো। মুখে অভিযোগের একটি বর্ণও আসতে দিওনা। এ দুনিয়া তো ক্ষণিকের পান্থশালা। পরকালই হচ্ছে স্থায়ী ও অনন্ত নিবাস। দুনিয়া ক্ষণিকের, আখের চিরস্থায়ী। শোন বোন, আমাদের ¯েœহময় নানাজান আল্লাহর রাসূল লোকান্তরিত হয়েছেন, আম্মাজান সাইয়িদাও বিরহের জ্বালা দিয়ে বিদায় নিয়েছেন। আব্বাজানের মাথায় ক্ষত তিন দিন তক নিজ চোখে দেখেছি। পরিশেষে তিনিও সমাধিতে লুকিয়ে গেছেন। ভাই হাসানের টুকরো টুকরো কলজে তোমরা আমরা তশতরীতে দেখেছি। এতকিছুতেও আমরা সবুর করেছি। এখন আমার বিষয়েও ধৈর্য ধর। তোমাদের তো আসন্ন মহা বিপর্যয়েও ধৈর্য্যরে মোহর লাগাতে হবে।’’ অতপর তিনি এক এক জনের নাম ধরে অন্তঃপুরের সবাইকে সালাম জানালেন। ধৈর্য্য ও সংযমের অন্তিম উপদেশ শোনালেন। ক্ষত বিক্ষত আহত হৃদয় আসন্ন বিচ্ছেদ ভাবনায় চুর্ণবিচূর্ণ হতে থাকলো। দুঃখভরা কাতর দৃষ্টিগুলো আলো ভরা চেহারা মোবারকের দর্শন সুধা উপভোগ করতে থাকল। বেদনা বিধুর ক্ষণকাল পরে এ আলোর দীপ্তি চিরতরে মিলিয়ে যাবে। ইমাম শেষ বিদায় জানিয়ে তাঁবু ছেড়ে আসলেন।
কারবালার মজলুম ডানে বামে চোখ বুলালেন। গোটা ময়দান আজ ফাঁকা। নিবেদিতপ্রাণ সহচরদের কেউ নেই, যারা সারাক্ষণ তাঁর সাহায্যে প্রস্তুত থাকতেন। আরোহণ করার সময় যারা পাদানি এগিয়ে দিতেন। হযরত যয়নব দেখলেন যে, ভাইকে সওয়ার করিয়ে দেবার মতও কেউ নেই। বললেন, ‘‘রাসুল-কাঁধের সওয়ারী, রেকাব ধারণের সেবায় কেউ নেই বলে নিরাশ হবেন না। রাসূলের এ নাতনী যে সেই খেদমতে হাজির।
ইমামে পাক ময়দানে কারবালায় অবতীর্ণ হলে মনে হলো যেন অসত্যের অন্ধকার চিরে সত্যের দীপ্ত সূর্যের রূপ উদ্ভাসিত হল। নিজের ব্যক্তিত্ব ও বংশ মর্যাদায় যশঃগীতি সম্বলিত কবিতা পড়লেন।
অতঃপর বললেন, ‘‘হে জনগোষ্ঠি, তোমরা যে রাসূলের কালেমা পড়ে থাক সেই রাসূলের ইরশাদ, ‘আমার এই দৌহিত্রদ্বয় (হাসান হোসাইন) হচ্ছে বেহেশতী যুবকদের সর্দার।’ তোমাদের মধ্যে কে এই হাদীস অস্বীকার করবে? সম্ভ্রমবোধ নেই? একটু লাজ শরম তো করো। আল্লাহ্ ও রাসূলের উপর যদি ঈমান থাকে তো চিন্তা করো, সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা, সর্বত্র দৃষ্টি নিক্ষেপকারী সেই আল্লাহকে কী জবাব দেবে? শ্রেষ্ঠ ত্রাতা, নূরানী সত্তা, রাহমাতুল্লিল আলামীন হুযূর মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মুখ দেখাবে কী করে? নিজ রাসূলেরই গৃহ উজাড়কারীরা, ক্বিয়ামতের প্রতি বিশ্বাস থাকে তো, নিজের পরিণাম তো ভাবো! হে বিশ্বাস ঘাতকেরা, তোমরাই আমাকে চিঠি লিখেছিলে, নিজেদের দূত পাঠিয়ে বলেছিলে, দোহাই আমাদের পথনির্দেশনা দিন। নচেৎ আল্লাহর কাছে আপনার পোশাক টেনেই নালিশ জানাব।’ আমি তোমাদের বিশ্বাস করেই এখানে এসে পৌঁছেছি। হে নির্লজ্জরা, তোমাদের তো উচিৎ ছিল আমার আগমন পথে দৃষ্টি বিছিয়ে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানানো, আমার চরণধুলি তোমাদের চোখে সুরমা বানিয়ে নেয়া, ওয়াদা মতে তোমাদের সর্বস্ব আমার উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য দেয়া। কিন্তু তোমরা তার সম্পূর্ণ বিপরীত আমার সাথে এতটাই খারাপ আচরণ করেছ যে, অনাচার কদাচারের আর অন্ত রইল না। রে দুরাচার যালিম, তোমরা আমার সামনেই যাহরা-কাননের দোলায়িত পুষ্পের মত নিরাপরাধ তরুণদের হত্যা করেছ। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রাণপ্রতীম সন্তানদের রক্ত ধুলোয় গড়াগড়ি করিয়েছ, আমার সাহায্যকারী ও সহযোগীদের কতল করেছ, এখন আমাকেও জবাই করতে চাচ্ছ!! এখনও সময় আছে, লজ্জা ও অনুশোচনায় বিদ্ধ হও। আমারও রক্তে হাত রঙিন করা থেকে সংযত হও। আমাকে হত্যা করার অভিশাপ নিজ ঘাড়ে নিতে যেও না। বলো, তোমাদের কী উত্তর?’’ তারা বলল, ‘‘আপনি ইয়াযীদের বশ্যতা মেনে নিন, অন্যথায় যুদ্ধ ছাড়া উপায় নেই।
তিনি জানতেন যে, তাঁর এ সব কথায় তাদের কোন প্রতিক্রিয়া হবে না। কারণ তাদের অন্তরে যে দূর্ভাগ্যের সীল পড়ে গেছে। মন্দ নিয়তি তার প্রান্ত সীমায় উপনীত। কিন্তু তিনি একথাগুলো প্রমাণ প্রতিষ্ঠার জন্য বলেছিলেন। যাতে পরবর্তীতে তাদের (আত্মপক্ষে) আর ওযর অবশিষ্ট না থাকে।
এবার নবুওয়তরবি প্রিয় নবীর নয়ন তারা, বেলায়তের স¤্রাট আলী (রাদি.)’র কলিজার টুকরো, বিশ্ব দুলালী খাতুনে জান্নাতের প্রাণের প্রশান্তি, ধৈর্য-সংযমের মূর্ত প্রতীক সায়্যিদুনা হুসাইন তৃষ্ণার্ত-অভুক্ত অবস্থায়, বন্ধু বান্ধব আত্মীয়স্বজনের বিয়োগ ব্যথা বুকে নিয়ে কারবালার উত্তপ্ত বালুকায় বিশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনীর সামনে বলতে লাগলেন, ‘‘যদি একান্তই নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ থেকে নিরস্ত হবে না, তবে এসো, আকাংঙ্খা চরিতার্থ করো, আমার রক্তে তোমাদের পিপাসা মিটিয়ে নাও। আর তোমাদের অধিকতর সাহসী, যুদ্ধপ্রিয় রণকুশলীদের এক এক করে আমার মোকাবেলায় পাঠাতে থাকো এবং খোদা প্রদত্ত শক্তি, হুসাইনী বীরত্ব ও হায়দরী আঘাত দেখতে থাকো।’’
সুতরাং জরুরী অবস্থায় ব্যবহার্য বিখ্যাত যুদ্ধংদেহী আর তেজস্বী সৈন্যদের বিশেষ সংরক্ষিত এক ব্যাটালিয়ন থেকে তমীম বিন কাহ্তাবা পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে, নিজ বাহাদুরী চালে অহংকার আর অহমিকাপূর্ণ বাক্যে গজড়াতে গজড়াতে ইমামের মোকাবেলায় আসল। রক্তমুখী চিতার মত ইমামের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তিনি চোখ ধাঁধানো বিজলীর মত তীক্ষ্ম তলোয়ারের আঘাত হানলেন। মুহূর্তেই তমীমের মাথা ঠুনকো কুটোর মত ধড় থেকে উড়িয়ে তার সমস্ত অহংকার ও স্পর্ধা ধুলোয় মিশিয়ে দিলেন। এ ঘটনাদৃষ্টে জাবের ইবনে কাহের কিম্মী অত্যন্ত শক্তিমত্তার ঠমক দেখিয়ে বকাবকি করতে করতে সামনে এগিয়ে আসল। হুঙ্কার ছেড়ে বলতে লাগল, ‘‘সিরিয়া ও ইরাকের বীর মহলে আমার শৌর্য-বীর্যের প্রচার রয়েছে। আমার সাথে লড়তে কেউ সাহস করে না।’’ সিরীয় সৈন্যদের এ উদ্ধত দূরাচার যখন ইমামের সামনে এসে তলোয়ার চালাল, তখন তিনিও আত্মরক্ষা করতঃ শাণিত তরবারীর এমন এক আঘাত হানলেন যে, শত্রুর একটি বাহু কাটা গিয়ে মাটিতে ছিটকে পড়ল। সে পেছন ফিরে পালাতে লাগল। মৃত্যুদূত তার পথরোধ করে দিল। ইমামে পাক দ্বিতীয় আঘাতে তার মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন।
প্রচন্ড ক্রোধে লাল হয়ে বদর বিন সুহাইল ইয়ামনী আমর বিন সা’দকে বলতে লাগল, ‘‘কী সব বীরত্বের কলঙ্ক আর কাপুরুষদের আপনি হুসাইনের মোকাবেলায় পাঠাচ্ছেন, যারা ভাল করে দু’দন্ড লড়তে পারে না। আমার চার পুত্রের মধ্যে যাকে চান এখন ময়দানে পাঠিয়ে দিন। আর দেখুন, আমার কাছ থেকে শিখে আমার সন্তানরা আজ কেমন যুদ্ধ বিদ্যার পারদর্শিতা দেখায়।’’ আমর বিন সা’দ বদরের বড় পুত্রকে ইশারা করল। সে রীতিমত ঘোড়া উড়িয়ে হযরতের মোকাবেলায় আসল। হযরত বললেন, ‘‘ময়দানে তোমাদের পিতা আসলেই ভাল হত। তাতে তোমাদের অশুভ পরিণতির তামাশা তাকে দেখতে হোত না।’’ এটা বলেই ইমাম রক্ত পিয়াসী তলোয়ার দিয়ে এমন এক আঘাত হানলেন যে, তার দফা রফা হয়ে গেল। বদর যখন পুত্রকে মাটিতে ছটছট করতে দেখল, তখন তার দু’চোখে দুনিয়া অন্ধকার মনে হল। মূর্তিমান ক্রোধ হয়ে বর্শা হেলিয়ে সে ময়দানে বেরিয়ে এসে ইমামের উপর হামলা চালাল। ইমাম নিজ ঢাল নিয়ে এমন সুন্দর কায়দায় তার হামলাকে প্রতিহত করলেন যে, মুহূর্তেই তার বর্শার অগ্রভাগ খুলে পড়ে গেল। হতভাগা বর্শার খালি দন্ডটা রাগে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলল আর তলোয়ার প্রস্তুত করল। হযরত বললেন, ‘‘দেখো, বকাবকি এক বিষয়, আর বীরত্ব ভিন্ন বিষয়। সাবধান, এখন তোমার সময়ও ফুরিয়ে গেছে।’’ এ বলেই চাঁদ খন্ডনকারী (নবী)’র প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ‘তাকবীর হাঁকলেন, আর উম্মুক্ত কৃপাণ দিয়ে এমন আক্রমণ চালালেন যে, বদরকে দুখন্ড করে ছাড়লেন। এভাবে একেকজন তলোয়ারবাজ, বর্শাধারী সিরিয়া ও ইরাকের বীরপুরুষদের মত যোদ্ধারা গর্জাতে গর্জাতে এবং হাতির চিৎকার করতে করতে হযরতের মোকাবেলায় আসতে থাকল। কিন্তু যে-ই সামনে আসে সে আর প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারে না। শে’রে খোদার যোগ্যপুত্র বীরত্বের এমন চমক দেখালেন যে, কারবালার ময়দানকে কুফা ও ইরাকের বীর জওয়ানদের ক্ষেত বানিয়ে ছাড়লেন। যশস্বী বীর যোদ্ধাদের তাজা তাজা রক্তে কারবালার মাঠকে রক্ত¯œাত করে ছাড়লেন। নিহতের স্তুপ রচনা করলেন।
শত্রু মহলে শোরগোল পড়ে গেল যে, যদি যুদ্ধের অবস্থা এভাবে চলতে থাকে, তবে এ সিংহ শার্দূল কাউকেই জ্যান্ত ছাড়বেন না। সিদ্ধান্ত হল যে, সময়ের চাহিদা মতে তাকে চারদিক থেকে ঘিরে একসাথেই হামলা করতে হবে।
যথারীতি ফাতেমার চাঁদকে যুলুম নির্যাতনের কালো মেঘে চারিদিক থেকে ছেয়ে ফেলল। সহ¯্র জওয়ান সৈন্যরা ইমামকে ঘিরে ফেলল। তিনি বললেন ‘‘হে অত্যাচারীর দল, তোমরা যদি ইবনে যিয়াদ আর ইয়াযীদকে খুনী বানাতে আওলাদে রাসূলের রক্ত বহানো জরুরী মনে করে থাক, তবে আওলাদে রাসূলও আল্লাহ্ তা’য়ালা ও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সন্তুষ্টি এবং দ্বীনে ইসলামের হেফাযতের জন্য সবকিছুই কুরবানী দিতে প্রস্তুত।
হযরত ইমাম হুসাইন রক্তপাগল শত্রুদের ভিড়ে তাঁর তলোয়ার যুলফিকারের চমক শাণিত করতে থাকলেন। যেদিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিতেন লাশের পর লাশ পড়তে লাগল। শত্রুরা আতঙ্কে প্রমাদ গুনতে লাগল।
আব্দুল্লাহ্ ইবনে আম্মার নামে এক সৈন্যের বর্ণনা- আল্লাহর কসম, আমি সন্তান-সন্তুতি পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব সবাই নিহত হয়ে যাওয়া সহায় স্বজনহীন কাউকে এমন তেজস্বীতা ও বীরত্ব নিয়ে লড়াই করতে না পূর্বে, না পরে কখনো দেখেছি, যেমনটি ইমামে হুসাইনকে দেখেছি। তাঁর প্রচন্ড হামলায় উভয় পাশের শত্রুদের আমি এভাবে পালাতে দেখেছি যেভাবে এক বাঘের আক্রমণ থেকে বাঁচতে ছাগল ভেড়ারা পালাতে থাকে।’’ [ত্বাবরী ২৫৯/৬০]
ইমামে পাক লড়াই করে যাচ্ছিলেন এবং বলে যাচ্ছিলেন, ‘‘আমাকে হত্যা করতে একত্রে আসা লোক সকল, খোদার কসম, আমার পরে তোমরা এমন কাউকেই আর হত্যা করবে না, যার নিহত হওয়া আমার শাহাদাতের চাইতে আল্লাহর আযাব নাযিল হওয়ার অধিকতর কারণ হবে। আল্লাহ্ আমাকে সম্মান দান করবেন এবং তোমাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন। যতক্ষণ তোমাদের প্রতি কঠোর আযাব নাযিল করবেন না, ততক্ষণ তিনি সন্তুষ্ট হবেন না।’’
যদিও তিনি তিনদিনের পিপাসার্ত, মর্মে মর্মে ছিলেন জর্জরিত, শাহাদাতের পরে পূতঃপবিত্রা, রক্ষণশীলা অন্তঃপুর বাসিনীদের বন্দীদশা ও অসহায় অবস্থার কথাও তাঁর মনে ছিল, কিন্তু তাঁর ধৈর্য্য ও মনোবল এবং শাহাদাতের তীব্র আকাঙ্খার কাছে যে ঘাট মানতেই হয়। তিনি বাতিলের সামনে কোনরূপ দূর্বলতার লেশাত্র প্রকাশ করেননি। প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, তাঁর ধমনীতে নবীজির রক্ত, আর বাহুতে ছিল হায়দরী তাক্বৎ। তাঁর মন বলছিল যে, আমার মত শাহী সওয়ার আর কেউ নেই; কেননা আমি যে আমার নবীজির পবিত্র কাঁধে সওয়ার হয়েছিলাম। আমার মত বাহাদুরই বা কে আছে? যেহেতু আমাকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ বীরত্ব দানে ধন্য করেছেন। আমি যে প্রিয়নবীর বীরত্বের প্রকাশস্থল! ইবনে সা’দ এবং তার পরামর্শ দাতারা যখন দেখল যে, ইমামে পাক একাই কুফা আর সিরিয়ার বিখ্যাত বীর বাহাদুরদের বীরত্ব ও শৌর্য বীর্যকে মাটিতে মিশিয়ে দিলেন; তখন তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, এক একজন করে যুদ্ধ করার বদলে ইমামের উপর চতুর্দিকে থেকে তীর বর্ষণ করতে হবে। যখন তিনি প্রচন্ড যখমে জর্জরিত হয়ে যাবেন, তখন পবিত্র ওই দেহকে বর্ষার আঘাতের লক্ষ্য বানাতে হবে। কাজেই ওই নরাধমদের নির্দেশে তীরন্দাজেরা চারপাশ থেকে তাঁর প্রতি তীর বৃষ্টি শুরু করে দিল। অনবরত তীরের আঘাতে ইমামে পাকের ঘোড়া এতই আহত ও কাহিল হয়ে পড়ল যে, চলার মত শক্তি ও তেজ হারিয়ে ফেলল। নিরুপায় ইমামকে একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে যেতে হল।
এখন চারিদিক থেকে তীর আসতে থাকল। ইমামে পাকের পবিত্র দেহই ছিল তাদের একমাত্র লক্ষ্য। যালিমেরা তাঁর নূরানী দেহকে তীরে তীরে ঝাঁজরা আর রক্তাক্ত করে ফেলে। আবুল হুনুক নামে এক অভিশপ্ত ব্যক্তির নিক্ষিপ্ত তীর তাঁর কপাল মোবারকে এসে বিদ্ধ হয়। সর্বশক্তিমান আল্লাহর উদ্দেশ্যে যে কপাল নিয়মিত ঝুঁকত, যা ছিল প্রিয় নবী আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চুম্বন ধন্য, তা এই মূহুর্তে বিদীর্ণ হয়ে গেল। রক্তের ফিনকি ধারায় নুরানী চেহারা মোবারক লালে লাল হয়ে গেল। তিনি চেহারা মোবারকে হাত ফিরালেন। বললেন, ‘‘বদনসীব, তোমরা তো রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র দুঃখবোধকেও গ্রাহ্য করলেনা।’’ দৃশ্যতঃ মনে হচ্ছিল, যেন শাহাদাতের মসনদে সমাসীন জান্নাতের দুলহা বহমান রক্তের পুষ্পালঙ্কার পরিধান করেছেন। আঘাতের মনিহার গলায় পরে আছেন। ওদিকে বেহেশতের হুর পরীরা জান্নাতের ঝরোকা থেকে বেহেশতী যুবকদের সর্দারকে অপলক তাকিয়ে আছেন। তিন দিনের পিপাসার্ত কারবালার মুসাফিরের জন্য ‘হাউজে কাউসার’ তার সুপেয় ঠান্ডা পানীয় নিয়ে অপেক্ষায় আছে। নবীগণ অলি আওতাদ আর শহীদকুলের পবিত্র আত্মাসমূহ নবীকুলস¤্রাটের প্রিয়দৌহিত্র শহীদ-স¤্রাটের সমাদর, অভ্যর্থনা জানাতে অধীর প্রতীক্ষায় প্রস্তুত!
জান্নাতুল ফেরদাউসের সাজ-সজ্জার ধুমধাম চলছিল।
بهاروں پر هيں اج ارائشيں گلزار جنت كى
سوارى انے والى هے شهيدان محبت كى
‘‘জান্নাতের ওই রঙিন শোভা বসন্তে আজ খুব হাসে,
মুহাব্বতের শহীদ নিয়ে কাফেলা আজ ওই আসে।’’
এক ফাঁকে খোলী ইবনে ইয়াযীদ আসবাহী হিংসামুক্ত ওই পবিত্র বুকে একটি তীর এমনভাবে ছুঁড়ে মারলো যে, তা ইমামের হৃদপিন্ডে গিয়ে বিঁধল। এখন পয়গম্বর কাঁধের আরোহী (হুসাইন)’র ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা মুশকিল হয়ে পড়ল। হাত থেকে ঘোড়ার লাগাম ছুটে গেল। ইমামে আরশে মকীন ঘোড়ার জিন থেকে কারবালার যমীনে পড়ে গেলেন। এবার অভিশপ্ত শিমার মুখাবয়বে তলোয়ারের আঘাত হানল। তার সাথে সাথেই সিনান ইবনে আনাস নখয়ী এগিয়ে এসে বর্শার আক্রমণ চালাল, যা দেহ মোবারক এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল।
تشنه لب ذروں په خون مشك بوبهنے لگا
خاك پر اسلام كے دل كا لهو بهنے لگا
তৃষ্ণাতুরের টুকরো ছুঁয়ে সুবাস ভরা খুন বহে,
দ্বীন ইসলামের বুক চেরা খুন ভেজায় মাটি, কারসহে।
বাগে রেসালতের জান্নাতী ফুল, বেলায়তের পুষ্পোদ্যানের বিকশিত কলি, হায়দরী কুসুমকাননের পুষ্পস্তবক, খান্দানে নবুওয়তের অন্যতম স্মারক শাহযাদায়ে কওনাইন ইমাম হুসাইন (রাদি.) পরম করুণাময়ের উদ্দেশ্যে সিজদারত অবস্থায় ইহধাম ত্যাগ করলেন। প্রাণপ্রিয় বোন সাইয়িদা যয়নব এ প্রলয়ঙ্করী দৃশ্য দেখে তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসলেন। আর্তনাদ করতে করতে তিনি ছুটে আসলেন। বলতে লাগলেন, ‘‘হায়রে প্রাণাধিক ভাই আমার! হায় আমাদের কর্ণধার! আসমান ছিঁড়ে যদি মাটিতে পড়তো!’’ সেই মুহূর্তে ইবনে সা’দ ইমামের পাশেই দাঁড়ানো ছিল। তাকে দেখে সাইয়িদা বলে উঠলেন, ‘‘আমর বিন সা’দ, ইমাম আবু আবদুল্লাহ্ (হুসাইন) এর হত্যাকান্ডের এ দৃশ্য তুমি উপভোগ করছ?’’ ইবনে সা’দের চোখে দুনিয়ার চাকচিক্যের মোহ ও লোভের আবরণ পড়ে গিয়েছিল। তবে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল বলেই সাইয়িদা যয়নবের এ বুকফাটা আর্তনাদ আর এ মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে এ পাষাণেরও চোখ ফেটে পানির ধারা দু’গন্ড বেয়ে নেমে আসল। লজ্জায় এতটুকু হয়ে সাইয়িদার দিক থেকে সে চোখ ফিরিয়ে নিল। (ত্বাবরী ২৫৯/৬)
চির-অভাগা খোলী ইবনে ইয়াযীদ হযরত ইমাম পাকের নূরানী শির মোবারক পবিত্র দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে এগিয়ে আসল। কিন্তু ভয়ে তার হাত কেঁপে উঠল। কম্পিত দেহে সে পেছনে হটে গেল। তার ভাই কুলাঙ্গার হাশাল বিন ইয়াযীদ ঘোড়া থেকে নেমে শির মোবারককে দেহ মোবারক থেকে বিচ্ছিন্ন করে তার ভাই খোলীর হাতে অর্পণ করল। কেউ বলেছেন, শিমার ছিল শ্বেতী রোগ বিশিষ্ট। সেই হতভাগ্যই শির মোবারক কেটে নিয়েছিল। হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছিলেন, ‘‘আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, এক ডোরাকাটা কুকুর আমার আহলে বাইতের পবিত্র রক্তে মুখ দিচ্ছে।’’ হযরত ইমাম জা’ফর সাদেক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, ‘‘সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা পঞ্চাশ বছর পরে প্রকাশ পেল, যখন শ্বেতীরোগী শিমার যুল জওশন ইমামে পাকের রক্ত বইয়েছিল।’’ হযরত মুহাম্মদ বিন ওমর বিন হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম বলেন, ‘‘আমি কারবালায় হযরত হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সাথে ছিলাম। তিনি শিমারকে দেখে বললেন, ‘‘আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল সত্য, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন, যে ‘‘আমি এক ডোরা কাটা কুকুরকে আমার আহলে বাইতের পবিত্র রক্তে মুখ দিতে দেখেছি।’’
তাযকেরায়ে সিবতে ইবনে জোযী’তে রয়েছে, ইমামের পবিত্র দেহে ৩৩ (তেত্রিশ) টি বর্শার জখম, ৪০ (চল্লিশ)টি তরবারির জখম এবং তাঁর পিরহান (জামা) শরীফে ১২১ (একশ’ একুশ) টি তীরের ফুটো (ছিদ্র) ছিল।
বেহায়া, বদনসীব পাষন্ডেরা খুলে নিল তাঁর পবিত্র দেহের সবগুলো কাপড়। মস্তকবিহীন দেহ মোবারক থেকে তাঁর জুব্বা শরীফ কায়েস বিন মুহাম্মদ বিন আশআস নিয়ে ফেলল। হুর বিন কা’ব নিল পায়জামা। আসওয়াদ বিন খালেদ জুতো জোড়া খুলে নিল। আমর বিন ইয়াযীদ নিল পাগড়ী মোবারক, চাদর মোবারক নিল ইয়াযীদ বিন শোবল, সিনান ইবনে আনাস নখয়ী বর্ম আর আংটি লুঠে নিল। বনু মহশলের জনৈক ব্যক্তি তরবারী নিয়ে ফেলল, যা পরবর্তীতে হাবীব ইবনে বদীল’র বংশে আনীত হয়।
এতটা যুলুম অনাচার করার পরও সিরিয়া ও কুফার পাষন্ড খুনীদের হিংসা বিদ্বেষের আক্রোশ মেটেনি। চির দুর্ভাগারা ইমামের পবিত্র শরীরের উপর ঘোড়া দৌঁড়িয়ে তাঁকে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলে। এ পাশবিক উম্মত্ততার পর ইয়াযিদী দস্যুরা পর্দানশীন পবিত্র মহিলাদের তাঁবুতে প্রবেশ করে, আহলে বাইতের যাবতীয় মালামাল লুঠ করে নেয়। (ত্বাবরী)
কারবালার এ বিজন মাঠে যুলুম অত্যাচারের মরুঝড় বয়ে গেল, গুলশানে মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পুষ্প কলিরা টর্ণেডোর বলি হয়ে গেল, লুণ্ঠিত হল আলীর ঘর বাড়ী, উৎপাটিত হল যাহ্রার সজীব কানন। দলিল মথিত করা হল প্রিয় নবীর এ সাজানো কুঞ্জ। পরদেশের অচিন পরিবেশে শিশুরা হয়ে গেল ইয়াতীম, বিধবার শ্বেতবাস নিলেন সম্ভ্রান্ত বিবিগণ। বিশ্ব মুসলিমের পরম শ্রদ্ধেয়রা আজ বরণ করলেন করুণ বন্দী দশা। ৬১ হিজরীর ১০ মুহররম পবিত্র জুমা’র দিন সংঘটিত হল এ মর্মান্তিক ঘটনা। সেদিন ইমাম পাকের বয়স ছিল ৫৬ বছর ৫ মাস ৫ দিন। সত্যানুরাগীদের অহংকার, সেই প্রাণপণ যোদ্ধা সেদিন মাতামহের সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করেছিলেন। সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে আপনজনদের নিয়ে এমন দৃঢ়চিত্তে নিজ প্রাণ আল্লাহর পথে উৎসর্গ করেছিলেন যে, যার কোন নজির পাওয়া যাবে না।
حشرتك چھوڑ گئے اك درخشنده مثال
حق پر ستوں كو نه بھولے گا يه احسان حسين
এমনি নজীর রেখে গেলেন ইমাম হুসাইন হাশর তক,
ভুলবে না সে এই অবদান, সর্বদা যে খুঁজবে হক।
আল্লামা মুহাম্মদ শফী উকাড়ভী (রহ.) প্রণীত
ও হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জামান অনূদিত
শামে কারবালা গ্রন্থ থেকে সংক্ষেপিত।