আমীরুল মু’মিনীন মাওলা আলী
মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ আবু নওশাদ নঈমী >
পরিচয়
নাম আলী। কুনিয়াত বা উপনাম আবু তুরাব। তাঁর সম্মানিত পিতা- হুযুর সরওয়ারে কায়েনাত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র চাচা আবু তালিব। হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যুবক অবস্থায় ইসলাম কবুল করেন। ইসালাম গ্রহণের সময় তাঁর বয়স কতো ছিলো এ বিষয়ে বেশ কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। এক বর্ণনায় পনেরো, এক বর্ণনায় ষোল, এক বর্ণনায় আট এবং আরেক বর্ণনায় দশ। যদিও তাঁর বয়স নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া যায়, তদুপরি একথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলা চলে যে, জীবনের প্রথম দিকেই তিনি ইমানের দৌলত হাসিল করে ধন্য হয়েছেন, তিনিও হযরত সিদ্দিক্বে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মতো কখনও মূর্তি পূজায় সম্পৃক্ত ছিলেন না। অন্যান্য খলিফাদের মতো তিনি আশরা-ই মুবাশ্শারাহ্’র অন্তর্ভূক্ত ছিলেন; যাঁদের ব্যাপারে জান্নাতের পূর্ব সুসংবাদ রয়েছে। চাচাত ভাই হওয়া ছাড়াও হুযূরে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র দরাবরে তাঁর জন্য বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। তাছাড়া তিনি হুযূরে আনওয়ার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র কলিজার টুকরা কন্যা, খাতুনে জান্নাত হযরত বাতুলে যাহরাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা’র সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। তিনি প্রথম সারির আলিমে রব্বানীদের মধ্যে শামিল ছিলেন। অদম্য সাহসী বীর পুরুষ হিসেবে তিনি জগত প্রসিদ্ধ এক অনন্য স্বত্তা। আরব-অনারব, জলে ও স্থলে শক্তিমান ও স্বকীয়তার তিনি তুলনাহীন। আজো তাঁর প্রভাবে শের সাদৃশ্য বীর নওজাওয়ানের অন্তরে কম্পনের সৃষ্টি হয়। একইভাবে রিয়াযত বা সাধনার জগতে তিনি বিশেষ মক্বামে অধিষ্ঠিত আছেন। অগণিত আউলিয়া কিরাম তাঁর নূরানী ক্বলবের ভান্ডার হতে ধন্য হয়ে চলেছেন। তাঁর সঠিক দিক-নিদের্শনার দরুন পৃথিবী জুড়ে মহান আল্লাহর আনুগত্য ও রিয়াযতে ভরপুর হয়ে আছে। সুষ্পষ্ট বয়ানদাতা এবং প্রসিদ্ধ বক্তা হিসেবেও তিনি উচুঁ স্থান দখল করে নিয়েছিলেন। পবিত্র ক্বোরআন সংকলনকারীদের তালিকায়ও তাঁর নাম নূরানী অক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে। তিনি বনী হাশিমের প্রথম খলিফা এবং তিনিই নবীজির আদরের দৌহিত্রদ্বয় হাসানাঈন, জামীলাঈন (সুন্দরতম), সা’দাঈন (সৌভাগ্যবান), শহীদাঈন (শাহাদতপ্রাপ্ত)’র মুহতারাম জন্মদাতা পিতা।
সাদাতে কিরাম সৈয়্যদ বংশ তথা আওলাদে রসূলের সিলসিলাহ্ বা বংশধারা মহান আল্লাহ তাঁর মাধ্যমেই জারী রেখেছেন। তাবুক ছাড়া ইসলামের পক্ষে যুদ্ধসমূহে অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য হাসিল করেন। হুযূরে আক্বদাস সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ঐ যুদ্ধের সময় তাঁকে মদীনায় খলিফা নিযুক্ত করেন, আর ইরশাদ করেন হে আলী! আমার দরবারে তোমার জন্য ঐ মর্যাদা অবধারিত, যেমনটা হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম’র দরবারে হযরত হারুন আলায়হিস্ সালামের জন্য ছিলো। হুযূর আক্বদাস সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বেশ কিছু অভিযানে হযরত মওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র হাতে ঝান্ডা তুলে দিয়েছিলেন। বিশেষত: ঐতিহাসিক খায়বার যুদ্ধে। নবীজি এও বলেছেন, আলীর হাতেই খায়বার বিজয় হবে। সেদিন খায়বার কিল্লার দরজা স্বীয় পিঠের উপর তিনি বহন করেন। মুসলিম বাহিনী এর উপর চড়েই ওই কিল্লা ফতেহ (বিজয়) করেছেন। অথচ যুদ্ধ শেষে দরজাটি বের করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু চল্লিশজন সিপাহীর পক্ষে সে দরজা বহন করা সম্ভব হয়নি। সুবাহানাল্লাহ!
অদম্য সাহসিকতা আর বিরত্বের জন্য শক্তিধর মাওলা আলীকে বিশ্ব আজো পরম সম্মানের চোখে দেখে। এমনি করে যুদ্ধ মাঠে শের-ই খোদা, হযরত মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শৌর্যবীর্য অমর হয়ে আছে।
আবূ তুরাব
“আবূ তুরাব” হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর কাছে অতি প্রিয় একটি উপনাম। এ উপনামের রয়েছে ভালোবাসা ভরা প্রেক্ষাপট।
একদিন মসজিদের দেয়াল ঘেষে শুয়ে রইলেন তিনি। পুশত (পিঠ) মুবারক ধূলো-বালিতে ছেয়ে গেছে। হুযূরে আকরম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সেখানে তাশরীফ আনেন। আর পিঠের ধূলো-বালি সরিয়ে দিতে দিতে বললেন, “হে আবূ তুরাব! (মাটি ওয়ালা) বসে পড়ো”। নবীর পবিত্র জবান থেকে নি:সৃত এ নামটি হযরত আলীর কাছে খুবই প্রিয় মনে হতো। ঐ নাম থেকে তিনি হুযূরে আনওয়ার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর দয়া-অনুগ্রহের স্বাদ-আস্বাদন করতেন।
ফযীলত বা মর্যাদা
হযরত সা‘দ ইব্ন আবী ওয়াক্কাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম থেকে বর্ণিত, তাবুক যুদ্ধের সময় হুযুরে আকরম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে আহলে বায়তের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মদীনা তাইয়্যেবায় রেখে যান। এ প্রেক্ষিতে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নবীজি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র দরবারে আরয করলেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি কি মহিলা ও শিশুদের জন্য আমাকে খলিফা (প্রতিনিধি) নিয়োগ করে দিয়েছেন?” নবীজি বললেন, “হে আলী! তুমি কি আমার এ কাজে অসন্তুষ্ট? অথচ আমার দরবারে তোমার জন্য ঐ মর্যাদা অবধারিত, যেমনটা হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম’র দরবারে হযরত হারুন আলায়হিস্ সালামের জন্য রক্ষিত ছিলো; তবে আমিই শেষ নবী। আমার পর আর কোন নবী নেই।”
হযরত সাহল ইব্ন সা’দ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, হুযূর-ই আনওয়ার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম খায়বারের দিন ইরশাদ করেন, আমি ঐ ব্যক্তির হাতে যুদ্ধঝান্ডা তুলে দেবো, যার হাতে আল্লাহ পাক ইসলামকে বিজয়ী করবেন। সে ব্যক্তি আল্লাহ ও রসূলকে ভালোবাসবে। তাকে আল্লাহ ও রসূল প্রিয় জানেন। হৃদয় উদ্বেলক এ শুভসংবাদ সাহাবায়ে কিরামকে সারারাত আকাঙ্খার প্রহর গুণার কাজে ব্যস্ত করে দিলো। আশান্বিত ঐ হৃদয়গুলোর পক্ষে রাত অতিবাহিত করা মুশকিল হয়ে পড়ে। বীর মুজাহিদগণ সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিলেন। প্রতিটি হৃদয় এ মহান নি’মাত লাভের আশা করে যাচ্ছিলো। চক্ষু তাদের অপেক্ষমান এ আশায়- প্রভাত হওয়ার সাথে সাথে না জানি সুলতানে দারাঈন বিজয়ের ঝান্ডা কার হাতে তুলে দেবেন! সকাল হতে না হতেই বুকে আশা নিয়ে সকলে নবীজির দরবারে হাযির হলেন আর আদব সহকারে দেখছিলেন, করুণাময় নবীজির পবিত্র হাত কাকে সৌভাগ্যবান করছে। কিন্তু মাহবুবে খোদা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর চক্ষু মোবারক সাগ্রহে কারো তালাশ করছিলো। রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, সবাইকে দেখছি কিন্তু আলী ইবনে আবু তালিব কোথায়? সাহাবীদের তরফ হতে বলা হলো, “হুযূর! তিনি তো অসুস্থ! তার চোখে অসুখ এসেছে।” নবীজি তাকে ডাকতে বললেন। কিছুক্ষণের মধ্যে হযরত মওলা আলী মুরতাদ্বা হুযুরের দরবারে তাশরীফ আনলেন। হুযুরে আক্বদাস সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থুথু মুবারক লাগিয়ে তাঁর চোখের চিকিৎসা করলেন এবং বরকতের জন্য দো‘আ করলেন। মুহুর্তেই তাঁর চোখের অসুস্থতা দূর হয়ে গেলো আর মওলা আলী পূর্ণ সুস্থতা লাভ করলেন যে, এখন না আছে চোখের ব্যাথা, না আছে লাল বর্ণ, না আছে ধুলো-বালি। তিনি আরাম অনুভব করতে লাগলেন। এমনকি সেদিন হতে আর কোনদিন আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে চক্ষুযোগলকে কোন অসুস্থতা স্পর্শ করতে পারেন নি। অতঃপর হুযূরে কায়েনাত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাতে ওই কাক্সিক্ষত ঝান্ডা তুলে দিলেন।
ইমাম তিরমিযি ও ইমাম নাসায়ী এবং ইমাম ইবনু মাজাহ রাহিমাহুমুল্লাহ্ হযরত হাবশী ইবনে জুহহাদাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, হুযূর আকরম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “আলী আমার থেকে আমি আলী থেকে।” মানে “আলী আমার আর আমি আলীর।” এ বাণী থেকে বারেগাহে রিসালাতে হযরত মওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর মর্যাদা ও সম্মান কতো বেশী তা পরিস্কারভাবে বুঝা যায়।
ইমাম মুসলিম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হযরত আলী মুরতাদ্বা কাররামাল্লাহু ওয়াজহুহুল কারীম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, শপথ! ঐ স্বত্তার যিনি বীজকে উদ্ভাবন করেছেন আর তা থেকে উদ্ভিদ দান করেছেন এবং তাতে প্রাণ সঞ্চার করেছেন। নিশ্চয় নবীকুল সরদার আমাকে বলেছেন যে, ঈমানদারগণই আমাকে ভালোবাসবে এবং মুনাফিকরাই আমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে।
ইমাম তিরমিযী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমাদের কাছে হযরত আলীর সাথে বিদ্বেষ রাখাই ছিলো মুনাফিকের আলামত বা নিদর্শন, যা দ্বারা আমরা মুনাফিক চিহ্নিত করতাম।
হযরত হাকেম রহমাতুল্লাহি আলায়হি হযরত মওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাকে ইয়ামেনের কাযী পদে নিয়োগ দিয়ে প্রেরণ করলেন। আমি আরয করলাম, “হুযূর! আমি স্বল্প বয়সী। বিচার কার্য সমন্ধে আমার ধারণা নেই। কিভাবে আমি এ মহান দায়িত্ব আনজাম দেব?” এটা শুনে নবীজি স্বীয় হাত মোবারক আমার বুকে রাখলেন অতঃপর দো‘আ করলেন। খোদার কসম! সেদিন হতে বিচার কার্য সম্পাদন করতে আমার কোন ধরণের দ্বিধা হয়নি। সিনিয়র সাহাবীগণ হযরত মওলা আলীকে উত্তম বিচারক হিসেবে জানতেন। রসূলে আকরম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ফয়জের এমন অবস্থা যে, হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বক্ষে স্বীয় হাত মোবারক রাখার সাথে সাথেই পূর্ণ-বিচারজ্ঞান ও সমসাময়িকদের মাধে অনন্যতা লাভ করলেন। অতএব ওই হাত মোবারকের স্পর্শে তাঁর হৃদয় জ্ঞানের ভান্ডারে পরিণত হয়। সুতরাং নবীজির ইলমের বর্ণনা কি দেয়া যায়? প্রকৃত অর্থে তা বর্ণনাতীত নয় বরং অসম্ভব।
ইবনে আসাকির আলায়হির রাহমাহ্ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শানে বহু আয়াত নাযিল হয়েছে।
ইমাম তাবরানী ও ইমাম হাকেম আলায়হির রাহমাহ্ বর্ণনা করেন হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে হুযূরে আক্বদাস সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আলী মুরতাদ্বাকে দেখা ইবাদতের শামিল।
হযরত বায্যার ও হযরত হাকেম উভয়ে হযরত আলী মুরতাদ্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি ইরশাদ করেন, হুযূরে আনওয়ার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, “হে আলী! হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাতু ওয়াসাল্লামের সাথে এক জায়গায় তোমার মিল রয়েছে। তা হলো, ইয়াহুদীরা তাঁর প্রতি এতো বিদ্বেষ রাখতো যে, শেষ পর্যন্ত তাঁর সম্মানিত মাতাকে অপবাদ দিয়েছে। অন্যদিকে নাসারারা ভালোবাসার সীমালঙ্ঘন করে এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে, শেষ পর্যন্ত তাঁকে খোদা হিসেবে বিশ্বাস করা শুরু করে দেয়।”
এ জন্য হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, সাবধান হয়ে যাও! আমাকে ঘিরে দু’দলের আবির্ভাব হবে। একটি দল আমাকে অতিরিক্ত ভালোবাসবে। এমনকি আমার মর্যাদাকে বুলন্দ করতে গিয়ে সীমালঙ্ঘন করে বসবে। দ্বিতীয়টি হবে বিদ্বেষ পোষণকারী, যারা শত্রুতা বশত: আমার উপর অপবাদ দিতে থাকবে।
হযরত আমিরুল মু’মিনীন’র ইরশাদ থেকে স্পষ্ট হলো যে, শিয়া ও খারেজী উভয় দলই পথভ্রষ্ট এবং ধ্বংসের দিকে তাদের পথ চলা। সঠিক পথ তথা সিরাতে মুস্তাক্বিমের পথে রয়েছেন আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জাম‘আত। যাঁরা মুহাব্বত করে কিন্তু সীমালঙ্ঘন করেন না। সকল প্রশংসা কেবল মহান আল্লাহ তা‘আলারই নিমিত্তে।
বায়‘আত ও শাহাদত
ইবনে সা’দ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বর্ণনানুযায়ী হযরত আমিরুল মু’মিনীন ওসমান গণী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শাহাদতের পর দ্বিতীয় দিন হতে মদীনা তাইয়্যেবায় অবস্থানরত সকল সাহাবী হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর হাতে বায়‘আত কাজ সম্পন্ন করেন। ৩৬ হিজরী সনে জমল বা উষ্ট্রী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ৩৭ হিজরীর সফর মাসে সিফফীনের যুদ্ধ হয়, যা একটি সুলেহ বা সন্ধির মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু কুফার দিকে প্রত্যাবর্তন করেন। ঐ সময়টিতে খারেজিরা অবাধ্য হয়ে উঠে এবং সৈন্য সমেত হামলা চালায়। আমিরুল মু’মিনীন হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাদেরকে মুকাবিলার জন্য হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে প্রেরণ করেন। হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু খারেজিদের পরাজিত করে বিজয় লাভ করে নেন এবং খারেজিদের একটি বড় অংশ প্রথমে তাওবা করে। তারা পরবর্তিতে দ্বীনে হক্বের উপর অটল ছিলো বটে, কিন্তু “নাহরাওয়ান”র দিকে রওয়ানা হয়ে রাহাজানী ডাকাতির কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। হযরত আমীরুল মু’মিনীন এ ফিতনা দমনের জন্য নিজেই নাহরওয়ানের দিকে ছুটে গেলেন। ৩৮ হিজরী সনে তিনি সেখানেই তাদেরকে কতল করেন। এরা এমন ফিতনা, যাদের আবির্ভাবের আগাম সংবাদ হুযূরে আনওয়ার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পূর্বেই দিয়ে রেখেছেন। খারেজীদের বদনসীব আবদুর রহমান ইবনে মুলজাম, যে কিনা বারক ইবনে আব্দুল্লাহ তামীমী খারেজী এবং আমর তামীমী খারেজীকে মক্কা মুর্কারমায় একত্রিত করে আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ও আমিরুল মু’মিনীন হযরত মু‘আবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এবং হযরত আমর ইবনে আস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে হত্যা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করলো। ইবনে মুলজাম হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে হত্যা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং একটি তারিখও নির্ধারণ করে।
হযরত মুনযেরি থেকে বা সাদি থেকে বর্ণিত আছে, ইবনে মুলজাম ক্বিতাম নামের এক খারেজী মহিলার প্রতি আসক্ত ছিলো। ঐ হতভাগীর বিয়ের মোহর ছিলো তিনহাজার দিরহাম; হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে শহীদ করে দেয়ার মত ঘৃন্য কাজকে যার বদলা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। [মুসতাদারাক]
ইবনে মুলজাম কুফায় পৌঁছাল। সেখানে খারেজীদের সাথে দেখা করলো এবং তাদের নিকট ওই নাপাক ইচ্ছার কথা প্রকাশ করলো। খারেজীরা তার সাথে ঐকমত্য পোষণ করল।
জুমু‘আহ্ রাত, ৪০ হিজরী সনে ১৭ রমজান! আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সাহরীর সময়ে জাগ্রত হলেন। ঐ রমজানে তাঁর একটি নিয়ম ছিলো যে, হযরত ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর কাছে একরাত ইফতার করেছেন তো অন্য রাত হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর কাছে ইফতার করতেন। তিন গ্রাসের (লোকমা) বেশী ইফতার গ্রহণ করতেন না। তিনি বলতেন, আল্লাহ পাকের সাথে যেদিন সাক্ষাত হয়, সেদিন আমার পেট খালি রাখাই উত্তম মনে করি। শাহাদতের রাতটির অবস্থা এমন ছিলো যে, তিনি বার বার ঘরের বাইরে তাশরীফ রাখছিলেন আর ঘন ঘন আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন কসম খোদার! আমাকে মিথ্যা সংবাদ দেয়া হয়নি। এটিই সেই রাত, যে রাতের প্রতিশ্রুতি আমাকে দেয়া হয়েছে। অত:পর যখন সকাল হয়, প্রিয় সন্তান হযরত আমীরুল মু’মিনীন হযরত হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে তিনি বললেন, হে হাসান! আজ রাতে হাবীবে আকরম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামার সাথে যিয়ারত হয়েছে। আমি আরয করলাম, “ইয়া রসূলাল্লাহ! আমি আপনার উম্মত থেকে শান্তি পাইনি।” নবীজি বললেন, “তাদের জন্য বদ দো‘আ করো (যারা তোমাকে কষ্ট দিয়েছে)।” আমি আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করলাম হে আল্লাহ! এ যুলুমের পরিবর্তে আমাকে আরো উত্তম প্রতিদান নসীব করো আর তাদের অনুকূলে মন্দ বদলা দান করো।
রমযানুল মোবারকের মাসে সিরিয়া থেকে আগত আবদুর রহমান ইবনে মুলযিম নামক ব্যক্তি হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে কুফার মসজিদে নামাযরত অবস্থায় বিষমিশ্রিত তলোয়ার দ্বারা আক্রমণ করেছিল, ফলে বিষের প্রভাব পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। ২১ রমজানুল মুবারক ফজরের সময় তিনি শাহাদতের অমীয় সুধা পান করেন।