পবিত্র ঈদুল ফিতর: শরীয়তের আলোকধারায়

পবিত্র ঈদুল ফিতর: শরীয়তের আলোকধারায়

মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ জসিম উদ্দিন আবিদী>
 
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর বান্দাহদের সৃষ্টি করে রহমত আর নি’মাত দিয়ে ভরপুর করে দিয়েছেন। আবার বিশেষ নি’মাতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমে আনন্দ-উৎসব উদযাপনের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। কারণ নি’মাতের শোকরিয়া আদায় অত্যাবশ্যক। বিশেষত: ঈমানদার কৃতজ্ঞ বান্দাহগণ এ ব্যাপারে খুবই সচেতন, বান্দাহ যখন যত বেশি আল্লাহ তাআ’লার নৈকট্য অর্জন করেন,ও ঐ বান্দাহর উপর সন্তুষ্ট হয়ে নি’মাতের মাত্রা আরো বৃদ্ধি করে দেন। 
যেমনিভাবে কালামে পাকে তিনি ইরশাদ ফরমান- وَاِذۡ تَاَذَّنَ رَبُّکُمۡ لَئِنۡ شَکَرۡتُمۡ لَاَزِیۡدَنَّکُمۡ وَلَئِنۡ کَفَرۡتُمۡ اِنَّ عَذَابِیۡ لَشَدِیۡدٌ ( ابراهيم ٧)
অর্থ: ’এবং স্মরণ করো, যখন তোমাদের প্রতিপালক শুনিয়ে দিলেন, যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও,তবে আমি তোমাদের আরো অধিক দেবো এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে আমার শাস্তি কঠোর।’ [সুরা ইব্রাহীম:৭, কানযুল ঈমান] 
উক্ত আয়াতে পাক দ্বারা সুষ্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, নি’মাতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, আরো অতিরিক্ত মাত্রায় নি’মাত প্রাপ্তির মাধ্যম, পক্ষান্তরে নি’মাতের অবজ্ঞা শাস্তি ও ধ্বংস প্রাপ্তির অন্যতম কারণ। যেমনিভাবে এ আয়াতে পাকের তাফসীর করতে গিয়ে সদরুল আফাযিল আল্লামা নাঈম উদ্দিন মুরাদাবাদী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ‘তাফসীরে খাযাইনুল ইরফান’ নামক গ্রন্থে লিখেন- এ আয়াত থেকে বুঝা গেলো যে, ‘কৃতজ্ঞতা প্রকাশ দ্বারা আল্লহর অনুগ্রহ বৃদ্ধি পায়। শোকর (কৃতজ্ঞতা) এর মূল হচ্ছে যে, মানুষ অনুগ্রহের কল্পনা করবে এবং সেটা প্রকাশ করবে। আর প্রকৃত শোকর (কৃতজ্ঞতা প্রকাশ) হচ্ছে এ যে, নি’মাত কে সেটার প্রতি সম্মান প্রদর্শন সহকারে স্বীকার করবে এবং নফসকে সেটার প্রতি অভ্যস্ত করবে। এখানে একটা সুক্ষ্ম বিষয় রয়েছে, সেটা এই যে, বান্দাহ যখন আল্লাহ তা’আলার নি;মাত সমূহ এবং তাঁর বিভিন্ন ধরেণের অনুগ্রহ, বদান্যতা ও উপকার দানের কথা পর্যালোচনা করে, অতঃপর তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশে মগ্ন হয়, তখন এর ফলে আল্লাহর অনুগ্রহ বৃদ্ধি পায়। আর বান্দার অন্তরে আল্লাহ তা’আলার মুহাব্বত বাড়াতে থাকে এবং এই স্তর খুবই উচ্চ পর্যায়ের। তা থেকে অধিকতর উচ্চু স্তর এই যে, নি’মাত দাতার ভলোবাসা এ পর্যন্ত প্রাধান্য লাভ করবে যে, অনুগ্রহ সমূহের প্রতি হৃদয়ের লক্ষ্য নিবন্ধ থাকবেনা (বরং নি’মাত দাতার প্রতিই থাকবে) এই স্তর হচ্ছে ‘সিদ্দীক’ (মহাসত্যবাদী) গণেরই। আল্লাহ তা’আলা আপন অনুগ্রহ ক্রমে আমাদের কে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার শক্তি দিন।” [তাফসীরে খাযাইনুল ইরফান, পৃষ্ঠা- ৪৬৬]
প্রত্যেক নি’মাত প্রাপ্তিলগ্নে শোকরিয়া আদায়ের ব্যবস্থা ইসলামী শরীয়তে স্বীকৃত। যেমন আমাদের প্রাণপ্রিয় মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সর্বশ্রেষ্ঠ নি’মাত হিসেবে আমরা পেয়েছি বিধায়, এ নি’মাতের শোকরিয়া আদায় করতে হয় ‘পবিত্র ঈদে মীলাদুন্নবী (দ.) ও জশনে জুলুস উদযাপনের মাধ্যমে। যার প্রমাণ পবিত্র কুরআন মাজীদে বিদ্যমান। 
হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম কর্তৃক হযরত ইছমাঈল আলায়হিস্ সালামকে আল্লাহ তা’আলার নির্দেশে কুরবানী করার প্রেক্ষাপটে হযরত ইছমাঈল আলায়হিস্ সালাম’র পরিবর্তে বেহেশতী দুম্বা কুরবানী হওয়ার শোকরিয়া ঈদুল আযহার মাধ্যমে। পবিত্র কুরআন মাজীদ অবতীর্ণ হওয়ার মাস মাহে রমযানুল মোবারক সিয়াম সাধনার মাধ্যমে অতিবাহিত করতে পারার শোকরিয়া পবিত্র ঈদুল ফিতরের মাধ্যমে। নিম্নে ঈদুল ফিতর সম্পর্কে আলোচনা করার প্রয়াস পাব।
 
পবিত্র ঈদুল ফিতর  
* ঈদ (عيد ) শব্দটি আরবী, বহুবচনে اعياد। এটা عاد يعد শব্দ থেকে সংগৃহীত, এটার অর্থ হলো বারং বার । প্রার্থনা কল্পে এরূপ নাম রাখা হয়েছে। অর্থাৎ এটা যেন জীবনে বারং বার আসে। কেননা এ দিনটিতে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে অসংখ্য নি’মাতের অবতারণা হয়।
* ফিতর (فطر) শব্দের অর্থ ফেটে দেয়া, ফুটো করে দেয়া, ভেঙ্গে দেয়া, রোযা ভঙ্গ করে দেয়া ইত্যাদি। সুতারাং ‘ঈদুল ফিতর’ মনে রোযা পরিসমাপ্তির আনন্দ। একটি মাস রোযা পালনের মাধ্যমে আল্লাহর বান্দাগণ দিনের বেলায় বৈধ পানাহার ও জৈবিক রসনা থেকে বিরত ছিল শুধু আল্লাহ তা’আলার জন্য। রমযানের কঠোর আনুগত্য ও চরম শৃঙ্খলতার পর যে আনন্দ তাই ‘ঈদুল ফিতর।’ উল্লেখ্য যে, এটা মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের দিন বলে পরিগণিত বিধায় এটার প্রতি মুসলমানদের মাঝে খুবই গুরুত্বানুধাবন করার মানসিকতা সৃষ্টি হয়। এ জন্য এ দিনকে يوم الرحمة বা ‘করুণার দিবস’ বলা হয়। তাছাড়া ঐ দিন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত জিব্রাঈল আমীন আলায়হিস্ সালামকে মনোনীত করেছেন। ঐ দিন আল্লাহ তা’আলা মধু পোকাকে মধু চক্র বা বাসা তৈরীর জন্য ঐশী নির্দেশ প্রদান করেছেন।
 
কুরআন ও হাদীসের আলোকে ঈদুল ফিতর
পবিত্র কুরআন মজীদে ঈদুল ফিতরের কথা সরাসরি উল্লেখ না থাকলে ও কতেক আলেমের মতে এর ইঙ্গিত রয়েছে। যেমন আল্লাহ তা’আলার বাণী- 
وَلِتُکَبِّرُوا اللّٰہَ عَلٰی مَا ہَدٰىکُمۡ وَلَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ- (البكر ١٧٥)
অর্থ:- ‘এবং আল্লাহর মহিমা বর্ণনা করবে এর উপর যে, তিনি তোমাদেরকে হেদায়েত করেছেন। আর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও”। [সুরা বাক্বারা: ১৮৫,কানযুল ঈমান]
কতেক আলেমদের মত হলো এ আয়াত দ্বারা ঈদের নামায কে বুঝানো হয়েছে। আর এ আদেশ ওয়াজিবের জন্য। আর এ আয়াত সুরা বাক্বারায় সিয়ামের বিষয়ে বর্ণনা হয়েছে বিধায় এখানে ঈদুল ফিতরের নামায শরীয়তের দৃষ্টিকোণে ওয়াজিব হওয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আবার এ আয়াত সুরা হজ্জের ৩৭ নং আয়াতে  ছাড়া কুরবানি ও হজ্জের বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে। তখন ঈদুল আযহার নামায কে বুঝানো হয়েছে। [দরসে তিরমিযী, ২য় খন্ড, পৃ. ৩০৭]
উক্ত গ্রন্থে আরো উল্লেখ রয়েছে-সুরা কাউসারে فَصَلِّ لِرَبِّکَ وَ انۡحَرۡ ؕ’ অর্থ:- ‘সুতারাং আপনি আপনার প্রতিপালকের জন্য নামায পড়ৃন এবং ক্বোরবানী করুন। [সূরা কাউসার: আয়াত-২]
এ আয়াতের তাফসিরে আল্লামা মাহমুদ আলূছী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর স্বীয় তাফসীর রুহুল মা’আনী গ্রন্থে صل (আপনি নামায পড়ুন) শব্দের তাফসীর করতে গিয়ে বলেন- صل صلوة العيد অর্থাৎ আপনি ঈদের নামায পড়ুন। সুতারাং এর দ্বারা বোঝা গেল যে, ঈদের নামাযের ইঙ্গিত পবিত্র কুরআনে পাকে বিদ্যমান।
 
হাদীস শরীফে ঈদুল ফিতরের গুরুত্ব
ঈদুল ফিতরের গুরুত্বের উপর অসংখ্য হাদীস শরীফ রয়েছে। নিম্মে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হাদীস শরীফ উল্লেখ করার প্রয়াস পাব।
* নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ ফরমান- ‘ঈদুল ফিতরের দিন আল্লাহ তাআ’লঅ স্বীয় নেক বান্দাহদের নিয়ে গর্ববোধ করেন।’  [মিশকাত শরীফ]
* প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন শাহ সুফী আল্লামা আলম ফকরী তাঁর রচিতبارہ ماہ کی نفلی عبادت  নামক গ্রন্থে বেশ কয়েকটি হাদীস শরীফ বর্ণনা করেন এ বিষয়ে। যেমন- 
* হযরত আনাছ বিন মালেক রাহমাতুল্লাহি আলায়হি থেকে বর্ণিত যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ ফরমান- ‘আল্লাহ তা’আলা ঐ ব্যক্তিকে ঈদুল ফিতরের রাতে পরিপূর্ণ প্রতিদান বা পুরস্কৃত করেন যে ব্যক্তি পবিত্র রমযান মাসে সিয়াম সাধনা করেছেন এবং ঈদের দিন প্রত্যুষে মহান আল্লাহ পাক ফিরিস্তাদের নির্দেশ প্রদান করে ফরমান- তোমারা যমীনে প্রত্যেক অলী গলী তথা লোক সমাগমে গিয়ে ঘোষণা করে দাও (যে ঘোষণা মনব-দানব ব্যতীত সৃষ্টিকুলের প্রত্যেকে শুনে) হে উম্মতে মুহাম্মদী (দ.) স্বীয় পালনকর্তার দিকে মনোনিবেশ কর, তিনি তোমাদের সামান্য নামায কবুল করে খুবই বড় পুরষ্কার প্রদান করছেন এবং বড় বড় গোনাহ ক্ষমা করে দিচ্ছেন। অতঃপর যখন মানুষ ঈদগাহে গিয়ে ঈদের নামায আদায়ান্তে (মোনাজাতের মাধ্যমে) মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করতে থাকে। সে মুহূর্তে মহান দয়ালু সৃষ্টিকর্তা কোন বান্দার দুআ তথা যে কোন প্রয়োজনীয়তার প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান করেন না অর্থাৎ সব ধরনের দুআ কবুল করেন এবং কারো গোনাহ ক্ষমা না করে ছাড়েন না। এমন কি প্রত্যেক ব্যক্তি স্বীয় গোনাহের ক্ষমা প্রাপ্ত হয়ে নিস্পাপ অবস্থায় স্বীয় ঘরে ফিরে যায়।”
* অন্য রেওয়ায়েতে রয়েছে- ‘হুযুর করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ ফরমান যখনি ঈদুল ফিতরের দিন আসে এবং মানুষ ঈদগাহের দিকে যায় ঠিক সে মুহূর্তে রাব্বুল আলামীন তাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ইরশাদ ফরমান- হে আমার বান্দাগণ ! তোমরা আমার জন্য রোযা রেখেছ, আমার জন্য নামায আদায় করেছ, এখন তোমরা স্বীয় গৃহে এ অবস্থায় প্রত্যাবর্তন কর যে অবস্থায় তোমদের ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে।’
* অন্য একটি হাদীসের শেষাংশে হযরত ইবনে আব্বাছ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন- ‘‘ফিরিস্তারা এ শুভসংবাদ শুনে খুশি হয়ে যান এবং মাহে রমযানের সমাপ্তি লগ্নে উম্মতে মহাম্মদী (দ.)’র নিকট এ শুভ সংবাদ পৌঁছিয়ে দেন।”  [গুনিয়াতুত্তালিবীন, কৃত হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রাহ.)]
 
কোন ধরণের ঈদ হওয়া প্রয়োজন
হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এর নিকট ঈদের পূর্বের দিন কতেক ছেলে গিয়ে আরয করেন যে, আমাদেরকে ঈদ সম্পর্কীয় পংক্তি লিখে দিন। তিনি তখন নিম্মোক্ত পংক্তি লিখে দেন,
خلق گوید کہ فرداروز عید است
خوشی درروح ہر مؤمن پدید است
داروں روزے کہ با ایمان بمیرم
مراد وملک خود آں روز عیداست
অর্থাৎ- ‘মানুষ বলছেন যে, আগামিকাল ঈদের দিন, তবে আমার তো সে দিনই ঈদ হবে, যে দিন আমি ঈমান নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারি।’ সুবহানাল্লাহ ! কী চমৎকার শিক্ষানীয় অমূল্যবাণী তিনি পেশ করলেন যদি সত্যিকার অর্থে প্রকৃত ঈমানের অধিকারী হতে না পারে, তাহলে আবার ঈদ কিসের? বাস্তব ঈদ হলো মহান আল্লাহ পাক এর পক্ষ থেকে ক্ষমা। ক্ষমার এ দিনকে অহেতুক কার্যাদির মাধ্যমে শাস্তির দিনে পরিণত করতে দেখা যায় অনেক দূর্ভাগাদের।
শুধু তাই নয় ইসলামী জগতের দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র পবিত্র জীবনে ও এ ধরনের চিত্র প্রস্ফুটিত হয়েছিল। ঈদের দিন সবাই আনন্দ- খুশীতে দিশেহারা। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁর ঘরে গিয়ে দেখেন খলীফার ঘরের দরজা বন্ধ। ভিতরে তিনি ক্রন্দনরত অবস্থায়। তখন হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন- হে খলীফাতুল মুছলিমীন ! মানুষের আজ ঈদের দিন আনন্দ-খুশিতে, আর আপনি ক্রন্দনরত, ব্যাপার কী? প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন-
لو علم الفارحون ما فرحوا،ثم جعل يبكى ويقول إن كانوا من المقبولين فليفرحوا ،وان كانوا من المطرودين فليبكوا،فانى لا أدرى من المقبولين أنا ام من المطرودين.
অর্থ: ‘যারা আজ আনন্দরত তারা যদি বাস্তব  বিষয় জানত, তাহলে এত আনন্দিত হতোনা। অতঃপর আবার ক্রন্দন শুরু করে বললেন- যদি তারা আল্লাহ পাকের দরবারে গ্রহণযোগ্য হয়, তাদের এ আনন্দ যথাযথ,আর যদি প্রত্যাখ্যাত হয়,তাদের প্রয়োজন ক্রন্দন করা। আমি তো জানিনা আমি কি গ্রহণযোগ্যদের মাঝে না প্রত্যাখ্যাতদের মাঝে।’ সুবহানাল্লাহ ! এ কেমন দৃশ্য, এত উচ্চাসনে আসীন হয়ে যদি খোদাভীতির এ দৃশ্য, তাহলে আমাদের অবস্থা কী ? 
উপরোক্ত বর্ণনা থেকে শিক্ষাগ্রহণ আমাদের অতীব প্রয়োজন। শুধু আনন্দ খুশিতে মগ্ন না হয়ে যেন মহান রাব্বুল আলামীনের পবিত্র দরবারে ক্রন্দনের মাধ্যমে আমদের সমুদয় আমল কবুল করিয়ে নিতে পারি।
 
ইসলামী ভাবধারার ঈদ
সমস্ত অনৈসলামিক, অনৈতিক ও অপসংস্কৃতিমূলক কর্মকান্ডের মূলোৎপাটনের জন্যই ইসলামী ভাবধারার ঈদের সূচনা। ইসলাম পূর্ববর্তী তথা আইয়্যামে জাহিলিয়াতের কুসংস্কার পূর্ণ উৎসবে মেতে উঠত তখনকার যুগের লোকেরা। সেসব উৎসব অন্যায়-অবিচার মূলক কাজে ছিল ভরপুর। বিশেষ করে বছরে দুটি প্রধান উৎসব পালন করত তারা। আমাদের প্রিয় নবী তাদের এ ধরনের ধর্ম বিরোধী, বিবেক বিবর্জিত উৎসব চিরতরে দুনিয়া থেকে বিদায় দেয়ার লক্ষে দুটি উৎসবের প্রথা চালু করেন। যা ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে ভরপুর। আর তা হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আদ্বহা। সত্যিকার অর্থে ইসলামী ভাবধারায় উদ্ভাবিত এ দু’ঈদের মাধ্যমে মানুষ বাস্তবধর্মী উৎসব উদযাপরে শিক্ষা লাভ করেছেন। 
আমাদের ঈদের উৎসব ও অন্যান্য জাগতিক উৎসবের রয়েছে যথেষ্ট পার্থক্য। ইসলামী ঈদ এক মহান সৎ উদ্দেশ্যের আলোকে প্রতিষ্ঠিত। এই ঈদের সৌন্দর্যের ও রয়েছে এক বিরাট স্বকীয়তা। এটার খুশী ও আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে অন্যান্য জাতির ন্যায় খেল-তামাশা ও অপকর্মে জড়িয়ে যাওয়া মারাত্মক অন্যায়। বরং আল্লাহ তা‘আলার বিধি-বিধান পালনের শোকরিয়া আদায়ার্থে এলাকার সর্বস্তরের মুসলমান সমবেত  হয়ে এক ইমামের পেছনে স্বীয় ম’বুদে হা ক্বীক্বির সামনে শির অবনত করতে হয়। আর সবাই একই প্রেরণা, আনন্দ ও অভীন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে মশগুল থাকেন। শুধুমাত্র মহান আল্লাহ পাকের সন্তষ্টি অর্জনই সবার মূল লক্ষ্য। আমাদের ঈদের উৎসব পালনে কোন অন্যায় ও অপকর্মের সম্পর্ক থাকতে পারেনা। কারণ ঈদ তো মহান আল্লাহ পাকের নি’মাতের শোকরিয়া আদায়ের জন্যই। অপর দিকে চিন্তা করলে আমাদের বোধগম্য হয় যে, আসলে ঈদ তো রোযা দারদের পুরষ্কার প্রদানের জন্যই। কেননা সম্মানিত রোযাদারগণ দীর্ঘ একমাস আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যতার মধ্যে ডুবে ছিলেন বলেই তাদের জন্য এ মহাপুরষ্কার।
 
বাহ্যিক ও আত্মার পরিশুদ্ধতা
পবিত্র রমযানে পরিপূর্ণ একমাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে একদিকে আত্নার পরিশুদ্ধতা অর্জিত হয়। যেমনিভাবে ময়লাযুক্ত কাপড় গরম পানি বা সাবান দ্বারা পরিষ্কার হয়। তেমনিভাবে ক্ষুধা ও তৃষ্ণার আগুনে তাক্বওয়া পরহেয গারীর সাবান দ্বারা মাসব্যাপি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার সাড়াশি অভিযানে চমকে উঠে আত্মা। ইসলাম যেহেতু বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীন উভয়দিক উজ্জ্বলতার জোর তাকীদ প্রদান করে, এ জন্য ঈদের দিনের ঘোষণা হলো- তোমাদের বাহ্যিক দিকের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অর্জন কর। সে আলোকে আজ গোসল কর, নতুন জামা পরিধান  কর, আঁতর-গোলাপ লাগাও। পরিশেষে ঈদগাহে গিয়ে ভিতরগত ও বাহ্যিকগত পবিত্রতার সমাবেশ ঘটাও, সাথে সাথে বাহ্যিক আলো বিচ্যুরিত করে এ ঘোষণা দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলো-
اللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ لَا إلَهَ إلَّا اللهُ وَاَللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ وَلِلّٰهِ الْحَمْدُ
 
গরীব-দুঃখী অসহায়দের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ানো
ঈদের আনন্দ শুধুমাত্র ধনী ও বিত্তশালীরা ভোগ করবে পক্ষান্তরে গরীব দুঃখী অসহায়রা এ আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে ইসলাম তা সমর্থন করেনা। সে আনন্দ ভাগাভাগির জন্য ইসলাম ব্যবস্থা করেছে ফিতরা তথা সদকা-খয়রাতের। স্বচ্ছল সামর্থবান বা যারা নেছাব পরিমাণ সম্পদের মালিক (ফিতরার ক্ষেত্রে একবছর মালিকানাধীন অবস্থায় অতিবাহিত হতে হবেনা, যা যাকাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বরং ঈদের দিন সকালেও যদি নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়ে যান তার উপর ফিতরা ওয়াজিব) তারা গরীব-মিসকিনদের অবশ্যই ফিতরা আদায় করবে। যা ওয়াজিব। আর তা হলো ২ কেজি ৫০ গ্রাম (প্রায়) সমপরিমাণ গম বা সমমূল্য, অথবা এর দ্বিগুণ যব বা সমমূল্য। এ ফিতরা ঈদের নামাযে যাওয়ার পূর্বেই আদায় করা মুস্তাহাব। হাদীস শরীফে বর্ণিত রয়েছে- যতক্ষণ কেউ এ ফিতরা আদায় করবেনা, তার রোযা আসমান ও যমিনের মধ্যখানে ভাষমান থাকবে। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার পবিত্র দরবারে তা কবুল হবেনা। এটা এ জন্য যে, অসহায় গরীবেরাও যাতে ঈদের আনন্দে অংশ নিতে পারেন। তাছাড়া বিত্তবানরা যাকাত প্রদান করেন। যাকাত ফিতরা ছাড়াও কেউ গোটা রমযান শরীফ ও ঈদ পূর্ববর্তী সময়ে অকাতারে দান করে থাকেন। এটা একটি উত্তম ও মহৎ দিক। ধনাঢ্যদের এভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। মহান আল্লাহ পাকের নির্দেশও তাই। কারণ ইসলাম আত্ম কেন্দ্রিকতা কে সমর্থন করেনা। বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলাম খুবই চমৎকার লিখেছেন-
ইসলাম বলে সকলের তরে মোরা সবাই 
সুখ-দুঃখ সমভাগ করে নেব সকলে ভাই
নাই অধিকার সষ্ণয়ের।
ঈদ-উল ফিতর আনিয়াছে তা নব বিধান 
ওগো সষ্ণয়ী,উদ্বৃত যা করিবে দান
ক্ষুধার অন্ন হোক তোমার।
 
অনেক সৎ আমলের সমাহার
পবিত্র ঈদুল ফিতর নিছক বাহ্যিক আনন্দ-খুশী বা শুধুমাত্র উৎসব উদযাপনের দিন নয়। এতে রয়েছে ইবাদতের বিভিন্ন মুখী সমাহার। যাতে করে এসব ইবাদতের মাধ্যমে আত্মার উন্নতি সাধন করত: মহান আল্লাহ পাকের পবিত্র দরবারে একজন মাকবুল বান্দা হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন। ঈদের দিন সূচনা থেকে যে সমস্ত আমল করা হয় সবগুলো উত্তম ইবাদতের শামিল। এগুলো ওয়াজিব, সুন্নাত ও মুস্তাহাবের অন্তর্ভূক্ত যেমন সদকায়ে ফিতর ও ঈদুল ফিতরের নামায ওয়াজিব।  গোসল করা , ঈদের নামাযে যাবার পূর্বে কিছু মিষ্টি  খাওয়া সুন্নাত। এ ছাড়া নামাযের পূর্বে নখ কাটা, পরিষ্কার পরিচ্ছিন্ন হয়ে উত্তম জামা পরিধান করা, আতর খুশবু ব্যবহার করা, হেঁটে এক রাস্তা দিয়ে ঈদগাহে গিয়ে ভিন্ন পথে প্রত্যাবর্তন করা, ঈদগাহে যাওয়ার সময় তাকবীর অর্থাৎ اللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ لَا إلَهَ إلَّا اللهُ وَاَللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ وَلِلّٰهِ الْحَمْدُ
 পাঠ করা ও নামাযান্তে মুসলমানদের সাথে মুসাফাহা-করমর্দন, মুয়ানাক্বা (আলিঙ্গন) করা মুস্তাহাব। এ গুলোর মধ্যে রয়েছে অসংখ্য সওয়াব। তবে কথা হল তখনই আমরা এতে সাওয়াব অর্জন করব যখনি এগুলো সুন্নাতের নিয়্যতে ও সঠিক পদ্ধতিতে সম্পাদন করতে পারি। 
ঈদুল ফিতরে খেলতামাশা তথা অবৈধ কার্যকলাপে লিপ্ত না হয়ে খোদাভীতি অন্তরে ধারণ করে সমুদয় ইবাদত ও ইবাদতের নিয়্যতে সম্পাদন করতে পারলে সত্যিকার অর্থে ঈদুল ফিতর আমাদের জন্য পার্থীব ও পরকালীন জীবনের সফলতা বয়ে আনবে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যথাযথ আমল করার তাওফীক আমাদের দান করুন। আমিন, বিহুরমাতি সায়্যিদিল মুরছালীন;
 
লেখক: উপাধ্যক্ষ, বেতাগী রহমানিয়া জামেউল উলুম সিনিয়র মাদরাসা, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।
 
 

Share:

Leave Your Comment