ফিলিস্তিনে বিপন্ন মানবতার দীর্ঘ ছায়া এবং ইহুদিবাদ নাৎসিবাদের রূপ ধারণ প্রসঙ্গে
আবসার মাহফুজ>
জায়নবাদী ইসরায়েলে কট্টরপন্থী বেনজামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন অতীতের সব মাত্রাকে ছেড়ে গেছে। ইসরায়েলি বাহিনী কোনো কারণ ছাড়াই প্রতিদিনই নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যা করে চলেছে। নির্মমভাবে গুড়িয়ে দিচ্ছে ফিলিস্তিনীদের ঘরবাড়ি। গাজা এবং পশ্চিম তীর সহ বিভিন্ন স্থানে দখল করে নিচ্ছে ফিলিস্তিনিদের ভিটেবাড়ি। আর আন্তর্জাতিক সব আইন লঙ্ঘন করে সেখানে গড়ে তুলছে নতুন নতুন ইহুদি বসতি। শুধু তাই নয়, তারা এখন মুসলমানদের প্রথম কেবলা পবিত্র আল আকসা মসজিদেও চালাচ্ছে পাশবিক হামলা। রমজান মাসেও তারা পবিত্র আল আকসা মসজিদে নামাজরত মুসল্লিদের ওপর বার বার হামলা চালাচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের প্রতি এসব বর্বর আচরণের মাধ্যমে ইসরায়েল প্রমাণ করেছে ইহুদিবাদ ক্রমান্বয়ে নাৎসিবাদের রূপ ধারণ করতে যাচ্ছে। অথচ এক্ষেত্রে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অনেকটাই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে চলেছে। এটি উদ্বেগকর। কারণ ইসরায়েলের এমন আচরণ বিশ্বশান্তির প্রতি মারাত্মক হুমকি। একটি স্থিতিশীল বিশ্ব গড়ার পথে প্রধান প্রতিবন্ধক।
‘নাৎসিবাদ’ একটি রাজনৈতিক মতবাদ। এই মতবাদকে সাধারণত একধরনের ফ্যাসিবাদ বলে চিহ্নিত করা হয়, যার মধ্যে বৈজ্ঞানিক-কৌলিন্যবাদ (সায়েন্টিফিক রেসিজম), এন্টিসেমিটিজম অন্তর্ভুক্ত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে অর্থাৎ বিংশশতকের প্রথমার্ধে জার্মানিতে নাৎসিবাদের উদ্ভব ঘটে। জার্মানিতে নাৎসিবাদের বিকাশ ঘটেছিল এডলফ হিটলারের হাত ধরে। যিনি পরবর্তীকালে জার্মানির জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। নাৎসি নেতা এডলফ হিটলারের আত্মজীবনী ‘মেঁই ক্যাম্ফ’ থেকে নাৎসিবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। নাৎসিদলের প্রধান নেতাকে ‘ফ্যুয়েরার’ বলা হতো, যিনি ছিলেন অভ্রান্ত। দলনেতা বা ফ্যুয়েরার প্রতি অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শন করাই ছিল নাৎসিদলের প্রধান নিয়ম। নাৎসিদলের সদস্যদের ফ্যুয়েরার প্রদত্ত সমস্ত নির্দেশনাগুলোকে বিনাপ্রশ্নে মেনে নিতে হতো। নাৎসিদের মতে, পৃথিবীর সকল মতবাদ ভ্রান্ত, শুধু তাদের মতবাদই সঠিক এবং অভ্রান্ত। একনায়কতান্ত্রিকতা ও ব্যক্তিপূজা ছিল নাৎসিবাদের অন্যতম মূলনীতি। নাৎসিবাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সমগ্র বিশ্বে জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা। নাৎসিবাদীরাও ফ্যাসিবাদীদের মতো বলপ্রয়োগের মাধ্যমে শাসনক্ষমতা দখলে বিশ্বাসী ছিল। যেহেতু নাৎসিবাদ বিংশশতকে সা¤্রাজ্যবাদকে উস্কে দিয়েছিল সেহেতু নাৎসিবাদ ও সা¤্রাজ্যবাদ একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জার্মানিতে নাৎসিবাদ প্রবলভাবে সক্রিয় ছিল। এ সময় নাৎসিবাদ হয়ে উঠেছিল জার্মানির প্রধান রাষ্ট্রীয় মতবাদ। এই সময়কালে জার্মান সরকার একটিমাত্র রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি বা নাৎসি পার্টির অধীনে ছিল, যার কেন্দ্রে ফিউরার হিসেবে ছিলেন আডলফ হিটলার। হিটলারের অধীনে জার্মানি একটি আধিপত্যবাদী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের সমস্ত কর্মকা- পরিচালিত হয় তৃতীয় রাইখের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এ সকল প্রতিষ্ঠান তাদের মানবতাবিরোধী ভূমিকার জন্য দেশে ও বিদেশে অত্যন্ত বিতর্কিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, ভাইমার প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি পল ভন হিনডেনবার্গ ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি হিটলারকে জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দেন। এর পরপরই নাৎসি পার্টি তার সকল বিরোধীপক্ষকে একে একে নির্মূল করা শুরু করে এবং ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার সুযোগ পায়। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২ আগস্ট হিনডেনবার্গ মৃত্যুবরণ করলে রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলরের ক্ষমতা একত্রিত করা হয় এবং তার ফলস্বরূপ হিটলার জার্মানির একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে আবির্ভূত হন। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১৯ আগস্ট এক গণভোটের মাধ্যমে হিটলার জার্মানির একমাত্র আইনগত ফিউরার (নেতা) নির্বাচিত হন। হিটলার রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেন এবং তার মুখের কথাই আইন হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করে। বর্ণবাদ, বিশেষ করে জাতি বিদ্বেষ ছিল নাৎসি পার্টির শাসনামলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। জার্মান জনগণ নর্ডিক জাতি হিসেবে পরিচিতিপ্রাপ্ত হয় এবং নিজেদের আর্য জাতির বিশুদ্ধ উত্তরসূরি হিসেবে মনে করা শুরু করে। তারা একসময় প্রভুত্বকারী জাতি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়া শুরু করে। ইহুদি এবং অন্যান্য সম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠীর ব্যক্তিবর্গকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। তাদের বেশিরভাগই অত্যাচার, নিপীড়ন বা হত্যার শিকার হন। হিটলারবিরোধী সকল শক্তিকে দমন করা হয়। বিরোধী দলের সদস্যদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়, বন্দি করা হয়, নয়তো দেশান্তরি হতে বাধ্য করা হয়। শুধু তাই নয়, নাৎসি জার্মানি তাদের জন্য অতিরিক্ত এলাকা দাবি করে এবং জোর করে বিভিন্ন এলাকা দখল করে নেয়। ১৯৩৮ ও ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে দেশটি অস্ট্রিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়া দখল করে নিয়েছিল। এভাবে পুরো বিশ^ দখলের স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠে নাৎসিরা। এমন প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল। দ্বিতীয় স্তালিনের সাথে হিটলার একটি সমঝোতা চুক্তি সাক্ষর করে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে পোল্যান্ড আক্রমণ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত করেন। ইতালি ও অন্যান্য সহযোগী শক্তির সহায়তায় ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জার্মানি ইউরোপের বেশিরভাগ এলাকা দখল করে নেয়। বিভিন্ন সম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠীর ব্যক্তিবর্গকে বিভিন্ন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি ও হত্যা করা হয়। যা ইতিহাসে ‘হলোকস্ট’ নামে পরিচিত। তবে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে নাৎসি জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে বসলে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের পর বড় বড় যুদ্ধে জার্মান বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত বাহিনী জার্মানির পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমা মিত্রবাহিনী জার্মানির পশ্চিমাঞ্চল দখল করে। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ইউরোপ মহাদেশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি হয় এবং একই সাথে জার্মানিতে নাৎসি শাসনের অবসান ঘটে। যুদ্ধ শেষে যুদ্ধাপরাধের দায়ে নাৎসি জার্মানির অধিকাংশ নেতৃবৃন্দকে নুরেমবার্গ ট্রায়ালেলের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। এভাবেই নাৎসিবাদের মতো একটি উগ্র রাজনৈতিক মতবাদের পতন ঘটে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা এখন কট্টরপন্থী নেতানিয়াহুর হাত ধরে ইসরায়েলে ‘ইহুদিবাদ’ নাৎসিবাদে রূপ নেয়া হচ্ছে বলে অভিমত দিচ্ছেন। আগে ইসরায়েলের কট্টরপন্থীরা জায়নিজমকে রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি বিবেচনা করে ইহুদীধর্মের বাইরের সবাইকে বিতাড়িত করতে হত্যা ও ভিটেমাটি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদসহ নানাধরনের কট্টর পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু সেখানকার সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐক্য ছিল। এখন নেতানিয়াহু চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আগের সব চিত্র পাল্টে গেছে। তিনি একদিকে ফিলিস্তিনিদের নির্মূল করতে স§রণকালের সব পাশবিক কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন, অন্যদিকে নেতানিয়াহুবিরোধীদের দমন করতে বিচারবিভাগের ক্ষমতা হ্রাস করাসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি একদিকে ফিলিস্তিনের অস্তিত্ব মুছে দিয়ে এবং আরো আরব ভূমি দখলে নিয়ে বিশাল ইসরায়েল গড়তে চায়, অন্যদিকে হিটলারের পদাংক অনুসরণে সব বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করে এককভাবে আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চায়। নেতানিয়াহুর ‘ক্ষমতা-বাসনার’ বিরুদ্ধে অগ্নিগর্ভ বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছিল ইসরায়েল। পার্লামেন্ট ভবন থেকে শুরু করে নেতানিয়াহুর ব্যক্তিগত বাসভবন পর্যন্ত সরকার পতনের লক্ষ্যে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত গণজাগরণ ও বিক্ষোভ তীব্রভাবে বিস্তার লাভ করে। ক্ষমতাকে নিজস্ব সম্পত্তি বানানোর চক্রান্তের বিরুদ্ধে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি চরম অস্থির হয়ে ওঠে। জনতার ঢলে রাজপথ জনসমুদ্রের রূপ নেয় এমনকি সেনাবাহিনীর মধ্যেও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। ইসরায়েলি হারেটজ সংবাদপত্রে এ গণজোয়ারকে ‘দেশের ইতিহাসে বৃহত্তম বিক্ষোভ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শেষপর্যন্ত জনতার উত্তাল তরঙ্গে উগ্রডানপন্থি নেতানিয়াহু আগামী মে মাস পর্যন্ত তার পরিকল্পনা পিছিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। সংসদের গ্রীষ্মকালীন অধিবেশনে বিচার সংস্কার বিলম্বিত করার জন্য নেতানিয়াহু একটি চুক্তিতেও স্বাক্ষর করেছেন। নয়তো বিদ্যমান সরকার সর্বনাশ এড়ানোর কোনো সুযোগ পেত না। সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ার ক্ষুণœ করে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্বাধীন করার লক্ষ্যে এবং বিচারক নিয়োগকারী কমিটির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে রেখে বিচার বিভাগের সংস্কারের নামে সরকারের পরিকল্পনাকে ইসরায়েলের সংগ্রামী জনতা নস্যাৎ করে দিয়েছে বটে। কিন্তু সুযোগ পেলেই নেতানিয়াহু তার নাৎসি মানসিকতা চরিতার্থ করবে, সন্দেহ নেই। তবে তার এসব আকাক্সক্ষা শেষপর্যন্ত হয়তো হিটলারের পরিণতির দিকে যাবে। নেতানিয়াহুকে হিটলারের ভাগ্যবরণ করতে হবে। এমনকি অবৈধ জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের চূড়ান্ত পতনকেও ত্বরান্বিত করবে। ইতিহাস বলছে গত পাঁচহাজার বছরের ইতিহাসে ইহুদিরা তিনবার স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র গঠন করেছে। কিন্তু প্রথম দু’বার একশ’ করে প্রায় দু’শ বছরের বেশি সেসব রাষ্ট্র টিকেনি। রাষ্ট্র গঠনের পর তারা পাশর্^বর্তী দেশগুলোর ভূমি দখল এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষদের ওপর চরম নিপীড়ন চালাতো। একসময় নির্যাতিতরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইহুদি রাষ্ট্রের পতন ঘটাতো। সা¤্রাজ্যবাদী যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাবিশে^র সহায়তায় এখন তৃতীয়বারের মতো ফিলিস্তিনের বুকে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ জায়নবাদী ইসরায়েল। দেশটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সেখানকার মুসলমানদের ওপর হত্যাসহ নানা নিপীড়ন চালাচ্ছে। জোর করে দখলে নেয়া হয়েছে আরব ভূমি। জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের কথা থাকলেও আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। উল্টো ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো হচ্ছে গণহত্যাসহ নানা নির্যাতন-নিপীড়ন। নেতানিয়াহু চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতন আরো বেড়ে গেছে। পবিত্র রমজান মাসেও ইসরায়েলি হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না ফিলিস্তিনিরা। এমনকি মুসলমানদের প্রথম কিবলা আল আকসা মসজিদও বর্বর ইসরায়েলি সৈন্যদের হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। নামাজরত ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের সেনারা এই পবিত্র রমজানে কয়েকবার পৈশাচিক হামলা চালিয়েছে। উল্লেখ্য, ইসরায়েল দখলকৃত পূর্ব জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদ মুসলমানদের ধর্মীয় সংবেদনশীলতার অংশ। পবিত্র কাবা এবং মদিনার মসজিদের পর এটি তৃতীয় কাবা এবং মদিনার মসজিদের পর এটি তৃতীয় পবিত্র মসজিদ। মুসলমানরা প্রথমদিকে জেরুজালেমের এই পবিত্র মসজিদের দিকে ফিরে নামাজ পড়তেন। সেদিক থেকেও আল আকসা বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। প্রতিবছরই রমজানে আল আকসায় নামাজ আদায়ে মুসল্লিদের ঢল নামে। কিন্তু মুসল্লিদের নামাজ আদায়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতে পবিত্র রমজান মাসে টানা কয়েকবার আল আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে অভিযান চালিয়েছে ইসরায়েলি পুলিশ। অভিযানকালে তারা ফিলিস্তিনি মুসল্লিদের লক্ষ্য করে শব্দবোমা ও রাবার বুলেট ছোড়ে। অভিযানকে কেন্দ্র করে ইসরায়েলি পুলিশের সঙ্গে ফিলিস্তিনি মুসল্লিদের সংঘর্ষ হয়। ইসরায়েলি পুলিশের এসব অভিযানে কয়েকজন ফিলিস্তিনির মৃত্যু ও কয়েকশ’ আহত হয়েছেন। মসজিদ থেকে কয়েকহাজার ফিলিস্তিনিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পবিত্র আল আকসা মসজিদ এবং ফিলিস্তিনের বিভিন্ন এলাকায় অভিযানের পাশাপাশি ইসরায়েল পাশর্^বর্তী দেশ জর্দান এবং লেবাননেও বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়েছে। বলা হচ্ছে ১৭ বছরের মধ্যে লেবানন ও জর্দানে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় হামলা। লেবানন এবং জর্দান থেকেও হামাস ও হিজবুল্লাহ ইসরায়েলে রকেট ছুড়েছে। এসব ঘটনা নিয়ে আলোচনার জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি অধিবেশনও আহ্বান করা হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও চীনের অনুরোধে রুদ্ধদ্বার এ বৈঠক ডাকা হয়। পবিত্র আল আকসা মসজিদ চত্বরে মুসল্লিদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ। ইসরায়েলের ভেতরে-বাইরে নেতানিয়াহু সরকারের এমন পাশবিক আচরণ ‘ইসরায়েলে নতুন নাৎসিবাদের’ ইঙ্গিত দিচ্ছে। আল আকসা মসজিদে ইসরায়েলি পুলিশের নগ্ন হামলা এবং ইসরায়েলে নাৎসিবাদের উত্থান মধ্যপ্রাচ্য শুধু নয়, বিশ্বশান্তির জন্যও এক অশনিসংকেত। ইসরায়েলি শাসক এবং তাদের মুরুব্বিদের মদদে ইহুদিবাদ যেভাবে নব্য নাৎসিবাদের রূপ ধারণ করছে তার পরিণাম ভালো হতে পারে না। জাতিসংঘসহ বিশ্ব সমাজকে এ ব্যাপারে রুখে দাঁড়াতে হবে।
হামলা জোরদারের পাশাপাশি ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করে ইহুদি বসতিও নির্মাণ করে চলেছে। অথচ গত ২৬ ফেব্রুয়ারি জর্ডানের বন্দর শহর আকাবায় ফিলিস্তিন, ইসরায়েল, জর্ডান, মিসর ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। বৈঠক শেষে দেওয়া যৌথবিবৃতিতে বলা হয়েছিল, সবপক্ষ ‘উত্তেজনা প্রশমনে ও ভবিষ্যতের সহিংসতা বন্ধে’ জোর দিয়েছে এবং পরবর্তী ছয় মাস ইসরায়েল ফিলিস্তিনি ভূখ-ে কোনো অবৈধ বসতি স্থাপনার অনুমোদন দেবে না বলে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। গত ১৯ মার্চ মিসরের শারম আল-শেখ শহরে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের কর্মকর্তারা এক বৈঠকে মিলিত হয়ে জেরুজালেমের পবিত্র শহরের মর্যাদা ‘কথায় ও কাজে’ বজায় রাখার এবং বিশেষ করে রমজান মাসে সহিংস পরিস্থিতিতে না জড়ানোর প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু নেতানিয়াহুর সরকার সে প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করেনি। চাপে পড়ে কৌশলগতকারণে প্রতিশ্রুতি দিলেও শেষপর্যন্ত তা রক্ষা করা হয় না। সুযোগ পেলেই কুউদ্দেশ্য চরিতার্থ করা হয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের নতুন এক রিপোর্ট বলছে ইসরায়েলের ভেতর এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে ইসরায়েলের নীতি, আইন, আচরণ ‘আ্যাপারথাইড’ অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদের সমতুল্য। রিপোর্টে বলা হয়েছে ইসরায়েল এমন একটি নির্যাতনমূলক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা কায়েম করেছে, যা প্রয়োগগ করে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর ওপর কর্তৃত্ব ফলানো যায়। আন্তর্জাতিক আইনে এ ধরনের ‘অ্যাপারথাইড’ অর্থাৎ নির্যাতন এবং বৈষম্যমূলক আইনের মাধ্যমে একটি জনগোষ্ঠীর ওপর অন্য জনগোষ্ঠীর কর্তৃত্ব এবং শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়। প্রসঙ্গত, ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের একটি কনভেনশন অ্যাপারথাইডের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এমন : ‘একটি জাতিগোষ্ঠীর ওপর অন্য এক জাতিগোষ্ঠীর কর্তৃত্ব এবং শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা এবং তা বজায় রাখতে যে অমানবিক কর্মকা- এবং সুপরিকল্পিত নির্যাতন চালানো হয়।’ দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ শাসকরা ১৯৪৮ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে শ্বেতাঙ্গদের কাছ থেকে পৃথক রাখতে, তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য করতে যে কুখ্যাত নীতি নিয়েছিল তা ‘অ্যাপারথাইড’ নামে পরিচিত। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ আফ্রিকার সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গদের ন্যাশনাল পার্টি সরকার এই নীতি জারি করে, যাতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গদের নিকৃষ্ট জাতিগোষ্ঠী হিসাবে বিবেচনা শুরু হয়। জাতীয় নির্বাচনে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটের অধিকার খর্ব করা হয়। শ্বেতাঙ্গ এলাকায় প্রবেশ বা বসবাস নিষিদ্ধসহ সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার অধিকাংশ জায়গায় কৃষ্ণাঙ্গদের জমির মালিকানা নিষিদ্ধ হয়। লোভনীয় এবং দক্ষ সমস্ত চাকরি শ্বেতাঙ্গদের জন্য রিজার্ভ রাখা হয়। নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচনে জেতার পর ঐ আইন বাতিল করা হয়।
অ্যামনেস্টির রিপোর্ট বলছে, ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের নিকৃষ্ট ‘অ-ইহুদি’ একটি জাতিগোষ্ঠী হিসাবে বিবেচনা করে এবং তাদের সাথে সেইমত আচরণ করে। আইন, নীতি এবং প্রচলিত ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত খুবই শক্ত এবং সুপরিকল্পিত একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় দুই জাতিগোষ্ঠীর এই পৃথকীকরণ বা বর্ণ-বিভেদ প্রয়োগ করা হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো ইসরায়েল এবং অধিকৃত ফিলিস্তিনি এলাকায় যেন ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠী ইহুদিদের মত সমান অধিকার ভোগ করতে না পারে। ফিলিস্তিনিদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং নির্যাতনই এর উদ্দেশ্য। সেই সাথে অ্যামনেস্টির রিপোর্ট বলছে, ইসরায়েলের বাইরে যেসব ফিলিস্তিনি শরণার্থী বসবাস করছে আইন করে তাদের অধিকার খর্ব করা হয়েছে, তাদের বাড়িঘরে ফেরার রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে ফিলিস্তিনি এলাকাগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে তাদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং নির্যাতনের ভিত্তি তৈরি করা হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলের এমন আচরণ ও নীতি ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সামিল’। আমরা মনে করি, ইসরায়েলের এই ‘অ্যাপারথাইড’ ব্যবস্থার বাস্তবতা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে চোখ এবং মুখ খুলতে হবে। নির্লজ্জভাবে চুপ করে না থেকে সুবিচার প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন রাস্তা খোঁজার উদ্যোগ নিতে হবে। আর আরব ও মুসলিমদেশগুলোকে এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। যদি ইসরায়েলকে এখনই না থামানো যায়, তাহলে নেতানিয়াহুর ডানপন্থি উগ্রবাদী বন্ধুরা আরও নৃশংস হয়ে উঠবে। মানবতা আরও বিপন্ন হবে। মুসলিমদের (এমনকি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদেরও) পবিত্র স্থানগুলোতে আরও ভয়াবহ হামলা পরিচালনা করবে। আর নেতানিয়াহু ও তার উগ্র ডানপন্থী মিত্ররা শুধু আল আকসা মসজিদ নয়, পুরো ফিলিস্তিন থেকে মুসলমানদের বিতাড়িত করতে দ্বিধা করবে না। একইসঙ্গে বিশাল ইসরায়েল গড়ার খায়েশ পূরণ করতে আরব দেশগুলোর ভূমিও গ্রাস করে নেবে। নানাভাবে ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি এ অবস্থায় ফিলিস্তিন সঙ্কটের দ্বি-রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধানে জোরালো উদ্যোগও নিতে হবে। তবে তা হতে হবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে, পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে ১৯৬৭-পূর্ব সময়ের সীমানা অনুসারে। আর এটিই হচ্ছে ইসরায়েলের সাথে শান্তি স্থাপনে যুদ্ধের একমাত্র বিকল্প সমাধান। ইসরায়েল যদি সে পথে না হেঁটে ট্রাম্প ডকট্রিন অনুসারে সমাধান চায়, তাহলে তা হবে অগ্রহণযোগ্য। এক্ষেত্রে মুসলিমবিশে^র উচিত হবে ইসরায়েলের সাথে সবধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা, যাবতীয় সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়া, ফিলিস্তিনিদের ইন্তিফাদাকে জোরদার করতে একাট্টা হয়ে সবধরনের সাহায্য-সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে দেয়া। একইসঙ্গে মার্কিন-ইসরাইলি পণ্য বর্জনেও দৃঢ়তা থাকতে হবে। তবে এজন্য দরকার সুদৃঢ় মেরুদ-, ইস্পাতকঠিন ঐক্য ও দৃঢ়তা।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক; সভাপতি, গ্রিন অ্যালায়েন্স বাংলাদেশ।