Anjuman-E Rahmania Ahmadia Sunnia Trust

মাহে শাওয়াল

মাহে শাওয়াল

ঈদুল ফিতরের মাস বিশ্ব মুসলিমের অপার আনন্দের মাস শাওয়াল। এক মাস সিয়াম সাধনার পর মুসলিম উম্মাহর দ্বারে সিয়াম সাধনার সমাপনী আনন্দ ও শুকরিয়া এবং খোদাভীরু জীবনের প্রতিফলনের দাবী নিয়ে মাহে শাওয়াল সমাগত হয়েছে। হিজরী সনের দশম এবং হজ্জ্বের প্রস্তুতি মাস হিসেবেও মাহে শাওয়াল সবিশেষ তাৎপর্যবহ। আল্লাহর প্রেমে উজ্জীবিত হবার সত্যিকার মানসিক শক্তি যেহেতু পবিত্র রমযানের পূর্ণ একমাস সিয়াম সাধনায় অর্জিত হয়েছে। তাই আসন্ন হজ্জ্ব ও উমরাহ্ পালনে প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য শাওয়াল উপযুক্ত সময়। যখন মাহে শাওয়ালের বাঁকা চাঁদ পশ্চিমাকাশে উদিত হয় তখন থেকে শুরু হয় পরের দিবসের আনন্দের ঈদের ঘনঘটা। কিন্তু এরই মাঝে আল্লাহর আবেদ বান্দাগণের নিদ্রাহীন রাত অতিবাহিত হয় নফল নামায, ক্বোরআন তিলাওয়াত, যিকির ও দরূদ শরীফ এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনার মধ্য দিয়ে।
ঈদুল ফিতরের রাত স্বীয় বান্দাদের জন্য আল্লাহর বিশেষ দান বা অনুগ্রহের প্রতীক পঞ্চরাত্রীর অন্যতম। আল্লাহর অনুগ্রহ প্রত্যাশীরা এ রাতে তাই ইবাদতে রত থাকেন। এ রাতের জন্য বিশেষভাবে চার রাকাত (দুই রাকাত বিশিষ্ট) নফল নামাযের নিয়ম নির্দেশ করা হয়েছে। প্রতি রাকাতে ২১ বার সূরা ইখলাস দ্বারা দুই নিয়্যতে এ চার রাকাত নামায আদায়কারীর জন্য আল্লাহ্ তা‘আলা বেহেশতের আটটি ফটক উম্মুক্ত করবেন এবং দোযখ হতে পরিত্রাণ দেবেন।

ঈদের দিনে করণীয়
এ দিন দুই রাকাত ঈদুল ফিতরের নামায আদায় করা প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের জন্য ওয়াজিব। বিনা কারণে এ নামায পরিত্যাগ করা গোমরাহী ও বিদআত। তবে মুসাফির, অসুস্থ ব্যক্তি, ক্রীতদাস, অন্ধ ও নাবালেগ প্রমুখের জন্য এ নামায বাধ্যতামূলক নয়।

ফিতরা
যারা স্বচ্ছল, অর্থবান তথা শরীয়ত নির্ধারিত ধনসম্পদের অধিকারী তাদের উপর এ দিন ফিতরা প্রদান করা ওয়াজিব। ফিতরা হলো জন প্রতি ২ কেজি ৫০ গ্রাম (প্রায়) পরিমাণ গম বা সমমূল্য অথবা তার দ্বিগুণ যব বা সমমূল্য। এ ফিতরা নামাযে যাওয়ার আগে আদায় করা মুস্তাহাব। এ ছাড়া নামাযের পূর্বে নখ কাটা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে ভাল জামা-কাপড় পরিধান করে আতর খুশবু ব্যবহার করা, ঁেহটে এক রাস্তা দিয়ে গিয়ে ভিন্ন পথে ঈদগাহ হতে প্রত্যাবর্তন করা, ঈদগাহে যাওয়ার সময় অনুচ্চ স্বরে তাকবীর- ‘আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ’ পাঠ করা নামাযান্তে মুসলমানদের সাথে মুসাফাহা (হাত মিলানো ও গলাগলি করা) ইত্যাদি মুস্তাহাব। আর ঈদের নামাযে যাওয়ার আগে কিছু মিষ্টি খাওয়াও সুন্নাত। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নামাযের পূর্বে বিজোড় সংখ্যায় খেজুর খেতেন।
এদিন পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন ঈদগাহ বা ময়দানে এ নামায অনুষ্ঠিত হয়। (অবশ্য বৃষ্টি বা অন্য কোন অসুবিধার কারণে মসজিদের ভেতর নামায আদায় করা যায়) ছয় তাকবীর বিশিষ্ট ওয়াজিব এ দুই রাকাত নামায আদায়ের জন্য একদিকে বান্দা হাজির হন, অন্যদিকে আল্লাহ্ তা‘আলা ফেরেশতাদের বলেন, যে শ্রমিক নিজের অর্পিত দায়িত্ব পালন করে তার প্রাপ্য কি হওয়া উচিত? উত্তরে ফেরেশতারা বলেন, কাজের পূর্ণ প্রতিদানই তাকে প্রদান করা উচিত। এরপর আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন, আমার বান্দাগণ আমার নির্দেশ (রোযা) পালন করেছে এবং অতি নম্রতার সাথে ক্রন্দনরত অবস্থায় নামায দো’আর জন্য ঈদগাহে সমবেত হয়েছে। আমি আমার ইজ্জতের শপথ করে ঘোষণা করছি তাদের দো’আ কবুল করব এবং তাদের পাপ সমূহ ক্ষমা করে দেব।
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, ঈদের দিন ফেরেশ্তাগণ রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে এ মর্মে আহ্বান করতে থাকেন যে, হে মুসলমানগণ! বিগত রমযানের রাতে যারা ইবাদত করেছে এবং দিনসমূহে রোযা রেখেছে এবং আল্লাহ্র নির্দেশ মোতাবেক গরীব-দুঃখীদের খেতে দিয়েছে, আজ তারা পুরষ্কার গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হও। অতঃপর মুসলমানগণ যারা ঈদের নামায আদায় করেন তখন একজন ফেরেশ্তা উচ্চ আওয়াজে বলেন যে, তোমাদের প্রভু ও প্রতিপালক আল্লাহ্্ পাক তোমাদের ক্ষমা করেছেন। তোমরা পুতঃপবিত্র দেহ মন নিয়ে ঘরে প্রত্যাবর্তন কর।

ঈদুল ফিতরের নামাযের নিয়্যত
নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তা‘আলা রাকাতাই সালাতিল ঈদিল ফিত্রি মা‘আ সিত্তে তাকবীরাতিন ওয়াজিবিল্লাহ্ িতা‘আলা ইক্বতিদাইতু বিহা-জাল ইমাম মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ্ শরীফাতি আল্লাহু আকবর।

নামাযের নিয়ম
নিয়্যতের পর ইমামের সাথে তাকবীরে তাহরীমা আল্লাহু আকবর বলে কানের গোড়া পর্যন্ত হাত তুলে নামায শুরু করা হবে। তারপর অনুচ্চ স্বরে সানা পাঠ করে তিনবার ইমামের সাথে আল্লাহু আকবর বলে তাকবীরে যায়েদা বা অতিরিক্ত তাকবীর কালে স্বীয় হাত কান পর্যন্ত উঠাতে হবে। প্রথম দুই বার হাত তুলে ছেড়ে দিবে এবং তৃতীয়বার হাত বেঁধে নিতে হবে। এরপর ইমাম সাহেব যথানিয়মে উচ্চস্বরে কেরাত পড়বেন এবং প্রথম রাকাতের পর দ্বিতীয় রাকাত আরম্ভের জন্য দাঁড়িয়ে ইমাম সাহেব প্রথমে কেরাত পড়ে নেবেন এরপর রুকুতে যাওয়ার পূর্বে তিনবার তাকবীরে যায়েদা বলা হলে মুক্তাদীগণ ইমাম সাহেবের অনুবর্তী হবেন এবং অনুচ্চস্বরে তাকবীর পড়তে পড়তে কান পর্যন্ত হাত তুলে ছেড়ে দেবেন। এরপরই রুকুর তাকবীর বলা হলে রুকুতে যাবেন। তারপর নিয়মানুযায়ী এ রাকাতও সমাপ্ত করার পর ইমাম সাহেব খোতবা প্রদান করবেন।
ঈদের নামাযের খোতবা প্রদান সুন্নাত কিন্তু শুনা ওয়াজিব এবং এ সময় কথা বলা বা অন্য কাজ করা সম্পূর্ণ নিষেধ। খতিবের খোতবা শুনা না গেলেও চুপ থাকতে হবে। অন্যথায় গুনাহগার হবে। ঈদের খোতবার পূর্বে ইমাম সাহেব মিম্বরে না বসে খোতবা শুরু করে দেয়া সুন্নাত এবং প্রথম খোতবার পূর্বে নয়বার দ্বিতীয় খোতবার পূর্বে সাতবার এবং মিম্বর হতে অবতরণের পর চৌদ্দবার আল্লাহু আকবর (চুপে চুপে) পাঠ করা সুন্নাত। নামায ও খোতবার পর মুনাজাত শেষে উপস্থিত সকলের শুভেচ্ছা বিনিময় ও কোলাকুলিতে মুসলমানদের গভীর সম্প্রীতি ও ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে। যা ঈদোত্তর সকল ক্ষেত্রে হিংসা, ঘৃণা ও বিদ্বেষ দূরীভুত হয়ে যায়।
ঈদের দিন নির্দোষ আনন্দ ও উৎসব করারই দিন। এ দিনে শরীয়ত পরিপন্থী আনন্দ ও উৎসব ঈদের ধর্মীয় গুরুত্বের হানি করে। এতদসত্ত্বেও আমাদের দেশে ঢাকঢোল পিটিয়ে ঈদোপলক্ষে অশ্লীলতায় ভরপুর চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর দিকে আহ্বান করা হয় এবং বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ঈদের বিনোদনের নামে প্রায়শঃ স্থুল বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়। এসব দেখে মনে হয় যে, রোযার এক মাসের তাসবীহ তাহলীল, নামায দো’আ তথা সামগ্রিক ধর্মীয় সংযম শেষ হবার সাথে সাথে দ্বীনি চিন্তা চেতনা ও মূল্যবোধকে বিসর্জন দেয়াটাই যেন রীতি। বস্তুতঃ এগুলো ঈদের ধর্মীয় মর্যাদা ও গুরুত্বের প্রতি স্পষ্টতঃ এক চ্যালেঞ্জ। সকলে এ ব্যাপারে ভেবে দেখবেন বলে আশা করি।
শাওয়ালে নফল রোযা
ঈদের দিন ব্যতীত শাওয়ালের সারা মাসের মধ্যে ছয়টি নফল রোযা রাখার জন্য হাদীস শরীফে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। ন্যূন্যতম একটি রোযাও যদি কেউ পালন করে তবে তার আমল নামায় এক হাজার রোযার সাওয়াব প্রদান করা হবে বলে হাদীস শরীফে জানানো হয়েছে। এ মাস থেকে শুরু হবে হজ্জ্ব যাত্রীদের প্রস্তুতি। অনেকে রওয়ানা হবেন পবিত্র ভূমির উদ্দেশ্যে। এ সৌভাগ্যবানদের প্রতি আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা রইল।

এ মাসে ওফাতপ্রাপ্ত ক’জন বুজুর্গ
০১ শাওয়াল: ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি।
০৬ শাওয়াল: খাজা উসমান হারূনী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি।
১০ শাওয়াল: মুফতি সৈয়্যদ মুহাম্মদ আমীমুল ইহসান রাহমাতুল্লাহি আলায়হি।
১২ শাওয়াল: বাদশাহ্ আওরঙ্গজেব আলমগীর (জিন্দাপীর) রাহমাতুল্লাহি আলায়হি।

Share:

Leave Your Comment