কদম মুবারক শাহী জামে মসজিদ

কদম মুবারক শাহী জামে মসজিদ

 

মুহাম্মদ তৈয়ব হোসেন-

কদম মুবারক শাহী জামে মসজিদ, ইতিহাস-বিখ্যাত বারো আউলিয়ার পূণ্যভূমিরুপে খ্যাত চট্টগ্রামে অবস্থিত ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাথে মুঘল আমলে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম শহরের এ মসজিদের নাম অঙ্গাঅঙ্গিভাবে মিশে আছে। সে মুঘল আমল থেকেই কদম মুবারক শাহী জামে মসজিদের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এ মসজিদ, মুঘল স্থাপত্যশিল্পের এক ঐতিহাসিক অনন্য নির্দশন হিসেবে তার অতীত ঐতিহ্যকে ধারণ করে যুগযুগ ধরে আজো টিকে আছে।

কদম মুবারক শাহী জামে মসজিদের অবস্থান
এ মসজিদ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অধীন একপাশে ২১ নং জামাল খান ওয়ার্ড এবং অন্যপাশে ৩২ নং আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের কদম মুবারক মহল্লায় অবস্থিত। এ মসজিদের নিকটবর্তী লোকালয় কদম মুবারক মহল্লা নামে পরিচিত। এছাড়াও এ মসজিদের চতুর্দকে ঝাউতলা, আন্দরকিল্লা, রহমতগঞ্জ, জামাল খান, মোমিন রোড মহল্লা অবস্থিত।
কদম মুবারক শাহী জামে মসজিদের নাম করণ
এ মসজিদের মূল নামাজ (প্রার্থনা) কক্ষের দক্ষিণ বা ডানপাশের কক্ষে রক্ষিত এক শিলাখন্ডে প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজোড়া পবিত্র পদচিহ্ন (নবী পাকের কদম শরীফ) থেকে এ মসজিদের নামকরন কদম মুবারক করা হয়েছে। এছাড়াও পৃথক এক শিলাখন্ডে আউলিয়াকূলের শিরোমণি হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রহমতুল্লাহি আলাইহিরও একজোড়া পবিত্র পদচিহ্ন রয়েছে।

কদম মুবারক শাহী জামে মসজিদের নির্মাণের ইতিহাস
এক উৎকীর্ণলিপি থেকে জানা যায় যে, ইয়াসিন মুহম্মদ খান নামে এক স্থানীয় মুঘল ফৌজদার মুঘল সম্রাট মুহম্মদ শাহের শাসনামলে ১১৫৬ হিজরিতে (১৭২৩ খ্রি.) এ মসজিদ নির্মাণ করেন। ১৭১৯ থেকে ১৭২৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচ (৫) বছরে মসজিদের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। তিনি নিজস্ব খরচে চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্র চেরাগী পাহাড় (বর্তমান মোমিন রোড-কদম মুবারক এলাকা) এলাকায় এ মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা মুঘল ফৌজদার নবাব ইয়াসিন মুহাম্মদ খান প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ মুস্তাফা সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজোড়া পবিত্র পদচিহ্নের শিলাখন্ড সুদূর পবিত্র মদিনা থেকে এবং আউলিয়াকূলের শিরোমণি হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ:)’র একজোড়া পবিত্র পদচিহ্ন বর্তমান ইরাকের রাজধানী বাগদাদ থেকে সংগ্রহ করে এ মসজিদে স্হাপন করেছিলেন বলে জানা যায়। বৃটিশ শাসনামলে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদকে অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করলে তখন অত্র এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা কদম মুবারক শাহী জামে মসজিদে নামাজ আদায় করতেন।

কদম মুবারক শাহী জামে মসজিদের স্থাপত্য শৈলী
উঁচু ভিতের উপর নির্মিত আয়তাকার এ মসজিদের ছাদ তিনটি গম্বুজ দ্বারা ও দুটি ভল্ট দ্বারা আচ্ছাদিত। চারকোণে রয়েছে তিন-স্তর বিশিষ্ট অষ্টভুজী মিনার বা বুরুজ। এ মিনারগুলির প্রতিটির শীর্ষে রয়েছে ক্ষুদ্র গম্বুজ ও তারও শীর্ষে গোলাকার শীর্ষালঙ্করণ (ভরহরধষ)। আয়তাকার এ মসজিদের নামাজ (প্রার্থনা) কক্ষের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে একটি করে পার্শ্বকক্ষ। প্রার্থনা কক্ষের ছাদে আছে তিনটি গম্বুজ এবং এর পার্শ্বকক্ষ দুটি খিলান ছাদ দ্বারা আবৃত। মসজিদ গৃহের বাইরের দিকের মাপ হচ্ছে ১৩ মিটার দ্ধ ৭.৪২ মিটার। এর সঙ্গে বাড়তি পার্শ্বকক্ষ দুটির দৈর্ঘ্য ২৩.১৬ মিটার। মসজিদের পূর্ব দিকে এক সুপরিসর খোলা আঙ্গিনা ছিল। এ মসজিদের প্রার্থনা কক্ষের দক্ষিণ দিকের কক্ষে এক শিলাখন্ডে প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজোড়া পবিত্র পদচিহ্ন এবং পৃথক আরেকটি শিলাখন্ডে আউলিয়াকূলের শিরোমণি হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ:)’রও একজোড়া পবিত্র পদচিহ্ন রয়েছে। অলঙ্কৃত কুলুঙ্গি সারিতে সাজানো ও দুটি অষ্টভুজী বুরুজ বেষ্টিত এ মসজিদের সম্মুখভাগটি অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর ও আকর্ষণীয়। মূল মসজিদগৃহের রয়েছে পাঁচটি দরজা, তিনটি দরজা সম্মুখভাগের দেওয়ালে ও একটি করে দরজা পার্শ্বকক্ষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে। পার্শ্বকক্ষগুলিরও নিজস্ব প্রবেশপথ ও জানালা রয়েছে। মিহরাব রয়েছে পশ্চিম দেওয়ালের সঙ্গে। মসজিদের ভেতরের দেওয়ালগুলি আয়তাকার নানা খোপ বা প্যানেল ও কুলুঙ্গি বা তাক দ্বারা অলঙ্কৃত। মসজিদ কক্ষটি তিনটি ‘বে’তে বিভক্ত এরং পশ্চিম দেওয়ালের কেন্দ্রে একটি কেন্দ্রীয় মিহরাব রয়েছে। সম্পূর্ণ কদম রসুল কমপ্লেক্সটিকে ঘিরে রয়েছে মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা, প্রাচীন কবরস্থান প্রভৃতি অবকাঠামো।

মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থান
এ মসজিদের পাশে অবস্হিত কবরস্হানের মাঝখানে কবরগৃহে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন এ মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা মুঘল ফৌজদার নবাব ইয়াসিন মুহাম্মদ খান। তিনি ছাড়াও এ কবরস্হানে কবরগৃহে শুয়ে আছেন বহু বুজ্র্গূ আউলিয়া এবং চট্টগ্রামের তথা এ উপমহাদেশের বহু কৃতি সন্তান। তাঁদের মধ্যে প্রসিদ্ধ বুজুর্গ আলেম হযরত মাওলানা আবুল হাসান রহমতুল্লাহি আলাইহি, তাঁকে বিদ্যার জাহাজ বলা হতো ও কদম মুবারক মুসলিম এতিমখানার প্রতিষ্ঠাতা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা মনিরজ্জামান ইসলামাবাদী সাহেব উল্লেখযোগ্য।
উল্লেখ্য যে, এ কবরস্হানে ঝাউতলা, মোমিনরোড, জামাল খান, রহমতগঞ্জ, কদম মুবারক, আন্দরকিল্লা মহল্লার মুসলিম স্হায়ী বাসিন্দাদের কবর দেয়া হয়।

মসজিদের অতীত ও বর্তমান সম্প্রসারন
মুঘল আমলে এ মসজিদ যখন নির্মাণ করা হয়েছিল তখন ৫ কাতারের ১০০ জন মুসল্লী একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারতেন। মুসল্লী সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় পাকিস্হান আমলে তৎকালিন চট্টগ্রাম পৌরসভার চেয়ারম্যান নূর আহমেদ সাহেব এবং পরবর্তিতে চেয়ারম্যান ফজল করিম ও এলাকার ধর্মপ্রাণ মানুষের উদ্যোগে প্রথম দফা মসজিদটি সম্প্রসারণ করা হয়। পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ঢাকায় জন্ম নেয়া ইসলামপ্রেমিক ও ধার্মিক চট্টগ্রামের বিশিষ্ট শিল্পপতি মরহুম সফদর আলী এলাকার ধার্মিক বিশিষ্ট ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরা এবং ইসলামপ্রেমী এলাকাবাসীদের উদ্যোগে দ্বিতীয় দফা মসজিদটি সম্প্রসারন করা হয়। পূর্বে মুঘল আমলে নির্মিত এ মসজিদের সুন্দর ও সুউচ্চ মিনার ছিল পরে ক্রমে মুসল্লী সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মিনারটি ভেঙ্গে এ এলাকার ধর্মানুরাগী ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মরহুম হাজী জালাল আহমদ, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও মরহুম সফদর আলী সাহেবের ভাই করম আলী সাহেব এবং এলাকাবাসীদের উদ্যোগে তৃতীয় দফা মসজিদটি সম্প্রসারণ করা হয়। এ এলাকার তৎকালীন চট্টগ্রাম পৌরসভার পৌরকমিশনার মরহুম মোহাম্মদ শরীফ সাহেব বৃষ্টি অথবা রৌদ্র তাপ থেকে নিজেদের রক্ষা করে নির্বিঘ্নে মুসল্লীরা যাতে মৃত ব্যাক্তির জানাজা পড়তে পারেন সেজন্যে মসজিদের সামনে খোলা প্রাঙ্গণটির উপরে নিজের ব্যয়ে কংক্রিটের ছাদ নির্মাণ করেন।
বর্তমানে মুসল্লী সংখ্যা আরো বেড়ে যাওয়ায় এলাকার সজ্জন, ধর্মপ্রাণ ধনী ব্যক্তিরা, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন-এর প্রাক্তন মেয়র আ,জ,ম নাসিরউদ্দিন সাহেব ও ঝাউতলা, মোমিন রোড, জামাল খান, কদম মুবারক, রহমতগঞ্জ, ও আন্দরকিল্লা মহল্লা কমিটি সমিতি এবং এলাকার তৌহিদ ও রিসালাত প্রিয় জনগণের উদ্যোগে চতুর্থদফা মসজিদটি সম্প্রসারন করে দোতলা করা হয়। বর্তমানে এ মসজিদটির এ সম্প্রসারণ করায় এখানে একসাথে ১০০০ জন (এক হাজার) মুসল্লী নামাজ আদায় করতে পারেন।

ইসলামী অনুষ্ঠান পালন
এ মসজিদে প্রতিবছর ঝাউতলা, মোমিন রোড, জামাল খান, কদম মুবারক, রহমতগঞ্জ, ও আন্দরকিল্লা মহল্লা কমিটির উদ্যোগে প্রিয় নবী মুহাম্মদ মুস্তাফা(সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’র পবিত্র জন্মদিন পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মহাসমারহে পালন করা হয়। এছাড়াও বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)’র মৃত্যু দিবস ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহামও পালন করা হয়।
সে মুঘল আমল থেকেই ধর্মীয় তীর্থ কেন্দ্র হিসেবে কদম মুবারক শাহী জামে মসজিদের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। মহানবী হযরত মুহম্মদ মুস্তাফা সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজোড়া পবিত্র পদচিহ্নের শিলাখন্ড এবং আউলিয়াকূলের শিরোমণি বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ:)’র একজোড়া পবিত্র পদচিহ্নের শিলাখন্ড সবসময় পানিতে ডুবানো থাকে। মনোবাসনা পূরনের উদ্দেশ্যে এবং রোগমুক্তির আশায় অনেকেই এ পানি ভক্তি সহকারে পান করে। প্রায় প্রতিদিন অনেক নবীপ্রেমিক ও অলী প্রেমিক দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কদম মুবারক ও বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রহমতুল্লাহ আলাইহির কদম মুবারকের দর্শন লাভের আশায়।

তথ্যসসূত্র: ১. Banglapedia. ২. Wikipedia. ৩. From Portuguese fort to Kadam Mubarak Mosque: 4 of Ctg’s best hidden gems, Dhrubo Alam, Banglatribune.৪. চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের পবিত্র কদমমোবারক শাহী জামে মসজিদ ও কদমরসুল দরগাহের ইতিকথা, এডভোকেট কবির উদ্দিন আহমেদ।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সমাজ ও মানবাধিকার কর্মী।

Share:

Leave Your Comment